আমাদের পদক্ষেপ পত্রিকা
আয়োজিত এক বিশেষ ইভেন্ট - ভাষা
আমি বাংলায় গান গাই
কণ্ঠে - প্রীতম ঘোষ
ভাষা-২
গড়
আর্যতীর্থ
পাশের দেশ তো শেকড়কে ভুলে আত্মনিধনে রত,
সে তাসের দেশে আরবি খাঁচাতে মা ভারী বিব্রত
সীমান্তপাড় ফিরিয়েছে মুখ দূর অতীতের দিকে,
নাড়ি’র মা’কে সে রাখবে বাড়িতে সেরকম আশা ফিকে,
বরাকে’ও শুনি বাঙালি খেদাও, দাগিয়ে বাংলাদেশি
আ মরি ভাষাটি আজ মরমর, রাষ্ট্র ফোলান পেশি,
এই অসময়ে কে যে বাঁচাবে, ক্রমাগত বাড়ে হামলা..
সামাল সামাল..গড় খাড়া আছে স্রেফ পশ্চিম-বাংলা।
আমি জানি আজ শিশুরা পড়ছে ইংরাজি মাধ্যমে,
বাংলার বুকে পাঠক্রম ছেঁকে বাংলাই বাদ ক্রমে,
আমি জানি আজ রবীন্দ্র কাজী ক্রমশ পঠনে ব্রাত্য
‘বাংলায় পড়ে কিসসু হবে না’ , কটূক্তি জোটে মা’র তো,
যুগ ঠেলে দেয় পেছনের দিকে, নিচে যেতে ঢালু রাস্তা,
বাঙালী বাংলা জানে না তেমন, সংবাদ নয় খাস তা,
তবু এখানেই গদ্যে পদ্যে এখনো হাজার লেখনি,
যারা না লিখলে অনুযোগ আসে ‘কেন আজ কিছু লেখো নি?’
বিদ্রোহ আর প্রতিরোধ শুধু ক'টা মনভুঁইয়ে জন্মায়
এটাই নিয়ম, বাকিরা দেখে না দখলদারিতে অন্যায়,
এভাবেই চলে আবিশ্ব যত লঘুর শেকড়-সংগ্রাম
বাকিরা দিব্যি মেনে নিতে শেখে নিত্য পাওনা কম দাম,
মা-ভাষা বাসাতে কিছু লোকই রাখে মা’র মতো ভালোবেসে,
যতই কেন হোক আগ্রাসনের যুদ্ধটা একপেশে,
চর্চা ছাড়ে না, লড়াইয়ে হারে না, মন-কথা লেখে এখানেই,
রোজ বাংলায় বলে বাংলা-কে, মা দেখো তুমি একা নেই।
রফিক সালাম কমলা শচীন সীমানার দুই ধারে
অ-বাংলা চায় সেইসব নাম মুছে যাক একেবারে।
ওদিকে উর্দু আরবি বাহিনী, এদিকে হিন্দি-হুমকি
স্কুলও ইংরাজি, বাঙালিরা আর খায় বাংলার নুন কি,
শেকড় ছাড়াটা সুতরাং সোজা , ওড়া বিজাতীয় ডানাতে
খামোখা কেন বা হবে আগ্রহ রবীন্দ্র-কাজী জানাতে?
এসবের মাঝে বাংলায় আজও খোলে যে মনের জানলা,
আবেগের রেশে ভেসে বাংলায় আয়নাকে বলে সামলা,
রোজনামচায় রোজ বাংলায়, লিটল ম্যাগে যে হ্যাংলা..
তাদের বাঁচাতে মজবুত গড় হও পশ্চিম-বাংলা।
ভাষা-৩
আমার ভাষা
করুণাসিন্ধু মণ্ডল
আমার ভাষা সত্ত্বা আমার, আমার ভালোবাসা,
আমার ভাষা স্বপ্ন দেখায় নিত্যনতুন আশা।
আমার ভাষা আবেগ ভরা, গর্বে ভরে বুক,
আমার ভাষা অহংকারের, আলাপনের সুখ।
আমার ভাষায় বাঁচি আমি, আমার পরিচয়,
আমার ভাষার সুর ছন্দ হৃদয় করে জয়।
আমার ভাষা বিশ্বসেরা , সবার থেকে দামি,
আমার ভাষায় তাই তো সুখে 'মা' ডাকি আমি ।
আমার ভাষা ছড়িয়ে আছে আগত বা অতীতে,
আমার ভাষায় ভর করেছি বর্তমানের গতিতে।
আমার ভাষা প্রেম শেখায়, জাগায় আমার মেধা,
আমার ভাষার গানের কলি অমৃতময় সুধা ।
আমার পরিচয় বাঁচাতে তাই ভাষা রক্ষা করি,
আমার জীবন জড়িয়ে থাক 'একুশে ফেব্রুয়ারি'।
ভাষা-৪
বিমুগ্ধ পদ
সহিদুল ইসলাম
জমানো কান্নার বাঁধ ভেঙে ভেসে গেলে
সেই আশ্চর্য গাছের তলায় ছুটে যাই
আর কারো কান্না পায় না ভেবে
উবু হয়ে হাঁটু মুড়ে দু'হাত তুলে নিজেকে সঁপি
অথচ আকাশে মাটিতে অবিরাম বয়ে যায়
মৃত ইচ্ছার লবণাক্ত কান্নার রক্তাক্ত প্রবাহ
কেউ দেশের মধ্যে নগন্য হয়ে কাঁদতে এসেছে
কেউ মোহে পিষ্ট হয়ে মোক্ষ মরণে কেঁদেছে
কেউ কর্মহীন শূন্যতায় কেঁদে ভেজায় মাটি
ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি শুধুই ইত্যাদি
কান্নার কোনো জাত ধর্ম হয় না বলে
সকলে কান্নার ধর্মগ্ৰন্থ রচনা করতে বসে
সভা শেষে হাড় মাংস জাত ধর্ম খায় যে যেমন
সভামুখে গালি টাঙিয়ে আগুন করেছি মন
শুধু মনে হয় চাবকানো হোক ন্যাকামির গালে
এ যাবৎ যত বেলুন উড়েছে বিষ বায়ু পেটে
সব বেলুন ফাটিয়ে পাথর হয়ে গান গায়
নিজের গালে থাপ্পড় মেরে অহরহ কাঁদি
সময়ের ইস্তেহার
আনন্দ মার্জিত
ঝড়েরা
উঠেছে দিগন্ত জুড়ে , কান পেতে শোন ঝড়ের আওয়াজ, এ কার পদধ্বনি ?
উদ্বেলিত
পদভারে দীপ্ত মিছিল হাঁটে শহরের রাজপথ থেকে
কানাগলি , শপথের মশাল জ্বলে ওঠে এক চোখে যেন চিতার আগুন, আর এক চোখে বেদনার কালি রক্ত অশ্রুতে মিশে , দেখেছ কি সেই মেয়েটির মুখ?
তোমার
বিষ্ঠা ছড়ানো পথ, মিথ্যার বেড়াজালে নিমগ্ন গভীর অন্ধকার , প্রসূতি ভোরের আলোয় ওরা নির্ভয়ে হাঁটে ফণিমনসার কাঁটা বিছানো পথে, কণ্ঠে
শিকল ভাঙ্গার গান, শুনতে কি পাও?
হে
গান্ধারী! তোমার চোখের পট্টি আজ খোল , বিবস্ত্রা
পাঞ্চালি লজ্জায় অবনত , অবাধ দুঃশাসনেরা
আলকেউটের
মতো ফণা দোলায় অবিরত বিষাক্ত নিঃশ্বাসে , ভূলুণ্ঠিতা অহল্যা মা ,অপমানিত আহত সীতার
লজ্জায় ধরণী দ্বিধা, দুষ্মন্তের চোখ সাপের জিহ্বার মতো
চেটে
নেয় শকুন্তলার রূপ সেই কবে থেকে আজও। এবার
তো চোখ খোল , নাকি চোখ বন্ধ করে অন্ধ সাজবে তুমিও ধৃতরাষ্ট্রের মতো , আর কতদিন?
পাহাড়
পতনের শব্দ ,ঐ শোন, কেন
বিচারের
বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে এখনো?
"আমরা
করবো জয় নিশ্চয় একদিন। " এ সময়ের ইস্তেহার ।
ভাষার অবমাননা
গৌতম সমাজদার
নিজ
দেশের জনগণের মাতৃভাষাকে কি হারে অবমাননা ও অপমান আমরা নিজেরাই করেছি, তা পুনরায় হিসাব
করে দেখলেই বোঝা সম্ভব। এটাও ঠিক, বিশ্বায়নের এই যুগে পৃথিবী আজ আমাদের হাতের মুঠোয়।
আর তাতে নিজ ভাষা গুরুত্বহীন হয়ে উঠছে। অন্য রাজ্যে যাতায়াতের ফলে তাকে হিন্দি, ইংরাজী
ব্যবহার করতে হচ্ছে। বিনোদনের জগতেও হিন্দির আধিক্য ব্যাপক। হিন্দি সিনেমা অনেক চাকচিক্যের
মধ্য দিয়ে মাতৃভাষা ভুলিয়ে দিচ্ছে। অবাঙালি বাংলায় বসবাস করছে। হিন্দিতে কথা বললেই
আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করি হিন্দিতে উত্তর দিতে। এটা মাতৃভাষার অবহেলা, অবমাননার সামিল।
দোকানের সাইনবোর্ড, শপিং মল সব নামই ইংরাজীতে লেখা। অর্থাৎ অন্য ভাষার আগ্রাসন ক্রমবর্ধমান।
মাতৃভাষাকে এই আত্মঘাতী প্রবণতা থেকে মুক্ত হতে হবে আমাদের। কারণ নিজ ভাষার সাথে আমাদের
জড়িয়ে থাকে মূল্যবোধের শিক্ষা। এক্ষেত্রে বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি ক্ষেত্রে আরো
বেশি করে মাতৃভাষার প্রয়োগে জোর দিতে হবে। নতুন প্রজন্মকে বারবার একুশে ফেব্রুয়ারীর
ভাষা আন্দোলনের কথা গর্বের সাথে বলতে হবে। জানাতে হবে শত শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত
এই গৌরবগাথা। ভাষার ঐতিহ্য, সাহিত্য সম্ভার সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। কারণ এরাই আগামী
দিনে বাংলা গড়বে।
আমার বাংলা
অশোক মণ্ডল
আমাদের ভরসা আমাদের আশা গর্বের বাংলা ভাষা
আমাদের আনন্দ বাংলাতেই ভালোমন্দ বাংলা ভালোবাসা।
বাংলা মোদের প্রাণ বাংলা দিয়েছে মান বাংলা অহংকার
বাংলা নিয়েই বাংলাতে যেন আসি ফিরে বারবার।
বাংলা মোদের নবান্নের ঘ্রাণ বাংলা মোদের মান
বাংলাতেই মোরা গাই উচ্চ করি শির বাংলার জয়গান
বাংলা বলি বাংলাতেই চলি বাংলা যে মখমলি
বাংলা মোদের রামধনু বাংলা মোদের রঙে রাঙা হলি।
মরমে মননে তুমি আছো ওগো মোর বাংলা ভাষা
এ বিশ্ব ভুবনে তোমার খ্যাতি মোদের জাগায় আশা।
বাংলা মোদের হৃদস্পন্দন বাংলাতে ভরে মন
বাংলা নিয়ে এ বাংলাতে আনন্দ হাসিতে কাটুক জীবন।
ভাষা-৮
একুশ আসুক ফিরে
গোপাল চন্দ্র বসাক
ফিরে আসুক বারবার, একুশে ফেব্রুয়ারি
জেগে উঠুক, সমগ্র বাঙালি
প্রতিষ্ঠিত হোক, বাংলা ভাষার সত্তা
গায়ে সাঁটা স্বাভিমান বোধ
চিনিয়ে দিক্ ঠাণ্ডাঘরের শয়তানি-মুখোশ
পত্ পত্ করে উড়ে বেড়াক
আমার মায়ের মিষ্ট ধ্বনি, বাতাসে-বাতাসে
একুশের স্বপ্ন ফেরাই, স্যালুট সালাম-বরকত-রফিক-জাব্বরকে।
ভাষা-৯
আমরি মায়ের ভাষা
রমিতা মজুমদার
আজ আমি পরবো না আর সেই শাড়িখান
যাতে আছে অশ্রুজলের কথা,
পরবো আমি সেই শাড়িটি
যাতে আছে বিশ্বজয়ের গাঁথা।
আজ বাংলা ভাষা বিশ্বের দরবারে উজ্জ্বল মহিমায় বিরাজিত।
আমরা বাংলা ভাষাভাষীরা তার জন্য গর্বিত। আনন্দিত।
আমরা জানি একুশে ফেব্রুয়ারি চারজন তরুণ পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়েছিলেন মাতৃভাষার মান রক্ষা করতে বাংলাদেশের মাটিতে।
সেই থেকে ঐ দিনটি 'ভাষা দিবস' হিসাবে পরিগণিত হয়ে আসছে।
আমরা কি জানি আমাদের কাছেই আছে আসাম নামে এক রাজ্য যার ভাষা অসমীয়া।
কিন্তু আসামে পূর্ব পাকিস্তান থাকাকালে বহু বাঙালি বাস করতেন এবং আসামে বাংলা ভাষাই ছিল সরকারি ভাষা।
পড়াশোনা, অফিসের কাজকর্ম সব বাংলা ভাষায় সম্পন্ন হত।
হঠাৎ করে বদলে যেতে লাগলো সব নিয়ম।
কয়েক মাস ধরেই ভিতরে ভিতরে চলছে চাপা ক্রোধ আর অশান্তির আগুন। প্রথমে পাড়ায় তারপর গ্রামাঞ্চলে তারপর শহরে, সব জায়গায় রটে গেছে খবর-- তোমাদের মাতৃভাষা আর এখানে চলবে না। এবার এ দেশের ভাষাই হবে তোমাদের মাতৃভাষা।
বাহ বাহ। ফরমান জারি করেছে সরকার।
কিন্তু ফরমান জারি করলেই তো সব হয়ে যায় না!
যাদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চায়, তারা কি এত সহজে ছেড়ে দেবে!!!
না না না। কিছুতেই না।
তোমার ফরমান তোমার কাছেই রাখো । দেখি আমরা কি করতে পারি।
যেন এক বিশাল ঢেউ জেগেছে।ফুঁসে উঠছে। ফুলে ফুলে উঠছে প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের ঢেউ।
ছাড়বো না কিছুতেই। দেবো না সাড়া তোমার ফরমানে হে সরকার।
শুরু হলো আন্দোলন ।
সত্যাগ্রহ, অসহযোগ ইত্যাদি নীরব ভাষায়।
জেগে উঠছে গ্রাম থেকে শহর।
তরুণ তরুণী যুবা বৃদ্ধ সকলে।
মিছিল করে, প্রভাতফেরি করে গানে গানে আকাশ বাতাস মথিত করে তুলছে ছেলেমেয়েরা।
নেতারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, কোন রকম উগ্রতা নয়, কোন উচ্ছৃঙ্খলতা নয়।
কিন্তু সরকার তৎপর তার কাজে।
ছাড়ল জলকামান।
উঃ। কী জ্বালা!!! জ্বলে যাচ্ছে চোখ মুখ, সারা শরীর।
জল...জল...কোথায় আছে জল!! কেউ কেউ পুকুরে ঝাঁপ দিয়েছে। কেউ ছুটছে বাড়ির দিকে।
প্রথম দিনের পরিকল্পনা এভাবেই গেল।
তাতে কি? জ্বলুক না শরীর। তার জন্য কি মায়ের অপমান সইতে হবে!!!
অত্যাচার তুমি যত খুশি কর। কিন্তু পারবে না হে সরকার।
প্রাণ পর্যন্ত তুচ্ছ আমাদের কাছে।
পুলিশ বলছে কী সাহস বাবা ঐ ছেলেমেয়েগুলোর!!!
ফরমানের পর ফরমান জারি হচ্ছে।
সরকার নড়েচড়ে বসছে।
কিন্তু এবার যে সত্যিই আগুন লাগলো।
জাগো জাগো সকলে। আর ঘুমিয়ে থাকার সময় নেই।
আমাদের মায়ের ভাষা হরণ করতে চায়।
প্রাণ দেবো। প্রস্তুত থাকো।
জেগে উঠলো ঘরে ঘরে তরুণ তরুণী যুবক যুবতীর দল।
প্রকাশ্য রাজপথে বেরিয়ে পড়ল।
কন্ঠ ছাড়ল জোরে, "মাতৃভাষা জিন্দাবাদ।"
সকালের প্রথম রেলগাড়ি আটকাতে হবে।
করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে।
একাক্ষরী মন্ত্র 'মা' এক রক্ষা কবচ।
সরকারের তরফে বড় মন্ত্রী এসেছেন।
মিটমাট করাই উদ্দেশ্য।
কিন্তু কিসের মিটমাট!
ওরা উল্টে বলছে, আপনি জানেন না এই ভাষার মাধুর্য। কী আনন্দ। কী শান্তি এই ভাষায় কথা বলে।
চালাও গুলি।
যত পারো।
ফায়ার!! ফায়ার!!
সকাল থেকেই বেরিয়ে পড়েছে ওরা।
ভোর হওয়ার আগেই স্লোগানে স্লোগানে স্টেশনের আকাশ বাতাস ভরে উঠেছে।
কী অদ্ভুত শিহরণ।
উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছে ওরা।
রেলের লাইনের উপর শুয়ে পড়লো কয়জন। নির্ভীক দুঃসাহসী।
যারা দাঁড়িয়ে আছে তারা উদাত্ত কণ্ঠে গান গাইছে।
যাত্রীরাও এসেছে ট্রেন ধরবে বলে।
ভোর চারটের আগের মুহূর্ত।
ট্রেন এসে দাঁড়ায়নি স্টেশনে।
ট্রেনের চালক গার্ড সকলেই তো সন্তানের পিতা।
কি করে তারা সন্তানদের উপর দিয়ে গাড়ি চালাবে?
চাকরি গেলে যাক।
এই মহৎ কর্মযজ্ঞের বিরুদ্ধে তারা যেতে পারবে না।
হঠাৎ গর্জে উঠলো---গুড়ুম গুড়ুম।
পুলিশের গুলি।
আদেশ এসেছে "ফায়ার ফায়ার"।
সারা স্টেশনে চিৎকার ছোটাছুটি।
রক্তে ভেসে যাচ্ছে রেলের লাইন।
এগারো জনের তাজা রক্ত।
নদী বয়ে যাচ্ছে রক্তের।
এক মুহূর্ত আগেও যে প্রাণগুলি চলছিল, কথা বলছিল, এক লহমায় শেষ।
ওরা আর কথা বলবে না।
ওরা আর সাড়া দেবে না।
ওরা শহীদ হয়েছে।
কমলা শহীদ হয়েছে
"বিশ্বের প্রথম নারী শহীদ বাংলা ভাষার।"
ও ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছিল।
ফল বের হবার পর জানা গেল দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেছে।
হায়রে মেয়ে।!!! পড়াশোনা শিখে বিয়ে করে
সংসার করবি! না শহীদ হলি !
ওর চোখে গুলি লেগেছিল।
ছোটবোনও শিলচরের রেলস্টেশনের লাইনে শুয়ে ছিল।
হঠাৎ দিদি বলে চিৎকার করে।
দিদি কমলা উঠে দাঁড়িয়ে কিছু বলতে গিয়েছিল বোনকে।
সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের গুলি লাগে ওর চোখে। লুটিয়ে পড়ে।
ওরা আসামের শিলচর শহরের শহীদ। ১৯৬১ সালের ১৯শে মে এই ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটেছিল।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, ভাষা শহীদ বললেই এখনো অনেকে বাংলাদেশের শহীদদের কথাই বলেন।
ওঁরা তো প্রণম্য।
ভাষা-১০
আমার মায়ের মুখের ভাষা
প্রণব ঘোষ
তখন হাঁটতে শিখেছি একপা দু'পা।
টলমল টলমল। তবু শিখছি।
আর কানে কত শব্দ এসে কড়া নাড়ছে।
মুখে বোল ফুটছে আধো আধো।
আমার মা আমাকে কোলে বসিয়ে
ভাষা চেনাত, জগৎ চেনাত।
এভাবেই আস্তে আস্তে মা, বাবা, পাখি।
এভাবেই সবাইকে ডাকাডাকি।
এমনি করেই আমার অন্তরে ফুটলো
মায়ের শেখানো বুলি।
আমি পেলাম আমার মায়ের ভাষা,
আমার আজন্মের ভালোবাসা।
এখন অনেকটা বড় হয়েছি বয়সে,
এখনও আবেগ টানে আমাকে বাংলা কথনে।
এখনও কোনও পরবাসে যদি শুনি,
' শুনছ হ ? আজ তুমি কুটি যাবে বাহে '?
আমার শরীরে শিহরণ জাগে,
জাগে কম্পন মনে প্রাণে।
এখানেও আমার মায়ের ভাষা,
আমার আদরের ভালোবাসা।
সেই অজানা পথের ধারে
ছোট্ট গুমটি ঘরের ছিন্ন বসন পরা
চা দোকানি আর তার পড়শিকেও
আলিঙ্গন করতে বড় ইচ্ছে করে।
তারা যে কইছে কথা আমার ভাষায়।
আমার চেতনার স্ফুরণের দিনের
আমার মায়ের ঠোঁট থেকে নেওয়া
আমার চিরন্তন ভালোবাসা বাংলা ভাষা।
একুশে ফেব্রুয়ারি
অংশিকা রায় (ষষ্ঠ শ্রেণী)
জন্মানোর পর মায়ের মুখের প্রথম ভাষা
তা হল আমাদের মাতৃভাষা।
মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধসম
বিদেশি ভাষা কক্ষনো হয় না সম।
ভাষার জন্য বাংলাদেশ প্রথম দেখালো পথ
মাতৃভাষাকে মায়ের সম্মান দিতে নিল শপথ
আমরা কখনো কি ভুলিতে পারি
মোদের ভাষা বাংলা অমর ভাষায় সম্মানিত হোক
বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ুক একুশে ফেব্রুয়ারি।
জেগে আছি
রাহুল ঘোষ
জেনেছি নদীর জলেও তোমার ছায়া পড়ে আছে
আকাশের মতো অসীম-উদার রঙে লেগে আছে আলো।
যেভাবে তোমার গানের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে অনিবার্য মায়া
নিরুপম লাবণ্যে মোড়া কবিতাশরীর জেগে থাকে চেতনায়,
চিরস্থায়ী হয়ে সেভাবেই আছো অন্তরমহলে আমার।
প্রিয় রমণীকে 'ভালোবাসি' বলার মতো অস্থির সুখে তাই
জন্ম আর মৃত্যুর মাঝখানে জেগে আছি বাংলা ভাষায়।
ভাষা-১৩
শহীদ স্মরণে
দীপশিখা চৌধুরী
আট ফাল্গুন বুকের আগুন
তুলেছিল
যে ঝড়
দাবানল হয়ে ছড়িয়েছিল
ঢাকা থেকে
শিলচর।
বাহান্ন আর একষট্টির
যুদ্ধ
জয়ের ঘাঁটি
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো
ভাষা শহীদের মাটি।
যে মাটির বুকে আজও জেগে আছে
অমলিন
মহিমা
একুশে উনিশে ফিরে ফিরে আসে
শহীদের
গরিমা।
ব এ বাংলা বর্ণমালা
বর্ণপরিচয়
আমরা বাঙালি সগর্বে বলি
বাংলা ভাষার
জয়।
স্মরণে শপথে ভুলিনি তোমায়
চলেছে
প্রভাতফেরি
মননে চেতনায় উনিশে মে
আর একুশে
ফেব্রুয়ারি।
ভাষা-১৪
বাংলা ভাষা
দীপা কুমার
বাংলা
ভাষা তোমার চোখে আজ কেন জল?
তুমি
তো সেদিন হারিয়ে গেছো, মানুষ যেদিন তোমার সাথে করেছে ছল।
দলে
দলে ছাত্ররা চলেছে বিদেশি ভাষার কবলে।
বর্ণপরিচয়
পড়ে আছে ধুলো ধরা মলাট নিয়ে,
এখন
শিশুপাঠ্য শুরু হয় এ,বি,সি,ডি দিয়ে।
হাতে
খড়ির অ,আ পড়ে থাকে এককোণে,
ইংরেজিটা
ভালো করে শিখতে হবে মা ভাবেন মনে-মনে।
বাংলা
ভাষার তেমন তো নেই জোর,
এই
ভাষাতে পড়লে পরে জীবনে নামবে যে অন্ধকারের
ঘোর!
বাবা
বললেন এ ভাষা অবশ্যই শিখতে হবে,তা না হলে,বাবা,মা,বলে ডাকতে ভুলে যাবে।
বাংলা
ভাষা আজ কেন তোমার চোখে জল?
তোমার
সাথে শিক্ষিত মানুষই করেছে তো ছল!
কিছু
মানুষ এখনো তোমার ভাষাতেই কথা বলে,
আ
মরি বাংলা ভাষা, ওরা তো তোমার ভাষাতেই মাকে মা বলে ডাকে।
বাংলা
ভাষা মায়ের ভাষা রাখবো তোমার মান,
এই
ভাষাকেই করবো মোরা বিশ্বসেরা মহান।
বাংলা আমায় পিছিয়ে দিল
দীপক আঢ্য
তোমরা কেমন স্যুটেড বুটেড ইংরেজিতে কথা বলো,
আমি হলাম হদ্দ গেঁয়ো বাংলা আমায় পিছিয়ে দিল।
ছোটবেলায় অবৈতনিক সেখান থেকেই বাংলা গোঁতাই,
বাংলা ছেড়ে অন্য ভাষা দেখলে আমি হাঁ হয়ে যাই।
অফিস থেকে আদালতে বাংলা বললে হ্যাটা করে,
দু'চার খানা ইংরেজি বা অন্য ভাষায় তাকিয়ে থাকে।
ভাবখানা এই কেউকেটা সে আঙুল চোখে দেখিয়ে দিল,
সেসব দেখে বুঝতে পারি বাংলা আমায় পিছিয়ে দিল।
হোয়াটস অ্যাপে ফেসবুকে ভাই অবাক লাগে তাকিয়ে থাকি,
তোমরা সবাই কত্ত জানো আমিই কেবল বাংলা জানি।
বাংলায় আমার কী আছে গো, নেই শেলী,কীটস, বায়রণও,
এসব দুঃখে বাংলা নিয়ে হয়না কোনো আহ্লাদও।
তাই তোমরা যখন ২১রাতে অমর বাংলা চেঁচিয়ে বলো,
অবিশ্বাসের কানে বুঝি বাংলা আমায় পিছিয়ে দিল।
ভাষা-শহীদের ঋণ
প্রভাত কুমার মণ্ডল
মাতৃভাষার অপমানে
কি আর করি তখন?
দু-চার কথা বলতে গিয়ে
প্রত্যুত্তর বরিষণ।
দিনে দিনে ভাষার নিন্দায়
চিত্ত জড়সড়।
মাতৃভাষা বাঁচার আশা
ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর।
“বিদেশে কি বাংলা চলে?”
কবির কথায় বলি।
একুশে কি শুধুই শোনে
বাংলা গানের কলি?
একুশ সকাল প্রভাতফেরি
প্ল্যাকার্ড হাতে হাতে।
বিকেল সন্ধ্যা বাংলা স্তুতি
সুরা সেবন রাতে।
“বাংলাতে চাই বাংলা ভাষা”
প্রতিজ্ঞায় অবিচল।
চল্লিশ কিম্বা তারও অধিক
প্রাণ নিলো শত্রুদল।
সেসব এখন গল্পগাথা
স্মরণে একটি দিন।
রক্ষা করো বাংলা ভাষা
ভাষা-শহীদের ঋণ।
২১ শে ফেব্রুয়ারি
আশিস কুমার দাঁ
একুশে ফেব্রুয়ারি, রক্তে আঁকা ইতিহাস,
ভাষায় ধ্বনি-প্রতিধ্বনির নিঃশ্বাস
শাসকের কাছে নত হয়নি শব্দের সাহস,
বাংলা ভাষা এনে দিয়েছে মোদের অহঙ্কার।
একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের প্রেরণার দিন,
ভাষার মর্যাদা বাঙালি কখনো করেনা বিলীন
আমার ভাষা আমার জয়
মৌমিতা চ্যাটার্জী
সে ভাষায় শিখি মনের আলাপ,
ভুলতে পারিনা কোনো ছলে,
জন্মকালীন অক্ষরজ্ঞান,
মিশে যায় খোলা লোনা জলে।
শিরার লোহিত নদী প্রবাহে
সে ভাষার গান কথা বলে,
সে ভাষা দিয়েছে রোদ, জল, হাসি,
ভাষায় স্বপ্ন আঁখি মেলে।
ভুলতে কী পারি আগুন শেখানো
ভায়েদের সেই রুধির ঋণ,
সে ভাষা বিহনে গায় না বাউল,
জ্যোৎস্নাটুকুও চন্দনহীন।
এ ভাষায় মোরা হারতে শিখিনি,
একুশে লড়াই বৃথা তো নয়,
আকাশে, বাতাসে, ফাগুনে, আবীরে
বুকের গভীরে ভাষারই জয়।
শিল্পী - স্নেহা চক্রবর্তী
তুমি আছো বলে
গোপাল বাইন
তুমি না থাকলে আমি অন্ধ হয়ে যেতাম
এমন শরীরী সৌন্দর্য, শিল্পকলা
তুমি বর্ণে বর্ণে সাজিয়ে রেখেছ।
তুমি না থাকলে আমি বোবা হয়ে যেতাম
এত ভালোবাসা, স্নেহ মায়া জড়ানো গলায়
কোল পেতে খোকন বলে ডাকো।
তুমি না থাকলে আমি কালা হয়ে যেতাম
এমন মধুর ললিত বাঁশির সুর
মাতৃভাষা বাংলা ছাড়া আর কোথাও নেই।
তুমি আছো বলে আমি চক্ষুষ্মান
তুমি আছো বলে আমি বাঙ্ময়
তুমি আছো বলে আমি
ভাটিয়ালি বাউল রবীন্দ্র নজরুল শুনি।
ভাষা-২১
শহীদের ঋণ
দেবকুমার মুখোপাধ্যায়
ঐপারে এইপারে একই ভাষা বাংলা
অঞ্চলভেদে তার কিছু ভিন্ন রূপ,
পড়শি বেজায় ক্ষেপে ও ভাষা আমার নয়,
ভাষার চলন এ তো সযত্নে বোঝাই।
ভাষার লিখিত রূপ একই আছে যা ছিল
এপারে ওপারে তার নেই কোন ভেদ,
শাসক আসবে যাবে, শহীদের রক্ত
মুছে গেছে, শোধ হবে না তাহাদের ঋণ।
ভাষা-২২
পৃথিবীর বারান্দা মুখরিত হয়
আবদুস সালাম
উদ্বেগে উথলে ওঠে বাহু
অন্তহীন অভিসারে চুমু খায় প্রেমের পাখি
কড়া নির্দেশে মুহুর্মুহু গর্জে উঠে বুলেট
নীরব স্রোতে মেশে রক্তের ফুলকি
লুটোপুটি করে ফাগুনের রক্তমাখা ভাষা শহিদের অঙ্গীকার
মৃতময় ধূসর আল্পনা আঁকে মাতৃভূমির উঠোনে
সালাম বরকত জাব্বারেরা দেখছে বেহেশত থেকে
মাতৃভাষার ফেরেস্তারা খোঁজ করছে তাদের
স্মরণে লক্ষ পাখির কলতানে মুখর আজ পৃথিবীর বারান্দা
ভাষা-২৩
'একুশ'
ধনঞ্জয় সিংহ
'একুশ' হল মাতৃভাষার
সব মানুষের গান,
'একুশ' হল বাংলাভাষীর
বাংলা জাতির মান ।
'একুশ' হল বুকে গাঁথা
বাঙালির আত্মদান,
'একুশ' হল মনে প্রাণে
রফিক
বরকত রহমান ।
'একুশ' হল উনিশশো বাহান্নর
২১
শে ফেব্রুয়ারী
'একুশ' হল স্মরণীয় দিন
ভুলতে
কি কেউ পারি !
'একুশ' হল ভাষা দিবস
ঐতিহাসিক
কৃষ্টি,
'একুশ' হল ভাষার লড়াই
বাংলা পেল দৃষ্টি ।
ভাষা-২৪আমার ভাষা তোমার ভাষা
অভিজিৎ পানীগ্রাহী
সময়কালেই বাংলা ভাষা পৌঁছে যায়
শৈশব থেকে যৌবনে-
জনপ্রিয়তার শিখরে, বার্ধক্য নেই
যে ভাষার
চিত্রিত হয় কবির হাতে ঐ ভাষা
এ ভাষা আনে
কত পুরস্কার কত সম্মান-
এ ভাষায় শুনি পাখির কলতান
এ ভাষায় কত
মধুর বাউলের গান,
যে ভাষায় আজীবন বেঁচে থাকা
যে ভাষায় হব
আমরা আয়ুষ্মান।
ভাষা-২৫
২১শের আওয়াজ
তরুণ চ্যাটার্জী
২১ আমার গর্ব।
২১ আমার অহংকার।
একুশ যখন হুঙ্কার ছাড়ে বিশ্ব কাঁপে ভয়ে।
একুশ যখন মিছিলে হাঁটছে,
বিশ্ব হাঁটবে বলছে।
একুশ যখন শ্লোগান তুলছে,
স্বৈরাচারী কাঁপছে।
একুশ মানে বুকের রক্তে রাজপথ আজও ভাসছে।
একুশ মানে মায়ের অশ্রু পৃথিবীতে বান ডাকছে।
একুশ মানে বরকত-জব্বর আজও পথে পথে হাঁটছে।
একুশ মানে দৃপ্ত কণ্ঠে মিছিলে শ্লোগান তুলছে।
একুশে বলছে নৈতিকতা,
একুশে বলছে সাম্য,
একুশে বলছে বিভেদকামীরা হোক ধ্বংস বিশ্বে।
ভাষা-২৬
আকাশ সামিয়ানা উদযাপন
অমিতাভ
শরীর জুড়ে ক্ষত তোমার শরীর জুড়ে ঢেউ
রাত গভীরে বুকের মাটি কুপিয়ে চলে কেউ
কত ব্যথা সমস্বরে আখর ভেঙে কাঁদে
আঁক কেটেছি দেওয়াল জুড়ে চিলেকোঠার ছাদে
ফুটিফাটা বুকের মাটি দীন ভিখারী হয়ে
রন্ধ্রে রন্ধ্রে বুনো জ্বালা যাচ্ছে কেবল সয়ে
বাঁকতে বাঁকতে শিরদাঁড়াটা ধনুক আঁকা পাতা
ঝুঁকতে ঝুঁকতে মাটির সাথে মিশতে থাকে মাথা
ঠিক তখনই চিলেকোঠার আখরগুলো ভাসে
অ আ ক খ মায়ের মতো রোদ মাখিয়ে হাসে
সেই রোদেরই দারুণ তাপে সেঁকতে থাকি বুক
আমার ভাষা,বৃষ্টি আমার,আমার মায়ের মুখ
সে মুখ ভাসে নদীর জলে ভাঙতে থাকে ঢেউ
আবছায়া এই দৃষ্টি ধুতে স্রোত পাঠালো কেউ
স্বচ্ছ হয়ে একতারাটা নামিয়ে আনি হাতে
অ আ ক খ সুর লাগিয়ে গান বেঁধে যাই তাতে
গানের মাঝে রক্ত ঝরে গানের মাঝে ক্ষত
গাইতে গাইতে দুঃখগুলো ঝরা পাতার মতো
বিছিয়ে থাকে মাটির ওপর ভাঙতে থাকে ভুল
আকাশ সামিয়ানা জুড়ে মায়ের ভাষার ফুল
ভাষা-২৭
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস
মনীষা কর বাগচী
একুশে
ফেব্রুয়ারি বিশ্বের ইতিহাসে এক স্বর্ণোজ্জ্বল দিন। কোনো ভাষাকে নিয়ে এমন ভয়ঙ্কর আন্দোলন
এর আগে কোনোদিন হয়নি।
১৯৪৭
সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তানের উদ্ভব হয়। ১৯৪৮
সালে পাকিস্তান সরকার উর্দুকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেন। স্কুল ও মিডিয়াতে
উর্দু ভাষাকে মাধ্যম করা হয়। মুদ্রার নোট ও স্ট্যাম্প থেকে বাংলা মুছে ফেলা হয়। এই
অন্যায্য সিদ্ধান্তকে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ, মাতৃভাষা যাদের বাংলা, তাঁরা মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। গভীরভাবে মর্মাহত হয়ে
তাঁরা রাগে দুঃখে ফেটে পড়েন।
বাংলা
ভাষা বাঙালির প্রাণ , যে ভাষায় বাঙালি শ্বাস নেয়, গান গায়, প্রথম মা বলে ডাকে, যে ভাষায়
প্রিয় মানুষটিকে প্রেম নিবেদন করে, যে ভাষাকে সে যাপন করে সেই ভাষার অবমাননা কি করে
তাঁরা সহ্য করবে ....তাই তো প্রাণের মায়া না করে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন অসংখ্য তাজা
তরুণ প্রাণ।
১৯৫২
সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন ১৩৫৮) আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র
ও কিছু রাজনৈতিক দলের কর্মী মিছিল শুরু করেন। ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে পুলিশ নৃশংসভাবে
গুলি চালায়। গুলিতে নিহত হন তেজদ্বীপ্ত তরুণ রফিক, সালাম, বরকত-আব্দুল জব্বার সহ আরও
অনেকে। ১৭ জন ছাত্র আহত হন। ২২ ফেব্রুয়ারি নিহত হন শফিউর রহমান শফিক, রিক্সাচালক আউয়াল
এবং এক কিশোর। শহীদদের রক্তে ভেসে যায় রাজপথ। ঢাকার আকাশে বাতাসে গুঞ্জে ওঠে আক্রোশ,
জ্বলে ওঠে প্রতিবাদের আগুন। পুলিশের পাশবিক অত্যাচারে ছাত্র আন্দোলন পরিণত হয় গণ আন্দোলনে
।
ক্রমবর্ধমান
গণ আন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সরকার শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করেন। ১৯৫৪ সালের ৭ মে
মুসলিম লীগের সমর্থনে বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়।
১৯৯৯
সালে ইউনেস্কো মানুষের ভাষা ও কৃষ্টির অধিকারের সম্মান জানিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক
মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এই দিনটিকে গভীর শ্রদ্ধা ও যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে
পালন করা হয়।
২৩
ফেব্রুয়ারি শহীদ স্মৃতিকে অম্লান রাখার জন্য ঢাকা মেডিকেল হোস্টেল প্রাঙ্গনে রাতারাতি
ছাত্ররা গড়ে তোলেন শহীদ মিনার। ২৪ ফেব্রুয়ারি এটার উদ্বোধন করেন শহীদ শফিউর রহমানের
পিতা। পরে ২৬ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেন দৈনিক আজাদ পত্রিকার
সম্পাদক জনাব আবুল কালাম সামসুদ্দিন।
ভারতবর্ষেও
অনেক বার মাতৃভাষার অধিকার আদায়ে বাঙালি জনগোষ্ঠী আন্দোলন করেছেন বা এখনও করছেন।প্রথম
বাংলাভাষার জন্য আন্দোলন হয় মানভূমে ১৯১২ সালে। আসাম সরকার যখন অসমীয়া ভাষাকে রাজ্যের
একমাত্র দাপ্তরিক ভাষা করার সিদ্ধান্ত নেন তখন সেই অঞ্চলের বাংলাভাষী জনগণ ভাষা আন্দোলন
করেন । ১৯৬১ সালের ১৯ মে ১১ জন প্রতিবাদীকে শিলচর স্টেশনে প্রাদেশিক পুলিশ গুলি করে
হত্যা করে। ভারতবর্ষের ইতিহাসে এটা একটা চরমতম নিন্দনীয় ঘটনা। এরপর আরও তিনজন ভাষা
আন্দোলনকারীর হত্যা হয় বিভিন্ন সময়ে। এখনও ঝাড়খণ্ড, বিহার, ছত্রিশগড়,কর্ণাটক ও দিল্লিতে
বাঙালি মাতৃভাষার দাবিতে লড়াই করে চলেছে।
বিভিন্ন
সময়ে যে ভাষাকে নিয়ে এত আন্দোলন, এত রক্ত গঙ্গা বয়ে যাওয়া, সেই ভাষার কি সঠিক মূল্যায়ন
হচ্ছে? সেই ভাষার যোগ্য সম্মান কি আমরা বাঙালিরা দিচ্ছি? মনে হয় না। আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের
সঙ্গেই বাংলা ভাষায় কথা বলতে দ্বিধাবোধ করছি। বাংলায় কথা বলাটা যেন লজ্জার বিষয়। হিন্দিতে
কথা বলতে হবে, ইংলিশে কথা বলতে হবে, না হলে সমাজে সম্মান পাওয়া যাবে না,অনেক বাঙালির
এটা বদ্ধমূল ধারণা। বাংলা বই পড়তে চায় না অনেকেই। বাংলাটা এখন আর তেমন পড়া হয়ে ওঠে
না - অনেকের মুখে শুনেছি।
যে
সব মানুষগুলি এই ভাষার জন্য নির্দ্বিধায় নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিলেন, তাঁদের যদি সত্যিকারের
শ্রদ্ধা জানাতে চাই তবে সর্বপ্রথম বাংলাভাষাকে ভালোবাসতে হবে । বাংলাভাষার প্রতি শ্রদ্ধা
রাখতে হবে।
বাংলাভাষার জন্য অকাতরে প্রাণ দিয়েছেন যাঁরা, তাঁদের
জন্য রইল শতকোটি প্রণাম।
ভাষা-২৮
বাংলা গান
পিয়ালী ভট্টাচার্য
ভাবছো বুঝি হারিয়ে যাবে
নতুন নতুন শব্দতোড়ে!
বাংলা ভাষা থাকবে জেনো
নিজের নামে নিজের জোরে।
যে ভাষাতে মাকে ডাকি
কণ্ঠে ওঠে গান -
হাজার প্রাণের বিনিময়ে
মা পেলো সম্মান ।
দুই বাংলার রক্ষাকবচ
একই মায়ের ভাষা
বিবিধতার ঐশ্বর্যে
দেখায় আলো-আশা।
রফিক জব্বার বরকত সালাম
দিয়েছিল প্রাণ
রক্তে রাঙা এই মাটিতে
গাইছি বাংলা গান।
বিশ্ব জুড়ে পেল মানুষ
মাতৃভাষার দিবস
মায়ের ভাষা করলে লালন
পাবে প্রেমের পরশ।
ভাষা-২৯
মাতৃভাষা
কালীপদ চক্রবর্ত্তী
মা আমাদের যত্ন করে শেখালেন যে ভাষা,
সে ভাষাকে নিয়ে মোদের অনেকে গর্ব, আশা।
বহু পুণ্যে পেলাম মাগো বাংলা মায়ের কোল,
সহজ করে তাই শিখেছি বাংলা মায়ের বোল।
হাওয়ার মধ্যে আজও শুনি বাংলা ভাষার সুর,
বাংলাভাষী পাখির গানে দুঃখ যে হয় দূর।
আমার গ্রামের নরেন বাউল আজও গায় সেই গান
যে গানেতে ঘুম ভাঙত জুড়াত মোর প্রাণ।
ভাষা-৩০
ভাষার খিচুড়ি
সুজন দাশ
আজ বাঙালি মুখে
ইংরেজি কয় সুখে!
বিশেষত নিজের পরিবেশে,
লজ্জা লাগে ভেবে
কেউ কি জবাব দেবে?
কোন চেতনায় যাচ্ছে ওরা ভেসে!
একুশ এলেই ওরা
হাতে ফুলের তোড়া
মাতৃভাষার মাতেও গুণগানে,
তারপরে যায় ভুলে
আঘাত করে মূলে!
যথারীতি ইংরেজিটাই টানে।
হায় কী জ্ঞানের চাষা!
মিশিয়ে দুই ভাষা
জাহির করে আপনাকে বেশ খুলে,
সবার নজর কাড়ে
জ্ঞানীও কয় তারে!
ভাষার দাবি একুশ রাখে তুলে।
======================================
একুশ এলেই বাংলা বলি
দীপক আঢ্য
গুডমর্নিং-এ
দিনের শুরু, গুডনাইটে ঘুমে ঢুলি
সারাবছর ককটেলে ভাই, একুশ এলেই বাংলা বলি
বার্থডে কিম্বা অ্যানিভার্সারি, সেলিব্রেশনে মাতোয়ারা
ক্লিশে কেমন বাংলাগুলো, আজকে তারা বাস্তুহারা
উত্তমে নেই সুচিত্রাও না, আমার এখন লিওনার্দো-কেট্
হল্লাবোলে বাতি নেভায়, মাখামাখি পেস্ট্রি-কেক
বাংলা কোথায় ঘরের ভিতর, ইংরেজিতে ঠাসা বুলি
পথেঘাটে ইংরেজিতেই, একুশ এলে বাংলা বলি
লনটেনিসে মুগ্ধ
চোখে, উইলিয়ামসদের খেলা দেখি
হারিয়ে গেছে হাডুডু, ড্যাংগুলি আর কাচের গুলি
পূর্ণদাসকে আর শুনিনা, বব ডিলানে মজে গেছি
না সত্যজিৎ, মৃণাল সেন-এ, স্পিলবার্গের ফ্যান হয়েছি
মোবাইলে পিএনপিসি, স্টেটাস দিই ইংরেজিতে
প্রোফাইলে বদলে গেছি, বদলে গেছে জন্মভিটে
সারাবছর ভাবনা জুড়ে, ভিনদেশেরই অলিগলি
পাছে তোমরা ছিছি করো, তাই একুশ এলেই বাংলা বলি।
ভাষা-৩২
বাংলা ভাষা: সেই সময়, এই সময়
বন্দনা সেনগুপ্ত
আন্তর্জাতিক
ভাষা দিবস এসে গেল। প্রতি বছরই এই সময় দুটো জিনিস লক্ষ্য করি। একটি হচ্ছে ভাষা শহীদদের
প্রতি সম্মান প্রদর্শন। এটা আমার খুব ভালো লাগে। তাঁরা নিজেদের জীবন দিয়ে নিজের মাতৃভাষার
অধিকার আদায় করেছেন, তার সম্মান প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁদের সংগ্রাম এতটাই কার্যকরী
ছিল যে, সারা পৃথিবীতেই সব মাতৃভাষার সাধকেরা এই দিনটি শ্রদ্ধা ও সম্মানের সঙ্গে পালন
করেন। তাঁদের আমি প্রণাম জানাই।
যা
ভালো লাগে না সেটা হল অন্য ভাষা, বিশেষত ইংরেজির প্রতি বিদ্বেষ। যদিও বুঝতে পারি যে
তার জন্য যথেষ্ট কারণও রয়েছে।
কিছুদিন
আগে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মহাশয়ের 'সেই সময়' বইটি পড়ছিলাম। যাঁরা পড়েছেন, জানেন
যে ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলা ভাষাকে বিশেষ একটা সম্মান করা হত না। বলা হত চাকর বাকরের
ভাষা। আর, অভিজাত শিক্ষিত সমাজ কথা বলবেন মিশ্র ভাষায়, “দেন তুমি কি থিঙ্ক করচ” জাতীয়
ভাষা।
তারপর
অবশ্য মাইকেল মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ইত্যাদি অনেকের হাত ধরে বাংলা ভাষা
আজকের যুগে এসে পৌঁছেছে।
যে
কোনো ভাষার মূল গতিশক্তি হল তার স্রোত, তার পরিবর্তনশীলতা। সব ভাষার থেকে শব্দ, সৌন্দর্য
আহরণ করেই তাকে বহমান থাকতে হয়। নাহলেই সে প্রাচীনতার বেড়াজালের পাঁকে পথ হারাবে।
বাংলা ভাষাও এর ব্যতিক্রম নয়। শব্দকোষের সুপ্রচুর তৎসম তদ্ভব শব্দই এর প্রমাণ। অনেক
ভাষার কিছু শব্দ তো বাংলায় তার অর্থ পর্যন্ত পরিবর্তন করে ফেলেছে।
এ
তো গেল বিবর্তনের কথা। এবার আসি এই সময়ের বাংলা ভাষার কথায়। এখন এই সোস্যাল মিডিয়ার
যুগে ভাষার খুব দ্রুত পরিবর্তন হতে পারে। হচ্ছেও।
এখন
অনেক লেখক উঠে আসছেন। হয়ত বই না করে শুধু ফেসবুক এবং ওই জাতীয় প্ল্যাটফর্মে লিখছেন।
বা, এখন যে সব নতুন নতুন সংকলন বার হচ্ছে, সেখানে লিখছেন। এই অনলাইনের যুগে কেনার বা
রাখার সমস্যা না থাকায় নিঃসন্দেহে পাঠক সংখ্যাও অনেক বেড়েছে। আবার অনেক পাঠক তাঁদের
সুচিন্তিত মতামত দিয়ে এই সব নবীন লেখকদের উৎসাহিত করছেন। যাঁরা শুধু ট্রোল করতে ভালোবাসেন,
আমি তাঁদের উল্লেখযোগ্য বলে মনে করছি না।
আমি
জন্মাবধি প্রবাসী বাঙালি। কাজেই বিভিন্ন ভাষার মিশ্রণ দেখে, শুনে ও করে বড় হয়েছি।
তাই মুঠোফোন বা মুখবই ব্যবহার না করে মোবাইল বা ফেসবুক বলতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করি। লেখক
যখন থ্রিলার বইয়ে ক্রাইম, ভিকটিম, ক্রিমিনাল সাইকোলজি জাতীয় শব্দবন্ধ ব্যবহার করেন,
অসুবিধা হয় না। তাহলেও হার্দিক অভিনন্দন বা ভয়ের বাতাবরণ জাতীয় কথা শুনে প্রথম প্রথম
অবাক হই নি, এমন নয়।
অনেকেই
নিজের বা ফোনের অসুবিধার জন্য বাংলা কিবোর্ড ব্যবহার করতে পারেন না। ইংরেজি অক্ষরে
বাংলা লেখেন। আমি তাতে অসুবিধা দেখি না। অবশ্য, আমি “tmi ekhn kmn a66a” জাতীয় টাইপিংয়ের কথা বলছি
না। এই জাতীয় সুবিধা এবং (অ)সুবিধাগুলি মূলত সোস্যাল মিডিয়া এবং স্মার্টফোনের অবদান।
আর
একটা সমস্যার কথা একুশে ফেব্রুয়ারির আগে পরে প্রত্যেক বছর উঠে আসে। সেটা হল যে আজকের
বাবা মা তাঁদের সন্তানদের যথেষ্ট বাংলা শেখান না। দিদিমা ঠাকুমার বাংলা গল্প তাঁদের
কাছে ব্রাত্য। রবীন্দ্রনাথও সম্ভবত তাঁরা অনুবাদে পড়েন অথবা পড়েনই না ইত্যাদি।
এই
প্রসঙ্গে সবিনয়ে কয়েকটি কথা বলতে চাই।
বাংলার
বাইরের কথা বাদই দিচ্ছি, যাঁরা কলকাতা বা অনুরূপ বড় শহরে থাকেন এবং ইংরেজি মাধ্যমে
পড়ানোর উপায় আছে, তাঁদের কজন শুধু ভালোবেসে ছেলে মেয়েকে বাংলা মিডিয়ামে পড়াচ্ছেন?
শুধু সাহিত্য নিয়ে পড়তে বা সাহিত্যকেই পেশা করতে উৎসাহ দিচ্ছেন? কেউ নেই, এমন নয়।
কিন্তু, তাঁদের সংখ্যা খুব কম। কেন জিজ্ঞেস করার দরকার নেই। আমরা সব মা বাবা চাই যে
আমার সন্তান যেন আমার থেকে একটু বেশি ভাল থাকে। আর, বেশিরভাগ পেশাগত শিক্ষার জন্য ইংরেজি
জানা অত্যন্ত প্রয়োজন। এই সমস্ত মা বাবা, যাঁরা আজ ছেলে মেয়েকে ইংরেজি শেখার জন্য
বাধ্য করছেন, তাঁদের অনেকেই কিন্তু গ্রামগঞ্জ থেকে, বাংলা মিডিয়াম থেকে উঠে এসেছেন।
তাই তাঁরা জানেন যে তাঁদের স্বল্প ইংরেজি জ্ঞান নিয়ে উঠে আসতে কত রাত জেগে কত লড়াই
করতে হয়েছে। তাই তাঁদের বেশিরভাগই বাড়িতেও ছেলে মেয়েদের সঙ্গে ইংরেজি, এখন হিন্দিতেও
কথা বলেন। গান, সাহিত্য, পার্টি, সর্বত্রই তাঁরা এই ধারাটি বজায় রাখেন।
এবং
এটা করতে গিয়ে অনেকেই যে মাত্রা ছাড়াচ্ছেন, সেটাও সত্যি। তাঁরা গর্বের সঙ্গে বলেন
“আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না”।
আবার,
আধুনিক পড়াশুনা, টিউশন, নাচ, গান, ক্যারাটে, সাঁতার ইত্যাদি সামলে অপ্রয়োজনীয় বাংলার
জন্য সময় বার করাও এই সব বাচ্চাদের জন্য বেশ চাপের।
এখানেই
সমস্যার মূল শিকড় বলে আমার মনে হয়।
মাতৃভাষা,
আমার ভালোবাসার ভাষা। আমার মনের ভাষা। সেই ভাষায় আমি ভাবি, স্বপ্ন দেখি। এই বোধটি
যদি ছোটবেলাতেই হয়, তাহলে বাংলা লিখতে পড়তে বলতে কোনও সমস্যাই হবে না। ছোটরা হ্যারি
পটার, ড্যান ব্রাউন পড়ুক না, সঙ্গে ঠাকুমা দিদিমার কাছে ঠাকুরমার ঝুলি, দক্ষিণারঞ্জন,
সুকুমার, রবীন্দ্রনাথও পড়ুক, শুনুক। শুধু পুরোনো দিনের লেখকই বা কেন! একজন লেখক আমাদের
ছোটবেলার লালকমল নীলকমলের গল্পের কি চমৎকার বিনির্মাণ করেছেন। হ্যারি পটারের থেকে একটুও
কম রোমাঞ্চকর নয়। কি সুন্দর সুন্দর ছড়া ও আবৃত্তিযোগ্য কবিতার বই আসছে। ওরা পড়ুক,
শুনুক, আবৃত্তি করুক।
অনেকেই
করছেও! অনেক ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশুনা করলেও বাংলা গল্প, কবিতা,
ছড়া লিখছে। সুন্দর এবং উন্নত মানের লেখা। গত বছর বইমেলায় একটি ক্লাস সিক্সের মেয়ের
নিজের লেখা গল্পের বই বেরিয়েছে। অনেকেই বাংলায় গান করে, নাটকে অভিনয় করে।
তাই
বলছি হতাশ হবার কিছু নেই। এদের উৎসাহ দিতে হবে। তাহলেই বাংলা ভাষার স্রোত বহমান থাকবে।
ভাষা-৩৩
ভাষার কলতান
অয়ন মণ্ডল
ভাষা!
যা হল বিচিত্র কণ্ঠস্বর
পূর্ব থেকে পশ্চিম, উত্তর থেকে দক্ষিণ
শব্দের একটা ক্যানভাস। মুখের ঐকতান।
ভাষা!
প্রতিটি শব্দগুচ্ছের মাধ্যমে এক সংস্কৃতির প্রকাশ।
ভাষা!
একটি ইতিহাস, একটি ঐতিহ্য,
একটি সিলমোহরহীন গল্প।
এটি একটি দৃষ্টিকোণ , একটি আন্তঃ দৃষ্টি
এটি এমনই এক অনুভূতি, যা হৃদয়ে ধ্বনিত হয় ।
ভাষা!
একটি বন্ধন যা সীমানা অতিক্রম করে,
কিন্তু ভালোবাসাকে রাখে অক্ষত ।
ভাষার বৈচিত্র্যই হল
বৃহৎ পরিসরে সৌন্দর্যকে আলিঙ্গন করা।
ভাষা-৩৪
আমি সেই বাংলা ভাষা
সঞ্জয় বৈরাগ্য
আমি সেই মধুর ভাষা,
যে ভাষা শিশুর মুখে প্রথম বুলি ফোটায়
আজও ভাসে অমর 'একুশ'-এর ভালোবাসায়।
এই বাংলাতেই জন্মেছে জীবনানন্দ, জসীমউদ্দীন
রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এই ভাষাতেই কাটিয়েছে স্বপ্নের দিন।
আমি সেই গর্বের ভাষা,
যে ভাষাতে গায় ভাটিয়ালি সুরে জীবনের জয়গান
ঐ গ্রাম্য পথে বাউলের একতারা পায় প্রাণ।
এই বাংলা আমার মাতৃভাষা, বাংলা মোদের প্রাণ,
বাংলা আমার জন্মভূমি, রাখবো বাংলা ভাষার মান।
আমিই সেই প্রাণের ভাষা,
যে ভাষায়, প্রার্থনা ও বাগদেবীর আরাধনা করি
অ-আ-ক-খ --- এই ভাষাতেই প্রথম হাতেখড়ি।
কত শহীদের রক্তে রাঙানো ১৯৫২-র সেই ২১শে ফেব্রুয়ারী,
আমরা কি কখনও ভুলতে পারি ...!
ভাষা-৩৫
২১শে ফেব্রুয়ারী
দেবযানী ঘোষ
টলমল
পায়ে নিকানো মাটির দেওয়াল ধরে প্রথম অস্ফূট বুলি, প্রথম মাতৃসম্বোধন-- সে তোমার দান।
সদ্যজাত পক্ষীশাবকের থিরথিরে ছোঁয়ায় শিহরিত নির্ভরতার ঘ্রাণ-- সেও শুধু তুমি ছিলে
বলে।
কাউকে
কাছে পাওয়ার দূর্নিবার টান-- কাউকে না পাওয়ার কলস্বন
বেদনা
যখন উঠে আসে হৃদয়ের গভীরতম কূপগর্ভ থেকে, তখনো
দু'দণ্ড
শয্যা পেতেছি তোমার বুকে --- তুমি যে আমার প্রথম দোসর।
আমার
প্রথম প্রেম, আদ্যিকালের খেলার সাথী, আমার জিহ্বাতে প্রথম মাতৃস্তনের আস্বাদন, মায়ের
আঁচলের অবাধ্য লুকোচুরি, বাবার হাত ধরে জীবনের রেলগাড়িতে চেপে বসা আর আত্মজের আলিঙ্গন----
সব সব তুমি। তুমিই তো সেই মন্দির প্রাঙ্গনের বুড়ো অশ্বথ---- আমার জীবনের সব ক্লীবতা,
মননের সব
পঙ্গুত্বের
হলাহল শুষে নিয়ে দিয়েছ জীয়নকাঠি।
আ
মরি বাংলাভাষা! আ মরি একুশে ফেব্রুয়ারী! আ মরি তোমার যুযুধান বীর সন্তান।
বরকত,
জাব্বার, রফিকুদ্দিন, সালাম, রক্তের আল্পনায় বরণ করেছে ভাষামাতৃকাকে।
কুর্ণিশ
সেই আবুল বরকতকে, বুকচেরা রক্ত দিয়ে সাজিয়েছিল
তোমার
বরণডালা!, দানবকে বুঝিয়েছিল মানবের ভাষা।
বৃথা
হয়নি সেই লহু। সে বেঁচে আছে গাজীপুর, টাঙ্গাইলের এলায়িত ধানক্ষেতে। বেঁচে আছে বুড়িগঙ্গার
প্রতিটি ঢেউয়ের মুকুট হয়ে।
আ
মরি বাংলাভাষা,আ মরি প্রাণের ভাষা।
ভাষা-৩৬
সোনার বাংলা
সৌরভ ঘোষ
দেশের ভেতর মেঘ,
মেঘের কুলে মনের আনন্দে ভেসে বেড়াই
মাঝেমাঝে কুড়িয়ে পাই প্রশান্ত সৌভাগ্য।
খুশির ঢেউ বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে
অনেকগুলো আমি নিরন্তর দাঁড় টানি,
মাতৃভাষায় আদান প্রদান করি আসন্ন সংকট।
আমাদের ডাক-নৌকোর নাম সোনার বাংলা...
মাঝেমাঝে সীমানা থেকে উঠে আসে প্রকাণ্ড প্রলয়
ভেঙে যায় মেঘ-বৃক্ষ, বাসা হারায় দেশ গড়ার স্বপ্ন।
গালে হাত দিয়ে যখন আগামী চিন্তামগ্ন, ঠিক তখনই
পাতাল ফুঁড়ে আবার ভেসে ওঠে মাস্তুল, সোনার বাংলা...
আমরা মেঘের কোলে রোদ হয়ে জোট বাঁধতেই
ঢেউ ফিরে ফিরে যায়,
এবার হয়ত অন্য কোথাও, অন্য কোনো নৌকাডুবি...
ভাষা-৩৭
বাবলা গ্রামের সেই ছেলেটি
শান্তনু গঙ্গারিডি
মাঠ ঘাট সব সবুজ বরণ আকাশ বাতাস রঙিলা পাখি,
গ্রীষ্মের পর বৃষ্টি শেষের রামধনুকের সাতটি রাখি।
নদীর জলের কলধ্বনি জলায় হাঁস ও কলমি শাপলা,
আর দশটি গাঁয়ের মতো এই সে সজীব গ্রাম বাবলা।
দিঘির জলে ছিপ ফেলেছে ডাগর চোখের শান্ত ছেলে
শ্যামল বরণ দিঘল শরীর ডুব সাঁতারে দারুণ খেলে।
সবার প্রিয় আবাই ভায়া নাম তার আবুল বরকতও,
আম বাগানে জাম বাগানে দুষ্টুমি আর হরকতও।
বেশ তো ছিল সবাই মিলে হাসি খুশি হট্টগোলে—
স্বাধীনতার লড়াই ছেড়ে বিভেদ দাঙ্গা মাথা তোলে।
দেশটা ভাঙে কালনেমিরা নিজের ঝোলায় মধুর চাক,
গভীর সে এক চক্রান্ত; নয় কাকতালীয় বা ইত্তেফাক।
র্যাডক্লিফ লাইন বঙ্গদেহে পুঁতলো কাঁটা তারের বেড়া
এপার থেকে ওপারে যায় শফিউর আর বরকতেরা।
বাস্তুহারা দলের ভিড়ে হিতেশ চণ্ডী কুমুদ কানাই;
কুশিয়ারা বরাক কূলে বাংলাভাষা ষোলো আনাই।
ওপার এপার ছাড়াছাড়ি, বিভেদ তো নেই মুখের বুলির,
বাঁটোয়ারা এপার ওপার, আকাশ অপার একই তুলির।
অদল বদল গৃহহারা বাবু মিয়া মজুর চাষা—
ছন্নছাড়া হবার পড়েও ছাড়ছে না তো মুখের ভাষা।
ছাড়তে জবান দিচ্ছে হুকুম, উচ্ছন্নে যাক ফতোয়ারা,
পুব বাংলায় আম জনতা মাতৃভাষায় মাতোয়ারা।
ঢাকার পথে রফিক সালাম সঙ্গে জব্বার বরকতও,
রুখবি শাসক ভাষার মিছিল, ছুঁড়বি বুলেট? ছোড় কত!
বাহান্নর সেই আগুন ঝরা আন্দোলনের সব আগে
বাবলা গ্রামের আবাই নামক শান্ত ছেলেও রাত জাগে।
পোস্টারেতে ঢাকলো শহর হাজার যুবক মিছিলে,
আবুল তুমি আজ সেনানী বাবলা গাঁয়ের সেই ছেলে।
মুখের জবান ছাড়বে না তাই লক্ষ মানুষ হরতালে
বাংলা গানে আর কবিতায় পা মেলানো কর-তালে।
টিয়ার-গ্যাসে ভরলো বাতাস ছুটে আসে ঝাঁক বুলেট
মাথায় গুলি রফিক বন্ধুর বুলেট বিদ্ধ আবাইর পেট।
রফিক সালাম জব্বারেরা ভাসিয়ে দিল শাহি দম্ভ;
বরকতের সেই দীঘল দেহ আকাশলঙ্ঘী বাতিস্তম্ভ।
ভুলবে না কেউ, ভুলবো না গো, ফেব্রুয়ারির রাত্রিদিন,
মুখের জবান রক্ষা করে শোধব রে ভাই মাতৃঋণ।
ভাষা-৩৮
আমার প্রিয় বাংলা ভাষা
প্রশান্ত পাল
ভাষার জন্য নেই কোন যুক্তি;
আছে শুধুই আপন কণ্ঠের ভক্তি।
তাই ভাষার জন্য নেই তো কোন সংজ্ঞা,
দেওয়াও কঠিন ভাষার আত্মসংজ্ঞা।
ভাষার সংজ্ঞাকে সঠিক প্রয়োগ কর,
বাক্ যন্ত্রের মাধ্যমে তুলে ধর।
ভাবপ্রকাশে সক্ষম অর্থবহ ধ্বনি,
সকলেই তা কর্ণগোচরে শুনি।
ভিন্ন রূপে আছে ভাষা আমাদের মাঝে,
লিখিত-মৌখিক, ব্যক্তি-কৃত্রিম,
সামাজিক-আঞ্চলিক সাজে।
সেই ভাষা প্রয়োগে রইব না তো লাজে,
স্বমহিমায় সগৌরবে অন্তরে তা বিরাজে। ।
নানা দেশের নানা ভাষা-আদি সংস্কৃত ভাষা,
বাংলা অভিধান ছাড়া তা বুঝি- করিনা আশা।
ভাষা বিনিময়ের জন্য আন্তর্জাতিক ভাষা,
তারই মাঝে আমার প্রিয় বাংলা--
আমার মাতৃভাষা।।
বাংলা ভাষার দাবিতে চলল মিছিল বাংলাদেশে,
দমন করতে নেমে গেল খান সেনারা এসে।
চালালো নানা দমন পীড়ন অত্যাচার আর বন্দুকের গুলি,
কেড়ে নিল কত শত প্রাণ আর বরকত-সালাম-রফিক-জব্বার বুলি।
অবশেষে ইউনেস্কো দিল বাংলা
ভাষাকে আন্তর্জাতিক সম্মান,
বাংলা ভাষা ফিরে পেল তার
মর্যাদা ও মান।
ভাষা-৩৯
ভাই
তুহিন সেন
এপার বাংলা, ওপার বাংলা,
বাঙালি আছে যত্র তত্র,
পৃথিবীতে বাঙালি আছে,
দেখতে পাই সর্বত্র,
আগরতলায় বাংলায় বলে,
শিলচরেতেও তাই,
যে যেখানে বাংলায় কথা বলে,
সেই আমার ভাই,
হোক সে হিন্দু,
হোক মুসলমান,
হোক বা খ্রিস্টান
ভাই বলে তাকে ডাকি,
করি বাংলার জয়গান।
ভাষা-৪০
ভাষা ভুলেছি
অগ্নিমিত্র
ও আমার মনের ভাষা,
তোমায় ভুলেছি আমি।
তুমি আজ ' হিন্দলা' হয়ে
হয়েছ যে নামীদামী।
'লাফড়া' করে বাঙালি আজ;
ঝগড়া করে না...
'হাতাপাই' করে সবাই,
মারপিটে পড়ে না ।
ডান-বাঁ বুঝতে না পারে;
'লেফ্ট, রাইট' করে...
বাঙালি বলে আবার তারা
বেজায় বড়াই করে ।
ভাষা দিবসে বাংলা ভাষা
মনের ভিতরে যাক...
প্রাণের ভাষায় নাড়ির টান
আবার বজায় থাক ।
ভাষা-৪১
মিৎসু ডাট্
কুণালকান্তি দে
বৃদ্ধা
অনর্গল বকে চলেছেন, 'বাংলাভাষা' 'চাকুরী' এম. এ পাশের সার্টিফিকেট সব শেষ। বৃদ্ধ স্বামী
মাঝে মাঝে সামাল দিচ্ছেন স্ত্রীকে। সম্ভ্রান্ত চেহারা দুজনেরই। এই করুণ দৃশ্যে সকলের
সঙ্গে আমিও হতবাক। তবে কি বৃদ্ধার মাথায় গোলমাল আছে কিছু? ইশারায় আমাকে ডাকলেন বাংলাদেশ
হাই কমিশনের সচিব বকুল।
এক
লহমায় সমস্ত সার্টিফিকেট ছিঁড়ে ফেললো অনন্ত। আর্তনাদ করে বললো স্ত্রী মিনতি, ''এ তুমি
কি সর্বনাশ করলে? পাগল হয়ে গেলে নাকি?'' রাগে দুঃখে হতাশায় ঝোড়ো কাকের মতো চেহারা অনন্তর।
মিনতির মুখ নীল।
লন্ডনে
বাংলাদেশ হাইকমিশন অফিসে চাকরি পেয়েছে অনন্ত। মিনতি তখন ঢাকায়। একটা ভালো চাকরির জন্য
চেষ্টা চালাচ্ছে। মুহূর্তে সার্টিফিকেটগুলো ছিঁড়ে দেওয়া মানে এ জীবনেই সম্ভবত আর চাকরি
হবে না। আত্মীয় বন্ধুবান্ধবদের কি বলবে? অনন্ত সচেতন দায়িত্বশীল হয়েও কেন এ কাজ করলো?
মিনতি কিছুই ভেবে পায় না। ভীষণ ক্ষুব্ধ। উচ্চশিক্ষিতা, সুন্দরী, আধুনিকা মিনতি নিজেকে
গড়ে তুলেছে পাশ্চাত্যের ভাবধারায়। আজ সব শেষ। গতকাল লন্ডন থেকে ঢাকায় ফিরেই আজ অনন্ত
এই দুর্ঘটনা ঘটালো। কাঁদতে গিয়েও পারলো না। শুধু স্তব্ধ মৌন হয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে
রইলো অনন্তর দিকে।
পরক্ষণেই
অনন্ত উঠেছিল, আমি স্বীকার করি চোস্ত ইংরেজী না বললে মানমর্যাদা-সম্মান কিছুই জুটবে
না। তাই বলে মাতৃদুগ্ধের মতো মাতৃভাষা ভুলে যেতে হবে। সরকারি অফিসারের স্ত্রী হয়ে তুমি
সরকারি ভাষাকে অপমান করে যাবে? এই ভাষাকে মর্যাদা দিতে সালাম, রফিক বরকত জাব্বার প্রাণ
দিয়েছে। সেই দেশের সার্থক উত্তরসূরী তোমরা? তোমরা কলঙ্ক। দৈনিক কাগজে দেখলাম মিনতি
দত্ত নাম বদলে মিৎসু ডাট্ হয়েছ; এফিডেবিট করে। একটুও লজ্জা হল না? ধিক তোমার শিক্ষা।
এতক্ষণ
অবাক হয়ে শুনছিলাম। এত যুগ পরে বৃদ্ধ বৃদ্ধার অতীত ইতিহাস। মিনতি দেবী সেই থেকে আঘাত
পেয়ে মানসিকভাবে অপ্রকৃতিস্থ। বৃদ্ধ অনন্ত দত্ত স্ত্রী মিনতি দেবীকে নিয়ে প্রতিবছর
এই ফেব্রুয়ারী মাসটা বাংলাদেশ হাইকমিশন অফিসের চাতালে বসে কাটান সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত।
প্রায়শ্চিত্ত করতে। একুশে ফেব্রুয়ারী ভাষা দিবসের সমস্ত রাত জেগে কাটান। দূরে শহীদ
বেদীর প্রাঙ্গনে। চোস্ত ইংরেজী জানা লোকটা বাংলায় কথা বলেন ফেব্রুয়ারী মাসটা।
বক্তার
চোখে জল। কণ্ঠস্বর ভারি হয়ে এল। বক্তা বাংলাদেশ হাইকমিশন অফিসের পদস্থ অফিসার বললেন,
আমি দত্ত পরিবারের একমাত্র বংশধর।
*********
আমার
মনটা কেমন টানটান হয়ে গেল। বাংলাভাষার জন্য এতটা না করলেই কি হত না? আমি কি পিছিয়ে
যাচ্ছি মাতৃভাষার আঁতুরঘর থেকে?
ভাষা-৪২
গ্লানি
স্বরূপ ভঞ্জ
"এই বাংলাই আজ বাংলা ভাষার বধ্যভূমি,
বাঙালি নিজেই তার হন্তারক...''
ভাষা দিবসের সুসজ্জিত মঞ্চে
সুদীর্ঘ, সুতীব্র জ্বালাময়ী বক্তৃতায়
এসব কথাই বললেন বিদগ্ধ লেখক।
তারপর ক্ষণিক বিশ্রামের অভিপ্রায়ে
বসলেন পিছনের সারির কেদারায়।
পকেট থেকে মোবাইল বের করে
হোয়াটসঅ্যাপ খুললেন।
আত্মজা টেক্সট করেছে :
"হাই ড্যাড,উই আর গোইং টু পার্ক ফর ডিনার।
মম অ্যান্ড ব্রো আর উইদ মি।
রিটার্ন হোম ইন টাইম অ্যান্ড ডাইন ইয়োরসেল্ফ।
উইশ ইউ হাপ্পি মাদার-টাং-ডে।"
ম্যাসেজটা পড়েই এদিক-সেদিক তাকালেন তিনি,
দেখলেন কেউ দেখে ফেলল কিনা।
কন্যা যে তাঁর বাংলা পঠন-লিখনে অক্ষম!
আত্মগ্লানি নয়,
কিঞ্চিৎ আত্মশ্লাঘা অনুভব করে
পরবর্তী সঞ্চালনায় মনোনিবেশ করলেন
সেই বঙ্গীয় সাহিত্যিক।
===========================================
ওঁ বঙ্গভাষায় নমঃ
কুমার আশীষ রায়
যে ভাষাতে কইছি কথা
"বাংলা" বলি তাকে,
প্রতিদিনই এই ভাষাতে
স্মরণ করি মা'কে ।
এই ভাষাতেই ফুটলো বুলি
মায়ের কোলে বসে
ব্যক্ত করি শত আবেগ
আনন্দে অভ্যাসে ।
মা আমাদের এই ভাষাতেই
বলে থাকেন কথা,
যোগসূত্রে সব বাঙালির
জাগায় মর্মব্যথা ।
যে ভাষাতে ক'রে চলি
সকল ভাবের প্রকাশ,
বাংলা ভাষাই সব বাঙালির
আকাশ এবং বাতাস ।
বাংলা ভাষার জন্য দিল
কত শহীদ প্রাণ,
ভুলতে পারি কোনদিনও
তাদের বলিদান ?
এই ভাষাতে চর্চা ক'রে
রাখবো মায়ের মান
আজ একুশে ফেব্রুয়ারি
দিচ্ছে যে আহ্বান ।
মাতৃভাষা মায়ের মতোই
স্নেহ আদর ঝরায়,
কোন ভাষাটা এমন মধুর
বিশাল বসুন্ধরায় ?
বাংলা ভাষা অতি কোমল
যেন নরম তুলো,
ভিন্ন ভাষা অন্ন জোগায়
তবু পথের ধুলো ।
শিক্ষা পাওয়া সহজ কত
নিজের মাতৃভাষায়,
অন্তরেতে করে প্রবেশ
পূর্ণ ভালোবাসায় ।
বাংলা আমার মনের ভাষা
স্নিগ্ধ মনোরম
কোন ভাষাটা বলো তাকে
করবে অতিক্রম ?
হাজার ভাষা থাক জগতে
নেইকো তাতে ক্ষতি,
মাতৃভাষার প্রতি যেন থাকে আমার মতি ।
বাংলা আমার দেবীসমা
মাতৃ অধিষ্ঠানে,
রাখতে হবে জাগিয়ে তাকে
বঙ্গজনের প্রাণে ।
মধুর মতো মিষ্টি ভাষা
ভালবাসি তোমায়,
বাংলা তোমার চরণতলে
আমরা মাথা নোয়াই
ভাষা-৪৪
তোমাকে বুনে-বুনে
অঙ্কিতা মজুমদার
তোমার-আমার সেই যে ছেলেবেলায় দেখা হয়েছে,
প্রথম উচ্চারণে
মা...
আমি সন্তানসম
তোমার কাছে।
তাইতো আজও নিঃস্বার্থ
ভালোবাসায় মোড়া ভালোবাসার সম্পর্কটা-
সেই যে এক পা এক পা করে তোমার হাত ধরে গণ্ডি পেরোনো-
তার বিকাশ আজও বহমান।
কী অসীম....
অপার
তোমার সঙ্গে
মাতৃত্বের আবরণ।
কখনও কান্নায়...
কখনও চিৎকারে...
কখনও আবেগে মায়ায় সাড়া দিয়েছ প্রাণে-প্রাণে।
উন্মুখ হয়েছি চেতনার কাছে।
তোমারই আকাশ
ছুঁয়ে ছু্ঁয়ে স্বপ্ন দেখা-
মুগ্ধ হওয়া-
যেখানে মাতৃভাষার অনুরাগী হয়ে তোমারই সাথে শ্বাস নেওয়া।
ভাষা-৪৫
একুশের ডাক
ঋতম পাল
রাত পোহালেই একুশের ডাক,
মাতৃভাষা আমার অমর থাক;
নতুন সকালের পুণ্য দিনে,
বাংলা ভাষা শ্রেষ্ঠত্বের সম্মান পাক।
এই একুশে চোখের জলে রক্ত ঝরে,
শত শত জীবন হয় বলিদান;
বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে,
মাতৃভাষাকে ভালোবেসে মাতৃভাষার তরে।
আজও রক্তে রাঙানো শহীদবেদী,
রয়েছে সেই বিপ্লবীদের অপেক্ষায়;
বাংলা ভাষায় নাড়ির টানে,
তেপান্তরের মাঠে গুলিবিদ্ধ হয়ে যারা প্রাণ দেয়।
বাংলায় প্রথম মা বলে ডেকে ওঠা,
বাংলা রয়েছে মনে প্রাণে;
রক্ত দিয়ে গড়া এই ইতিহাস,
অক্ষয় হয়ে থাকবে আজীবন বাঙালির স্মরণে মননে।
ভাষা-৪৬
একুশে ফেব্রুয়ারি
অনিতা মুখার্জী
বলতে
পারেন বাংলা ভাষার বয়স কত? এখনো পর্যন্ত পণ্ডিত বা গবেষকরা তার সঠিক হিসেব করে উঠতে
পারেননি। তবে মনে হয় তার জন্ম এথনিক কালচার থেকেই। সাধারণ বাঙালি তখনও ইংরেজি সংস্কৃত
আরবি হিন্দি উর্দুকে ভালোবেসে কাছে টেনে নেয়নি, বরং দূরে ঠেলেছে। আজকের প্রজন্মে যেমন
আমরা এর উলটোটা দেখতে পাই। কিন্তু এই ভাষার প্রতি ভালোবাসার জন্য কত টগবগানো প্রাণ
অকালে ঝরে গেছে তার হিসাব নেই। রক্তে রাঙানো
সেই দিনগুলো আজও আমাদের মনকে ভারাক্রান্ত করে
তোলে। একটু সেই পুরনো ছবিগুলোকে নতুন করে দেখা
যাক।
ভারত
ভাগ হলো, তৈরি হলো পাকিস্তান । তার আবার দুইভাগ - পূর্ব ও পশ্চিম। ইতিহাসের রসিকতা
দেখুন, পাকিস্তান-এর প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কিন্তু উর্দুভাষী ছিলেন না।১৯৪৭
সালে দেশভাগের কয়েক মাস পরে ১৯৪৮ সালে পল্টন ময়দানে (যা এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান
)এসে ঘোষণা করলেন পাকিস্তানের ভাষা হবে উর্দু। তিনি ভুলে গেলেন সাত কোটি মানুষের প্রাণের
ভাষা বাংলা । শুরু হল বিরোধ, শুরু হল ইতিহাস।
উর্দুকে
রাষ্ট্রভাষা করার পেছনে বাঙালিদের উপর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করার ও শোষণের
অভিসন্ধি বলে মনে করা হয়েছিল । প্রতিক্রিয়া হিসেবে থেমে থেমে আন্দোলন চলছিলই। কিন্তু
সেই স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানলের সৃষ্টি হল তখন, যখন বাহান্নর ২৬ শে জানুয়ারি পাকিস্তান
এসেম্বলিতে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারটা চূড়ান্ত হল।
পূর্ববঙ্গের
অধিবাসী হওয়া সত্ত্বেও ১৯৫২ সালের জানুয়ারিতে খাজা নাজিমুদ্দিন
পল্টনের
এক সমাবেশে জিন্নাহর কথার পুনরাবৃত্তি করে অগ্নিতে ঘৃতাহূতি করলেন। তাঁর বক্তব্য প্রত্যাখ্যান
করে পরদিন থেকে পূর্ব পাকিস্তানে শুরু হল ধর্মঘট ও বিক্ষোভ মিছিল ।তাতে সক্রিয় ভূমিকা
নিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা
। পথে পথে ছাত্ররা নেমে এল । একুশে ফেব্রুয়ারি সাধারণ ধর্মঘট ঘোষণা করা হয়েছিল। ধর্মঘট
প্রতিহত করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তার আশপাশের এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হল। তা
লঙ্ঘন করে জন্ম হল শহীদ দিবসের।
একুশে
ফেব্রুয়ারি বিক্ষোভকারীরা ১৪৪ ধারা ভাঙতে গেলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। কিছু
ছাত্রের একটি দল গণপরিষদ ভবনের দিকে যাবার চেষ্টা করলে পুলিশ গুলি চালায় । তাতে শহীদ
হন রফিক ,আবুল বরকাত নামে দুই ছাত্র । কিন্তু সরকারি হিসেবে চারজন নিহত হওয়ার কথা
বলা হয়। তবে দুদিনে যে কতজন নিহত হয়েছিল তার সঠিক সংখ্যা এখনো অজানা। শুধু ভাষাকে
ভালবেসে নিজের প্রাণের বলিদান দিল কিছু দামাল ছেলে আর তারা স্মরণীয় হয়ে রয়ে গেল
মানুষের মনে।
শহীদের
রক্ত কখনো বৃথা যায়নি ,যেতে পারেনা। । সেই ক্ষ্যাপা বুনো ঝড় এক নতুন বীজের সন্ধান
দিল। একুশে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২। সেদিন যে বীজ
রোপিত হয়েছিল সেটাই এক বিশাল মহীরুহরূপে দেখা দিল ১৯৭১ সালে । মৌলবাদ উৎখাত করে জন্ম
হল স্বাধীন বাংলাদেশের। যার জাতীয় সংগীত হল আমাদেরই কবিগুরুর রচিত গান। দেশ হয়তো আলাদা, কিন্তু ভাষার বন্ধনে
আমরা আবদ্ধ । তাই ইদানিং এক অশনি সংকেত সেই দেশের উপর প্রভাব বিস্তার করছে । ধীরে ধীরে
মৌলবাদ তার নিজের শাখা-প্রশাখা বিস্তার করার চেষ্টা করছে। নারী স্বাধীনতা খর্ব করারও
চেষ্টা চলছে । যদি তারা সাফল্য লাভ করে তবে এরপর তাদের নিশানা হয়তো হবে ‘বাংলা ভাষা’। রাজনৈতিক
কারণে প্রত্যক্ষভাবে তাদের সমর্থন করতে না পারলেও এই মুহূর্তে আমাদের কর্তব্য তাদের
নৈতিক সমর্থন দেওয়া এবং বিশ্ব জনমত সৃষ্টি করা । কারণ রবীন্দ্রনাথ নজরুল জীবনানন্দের
ভাষাকে আমরা কতিপয় মৌলবাদীর হাতে নিঃশেষ হতে দিতে পারিনা ।
ভাষা-৪৭
বাংলাই আমার সম্মান
মৌসুমী ভৌমিক
বাংলা আমার মাতৃভাষা, আমার গভীর প্রত্যয়
তাকে ছাড়া আমি কিছু না, আমার অস্তিত্ব অজানা,
বাংলা আমার কথাকলি, মুদ্রায় মনের কোলাজ
বাগানে ফোটা নক্ষত্র, আমার হাসনুহানা।
বাংলায় আমি কথা বলি, বাংলায় গাই গান
এই ভাষা ছাড়া আমি অকেজো, বাকহারা এক প্রাণ।
এই ভাষার শব্দবন্ধে, ছত্রে ছত্রে পাই খুশি
কখনও ভেবে দেখিনি বাংলা ছাড়া কী মন ভরে?
মায়ের মুখের হাসির মতো আর কি কিছু আছে
এমন করে তৃপ্তি দিয়ে আর কোনো ভাষা কি আসে মুখ- প‘রে
!
এমন করে বেঁধে রাখে গভীর সে তো টান
এই ভাষারই সুরে ভাসি, এতেই পাই সম্মান।
ভাষা-৪৮
প্রবাসীর ছেলে
জয়দেব দাস
সারাদিন লিখি কত এটা সেটা এই ওই,
ভুল হয় মাঝে মাঝে হ্রস্ব-ই দীর্ঘ-ঈ ।
শয়ে শয়ে ঘোষি কত বানানের মন্ত্র,
বাংলার শয়ে শয়ে যত ষড়যন্ত্র।
রয়ে রয়ে ভুল হয় ভাবি ভুল আর না,
কার ঘাড়ে কে যে চড়ে, দেখে পায় কান্না।
উড়ে এসে জুড়ে বসে হসন্ত গোপনে,
হুঁশ নেই কেন ভাই আছো কোন স্বপনে
র-ফলাটা খাড়া হয়ে য-ফলায় ব্যাপ্ত,
শিখবই বাংলাটা যত হোক শক্ত।
ভাষা-৪৯
ভালোবাসার ভাষা
দেবব্রত ঘোষ মলয়
তিনতলা
হলুদ স্কুলবাড়িটির সামনে প্রশস্ত মাঠ। মাঠের সামনে পিচের রাস্তা, সেই রাস্তার উপরেই
স্কুলের মেন গেট। স্কুল বাড়িটির পাশাপাশি গেটটিকেও আজ নানা রকম ফুল ও কাগজের শিকলিতে
সাজানো হয়েছে। সেখানেই একটি সিল্কের ফেস্টুন টাঙ্গানো হয়েছে:-
শতবর্ষ
উদযাপন অনুষ্ঠান
নিঝুমপুর
উচ্চ বিদ্যালয়
নিঝুমপুর,
বর্ধমান।
ড্রাইভারকে
গাড়িটা পার্ক করতে বলে স্কুলের গেটের দিকে এগিয়ে আসেন ঋজু। ঋজুরেখ মজুমদার। এই স্কুলের
প্রাক্তন ছাত্র, ৭৯ এর মাধ্যমিক ব্যাচ। ওদের ব্যাচমেটদের একটি প্রাক্তনী সংগঠনও আছে
যার নাম 'উচ্ছ্বাস ৭৯'। ঋজু একটি বহুজাতিক সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মচারী। যদিও প্রাক্তন।
লেখালেখির জগতে কিছুটা নাম হবার পরেই চাকরিটা ছেড়ে দেয় ও। বর্তমানে ওর লেখার কিছু
গুণগ্রাহী পাঠক তৈরি হয়েছে। তাই দিনের বেশি সময়টাই ও ব্যস্ত থাকে সাহিত্যের জন্য।
গত সপ্তাহের প্রথমদিকে ওর কাছে পোস্টে একটি আমন্ত্রণপত্র আসে। তারপরই এই স্কুলের বর্তমান
প্রধান শিক্ষক মানবেন্দ্র সান্যাল ওকে ফোন করে। ফোনটি ধরেই স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে ঋজু
বলে—বলছি।
ওপাশ
থেকে পরিশীলিত কণ্ঠে নিজের পরিচয় দিয়ে মানবেন্দ্রবাবু বললেন—নমস্কার
ঋজুরেখবাবু। আপনি তো জানেন আমাদের স্কুলে শতবর্ষ উদযাপন চলছে সারা বছর ধরে। সেই উদযাপন
অনুষ্ঠানের সমাপ্তি লগ্নে আমরা আগামী একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবস উপলক্ষে একটি সাহিত্য
সম্মেলন আয়োজন করেছি। এই সম্মেলনে অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন আমাদের জেলার তিনজন
সাহিত্যিক। আমরা আপনাকে ঐদিন স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে প্রধান অতিথিরূপে আমন্ত্রণ
জানাচ্ছি। বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষক ও ছাত্রদের একান্ত অনুরোধ, আপনি আপনার
স্কুলের এই অনুষ্ঠানে ঐদিন উপস্থিত থেকে আমাদের অনুষ্ঠানটিকে সফল ও সর্বাঙ্গসুন্দর
করবেন।
চিন্তিত
হয়ে পড়ে ঋজু। এই মুহূর্তে দুটি প্রকাশনীর পক্ষ থেকে দুটি বড় উপন্যাসের কাজে হাত
দিয়েছে ও। একটি কলকাতার নামকরা প্রকাশনী, সেখান থেকে প্রকাশিত হবে ওর একটি গবেষণালব্ধ
ঐতিহাসিক উপন্যাস। দ্বিতীয়টি ত্রিপুরার একটি প্রকাশন সংস্থা, ওদের কাছ থেকে প্রকাশিত
হবে ওর একটি প্রেমের উপন্যাস। একটু ভেবে নিয়ে বলে ঋজু— আমি
খুবই খুশি ও আপ্লুত হয়েছি স্যার এই আমন্ত্রণ পেয়ে। কিন্তু একই সাথে বিব্রত বোধ করছি
যে ঠিক ওই সময়টাই আমি চূড়ান্ত রকম ব্যস্ত থাকব দুটো লেখার কাজে।
ঋজুকে
আর কিছু বলতে না দিয়ে স্যার আবার বলে ওঠেন—আমরা সবাই জানি ঋজুবাবু এই মুহূর্তে আপনি কতটা ব্যস্ত।
কিন্তু ওই একটি দিন আপনাকে যাহোক করে সময় বার করে আমাদের এখানে আসতেই হবে। আমাদের
স্কুলের সকলেই একান্তভাবে আপনাকে চাইছে ওই দিনের অনুষ্ঠানে।
এরপর
ঋজু আর না করতে পারেনি। এই স্কুলে এবং এই গ্রামের প্রতি আনাচে কানাচে ওর ছোটবেলার অনেক
স্মৃতি জড়িয়ে আছে। ভিতর থেকে কোথাও একটা অমোঘ টান অনুভব করে ওখানে যাবার। মনে মনে
রোমাঞ্চিত হয় আবার সেই স্কুলের বেঞ্চে বসা বন্ধুগুলোকে দেখতে পাবে ভেবে। স্যারকে বলে—ঠিক
আছে স্যার আমি ওই দিন আসবো। তবে সাহিত্যিক হিসেবে নয় একজন প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে।
স্কুলের
গেটের সামনে হইহই করে এসে পড়ে ক্লাস টেন ইলেভেনের একদল ছাত্র এবং দু তিন জন শিক্ষক।
তারা এগিয়ে এসে ঋজুকে অভ্যর্থনা করে। অশীতিপর গোপালবাবুকে ঋজু চিনতে পারে। পায়ে হাত
দিয়ে নমস্কার করলে স্যার ওকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করে বলেন—তুই
আমাদের গর্ব বাবা।
প্রধান
শিক্ষক মানবেন্দ্রবাবু বাকি শিক্ষকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় ঋজুর। তারপর ওরা সবাই
অনুষ্ঠান মঞ্চের দিকে এগিয়ে যায়।
মঞ্চের
অনুষ্ঠানের ঘোষণায় ছিলেন স্কুলের নবনিযুক্ত তরুণী শিক্ষিকা তানিয়া দত্ত রায়। আদতে
এটি একটি বয়েজ স্কুল, কিন্তু গত বছর থেকে ক্লাস ইলেভেন এবং টুয়েলভ কো এডুকেশন স্কুল
হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ওই দুটি ক্লাসের ছাত্রীদের জন্য কয়েকজন শিক্ষিকাও নিয়োগ
করা হয়েছে। তানিয়া কলকাতার একটি স্কুল থেকে বদলি হয়ে এখানে এসেছেন। ওর স্কুলের প্রতি
আন্তরিকতা এবং মিষ্টি ব্যবহার ইতিমধ্যেই সবার মন জয় করে নিয়েছে।
আজ
অনুষ্ঠান মঞ্চে সঞ্চালক হিসেবে তানিয়া এক এক করে অতিথিদের মঞ্চে ডাকেন। ঋজুর নাম ঘোষণা
হতে ঋজু দৃঢ় পদক্ষেপে মঞ্চে এসে আসন গ্রহণ করে। এরপর সমস্ত অতিথিদের স্কুলের পক্ষ থেকে
মানপত্র, ফুলের তোড়া, একটি সুন্দর শতবর্ষ স্মারক এবং শতবর্ষের প্রকাশিত পুস্তিকা দিয়ে
বরণ করে নেওয়া হয়।
প্রথমেই
উদ্বোধনী সংগীত। ক্লাস সিক্সের ছোট্ট মেয়ে বিদিশা দাস মিষ্টি গলায় একটি রবীন্দ্রসংগীত
শোনায়। এরপর স্কুলের আরেক প্রাক্তন ছাত্র সিদ্ধার্থ কর্মকার একটি অসাধারণ ছোট্ট মূকাভিনয়
শো মঞ্চস্থ করে। তারপর তানিয়ার ঘোষণা মতো শুরু হয় ভাষা দিবসের অনুষ্ঠান। একে একে
সাবলীল বক্তব্য রাখেন জেলার তিন সাহিত্যিক।
এরপর
তানিয়া ঘোষণা করেন—এখন আমরা ডেকে নিচ্ছি আমাদের স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র
এই মুহূর্তের বিশিষ্ট সাহিত্যিক ঋজুরেখ মজুমদারকে। তাঁর কাছ থেকে আমরা শুনে নেব ভাষা
দিবসের তাৎপর্য এবং এই স্কুলের কিছু স্মৃতিচারণ।
মাইকের
সামনে অভ্যস্ত ভঙ্গিতে দাঁড়ায় ঋজু। তারপর গমগমে কণ্ঠে আবৃত্তি করে—বাংলার
মাটি বাংলার জল। আবৃত্তি শেষ হবার পর ঋজু বলে—মঞ্চে উপবিষ্ট আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষকবৃন্দ, বিশিষ্ট
অতিথিবৃন্দ এবং সামনে উপস্থিত অগণিত অনুজ ছাত্র-ছাত্রীবৃন্দ, আমি ভাষায় প্রকাশ করতে
পারছি না আজ এখানে আসতে পেরে আমি কতটা আনন্দিত। সাহিত্য ছোট থেকেই ভালোবাসি। আজ এই
অনুষ্ঠান মূলত ভাষা দিবস উপলক্ষে। এই মঞ্চে বসেই আমার পূর্ববর্তী তিন প্রিয় সাহিত্যিকের
কাছ থেকে ইতিমধ্যেই আমরা ভাষা দিবসের তাৎপর্য, প্রয়োজনীয়তা এবং প্রাসঙ্গিকতা সম্বন্ধে
খুব সুন্দর কিছু কথা শুনেছি। এদের বক্তব্যের পর আমার মনে হয় না এ প্রসঙ্গে আর কিছু
বলার অপেক্ষা রাখে। আমি বরং ভাষাদিবস উপলক্ষে রচিত আমার একটি কবিতা আবৃত্তি করি প্রথমে।
ঋজুর
কণ্ঠে কবিতাটি শেষ হতেই হাততালির ঝড় বয়ে যায়। একটু অপেক্ষা করে ঋজু আবার বলে—আমাকে
বলা হয়েছে এই স্কুলের সম্বন্ধে কিছু স্মৃতিচারণ করতে। বিদ্যালয় তো আমাদের আঁতুরঘর।
আমরা আজ যে যা কিছু হয়ে উঠেছি, তার নেপথ্যে আমাদের ভিত তৈরি করেছে এই বিদ্যালয়। আমি
আজ একজন সাধারণ সাহিত্যকর্মী। যদিও কর্মজীবনের অনেকটাই আমি একটি বহুজাতিক সংস্থার সঙ্গে
যুক্ত ছিলাম। আমার ভিতরে যে একটি সাহিত্যিক মন আছে এটা কিন্তু প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন
এই স্কুলেরই শিক্ষক মহাশয়রা। যদিও তাঁদের সে আবিষ্কারের মর্যাদা আমি দিতে পারিনি।
কিন্তু কথায় বলে, ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভাঙ্গে। তাই বহুজাতিক সংস্থায় অনেকদিন
অতিবাহিত করলেও বোধ হয় মা সরস্বতী আমাকে এই সাহিত্য জগতে টেনে নিয়ে আসেন। আর এই ভবিষ্যৎবাণী
করেছিলেন আমাদের শিক্ষকরাই। সেই ঘটনাই আজ তোমাদের আমি বলব।
কিছুক্ষণ
মাইকের সামনে চোখ বুজে দাঁড়ান ঋজু। তার পরনে শান্তিনিকেতনি কাজ করা আকাশী পাঞ্জাবি,
গলায় স্কুলের তরফে দেওয়া উত্তরীয় আর কাঁধে একটি শান্তিনিকেতনি ব্যাগ।ঋজুর সৌম্য
চেহারার দিকে মুগ্ধ নয়নে চেয়ে থাকে ছাত্রছাত্রীরা।
আবার
বলতে শুরু করেন সাহিত্যিক ঋজুরেখ মজুমদার।
সেদিন
সকাল থেকেই তুমুল বৃষ্টি। বাবা বারান্দায় খবরের কাগজ পড়তে পড়তে মাকে বললেন, আজ কিন্তু
খিচুড়ি কর, স্টেশনের দিকে কিছুটা জায়গায় জল উঠে গেছে এইমাত্র পঞ্চুকাকা বলে গেল।
আমারও ছুটি পাওনা হয়েছে কয়েকটা, আজ যাব না ভাবছি।
ছোট্ট
ঋজু তার দুই ভাইয়ের সঙ্গে বারান্দায় বসে লুডো খেলছিল। এখন ওদের সবারই পড়াশোনার চাপ
কম। বছরের শুরু। বাবার কথা শুনে চোখ তুলে দেখল মায়ের মুখে একটা খুশির মুচকি হাসি মিলিয়ে
গেল।
বাবার
দিকে তাকিয়ে মা বললেন—কিন্তু আজ যে ঋজুর গেজেট বেরোবে।
বাবা
খবর কাগজটা ভাঁজ করে রেখে বললেন—আরে তাই তো, ঠিক আছে ঋজু স্কুলে যাক আমি একটু পরে যাব।
সে
সময় মাধ্যমিক সবে শুরু হয়েছে। তখন গেজেট বের হত। গেজেটে সমস্ত ছাত্রের পাশ ফেল এবং
মোট নম্বর লেখা থাকতো। সেটি স্কুলের সামনে টাঙিয়ে দেওয়া হত আর উৎসবের মেজাজে হইহই
করে ছাত্র-ছাত্রীরা বা তাদের অভিভাবকেরা গেজেটে নাম খুঁজতেন পরীক্ষার্থীর। সে এক আলাদা
উন্মাদনা ছিল। তখন এখনকার মতো এত বেশি ফার্স্ট ডিভিশন পাওয়া যেত না, আর প্রথম, দ্বিতীয়
বা তৃতীয় কেউ হলেও সেটা নিয়ে এত মাতামাতি হত না।
আজও
স্কুলে এসে ঋজু দেখলো একটা বেশ হৈ হৈ ব্যাপার। তার অন্যান্য বন্ধুরাও এসে গেছে। হেডস্যারের
ঘরের পাশেই একটি দেওয়ালে গেজেট লাগানো হয়েছে। কিন্তু তার উপরে এতগুলো মাথা হুমড়ি
খেয়ে পড়েছে যে ঋজুরা সামনে পৌছাতেই পারছিল না। বেশ কিছুক্ষণ পরে গেজেটের সামনে গিয়ে
নিশ্চিন্ত হল ঋজু ও তার বন্ধুরা। তারা সবাই ভালোভাবে পাস করেছে।
সে
সময় রেজাল্ট নিয়ে এত টেনশন করত না কেউ। তারা ওখানে বিকেল বেলা ফুটবল ম্যাচের পরিকল্পনা
নিয়ে আলোচনা করতে শুরু করে। এ সময় বিশ্বনাথদা হেড স্যারের ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন।
বিশ্বনাথদা স্কুলের ঘন্টা বাজানো থেকে শুরু করে পরীক্ষার খাতা দেওয়া সমস্ত কিছুই দেখাশোনা
করে। বিশ্বনাথদা ঋজুর সামনে এসে বলেন, তুমি একবার হেড স্যারের ঘরে যাও।
বন্ধুদের
বিস্মিত দৃষ্টির সামনে ঋজু বলে ওঠে—কেন বিশ্বনাথদা? আমাকে কেন ডাকছেন স্যার, আমি তো কিছু
করিনি।
বিশ্বনাথদা
হেসে বলেন—শুধু কিছু করলেই কি স্যার ডাকেন নাকি। যাও যাও দেরি করো না স্যারের অনেক
কাজ আছে।
মনে
মনে একটু আশঙ্কিত হয়েই ঋজু হেডস্যারের ঘরের দিকে পা বাড়ায়। যতদিন এই স্কুলে পড়ছে
কোনদিন কোন কারণে তাকে কোন স্যার শাসন করার সুযোগ পাননি। আজ কি এমন হলো যে স্যার তাকে
ডাকছে।
হেড
স্যারের ঘরের দরজা খোলা। দরজার মাঝখানে একটি কাঠের ছোট্ট দরজা আছে। সেই দরজার উপর দিয়ে
আর নিচে দিয়ে ভেতরটা দেখা যায়। ঋজু দেখল হেড স্যারের সামনে বসে আছেন তাদের বাংলার
শিক্ষক জীবনানন্দ ঘোষ ওরফে জীবনবাবু।
কাঠের
ছোট্ট দরজা ঠেলে কাঁপাকাঁপা গলায় ঋজু বলে—স্যার আসছি।
চোখ
তুলে তাকান হেডস্যার সত্যেন ঘোষাল। ওঁর একটি মোটা গোঁফ আছে, পরনে ধবধবে সাদা ধুতি পাঞ্জাবি।
চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা।
হেড
স্যার স্নেহ মিশ্রিত গলায় বলে ওঠেন, আয় ঋজু সামনে আয়।
এবার
ভরসা পেয়ে ঋজু স্যারের পাশটিতে গিয়ে দাঁড়ায়।
স্যার বলে ওঠেন,পুজোর ছুটিতে স্কুলের দেওয়াল পত্রিকায় তোর লেখা দেখেই আমি বলেছিলাম—তোর
সম্ভাবনা আছে। আজ সেটাই সত্যি প্রমাণ হয়েছে। কি বলেন জীবনবাবু?
ঋজু
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। স্যার কিসের সম্ভাবনার কথা বলছেন সে বুঝে উঠতে পারে না।
এই
সময় বাংলার স্যার জীবনবাবু ঋজুর দিকে তাকিয়ে বলেন—ঋজু, তুমি বাংলায় হায়েস্ট নম্বর পেয়েছ। শুধু স্কুলের
মধ্যে নয়, আমাদের জেলার মধ্যে তোমার নম্বর সবথেকে বেশি।
ঋজুর
মুখে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে। হায়েস্ট নম্বর পাবার আনন্দে নয় কারণ সে সময় আমাদের কাছে
নম্বর পাওয়াটা অতটা বিশাল কিছু ব্যাপার ছিল না। ঋজু যে কোন অন্যায় করেনি এই নিশ্চিন্তিবোধই
তার মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলে।
হেডস্যার
মাথায় হাত দিয়ে বলেন—আমার অনেক আশীর্বাদ রইল তুই জীবনে অনেক বড় হবি।
জীবনবাবু
বলেন—আমার এবং স্যারের একান্ত ইচ্ছা তুই ভবিষ্যৎ জীবনে বাংলা নিয়ে পড়াশোনা
কর। তোর সম্ভাবনা আছে সেখানেই।
হেডস্যার
বলেন, তোমাকে পরে স্কুলের পক্ষ থেকে একটা উপহার দেবো আমরা। এখন এসো।
ঋজু
হেড স্যারের ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসতেই বন্ধুরা ঝাঁপিয়ে পড়ে তার উপর কি হল জানার জন্য।
সব শোনার পর তাদের ফার্স্ট বয় কৌশিক বলে ওঠে, বাংলায় হায়েস্ট নম্বর পেলেও খুব একটা
কিছু হবে না রে।
রাত্রে
বাড়িতে আজ ভালো ভালো খাবার ছিল। সে সময় চাইলেই মিষ্টি বা অন্যান্য খাবার পাওয়া যেত
না। আজ ঋজুর ছোটমামা এবং মেজো পিসিমা এসেছেন। দুজনেই উচ্চশিক্ষিত। ঋজুর মুখে সব কথা
শুনে দুজনেরই এক কথা—আমাদের ঋজুর মাথা পরিষ্কার। ও পিওর সায়েন্স নিয়েই পড়বে।
সে
সময় বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন লেগেই থাকতো। আর আত্মীয়-স্বজনরা এবং পাড়ার কাকু জেঠুরা
প্রত্যেকেই যে কোন ছোটদের শাসন করার অধিকার রাখত। তাদের কাছে নিজের ছেলে এবং আত্মীয়র
ছেলে বা প্রতিবেশীর ছেলে সমার্থক ছিল।
ঋজুরও
বাংলা নিয়ে পড়া হয়নি। সে পিওর সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করে যদিও পাস করে যায়, কিন্তু
উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু করতে পারেনি। ইন্টারভিউতে পাস করে একটি বহুজাতিক সংস্থায় চাকরি
পেয়ে যাওয়ার পরে আর পড়াশোনা করার সুযোগ বা ইচ্ছা কোনটাই হয়নি তার।
কথা
থামিয়ে পোডিয়ামে রাখা গ্লাস থেকে একটু জল খান সাহিত্যিক ঋজুরেখ মজুমদার। এ সময় ক্লাস
টেনের একটি ছাত্র হাত তুলে বলে, স্যার আমি
একটা প্রশ্ন করব।
ঋজুরেখ
বলেন—হ্যাঁ নিশ্চয়ই বল।
ছেলেটি
বলে, স্যার আমার নাম অনিমেষ আমি ক্লাস টেনে পড়ি। আমার প্রশ্ন আপনার এতক্ষণ বলা গল্পের
ঋজু কি আপনি?
মাইকটা
আবার কাছে টেনে নিয়ে ঋজুরেখ বলেন—হ্যাঁ, আমিই সেদিনের সেই ছোট্ট ঋজু। প্রায় পনেরো বছর
চাকরি করার পর আমার জীবনের গতিপথ পাল্টে যায়। চাকরির ফাঁকে ফাঁকে আমি বিভিন্ন লিটল
ম্যাগাজিনে ছোট ছোট গল্প লিখে পাঠাতাম। কিছুদিন পর দেখলাম আমার পাঠানো প্রায় সমস্ত
গল্পগুলোই নির্বাচিত হয়ে যায়। এরপর আমি দু' একটি বড় পত্রিকায় লেখা পাঠাই। সেগুলোও
প্রকাশিত হয়। তখন অফিস এবং পাড়াতে লেখালেখির সুবাদে একটু পরিচিতি পেয়েছি। এ সময়
একটি নামকরা পত্রিকার সম্পাদক মহাশয় আমাকে প্রস্তাব দেন, সর্ব সময়ের সাহিত্যিক হওয়ার
জন্য এবং তাদের পত্রিকায় নিয়মিত লেখার জন্য। তখন আমার মনে পড়ে ছোটবেলায় বলা প্রধান
শিক্ষক এবং বাংলার শিক্ষক মহাশয়ের কথা। আমি চাকরি ছেড়ে দিই। আমার শুভানুধ্যায়ী অনেকেই
আমাকে বলেছিলেন হঠকারী সিদ্ধান্ত। কিন্তু ভবিষ্যতে প্রমাণিত হয়, বাংলা ভাষায় গল্প
লিখেও জীবন চালানো যায়। অর্থের নিরিখে সাহিত্য জগৎ থেকে আমি যা পেয়েছি সেটা আমার
কর্মজীবনের পাওনার থেকে কিছুটা বেশিই। কিন্তু এর থেকে অনেক বড় পাওনা আমি বহু মানুষের
ভালোবাসা পেয়েছি, সম্মান পেয়েছি। আজ ভাষা দিবসে আমার নতমস্তকে প্রণাম বাংলা ভাষাকে।
আর যা কিছু হয়েছি আমি তার নেপথ্যে আমার এই স্কুল।
মঞ্চ
থেকে নেমে আসেন সাহিত্যিক ঋজুরেখ মজুমদার। হাততালির শব্দে চারদিক মুখরিত করে তাকে ঘিরে
ধরেন অগণিত ছাত্রছাত্রীরা। নেপথ্যে মাইকে ভেসে আসে গান—আমি
বাংলাকে ভালবাসি...
ভাষা-৫০
রক্তাক্ত ভাষা
হেমন্ত মণ্ডল
শত শহীদের রক্তে রাঙানো
একুশে ফেব্রুয়ারি,
এসো আজ স্মরণ করি।
শহীদ বেদিতে বরকত শুয়ে আছে,
শরীরে বুলেটের দাগ,
রক্তে ভিজেছে
কমলার শাড়ি, পলাশ, শিমূল ঝরে পড়ে আছে
শহিদ, পলাশ
একাকার -
ভুলিনি আমি, ভোলোনি তুমি!
বাংলা আমার জন্মভূমি,
এ ভাষার তরে লড়তে গিয়ে -
মৃত্যুবরণ করে।
তাই বাংলায় গান করি ।
===========================
ভাষা-৫১
অনন্ত সত্য
মনীষা কর বাগচী
মা মাটি মাতৃভাষা
জীবনের চরমতম উপলব্ধি প্রেম
অনন্ত সত্য...
যেকোন মূল্যে রক্ষা করতে হয়
তাঁর সম্মান!
কী দুধ খেয়েছিলে?
কী প্রেম ধরেছিলে বুকে ?
কতটা সাহস পুষেছিলে প্রাণে?
বরাক উপত্যকায় মাতৃভাষার অপমান
তুলেছিল তুফান
স্বার্থলোভীদের স্বার্থে
বাংলা ভেঙে খানখান
থেকে থেকে বাংলা ভাষার
কেন এত অপমান?
বুঝিয়ে দিয়েছ
বেঁচে আছে বাংলা বেঁচে আছে মায়ের সন্তান
আসাম সরকারকে জানিয়ে দিয়েছ
বাঙালি হার মানেনা
মায়ের পদতলে
উৎসর্গিত তাদের প্রাণ।
হে মৃত্যুহীন প্রাণ
শতশত প্রণাম
বিফল হয়নি বলিদান...
বিফল হয়নি তোমাদের বলিদান।
ভাষা-৫২
বাংলা ভাষা
প্রভাত ভট্টাচার্য
বাংলা আমার নয়নমণি
বাংলা আমার প্রাণ
বাংলা আমার হাসিকান্না
বাংলায় গাই গান ।
বাংলা আমার প্রাণভোমরা
বাংলা হৃদয়জোড়া
বাংলা ভাষা ছুটছে যেন
অশ্বমেধের ঘোড়া।
বাংলা ভাষা এসছে চলে
পেরিয়ে অনেক পথ
একুশের শহীদ সাথে
ছুটছে বিজয়রথ।
তোমার আমার মনের ভাষা
মোদের পরিচয়
সবাই মিলে বলি মোরা
বাংলা ভাষার জয়।
ভাষা-৫৩
ভাষা দিবসে শহীদ স্মরণ
প্রজ্ঞানন্দ মুখোপাধ্যায় ( প্রনমু)
১৯৫২ সাল,২১শে ফেব্রুয়ারি, ঢাকায় সেই দিন।
কিভাবে শোধ করি,ভাষা শহীদদের রক্তঋণ।
সেদিন বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি দেবার আহ্বান।
এগিয়ে ছিল আন্দোলনে
কত ছাত্র, তরুণ প্রাণ।
এগিয়ে বন্দুকের সামনে, দাবি যে সোচ্চার।
রেখে জীবন পণ,চাই মাতৃভাষা স্বীকৃতি উদ্ধার।
ভেবেছিল, মাতৃভাষা তো মাতৃদুগ্ধ ,অমৃত সমান।
চেয়ে মাতৃভাষার ঠিক মর্যাদা ও সম্মান।
সেদিন,পুলিশের গুলি রক্তাক্ত হয় ঢাকার পথ।
ওরা, জীবন দিয়ে পূর্ণ করে যে কাঙ্ক্ষিত শপথ।
ওখানে থামেনি লড়াই সংগ্রাম, এ মাতৃভাষার।
৩৮ বছর পর, জাতিসংঘ করে এর প্রকৃত স্বীকার।
তাই এদিন নয় ,শুধু বাংলার ভাষা দিবস পালন।
এদিন
"আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস"
স্মরণ।
ভাষা-৫৪
মাতৃভাষা
অভিজিৎ দত্ত
বাংলা মোদের
মাতৃভাষা
বাংলা মোদের গর্ব
বাংলায় তাই কথা বলতে
সবসময়ই আমরা স্বচ্ছন্দ।
বাংলায় কথা বলার অধিকার
একদিন ছিল না পূর্ব বাংলার
তার জন্য তারা
জীবন বাজি রেখে
করেছিল মরণপণ লড়াই
শেষ পর্যন্ত শাসকের কাছ থেকে
বাংলা ভাষায় কথা বলার
অধিকার করেছিল আদায়।
একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা জন্যে
প্রাণ দিয়েছিলেন অনেকে
রফিক, সালাম, বরকত, জাব্বারের
লড়াই হয়নি বিফল
সারা বিশ্বে মর্যাদার সঙ্গে আজ
মাতৃভাষা দিবস হচ্ছে পালন।
ভাষা-৫৫
মধুর ভাষা, বাংলা ভাষা
রবীন বসু
ভাবের ভাষা বাংলা ভাষা, আমার ভাষা কই
কোথায় যেন ছিঁড়ছে সুতো বেসুরো যে হই।
মায়ের ভাষা ভুলি আশা প্রাণের ভাষা নেই
মুখের বুলি অন্য ভাষায় নকল শুধু সেই।
এমনি ভাবে মাতৃভাষা ভিন্ন ভাষা হয়
অন্য ভাষায় কথা বললে লজ্জা তারে কয়।
ভাষা শিক্ষা মহান বটে প্রয়োজনও তাই
ভুলে যেন মায়ের ভাষা কখনও না যাই।
কিন্তু যারা কথায় কথায় মিশ্র বাংলা বলে
তাদের জন্য মাতৃভাষা শির হেঁট করে চলে।
ভাবের ভাষা মধুর ভাষা বাংলা ভাষা ওই
নোবেল আনেন রবি ঠাকুর, আমরা সেরা হই।
ভাষা-৫৬
আমার ভাইয়ের রক্ত একুশে ফেব্রুয়ারি
সঞ্জয় ব্যানার্জী
আমার
ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি।
একুশে
ফেব্রুয়ারি দিনটি ভাষা আন্দোলনের দিন। এই দিনটিতে শুধুমাত্র মাতৃভাষার জন্য শহীদ হয়েছিলেন
আবদুল, জব্বর বাংলাদেশের মহান বিপ্লবী ভাইরা।
একুশে
ফেব্রুয়ারি দিনটি একটা বিপ্লবের দিন। শুধুমাত্র বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য
বাংলাদেশে এক মহান ঐতিহাসিক বিপ্লব হয়েছিল।
আজও
আমরা চোখের জলে একুশের বিপ্লবকে স্মরণ করি।
বাংলা
ভাষা দিবস বা মাতৃভাষা দিবস বা ভাষা দিবস যে কোনও নামেই উল্লেখ করি না কেন ,পৃথিবীর
ইতিহাসে এই আন্দোলন চিরস্মরনীয় বা অবিস্মরনীয় হয়ে থাকবে।
এই
রকম ভাষা আন্দোলন পৃথিবীর ইতিহাসে দ্বিতীয়ত আর উল্লেখ নেই।
বাংলাদেশের
কিছু তরুণ ছেলেরা বাংলা ভাষাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার দাবিতে বুলেটের সামনে বুক পেতে লুটিয়ে
পড়েছিলেন বাংলাদেশের মাটিতে।
আন্তর্জাতিক
মাতৃভাষা দিবস হলো একুশে ফেব্রুয়ারি।
বাংলাদেশ
ও পশ্চিমবঙ্গ সহ সমস্ত বাংলাভাষী অঞ্চলে এই দিনটিকে বিশেষ দিবস হিসাবে পালন করা হয়।
১৯৯৯
খ্রিস্টাব্দের ১৭ নভেম্বরে জাতিসংঘ কর্তৃক ২১ শে ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী মাতৃভাষা দিবস
নামে পালন করা হয়।
এই
দিনটি বাঙালি জনগণের ভাষা আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতি বিজরিত একটি দিন হিসাবে আজও
স্মরণ করি।
১৯৫২
সালে ২১ শে ফেব্রুয়ারি, বাংলা ৮ই ফাল্গুন, ১৩৫৮ সালের বৃহস্পতিবারে মাতৃভাষা বাংলাকে
পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে বাংলাদেশের ঢাকা শহরে আন্দোলনরত বাঙালি
ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষনে বহু তরুণ ছাত্র মৃত্যু বরণ করেন।
ইউনেস্কো
কর্তৃক স্বীকৃত এই দিনটি মাতৃভাষা সংরক্ষণ এবং বহুভাষিক শিক্ষা নিশ্চিত করার তাৎপর্য
তুলে ধরেন।
ভাষা-৫৭
মাতৃভাষা
উৎপলেন্দু দাস
অধীর অপেক্ষায় কান পেতে রাখি
কণ্ঠে ধরে রাখি শব্দ
নিভৃতে বুকের স্পন্দনে করি অনুভব
আকাশ জুড়ে স্বপ্ন দেখি ব্যর্থতা ভুলে...
মেঘ কেটে দেখা দিয়েছে নির্মল আকাশ
রামধনু আঁকা আলোর অনুপম উদ্ভাসে
ঝড় শেষে বইছে শীতল বাতাস
দিগন্তের ওপার থেকে ভেসে আসছে আশ্বাস ...
প্রিয় বাংলা ভাষা, তুমি বহমান নদী হয়ে বয়ে যাও
আমি পাল তুলে ভেসে যাই বন্দরে বন্দরে
সব নাবিকদের কানে কানে বলে আসি প্রাণের কথা
শ্বাস প্রশ্বাসের মতো তোমায় ভালোবাসি ।
ভাষা-৫৮
আঁচল বিছানো আছে
দেবাশীষ চক্রবর্তী
বুকে হাত রাখুন,
ভাবুন কতদিন ভালোভাবে মায়ের মুখ দেখেননি!
অসংখ্য মানুষের দৃঢ় ইচ্ছেতে
ভাই-বোনদের রক্ত, ত্যাগ আর নিষ্ঠ সেবায়
যে মা উঠে দাঁড়িয়েছিল সুস্থ সবলা,
আজ তার বিষণ্ণ ফ্যাকাসে মুখে উপেক্ষার কালিঝুলি;
চোখের নীচে শুকনো কান্নার আঁকিবুকি।
আপনি চালাক লোক---
চাটুকারিতার উপকারিতা আপনার জানা,
বাঁকা পথে সফল হতে হতে
সোজা সরল ভাই-বোন-মাকে কবেই ভুলে গেছেন।
সম্পর্ক এখন শুধুই প্রয়োজন
কোনো অতীত নেই, ভালোবাসা-কৃতজ্ঞতা নেই,
স্মৃতির পথে যাওয়া আসা নেই।
সত্যের সামনে দাঁড়ান---
দেখুন আপনি পরজীবীর মতো দয়া ধরে ঝুলে আছেন।
আপনি পড়বেন...
যেকোনো মুহূর্তেই পড়ে যেতে পারেন, কিন্তু মরবেন না।
বাঁচাতে বাংলা মা আজো আঁচল বিছিয়ে আছে।
ভাষা-৫৯
একুশে ফেব্রুয়ারী
অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়
তুমি যে আমার প্রাণের ভাষা
তুমি যে আমার মা
তুমিই আমাকে বলেছো সেদিন
গলা ছেড়ে গান গা।
তুমিই আমাকে বিদ্রোহী করো
শ্রদ্ধায় মাথা নত
গর্জে উঠে টুঁটি চেপে ধরি
যারা বলে তুমি গত।
তোমাকে আঁকড়ে ভালোবাসি আমি
তোমাকে আঁকড়ে কাঁদি
তোমাকে আঁকড়ে বেঁচে থাকি রোজ
অন্ত হতে আদি।
যারা তোমাকে মারতে চায়
বলে মৃত বাংলা
মূর্খ তারা বোঝেনা কখনো
কত তারা হ্যাংলা!
নিখিল বিশ্বে ছড়িয়ে আছে
অগণিত ভক্ত
তোমাকে বাঁচাতে মরিয়া আমরা
ঝরুক না রক্ত!
তুমি আমার অমর প্রেম
তুমিই মাতৃভাষা
তুমি আমার মুক্ত বাতাস
হতাশার মাঝে আশা।
পৃথিবী চিনেছি তোমার কাছে
অপরূপ সৃষ্টি
তুমি যেন ঠিক ঊষর মরুতে
ঝিরঝিরে বৃষ্টি।
তোমার সাথে গলাগলি ভাব
নয় কখনো আড়ি
প্রণাম সেলাম মাথা উঁচু করে
একুশে ফেব্রুয়ারী।
ভাষা-৬০
ভাষা লিপির পথ
বিমল চন্দ্র সরদার
বহু প্রাচীন গুহার শিলালিপি বেয়ে
আজ আমার বর্ণপরিচয়ের বুকে
একুশে ফেব্রুয়ারীর ক্ষত...
নদীর জলের মতো রক্তের অস্তিত্ব
আজও আমাদের হৃদয়ে শুকনো ক্ষত মাটি
রাঙায় ; আর বলে --
আ-মরি বাংলা ভাষা ...
আমি তোমায় ভালোবাসি ।
শতাব্দীর রোদ্দুর গড়ায় সংগ্রামীর হাতে
একুশে ফেব্রুয়ারীর রোদ্দুর ফেরে কলমের আগায়
সোনার বাংলায় রক্ত ঝরিয়ে যারা মাটি করেছে লাল
,
তাদের হৃদয়ে ফোটে বাংলা ভাষার নির্ভীক প্রাণ ।
অস্তিত্বের সংগ্রাম লড়াইয়ে
আজও আমাদের প্রাণে ভাষা লিপির পথ বেয়ে
বাঁচার গান গাই -- আ-মরি বাংলা ভাষা
আমি তোমায় ভালোবাসি...
ভাষা-৬১
ভাষা দিবস স্মরণে
আত্মদীপা মুখার্জী
গুপী
গাইন বাঘা বাইন ছায়াছবিতে
গুপী তার গানে বলেছিলো , " এ যে
সুরেরই ভাষা , তালেরই ভাষা, ছন্দেরই ভাষা, আনন্দেরই ভাষা ।" সে আরো বলেছিলে , "ভাষা এমন কথা বলে বোঝেরে সকলে
। উঁচা নীচা ছোট বড় সমান ।মোরা সেই ভাষাতেই করি গান ।" বাংলা ভাষা সম্পর্কে এর চাইতে সম্পূর্ণ করে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন বুঝি আর কোন
ভাবেই সম্ভব নয় । জীবনের
এমন কোন পরিপ্রেক্ষিত নেই যেখানে আমরা আমাদের এই মাতৃভাষার কাছে ঋণী নই ।সেটা হয়তো যে কোন মাতৃভাষারই স্বাভাবিক
ধর্ম । উদাহরণে যাব না । কারণ সুদীর্ঘ এক হাজার বছরের নবীন এক ভাষার জীবনধর্মিতার নিদর্শন
এত অসংখ্য যে তা উল্লেখ করে শেষ করা যাবে না
। এবং সেই উদাহরণ আমাদের আনন্দ বিষাদ আধ্যাত্মিকতা প্রেম বিরহ যাই হোক না কেন । এমনকি এই ভাষার যে লোকায়ত রূপ তার বৈচিত্র্যেরও
কোন সীমা পরিসীমা নেই ।জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত লোকায়ত সমাজে যে কত অসংখ্য ভাষাগত
রূপ পাওয়া যায়, তারও কোন শেষ নেই । কারণ লোকায়ত রূপগুলিও বৈচিত্র্যময় ।
আরেকটা প্রসঙ্গ । পৃথিবীর ইতিহাসে বোধ হয়
শুধুমাত্র একটা ভাষার জন্য এরকম একটা রক্তাক্ত আন্দোলন আর কোথাও কোনদিন হয়নি ।এবং সেই স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য এই রকমের একটা উদযাপন ।
আন্তর্জাতিকভাবে । সম্প্রতি অবশ্য এই ভাষাদিবস শুধুমাত্র বাংলা ভাষার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই ।রূপ নিয়েছে আন্তর্জাতিক
মাতৃভাষা দিবসরূপে । কিন্তু ----
এই কিন্তু
থেকেই দ্বিতীয় চিন্তার শুরু । কি রকম !!! ভাষাদিবসের সেই বিখ্যাত গানকে কণ্ঠে নিয়ে অসংখ্য প্রভাতফেরি এবং সমস্ত দিন ধরে
অসংখ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান । এই একদিনের আবেগকে পাশে সরিয়ে যদি যথাযথ অনুসন্ধান করা যায় তাহলে প্রশ্ন করা যেতে পারে এই প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা বা বাবা মায়েরা
কতখানি বাংলা ভাষার প্রতি সমবেদনাশীল , শ্রদ্ধাশীল
বা সচেতন । পরিস্থিতিগত কারণে আমরা অধিকাংশই
আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে যতখানি ইংরাজী শিক্ষায়
শিক্ষিত করতে উদ্যোগী হই, তার সমপরিমাণ উদ্যোগ
কিন্তু বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে থাকে না ।বলা ভালো বড় শহরগুলোতে এই ছবি । ছোট শহর বা
মফঃস্বলে অবশ্য মাতৃভাষা চর্চার প্রবহমানতা বেশি দেখা যায় । এটি যদিও একটি বিতর্কিত বিষয় । প্রচেষ্টা
নেই তা নয়, কিন্তু স্বাভাবিক কারণেই সেই প্রচেষ্টা স্তিমিত হয়ে পড়ে। আশার কথা এই যে সমাজমাধ্যমের
কল্যাণে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে যে লেখালেখির
অভ্যাস তৈরি হচ্ছে তা অত্যন্ত আশাপ্রদ ।
শামসুর রহমান বলেছিলেন বাংলাভাষার সেই অমোঘ
সত্য , " বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে নিকানো উঠানে ঝরে রোদ / বারান্দায় লাগে জ্যোৎস্নার চন্দন " । কয়েক
দিন আগে চলে গেলেন প্রতুল মুখোপাধ্যায় ।শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত শুনিয়ে গেলেন, শেখাবার
চেষ্টা করে গেলেন , " আমি বাংলায় গান গাই " । আমরা যেন সেই গান গাইতে পারি
।
ভাষা-৬২
অমর একুশে
ডলি সাধুখাঁ
আবেগ মাখানো
একটি দিন
রক্ত আখরে লেখা এ দিন
অধিকার আদায়ের সেদিন
সত্তা উন্মোচনের এ দিন
জাতির জীবনের মহান দিন
বাংলা দামালের বুকের ঋণ
স্মরণে রাখবে চিরদিন।
মাতৃভাষা হোক অমলিন
৫২-র ফেব্রুয়ারির সেই দিন
পুষ্পমাল্য নয় শুধু উড্ডীন,
অমর একুশ বরেণ্য দিন,
থাকবে পবিত্র চিরদিন।
ভাষা-৬৩
একুশ এক স্পর্ধিত যৌবন
তরুণ চ্যাটার্জী
একুশ
মানে দৃপ্ত কণ্ঠে মিছিলে শ্লোগান তোলা যৌবনের মুষ্টিবদ্ধ হাত ।
একুশ
মানে অত্যাচারীর বুকে কাঁপন ধরানো ,
রক্ত
চক্ষু উপেক্ষা করার স্পর্ধা ।
একুশ
মানে শহীদ বন্ধু তোমায় ভুলি নাই ,
তর্পণ
করা রক্তমাখা ভায়ের স্মৃতি ।
একুশ
মানে শাসকের দ্বারে গর্জে ওঠা স্পর্ধিত যৌবন
।
একুশ
মানে নির্ভীক যৌবন আওয়াজ তোলে---
রাজা
তোর কাপড় কোথায় !!!
ভাষা-৬৪
বাংলা আমার প্রাণ
মোঃ মনিরুল আলম
বাংলা আমার মায়ের ভাষা
বাংলা আমার
প্রাণ,
সেই ভাষাতেই গাইল মাঝি
জীবন নদীর
গান ।
কাটল চাষী সোনার ফসল
বাংলা গানের
তালে ,
বাংলা ভূমি রাঙিয়ে গেছে
শিমুল ,পলাশ
ফুলে।
বাংলা আমার প্রাণের ভাষা
মধুর গানের
সুর ,
বাংলা আমার ফুলের মালা
সুগন্ধে
ভরপুর ।
ভাষার জন্য প্রাণ দিল
রফিক, বরকত,
সালাম;
একুশে ফেব্রুয়ারি অমর শহীদ
লও গো
সকলে প্রণাম ।
ভাষা-৬৫
বাংলা ভাষা
সুনন্দন শিকদার
ঝড় - জল ভেঙে হাজার বছর সে ,
কোন এক ঠিকানা খুঁজে বেরিয়েছে ।
তিস্তা , গঙ্গা আর পদ্মার চর পেরিয়ে
,
সুদূর নীল মিসিসিপি আর টেমসকে
সে অবলীলায় করেছে আপন ।
প্রোজ্জ্বল অফিসের প্রহরীকে
সে বলেছে , এই দ্যূতসভায়
আজ নয় , আসব আরেকদিন ।
মন্দির তাকে বাইরে বসিয়ে রাখে,
প্রযুক্তির মাঠ তার খেলার নয় ,
নিওন আর সাইনবোর্ডে সে ব্রাত্য ,
তবু আজও সে অকুতোভয় ।
প্রতিবাদে-প্রেমে সে মূর্ত ,
রোজ কবিতায় করি তার অপেক্ষা ।
আজও রাত্রে নেই ঘুমোবার জো ,
কখন সে একান্তভাবে এসে দাঁড়াবে
;
আবছাস্বরে বলবে , আবার স্বপ্ন দেখো ।
ভাষা-৬৬
ভাষা দিবস
দীপ্তবিভু ঘোষ
মায়ের ভাষা, মোদের আশা,
আবেগ ভরে রাখতে হবে,
নইলে বৃথা থাকাই ভবে,
তোমার আমার মুখের ভাষা, ভালবাসা।
আন্তর্জাতিক দিবস তুমি,
প্রাণপ্রিয় একুশে রক্তিম সেলাম,
তোমার বীরত্ব, গর্বগাথার অপর নাম,
প্রাণের আরাম, জানেন অন্তর্যামী ।
মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধসম,
শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইন তোমাকে চাই,
চিন্তা, গবেষণা, তোমাকেই চাই,
আনন্দদায়ী তুমি, বিরাজ চিত্তে মম।
অমোঘ তুমি, সূর্যরশ্মির ন্যায়,
বাসনা, পূজিব আমৃত্যু তোমায়।
ভাষা-৬৭
স্বাধীনতার "একুশে"
সুমিতা চৌধুরী
হাজারো কোল শূন্য হয়েছিল,
খেলেছিল এ ধরা রক্তের হোলি।
আপন মাতৃভাষাকে দিতে সম্মান,
শত সহস্র বাংলার তরতাজা প্রাণ দিয়েছিল আপনাকে বলি।
যে ভাষা ছিল সবচেয়ে প্রাচীন
সাহিত্যে ও সুমিষ্টতায়,
দুর্বল ভেবে তাঁরই টুঁটি টিপে ধরেছিল
রাজাকারের দল
হেলায়!
আপন রক্তে চুকিয়েছিল দেনা
আপন মাতৃভাষার,
মান্যতা পেয়েছিল বাক স্বাধীনতা
শৃঙ্খল ভেঙেছিল পরাধীনতার।
শত সহস্র শহীদের
রক্তে
বাংলা পেয়েছিল তার হৃত মান,
আজ সবাকার মুখে মুখে ফেরে
জগতে বাংলা
ভাষার সুউচ্চ স্থান।
তবে কেন বাঙালি, আজ আপনি হেলা করো
আপন মাতৃভাষাকে?
যে ভাষাতে আওড়ালে তুমি প্রথম বুলি,
যার মাধ্যমে
চিনলে এ ধরাকে!
শুধু একটি দিনের তরে করো না স্মরণ
আপন ভাষার গৌরব,
তার আকরের মণিমুক্তায়
খোঁজো আপনার চির বৈভব।
বাংলা আমাদের চেতনা, মনন,
আমাদের স্বাভিমান,
আজীবন তারে ন্যায্য মান্যতা দিয়ে
দাও হৃদয়ে অধিষ্ঠান।
তবেই তুমি মান্যতা পাবে,
অর্জন করবে আপন স্বাধীনতা।
নইলে "একুশে" ইতিহাসে একটি দিন হয়েই রবে,
পদলেহনে তুমি
চিরতরে বন্দী হবে পরাধীনতার।
ভাষা-৬৮
ভালো থেকো মাতৃভাষা
ড. সুব্রত চৌধুরী
প্রিয়
মাতৃভাষা,
সেই
ছোট্টবেলায় মায়ের হাত ধরে মামারবাড়িতে বারোয়ারি কালীপুজো দেখতে যেতাম। কী ভিড় সেথায়!
কত বড় প্রাঙ্গণজুড়ে মেলা বসতো। ভক্তি আর আনন্দময় সে মিলনায়তনে আমার বিস্ময় থাকতো
সীমাহীন। হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে শক্ত করে ধরেছি মায়ের হাত আর চোখ দিয়ে ছুঁয়েছি দৃশ্যের
রং। এমনভাবে থেকেছি তো কতবার। জীবন জুড়ে আপনজনের বিভিন্নতা দেখেছি, শুনেছি টিকে থাকার
মূল সুর। ভেসেছি মানুষের বিশ্বাসের সমুদ্রে, ডুবেছি ভালোবাসার গভীরতায়। তবু হাত ছাড়িনি
নিজস্বতার।
এখন
আমার মা বৃদ্ধ হয়েছে। আমাকে আর হাত ধরে নিয়ে যেতে পারে না প্রাণের মেলায়। তবে আমায়
ধরিয়ে দিয়েছে চেতনার হাত। তাই নিশ্চিন্তে থাকতে পারে বন্ধ দরজার আড়ালে। কর্মস্থল
থেকে যখন বাসায় ফিরি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। আমি মুচকি হাসি, মাও
ছড়িয়ে দেয় প্রশান্তির হাসি। মা বুঝতে পারে কর্মস্থলে ছোট্ট হয়েও আমি হাত ধরে আছি
আমার গর্বিত স্পর্ধার - আমার মাতৃভূমি, আমার বন্ধন আর আমার মাতৃভাষা।
ভালো
থেকো মায়ের স্নেহের মতোই অকৃত্রিম সকল মাতৃভাষা।
ভাষা-৬৯
অমর একুশে
আসমত আলী
আধুনিকতার ছোঁয়া
মেখে
দৃষ্টি সুদূর
সম্মুখে।
কর্মব্যস্ত জীবনকে-
পাশ কাটানোর
ফুরসত নেই।
ব্যস্ততার মাঝে নব
উদ্যমে-
সামনে যেতে ক্ষণিকের বিরতি।
হালকা হালকা রসদের সাথে,
হাতে উষ্ণ চায়ের পেয়ালা,
মননে নব চেতনা।
এগিয়ে যাওয়ার উদ্যত আশা,
দূর থেকে ভেসে আসা সুর,
হৃদয় নাড়িয়ে গেল।
" আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো
একুশে ফেব্রুয়ারি,
আমি কি ভুলিতে পারি....?"
হতচকিত হয়ে ভাবি যে,
এ তো একুশের গান,
মায়ের ভাষার টান।
এ যে সেই ফেব্রুয়ারি,
আজ 'ভাষা দিবস'।
স্মৃতিকোণে উঁকি দিল সেই রাজপথ,
একুশের মহা-মিছিল।
মনে পড়ে গেল--
তাজা লাল ছোপ ছোপ রক্তদাগ।
ঢাকার সড়কে ভাইয়ের লাশ।
জন্মের পর ঠোঁটে ধরা বর্ণমালায়,
প্রাণ জাগাতে কী নির্ভীক বলিদান!
"রফিক বরকত জব্বার সালাম"...
বীর শহীদের
আত্মাহুতি মহাপ্রয়াণ ।
মুহূর্তে হাতের পেয়ালা হল চুরমার,
কর্মব্যস্ততা গেলো থমকে।
একঝাঁক তরুণের গগনবিদারি চিৎকার
"বাংলা ভাষা মায়ের ভাষা",--
ভরে গেলো বিমূর্ত হৃদয়।
কারা ওরা?
বর্ণখাদকের দল!
ওদের দাপটে অভিধান ঝালাপালা,
রক্তাক্ত হয়েছে বাংলামায়ের পাঠশালা।
সম্মুখে সব যেন আবছায়া ঝাপসা।
স্বাধীনতার বুকে আজ অনিশ্চিত,
একান্ত মানবিক ভাষার অধিকার।
একুশ তুমি বেঁচে আছো বেঁচে রবে,
বাঙালির হৃদয় কোণে দুর্নিবার,
বিপ্লবের বর্ণে বর্ণে, উঠবে জেগে বারবার।
অমর একুশ তোমাকে ভুলিনি,
তুমি বেঁচে থাকবে চিরকাল--
বাংলা মায়ের অন্তরে।
ভাষা-৭০
ভাষার জন্য
চৈতন্য দাশ
ভাষার জন্য আমরা ছিলাম
ভাষার জন্য আছি,
ভাষাই আমার শ্বাস-প্রশ্বাস
ভাষার জন্য বাঁচি।
ভাষার জন্য তুমি আমি
পাশাপাশি বসি
হাসি কাঁদি একই সঙ্গে
নিয়ে পাড়া-পড়শি।
তোমার কথা আমার কথা
সবই ভাষার জন্য,
ভাষাই সঠিক মানুষ গড়ে
ভাষায় জীবন ধন্য।
ভাষার জন্য মিষ্টি কথায়
মনের আবেগ-বুলি
সবার সামনে নিজের মতো
সাজিয়ে আমি তুলি।
সে যে আমার বাংলা ভাষা
বাংলা মায়ের হাসি,
এই ভাষাতেই রঙিন স্বপ্ন
দেখতে ভালোবাসি।
বাংলার ভবিষ্যৎ
রাজীব চক্রবর্তী
সময় লাগবে শুষে নিতে নতুন পরিবেশ
সময় লাগবে কথা ফুটতে।
যে ছেলেটা ক্যাসেটের স্টলে হতাশ সুরে
বলেছিল, “সব বাংলা!”
সেও প্রিয়তর ভাষায় পদে পদে হোঁচট খাবে
যতই গান শুনুক সিনেমা দেখুক বোকা
বাক্সে ডুবে থাকুক।
যিনি বলেছিলেন, “বাংলা না শিখলেও চলে”
আর যে বলেছিল, “বাংলা শিখে কোনো
লাভ নেই”
তাদের দশাও তথৈবচ
যদিও তারা উল্টোটাই জানে।
হৃতবৈচিত্র্য দেশে ষাট শতাংশ মানুষ
শতক দুয়েক বোবা হয়ে থাকবে
সময় লাগবে অন্য ভাষায় কথা ফুটতে।
ভাষা-৭২
একুশ মানে
পার্বতী শংকর রায় চৌধুরী
একুশ মানে উদাস দুপুর স্বপ্নভাঙা ঝড়
একুশ মানে পদ্মা মেঘনার উষ্ণ শীতল চর
একুশ মানে পলাশ পদ্মের আবীর আবীর খেলা
একুশ মানে পুষ্পরাগে ভ্রমর বসা দুইবেলা
একুশ মানে এক বুক আনন্দ নিয়ে অনাবিল হাসি হাসা
একুশ মানে বাংলার কৃষ্টি আর বাংলাকে ভালোবাসা
একুশ মানে দুষ্টু ছেলের ভরদুপুরে ছুট
একুশ মানে ভাই বোনেদের সারাদিন খুনসুট '
একুশ মানে বোলান বাউল আলকাপ ভাটিয়ালি
একুশ মানের রক্তে ভেজা রাজপথ চোরাগলি
একুশ মানে বাবার আদর মায়ের ভালোবাসা
একুশ মানে শপথ নেওয়া , শিকড় ছোঁয়ার আশা,
একুশ মানে স্বাধিকার চাওয়া জীবনটা বাজি রেখে
যেমন রেখেছে বরকত রফিক লাঞ্ছিতা মাকে দেখে ৷
ভাষা-৭৩
ভাষা নিয়ে একটি অভিজ্ঞতা
চন্দ্রমা মুখার্জী
এখন ফেব্রুয়ারী মাস, এই মাসেরই ২১ তারিখ
সারা বিশ্বে পালিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বাংলা ভাষা বাঁচিয়ে রাখার আন্দোলন
ও সেই আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে সারা বাংলায় দিনটি পালিত হয়। অথচ এই ফেব্রুয়ারী মাসেই
এমন একটি ঘটনার কথা জানতে পারলাম, যা অত্যন্ত লজ্জাজনক একজন বাঙালির পক্ষে। সেই ঘটনার
কথাই আজ জানাতে চাই।
পাত্রী নির্বাচন করতে এক পাত্র ও তার মা
পাত্রীর বাড়ি এসেছে। পাত্রের মা স্বঘোষিত আধুনিকা। সেই আধুনিকা নারী পাত্রীকে এসে জিজ্ঞাসা
করে ‘তুমি ইংলিশ বলতে পারো? Then speak in English’। যেন পাত্রী কোথাও চাকরির ইন্টারভিউ
দিতে গিয়েছে।
পাত্রী যথেষ্ট শিক্ষিতা। সে একটি বড় আইটি
কোম্পানিতে কর্মরতা। কিন্তু তার যোগ্যতা নাকি বিচার হবে তার ইংরাজী বলার ক্ষমতার মাপকাঠিতে।
পাত্রী যথেষ্ট ভালো ইংরাজী বলতে জানে। কিন্তু সে প্রতিবাদী অথচ ভদ্র। তাই সে ভদ্রতা
করে কোনরকম বিরূপ মন্তব্য প্রকাশ করেনি। কিন্তু প্রতিবাদস্বরূপ সব কথাই বাংলাতেই বলেছে।
ঘটনাটা কতটা লজ্জাজনক আপনারাই ভেবে দেখুন।
একজন মানুষ ছেলের জন্য পাত্রী দেখতে এসেছে নাকি চাকরির ইন্টারভিউ নিতে এসেছে। আজ থেকে
৫০-৬০ বছর আগেও শুনেছি পাত্রপক্ষ পাত্রী দেখতে এসে বলেছে, তুমি হেঁটে দেখাও, তোমার
চুল খুলে দেখাও। কিন্তু এই স্বঘোষিত আধুনিকা নারীর শুধু মুখেই ইংরাজী বুলি ফুটেছে।
মনটা এখনো সেই আগের যুগের মতোই পঙ্কিল হয়ে আছে।
এর থেকে দুটো জিনিসই বোঝা যায়। আমরা বাঙালিরা
একদিকে যেমন আধুনিকমনস্ক বলে নিজেদের জাহির করছি, আসলে তা নয়, পুরোটাই চাকচিক্য ও বাহার।
অন্যদিকে আমরা নিজের মাতৃভাষাকেই ভালোবাসছি না। উল্টে আবার অন্যের বলা ভাষাকে ব্যঙ্গ
করছি। এতে করে নিজের মাতৃভাষা ও অন্যের মাতৃভাষা – দুই ভাষাকেই অপমান করছি।
আমরা একদিকে গান গাইছি – ‘মোদের গরব মোদের
আশা, আ মরি বাংলা ভাষা।‘ ‘আমি বাংলায় গান গাই’ – গানের
রচয়িতা প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে শোক পালন করছি। কিন্তু মন থেকে নিজেদের মাতৃভাষাকেই
সম্মান করছি না। যতদিন না আমরা নিজের ভাষাকে সম্মান করছি ততদিন আমরা অন্য কোন ভাষাকেও
সম্মান করতে পারব না। মাতৃভাষা দিবস পালন যেন একটি নির্দিষ্ট দিনেই আটকে থাকছে। মাতৃভাষাকে
যথাযোগ্য সম্মান দিয়ে বাঁচাতে হলে আমাদেরই এগিয়ে আসতে হবে।
=====================================
ভাষা
অঞ্জন সেন
দাঁড়াও পথিক
যদি তোমার জন্ম হয় এই গৌড়বঙ্গে
যদি তুমি শুনে থাকো
পদাবলী
মঙ্গল
পাঁচালী প্রসাদী মধু
রবীন্দ্র
তিলেক দাঁড়াও
বন্যা সুফলা খরা দেশে তোমার জন্ম যদি হয়।
তুমি বলবে
ভাষা আমার চতুর্দিকে
তবু তোমার কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে
যেহেতু তুমি বলতে পার না ভাষা আমার
আমাকে বলতে দাও
তুমি বলতে পার না তবু
তোমার মধ্যে আউলে উঠছে ভাষা
বাংলা ভাষা
যখনই তুমি বলতে যাচ্ছ ভাষা আমার
তুমি হারিয়ে ফেলছ কণ্ঠ বাহু জিভ
দাঁড়াও পথিক
দাঁড়াও তিলেক
বলে আশাই তো মাতৃভাষা
प्राथमिक शिक्षामा मातृभाषाको महत्व
राजु घिसिङ
"मातृभाषा भनेको त्यो भाषा हो जुन बच्चाले आफ्नो आमाको कोखबाटै सुन्दै आएका हुन्छन् ,जन्मेपछि सुन्न पाउँ
छ र हाम्रा भावना र विचारहरूलाई निश्चित आकार दिन मद्दत गर्छ।" मातृभाषा महत्त्वपूर्ण छ किनकि यसले तपाईंलाई आफ्नो अस्तित्व , आफ्नो संस्कृतिसँग जोडेर राख्छ।
कुनै पनि व्यक्तिले सिकेको प्राथमिक भाषालाई उसको मातृभाषा भनिन्छ। कुनै पनि व्यक्तिलाई उसले बोल्ने भाषाबाट वर्णन गर्न सकिन्छ।भाषा सिक्नुको मुख्य उद्देश्य भनेको मानिसहरूलाई आफ्नो विचार व्यक्त गर्न सक्षम बनाउनु र अरूसँग आफ्नो विचार साझा गर्नु हो।मातृभाषा नियमित रूपमा बच्चालाई आमाबाबु वा उनीहरूको आफ्नै परिवारका सदस्यहरूबाट हस्तान्तरण गरिन्छ। भाषाको ज्ञान प्राप्त गर्नाले सानो बच्चालाई त्यो क्षेत्र पत्ता लगाउनर आफूलाई अभिव्यक्त गर्न धेरै नयाँ अवसरहरू खोल्छ। मातृभाषा वा मातृभाषा व्यक्तिको पालनपोषणमा एक आवश्यक पक्ष पनि हो किनकि यसले संसारलाई बुझ्ने तरिका र अरूलाई आफ्नो भावना व्यक्त गर्ने तरिकालाई आकार दिन्छ। बच्चाहरूले जे देख्छन् वा सुन्छन् त्यसको नक्कल गर्छन्। आफ्ना आमाबाबुको नक्कल गरेर आफ्नो मातृभाषा सिकेकाले शिशुहरू छिटो सिक्ने हुन्छन्।पहिचानको लागि महत्त्वपूर्ण छ।
प्राथमिक विद्यालयमा बालबालिकालाई उनीहरूको मातृभाषामा पढाउनु शैक्षिक प्रदर्शन, संज्ञानात्मक विकास र सांस्कृतिक म बनाउनु हो। मातृभाषा सिक्नुको मुख्य कारण यो हो कि हामी संसारको जुनसुकै ठाउँबाट पनि आफ्नो भूमि, आफ्नो संस्कृतिसँग जोडिन सक्छौं
शैक्षिक प्रदर्शन
आफ्नो मातृभाषामा सिक्ने बालबालिकाहरूले लामो समयसम्म शैक्षिक रूपमा राम्रो प्रदर्शन गर्छन्।
उनीहरूले पठन र लेखनमा बलियो जग विकास गर्छन्, जसले उनीहरूलाई अन्य विषयहरूमा उत्कृष्ट हुन मद्दत गर्छ। उनीहरूले आफ्नो दोस्रो भाषामा पनि राम्रो प्रदर्शन गर्ने गर्छन्।
संज्ञानात्मक विकास
मातृभाषामा सिकाइले बच्चाहरूलाई बलियो संज्ञानात्मक सीपहरू विकास गर्न मद्दत गर्छ, विशेष गरी
आलोचनात्मक सोच, समस्या समाधान र रचनात्मकतामा। यसले उनीहरूलाई दोस्रो भाषा अझ सजिलै सिक्न पनि मद्दत गर्छ।
सांस्कृतिक पहिचान
आफ्नो मातृभाषामा सिकाइले समुदायको सांस्कृतिक पहिचानको संरक्षण र प्रवर्द्धन गर्न मद्दत गर्छ। यसले आत्म-मूल्य र सांस्कृतिक पहिचानको भावनालाई बढावा दिन्छ।
समावेशीकरण
समावेशीकरण र गुणस्तरीय सिकाइको लागि मातृभाषामा आधारित शिक्षा एक प्रमुख कारक हो। यसले सबै शिक्षार्थीहरूलाई समाजमा पूर्ण रूपमा सहभागी हुन सशक्त बनाउँछ। राष्ट्रिय शिक्षा नीति, २०२० मा सबै विद्यालयहरूमा कक्षा ५ सम्मको शिक्षाको माध्यम मातृभाषा हुने उल्लेख छ। यसकारण प्राथमिक शिक्षामा मातृभाषाको महत्व अत्यन्तै ज्यादा छ।आफ्नो घरमा बोलिने भाषामा शिक्षा ग्रहण गर्न पाउनु शिशुहरुको निम्ति अत्यन्त सहज र लाभकारी हुनेछ।
নেপালি ভাষায় লিখিত
মাতৃভাষা দিবস
ভাগ্যধর মল্লিক
"জানেন দাদা , আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না"
।
বাংলা ভুলে গেছে বলে এখন কেহই হাসে না ।
বলুন তো ভাই , কি যায় আসে ,
আর এন টেগোর টুডে যদি কেঁদেই ভাসে ।
বেঙ্গলিরা এখন নাকি বাংলা ভালো বাসেই না ।
বাংলায় গান শুনে কেহ নাচের তালে ভাসেই না ।
বাংলা পোয়েম ট্রান্সেলেট করে
দরকার কি ছিল ওঁর নোবেল প্রাইজ আনা ?
স্বাধীন দেশটা ছেড়ে দেবে মায়ের ভাষা -
সেদিন ওঁর উচিৎ ছিল এটা জানা ।
'মোদের গরব , মোদের আশা
আ মরি বাংলা ভাষা' -
এই গানেতে এখন কেহ আগের মত মজে না ।
বাংলায় গান গাইতে হবে - এই বলে আর যোঝে না ।
বাংলা জেনে কী লাভ বলো , - কেন যে কেউ বোঝে না !
দেশ বিদেশের ডিগ্রি বল ,
উঁচু পদের চাকরি বল -
বাংলাভাষী মানুষকে আজ স্বাধীন ভারত খোঁজে না ।
হায় বাঙালি ,
রবির সুরে নেচে গেয়ে আনন্দ আর হচ্ছে না ?
মায়ের ভাষায় কথার মজা কেহই কেউ কি আর পাচ্ছে না ?
বাংলা ভাষা করে আশা
সন্তানদের ভালোবাসা ,
পরের ভাষায় কথা যে তার মিষ্টি তেমন লাগছে না ।
হায় একুশে ফেব্রুয়ারি
আজ তোমাকে স্মরণ করি ,
শহীদ বেদি সাজিয়ে ফুলে নেচে গেয়ে শহীদ বরি ।
দুদিন বাদেই সব ভুলে যাই ,
ড্যাড মম্ কে রাইম শোনাই ,
ঝরে পড়া 'মা'য়ের অশ্রু নাহি পড়ি ।
তবু একুশে ফেব্রুয়ারি ,
ভুলতে তোমায় নাহি পারি ।
ভাষার জন্য রক্ত ঝরা-
দেখি যখন নয়ন বুজে
ঝরতে থাক অশ্রুবারি
।
শৈশবের বর্ণমালা
সুরভি চট্টোপাধ্যায়
কুল ছাপানো জলে
ভাসতে ভাসতে
আমি যখন সীমান্ত ঘেঁষে...
প্রতিটি বিভাজনের ইশারায়
খুলে যাওয়া চোখে জানলাম
এই দেশ
এই তুমুল বাতাস
এই নদীমাতা
কোনোটি-ই ঈশ্বর নয়...
ডুবলাম...আরো ডুবলাম চেতনাহীনতার সমস্তরকম আশ্বাসে...
আর আমার অপরাহ্নের স্পন্দনে
প্রাণ জাগাতে এগিয়ে এলো
শৈশবের বর্ণমালা...
হিম পাথরের পাত্রে রাখল জীবনের সংলাপ...
নালিশ
অমিতাভ
বিদ্যাসাগর
শুনছি তোমার দয়া ছিল ভারি একটা-দুটো দুঃখ তোমায় বলতে আমি পারি?
ইংরাজিটা
প্রথম ভাষা হিন্দি দুয়ের স্থানে
বাংলা
ভাষার জায়গা কোথায় কি জানি কে জানে?
অ
আ ক খ দেখতে আমার ভীষণ লাগে ভালো
কালোর
মধ্যে ওরা যেন ছড়িয়ে রাখে আলো!
বিদ্যাসাগর
আমার বাবা-মাকে স্বপ্ন দাও
ওদের
মনের নদীর স্রোতে ভাসুক বাংলা নাও।
আজ একুশে
দীপক আঢ্য
সবাই জানে একুশ মানে মা ভাষার আজ দিন
আমরা জানি কত লড়াই কত ভাষা-শহীদের ঋণ
একুশ প্রাণের স্বাধীনতা একুশ মুখের ভাষা
একুশ এলেই গর্বে বুঝি আন্তর্জাতিক ভাষা
আমার ভায়ের রক্তে লেখা একুশে ফেব্রুয়ারি
আমার ভাষা বাংলা ভাষা আমি গর্বিত অহংকারী
আজকে আমার রফিক সালাম বরকত আর জব্বারেরা
ভাষা শহীদ আরও যারা বিশ্বজুড়ে বন্দিতেরা
বেহেস্ত থেকে দেখছে বুঝি মা ভাষারই উল্লাসে
আমরা যারা নিজের ভাষায় স্বপ্ন দেখি উচ্ছ্বাসে
একুশ আমার মুখের ভাষা-- স্বপ্ন আশা ভালোবাসা
এই একুশে বিশ্বজুড়ে শ্রদ্ধা জানাই মাতৃভাষা!
ভাষাদিবসের কবিতা
আবীর ভট্টাচার্য চক্রবর্তী
আশ্রয়সুখ ঢের কেড়েছ, ভাঙনে নেই ভয়
আলোক মেঘে এঁকেছি আমার আখর পরিচয়।
চক্রাকার ধুম্রজালে খ্যাতি বিড়ম্বনা,
যাপনব্যথা অতিক্রমী বিজন সান্ত্বনা
বর্জিত সে বর্ণমালার বিস্তৃত অক্ষরে
আমার সত্ত্বা প্রকাশ হোক জন্ম জন্ম ধরে।
ফুরোলে কথা প্রয়োজনের; ন্যস্ত বিনির্মাণ
পাখিঠোঁটের আহার্য দেয় ঘরে ফেরার মান
অকস্মাৎ দুইটি ফোঁটা চোখের জলে ভেজে
শৈশবসুখ-পাঠশাল-ধুন স্মৃতির মন্তাজে
উথলে ওঠে অযুত প্রেমে মাতৃভাষা টান
ভাষাশহীদ রক্তে ভাসে আজও কিশোর প্রাণ
রস মাধুরী সৃষ্টিসুখে, জীর্ণ পাতা ঝরে
অভিযোজনে, বিস্মরণে, নিজেকে মনে পড়ে।
সুসংহত অহংবোধ, তার আরব্ধ দায়
আলোক মেঘমায়ায় আঁকে স্বকীয় বরাভয়।
ভাঙনে তাই নেই তো ভয়, মিলে থাকার ঋণ
মাতৃভাষা- মাতৃদুগ্ধ…লালন শর্তহীন।
অমর ২১শে ফেব্রুয়ারী বাঙ্গালীর বাংলা ভাষা দুর্জয় দিবস
বটু কৃষ্ণ হালদার
২১
শে ফেব্রুয়ারি এলেই আব্দুল গাফফার চৌধুরীর সেই মর্মস্পর্শী গানের কথা মনে পড়ে যায়:_"আমার
ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি
কি ভুলিতে পারি
ছেলেহারা
শত মায়ের অশ্রু-গড়া এ ফেব্রুয়ারি
আমি
কি ভুলিতে পারি
আমার
সোনার দেশের রক্তে রাঙানো ফেব্রুয়ারি
আমি
কি ভুলিতে পারি"।
শুধু
বাঙালি নয়, বিশ্বের প্রতিটি জাতির মাতৃভাষার মর্যাদা, স্বাধিকার, স্বাধীনতা ও মানুষের
মতো বাঁচার দাবির সংগ্রামের দুর্জয় অনুপ্রেরণা সৃষ্টির চির অনির্বাণ শিখার দীপ্তিতে
দিগন্ত উদ্ভাসিত করেছে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’।
‘একুশে
ফেব্রুয়ারি’ এদেশের মানুষকে শিখিয়েছে আত্মত্যাগের মন্ত্র, বাঙালিকে করেছে মহীয়ান।
সমগ্র
বিশ্বের ইতিহাস জানে ভাষা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে একটি দেশের জন্ম হয়েছিল তার নাম বাংলাদেশ।
আর ভাষাটির নাম হল সমগ্র বাঙালি জাতির প্রাণের ভাষা বাংলা ভাষা। আর সেই বাঙালিদের উপর
পাকিস্তানি হায়নাদের চাপিয়ে দেওয়া ভাষাটার নাম ছিল উর্দু।জাত ধর্ম নির্বিশেষে আপামর
বাঙালি জনসাধারণ পাকিস্তানীদের জোর করে চাপিয়ে দেওয়া উর্দুভাষা মেনে নেয়নি। যার
ফলে ভাষা আন্দোলন তৎকালীন সময় অর্থাৎ ১৯৫২ সালে ব্যাপক রূপ ধারণ করে।দাবালনের আগুনের
ফুলকির মতো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।সেই আন্দোলন রুখতে তৎপর হয়ে পড়ে পাকিস্তানিরা।
কিন্তু বাঙালির প্রাণের বাংলা ভাষা কেড়ে নিতে পারেনি তাদের মুখ ও মন থেকে।
কি
ছিল সেই ইতিহাস তা একটু জেনে নেওয়া দরকার।
১৯৪৭
সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান অধিরাজ্য ও ভারত
অধিরাজ্য নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। পাকিস্তানের ছিল দুইটি অংশ: পূর্ব
বাংলা (১৯৫৫ সালে পুনর্নামাঙ্কিত পূর্ব পাকিস্তান) ও পশ্চিম পাকিস্তান। প্রায় দুই
হাজার কিলোমিটারের (প্রায় ১২৪৩ মাইল) অধিক দূরত্বের ব্যবধানে অবস্থিত পাকিস্তানের
দুটি অংশের মধ্যে সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও ভাষাগত দিক থেকে অনেকগুলো মৌলিক পার্থক্য বিরাজমান
ছিল। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান অধিরাজ্য সরকার পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলাকে ইসলামীকরণ
তথা আরবিকরণের অংশ হিসেবে ঘোষণা করে যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা,
পাশাপাশি বিকল্প হিসেবে আরবি হরফে বাংলা লিখন অথবা সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা আরবি
করারও প্রস্তাব দেওয়া হয়। আবার, সমগ্র পাকিস্তানের সকল ভাষা লাতিন হরফে লেখার মাধ্যমে
বাংলার রোমানীকরণের প্রস্তাবও করা হয়। এসকল ঘটনার প্রেক্ষাপটে পূর্ব বাংলায় অবস্থানকারী
বাংলাভাষী সাধারণ জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভের জন্ম হয় ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি
করে। কার্যত পূর্ব বাংলার বাংলাভাষী মানুষ আকস্মিক ও অন্যায্য এ সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে
পারেনি এবং মানসিকভাবে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ফলস্বরূপ বাংলাভাষার সম-মর্যাদার দাবিতে
পূর্ব বাংলায় আন্দোলন দ্রুত দানা বেঁধে ওঠে। আন্দোলন দমনে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে
ঢাকা শহরে মিছিল, সমাবেশ ইত্যাদি বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
১৯৫২
সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি (৮ই ফাল্গুন ১৩৫৮) এ আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
বহু সংখ্যক ছাত্র ও প্রগতিশীল কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি
ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের
ওপর গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে নিহত হন বাদামতলী কমার্শিয়াল প্রেসের মালিকের ছেলে রফিক,সালাম,
এম. এ. ক্লাসের ছাত্র বরকত ও আব্দুল জব্বারসহ আরও অনেকে। এছাড়া ১৭ জন ছাত্র-যুবক আহত
হয়। শহীদদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়ে ওঠে। শোকাবহ এ ঘটনার অভিঘাতে সমগ্র পূর্ব বাংলায়
তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ২১শে ফেব্রুয়ারির ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে সারাদেশে বিদ্রোহের
আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। ২২শে ও ২৩শে ফেব্রুয়ারি ছাত্র, শ্রমিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী,
শিক্ষক ও সাধারণ জনতা পূর্ণ হরতাল পালন করে এবং সভা-শোভাযাত্রাসহ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে।
২২শে ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহীদ হন শফিউর রহমান শফিক, রিক্সাচালক আউয়াল এবং
অলিউল্লাহ নামক এক কিশোর।২৩শে ফেব্রুয়ারি ফুলবাড়িয়ায় ছাত্র-জনতার মিছিলেও পুলিশ
অত্যাচার-নিপীড়ন চালায়। এ নির্লজ্জ, পাশবিক, পুলিশি হামলার প্রতিবাদে মুসলিম লীগ
সংসদীয় দল থেকে সেদিনই পদত্যাগ করেন। ভাষা আন্দোলনের শহীদ স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার
জন্য মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে রাতারাতি ছাত্রদের দ্বারা গড়ে ওঠে শহীদ মিনার,
যা ২৪ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধন করেন শহীদ শফিউর রহমানের পিতা। ২৬শে ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে
শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেন দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন।
ক্রমবর্ধমান
গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করতে বাধ্য
হয় এবং ১৯৫৪ সালের ৭ই মে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত
হয়।১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে ২১৪ নং অনুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দুকে
পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লিখিত হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে একমাত্র
রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা প্রবর্তিত হয়। সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ
সরকার ১৯৮৭ সালে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন জারি করে। ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর বাংলা
ভাষা আন্দোলন,মানুষের ভাষা এবং কৃষ্টির অধিকারের প্রতি সম্মান জানিয়ে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে যা বৈশ্বিক পর্যায়ে সাংবার্ষিকভাবে গভীর
শ্রদ্ধা ও যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে উদ্যাপন করা হয়।
এবার
আসা যাক আসামের শিলচরে বরাক উপত্যকায় ভাষা আন্দোলনের প্রসঙ্গে।এখানের ইতিহাস
বলছে বহু যুগ ধরে বসবাসকারী বাংলা ভাষা সংস্কৃতি বুকের মাঝে বাঁচিয়ে রেখে ছিল বরাক
উপত্যকার বাঙালিরা।কিন্তু আসাম সরকার তাদের উপর জোর করে অসমীয়া
ভাষা চাপিয়ে দিচ্ছিলেন।কিন্তু আপামর বাঙালিরা অসমিয়া ভাষা মেনে নেয় নি।কারণ রক্তে
মিশে আছে বাংলা ভাষা,সংস্কৃতির মূলমন্ত্র।শুরু হয় আন্দোলন।১০ অক্টোবর, ১৯৬০ সালের
সেই সময়ের অসমের মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চলিহা অসমীয়াকে আসামের একমাত্র সরকারী
ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়ার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। উত্তর করিমগঞ্জ-এর বিধায়ক রণেন্দ্রমোহন
দাস এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু ২৪ অক্টোবর প্রস্তাবটি বিধানসভায়
গৃহীত হয়।বরাক উপত্যকার বাঙালিদের ওপরে অসমীয়া ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ
করতে ১৯৬১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে কাছাড় গণ সংগ্রাম পরিষদ নামক সংগঠনটির জন্ম
হয়। আসাম সরকারের এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে ১৪ এপ্রিল তারিখে শিলচর, করিমগঞ্জ আর হাইলাকান্দির
লোকেরা সংকল্প দিবস পালন করেন । বরাকের জনগণের মধ্যে সজাগতা সৃষ্টি করার জন্য এই পরিষদ
২৪ এপ্রিল একপক্ষ দীর্ঘ একটি পদযাত্রা শুরু করেছিল। ২ মে তে শেষ হওয়া এই পদযাত্রাটিতে
অংশ নেওয়া সত্যাগ্রহীরা প্রায় ২০০ মাইল উপত্যকাটির গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রচার চালিয়েছিলেন।
পদযাত্রার শেষে পরিষদের মুখ্যাধিকারী রথীন্দ্রনাথ সেন ঘোষণা করেছিলেন যে, যদি ১৩ এপ্রিল,১৯৬১
সালের ভিতর বাংলাকে সরকারী ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা না হয়, ১৯ মে তে তারা ব্যাপক হরতাল
করবেন। ১২ মে তে অসম রাইফেল, মাদ্রাজ রেজিমেন্ট ও কেন্দ্রীয় সংরক্ষিত পুলিশ বাহিনী
শিলচরে ফ্ল্যাগ মার্চ করেছিল।১৮ মে তে অসম পুলিশ আন্দোলনের তিনজন নেতা নলিনীকান্ত দাস,
রথীন্দ্রনাথ সেন ও বিধুভূষণ চৌধুরী (সাপ্তাহিক যুগশক্তির সম্পাদক)-কে গ্রেপ্তার করে।১৯
মে তে শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতে হরতাল ও পিকেটিং আরম্ভ হয়। করিমগঞ্জে আন্দোলনকারীরা
সরকারি কার্যালয়, রেলওয়ে স্টেশন, কোর্ট ইত্যাদিতে পিকেটিং করেন। শিলচরে তারা রেলওয়ে
স্টেশনে সত্যাগ্রহ করেছিলেন। বিকেল ৪টার সময়সূচির ট্রেনটির সময় পার হওয়ার পর হরতাল
শেষ করার কথা ছিল। ভোর ৫:৪০ এর ট্রেনটির একটিও টিকিট বিক্রি হয় নি। সকালে হরতাল শান্তিপূর্ণ
ভাবে অতিবাহিত হয়েছিল। কিন্তু বিকালে স্টেশনে অসম রাইফেল এসে উপস্থিত হয়।
বিকেল
প্রায় ২:৩০র সময় ন'জন সত্যাগ্রহীকে কাটিগোরা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের একটি ট্রাক
তারাপুর স্টেশনের (বর্তমানের শিলচর রেলওয়ে স্টেশন) কাছ থেকে পার হয়ে যাচ্ছিল । পিকেটিংকারী
সকলে তাদেরকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যেতে দেখে তীব্র প্রতিবাদ করেন। ভয় পেয়ে ট্রাকচালক
সহ পুলিশরা বন্দীদের ফেলে পালিয়ে যায়। এর পর কোনো অসনাক্ত লোক ট্রাকটি জ্বালিয়ে
দেয়, যদিও জনগণের তৎপরতার সাথে সাথে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। তারপর প্রায় ২:৩৫ নাগাদ
স্টেশনের সুরক্ষায় থাকা প্যারামিলিটারি বাহিনী আন্দোলনকারীদেরকে বন্দুক ও লাঠি দিয়ে
মারতে শুরু করে। এরপর সাত মিনিটের ভিতর তারা ১৭ রাউণ্ড গুলি আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য
করে চালায়।অনেক লোকের দেহে গুলি লেগেছিল। তাদের মধ্যে ন'জন সেদিনই নিহত হয়েছিলেন;
দু'জন পরদিন শহিদ হন। ২০ মে তে শিলচরের জনগণ শহিদদের শবদেহ নিয়ে শোকমিছিল করে প্রতিবাদ
সাব্যস্ত করেছিলেন।এই ঘটনার পর অসম সরকার বরাক উপত্যকায় বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসাবে
ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।একইভাবে সংঘটিত হয়েছিল মানভূমের ভাষা আন্দোলন।
ইতিমধ্যে
বিশ্বের সবথেকে সুন্দর ও সুমধুর ভাষার তকমা জুটেছে বাংলাভাষার কপালে। ইউনেস্কোতে নিজের
জায়গা পাকা করেছে বাঙালির হৃদয়ের ভাষা।কিন্তু বাংলা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস গভীর ভাবে
অনুধাবন করলে বোঝা যায় এই ভাষা বিশ্বের ইতিহাসে সব থেকে বেশি অসহায় আর বিপন্ন।তার কারণ
ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস বাংলা ভাষা ছাড়া অন্য ভাষার ক্ষেত্রে অসহায় ও বিপন্ন হয়ে আন্দোলন
হয়েছে কি? মুখের ভাষা, মনের ভাষা সাহিত্যের ভাষা বাঁচিয়ে রাখতে কোন রক্তপাত ঘটেছে?
বর্তমান
সময়ে এসেও এই বাংলায় জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে হিন্দি ভাষা।কিন্তু ভারত কোন নির্দিষ্ট
ভাষার দেশ নয়।এই দেশ তো ভিন্ন ভাষা,ভিন্ন ধর্মের মহামিলনক্ষেত্র তা ভুলে গেলে চলবে
না।হিন্দি ভাষা আগ্রাসনের পর এই বাংলায় উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার প্রয়াস চলছে।
তবে
মনে রাখতে হবে একুশে ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান স্বৈরাচারী শাসকদের ভাষা নীতির প্রতিবাদে
বাংলা ভাষা অধিকার প্রতিষ্ঠাতায় শহীদ হয়ে তরুণ ভাষা সৈনিকরা যে ইতিহাস রচনা করেছিল
সেই গৌরবগাথা সাহস যুগিয়েছিল ৬১'র ভাষা আন্দোলনকে। তাই একুশে ফেব্রুয়ারির প্রেরণা
শুধুমাত্র ওপার বাংলার বাংলা ভাষা সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখে তা নয় যখনই বাংলা ভাষা
মুখের থেকে কেড়ে নেওয়ার প্রয়াস হয়েছে বাংলা ভাষা অস্তিত্ব বিপন্ন হয়েছে তখনই একুশে
ফেব্রুয়ারি, ভাষা আন্দোলনকারীদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। তাই বর্তমান সময়ে নয় অতীতে
এবং আগামী ভবিষ্যতেও বাঙালিদের ভাষা সংস্কৃতি উপর কারো দখলদারি বাঙালি সমাজ মেনে নেবে
না। যদি দরকার হয় তার জন্য আরও একটা ভাষা আন্দোলন গড়ে তুলবেই নিজের ভাষাকে বাঁচিয়ে
রাখতে। বাংলা উন্মুক্ত ছিল বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য, বর্তমানে আছে এবং আগামী ভবিষ্যতেও
থাকবে।এখানে হিন্দি,উর্দুর প্রভাব কোনমতেই মেনে নেবে না।
ভাষা-৮২
ভাষায় প্রকাশ
তরুণ চ্যাটার্জী
ভাষার
কি বাবা-মা হয় !
জানিনে
বাপু ।
শুধু
জানি যে শব্দ দিয়ে মনের ভাবখানার প্রকাশ ঘটে সেটাই ভাষা ।
তোমাদের
কাছে ভাষার কি রঙ হয় জানিনে।
আমার
কাছে ভাষার রঙ কখনো সাদা কখনো কালো ।
শিশু
যখন মা বলে ডাকে ,
নামতা
পড়ে , কিম্বা খেলার ছলে গল্প বলে ,
তখন
সাদা রঙের ভাষা ফুটে উঠে তার ঠোঁটের ফাঁকে
।
ভাষা
কালো রঙ ধরে তখন ,
যখন
নেতা-নেত্রী মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেয় , পরে
উল্টো পথে চলে , অন্যের কাঁধে বন্দুক রাখে
আর নিজে শিকার করে তখন ভাষা হয় কালো ।
ভাষারা
কখনো রক্তিম মনে হয়
যখন প্রতিবাদ হয় ,
দাবি
আদায় করতে পথ চলে মিছিল , দৃপ্ত হয় কণ্ঠ , মুষ্টিবদ্ধ হয় হাত , জোট বাঁধে মানুষ তখন ভাষা হয় রক্তিম বর্ণ ।
মানুষ
যখন ভালোবাসে তখনই বোধহয় ভাষা সবুজ রঙ গায়ে মাখে
আর মৃত্যুর সাথে সাথে ভাষা হয় নীল
।
আমার
ভাষা এত রঙ ধরে ।
তোমাদের
ভাষার রঙ কী ?
সবার সেরা বাংলা ভাষা
মেরী খাতুন
১৯৪৭
সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান অধিরাজ্য ও ভারত অধিরাজ্য
নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়।পাকিস্তানের ছিল দুটি অংশ পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম
পাকিস্তান।১৯৪৮ সালে পাকিস্তান অধিরাজ্য সরকার ঘোষণা করে যে,উর্দু-ই হবে পাকিস্তানের
একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এই ঘোষণার প্রেক্ষাপটে পূর্ব বাংলার বাংলাভাষী মানুষ আকস্মিক
ও অন্যায্য এ সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি এবং মানসিক ভাবে মোটেও প্রস্তুত ছিল না।ফলস্বরূপ
বাংলা ভাষার সম-মর্যাদার দাবিতে পূর্ব বাংলার আন্দোলন দ্রুত দানা বেঁধে ওঠে। আন্দোলন
দমনে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে মিছিল,সমাবেশ ইত্যাদি বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষণা
করে।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮-ই ফাল্গুন ১৩৫৮)
এ আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক ছাত্র ও প্রগতিশীল কিছু রাজনৈতিক
কর্মী মিলে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ
১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে । গুলিতে নিহত হন দামাল
ছেলে রফিক,সালাম,শফিক,আব্দুল জব্বার সহ আরোও অনেকে।শহিদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়ে ওঠে।
শোকবহ এই ঘটনার অভিঘাতে সমগ্র পূর্ব বাংলায় তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ২১ ফেব্রুয়ারী ছাত্র
হত্যার প্রতিবাদে সারা দেশে বিদ্রোহের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে।
১৯৫২ সাল, সারা বাংলায় চলেছে একুশের রক্তের
প্রতিবাদ, শ্লোগান, গানে, কবিতায়- "আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি,
আমি
কি ভুলিতে পারি?" এই কবিতাতেই প্রথম বাংলাকে উল্লেখ করা হলো একটি দেশ হিসেবে।
লেখা হল অমর একটি নাম "বাংলাদেশ"।এই
দিনটিকে পরে জাতিসংঘ 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে ঘোষণা করেন।
তবে এখন কি বাংলা ভাষার ঐতিহ্য সম্বন্ধে বাঙালির
যে অতীত গৌরব ছিল তা আছে? বাংলা ভাষাটি আদৌও "মোদের গরব মোদের আশা" আছে?
আমার
মনে হয় যত দিন এগিয়ে আসছে ততই বাংলা ভাষার প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে। কর্পোরেট দুনিয়াতে
ঢোকার আগ্রহ সবার মধ্যে বেড়েই চলেছে। বাংলা ভাষা সত্যিই আজ বিপন্ন নিজ দেশে। আধুনিক
শিক্ষায় শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা বাংলা ভাষার চর্চা বেশিরভাগই করতে আনন্দ পায় না।
ইংরেজি স্কুলগুলোতে পড়াশোনার দৌলতে বিপন্ন
তো কিছুটা বটেই । অনেকের হয়তো বা বাংলা রয়েছে, কিন্তু তাতেও তারা বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব
দেয় না। এক্ষেত্রে মা-বাবা অর্থাৎ অভিভাবকদেরই দোষারোপ করবো। এখন অনেক মা-ই সগর্বে
ঘোষণা করেন আমার সন্তান বাংলা জানে না। সম্ভব হলেও অনেক সময় বাংলাটা শেখান না মা বাবারা।
সেই ব্রিটিশরা যখন আমাদের দেশ শাসন করতো তখন যে ওদের গোলামি করাটা আমাদের অভ্যাসে পরিণত
হয়েছিল, সেটা যেন এখনো পরিবর্তন হয় নি।অথচ তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীর অনেক দেশেই ইংরেজিতে
কথা বলা হয় না। শুধু বাংলায় নয়, বরং এখন সব আঞ্চলিক ভাষাই কোন না কোনভাবে বিপন্ন। এই
প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা যখন একসঙ্গে কথা বলে, তখন বাংলা থেকে ইংরেজী কিংবা হিন্দিতে
কথা বলতেই বেশি পছন্দ করে।সহজে জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা
আজ বেড়েই চলছে। ইংরেজি শিক্ষা পদ্ধতি ছাড়া আমাদের আগামী প্রজন্মের অগ্রগতি সম্ভব নয়-
এটা আজ খুব সহজভাবে উপলব্ধ। কিন্তু মাতৃভাষার প্রতি আমাদের উত্তরসূরিদের আবেগ ও ভালোবাসা
তৈরি করা কি আমাদের কর্তব্যের মধ্যে পরে না? এক্ষেত্রে আমি বলবো মা-বাবার দায়িত্ব অনেক,
মা-বাবা যদি সন্তানদের শিক্ষিত করে তোলেন এবং মাতৃভাষার প্রতি সন্তানকে শ্রদ্ধাশীল
করে তুলতে পারেন তবে অবশ্যই আমাদের মাতৃভাষার অনেক উন্নতি হতে পারে ।
আমরা ছোট ছোট বাচ্চাদের আজ আর,
'সকালে
উঠিয়া আমি মনে মনে বলি,
সারাদিন
আমি যেন ভালো হয়ে চলি'।
শেখাই
না,আমরা শেখাই ইংরেজি কবিতা।
শিশুকাল
থেকেই তাদের আমরা ইংরেজি বিলাসী তৈরি করি। রবি ঠাকুরের 'মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধসম' কথাটা
আজকাল আমরাই ভুলতে বসেছি। ছোটদের আর কি দোষ দেব? আমরা মাতৃভাষার অধিকার পেয়েছি রক্তের
অক্ষরে। মাতৃভাষা চর্চার মধ্যেই লুকিয়ে আছে আমাদের প্রাণ ভোমরা। আমরা যদি ছোট থেকেই
আমাদের বাচ্চাদের ইংরেজি শিক্ষার পাশাপাশি মায়ের ভাষাকে ভালোভাসতে শেখাই, অ-এ অজগর
আসছে তেড়ে শেখাই, বাংলা বারো মাসের নাম, ছয় ঋতুর নাম, বাংলা তিথিগুলোর নাম শেখাই, সাতভাই
চম্পা, রামায়ণ, মহাভারত, বিশ্ব নবীর কাহিনী, বিষাদ সিন্ধু কিংবা বাংলার মনীষীদের পাঠ
দিই, তবে আশা করি বাঙালির ইংরেজি প্রীতিতে ভাঁটা পড়বে না। কারণ বাংলাকে অর্থাৎ মাতৃভাষাকে
মনেপ্রাণে ভালো না বাসলে যে আমরা নিজের মা-বাবাকে মন খুলে ভালোবাসতে পারবো না। আমার
মতে, কোন ভাষাশিক্ষা কোনভাবেই নিন্দনীয় নয়। বরং প্রশংসনীয়। এই পৃথিবীর সঙ্গে তাল মেলাতে
ইংরেজির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে তা অনস্বীকার্য। কিন্তু কোনভাবেই নিজের মাতৃভাষাকে উপেক্ষা
করে নয়। ভাষা তো একটা জাতির পরিচয়। ভাষা হলো পরস্পরের ভাব প্রকাশের মাধ্যম। অন্য ভাষাশিক্ষার
মধ্যে কোন অপরাধ নেই। অপরাধ হচ্ছে নিজের মাতৃভাষাকে সম্মান না করা।
আজও আমরা নববর্ষ-এর দিনে আটপৌরে স্টাইলে দামি
ঢাকাই শাড়ি জামদানি পরি। কপালে বড় টিপ,একটু শাখা সিঁদুর। বাড়িতে বর্ষপূর্তির দিনে জল
খাবারে ফুলকো লুচি আর কালো জিরে,কাঁচা লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে সাদা আলুর চচ্চড়ি আর বেগুন ভাজা
সেই বাঙালিয়ানায় ফুটে ওঠে আমাদের মধ্যে । বাংলা ভাষার ব্যবহার এখন পৃথিবীর এক বৃহত্তম
জনগোষ্ঠীর দ্বারা ব্যবহৃত ভাষা। পৃথিবীর জনসংখ্যার নিরিখে প্রায় ২৩ কোটি মানুষের মাতৃভাষা।
=================================
==================================
ভাষা-৮৪
আমার বাংলা ভাষা
দীপক রঞ্জন কর
ভাব ব্যক্ত করার মাধ্যম
যাকে বলি ভাষা ,
আবেগ মেশানো মন্ত্র
কেবলই মাতৃভাষা।
হৃদয় ছুঁয়ে আসে যে
ভক্তি ভালোবাসা
সরল প্রাণ বিনিময়
একমাত্র মায়ের ভাষা।
যে ভাষাতে মিটে যায়
মনের আশা পিপাসা
আমার গর্ব আমার প্রাণ
আমার বাংলা ভাষা ।
বাংলা ভাষা বাংলা বোল
মনের আদান-প্রদানে,
বাংলার বাদ্য ঢাকঢোল
উৎসব পূজা পার্বণে।
এ ভাষা বলতে সহজ
শুনতে বড়ই সুমধুর,
বাংলা ভাষায় পাই রে
কোমল অনুভূতির সুর ।
কবির ভাষায় মাতৃভাষা
মায়ের দুধের সমান,
এই ভাষা রক্ষার স্বার্থে
আত্মবলি হায় কত তাজা প্রাণ ।
শহীদ প্রণাম
কৃষ্ণচন্দ্র রায়
যে ভাষাতে প্রথম ডাকি মা
সেই ভাষাটাই আমার মায়ের দান
সেই ভাষাতেই প্রিয়ার ভালোবাসা
শুনি মায়ের ঘুমপাড়ানি গান ।
সেই ভাষাটাই পাখির মুখের বুলি
নদী বুকে তারই কলতান
সেই ভাষাতেই সাগর কাছে ডাকে
সেই ভাষাতেই নাচে আমার প্রাণ ।
চারিপাশের গাছ-গাছালি যত
সূর্য দেখে প্রথম হাসি হাসে
মাঠ ঘাট আর ঝর্ণা পাহাড় মরু
সেই ভাষাতেই গাইতে ভালবাসে ।
সেই ভাষাটাই সবার চোখের তারা
সবার কাছে বেঁচে থাকার শ্বাস
সেই ভাষাতেই গান গেয়ে যায় ভ্রমর
ডেকে আনে একটা মধুমাস ।
সেই ভাষাকেই লুটতে এলো ওরা
হাতে নিয়ে বারুদ বোমা গুলি
বাংলা মায়ের দামাল কিছু ছেলে
রুখলো তাদের সকল বিভেদ ভুলি ।
পালিয়ে গেল হানাদারের দল
শহীদ হলো টাটকা কিছু প্রাণ
সেই ভাষাটাই আমার বাংলা ভাষা
যে ভাষাতে গাই যে মায়ের গান ।
ফেব্রুয়ারির একুশ যেদিন আসে
দু'হাত তুলে করি নমস্কার
এসো না ভাই আবার শপথ করি
সেই শহীদদের ভুলে না যাই আর ।
ভাষা-৮৬
বাংলা ভাষা
সাবিত্রী দাস
বাংলা আমার বুকের ভেতর গৌরব আলো আশা,
বুকের ভেতর নক্সী কাঁথার সযতন ভালোবাসা।
বাংলা ভাষার চর্চা করে কি আমরা পিছিয়ে পড়া!
মা ঠাকুমার বুকের ভাষায় এখনো হৃদয় মোড়া।
জীবনানন্দ, মধুসূদনের সাধের বাংলা ভাষা
বিশ্বকবির অন্তর জুড়ে সুগভীর ভালোবাসা।
শরৎচন্দ্র ,বঙ্কিম কভু ভেবেছিল মনে মনে,
তাদের বাংলা বাঙালির ঘরে ব্যথার প্রহর গোনে।
ভাষাদিবসের মঞ্চের গাছে ফুল ফোটে জাগে আশা
একটি বেলার দিবস ফুরোলে ফুরোয় যে ভালোবাসা।
হায় প্রজন্ম ! বাংলা ভাষাকে এতটাই ভালোবাসে,
কথা বলে তাও বাংলার সাথে হিন্দিকে মেজে ঘষে।
বাংলা হিন্দি ইংরেজি নিয়ে মিক্স এ্যান্ড ম্যাচে চলে,
তা না হলে আর
আধুনিক কিসে তাইতো এভাবে বলে!
আজ ভাষা বাঁচে বিদেশীয় ধাঁচে অন্য ভাষার ভিড়ে,
বুকের ভেতর বাংলা ভাষার শেকড় ফেলেছে ছিঁড়ে।
স্বপ্নের ভাষা বাংলা তাইতো চিন্তন জুড়ে রয়
বাংলা হারানো ,স্বপ্নবিহীন অন্তরে জাগে ভয়।
প্রজন্ম জুড়ে বাংলা ভাষায় দুস্তর ব্যবধান,
মিছে মরি ঘুরে
বুকে বয়ে শুধু বাংলা ভাষার টান!
আন্তর্জাতিক ভাষাদিবস এবং বাংলাভাষার
চর্চা
হিমাদ্রি শেখর দাস
আমাদের
সাহিত্য-সাংস্কৃতিক চেতনার বিকাশে একুশে ফেব্রুয়ারি যেন হাজার তারের এক বীণা। তাতে
সৃষ্টি হয়েছে অনেক সুর, অনেক ঝংকার! একুশের বীণায় ঝংকৃত হয়েছে আমাদের ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির
বিচিত্র সুর।
ইউনেস্কোর
৩০তম অধিবেশনে উত্থাপন করা হয়। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর সেই সভায় ২১ ফেব্রুয়ারিকে
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরের বছর ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি
থেকে পৃথিবীর ১৮৮টি দেশে দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন শুরু হয়।
মা
যেমন তার সন্তানের কাছে শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভালোবাসার পাত্র, তেমনি একটি জাতির কাছে
তার ভাষা, দেশ ও শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভালোবাসার বস্তু।
জনসংখ্যার
ভিত্তিতে বর্তমানে পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় দশটি ভাষার একটি হলো বাংলা। বাংলার স্থান ষষ্ঠ।
অন্যদিকে ব্রিটেনে শীর্ষস্থানীয় পাঁচটি ভাষার একটি বাংলা। লন্ডনে ইংরেজির পরেই বাংলার
অবস্থান।
মাতৃভাষায়
একজন শিশু সবচেয়ে ভালোভাবে জানতে, বুঝতে ও চিন্তাভাবনা করতে পারে। সঙ্গে আবেগ-অনুভূতি,
চিন্তা-ভাবনা, স্বপ্ন-কল্পনা সবকিছু জড়িত। ভাষা ছাড়া কোনো কিছু চিন্তা বা মনে মনে কল্পনা
করা যায় না।
পৃথিবীতে
বাংলা আজ ত্রিশ কোটি বেশি মানুষের ভাষা। জনসংখ্যার বিচারে বাংলা ভাষা সপ্তম অবস্থানে আর মাতৃভাষার দিক থেকে পঞ্চম।
বাংলা ভাষা পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, আসাম, ঝাড়খণ্ড,
ত্রিপুরা, দিল্লি ছাড়া বাংলাদেশের সতেরো কোটি মানুষের মাতৃভাষা হলো বাংলা।
বাংলাদেশ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্য, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া,
সিঙ্গাপুর, জাপান, মালয়েশিয়া সহ ইউরোপের অনেক দেশে যে অসংখ্য বাংলাভাষী বসবাস করে,
তারাও নিজ উদ্যোগে বাংলা ভাষা চর্চা, গবেষণা ও প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি ইউরোপ,
আমেরিকা, জাপান ও কানাডা থেকে বাংলা ভাষায় বর্তমানে একাধিক সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়এবং
দূরদর্শন, বেতার চ্যানেলে অনুষ্ঠান বাংলা ভাষায় সম্প্রচারিত হচ্ছে।
বাংলা ভাষা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে পৃথিবীব্যাপী।
সম্প্রতি সিয়েরা লিওন বাংলা ভাষাকে তাদের দেশে দ্বিতীয় ভাষার মর্যাদাও দিয়েছে। বহির্বিশ্বে
বাংলা ভাষা চর্চার ক্ষেত্রে স্বাধীনতাপূর্বকালে ইংল্যান্ড, আমেরিকা ও জাপান আর আশির
দশক পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা রাশিয়া। তখন বাংলা ভাষার
সেরা সেরা ক্লাসিক গ্রন্থ প্রকাশিত হতো সেখান থেকে।
ইংল্যান্ডের
ইস্ট লন্ডন, ম্যানচেস্টার ও বার্মিংহামে অসংখ্য বাংলাভাষীর বাস। সেখানকার সরকারি বিদ্যালয়গুলোতে
যেমন বাংলা শেখার ও চর্চার সুযোগ রয়েছে, তেমনি বাংলা গবেষণাসহ নানা ধরনের প্রকাশনাও
আছে। বাংলা ভাষাভাষীদের পাশাপাশি কাজ করছেন
জেডি এন্ডারসন, টি ডব্লিউ ক্লার্ক (কেমব্রিজ), জন বোল্টন, উইলিয়াম রাদিচে, হানা রুথ
টমসন প্রমুখ। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের
অধ্যাপক অদিতি লাহিড়ি বাংলা রূপতত্ত্ব ও ধ্বনিতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করছেন বিগত বেশ কিছু বছর ধরে। যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক, ইথাকা,
শিকাগো, মিনেসোটা, ফ্লোরিডা, মেরিল্যান্ড, ক্যালিফোর্নিয়া, ভার্জিনিয়া, উইসকনসিন,
হার্ভার্ড ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় ও এশীয় গবেষণা
কেন্দ্রে বাংলা ভাষা চর্চা চলছে। ওয়াশিংটনে
বাংলা স্ল্যাং নিয়ে। নিউইয়র্কে মারিয়া হেলেন বেরো কাজ করেন নজরুল সাহিত্য নিয়ে।
বাংলা
ভাষা শিক্ষাদান ছাড়াও গবেষণা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, লালন, চর্যাপদ
এবং মধ্যযুগের সাহিত্য নিয়েও। যেসব গবেষক এ কাজে জড়িত ছিলেন বা আছেন, তাঁদের মধ্যে
উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হচ্ছেন ক্লিনটন বি সিলি, র্যাচেনল ফন বমার, র্যালফ নিকোলাস, ডেভিড
কফ ব্যাচেলবাওয়া, ক্যারল সলোমন, রিকি সলোমন, উইন্সটন ল্যাংলি, ক্যারোলিন রাইট, হেনরি
গ্লাসি, কেলম্যান, অ্যান্ড্রু সিম্পসন, আনে ডেভিড প্রমুখ। এদের মধ্যে ক্লিনটন বি সিলি
বাংলা ভাষার কবি জীবনানন্দ দাশ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে
ইন্দ্রনীল দত্ত বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সলিম-উদ-দৌলা খান বাংলা ধ্বনিবিজ্ঞান নিয়ে
উচ্চতর গবেষণা করেছেন । উল্লেখ্য, আমেরিকার নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস কিংবা লস অ্যাঞ্জেলেসে
গড়ে উঠেছে বাঙালি পাড়া, যেখানে বাংলা ভাষার এক নতুন প্রবাসী-সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে।
কানাডায়
জোসেফ ও কনেল, ভ্যাঙ্কুভারে ব্যারি মরিসন প্রমুখসহ বেশ কিছু প্রবাসী ব্যক্তি বাংলায়
অধ্যাপনা ও গবেষণায় নিয়োজিত। মন্ট্রিয়ল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাজেন্দ্র সিংহের
বাংলা বিষয়ে গবেষণা ও সম্পাদিত প্রকাশনা রয়েছে। আমরা অস্ট্রেলিয়ায় পাই স্থানীয়
ও প্রবাসী বাঙালিদের এক জনগোষ্ঠী, যাঁরা নিয়মিত বাংলা চর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন। অতীতে
বাংলা বিষয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে শিবনারায়ণ রায় এবং আবু সয়ীদ আইয়ুবের বাইরে মারিয়েন
ম্যাডার্নের অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার শিক্ষা মন্ত্রণালয় সে
দেশের বিদ্যালয়ে যেসব এশীয় ভাষা শেখার অনুমতি ও গুরুত্ব দিয়েছে, তার মধ্যে বাংলার
অবস্থান তৃতীয়।
এশিয়ার
মধ্যে (মধ্যপ্রাচ্য বাদ দিয়ে) জাপান, চীন, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় বাংলা
গবেষণা ও চর্চা রয়েছে। জাপানে প্রায় ৭০ বছর
আগে কাজুয়ো আজুমা রবীন্দ্রপ্রেম থেকে বাংলা ভাষার চর্চার হাত ধরে জাপান ফাউন্ডেশন
ও টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের কে ই শিরায়, অধ্যাপক কে নারা কিওকো নিওয়া এবং স্থানীয় বাঙালি গবেষক সেখানে কাজ করছেন। টোকিও
ইউনিভার্সিটি অব ফরেন স্টাডিজে শুরু হয়েছে বাংলা ভাষা শেখানো, জাপানি শিক্ষার্থীরা
সেখানে বাংলা ভাষা শেখা ও চর্চার সুযোগ পাচ্ছে। বর্তমানে এই বিভাগে শিক্ষার্থীর সংখ্যা
দুশোর বেশি। সেখানে পাঠদান করেছেন কিওকো নিওয়া,
কাজুহিরো ওয়াতানাবে, মনজুরুল হক প্রমুখ। রেডিও
এনএইচকেতে বাংলা ভাষা শিক্ষাসহ নিয়মিত বাংলা অনুষ্ঠান হচ্ছে।
দীর্ঘদিন
ধরে চীনে রেডিও বেইজিংয়ে বাংলায় সম্প্রচার চলে আসছে । চীন থেকে প্রকাশিত হয়েছে বেশ
কিছু বাংলা অনুবাদকর্মও। রবীন্দ্রনাথ নিয়ে
বাংলা থেকে চীনা ভাষায় অনুবাদের কাজ করছেন প্রায় ৩০ জন সিআরআইয়ের (চায়না রেডিও
ইন্টারন্যাশনাল) কর্মী। চেক রিপাবলিকে প্রথম
মহাযুদ্ধ-পরবর্তীকালে বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকেরবীন্দ্রনাথের নোবেল জয়ের পর। বাংলা
চর্চা শুরু হয় মূলত ভি লেসলি, দুশন জভাভিতলে
এবং হান্না পেইনরো হেলতেমেভা এ কাজে অগ্রণী ছিলেন। ইউরোপের মধ্যে ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, বেলজিয়াম,
পোল্যান্ড প্রভৃতি দেশে বাংলা চর্চা ও গবেষণা চলছে।
জার্মানির
হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবাসী কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ও মার্টিন কেম্পশেন; ফ্রান্সে
ফ্রাঁস ভট্টাচার্য, মাদাম আনসারি, ক্যাথরিন তোমা ভট্টাচার্য, জোসেফ বায়ার ইতালিতে অধ্যাপক মারামারা বেলজিয়ামে ফাদার পল দ্যতিয়েন, নরওয়ের থ্রমসো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জিলিয়ান
রামচান্দ এবং নেদারল্যান্ডসের গবেষক ভিক্টর ভ্যান বিজার্ট ও অধ্যাপক উইলিয়াম ভ্যানদারউফ
বাংলা ভাষা নিয়ে নিয়মিত কাজ করছেন। পোল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক এলভিয়েতা
য়োল্টার বাংলা থেকে পোলিশ ভাষায় রবীন্দ্রনাথ ও বিভূতিভূষণ অনুবাদ করেছেন।
ভারত ও বাংলাদেশের
বাইরে মধ্যপ্রাচ্যে এক কোটি বেশি বাঙালি নিজ
মাতৃভাষার দীপ জ্বালিয়ে রেখেছেন। উপসাগরীয় অঞ্চলের কাতার, বাহরাইন ও ওমান থেকে বাংলায়
প্রথম আলো প্রকাশিত হচ্ছে। অবশ্য ইউরোপ, আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি বাংলা চর্চা হয়—এমনকি
কোথাও কোথাও নজরুল ও রবীন্দ্র সেন্টারও রয়েছে। ইংল্যান্ডের শতাধিক বিদ্যালয়ে বাংলা
ভাষা শেখানো হচ্ছে। নিউইয়র্ক, ক্যালিফোর্নিয়া, ফ্লোরিডায় বাংলা ভাষা চর্চা ও গবেষণা
হচ্ছে। ফ্লোরিডায, মন্ট্রিয়ল, টরন্টো, সিডনি, মেলবোর্ন, টোকিও, ওসাকা, সিঙ্গাপুরে নিয়মিত বাংলা ভাষার চর্চা ও আলোচনা হয়। কাজেই
বাংলা ভাষা এখন বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে—এ কথা বলতেই হয়।
ভাষা-সাহিত্য বাইরে ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম
কারণ একুশে ফেব্রুয়ারি, যা আন্তর্জাতিক
মাতৃভাষা দিবস। পৃথিবীতে বাংলা ভাষার পরিচিতি এখন অনেক বেড়েছে। ফলে বাংলা ভাষার চর্চা
ও গবেষণায় অগ্রহ প্রকাশ করছেন।
তথ্যঋণ-
১.
বিদেশিদের বাংলাচর্চা- সৌরভ সিকদার ( ফেব্রুয়ারি ২০১৫)
২.
বিদেশে বাংলা ভাষা এবং তরুণ প্রজন্ম-রায়হান আহমেদ তপাদার (ফেব্রুয়ারি, ২০২২)
ভাষা-৮৮
বিবেকানন্দ নস্কর
যে ভাষা মন্ত্রের মতো উচ্চারিত হয়
দৃপ্ত চেতনা আর মুক্ত অনুভব
মিলেমিশে গনগনে আন্দোলন ।
আ মরি ভাষার পরশ
বাদাবন, ঘাস মাটি পাহাড়
অশ্রুত মায়ের আঁচল ।
শহীদের রক্ত স্নাত
হে আমার বর্ণমালা
বাঙালি মননে বন্দনা গান
একুশে ফেব্রুয়ারীর ভোরে
মাতৃভাষা শপথের মন্ত্র হয়ে
ধ্বস্ত প্রেক্ষাপটে ভেসে ওঠে বারবার।
ভাষা-৮৯
ভাষা দিবস , এক মেকি আবেগ
প্রীতম ঘোষ
পাপা
, ল্যাঙ্গোয়েজ ডে না কি যেন আজ ? --- বনেদি বাঙালি পরিবারের সেকেন্ড ল্যাঙ্গোয়েজ
হিন্দি নিয়ে শহরের নামী ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়া বারো বছরের ছেলেটা জিজ্ঞেস করলো
বাবাকে ।
----
ও ইয়েস্ , আজ টোয়েন্টি ফার্স্ট ফেব্রুয়ারি , আজকের দিনে বাংলা ভাষার জন্য এ লট অব
পিপল হ্যাড ডায়েড ।
---
লাভ ইউ , লাভ ইউ ও মাই বাংলা --- খোকাকে আদর করতে করতে তার গায়ে অবিভক্ত বাংলার ম্যাপের
মধ্যে থাকা হিজল গাছের ছায়ার মতো বিষণ্ণ কবির অভাবী মুখের নীচে "আবার আসিব ফিরে
ধানসিঁড়িটির তীরে --- এই বাংলায় " লেখা কমলা টি-শার্ট পরিয়ে দিলেন মম --- স্কুলে
ল্যাঙ্গোয়েজ ডে সেলিব্রেশন !
বিকেলে
পাড়ার মোড়ে মানুষের পাশে মানুষের কাছে থাকতে চাওয়া লোকজনদের ভাষা দিবসের ধামাকা
!
দু'দিন
আগে থেকেই মোড়ের মাথার বিল্টুর দোকানের চারিদিকে ছোট ছোট প্ল্যাকার্ড ঝুলছে --- বধ্
কিনলে মধু ফ্রি।
আন্তোপ্রানো
সুহৃদ সুনীল-শক্তির সূক্ষ্ম দেহে বোধহয় এখনো নেশার ঘোর কাটেনি ,
বাতাসে
মেশা চোখগুলো পড়লো --- মদ কিনলে মধু ফ্রি ।
আসলে
ল্যাঙ্গোয়েজ ডে-র মরশুমে মধুকবির জন্মের দু'শো বছরের অফার ওটা ---- এক কপি "মেঘনাদবধ
" কিনলে এক শিশি ডাবুর হানি ফ্রি ।
বাংলা
মাধ্যম স্কুলের বাংলা ঝরঝরে রিডিং না পড়তে পারা একাদশ শ্রেণির তরুণী স্কুলে
ভাষা দিবসের মঞ্চ সাজাতে সাজাতে রফিক , সালাম , জাব্বারদের
ছবিগুলো দু'হাতে ধরে চটুল নেত্য করতে করতে গাইতে লাগলো --- লাভ ইউ , লাভ ইউ , ও মাই
জান বাংলা ।
সহপাঠী
বিশেষ বন্ধুটি জিজ্ঞেস করলো --- হাই সুইটি , লোকগুলো কে রে ?
"
লে হালুয়া , হু নোজ ?" -- দাঁত ক্যালানো হাসিতে বললো মেয়েটা !
---
বাংলা স্পেশাল একটা গোটা দিন আছে হাবি । সেলিব্রেট কী করে করবো দেন ?
'
কাপল স্পেশাল ' স্টল থেকে কর্পোরেট সেক্টরের যুবকটা ডার্লিং-এর জন্য কিনে দিল ভাষা
স্পেশাল মার্কা টি-শার্ট ।
বুকের
উপর পাতলা রবারে এমবস করা লাল রঙের বোঁটাহীন পানচিহ্ন , ভিতরে লেখা -- " বাংলাটা ঠিক আসে না " ।
এক্সক্লুসিভ
ইয়াররিং ফর ভাষা দিবস --- দিতেও ভুল করেনি ছেলেটা ।
একজোড়া
দুলের একটায় 2 , আরেকটায় 1 ; ঠিক 21শে ।
টি-শার্টের
বুকের ভিতর থেকে সদ্য মৃত ভবানীপ্রসাদ বেরিয়ে এসে শুধোলেন --- মা-গো তোমার ছেলের সঙ্গে
তোমার বাংলাটাও আর একেবারেই আসে না নাকি ?
মহাশূন্য
থেকে এক অভ্রভেদী চিৎকারে রবি , নজরুল , সুকান্ত বলে উঠল --- তুমি এত দেরিতে বুঝলে
ভবানী ? রফিক , সালাম , আতাউর , বরকত , জাব্বারের বুকের খুন কবেই বাংলাটাকে ধুয়ে মুছে
ওদের সাথেই পরপারে নিয়ে গেছে ।
এখন
শুধু পড়ে আছে বিশ্ব বাংলা লোগোর একটা প্রাণহীন 'ব' !
ঋণস্বীকার
: আনন্দবাজার পত্রিকা রবিবাসরীয়
ভাষা-৯০
বাংলা মা
তীর্থঙ্কর সুমিত
একুশ মানে বাংলা ভাষার
রক্তঝরা দিন
একুশ মানে বাংলা মায়ের
কাব্য গাথা ঋণ।
একুশ মানে রফিক সালাম
জব্বর - বরকত
একুশ মানে ইতিহাসের
কয়টি মহিরথ।
একুশ মানে বাংলা আমার
বেঁচে থাকার গান
একুশ মানে সবার ঘরে
বাংলার সম্মান।
একুশের পণ
দীপনারায়ণ মণ্ডল
একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটি শুধু একটি দিনের নয়
বুকের মাঝে সারা জনম যেন বাংলা যাপন রয়।
যে ভাষাতে প্রথম মাকে "মা" বলে ডেকে উঠি
বাংলা আমার প্রাণের ভাষা প্রণাম শতকোটি।
জন্মদায়িনীর ললাট চুম্বন আদর ভরানো গান
মিষ্টি মধুর বাংলা কথায় জুড়িয়ে যায় যে প্রাণ।
এই বাংলায় কান্না হাসি হুল্লোড় বিকেলবেলা
সারাদিন হুটোপুটি-দুষ্টুমি আর পড়া পড়া খেলা।
বাংলায় আমার জ্ঞান গরিমা বাংলা মনের ভাষ
বাংলায় আমার দিক চেতনা ব্যক্তি আমি-র প্রকাশ।
বাবা মায়ের ভালোবাসায় নাড়ির টান যেমন
ভিটে মাটির শিকড় টানে বাংলা আমার মন।
আজকে যত ক্ষমতা-আগ্রাসী যুদ্ধবাজের দল
আমার মাটি আমার ভাষাকে নিঃস্ব করার ছল।
প্রাণ দেব তবু আমার ভাষার মান বাঁচাবো পণ
ভালোবেসে রাখবো আমরা বাংলার আপনজন।
=================================
একুশে ফেব্রুয়ারি
স্বপ্না মজুমদার
ভাষা দিবস এগিয়ে এলো
দিনটি একুশে ফেব্রুয়ারি
ভোলে না বাঙালি, ভোলে না বাংলাদেশ
কেউ কি ওই দিনটি
ভুলতে পারে?
বঙ্গ সন্তানেরা শহীদ হয়েছে, নিয়েছে বুক পেতে
সহস্র যন্ত্রণা,গুলি--
বাংলা ভাষা, প্রতিষ্ঠা পেয়েছে
বাঙালি হয়েছে খুশি!
স্বপ্নের ভাষা বাংলা ভাষা বিশ্বের দরবারে
হয়েছে সমাদৃত, কবির কলমে লেখনী কথনে
বাংলা ভাষার পূর্ণ স্থান হয়েছে অর্জিত!
গর্বিত বাঙালি, গর্বিত দেশ
রেখো না জাতি, বর্ণ, ধর্ম বিদ্বেষ!
কত মায়ের অশ্রু ঝরেছে, শূন্য হয়েছে ঘর
ফেরেনি সন্তান, কখনোই আর
এসেছে নতুন ভোর!
ভারত পাশে বন্ধু রাষ্ট্র, পশ্চিম বাংলায়
বাঙালির বাস, এক সংস্কৃতি বয়ে চলে
পাশের রাজ্য, দেশ--
বাংলা ভাষার সম্মানে
এই বাংলার সকল মানুষ খুশি
একুশে ফেব্রুয়ারি এগিয়ে আসে
মনে করিয়ে দিয়ে যায়---
বাংলা ভাষা, মোদের ভাষা,
শ্রদ্ধা জানাই বীর শহীদদের
আজও তাদের স্মরণে একুশে ফেব্রুয়ারি
বারে বারে আসে---
সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই।
২১ শে ফেব্রুয়ারি
মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায় রায়
অক্ষরে থাক চেনাশুনা বাংলা ভাষায় বাঁচি
সহজপাঠ, বর্ণমালা হাতে খড়ির সাথি।
মনের আশা মাতৃভাষা বাংলা অঙ্গীকার
বছর বছর চলছে কাহন ভাষার আলিঙ্গন ।
দিন পঞ্জিকায় মেলে না কভু শ্রদ্ধা স্নেহ স্পর্শ
হৃদয়ে থাক আঁকিবুঁকি ভাষার মেলবন্ধন ।
একুশ মানে ভাষা দিবস উচ্চারণের বাঁধন।
চিরদিনই নজির থাকবে রক্তস্রোতে জীবন।
একুশ তুমি কোটি বাঙালির গর্ব সম্মাননা
স্মৃতির পাতায় গেঁথে আছে বাহান্নর যন্ত্রণা।
শত অনুন্নত পেশী শক্ত বিতর্ক বাংলাদেশ একলা
বাংলা ভাষায় যুগে যুগে নত থাক, পশ্চিম বাংলা।
একদিন নয়
,প্রতিদিন হোক মাতৃভাষার উৎসব।
ঐশ্বর্য অস্তিত্বে বেঁধে থাকি মোরা বাংলা ভাষার পূজায়।
ভাষার জন্য স্বপ্নের উড়ান
শংকর ব্রহ্ম
শুনতে গল্পের মতো মনে হলেও, নির্ভেজাল সত্য বাস্তব
ঘটনা এটি।
গল্পের শুরুটা ছিল ঠিক এরকম। নবম শ্রেণী থেকেই মেহদী
হাসান খানের প্রোগ্রামিংয়ের প্রতি অন্যরকম ভালোবাসা ছিল। বিভিন্ন প্রোগ্রামিংয়ের বই
কিনে পড়ে সে ঘরে বসেই প্রোগ্রামিং শিখত।
১৯৮৬ সালের ২৩শে জুলাই ঢাকায় জন্ম নেওয়া মেহদী
হাসান যে বাংলাকে নিয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখেছেন। বাংলাকে দিয়েছেন নতুন অনন্য এক রূপ।
কিন্তু সে এটার বাণিজ্যিক কোনও লাভ আশা করেননি। শখের বশে তৈরি করেছেন।
ইন্টারনেট দুনিয়ায় প্রবেশের শুরুর দিকের কথা। কয়েক
বছর হল দেশে ইন্টারনেট চালু হয়েছে। তবে সে সময় ওয়েবে বাংলা লেখা বা বাংলায় কোনও ওয়েবসাইট
তৈরি করা খুব কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তখন ওয়েবসাইটে বাংলা লিখতে ছবি কিংবা পিডিএফ করে দিতে
হত। ইমেল করার ক্ষেত্রে সহজে ইংরেজি লেখা সম্ভব হলেও বাংলা লেখা একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার
ছিল। ঠিক সেই সময় ভার্চুয়াল জগতে বাংলা ভাষার প্রসারে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে
‘অভ্র’ বাংলা কী-বোর্ড। ‘ভাষা হোক উন্মুক্ত’ এই স্লোগানে আঠারো বছরের এক তরুণের হাত ধরে বাংলা ভাষা
পরিচিতি লাভ করেছে এক নতুন আঙ্গিকে।
তাঁর
নাম ডা. মেহদী হাসান খান। নামের আগে তখনও ডাক্তার উপাধি যুক্ত হয়নি তাঁর। ময়মনসিংহ
মেডিকেল কলেজের সহজসরল হাসিখুশি প্রাণোচ্ছল ছেলেটি তখন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে বাংলা
ভাষাকে সারা বিশ্বের কাছে খুব সহজেই পৌঁছে দেওয়ার। কিভাবে সম্ভব এই অসাধ্য কাজ?
মেহেদী হাসান খান তখন ভাবলেন যদি এমন একটি সফটওয়্যার
বানানো যায় যেটি ইংরেজি অক্ষর টাইপ করেই বাংলা লেখা সম্ভব। তাহলে বাংলা ভাষাকে সারা
পৃথিবীর কাছে সহজে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে।
খুব একটা সহজ ছিল না কাজটা, বিশেষ করে মেডিকেলে
পড়া অবস্থায়। শিক্ষকরাও একসময় বলে দিয়েছিলেন এই ছেলের দ্বারা ডাক্তারি পড়া হবে
না। ডাক্তার হওয়া হবে না তার। কিন্তু হাল ছাড়েনি সে। সত্যি করেছে তাঁর স্বপ্নকে আর
সম্মানের সাথে এমবিবিএস পাশ করেছে। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সরকারি সমস্ত কাজে ব্যাপকভাবে
ব্যবহৃত ‘অভ্র’ সফটওয়্যার। সারা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ অভ্র ব্যবহার করে এবং করছে।
মেহেদী হাসান খান ২০০১ সালে ভর্তি হয় নটরডেম
কলেজে। ২০০৩ সালে মেডিকেলে। সে বছর ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমির একুশে বইমেলায় গেলেন
তিনি। সেখানে দেখলেন বাংলা ইনোভেশন থ্রু ওপেন সোর্স বায়োসের স্টল। ‘ওই স্টলে প্রথম
‘খাঁটি’ বাংলা ওয়েবসাইট দেখলেন। ইউনিকোডে বাংলা লেখাও দেখলেন। ইউনিবাংলা নামে ওদের
পুরো একটা অপারেটিং সিস্টেমও দেখা হলো। তবে এটা লিনাক্সের জন্য।’ বাসায়
এসে ওদের ওপেন টাইপ ফন্ট নামালেন। কিন্তু এ বাংলা লিনাক্সের জন্য। ক্যারেক্টার চার্টে
মাউস দিয়ে ক্লিক করে করে বাংলা লিখতে হয়। জনপ্রিয় অপারেটিং সিস্টেম উইন্ডোজের জন্য
নেই।
কিন্তু প্রোগ্রামিংয়ে আসক্ত ছেলেটির মনে এই
ব্যাপারটি গভীর এক কৌতূহলের সৃষ্টি করেছিল। তাই তিনি বাংলা লিনাক্সের ঐ ফন্টটি ইনস্টল
করেন। আর এ সময়ই তার চোখে পড়লো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যা মেহদী হাসানের ইউনিকোড
বাংলা সফটওয়্যার তৈরির অনুপ্রেরণা যোগায়। ভাবনার ফলস্বরূপ একটি ফনেটিক পদ্ধতিও তৈরি
করে ফেলেন, কিন্তু তখনও জানানোর মতো কিছু হয়নি।
মেডিকেল কলেজের প্রচণ্ড পড়াশোনার চাপ মাথায়
নিয়ে সে তার হোস্টেলের রুমে বসে দরজা বন্ধ করে ঐ ইউনিকোডভিত্তিক কিবোর্ড বানানোর কাজে
লেগে পড়লো। রাত দিন খেটে সে কাজ চালানোর মতো একটা প্রোটোটাইপ দাঁড় করিয়ে ফেলল। এটা
করতে গিয়ে তার কত নির্ঘুম রাত কেটে গেছে তার ঠিক নেই। মেডিসিন ক্লাবে যাওয়ার বদলে ছেলেটা
রুমের দরজা বন্ধ করে প্রোগ্রামিং এর কাজ করছে। অনেকের কাছেই ব্যাপারটা অদ্ভুত বোধ হবে
নিশ্চয়। এভাবে পড়াশুনা ক্ষতি করে অন্য কোন কাজে মনোনিবেশ করাটা কলেজও ভালো চোখে দেখত
না।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে পড়ছিলেন মেধাবী মেহদী
হাসান খান। কিন্তু শিক্ষকরা বলেছিলেন, এই ছেলে ডাক্তার হওয়ার অযোগ্য। মেডিকেল কলেজ
ছেড়ে দেওয়া উচিত মেহদীর। কারণ ডাক্তারি পড়াশুনা বাদ দিয়ে, দিন-রাত এক করে, খাওয়া-ঘুম
ভুলে হস্টেলের ঘরেই একটা ছোট্ট কম্পিউটার সম্বল করে মেহদী তখন লড়ছিলেন অন্য লড়াই। বাংলা
ভাষার জন্য লড়াই। বন্ধুরা মেহদীকে বলে পাগল, ডাক্তারি পড়তে এসে কেউ সময় নষ্ট করে!
তাও আবার নাকি বাংলা লেখার সুবিধার্থে! কিন্তু মেহদী হাসান পিছু হাঁটেনি। বাংলা ভাষার
জন্য তাঁর দেশের মানুষ প্রাণ দিতে পারেন, আর সেই বাংলাকে লেখার দিক থেকে সহজ করতে ক্যারিয়ার
বিসর্জন দিতেও রাজি মেহদী হাসান।
অবশেষে ২০০৩ সালে সফল হন মেহদী হাসান। বাংলাকে
বিশ্বায়নের দিকে এক ধাপ এগিয়ে নিতে তৈরী করে ফেলেন ইউনিকোডে বাংলা সফটওয়্যার 'অভ্র'।
কে জানত তার পড়ার ল্যাব একদিন হয়ে উঠবে ওমিক্রনল্যাব, তার স্বপ্নের আকাশ বাস্তবে
ধরা দিবে 'অভ্র' হয়ে।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসের এক জায়গায়
বসে ক্যাম্পাসেরই দুই পড়ুয়া (জুনিয়র-সিনিয়র) ছাত্রের মধ্যে কথা হচ্ছিল। সিনিয়র পড়ুয়া
বলল, জুনিয়র পড়ুয়াকে, কত করে নিবি? জুনিয়র পড়ুয়া উত্তরে বলে, মানে? কিসের কত করে নিবো?
সিনিয়র পড়ুয়া তখন পরিস্কার করে বলে আরে, তোর সফটওয়্যারের দাম কত করে রাখবি? জুনিয়র
পড়ুয়া তাকে জানিয়ে দিল, দাম রাখবো কেন? ওটা তো ফ্রি। কোন টাকা পয়সা দিতে হবে না।
জুনিয়রের কথা শুনে সিনিয়র এবার যারপরনাই অবাক।
বলিস কীরে? ওদিকে জুনিয়রের বরাবরের মতোই স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ। ভাষার জন্য
টাকা নেবো কেন?’
সেদিন রফিক, সালাম, বরকত আর জব্বারদের সাথে
মেহদী হাসানের কোথাও যেন সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। এই ছেলেটির তাঁদের মতো করেই
ভাষাটাকে ভালবেসেছিলেন। ভাষার জন্য তাঁদের ঠিক এতটাই মমত্ববোধ ছিল বুকের বাঁ পাশে।
বহুদিন পর বাংলা আরেকজন ভালোবাসার মানুষ খুঁজে পেল। স্বার্থের এই জগতে নিঃস্বার্থভাবে
ভালোবাসার মানুষ খুঁজে পাওয়া খুবই দুস্কর।
মেডিকেল চত্বরে কথোপকথনরত সেদিনের ওই জুনিয়র
ছেলেটির নাম মেহদী হাসান খান। তখন রাতদিন এক করে সফটওয়্যারটি দাঁড় করানোর জন্য মত্ত
ছিল সে। অবশেষে মাত্র আঠারো বছর বয়সে সফল হয় মেহদী হাসান খান। দিনটি ছিল ২৬ শে মার্চ
আমাদের প্রজাতন্ত্র দিবস। আর ২০০৩ সালের সেই দিনেই, স্বাধীনতার বাণী নিয়ে আগমন হয় এক
আগন্তুকের। যার নাম ‘অভ্র’। অভ্রের অর্থ আকাশ। মানে পুরো এক উন্মুক্ত আকাশ। অভিধান
ঘেঁটে এই শব্দটিই নির্বাচন করেছিলেন অভ্রের কারিগর মেহদী হাসান খান। কারণ তার ইচ্ছে
ছিল বাংলা ভাষার চর্চা হবে উন্মুক্ত। তাই অভ্রের স্লোগান হল, ‘ভাষা হোক উন্মুক্ত’।
বাংলা লেখার এই সফটওয়্যারটিই আজ বাংলা টাইপিস্টদের
নিকট অতি পরিচিত নাম অভ্র। যার জন্য আলাদা কিবোর্ড লাগে না, আলাদা করে টাইপিংও শিখতে
হয় না। ব্যবহারকারীরা শুধু ইংরেজি অক্ষরে মনের কথাটি লিখছেন আর তা অভ্রের যাদুতে বাংলায়
রূপান্তর হচ্ছে। তবে যে অভ্রর সাহায্যে আপনি আজ এত সহজে, এক নিমেষে বাংলা লিখতে পারছেন,
সেই অভ্রর জনক মেহদী হাসান কিন্তু তত সহজে কিংবা এক নিমিষে অভ্রকে তৈরি করতে পারেননি।
এই সৃষ্টি সাধারণ কোনো সৃষ্টি নয়, তার এই সৃষ্টি দশ বছর ধরে রচিত একটি গল্পের নাম।
মেহদী তখনকার জনপ্রিয় মাইক্রোসফটের ডটনেট ফ্রেমওয়ার্ক
ব্যবহার করে উইন্ডোজ ওএসের জন্য এপ্লিকেশন বানিয়ে ফেললেন। পরে ভারতের একটা বাংলা ফন্ট
প্রতিযোগিতায় ইমেইল করে নিজের বানানো প্রোটোটাইপটা পাঠানোর পর তারা জানালো, ‘এইটা তো
ঘন ঘন ক্র্যাশ করছে।’
তারপর আবার রাত জেগে প্রোটোটাইপের বাগ সারান।
তার আগে ডটনেট বাদ দিয়ে ক্লাসিক ভিজুয়াল বেসিকে সবগুলো কোড নতুন করে আবার লিখলেন মেহদী
হাসান। (যদিও পরবর্তীতে আবারো একেবারে নতুন করে কোড লেখা হয় Delphi/Object Pascal-এ।)
বর্তমানে অভ্র এই ফ্রেমওয়ার্কেই আছে। ক্র্যাশের ঝামেলা কমলো।
এরপর কাজ শুরু অভ্রর অফিসিয়াল সাইট বানানোর। মেহদী
তার সাইটে ফোরাম সেটাপ করলো, এটা অভ্রর জীবনে একটা গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন ছিল। ফোরামে
অভ্র’র ইউজাররা ফিডব্যাক দিত, বাগ রিপোর্ট করত, প্রশ্নোত্তর চলতো। মুহম্মদ জাফর
ইকবালের ওমিক্রনিক রূপান্তর বই পড়েই তখন মেহদীর মুগ্ধতা। ওখান থেকেই আসলো ওমিক্রন।
আর ল্যাব শব্দ যুক্ত হল একটু সিরিয়াস ভাব আনতে।
মেহদীর উদ্দেশ্য সফল হল। সে সময়ের জনপ্রিয় প্রযুক্তি
বিষয়ক মাসিক ম্যাগাজিন ‘কম্পিউটার টুমরো’ একদিন ফিচার প্রতিবেদন করল মেহদীর 'অভ্র'-কে নিয়ে।
শুধু তাই না, সেই ম্যাগাজিনের সাথে অভ্রের সিডির একটা করে কপি ফ্রি দেয়া হয়েছিলো। সে
মাসে নিউ মার্কেটের দোকানে দোকানে সিডিসহ ম্যাগাজিন, কি যে দারুণ অনুভূতি!
২০০৭ সালে ‘অভ্র কীবোর্ড পোর্টেবল এডিশন’ বিনামূল্যে
ব্যবহারের জন্যে উন্মুক্ত করা হয়। অভ্রের সোর্স কোড উন্মুক্ত, অর্থাৎ যে কেউ চাইলেই
গিটহাব রিপোজেটরি থেকে এর উন্নয়নে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। উল্লেখ্য, ভার্সন ৫ এর পর
থেকে অভ্রকে ফ্রিওয়্যার থেকে ওপেনসোর্সে রূপান্তর করা হয় এবং এটি ‘মজিলা পাবলিক লাইসেন্স’এর অধীনে
লাইসেন্সকৃত।
'অভ্র' সফটপিডিয়াতে শতভাগ স্পাইওয়্যার/অ্যাডওয়্যার/ভাইরাস
মুক্ত সফটওয়্যার হিসেবে স্বীকৃত। মাইক্রোসফটের অনলাইন সংগ্রহশালায় ইন্ডিক ভাষাসমূহের
সমাধানের তালিকায় 'অভ্র' কীবোর্ডকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
আজ কিন্তু ডা. মেহদী হাসান খান হাজার তাচ্ছিল্য
সত্ত্বেও তিনি ‘অভ্র’ আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে কৃতিত্বের সঙ্গে এমবিবিএসও
পাশ করেছেন। ২০১০ সালে ইন্টার্ন করেন, বিয়েও করেন সহপাঠী সুমাইয়া নাজমুনকে। স্ত্রীর
কাছ থেকে মতামত নিয়ে ডাক্তারি ছেড়ে প্রোগ্রামিং নিয়েই কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন মেহদী। এখন
প্রোগ্রামিং নিয়েই মেহদীর যত ব্যস্ততা। অবসর সময় কাটে ছেলে অর্ক হাসান খানের সাথে।
জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির কাজে বাংলাদেশ নির্বাচন
কমিশন 'অভ্র' ব্যবহার করেছে। যার কারণে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রকল্পে নির্বাচন কমিশনের
পাঁচ কোটি টাকার মতো বেচে যায়। আজ ভারত ও বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সরকারি
দপ্তরেও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে ‘অভ্র’। লেখা হচ্ছে সরকারি ফাইল থেকে পরিচয়পত্র। মেহদীর এই
আবিষ্কার বাঁচিয়ে দিয়েছে দুই দেশের কোটি-কোটি টাকা।
'অভ্র'-কে বাংলা কী-বোর্ড রিসোর্স হিসেবে ইউনিকোড
সংস্থার ওয়েব সাইটে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড
ইনফরমেশন সার্ভিসেস বা বেসিস বাংলা তথ্য প্রযুক্তিতে বিশেষ অবদানের জন্য অভ্রটিমকে-
২০১১ সালে ‘বিশেষ অবদান পুরষ্কার’ (Special Contribution Award) প্রদান করে।
বাংলা ভাষা ভালোবাসার ভাষা
অভিজিৎ পানীগ্রাহী
ধন্য
করেছে বাংলার মাটি, বাংলার গানে বাংলার তানে মাতৃভাষার কত আহ্বানে-
ভাষা
প্রতিবাদে আর আন্দোলনে-
বানানে
শব্দে আর অক্ষরে
বদলায় ভাষা বদলায় রূপে
মর্যাদা কত বাড়ে ঐ কলেবরে
তোমার জন্য
সুতপা ঘোষ
আমার ভাষা ,বাংলা ভাষা,তোমায় বড় ভালোবাসি।
হাসি কান্না ,সুখে দুখে নিত্য তোমার কাছে আসি।
মাতৃভাষা, তুমিও যে আমার আরেকটি মা।
তোমায় ছাড়া জীবন আমার একটুও চলে না।
তোমার জন্য বিশ্ব বাংলা,এক সুরে গান গায়।
তোমার জন্য চিত্ত ব্যাকুল ,কতই না বলতে চাই।
স্বপ্নে ,ঘুমে ,জাগরণে সঙ্গী হলে তুমি।
ধন্য হলাম পৃথিবীতে, ধন্য জন্মভূমি।
তোমার জন্য আনতে পারি ,রক্তে ভেজা জয়।
তোমার জন্য ছাড়তে পারি কুণ্ঠা, হিংসা ,ভয় ।
রবি ঠাকুর বাউল হলেন, তোমার পূজা করে।
সাহিত্য অঙ্গনকে তুমি সাজিয়েছো ভরে।
বিদ্রোহ ,প্রেম, ভক্তির সুর, অগ্নিবীণায় বাজো।
একই সঙ্গে ,একই অঙ্গে ,অপরূপ রূপে বিরাজো।
তোমার জন্য তমসা
কাটিয়ে ,ভোরের পাখি ডাকে ,
শীর্ণ তপা,চিত্ত
ভরে ,কত না ছবি আঁকে।
সন্ধ্যা আকাশে ,ধ্রুবতারা হয়ে তুমি থেকো।
ভোর আকাশে সুখ তারা মোর ,পথ চেয়ে নিয়ে রেখো ।
স্রোতস্বিনী
হয়ে আমার, ভাষা চলুক বেগে
সব বাঙালি জেগে উঠুক, মাতৃভাষার আবেগে ।
তোমার জন্য গঙ্গা পদ্মা ,এক মাটিতেই মেশে,
বাংলা ভাষায় নতুন ভোর হয় , ফেব্রুয়ারির একুশে।
======================================
ভাষা-৯৭
আমি বাংলায় গান গাই
শিল্পী - সুতপা ঘোষ
ভাষা-৯৮
বাংলা ভাষা
অশোক কুমার ঘোষ
বাংলা ভাষায় মাকে প্রথম ডাকি ,
আত্মীয় পরিজনের সোহাগ মাখি !
'আতা গাছে তোতা
পাখি ' ছড়া কাটি,
এই ভাষাতেই করি কত খুনসুটি !
মধুর মধুর সুরে সুরে গেয়ে গান ,
ভরে যায় আমার অন্তর পরান !
দুঃখের ব্যথায় যখন হই কাতর ,
শান্ত করে যে মাতৃ মধুর আতর !
প্রাণের মাঝে নিজেরে খুঁজে পাওয়া,
মাতৃভাষা আমার দখিন হাওয়া!
মনের মানুষ যখন
ফিরি খুঁজে,
প্রেয়সী এই ভাষাতেই মন বোঝে!
এমনি আরো আরো বলবো যত,
ভরবে তোমারও মন প্রাণ কত !
একুশে আসছে বলে
দীপক আঢ্য
একুশে আসছে বলে কেমন যেন
ভাবনারা সব নতুন বর্ণের শব্দ পরেছে
নতুন ভাবনায় ঋদ্ধ হয়েছে
অলস সময় কাটানো কাজ না জোটা
কতকগুলো বেকার
একুশে প্লাবন নেই -- নেই ঝড় কিম্বা দুর্যোগ
তবুও একুশ এসেছে তাই
ওরা আজ রাত জাগবে
মোমবাতির মেদুর আলোয়
এই বসন্তের হিমেল বাতাসে ঘ্রাণ নেবে স্নিগ্ধ উষ্ণতার
একুশ আসছে আজ রাতে
সারাদিন পোস্টার এঁকেছে লিখেছে ব্যানার
সেগুলো সাজাতে সাজাতে
ওদেরই একজন ফিসফিসিয়ে বলল,
ইংরেজি জানিনে বলে আজ গ্লানি নেই কোনো!
প্রাণের বাংলা ভাষা
তাপসী শতপথী পাহাড়ী
বাংলা ভাষায় গঙ্গা আমার বাংলা ভাষায় পদ্মা,
বাংলা বুকের ভালোবাসা বাংলায় থাক শ্রদ্ধা,
বাংলা আমার মিষ্টি বড়ই দোয়েল, ফিঙের গান।
বাংলা আমার সবুজ বনানী
সোনা রূপশালী ধান।
বাংলায় বহে নদী কুলু কুলু ভাটিয়ালি সুর তুলে,
ভ্রমর শোনায় প্রেমের সে গান বাংলার ফুলে ফুলে।
বাংলা আমার টাপুর টুপুর আয় আয় চাঁদ টিপে,
তুলসী মঞ্চে মায়ের ধরা শঙ্খ আর প্রদীপে।
বাংলার প্রাণে জীবনানন্দ, রবি আর নজরুল।
বিশ্ব আজকে মধুরতা পেয়ে সে ভাষায় মশগুল।
বাংলা আমার আকাশে বাতাসে স্বপ্নের আশাবরী,
বাংলা মানে রক্তে ভেজা সেই একুশে ফেব্রুয়ারি।
ভাষা-১০১
২১ শে ফেব্রুয়ারী স্মরণে
সমীরবরণ দত্ত
বাংলা
বিহার আসাম উড়িষ্যা নিয়ে যখন গৌর রাজ্য ছিল, শশাঙ্কের আমলে, তখন চার রাজ্যেই বাংলা
ভাষা চালু ছিল।
সেই ভাষা ছিল চর্যাপদের। বিদ্যাপতি যে সময়ে চর্যাপদ রচনা করেন, সেটা চৈতন্যদেবের পূর্ববর্তী সময়।
বিদ্যাপতি ছিলেন মিথিলার কবি । বাংলা থেকে মিথিলায় গিয়ে সেই যুগে বাংলার কবিরা বিদ্যাপতির কাছ থেকে চর্যাপদ সংগ্রহ করে আনতেন । তারপর বাংলায় অনুবাদ করতেন। সেই অনুবাদে বাংলা হিন্দি উড়িয়া আসাম মিশ্রিত থাকতো । পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজদরবারে লাইব্রেরী থেকে উদ্ধার করেছিলেন। অবশ্য রাজেন্দ্রলাল মিত্রের নামও করতে হয়। তৎকালীন বৌদ্ধ সাধকেরা গুপ্ত মন্ত্র -চর্যাপদের মাধ্যমে প্রকাশ করতেন। চর্যাপদের আগে নাম ছিল - " চর্যাচর্য - বিনিশ্চয় "।
বাংলা অনুবাদ করেন লুইপা, শবরপা , ভুসুকুপা।চর্যাপদের মাধ্যমে ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাস জানা যায়।
চর্যাপদের উদাহরণ- আপনা মাংসে হরিণাবৈরী । মানে হরিণের মাংসই হরিণের শত্রু। রূপক, উপমা ইত্যাদি সহ চর্যাপদ বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। এবার ব্রজবুলি ভাষা । কি রকম ছিল ব্রজবুলি ভাষা । এই কবিতাটি যেমন -
"হে
সখি হামারি, দুখেরও নাহি ওর /
এ
ভরা বাদর / মাহ ভাদর ।
শূন্য মন্দিরও মোর ।
ঝুম্পি
ঘনঘরো / জন্তি - সন্ততি /
ভুবনভরি বরি খোঁনতিয়া / কান্ত পাহুন -
কাম
দারুণ । সাখান খরসর হন্তিয়া।
কুলিশ
শতশত / পাত মন্দিত /
ময়ূর
নাচিত মাতিয়া। / মত্ত দাদুড়ি ,
ডাকে ডাহুকী। / ফাটি যাওতো ছাতিয়া ।
এর বাংলা - " হে সখি , আমার দুঃখের কোন শেষ নেই। এই ভরা বর্ষাকালের পরেই ভাদ্র মাস। আমার ঘর শূন্য। মেঘের গর্জনের মধ্যে বর্ষার জলে পৃথিবী পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে । শত শত বজ্রপাত হচ্ছে । ময়ূর নাচছে, বর্ষার জলে ব্যাঙ আনন্দে লাফাচ্ছে। ডাহুক পাখি ডাকছে। অসহ্য গরমে আমার বুকের ছাতি ফাটছে ।
এবার ব্রজবুলি ভাষা । ব্রজবুলি ভাষা থেকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ যে গানগুলি লিখলেন তার নাম ভানুসিংহের পদাবলী ।
তার
মধ্যে একটা গান যেমন-
" গহন কুসুম কুঞ্জ মাঝে / মৃদুল মধুর বংশী বাজে, / বিতরি ত্রাস , লোকলাজে / সজনি আও , আওলো ।/
আরেকটা গান - " শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা / নিশীথ যামিনী রে / কুঞ্জ পথে সখি / ক্যায়সে যাউ / অবলা কামিনী রে ।/ শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা"।
উপসংহারে বলা যায়, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস যেখানে বলা হচ্ছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে স্পেনের ভাষা
দিবস তেইশে এপ্রিল। জার্মানির ১২ই সেপ্টেম্বর। রাশিয়ায় ছয় জুন , চিন ২০ এপ্রিল , ফ্রান্সে ২০ মার্চ। আমেরিকা সহ মাত্র কয়েকটি দেশ নিয়ে ইউনেস্কো । আন্তর্জাতিক কথাটি তর্কসাপেক্ষ। সবশেষে একটা কথা উনিশে মেও বাংলা ভাষা দিবস। সেটাও আমরা স্মরণ করবো।
একুশ
প্রশান্ত কুমার ঘোষ
একুশ তারিখ মহান দিনে
বাংলা ভাষার জয়,
একুশ তারিখ মহান ক্ষণে
দস্যু হায়েনা লয়।
একুশ তারিখ মহান রণে
দেশের জন্য প্রাণ,
একুশ তারিখ মহান জনে
করল সবের ত্রাণ।
একুশ মানে একই বোলে
মায়ের কোলে লাফ,
একুশ মানে বিভেদ ভুলে
ঐক্যে অরি সাফ।
একুশ মানে ভাঙা কুলে
হাতের মুঠিই বল,
একুশ মানে ঝরা ফুলে
নতুন একটি ফল ।
ভাষা-১০৩
বিজ্ঞানের ভাষা
সৌমেন বিশ্বাস
হোক
না আন্তঃদেশীয় বিজ্ঞান চর্চার ভাষা ইংরাজী বা অন্য কোনো ভাষা। যে তার নিজস্ব জল, হাওয়া,
মাটিতে জন্মেছে, বড় হয়েছে, যে ভাষায় কথা শিখেছে মায়ের কাছে, মায়ের ভাষায়, হতে পারে
তা আঞ্চলিক ভাষা, সেটাই সহজ বোধ্য, সাবলীল। সেই মাতৃভাষায় বিজ্ঞান শিক্ষা এবং চর্চা
সহজ ও পূর্ণাঙ্গ হয়ে ওঠে। মাতৃভাষাই বিদ্যাচর্চার সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম। বিজ্ঞানাচার্য
পদার্থবিদ সত্যেন্দ্রনাথ বসু বলতেন, শিক্ষিত ভারতবাসী স্বাধীনতা লাভের সাথে সাথে একটা
নতুন দায়িত্ব লাভ করেছে। এই স্বাধীনতার যা কিছু সুফল, তা যেন শুধু অল্পসংখ্যক ইংরাজী
ভাষায় শিক্ষিতের আয়ত্তের মধ্যে না থাকে। সেগুলি যেন দেশের সকলের কাছে পৌঁছে যায়। পদার্থবিদ
সত্যেন্দ্রনাথ দেশের সর্বস্তরে বিজ্ঞানের প্রচার ও প্রসারের জন্য সর্বত্র সব সময় মাতৃভাষায়
বিজ্ঞান চর্চার কথা বলেছেন এবং তিনি নিজেও সেটা আজীবন করেছেন। বিজ্ঞানাচার্যের দৃঢ়
বিশ্বাস ছিল, বিজ্ঞানের মূল এবং প্রাথমিক বিষয়গুলির সঙ্গে সকল সাধারণ মানুষের কিছুটা
পরিচয় থাকা প্রয়োজন। দেশের জনগণ বিজ্ঞান বিমুখ হয়ে থাকলে দেশ কক্ষনো এগোবে না। তিনি
চাইতেন সকলেই বিজ্ঞানের ধ্যানধারণায় অংশগ্রহণ করুক।এ জন্যে আমাদের মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চার
প্রসার ঘটাতে হবে, তাহলেই আপামর সাধারণ বিজ্ঞানের স্বাদ গ্রহণ করতে পারবে এবং দেশে
বৈজ্ঞানিক মনোভাব গড়ে উঠবে। এই উদ্দেশে তিনি ১৯৪৮ সালে কলকাতায় 'বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ'
প্রতিষ্ঠা করেছেন, বাংলা (আঞ্চলিক/মাতৃ) ভাষায় জ্ঞান ও বিজ্ঞান চর্চার জন্য।
ভারতের
বিজ্ঞান চর্চার জগতে আরেকজন দিকপাল, জ্যোতির্পদার্থবিদ জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকর ইংরাজী,
হিন্দী ও মারাঠী ভাষায় বহু বিজ্ঞান গ্রন্থের লেখক কল্পবিজ্ঞানের কাহিনী এবং বক্তৃতার
মাধ্যমে ভারতে বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার জন্য তাঁর গবেষণার বাইরেও বহু সময় ব্যয় করেছেন।
মাতৃভাষা মারাঠীতে লেখা তাঁর কল্পবিজ্ঞানের কাহিনিগুলি বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে।
এহেন ভারতীয় জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকরের স্বাভাবিক উপলব্ধি – মাধ্যমিক
স্তর পর্যন্ত বিজ্ঞানবোধ মাতৃভাষাতেই হওয়া ভালো। এবং উচিৎ। এই সময়কালে শিশু কিশোরদের
প্রখর কল্পনাশক্তি, বুদ্ধিদীপ্ত ভাবনা ও সৃজনশীল জ্ঞানের বিকাশ ঘটে। শুধুমাত্র দুর্বোধ্য
ভাষার কারণে অস্পষ্ট ধারণা আর অসম্পূর্ণ বিজ্ঞান পাঠ ফলপ্রসূ বিজ্ঞান চর্চার প্রতিবন্ধক।
মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য ভাষা শিক্ষায় সময় ও মেধা ব্যয় না
করে শুধুমাত্র মাতৃভাষায় (আঞ্চলিক) ভাষায় বিজ্ঞানের পঠনপাঠন বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষার্থীর
সম্যক ধারণা জন্মায়। সুসংহত বিজ্ঞান মেধার বিকাশ ঘটে।
কল্পবিজ্ঞান
কাহিনি শিশু-কিশোর, এমন কি বড়দের কাছেও আকর্ষণীয়। চিত্তাকর্ষক কল্পিত গল্প বিজ্ঞান
জনপ্রিয়করণের উৎকৃষ্ট মাধ্যম। বিজ্ঞান চর্চায় কল্পবিজ্ঞান উর্বর মস্তিষ্কের ফসল। কল্পবিজ্ঞান
বিজ্ঞানের উদ্ভাবন ও আবিষ্কারের আকরভূমি। পদার্থবিদ জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকর বহু কল্পবিজ্ঞান
কাহিনি লিখেছেন এবং বিভিন্ন জায়গায় বক্তৃতা করেছেন বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার জন্য। কল্পবিজ্ঞান
মানুষকে ভাবায়। মস্তিষ্ককে সক্রিয় করে। কার্যকারণ খোঁজে। বাস্তবতার সাথে মেলাতে চায়।
যুক্তি সম্মত ব্যাখ্যা পেতে চায়। এটাই বিজ্ঞান মানসিকতা বা মনস্কতা। বিজ্ঞানমনস্ক ছাত্রই
প্রকৃত বিজ্ঞানশিক্ষা লাভ করতে পারে। বিজ্ঞান চর্চা ফলপ্রসূ হয়।
বিজ্ঞান
মানসিকতা গড়ে তোলার বিষয়ে বিদ্যালয়গুলির ভূমিকা অপরিসীম। বিজ্ঞান শিক্ষকদের ভূমিকা,
দায় ও দায়বদ্ধতা রয়েছে ছাত্রদের বিজ্ঞান বিষয়ে মানসিক গঠনে। বিজ্ঞানের পাঠ্যবই আর পাঁচটা
বইয়ের মতো পড়লে বা পড়ালে হবে না। শুধু নম্বর তোলার জন্য বা পাশ করার জন্য নয়। সে বিজ্ঞান
শিক্ষা অসম্পূর্ণ এবং পরীক্ষানির্ভর। সেই সাথে পাঠদান যদি যান্ত্রিক হয়, নীরস হয়, তাহলে
বিজ্ঞান পঠনপাঠনের উদ্দেশ্যই বিফল হবে। শিক্ষকগুণে পাঠ্য বিষয় সহজ হয়। সুখপাঠ্য হয়।
নীরস বিষয়বস্তু শ্রুতিনন্দন হয়। শিক্ষকমশাই পারেন বিজ্ঞান পাঠের অসম্পূর্ণ বিষয়বস্তুকে
আনুষঙ্গিক বিষয়সমৃদ্ধ করে পরিপূর্ণ পাঠ দান করতে। শিক্ষক একাধারে পাঠ-কার্যক্রমের রূপকার
এবং সুনাগরিক গঠনের কারিগর। বিজ্ঞান সচেতন মানসিকতা গড়ে তুলতে বিজ্ঞান শিক্ষকের সুদক্ষ
সচেতন প্রয়াস অনস্বীকার্য।
এক
সময় বিশেষ করে গ্রামের সব বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগ ছিল না। বর্তমানে প্রায়
সব বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান পড়ানো হয়। বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগ বেড়েছে, কিন্তু পরিকাঠামোর অভাব
রয়ে গিয়েছে। থাকলেও তা যথেষ্ট নয়। এমনকি শহরেও অনেক বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান শিক্ষা তথৈবচ।
বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান পরীক্ষাগারের মান এবং কুশলতা আরো বাড়াতে হবে। যথাসম্ভব হাতে-কলমে
বিজ্ঞান পাঠদান কার্যকারী হয়। বিষয়ানুসারী বিজ্ঞান পোস্টার, মডেল, আনুষঙ্গিক স্লাইড
এবং যন্ত্রপাতি সহযোগে পাঠদান অতি কার্যকর হয়।
বিজ্ঞান
স্বতঃসিদ্ধ। স্থান কালে সীমাবদ্ধ থাকে না। বিজ্ঞান সব দেশের, বিজ্ঞান সবার। বিজ্ঞান
আন্তর্জাতিক। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বিজ্ঞান চর্চা, উদ্ভাবন ও আবিষ্কারের খবর জানার
জন্য আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরাজী বা অন্যান্য ভাষায় লেখা বিজ্ঞান সংবাদ সহজবোধ্য বাংলায়
সদর্থক অনুবাদ দরকার। বাংলায় বিজ্ঞানের সংবাদ পরিবেশনের জন্য সাংবাদিকদের থাকতে হবে
বিজ্ঞানে ব্যুৎপত্তি ও বিজ্ঞানমনস্কতা। সংশ্লিষ্ট অনূদিত(বাংলা) এবং অনুবাদিত(ইংরাজী
ও অন্যান্য) ভাষাতে পারদর্শিতার প্রয়োজন। সেই সাথে সৎ ও স্বচ্ছ সাংবাদিকতার মানসিকতা।
সর্বোপরি সামাজিক দায়বদ্ধতা।
তথ্যসূত্রঃ-
১)
আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু – জীবন ও কৃতি, সম্পাদনাঃ তপনমোহন চক্রবর্তী, বঙ্গীয় বিজ্ঞান
পরিষদ
২)
bn.m.wikippedia.org
ভাষা-১০৪
২১শে ফেব্রুয়ারীর শব্দেরা
মৌ দাশগুপ্ত আদক
নির্বোধের
মতো ছড়িয়ে পড়ছে বিদায়ী অক্ষরের নামাবলী,‘ৠ,ঌ, ৡ, হ্ম,’…অভিধানের এ কোণ থেকে ও কোণ,
ঠিকানার সন্ধানে। সমস্ত দাড়ি , কমা , সেমিকোলন, ফুলস্টপ হাইফেনরা নিরুদ্দেশ হয়ে আছে
কিছু ব্যবহারিক শব্দের ভিড়ে, বাড়ি আর বাড়ী –র কোন অমিল নেই, সুখদুখ আলাদা নয় সুখদুঃখ-র
থেকে। অ-আ-ক-খ এখনও উদয়াস্ত খাটছে ঝগড়াঝাঁটি মান অভিমানের আক্রোশে, ছন্দে, সুরে, আবেগে
জরজর কি জড়সড় মনের উত্থানে,বাংলা যুক্তাক্ষরগুলো আদর্শলিপির পাতা ছেড়ে নেমে এসেছে তাসরাজ্যে,
বছরে শুধু একটা দিন, ২১শে ফেব্রুয়ারী, লোকের মুখে-মুখে কাগজের স্তুপ পায়ে পায়ে পার
হয়ে বাংলা শব্দেরা সবাই ঘরে ফিরে আসে, লৌকিক-অলৌকিক
অক্ষররা ঢেউ ভেঙে খেলা করে দিনভর, যেমন শিশুরা নিস্পাপ মুখে নিজেদের সাথে খেলে আনমনে।
মায়ের আঁচলের নিরাপদ আশ্রয়ে।
বাংলা ভাষা আন্দোলন ও বাঙালি
উত্তম চক্রবর্ত্তী
★মানভূমের
ভাষা আন্দোলন (ভারত)
বাংলা
ভাষার অধিকার রক্ষার্থে ভারতের একদা মানভূমে বাংলা ভাষা আন্দোলন ১৯১২ সালে শুরু হয়।মানভূম
জেলাকে বার খণ্ডিত ও সংযোজিত করার মাধ্যমে বাংলা ভাষার গুরুত্বকে খর্ব করার চক্রান্ত
চলতে থাকে।সমগ্র মানভূমের প্রায় আশি শতাংশ বাংলাভাষী মানুষ তা মেনে নিতে পারেনি।ফলে
তাদের ভাষা রক্ষার অধিকারে আন্দোলন চলতে থাকে। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬ সালের মধ্যে ভাষা আন্দোলন
তীব্রভাবে ছড়িয়ে পড়ে মানভূমের বাঙালিদের মধ্যে। মানভূমের এই ভাষা আন্দোলন পৃথিবীতে
ঘটে থাকা দীর্ঘতম ভাষা আন্দোলন, যা শুরু হয় ১৯১২ খ্রীষ্টাব্দে এবং ১৯৫৬ খ্রীষ্টাব্দে
পুরুলিয়া জেলা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে পরিসমাপ্তি ঘটে।১৯৫৬ সালের আগে পুরুলিয়া জেলা বিহারের
অন্তর্ভুক্ত ছিল। সেই সময় রাজনৈতিকভাবে বিহারের স্কুল-কলেজ-সরকারি দপ্তরে হিন্দি চাপিয়ে
দেওয়ার চেষ্টা করা হলে মানভূমের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাভাষী জনগণ জাতীয় কংগ্রেসের মাধ্যমে
হিন্দি ভাষার বিরুদ্ধে আন্দোলন করার চেষ্টা করে।কিন্তু তাদের বাংলা ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠিত
না হওয়ায় নেতৃস্থানীয় পুরুলিয়া কোর্টের আইনজীবী রজনীকান্ত সরকার, শরৎচন্দ্র সেন
এবং গুণেন্দ্রনাথ রায় জাতীয় কংগ্রেস ত্যাগ করে জাতীয়তাবাদী আঞ্চলিক দল 'লোকসেবক
সঙ্ঘ' গড়ে তোলেন। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার লড়াইয়ে তাঁরা সুদৃঢ় আন্দোলন করেন।
মানভূম
জেলার বাংলাভাষী মানুষদের ক্ষোভ আঁচ করে জেলা কংগ্রেসের মুখপত্র 'মুক্তি' পত্রিকায়
১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ৮ই মার্চ হিন্দী প্রচার, বাংলা ভাষাভাষীদের বিক্ষোভ ও মানভূম জেলার
বঙ্গভুক্তির যৌক্তিকতা বিশ্লেষণ করে সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশিত হল।এই বিষয়টি বিবেচনার
জন্য ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ৩০শে এপ্রিল বান্দোয়ান থানার জিতান গ্রামে অতুলচন্দ্র ঘোষের
সভাপতিত্বে জেলা কমিটির অধিবেশন হলে সেখানে মানভূমের বঙ্গভূক্তির বিষয়ে প্রতিনিধিদের
মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়। ঐ বছর ৩০শে মে পুরুলিয়া শহরের অধিবেশনে মানভূমের বঙ্গভুক্তির
প্রস্তাব ৫৫-৪৩ ভোটে খারিজ হয়ে গেলে অতুলচন্দ্র ঘোষ সহ সাঁইত্রিশজন জেলা কমিটি থেকে
পদত্যাগ করে ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ই জুন পাকবিড়রা গ্রামে 'লোক সেবক সংঘ' তৈরি করেন।
বিহার সরকার বাংলাভাষীদের প্রতিবাদসভা ও মিছিল নিষিদ্ধ করলে মানভূম জেলায় আন্দোলন
তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে। লোক সেবক সংঘ ১৯৪৯ থেকে ১৯৫১ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত সত্যাগ্রহ
আন্দোলন এবং ১৯৫৪ খ্রীষ্টাব্দের ৯ই জানুয়ারি থেকে ৮ই ফেব্রুয়ারি টুসু সত্যাগ্রহ আন্দোলন
করে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি এই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যোগদান করে। হাজার হাজার বাংলাভাষী
মানুষ কারাবরণ করে।এই সময় বেশ কয়েকটি টুসু সঙ্গীত জনগণের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয়
হয়েছিল। তার মধ্যে একটি হল,---
"শুন
বিহারী ভাই
তোরা
রাখতে লারবি ডাঙ দেখাই
তোরা
আপন তরে ভেদ বাড়ালি
বাংলা
ভাষায় দিলি ছাই৷"
এই আন্দোলনের ফলে ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৯শে ডিসেম্বর ভারত সরকার সৈয়দ ফজল আলির সভাপতিত্বে, হৃদয়নাথ কুঞ্জরু ও কবলম পানিক্করকে নিয়ে রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন তৈরী করে। এই কমিশন ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ৫ই ফেব্রুয়ারি থেকে মানভূম জেলায় তদন্ত করে ঐ বছর ১০ই অক্টোবর তাঁদের বক্তব্য জমা দেন। তাঁদের বক্তব্যে মানভূম জেলা থেকে বাঙালি অধ্যুষিত এলাকাগুলি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে ১৯টি থানা নিয়ে পুরুলিয়া জেলা নামে এক নতুন জেলা তৈরি করার প্রস্তাব দেন। তারা মানভূম জেলা থেকে ধানবাদ মহকুমার ১০টি থানা ও পুরুলিয়া মহকুমার ২টি থানা বিহার রাজ্যে রেখে দেওয়ার প্রস্তাব করেন। অপরদিকে ধলভূম পরগণায় বাংলাভাষীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা স্বীকার করেও যেহেতু ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ ঐ জেলায় বসবাস করেন সেই কারণে কমিশন জামসেদপুরকে পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত করতে বা ধলভূম পরগণা ভেঙ্গে বাংলায় আনতে রাজি ছিলেন না।
এইসময় ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৩শে জানুয়ারী পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধান চন্দ্র রায় ও বিহারের মুখ্যমন্ত্রী শ্রীকৃষ্ণ সিং পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার উভয় রাজ্যের সংযুক্ত করে পূর্বপ্রদেশ নামে এক নতুন প্রদেশ গঠনের প্রস্তাবনা করেন। তাঁরা প্রস্তাব দেন যে, ঐ প্রদেশের সরকারি ভাষা হিসেবে হিন্দী ও বাংলা উভয়ই স্বীকৃত হবে, মন্ত্রিসভা, বিধানসভা, পাবলিক সার্ভিস কমিশন একটি করে থাকলেও হাইকোর্ট থাকবে দুইটি। এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে প্রবীণ কংগ্রেস নেতারা ছাড়াও বামপন্থী দলগুলিও প্রতিবাদ করেন। দুই রাজ্যে এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে সত্যাগ্রহ আন্দোলনের মধ্যে বিহার বিধানসভায় ২৪শে ফেব্রুয়ারি প্রস্তাবটি পাশ হয়ে যায়। লোক সেবক সংঘের কর্মীরা ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ২০শে এপ্রিল পাকবিড়রা গ্রাম থেকে বাঁকুড়া, বেলিয়াতোড়, সোনামুখী, পাত্রসায়র, খন্ডঘোষ, বর্ধমান, পাণ্ডুয়া, মগরা, চুঁচুড়া, চন্দননগর, শ্রীরামপুর, হাওড়া হয়ে কলকাতা শহরের দিকে শান্তিপূর্ণ পদযাত্রা শুরু করে ৬ই মে কলকাতা পৌঁছায়, ৭ই মে মহাকরণ অবরোধের কর্মসূচী অনুসারে বিনয়-বাদল-দীনেশ বাগ পৌঁছালে ৯৬৫ জন কারাবরণ করেন। এই ঘটনার তিন দিন আগে ৪ঠা মে উভয় রাজ্যের সংযুক্তির প্রস্তাবনা বাতিল হয়ে যায়।
এই প্রস্তাবে ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ থেকে ২০শে জুন বিহারপন্থীরা মানভূম জেলায় ধর্মঘটের ডাক দেন। অপরদিকে বাংলা ভাষা আন্দোলনকারীরা ধানবাদ বিহারের অন্তর্ভুক্তিতে খুশি ছিলেন না।
১৯৫৬
খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই আগস্ট বাংলা-বিহার সীমান্ত নির্দেশ বিল লোকসভায় ও ২৮শে আগস্ট রাজ্যসভায়
পাশ হয়। ১লা সেপ্টেম্বর এতে ভারতের রাষ্ট্রপতি সই করেন। এর ফলে ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের
১লা নভেম্বর ২৪০৭ বর্গ মাইল এলাকার ১১,৬৯,০৯৭ জন মানুষকে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের নতুন জেলা
পুরুলিয়া তৈরি হয়।সম্পূর্ণ ধানবাদ মহকুমা ও জামশেদপুর বিহার রাজ্যে রয়ে যায়।
১৯৫৬
সালে ভারত সরকার সাবেক মানভূম জেলা ভেঙে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে সঙ্গে একটি নতুন জেলা (বর্তমান
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পুরুলিয়া জেলা) সংযুক্ত করতে বাধ্য হন।
★বাংলাদেশের
ভাষা আন্দোলন
বাংলা ভাষা আন্দোলন ছিল ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব বাংলায় (বর্তমান বাংলাদেশে) সংঘটিত একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। মৌলিক অধিকার রক্ষাকল্পে বাংলা ভাষাকে ঘিরে সৃষ্ট এ আন্দোলনের মাধ্যমে তদানীন্তন পাকিস্তান অধিরাজ্য পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণদাবির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে এ আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করলেও, বস্তুত এর বীজ রোপিত হয়েছিল বহু আগে।অন্যদিকে, এর প্রতিক্রিয়া এবং ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী।
রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার অধিকার আদায়ে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় আয়োজিত মিছিল ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান অধিরাজ্য ও ভারত অধিরাজ্য নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। পাকিস্তানের ছিল দুইটি অংশ: পূর্ব বাংলা (১৯৫৫ সালে পুনর্নামাঙ্কিত পূর্ব পাকিস্তান) ও পশ্চিম পাকিস্তান। প্রায় দুই হাজার কিলোমিটারের (প্রায় ১২৪৩ মাইল) অধিক দূরত্বের ব্যবধানে অবস্থিত পাকিস্তানের দুটি অংশের মধ্যে সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও ভাষাগত দিক থেকে অনেকগুলো মৌলিক পার্থক্য বিরাজমান ছিল। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান অধিরাজ্য সরকার পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলাকে ইসলামীকরণ তথা আরবিকরণের অংশ হিসেবে ঘোষণা করে যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, পাশাপাশি বিকল্প হিসেবে আরবি হরফে বাংলা লিখন অথবা সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা আরবি করারও প্রস্তাব দেওয়া হয়। আবার, সমগ্র পাকিস্তানের সকল ভাষা লাতিন হরফে লেখার মাধ্যমে বাংলার রোমানীকরণের প্রস্তাবও করা হয়। এসকল ঘটনার প্রেক্ষাপটে পূর্ব বাংলায় অবস্থানকারী বাংলাভাষী সাধারণ জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভের জন্ম হয় ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। কার্যত পূর্ব বাংলার বাংলাভাষী মানুষ আকস্মিক ও অন্যায্য এ সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি এবং মানসিকভাবে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ফলস্বরূপ বাংলাভাষার সম-মর্যাদার দাবিতে পূর্ব বাংলায় আন্দোলন দ্রুত দানা বেঁধে ওঠে। আন্দোলন দমনে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে মিছিল, সমাবেশ ইত্যাদি বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
১৯৫২
সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন ১৩৫৮) এ আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু
সংখ্যক ছাত্র ও প্রগতিশীল কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি
ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের
ওপর গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে নিহত হন বাদামতলী কমার্শিয়াল প্রেসের মালিকের ছেলে রফিক,
সালাম, এম. এ. ক্লাসের ছাত্র বরকত ও আব্দুল, জব্বারসহ আরও অনেকে। এছাড়া ১৭ জন ছাত্র-যুবক
আহত হয়। শহীদদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়ে ওঠে। শোকাবহ এ ঘটনার অভিঘাতে সমগ্র পূর্ব
বাংলায় তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ২১ ফেব্রুয়ারির ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে সারাদেশে
বিদ্রোহের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্র, শ্রমিক, সাহিত্যিক,
বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও সাধারণ জনতা পূর্ণ হরতাল পালন করে এবং সভা-শোভাযাত্রাসহ ১৪৪ ধারা
ভঙ্গ করে। ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহীদ হন শফিউর রহমান শফিক, রিক্সাচালক আউয়াল
এবং অলিউল্লাহ নামক এক কিশোর। ২৩ ফেব্রুয়ারি ফুলবাড়িয়ায় ছাত্র-জনতার মিছিলেও পুলিশ
অত্যাচার-নিপীড়ন চালায়। এ নির্লজ্জ, পাশবিক, পুলিশি হামলার প্রতিবাদে মুসলিম লীগ
সংসদীয় দল থেকে সেদিনই পদত্যাগ করেন। ভাষা আন্দোলনের শহীদ স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার
জন্য মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে রাতারাতি ছাত্রদের দ্বারা গড়ে ওঠে শহীদ মিনার,
যা ২৪ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধন করেন শহীদ শফিউর রহমানের পিতা। ২৬ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে
শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেন দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক জনাব আবুল কালাম শামসুদ্দীন।
ক্রমবর্ধমান
গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করতে বাধ্য
হয় এবং ১৯৫৪ সালের ৭ই মে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত
হয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে ২১৪ নং অনুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দুকে
পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লিখিত হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে একমাত্র
রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা প্রবর্তিত হয়। সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ
সরকার ১৯৮৭ সালে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন জারি করে।১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো বাংলা
ভাষা আন্দোলন, মানুষের ভাষা এবং কৃষ্টির অধিকারের প্রতি সম্মান জানিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারিকে
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে যা বৈশ্বিক পর্যায়ে সাংবার্ষিকভাবে গভীর
শ্রদ্ধা ও যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে উদ্যাপন করা হয়।
★আসামের
ভাষা আন্দোলন (ভারত)
১৯৬০ সালের এপ্রিলে, আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটিতে অসমীয়া ভাষাকে প্রদেশের একমাত্র দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ঘোষণা করার একটি প্রস্তাবের সূচনা হয়। এতে তুষের আগুনের মত ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় উত্তেজনা বাড়তে থাকে। অসমীয়া উত্তেজিত জনতা বাঙালি অধিবাসীদের আক্রমণ করে। জুলাই ও সেপ্টেম্বর মাসে সহিংস্রতা যখন উচ্চ রূপ নেয়,তখন প্রায় ৫০,০০০ বাঙালি হিন্দু ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে পালিয়ে যায়।অন্য ৯০,০০০ বরাক উপত্যকা ও উত্তর-পূর্বের অন্যত্র পালিয়ে যায়। ন্যায়াধীশ গোপাল মেহরোত্রার নেতৃত্বে এক ব্যক্তির একটি তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়।কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী,কামরূপ জেলার গোরেশ্বর অঞ্চলের ২৫টি গ্রামের ৪,০১৯টি কুড়েঘর এবং ৫৮টি বাড়ি ধ্বংস ও আক্রমণ করা হয়।এই জেলা ছিল সহিংস্রতার সবচেয়ে আক্রান্ত এলাকা। নয়জন বাঙালিকে হত্যা করা হয় এবং শতাধিক লোক আহত হয়।
১০
অক্টোবর, ১৯৬০ সালের সেই সময়ের অসমের মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চলিহা অসমীয়াকে আসামের
একমাত্র সরকারী ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়ার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। উত্তর করিমগঞ্জ-এর
বিধায়ক রণেন্দ্রমোহন দাস এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু ২৪ অক্টোবর
প্রস্তাবটি বিধানসভায় গৃহীত হয়।
আন্দোলনের
সূচনা
বরাক
উপত্যকার বাঙালীদের ওপরে অসমীয়া ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে ১৯৬১
সালের ৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে কাছাড় গণ সংগ্রাম পরিষদ নামক সংগঠনটির জন্ম হয়। অসম সরকারের
এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে ১৪ এপ্রিল তারিখে শিলচর, করিমগঞ্জ আর হাইলাকান্দির লোকেরা সংকল্প
দিবস পালন করেন । বরাকের জনগণের মধ্যে সজাগতা
সৃষ্টি করার জন্য এই পরিষদ ২৪ এপ্রিল একপক্ষকাল যাবৎ দীর্ঘ একটি পদযাত্রা শুরু করেছিল।
২ মে তে শেষ হওয়া এই পদযাত্রাটিতে অংশ নেওয়া সত্যাগ্রহীরা প্রায় ২০০ মাইল উপত্যকাটির
গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রচার চালিয়েছিলেন। পদযাত্রার শেষে পরিষদের মুখ্যাধিকারী রথীন্দ্রনাথ
সেন ঘোষণা করেছিলেন যে, যদি ১৩ এপ্রিল,১৯৬১ সালের ভিতর বাংলাকে সরকারী ভাষা হিসেবে
ঘোষণা করা না হয়, ১৯ মে তে তারা ব্যাপক ভাবে হরতাল করবেন।মে মাসের গোড়ার দিকে ঘন
আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করলে ১২ মে তে অসম রাইফেল, মাদ্রাজ রেজিমেন্ট ও কেন্দ্রীয়
সংরক্ষিত পুলিশ বাহিনী শিলচরে ফ্ল্যাগ মার্চ করেছিল। ১৮ মে তে অসম পুলিশ আন্দোলনের
তিনজন নেতা নলিনীকান্ত দাস, রথীন্দ্রনাথ সেন ও বিধুভূষণ চৌধুরী (সাপ্তাহিক যুগশক্তির
সম্পাদক) কে গ্রেপ্তার করে।
১৯
মে-এর ঘটনা
১৯
মে তে শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতে হরতাল ও পিকেটিং আরম্ভ হয়। করিমগঞ্জে আন্দোলনকারীরা
সরকারী কার্যালয়, রেলওয়ে স্টেশন, কোর্ট ইত্যাদিতে পিকেটিং করেন। শিলচরে তারা রেলওয়ে
স্টেশনে সত্যাগ্রহ করেছিলেন। বিকেল ৪টার সময়সূচির ট্রেনটির সময় পার হওয়ার পর হরতাল
শেষ করার কথা ছিল। ভোর ৫:৪০ এর ট্রেনটির একটিও টিকিট বিক্রি হয় নি। সকালে হরতাল শান্তিপূর্ণ
ভাবে অতিবাহিত হয়েছিল। কিন্তু অপরাহ্নে স্টেশনে অসম রাইফেল এসে উপস্থিত হয়।
প্রায়
২:৩০র সময় ন'জন সত্যাগ্রহীকে কাটিগোরা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের একটি ট্রাক তারাপুর
স্টেশনের (বর্তমানের শিলচর রেলওয়ে স্টেশন) কাছ থেকে পার হয়ে যাচ্ছিল।পিকেটিংকারী
সকলে তাদেরকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যেতে দেখে তীব্র প্রতিবাদ করেন।ভয় পেয়ে ট্রাকচালক
সহ পুলিশরা বন্দীদের নিয়ে পালিয়ে যায়। এর পর কোনো অসনাক্ত লোক ট্রাকটি জ্বালিয়ে
দেয়,যদিও দমকল বাহিনী এসে তৎপরতার সাথে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তারপর প্রায় ২:৩৫ নাগাদ
স্টেশনের সুরক্ষায় থাকা প্যারামিলিটারী বাহিনী আন্দোলনকারীদেরকে বন্দুক ও লাঠি দিয়ে
মারতে শুরু করে। এরপর সাত মিনিটের ভিতর তারা আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে১৭ রাউণ্ড গুলি চালায়। ১২ জন লোকের দেহে গুলি লেগেছিল। তাদের মধ্যে
ন'জন সেদিনই নিহত হয়েছিলেন।দু'জন পরে মারা যান। ২০ মে তে শিলচরের জনগণ শহীদদের শবদেহ
নিয়ে শোকমিছিল করে প্রতিবাদ সাব্যস্ত করেছিলেন।
শহীদদের তালিকায় রয়েছেন কানাইলাল নিয়োগী,চন্ডীচরণ সূত্রধর,হিতেশ বিশ্বাস,সত্যেন্দ্রকুমার দেব,কুমুদরঞ্জন দাস,সুনীল সরকার,তরণী দেবনাথ,শচীন্দ্র চন্দ্র পাল,বীরেন্দ্র সূত্রধর,সুকোমল পুরকায়স্থ এবংকমলা ভট্টাচার্য। এরপর ১৯৭২ সালের ১৭ আগস্ট সেবা সার্কুলার প্রত্যাহারের দাবিতে ভাষা আন্দোলনে শহিদ হন করিমগঞ্জের :–বিজন চক্রবর্তী।
এছাড়া ১৯৮৬ সালের ২১ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে বাংলা ভাষার দাবির আন্দোলনে শহিদ হন করিমগঞ্জের আরো দুজন:--জগন্ময় দেব এবং দিব্যেন্দু দাস। এই ঘটনার পর অসম সরকার বরাক উপত্যকায় বাংলাকে সরকারী ভাষা হিসাবে ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।
ফলশ্রুতি
প্রতি
বছর বরাক উপত্যকাসহ ভারতের বিভিন্নপ্রান্তে ১৯ মে কে বাংলা ভাষা শহীদ দিবস হিসেবে পালন
করা হয়।এবং শিলচর রেলওয়ে স্টেশনের পরিবর্তিত নাম ভাষা শহিদ স্টেশন।শিলচর রেলওয়ে
স্টেশনে ভাষা শহিদদের উদ্দেশে নির্মিত হয় স্মৃতিস্তম্ভ।
বরাক
উপত্যকার বাংলা ভাষা শহীদদের স্মরণে, আসামের উধারবন্দে ২০১১ সালে ভাষা শহীদদের মূর্ত্তি
স্থাপিত হয়। ভাষা আন্দোলনের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে শহীদ কমলা ভট্টাচার্য মূর্তি
স্থাপন কমিটির পক্ষ থেকে গোপা দত্ত আইচ ছোটেলাল শেঠ ইনস্টিটিউটের প্রাঙ্গণে কমলার ভট্টাচার্যের
একটি ব্রোঞ্জের আবক্ষ মূর্তি উন্মোচন করেন।
উপসংহার:----
বিশ্বব্যাপী
বাংলা মাতৃভাষী মোট জনসংখ্যা প্রায়২৮কোটি৫০ লক্ষ্য(২০১১ ভারতের আদমশুমারি ও২০১৯ বাংলাদেশ
আদমশুমারি অনুযায়ী)। তার মধ্যে বাংলাদেশ (৫৯.৯৯%),ভারত (৩৮.২১%)এবং অন্যান্য (১.৮%)।
বর্তমান পৃথিবীতে ভাষার পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলা ভাষা পঞ্চম স্থান অধিকার করে।
বাংলা
ভাষা বঙ্গভূমির অধিবাসীদের মাতৃভাষা, যা বর্তমান জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ এবং ভারতের অঙ্গরাজ্য
পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে গঠিত।
মূল
অঞ্চলের পাশাপাশি ত্রিপুরা,দক্ষিণ আসাম এবং ভারতীয় সংযুক্ত অঞ্চল আন্দামান ও নিকোবর
দ্বীপপুঞ্জে বসবাসরত বাঙালীদেরও মাতৃভাষা বাংলা। উড়িষ্যা, বিহার এবং ঝাড়খণ্ডের মতো
প্রতিবেশী রাজ্যসমূহেও বাংলা ভাষায় অনেকে কথা বলেন এবং দিল্লি, মুম্বাই, বারাণসী এবং
বৃন্দাবন সহ বঙ্গের বাইরে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় বাংলা ভাষাভাষী রয়েছেন। এছাড়াও মধ্যপ্রাচ্য,যুক্তরাষ্ট্র,
সিঙ্গাপুর মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা,
যুক্তরাজ্য এবং ইতালিতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় বাঙালি বসবাস করেন।
ভারতে
ভারতীয় সংবিধান দ্বারা স্বীকৃত ২৩টি সরকারি ভাষার মধ্যে বাংলা অন্যতম।ভারতের পশ্চিমবঙ্গ,
অসম এবং ত্রিপুরা রাজ্যের সরকারি ভাষা হল বাংলা।এছাড়াও বাংলা ভারতের আন্দামান ও নিকোবর
দ্বীপপুঞ্জের অন্যতম প্রধান ভাষা। ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাস হতে বাংলা ভাষা
ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যের দ্বিতীয় সরকারি ভাষা রূপে স্বীকৃত।পাকিস্তানের করাচী শহরের
দ্বিতীয় সরকারি ভাষা রূপে বাংলাকে গ্রহণ করা হয়েছে। ২০০২ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর
মাসে সিয়েরা লিওনের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আহমাদ তেজন কাব্বাহ ওই রাষ্ট্রে উপস্থিত জাতিসংঘের
শান্তিরক্ষা বাহিনীর ৫,৩০০ বাংলাদেশি সৈনিকের সেবার স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলা ভাষাকে সরকারি
ভাষার মর্যাদা প্রদান করেন।
নোবেলজয়ী বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুইটি বাংলা কবিতা ভারত ও বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে গৃহীত হয়। অধিকন্তু, অনেকে মনে করেন যে, শ্রীলংকার জাতীয় সংগীত (শ্রীলঙ্কা মাতা) মূলত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি বাংলা কবিতার প্রভাবে লেখা হয়েছিল, আবার অনেকে এমনটাও মনে করেন যে জাতীয় সঙ্গীতটি প্রথমে বাংলায় রচিত হয়েছিল এবং তারপর তা সিংহলিতে অনুবাদ করা হয়েছিল।
২০০৯
খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা জাতিসংঘের সরকারি ভাষা
হিসেবে বাংলা ভাষাকে মর্যাদা দেওয়ার দাবী জানান।
মাতৃ
ভাষা বাঙলার জন্য যে সমস্ত বাঙলা মায়ের সন্তান প্রাণ বলিদান দিয়েছেন তাদের জানাই
শ্রদ্ধা ও স্যালুট।সেই সব ভাইয়েদের আত্মবলিদান আমরা সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করি।
কবি
অতুল প্রসাদ সেনের কথায় আমরা গর্ব করে বলতেই পারি ----
" মোদের গরব মোদের আশা
আ মরি বাংলা ভাষা।"
তথ্যসূত্র
:----
১.ভাষা
আন্দোলনে মানভুম ,নন্দদুলাল আচার্য
আনন্দবাজার
পত্রিকা ২০ফেব্রুয়ারী,২০১৮
২.বিস্মৃত
বলিদান,এই সময়,১৯মে,২০১৩
৩.আবুল
মনসুর আহমদ, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, ঢাকা, ১৯৭৫।
৪.প্রথম
আলো,১০ নভেম্বর ২০২২
ভাষা-১০৬
শুভ্রকান্তি ভট্টাচার্য্য
পৃথিবীতে
যত মায়েরা আছেন, তাঁদের মুখের ভাষা
সন্তানদের
মুখে
থাকুক
যত্নে, সুখে...
ভাষা
সন্ত্রাস তবে
বন্ধ
হবেই, হবে
পৃথিবীর
রঙ আরও নীল হবে,গাঢ় হবে ভালোবাসা
*********
মাতৃভাষা-২
শুভ্রকান্তি ভট্টাচার্য্য
ফেব্রুয়ারি
বা মে, একুশ অথবা উনিশ
রক্তের
রঙ লাল'ই
মায়ের
কোল যে খালি
স্বপ্নেরা
শুধু বাঁচে
সেই
প্রতিবাদী আঁচে-
সকল
মায়ের ভাষাকে জানাতে শতকোটি কুর্ণিশ !
ভাষা-১০৭
বাংলা ভাষা বাংলা মা
অশোক কুমার ঘোষ
তখনও ঠিক হাঁটতে জানি না,
মুখে বাজে না মনোবীণা;
তবুও একটু একটু মা বলি,
মায়ের হাত ধরে বেশ চলি !
মায়ের ভাষা বুক ভরা আশা,
মায়ের ভাষা হৃদয়ে ভালোবাসা!
মায়ের ভাষায় গাই গান,
হৃদয় জুড়ে বীণার তান !
বলি সব উচ্চ স্বরে মাতৃভাষা,
জয় হোক বাংলা মায়ের আশা !
বাংলা ভাষায় ভরুক প্রাণ ,
বাংলা মায়ের থাকুক মান!
ভাষা-১০৮
একুশের জন্য
সনৎ গোস্বামী
একুশের পথে নেমেছি আমরা মিলেছি মায়ের ডাকে,
মাতৃভাষার দাবিতে বরণ করেছি বাংলা মা-কে।
একুশ তুমি তো বারবার ফেরো কণ্ঠে গানের সুর,
বাংলা আমার বাংলা আমার তুলি তান সুমধুর।
একুশ আমার একুশ তোমার দুই বাংলার ভাব-ই
একুশ এনেছে হিন্দু-মুসলমানের মিলিত দাবি
একুশ মানে কি কেবলমাত্র ভাষার স্বার্থে বাঁচা?
একুশ ভেঙেছে দারুণ দুঃশাসনের সোনার খাঁচা।
তাইতো একুশ বারবার আসে বলে বাংলার জয়
একুশ মানেনি কোনো বন্ধন, ভুলে গেছে দ্বিধাভয়।
তাইতো আজকে তুলেছি আওয়াজ একুশ আসুক ফিরে
বাংলা বাঁচক, বাংলা জাগুক বাংলার বুক চিরে
জেগেছে যে খুন তার শপথেই আমাদের বাঁচা-মরা
আজ বাংলার মাটিতে সে শুধু ধূসর, শিকল-পরা।
একুশ আসুক বাংলাদেশের শান্তির ব্রত নিয়ে
বাঁচুক সবাই নারী ও পুরুষ বাঁচুক মায়ে ও ঝিয়ে।
কেন এত বল বিশৃঙ্খল আমার স্বদেশভূমি
কেন এত ভেদাভেদ হানাহানি, কেন এত আমি তুমি
একুশ পারবে মিলাতে তোমাকে ঘুঁচিয়ে সবার ভয়
একুশ মানেই রাম-রহিমের একসুর নিশ্চয়
রফিক, সালাম, বরকত জেনো দিয়েছে যে বলিদান,
নিজের প্রাণের বিনিময়ে তার যথাযথ সম্মান
দিতে পারি যেন আজকে আমরা আমাদের বাংলায়;
সব ক্ষতি ভুলে ভাইবোনে মিলি এটাই মোদের দায়।
ভালোবাসার মাতৃভাষা
তমোঘ্ন চট্টোপাধ্যায়
জাদু
হচ্ছে। আমি অবাক হয়ে দেখি। জাদুকর পুরুষটি তার হাতের আঙুলগুলো বিভিন্ন ভঙ্গিতে সঞ্চালিত
করে। মুখে কোনো শব্দ নেই; নেই কোনো "গিলি গিলি গে" কিংবা "একাস ফোকাস"
মন্ত্র। শুধুমাত্র অঙ্গুলিহেলনেই তার সব কথা বুঝে যায় সঙ্গের মহিলাটি। ওরা ছাড়া ওদের
এই কথোপকথন বোঝে না কেউ। ওরা হাসতে থাকে। রাস্তা পার করে যায় একে অপরের হাত-ধরে। পৃথিবীর
সব শব্দ-গাড়ি তখন থেমে থাকে। ভালোবাসার সিগনাল পোস্টে লাল আলো পলাশের মতো উজ্জ্বল।
আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবি কোন ভাষায় কথা বলে ওরা! ওদের মাতৃভাষা কী?
ওরা
মিলিয়ে যায়। এ-পারের শব্দেরা ছুটতে থাকে দ্রুত গতিতে। এক-পা ফেলতেও ভয় লাগে। এই বুঝি
কোনো শব্দে চাপা পড়ে অক্কা পাবো। ওই জাদুকর আর তার সঙ্গিনীটির কথা মনে পড়ে। কে যেন
কানেকানে বলে - ওদের মাতৃভাষার নাম ভালোবাসা। বিশ্বাস সেই ভাষার স্বরবর্ণ। নির্ভরতা
ব্যঞ্জনবর্ণ। ওই ভাষার ব্যাকরণ লিখেছেন কোনো এক আদিম গুহামানব। অজন্তা-ইলোরার গুহার
দেওয়াল সেই ব্যাকরণ বই।সে-ভাষার পাঠশালা বসে গাছের ডালে, নদীর বুকে, আকাশের নীলে।
কত
মাতৃভাষা দিবস এলো,গ্যালো। ভালোবাসার সেই মাতৃভাষা শিখতে পারলাম না আজও। এ-জন্মে কি
শিখতে পারব! দিবস রজনী আমি যেন "তার" আশায় আশায় থাকি...
ভুলবো না তোমায় একুশে ফেব্রুয়ারী
দেবলীনা খান্না ব্যানার্জী
বাংলা মোদের মাতৃভাষা, মাতৃসম তার স্থান,
বাংলা ভাষাতেই কণ্ঠে মোদের জীবনের জয়গান।
বাংলা আজ নেই পিছনে, বিশ্বজুড়ে তার খ্যাতি,
বাঙালির কাছে গর্বের বিষয় ভাষাটির বিস্তৃতি।
বাংলাতেই লেখাপড়া, বাংলাতে গান গাওয়া,
বাংলায় লেখা মণিমানিক্য লাভে জীবনকে খুঁজে পাওয়া।
সহজপাঠ সেই রবিকবির বিদ্যাসাগরের
বর্ণপরিচয় ,
বাংলা মোদের আশা ভরসা, করে দান সাহস আর অভয়।
স্মৃতির পাতায় ২১ সে ফেব্রুয়ারি,
শোক বিহ্বল একটি
দিন __
কত প্রাণ হল বলিদান
শোধ করতে মাতৃভাষার ঋণ।
একুশের রণে বাজলো দুন্দুভি ,সময় কথা বলে,
কত তাজা প্রাণ হলো যে শহীদ বিদ্রোহের রোষানলে ।
একুশে মানে প্রতিবাদের ঝড়, মাতৃভাষার জয়জয়কার,
বাঙালি বলে গর্বিত আমি, করি গুণগান বাংলা ভাষার।
চিরকাল রবে চিন্তনে, মননে একুশে ফেব্রুয়ারি,
বাংলা আমার প্রাণের ভাষা, তারে কি ভুলতে পারি ?
ভাষার অবলুপ্তি
উত্তম চক্রবর্ত্তী
সর্বভারতীয়
বিভিন্ন ক্ষেত্রে পাল্লা দেওয়ার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগে কচিকাঁচা শিশুদের
শৈশব থেকে ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে রাজ্যের একাধিক সরকার পোষিত বিদ্যালয়ে
২০১৯ শিক্ষাবর্ষ থেকে ইংরেজি মাধ্যমে পঠনপাঠন চালু হচ্ছে। বিগত বাম সরকারের আমলে ইংরেজি
ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে চালু হওয়ার ফলে যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে অনেক অভিভাবক ইংরেজি
মাধ্যম স্কুলে সন্তানদের ভর্তি করান। বস্তুত সেই সময় থেকেই রাজ্যে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের
বাড়বাড়ন্ত।
একটু আর্থিক সঙ্গতিসম্পন্ন পরিবার তাদের সন্তানকে বাংলা মাধ্যম স্কুলে বর্তমানে ভর্তি করান না। এমনকি, কলকাতার অনেক নামি বাংলা মাধ্যম স্কুলেও পড়ুয়া বাড়ন্ত। শহর ও শহরতলি এলাকায় বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলি পড়ুয়াহীনতায় ভুগছে। মফঃস্বলেও ইংরেজি মাধ্যম স্কুল থাবা বসিয়েছে।
সমাজের প্রান্তিক পরিবারের সন্তানেরা কেবল মাত্র আজ সরকারি বাংলা মাধ্যম স্কুলের পড়ুয়া। অর্থনৈতিক সঙ্গতিসম্পন্ন ও অভিজাত বাঙালি পরিবারে বাঙালিয়ানা আস্তে আস্তে উধাও হয়ে যাচ্ছে। বাড়ছে ইংরেজি-হিন্দির সংস্কৃতি চর্চা। এমনকি, বর্তমানে বাংলা ব্যান্ডগানে বিকৃত বাংলা উচ্চারণ কানে বড় পীড়া দেয়। ঘরে-বাইরে সর্বত্র বেআব্রু হয়ে পড়ছে বাঙালি সংস্কৃতি-কৃষ্টি এবং বাংলা ভাষা। একে কেন্দ্র করে বাঙালি সমাজ স্পষ্টতই দ্বিধাবিভক্ত।
অনেকের প্রশ্ন, বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ কী? বাংলা ভাষা কি বিপন্ন নয়? এই মুহূর্তে মনে হয়, বাংলা ভাষা অস্তিত্বের সঙ্কটে না পড়লেও তার ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকণ্ঠার যথেষ্ট কারণ আছে। দু’টি দিক থেকে বিপদ তৈরি হয়েছে। এক দিকে, সমাজের ক্ষমতাবান শ্রেণির বাংলাচর্চা পরিত্যাগ ও প্রায় একক ভাষা হিসাবে ইংরেজি চর্চা ও ব্যবহারের প্রতি ঝোঁক বৃদ্ধি। পৃথিবী থেকে প্রতি পনেরো দিনে একটি ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গেলেও বাংলার সে ভয় নেই, কারণ বাংলাদেশ। পশ্চিমবঙ্গবাসীর তুলনায় বাংলাদেশিরা বাংলা ভাষার প্রতি অধিক শ্রদ্ধাশীল, যত্নশীল। কিন্তু বাংলার উপভাষা মানভূঁইঞা ? বর্তমান কালে শিক্ষিত মানভূঁইয়ারা কষ্ট করে হলেও মান্য বাংলায় কথা বলার চেষ্টা করছে। নিজের মাতৃভাষাতে কথা বলতে নাকি লজ্জা বোধ করছে।
বাংলা ভাষাভাষীর মানুষের সংখ্যা সব মিলে ত্রিশ কোটির বেশি। সংখ্যার বিচারে পঞ্চম ভাষা বাংলা। ভাষা নদীর মতো বহতা, তার পরিবর্তন, রূপান্তর ঘটে। গ্রহণ-বর্জনের মাধ্যমে সচল ভাষা সমৃদ্ধি অর্জন করে চলে। তাই মনে প্রশ্ন জাগে, বাংলা ভাষা বিপন্ন না হলেও আজকের দিনে তা একটি ক্ষয়িষ্ণু ভাষায় পরিণত। না কি, বাংলা ভাষা একটি ক্ষয়ের পর্ব অতিক্রম করছে? রাষ্ট্রে ও সমাজে ক্ষমতাবান শ্রেণি বাংলাচর্চা ত্যাগ করে ইংরেজি-হিন্দিমুখী হচ্ছেন। বাংলা এই শ্রেণির মানুষের কথ্য ভাষায় সীমিত হয়ে পড়েছে। এই কথ্য বাংলা একদিকে আঞ্চলিকতায় পীড়িত, অন্য দিকে, ইংরেজি-হিন্দি শব্দের অপপ্রয়োগে ভারাক্রান্ত। সংবাদের মতো আনুষ্ঠানিক পাঠ্যে দেদার ইংরেজি ও হিন্দি শব্দ ব্যবহৃত হচ্ছে। এ কৌশলই অনুসরণ করছে হালে জনপ্রিয় এফ এম রেডিও জকিরা। টিভি, রাস্তাঘাট এমনকি সরকারি দফতরেও বিকৃত বাংলায় বিজ্ঞাপন। ভাষার প্রতি অনীহা এবং অশ্রদ্ধা থেকেই এই ধরনের বিকৃত প্রদর্শনী।
ইংরেজি ভাষা চলছে কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে, সংখ্যায় বাড়তে থাকা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলিতে, শপিং মলে, কর্পোরেট সেক্টরে, শহরের অভিজাত পাড়ায় পাড়ায়। মোদ্দা কথা, একুশ শতকের বাঙালি প্রজন্ম ইংরেজির প্রতি যতটা আগ্রহী, বাংলার প্রতি ততটা নয়।
একটি ভাষার বেড়ে ওঠা, প্রচার-প্রসারের পিছনে বহু ত্যাগ থাকে, থাকে সীমাহীন শ্রম, সাধনা। বাংলা ভাষার জন্মলগ্ন থেকে অধুনাকাল অবধি বিবর্তন সেই সাক্ষীই বহন করে। ১৯১২ খ্রীষ্টাব্দে মানভূমের জনগন মাতৃভাষা রক্ষার তাগিদে ভাষা আন্দোলন শুরু করে । বৃহত্তর মানভূমের স্কুল, কলেজ,অফিস, আদালতে জোর করে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে এই আন্দোলন শুরু হয়।যা শেষ হয় ১৯৫৬ সালে পুরুলিয়া জেলার জন্মের সাথে সাথে। আবার ১৯৫২ সালে ২১ ফ্রেবুয়ারি বাংলাদেশিরা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য জীবন দিয়েছে। সালাম, বকরত, রফিক, শফিউর, জব্বার সঙ্গে কিশোর অহিউল্লাহও শহিদ হয়েছেন। জাতিসঙ্ঘ ২১ ফ্রেবুয়ারিকে আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। অসমের বাঙালিদের উপর ‘অসমিয়া’ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৬১ সালে ১৯ মে প্রতিবাদে রাজপথে নামে অসমের মানুষ। সে দিন পুলিশের গুলিতে শহিদ হন ১১ জন। যখনই কোনও শক্তি বা দেশ অন্য কোনও দেশকে দখল করেছে, পরাজিত করেছে, শাসন করেছে তারা ওই জাতি, দেশের উপর চাপিয়ে দিয়েছে দখলকৃতদের ভাষা, সংস্কৃতি।
ভাষা মানুষে মানুষে যোগাযোগের প্রধানতম বাহন। অসীম প্রকাশ ক্ষমতাসম্পন্ন ভাষা একান্তই একটি মানবিক বৈশিষ্ট্য। মানুষ ছাড়া আর কোনও প্রাণী এই ক্ষমতার অধিকারী নয়। প্রতিটি মানুষ ভাষা আয়ত্ত করার সহজাত বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মায় এবং ওই মানুষটি যে নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক পর্যায়ের নির্দিষ্ট ভৌগোলিক পরিবেশ বেষ্টিত ভাষিক সমাজের অন্তর্গত, সেই সমাজে সে দৈনন্দিন ভাষা প্রয়োগের মাধ্যমে তার নিজস্ব ভাষাজ্ঞান বিকশিত করে।
যখন কোনও ভাষার ব্যবহারকারী অবশিষ্ট থাকে না, তখনই ভাষা হারিয়ে যায় বা বিলুপ্ত হয়ে যায়। এবং তা অন্তর্হিত বা মৃত ভাষা হিসাবে পরিগণিত হয়। সংরক্ষিত বা লিখিত পাণ্ডুলিপি অধ্যয়ন ও গবেষণার মাধ্যমে বিলুপ্ত ভাষা বা মৃত ভাষা অবলোকিত হয়। যদিও সমগ্র মানব ইতিহাসে বিভিন্ন ভাষা ক্রমাগত নানা কারণে বিলুপ্ত হচ্ছে, তবুও সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বায়ন, নব্য ঔপনিবেশবাদ এবং অর্থনৈতিক ভাবে শক্তিশালী ভাষা অন্য ভাষার উপর আধিপত্য বিস্তারের ফলে আশঙ্কাজনক হারে অনেক ভাষা পৃথিবী থেকে অবলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। বাংলা ভাষাও সেই রোগে আক্রান্ত।
অধিক প্রচলিত ভাষা তুলনামূলক কম প্রচলিত ভাষার উপর প্রভাব বিস্তার করে। ফলে, শেষমেষ তা বিলুপ্ত হয়ে যায়। বিশ্বে বর্তমানে প্রচলিত ভাষার সংখ্যা ৬০০০ থেকে ৭০০০। এর মধ্যে আগামী কয়েক দশকের মধ্যেই এর নব্বই শতাংশ হারিয়ে যাবে বা বিলুপ্ত হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা। ২০টি অধিক প্রচলিত ও পরিচিত ভাষার প্রত্যেকটিতে কথা বলে ৫০ মিলিয়নের বেশি লোক, যা বিশ্বের জনসংখ্যার অর্ধেক। অপর দিকে, অন্য ভাষাগুলোতে কথা বলে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা, যার সংখ্যা ১০,০০০এর অধিক হবে না। বিশ্বের ১১টি সর্বাধিক প্রচলিত ভাষা হল চিনা, ইংরেজি, হিন্দি-উর্দু, স্পেনীয়, আরবি, পর্তুগিজ, রুশ, বাংলা, জাপানি, জার্মান ও ফরাসি।
এই সব ক’টি ভাষা ইন্দো ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত এবং বিশ্বের ৪৬ শতাংশ মানুষ এই ভাষায় কথা বলে। কিন্তু বর্তমান পরিমন্ডলে দাঁড়িয়ে বাঙালি জনগনের ইংরেজি,হিন্দির প্রতি ঝোঁক বাঙলা ভাষাকে বিপন্নের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।এর শেষ কোথায়,কে জানে?
ভাষা-১১২
ভাষাস্বাধীনতা
ড. তপন কুমার দাস
মাতৃভাষা মদীয় সর্বদা বাগীশ্বরী,
সকলের নিমিত্ত
অনুরাগের রসধারা।
রক্তে রঞ্জিত অস্মদীয় এই বসুন্ধরা,
স্বাধীনতার সূত্রে গ্রথিত অভিন্ন শৃঙ্খল।
অনুরাগে সংপ্রসিক্ত মধুর সুরের সঙ্গীত,
স্বকীয় ভাষায় নরসত্তা চির চলমান।
এই বাক্য আমাদের
নীতিরূপে প্রতিষ্ঠিত,
মাতৃভাষা মানুষের জীবনচর্যার অমৃত।
ভাষার মাধ্যমে শব্দ সার্থক ও প্রাণময় হয়,
যেখানে স্বাধীন জীবন পূর্ণমাত্রায় স্পন্দিত।
যাঁর বলিদানে পৃথিবী সমুদ্ভাসিত হয়,
তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করি পত্রমালায়।
আমার জীবন ভাষার সাথে পূর্ণরূপে যুক্ত,
তাই, ভাষাই আমার স্বাধীন জীবনধারার মূল স্তম্ভ।
ভাষা-১১৩
বাংলা ভাষা
শোভন চট্টোপাধ্যায়
ভাষা আমায় বাংলা
ভাষাই আমার জান,
ভাষা আমার বুকের রক্ত
ভাষাই বাঙালীর মান।
পশ্চিমবঙ্গে জন্ম আমার
খাঁটি বাঙালি আমি,
সর্ব ভাষার মূল্যায়নে
বাংলা ভাষাই দামী।
বুকটা মোদের ওঠে গর্বে
হলে ভাষার জয়।
বাংলা ভাষা সহজ সরল
এসকল বাঙালি কয়।
হাওয়ায় হাওয়ায় চলে ভেসে
বাংলা ভাষায় গান,
বাংলা আমার মাতৃভাষা
ভাষাই আমার টান।
ভাষা-১১৪
ইংরেজি বাংলা
দেবব্রত সরকার
বাংলাটা ঠিক আমার নয়
কেমন যেন হারিয়ে যায়
কেমন যেন ভীষণ ভয়
এ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায় !
বাংলা কথা বলতে পারো !
গড়গড়িয়ে, হরহড়িয়ে
ইংরেজি-টিংরেজি ওসব ছাড়ো !
বাংলা পড় ঝরঝরিয়ে !
না-না-না-না-না! মা, বলেছেন
বাংলা বাদে ইংরেজিতে
বললে কথা; সাহেব হব !
পড়ি; উঠতে বসতে খেতে
কিন্তু, সত্যিই বলছি আজ
পড়ার সময়; ভয় -এতো - না ---
মাকে বলেছি ; বাংলা ছেড়ে
মা- ইংরেজি ঠিক আসে না!
রাঙিয়ে চোখ মা, তুলেছে বেত
ওমা মা! মেরো না আর; থাক!
বাংলা বইটা তো বুকে জানা---
ইংরেজি টা; সাগর পাড়ে যাক!
আমাকে মা, ধমক দিয়ে বলেন,
যা--; বাংলা নিয়ে হোগে কানা--!
কাঁদতে কাঁদতে বলি মাকে ---
মা----, ইংরেজি আর পড়ব না!
==============================
ভাষা-১১৫
ভাষা’র আয়ু
আর্যতীর্থ
সব ভাষারই মৃত্যু আছে, লব্জতে সে পাল্টাবেই
বাঁধ দিতে যাক যতই মানুষ, এই প্রবাহের পাল্টা নেই,
প্রাচীন প্রাচীর ভাঙবে ভাষা নতুন বাঁকের সন্ধানে
সময় কেবল জানে নতুন নাম পাবে সে কোনখানে।
কিন্তু তাতে অনেক শতক, হাজার বছর কিচ্ছু নয়
শ’কোটি জিভ বাঁচায় তাকে রোজের কথার মূর্ছনায়
গান কবিতা সাহিত্যে নয়, সেই ভাষা-স্রোত কথ্যতে
ভাষা বাঁচে এমনি লোকের রোজের কথার পথ্যতে।
যেসব ভাষায় রবি-কাজী-মানিক-তারা’র জন্ম
না,
ভেবো না সেই মা-ভাষাকে আঁকড়ে বাঁচে কমজনা.
মায়ের দুধের মতোই সে যে প্রথম লাগে সব জিভে
সাহিত্য তার নাই কিছু থাক, যায় না প্রদীপ দপ নিভে।
আয়ুশেষের আগেই ভাষা চায় অনেকে করতে খুন,
বণিক এবং রাজার ভাষা করে অনেক ছল নিপুণ
‘ভিন্ন
ভাষা শিখলে তবেই শিক্ষা যাবে উঁচুর ধাপ ,
মা-ভাষা স্রেফ থাকলে শিখে টানবে নিচে লুডোর সাপ।’
তাতেও ভাষা মরবে না রে, থাকবে বেঁচে লোক-মুখে,
একটু শুধু গরীব হবে চাপিয়ে দেওয়া জোঁক ঢুকে।
ঢাকলে ভাষা রাজ-মদতে ভিন্নভাষার চর্বিত
‘এবার
ভাষা শেষ হবে ঠিক’ যতই তা হোক চর্চিত..
ভাষাকে শেষ যায় না করা থাকলে ভাষী গর্বিত,
যেই না ভাষা খতম করার স্বররা ষড়ে বর্ধিত
ডাক পাঠাবে সমভাষী, আয় না পাশে, লড়বি তো!
প্রশ্ন এটাই, আজকে তুমি বাংলা নিয়ে গর্বী তো?
ভাষা-১১৬
একুশের গান
সুজাতা বন্দ্যোপাধ্যায়
ফাগুন আগুন একুশ রঙে
বাংলা ভাষার আশায়।
শহীদের রক্ত হলো সফল
বাংলা কথার মালায় ।
বাংলা ভাষার বিজয় কেতন
ওড়াও সবাই ধরার বুকে।
লাল সবুজের বিশ্বজয়
ছড়িয়ে পড়ুক সবার মুখে।
ভাষাধরায় প্রাণ দিলো যারা
মনে রেখো তার আত্মদান।
মুকুলিত হোক বাংলাভাষার
নতুন নতুন সৃষ্ট গান।
ভাষা-১১৭
মাতৃভাষা
রাজকুমার ঘোষ
বাংলা ভাষা মিষ্টি মধুর যদি তুমি শোনো
তোমার ভাষাও থাকবে সাথে ভুলবেনা কক্ষনো।
বাংলা ভাষা অমৃত জেনো, যেখানেই তুমি থাকো,
তোমার ভাষার সাথী হয়ে গড়বে শব্দ সাঁকো।
আবেগ যত বাংলা ভাষায় শক্তিশালী ভিত
যার জন্য লড়াইতে হয়েছেন কত শহীদ
বাংলা ভাষা গর্ব আমার; আমার মাতৃভাষা।
এই বাংলায় আছো যখন; বাংলাই ভালোবাসা।
প্রথম শেখা মা'র কাছে তিনিই প্রথম গুরু
সাথে আমার মাতৃভাষা, স্বপ্ন নিয়েই শুরু...
ভাষা-১১৮
ভাষা শহীদ
অমিত মুখোপাধ্যায়
যে
বর্ণমালায় তোকে সৃষ্টি করি, যে ভাষায় তোকে লিখি, তোকে আঁকি, সে বড় পবিত্র বর্ণমালা।
বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির সকালে ঢাকার রাস্তায় তাকে ভাইয়ের রক্তে ধুয়ে নিয়েছি। সে
বড় পবিত্র ভাষা। একষট্টির উনিশে মে শিলচর রেল স্টেশনে তাকে ভাই-বোনের রক্তে ধুয়ে নিয়েছি।
বার বার ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে আমার স্বজাতি। কী হয় বাংলায় কথা না বললে! কী হয় বাংলায় না লিখলে! শোন তবে, আমি মুছে যাই এই
ভুবন থেকে, প্রকাশ ছাড়া আমার অস্তিত্ব নেই, তাই ভাষাই সম্বল। সত্যি, ভাবতে, তোকে ভাবতেও
আমার ভাষার দরকার হয়। এই যে তোর চোখের পাতায় আমি মনসামঙ্গল, বিষাদসিন্ধু পড়ি, সে এই
বাংলাভাষায়। তোর কন্ঠস্বরে যে প্রার্থনা, দোয়া দরুদ শুনি তা সংস্কৃত বা আরবিতে নয়,
বাংলায়। আবহমান বাংলাভাষায় তোর জন্য প্রতিদিন যে বন্দনাগীতি লিখি তা বাংলা ছাড়া অন্য
ভাষায় কল্পনাতেও আসে না। হাজার বছরের এই ভাষা লিখনে আমি মুহূর্তে ছুঁয়ে ফেলি 'চৌরাশি
সিদ্ধা'র ডোম্বী, কুক্কুরী, গুণ্ডরীর মত চর্যাপদের কবিদের। এই ভাষার লিখনে আমার হাত
ধরে থাকেন জীবনানন্দ, আল মাহমুদ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শামসুর রহমান থেকে বেবী সাউ,
ঝিলম ত্রিবেদী, আসমা অধরা। তারাই আমার কানে ভালোবাসার বাংলা মন্ত্র দিয়েছে। আয়, কোথায়
কে একুশের শহিদদের প্রণাম, সালাম জানালো কী জানালো না ভুলে যাই। তোর হাতখানি বাড়িয়ে
দে। ওই করতলে শহিদ মিনার আঁকি, তারপর চুম্বন করি সেই পবিত্র চিহ্নে। শপথ নিই, তোকে
ঠিক ততোটাই ভালোবাসবো, যতটা বাসি বাংলাভাষাকে।
অমর
একুশে ফেব্রুয়ারির সকালে সবাইকে জানাই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের শুভেচ্ছা। সবার
মাতৃভাষা বেঁচে থাক।
আ’মরি বাংলা ভাষা
রচনা : নির্মলেন্দু কুণ্ডু
চরিত্র
: অর্ণব (ছেলে), মা, ভাষা আন্দোলনকারীরা, পুলিশ
(অর্ণব
একটা চেয়ারে বসে একটা বই পড়ছিল ৷ পাশে ওর মা দাঁড়িয়ে কাপড় গোছাচ্ছিলেন ৷)
অর্ণব
: মা...
মা
: বল বাবু ৷
অর্ণব
: জানো, আজ একটা দারুণ গান শুনলাম স্কুলে ৷ তুমি তো জানো আজ ২১শে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠান
ছিল স্কুলে ৷ সেখানে স্যার একটা গান শোনালেন — "আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে
ফেব্রুয়ারি" ৷ কি দারুণ গান !
মা
: হ্যাঁ, গানটা কে লিখেছেন জানো ?
অর্ণব
: না, মা ৷
মা
: আব্দুল গাফফার চৌধুরী ৷ সেই ১৯৫২-র ২১ শে ফেব্রুয়ারি উনি গানটা লিখেছিলেন ৷ আর গানটায়
প্রথম সুর দিয়েছিলেন আব্দুল লতিফ ৷ তবে এখন যে সুরটা শোনো, সেই সুর দিয়েছিলেন আলতাফ
মাহমুদ ৷ ১৯৫৪ থেকে এই সুরটাই চলে আসছে ৷
অর্ণব
: ও.. স্যার বলছিলেন জানো, এদিন নাকি আমাদের মাতৃভাষা বাংলার জন্য বহু মানুষ আন্দোলন
করেছিলেন ৷ প্রাণও দিয়েছিলেন ৷ চারজনের নামও বললেন — রফিক-সালাম-বরকত-জব্বার ৷
মা
: তোমাদের স্যার ঠিকই বলেছেন ৷ সে কি আন্দোলন, জানো...
(বলতে
বলতে মা আর ছেলে মঞ্চের কিছুটা ভেতরে ঢুকবে ৷ অন্য উইঙ্গ থেকে ঢুকবে দুটি ছেলে, হাতে
প্ল্যাকার্ড, তাতে লেখা 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই', 'বন্দি ভাইদের মুক্তি চাই' ৷)
প্রথম
ছেলে : আমাদের ভাষা আমাদের অহঙ্কার ৷ আমাদের ভাষার ওপর জুলুম চলবে না৷ আমাদের রাষ্ট্রভাষা
বাংলা চাই ৷
দ্বিতীয়
ছেলে : আমরা কোন ভাষাকে অশ্রদ্ধা করিনা ৷ কিন্তু জোর করে আমাদের ওপর অন্য ভাষা চাপানো
যাবে না ৷ অন্যায় জুলুমে আটকে রাখা আমাদের ভাইদের মুক্তি চাই৷
(উল্টোদিক
থেকে উর্দিপরা এক পুলিশের প্রবেশ ৷)
পুলিশ
: থামো ৷ নইলে গুলি চালাতে বাধ্য হব ৷
প্রথম
ছেলে : না, আমরা থামব না ৷
দ্বিতীয়
ছেলে : মাতৃভাষার জন্য আমাদের লড়াই চলছে, চলবে ৷
(হঠাৎ
পুলিশটি গুলি ছোঁড়ার ভঙ্গি করল, দুটি ছেলেমেয়েই লুটিয়ে পড়ল ৷ মঞ্চ ধীরে ধীরে অন্ধকার
হয়ে এল, শুধু স্পটলাইট মা আর ছেলের ওপর ৷)
মা : ওখানকার মানুষেরা নিজেদের মাতৃভাষাকে খুব ভালোবাসতেন ৷ তাই নিজেদের অঞ্চলে নিজেদের ভাষার স্বীকৃতি চেয়েছিলেন ৷ আর সেজন্যই তো এমন মরণপণ করে সংগ্রাম করেছিলেন ওখানকার ছাত্র থেকে সাধারণ মানুষ ৷ আরও একটা জিনিস, তুমি যাঁদের নাম করলে, তাঁদের মধ্যে আবুল বরকত আমাদেরই জেলার ভরতপুরের বাবলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ৷
অর্ণব
: জানো মা, স্যার বলছিলেন শুধু এই ২১শে ফেব্রুয়ারিই নয়, বাংলা ভাষার জন্য নাকি আরও
দুটো আন্দোলন হয়েছিল ৷
মা : হ্যাঁ ৷ উনি ঠিকই বলেছেন ৷ সেটা ১৯৬১ সালের কথা ৷ আসামের বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষার স্বীকৃতি আদায়ের জন্য হয়েছিল আরেক আন্দোলন ৷ সেখানে আমরা পেয়েছিলাম অমর ১১ বীর ভাষাসেনানীকে ৷ পেয়েছিলাম প্রথম মহিলা ভাষাশহিদ কমলা ভট্টাচার্যকে, বছর ষোলোর যে মেয়েটি তার বোন মঙ্গলার সাথে ৷
(একথা
বলতে বলতেই মঞ্চ আবার আলোকিত হতে শুরু করল ৷ উল্টোদিকের উইংস থেকে ঢুকল দুটি মেয়ে ৷
একটি বড়, একটি একটু ছোট ৷)
বড়
মেয়ে (কমলা) : তুই এখানে থাক মঙ্গলা, কোথাও যাস না ৷ আমি একটু এগিয়ে দেখছি ৷
ছোট
মেয়ে (মঙ্গলা) : ওদিকে দেখ দিদি, পুলিশে লাঠি চালাচ্ছে ৷ তুই বেশিদূর যাস না৷
বড়
মেয়ে : ঠিক আছে ৷
(বড়
মেয়েটি কিছুদূর এগোতেই হঠাৎ উল্টোদিক থেকে কয়েকজন দৌড়ে ঢুকে পড়ে ৷ লাঠি চালাতে থাকে
৷ মঙ্গলার গায়ে আঘাত পড়ে ৷ ও পড়ে যায় ৷ ওকে পড়ে যেতে দেখে কমলা ছুটে আসে ৷ হঠাৎ গুলির
শব্দ ৷ চোখে হাত দিয়ে পড়ে গেল কমলা ৷ ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছে 'শোনো ডাকে ঐ একাদশ শহিদেরা
ভাই/আর দেরি নয়, দেরি নয়, দেরি নয়" ৷
মঞ্চ আবার অন্ধকার হয়ে এল ৷ স্পটলাইটে মা ও ছেলে)
ছেলে
: ইস ৷ কত কষ্ট সহ্য করেছেন ওঁরা ৷ আর কোন আন্দোলনের কথা বলছিলে...
মা
: মানভূমের ভাষা আন্দোলন ৷ এই তিনটে আন্দোলনের মধ্যে সবথেকে প্রথমে ওটাই শুরু হয়েছিল
৷ সেই ১৯১২ সালে ৷ স্বাধীনতার পর আন্দোলন তো আরও তীব্র হল ৷ পাকবিড়রা গ্রাম থেকে শুরু
হয়েছিল কলকাতা পর্যন্ত বিশাল পদযাত্রা ৷ শেষ পর্যন্ত ১৯৫৬ সালে গড়ে উঠল পুরুলিয়া জেলা
৷
(মঞ্চ
আবার আলোকিত হ'ল ৷ ওদিক থেকে এল জনা চারেকের দল সারি বেঁধে ৷ ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজতে
শুরু হল গান —
"বাংলা
আমার প্রাণের বাংলা
মায়ের
মুখের বুলি,
বাংলার
গান গেয়ে আমি
সাহসের
দ্বার খুলি।
অ
আ ক খ দিয়ে
প্রেমের
সুতোয় প্রতিদিন গাঁথি মালা
আলতা
রাঙানো পলাশের ফুলে
সাজিয়ে
মনের ডালা।
স্বপ্নদীঘিতে
হারিয়ে নিজেকে
শাপলা
- শালুক তুলি,
বাংলার
গান গেয়ে আমি
সাহসের
দ্বার খুলি।"
ওরা
এসে দাঁড়াবে মঞ্চের মাঝখানে ৷ অন্যদিক থেকে
আসবে কমলা, মঙ্গলা ও ঐ দুটি ছেলে ৷
মা-ছেলের পাশাপাশি তারা দাঁড়াবে ৷ তারপর একসাথে অভিবাদন গ্রহণ করবে ৷)
বাংলা ভাষা নিয়ে বিশ্বের ইতিহাসে ঘটা তিন আন্দোলনের অন্যতম কিছু সেনানী
আমাদের পদক্ষেপ প্রকাশনী ইতিমধ্যে প্রকাশ করেছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বই। বই আমাদের কাছে প্রতিমার মতোই। তাই যত্ন নিয়ে কাজ করতে চাই।
সেই নিরিখে আগ্রহী লেখক / লেখিকারা যোগাযোগ করতে পারেন আমাদের সাথে..
নিচের ফর্মটি পূরণ করে পাঠাতে পারেন। আমরা যোগাযোগ করে নেব আপনাদের সাথে -
https://surveyheart.com/form/671b71cff7d5b576adc7f1cc
No comments:
Post a Comment