===================
সম্পাদকীয় নয়
বুঝলে বন্ধুরা, পত্রিকা কাজ যখন শেষ পর্যায়ে, তখন মনে পড়ল আরে সম্পাদকীয় লিখতে হবে তো ! ঠিক তারপরই মনে পড়ল, ধুস নিয়মমাফিক তো কিছুই চলছে না গত দেড় বছর ধরে, তাহলে আমিই বা ওসব নিয়ম মেনে কী করব !
সত্যিই তো, এই গত দেড় বছর ধরে পৃথিবীর সবথেকে শক্তিশালী আর বুদ্ধিমান প্রাণী মানুষকে কি নাকানিচোবানিই না খাওয়াচ্ছে এক অদৃশ্য জীবাণু ! নিয়মমাফিক চলাফেরা যাচ্ছে না, নিয়মমাফিক একসাথে বসা হচ্ছে না, নিয়মমাফিক প্রতি বছর হওয়া পরীক্ষাগুলোও বন্ধ হয়ে গেল ! গত বছরের শেষে যখন ওষুধ বেরোলো, সব্বাই আনন্দে নেচে উঠেছিলাম ৷ ভেবেছিলাম এই তো বাছাধন, পুটুক করে দুটো ইঞ্জেকশন, ব্যস ব্যাটা আর পালাবার পথ পাবে না ! কিন্তু কোথায় কি ? এখনও অনেকে হা-পিত্যেশ করে আছে কবে ওষুধ পাবে তার জন্য ৷
আর সবথেকে বোধহয় কষ্টে আছো তোমরা ৷ কদ্দিন আর ঐ চারকোণা স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে খোপের মধ্যে বন্ধুদেরকে দেখে ভালো লাগে ! তোমাদের মধ্যে অনেকের তো আবার সেটুকুও হচ্ছে না ৷ দীঘা, পুরী বা গোয়ায় গিয়ে সাগরের একের পর এক ঢেউ দেখতে কি ভালোই না লাগে ! কিন্তু এই যে সব দ্বিতীয় ঢেউ, তৃতীয় ঢেউ আসছে, এ যে বড্ড ভয়ানক ৷
তাই তোমাদের জন্যই এবারে আমাদের পদক্ষেপ পত্রিকা আয়োজন করেছে এক বিশেষ সংখ্যা ৷ এই অতিমারী পরিস্থিতিতে তোমরা কেমন আছো, কী ভাবছো, তোমাদের ওপর কেমন প্রভাবই বা পড়ছে — তা নিয়ে ডাক্তারবাবুরা আর অনেক তোমাদের থেকে বয়সে একটু বড় বন্ধুরা লিখেছেন নিবন্ধ, কবিতা, গল্প, অনুবাদ গল্প, পত্রসাহিত্য, দিনলিপি ৷ এমনকি তোমাদের তিন বন্ধুও এবার তাদের কলমে তুলে ধরেছে এই সময়কে ৷
তাই আর কিচ্ছুটি না ভেবে রোজকার রুটিন থেকে একটু সময় বের করে পড়তে শুরু করো তোমাদের পছন্দমাফিক একের পর এক লেখা ৷ আর আমাদের জানাতে ভুলো না কিন্তু তোমাদের কেমন লাগলো ৷
সব্বাই সুস্থ থাকো, সাবধানে থাকো, আর সবথেকে বড় কথা যতটা সম্ভব আনন্দে থাকো ৷
চরৈবেতি...
নিবন্ধ
খাঁচায় বাড়া ডানা - আর্যতীর্থ
'এ কোন সকাল?' - সহেলী রায়
শিশু-মনে অতিমারী - কুণাল কান্তি দে
প্যান্ডেমিক কিন্তু প্যান্ডোরার বাক্স নয় - ডা. পূজা মৈত্র
ওরা কি ভালো আছে ? -
ঐশ্বর্য কর্মকার
শিশুমনে অতিমারী-কাল - সুজাতা মিথিলা
অতিমারী—
এক কালো সময়ের দস্তাবেজ - জয়তী অধিকারী
অতিমারী ও শিশু - ডা. দেবাংশু ঘোষ
বিপন্ন শৈশব - অর্ণব গরাই
শিশুমনে অতিমারী, অতিমারীর শিশুমন -
সুজিৎ দে
ভাল্লাগে না - দেবব্রত ঘোষ মলয়
শিশু কাঁদে বিষ ফাঁদে - ডঃ রমলা মুখার্জী
মনের কথা - ড. মধুমিতা ভট্টাচার্য
রিমোর বায়না - শুভ্রা ভট্টাচার্য
হারিয়ে যাচ্ছি - হামিদুল ইসলাম
ফাঁকিবাজ - অদিতি ঘটক
লকডাউনের লিমেরিক - শ্বেতা সরকার গুপ্ত
একলা খুকি - অরুণ কুমার
দাঁ
করোনা - তপনকান্তি মুখার্জি
করোনা জ্বালায় - জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়
বাবার থেকে বড় - অমিত চট্টোপাধ্যায়
বেলা ছোট হয়ে আসছে - মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায় রায়
ঠাকুর, চাইনা
এ অতিমারী !! - গোবিন্দ মোদক
লক আউট - নৃপেন্দ্রনাথ মহন্ত
অতিমারী - শ্যামল মণ্ডল
আজকের অমলরা - শিবেশ মুখোপাধ্যায়
ছুটি - সুজান
মিঠি
বিট্টুসোনার মেজাজ - রাজকুমার ঘোষ
হোম
ইউর ওন হোম - অনুপ দত্ত
ফেরা - সুজাতা বন্দ্যোপাধ্যায়
মুক্তি - সমাপন প্রামাণিক
বন্দি বিহগ - মিতালি রায়
রবীন্দ্রজয়ন্তী ও একটা বই - সুদীপ পাঠক
নব কলা পত্রে শিক্ষা চিন্তন - তপন তরফদার
ফিরিয়ে দাও - নীতিকা চ্যাটার্জী
ভয় - নির্মলেন্দু কুণ্ডু
জ্যাক ও মটরশুটি - দীপক আঢ্য
করোনাকালে পিঙ্কির দিনলিপি - অসিত কুমার পাল
ছোট্ট বন্ধুদের প্রতি - প্রণব ঘোষ
দুই রাজপুত্রর গপ্পো - ঋদ্ধিমান ব্যানার্জী
আনন্দ - সৃজনী সাহা
ভালো নেই - রাকা দে
===============================
নিবন্ধ-১
খাঁচায় বাড়া ডানা
আর্যতীর্থ
ডানা ওঠার
আগেই যদি পাখির ছানা খাঁচায় ঢোকে,
তবে সে আর উড়তে পারেনা। আকাশে তার চিরকালীন ভয় জন্মায়, খাঁচার
চৌহদ্দি তখন তার কাছে সমগ্র বিশ্ব। এই দুনিয়াব্যাপী মহামারী ঠিক এমনই বদ্ধ
প্রজন্মের জন্ম দিলো,
যাদের ভারচুয়াল আর বাস্তবের সেতুটা আগামীতেও পোক্ত হওয়া দুষ্কর। পুরো দুটো বছর
বাচ্চারা বাইরে খেললো না,
স্কুলে টিফিন চুরি করে খেলো না,
পড়ে গিয়ে হাঁটু জুড়ে ব্যান্ড এইড লাগালো না, ভয়ানক মারামারির পরদিন যেচে পড়ে
কাছের বন্ধুর সাথে সন্ধি করলো না। এর পরেও যদি এই প্রজন্ম সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ
হতে পারে, সেটা
কল্পনাতীত সৌভাগ্য ছাড়া কিছু নয়।
আমরা বড়রা ঠিক কী দিলাম শৈশবকে
এই প্যান্ডেমিকে? বদ্ধ
ঘরের মুখোশ বাঁধা একঘেয়ে জীবনে,
নিজেদের সমস্যা নিয়ে জর্জরিত আমরা কোথাও কি তৈরী করলাম ওদের জন্য সেই চিলতে
ফাঁকগুলো, যার
ভেতর দিয়ে আসা আলো
ওদের চোখে পড়লেই রামধনু হয়ে যেতো?
শেখালাম কি আমাদের মোবাইলবিহীন ছোটোবেলায় শেখা ঘরের মধ্যে স্বপ্ন গড়ার কায়দাকানুন? চেনালাম কি বই বলে একটা ম্যাজিকের দুনিয়া আছে, যার ভেতরে
একবার ঢুকতে পারলেই দশ ফুট বাই দশ ফুটের মধ্যে মহাবিশ্বের যাবতীয় অ্যাডভেঞ্চার উঠে
আসতে পারে? একশোর
মধ্যে নিরানব্বই দশমিক নয় শতাংশ ক্ষেত্রে সবকটার জবাব না হবে। তার বদলে আমরা তাদের
তুলে দিয়েছি মোবাইল নামক মগজখেকো রাক্ষসের হাতে অথবা আরো একটু এগিয়ে মুহুর্মুহু শত্রুহত্যাসম্বলিত
কোনো কম্পিউটার গেমসের করাল কবলে।
ঘরের মধ্যে বসে থাকা বাচ্চাগুলো জীবনের সেই সব দিকগুলো দেখে
ফেললো, যা
জানলে ছোটোবেলা বলে আর কিছু থাকে না।গার্হস্থ্য হিংসা বেশ কয়েকগুন বেড়ে গেছে, স্বভাবতই তার
প্রভাব ছোটোদের ওপরে পড়বেই। পড়ন্ত রোজগার আর লকডাউনের নিয়মকানুনে প্রথম বলি হয়
সখ আহ্লাদগুলো, বহুদিন
বেড়ানো বন্ধ, একসাথে
হই হই করে জমায়েত এখন আতঙ্কের ব্যাপার। আমরা বড়রাই এতে পাগল হয়ে যাচ্ছি, প্রজাপতির
মতো চঞ্চল শিশুমনে তার প্রভাব কি হতে পারে,
সেটা সহজেই অনুমেয়।এর সাথে পরিবারে করোনার বিষ ঢুকলে তো আর কথাই নেই, প্রিয়
মানুষদের না ছুঁতে পারার যন্ত্রণার সাথে কখনো না দেখতে পারার সম্ভাবনার আতংক মিশে
যে ভয়াবহ অবস্থার সম্মুখীন হচ্ছে ছোটোরা,
তা একমাত্র যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির সাথে তুলনীয়। অথবা তারও চেয়ে ভয়ানক, প্রত্যক্ষভাবে
তো গোলাবারুদ ফাটছে না কোথাও,
শত্রু কোথা থেকে আক্রমণ করবে সেটা আক্রান্ত হওয়ার আগে বোঝা অসম্ভব।
মোটের
ওপর, আমাদের
বাড়ন্ত প্রজন্মরা যে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে গিয়ে পড়েছে, তার তুলনা
মানবসভ্যতার ইতিহাসে নেই।
যদি দেশ ও জাতি
বাঁচাতে চাই, তাহলে
বড়দের খুব দ্রুত পথ খোঁজা প্রয়োজন ।মহামারী আমাদের সময় দিয়েছে একটু বেশি ঘরে
থাকার, সেই
সময়টাকে শিশুদের প্রয়োজনে লগ্নী করা দরকার,
আর সে সময়টা
কাটুক মুঠোফোনবিহীন আলাপচারিতায়। প্রতিটি শিশু অনন্য, এক অনন্ত
সম্ভাবনাময় আগামীর চারা। সার ভেবে ভুল করে বিষ না দিয়ে বসি, সেটা দেখা
যেমন প্রয়োজন, তেমনি
উচিৎ এই অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ে তার জন্য আলোর ব্যবস্থা করা।
এই সব নিয়ে
ভাববার লোক এখন বিরল,
অন্তত রাষ্ট্রব্যবস্থা যাদের হাতে,
তাদের মধ্যে এই নিয়ে ভাবান্তর হওয়ার সম্ভাবনা কম। তাই বাবা মা কাকা পিসি দাদা দিদিদেরই এই ভার
নিতে হবে।
আমরা বড়রা
কতটা সেই কাজ করতে পারলাম,
আগামী করোনাবিহীন কাল সেটার সাক্ষ্য দেবে।
নিবন্ধ-২
'এ কোন সকাল?'
সহেলী রায়
'আমি জন্মের প্রয়োজনে ছোট হয়েছিলাম,
এখন মৃত্যুর প্রয়োজনে বড় হচ্ছি'-
কবি নির্মলেন্দু
গুণের এই অসামান্য কবিতার লাইন দুটির আক্ষরিক অর্থ যেন বর্তমান পরিস্থিতিরই
দৃশ্যকল্প। এ প্রসঙ্গে কিছু ঘটনা মনে আসছে। ২০০৫ বা ২০০৬ হবে। আমার পুত্রের
শ্বাসকষ্টের রোগ ধরা পড়ে। প্রায় সময় হাসপাতাল, ডাক্তার
করতে করতে মানসিক অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম। ঠিক সেইসময়েই একজন চিকিৎসকের
সান্নিধ্যে এলাম, যিনি শুধু রাসায়নিক ওষুধ নয় আরও এমন কিছু
প্রাকৃতিক উপায়ের সন্ধান দিয়েছিলেন যা পেয়ে সত্যিই উপকৃত হয়েছি। উনি বলতেন, সবুজ
মাঠে খালি পায়ে বাচ্চাকে দৌড়তে দিন। প্রকৃতির সঙ্গে শারীরিক যোগাযোগ যত নিবিড় হবে, ততই
অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সচলতা বাড়বে, বাড়বে ফুসফুসের
কর্মদক্ষতা। বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে অবশ্যই, তবে
ভাবনার দিক থেকেও বড়ো গভীর ও মুক্ত।
ভাবী প্রজন্মকে নিজেদের ছেলেবেলার সব আস্বাদটুকু তুলে দিতে না পারলেও, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যতটুকু দেওয়া যায় সকলেই উজাড় করে দেন। আমাদের মফস্বলি মাঠ ছিল, পায়ে হেঁটে পৌঁছনো স্কুলবাড়ি ছিল, ছিল না অহেতুক প্রতিযোগিতা। এখন কংক্রিটের শহরে সবুজের ঘাটতি। প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে যানবাহনই ভরসা। সেরা স্কুলে তেমনই আদব কায়দা। তবু এই প্রতিকূল অবস্থাকেই সঙ্গী করে ওরাও বেড়ে উঠছিল।
যুগ পরিবর্তনশীল। সেই সঙ্গে মনন চেতনারও পরিবর্তন ঘটে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। তাই মেনে নিতেও কোন বাধা নেই। আচ্ছা, এই যে স্বাভাবিকতার আগল, তা ভেঙে যদি থাবা বসায় কোন অতিপ্রাকৃত বস্তু, তখন কি মেনে নেওয়া যায়? হ্যাঁ অতিপ্রাকৃতই বলব, যার সৃষ্টি জানিনা, ভবিষ্যতই বা কি তার কোন হদিশ নেই, তার জন্য অন্য কোন সংজ্ঞা জানা নেই আমার। আমার মতো মধ্যগগনের অনেকেই মহামারী বা অতিমারী শব্দটিকে শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের একটি অঙ্গ অথবা বিদ্যাসাগর মহাশয়, স্বামী বিবেকানন্দ, সিস্টার নিবেদিতার মতো মহাপ্রাণাদের, মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার একটি ছবি ছাড়া আর কিছু মনে করেনি কখনো। সেই আমরাই যখন এই শব্দের নাগপাশে জড়িয়ে পড়ি, প্রাণান্তকর পরিবেশের সম্মুখীন হই প্রতি মুহূর্তে। কোন ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট করতে পারিনি নিজেদের, সেখানে শিশু কিশোরদের জন্য কী রেখে যাব তা বারবার ভাবিয়ে তুলেছে।
প্রথমদিকে এতটা সমস্যা ছিল না। টুবলু, পাখিরা ছুটতে ছুটতে বাড়ি এসে বলল, 'ম্যাম বলেছে কাল থেকে ছুটি টিল ফারদার নোটিশ।' চোখেমুখে 'বাজল ছুটির ঘন্টা।' দিন কতক চলল অমনি। কিন্তু একী? ছুটি মানে তো ঘুরতে যাওয়া, পাড়ার বন্ধুরা মিলে সকাল বিকেল খেলা, ছাদে আলো টাঙিয়ে ফিস্ট। কিন্তু কোথায় সেসব। উলটে, বাইরে যেও না, কাউকে ডেকো না, হাত ধুয়েছ? বারান্দা, ছাদ কোত্থাও না। সবার কেমন গুরুগম্ভীর মুখ। অসুখ করেছে সবার, শুধু শরীরে নয়, মনেও। নতুন কত শব্দের ভান্ডার। প্যান্ডেমিক, লকডাউন, আইসোলেশন, ভ্যাক্সিনেশন, মাস্ক, স্যানিটাইজার। এর চেয়ে স্কুল ছিল ভালো। যা কিছু খারাপ লাগা ছিল, যেমন টিচারের বকুনি, এত এত পড়া, তাও ছিল ভালো। কবে খুলবে? বাবা মা নীরব। এও আবার হয় নাকি? সব প্রশ্নের উত্তরই তো ওঁদের জানা। সারাদিন প্রশ্ন করি, ক্লান্ত হয়ে যাই। আগে হৈ হৈ করে বাবা ছোটকা বাজার যেতেন। এখন যেন একরাশ বিরক্তি তাঁদের চোখেমুখে। বেরতে বিরক্তি, ফিরে বিরক্তি। কার্টুন দেখতে বসলেই জুটত বকুনি, সেই কার্টুন এখন ঘন্টার পর ঘন্টা চললেও কোন বাধা নেই। নিজেরাই ছেড়ে উঠে যাই। সেই বিরক্তি। না না সবটাই খারাপ নয়। বাবা মায়ের ফোনে হাত দেওয়া ছিল গর্হিত অপরাধ। মা এসে যেদিন ফোন সেট করে বসিয়ে দিয়ে গেলেন, খুশিতে চনমনিয়ে উঠলাম। ওইত্তো ম্যাম। বন্ধুদের গলার আওয়াজ। শুনতে পাচ্ছি। হঠাৎ হঠাৎ একেকজনকে দেখতেও পাচ্ছি। কিন্তু ছুঁতে পাচ্ছি না। শাওনা, বেস্ট ফ্রেন্ড। কত কথা জমে আছে, দেখা হয় না। মাঠে খেলা হয় না। স্পোর্টস, ফাংশন, পিকনিক কিচ্ছু হয় না। কবে হবে তাও কেও বলে না। একা একা গাও, নাচো, খেলো, আঁকো- একাকিত্বের বন্ধু হও। আমাদের দেখিয়ে ভাইকে বলা হোত তুমিও দাদা দিদিদের মতো স্কুল যাবে। যায় তো, তবে শোবার ঘরে দরজা বন্ধ করে মায়ের সঙ্গে মায়ের ল্যাপটপের হাত ধরে। ওটাই ওর স্কুল বলে জানে ও। একদিন বাবা ছবি আঁকতে বসাল। আমি আঁকলাম দার্জিলিং এর পাহাড়ের সামনে আমি বাবা মা ভাই দাঁড়িয়ে আছি। ভাইও এবড়ো খেবড়ো করে পাতা ভরাল। সবার মুখে মাস্ক এঁকে দিল। দূরপাল্লার ট্রেন, মা বলেন স্বপ্নের মতো লাগে।
প্রতিদিন কত মৃত্যুসংবাদ আসে। বাইরে এসে কখনো দাঁড়ালে পাখি, পথের কুকুর, গরু সবাইকেই কেমন একা লাগে। কারো বন্ধু নেই, নিঃশ্বাস ছাড়ি না। ঘরে এসে শ্বাস নিই জোরে জোরে। বাতাসে নাকি বিষ। ডাক্তারবাবু বলেছেন ফুসফুস ভালো রাখতে ঘরে থাকুন। ফেয়ারি টেলসের দৈত্যরা যেন সত্যি সত্যি ছুটে বেড়াচ্ছে। আমরা কি খুঁজে পাব সেই কৌটে রাখা ভোমরা যাতে আছে দৈত্যের প্রাণ নাকি শুধু মৃত্যুর প্রয়োজনে বড় হব।
===============================
নিবন্ধ-৩
শিশু-মনে অতিমারী
কুণাল কান্তি দে
শিশুরাই জাতির ভবিষ্যত , ওরাই আগামী দিনের সু-নাগরিক হবে ৷ কেউ কেউ বলেন এই আপ্তবাক্য — "এই পৃথিবীকে শিশুদের বাসযোগ্য করে যাব"। আমি নিজে বলি 'দেব-শিশু'। ওদের মানুষের মত মানুষ করে তুলতে মা , বাবা, অভিভাবকদের যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে , তেমনি পরিবেশেরও দায়িত্ব রয়েছে যথেষ্ট। দেশের সরকারের শিশু মানুষ করার পরিকল্পনার সবিশেষ প্রয়োজন।
শিশুদের 'মন' পড়াটা জরুরী এবং বড়দের মনটা শিশুর মত তৈরি করতে না পারলে অনর্থ হবেই। শিশুদের মানসিক বিকাশ বাবা, মা, যেমন দেখভাল করবেন, তেমনি প্রাথমিক স্তরে শিক্ষকের বিশেষ ভূমিকা আছে। সার্বিকভাবে নজর রাখলে পরিপূর্ণ মানুষের মতো মানুষ হবে। ওরাই তো জাতির ভবিষ্যত।
সাম্প্রতিক কালে গত ২০২০ এবং ২০২১-এর অর্ধেকের বেশী পার হতে চলল। সারা পৃথিবীর জুড়ে ভয়ঙ্কর মারণ-ব্যাধি করোনা আমাদের দিশেহারা করে তুলেছে। মৃত্যু মিছিল চারিদিকে। গৃহবন্দী আমরা সকলেই। আতঙ্কে দিন কাটছে আমাদের সকলেরই। দুশ্চিন্তা দুনিয়া জুড়ে। কে কাকে সান্ত্বনা দেবে ! অচল হয়ে পড়েছে স্বাভাবিক জীবনযাপন। প্রাত্যহিক রুটিন বদলে গেছে। কম বেশি অনেকেই আক্রান্ত হয়েছেন । সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে দেবশিশুদের। পড়াশোনা বন্ধ, স্কুল কলেজে তালা পড়েছে। খেলাধূলা থেকে সরে এসেছে। বাড়ির বাইরে যাওয়া কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এমতাবস্থায় শিশুদের জীবনে সংকট নেমে এসেছে। স্কুল যাওয়া বন্ধ, বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধূলার সুযোগ নেই। ফলে মানসিক দিক দিয়ে হতাশা এদের জীবনে নেমে এসেছে। ওরা মারী, মহামারী, অতিমারী কাকে বলে জানে না। মনোকষ্টে ভুগছে। সচেতন অভিভাবককে বড় দায়িত্ব নিতে হবে। চিকিৎসক, শিশু-বিশেষজ্ঞ, মনোবিদ— সকলেই দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। বিশাল সংখ্যক শিশুরা যেন মানসিক রোগ-আক্রান্ত না হয়। বড়দের মাস্ক পরা দেখে ওদের মনে কৌতূহল। সেটা দূর করতে হবে আমাদের , বড়দের। গল্পের ছলে সমস্ত বিষয় ওদের মতো করে বোঝাতে হবে। এই গুরুত্বপূর্ণ দায় আমাদের বাড়িতে নিতে হবে। হতাশা যেন ওদের গ্রাস করতে না পারে। অসুখের ভয়াবহতা সহজভাবে বোঝাতে হবে। হাসিখুশিভাবে থাকা এবং গল্প করা বড় ওষুধের কাজ করবে। পড়াশোনা বাড়িতে করাতে হবে। ওদের জন্য যথেষ্ট সময় দিতে হবে। হয়ত অনলাইনে ক্লাস করানোর ব্যবস্থা করেছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। তাতে কি লাভ জানিনা। সময় বলবে।
আমরা অনেক সময় পেরিয়ে এসেছি। এখনও করোনা-মুক্ত হয়নি পৃথিবী। সংকট কাটেনি। তাই মাথা ঠাণ্ডা করে ভাবার সময় এসেছে। সব একদিকে, শিশুরা একদিকে। এই ভাবনা নিয়ে এগোতে হবে। আতঙ্ক নয়, স্থির মন ও মানসিকতা নিয়ে সঠিক ভাবে চললে আমরা আগের সুস্থ পৃথিবীতে ফিরে যাব। আলোকময় বিশ্বের অপেক্ষায় আমরা ইতিবাচক ভূমিকা নেব। শুভায় ভবতু।
===============================
নিবন্ধ-৪
প্যান্ডেমিক কিন্তু প্যান্ডোরার বাক্স নয়
ডা. পূজা মৈত্র
অতিমারী
কথাটাই বড্ড ভারি ৷ তাও এমন কিছু যা একশো বছরে একবার হয় ৷ কেমন সেটা ? যুদ্ধ ? বড়সড় রাজসিক অ্যাটাক, নাকি
এলিয়েনদের হানা ? ভাইরাসটা নাকি ল্যাবে বানিয়েছে একদল দুষ্টু
মানুষ, অন্য দেশকে ফাঁপরে ফেলার জন্য ৷ ঠিক কী চলছে, কী হতে চলেছে এই ভাবতে না ভাবতেই হঠাৎ দাড়িওয়ালা বুড়োটা টিভিতে বলে দিল
লকডাউন ৷ মানে সব বন্ধ ৷ যে যেখানে তাকে সেখানেই থাকতে হবে ৷ নড়াচড়া যাবে না ৷
কেবল থালা বাজানো যাবে জানলায় ৷ ঘড়ির ঘণ্টা ধরে আবার মোমবাতি, টর্চ, মোবাইলের লাইট জ্বালানো যাবে ছাদে উঠে ৷ এগুলো
এক-একটা টাস্ক ৷ স্কুলে যেমন আমাদের টিচাররা টাস্ক দেন, তেমনই
সারা দেশকে টাস্ক দিচ্ছে ঐ সাদা দাড়ি দাদুটা ৷ আর সবাই শুনছে ৷ করছেও নিয়ম করে ৷
তোমরাই ভাবো কী বোকা বোকা না ! বাড়ির সব জানলা দরজা বন্ধ করে থাকো, টিভিতে সবকিছু বন্ধ করে সকাল-সন্ধ্যা ঐ এক অসুখের গল্প শোনা, অন্য কোন গল্প নেই, কথা নেই ৷ ঘুরতে যাওয়া তো দূরের
কথা ৷ কেবল বাড়িতে বসো, আর অপেক্ষা করো কখন ঐ পচা অসুখটা এসে
খপ করে ধরে নেবে তোমাকেও, আর বাঁচতে গেলে নানা কসরত করো ৷
তার মধ্যে স্কুলটাও বন্ধ ৷ কবে খুলবে কে জানে ! বন্ধুদের সাথে ক...ত...দিন দেখা হয় না ৷ ক...ত...দিন স্কুলের মাঠে খেলা হয় না, টিফিন ভাগ করে খাওয়া হয় না, টিউশন ব্যাচে দেখা হয় না ৷ দেখা একেবারে হয় না বললে ভুল, হয় তো, ভার্চুয়াল দেখা ৷ অনলাইনে স্ক্রিনের ওপাশে থাকে টিচার আর এপাশে কড়া নজর মা-বাবার ৷ আগে পড়া না পারলে, কি টাস্ক না করলে, কি মার্কস কম এলে লুকোনোর জায়গা ছিল ৷ এখন সেটাও নেই ! সেজেগুজে ইউনিফর্ম পরে বসে পড়ো অনলাইন ক্লাসে আর পাশে হয় মা, না হয় বাবা ৷ সবসময় সব দেখছে, শুনছে ৷ আর ক্লাস শেষ হতেই জুটছে দক্ষিণা ৷
এদিকে মা-বাবা কারোরই অফিস নেই ৷ সবার ওয়ার্ক ফ্রম হোম ৷ তিন ঘরে তিনজন অনলাইন ৷ তিনজন তিন জনেরই মুখ দেখছে সর্বক্ষণ ৷ মা-বাবার ঝগড়া দিন-দিন বেড়ে চলেছে ৷ কথায় কথায় রেগে যাচ্ছে ৷ বকছে ৷ ধমক দিচ্ছে ৷ ছোট ছোট ভুলগুলোও ধরছে, যেটা আগে ধরত না ৷ একে অন্যের ভুল ধরেই চলেছে অবিরাম ৷
ধুর ! তার থেকে মোবাইলে গেম খেলাই ভালো ৷ যেটুকু অনলাইন ক্লাস, সেটুকুই পড়া ৷ বাকি সময় গেম ৷ পাবজি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বলে কি কষ্ট হয়েছিল সবার ! এখন আবার চালু হয়েছে ৷ খুব মজা ৷ মাঝে মাঝে মনে হয় পাবজির মতোই গুলি মেরে উড়িয়ে দেওয়া উচিত যে সামনে আসবে তাকে ৷ বড়দের এই দুনিয়াটাকে ৷ একে অপরের সাথে লড়াইকে ৷ ভাইরাসটা তৈরি করল যারা তাদের ৷ ভাইরাস সম্পর্কে সব জেনেও যারা মাস্ক না পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদের ৷ ভালো লাগে না ! কিচ্ছু ভালো লাগে না ! সবসময় কষ্ট হয়, কান্না পায় ৷ বন্ধুদের দেখতে ইচ্ছে করে ৷ চ্যাট করে মন ভরে না ৷ যদি কোথাও যেতে পারা যেত, অন্য কোথাও না, যদি স্কুলে একটি বার যাওয়া যেত ৷ একবার আমরা সবাই একসাথে যদি আবার বসা যেত, খেলা যেত, গল্প করা যেত, আমার মধ্যে যা যা বদল হচ্ছে সব বলা যেত ৷
পরিসংহার
চিকিৎসক হিসেবে অতিমারীতে শিশুদের উপর যে প্রভাবগুলো চোখে পড়েছে, তাই গল্পের ছলে বললাম ৷ অবসাদ, স্থায়ী বিষাদ, মেজাজের যখন তখন পরিবর্তন, উগ্রতা, ভায়োলেন্সের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া, আত্মহত্যার প্রবণতা, একাকিত্ব-জনিত সমস্যা— সমস্তটাই এই অতিমারীকালে শিশুদের গ্রাস করেছে ৷
ভয় হয়, এই জীবাণু-যুদ্ধে আমরা হয়তো আজ না হয় কাল জিতব, কিন্তু জিতেও হেরে যাব ! কারণ এই চার-পাঁচ বছরে করোনাকালীন শিশু-কিশোরদের মনে যে স্থায়ী ক্ষতি হবে, মানসিক গঠনের যে স্থায়ী ক্ষয় হবে তা আমাদের পরের প্রজন্মকে গ্রাস করবে ৷ মানবসভ্যতার রূপরেখাকেই বদলে দিতে পারে এই পরিবর্তিত মানসিকতা ৷ আনতে পারে আরো হিংসা, আরো হানাহানি, আরো উগ্রতা ৷ শৈশব ও কৈশোরের বেড়ে ওঠার স্বাভাবিক পথটাকে হারিয়ে ফেলে শিশুরাই নয়, মানবসভ্যতাটাই এক অন্ধকার কানাগলিতে ঢুকে গেল না তো !
ভাবুন, আর একবার...
===============================
নিবন্ধ-৫
ওরা কি ভালো আছে ?
ঐশ্বর্য কর্মকার
গত এক বছরের বেশি সময় ধরে স্কুল বন্ধ। পাঠদানের জন্য হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ , গুগল মিট-এর সাহায্য নেওয়া হচ্ছে। ফোন মা - বাবাদের পাঠ্য বিষয় বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এই স্মার্টফোনের সুবিধা কতজনের আছে ?
UNICEF বলছে , পৃথিবীর মাত্র ৩০ শতাংশ শিশুর কাছে এই সুবিধা আছে। তাহলে বুঝতে অসুবিধা হয় না গ্রামাঞ্চলে স্মার্ট ফোনের অবস্থা কেমন। এই পরিস্থিতিতে অনেক শিশু স্কুলছুট হয়েছে। ২০০০ সালের পর বিশ্বে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে কমে যাওয়া শিশুশ্রমের হার আবার উল্টোদিকে বইবে না তো। একটা গোটা প্রজন্ম পাঠ্য অন্তর্গত বিষয়ের প্রায় কিছুই শিখতে পারলো না। শিশুদের মানুষ হয়ে ওঠার পথটাই বন্ধ হয়ে গেল। আমরা সবাই জানি তাদের মানসিক বিকাশ অনেকটাই ঘটে স্কুলে। এখন ওরা নিঃসঙ্গ , একা। স্কুল নেই, বন্ধুদের সাথে দেখা নেই, খেলা নেই, ঘরের চার দেয়াল ছাড়া কোথাও বেড়াতে যাওয়ার উপায় নেই।
আর অন্যদিকে সারাদিন বাবা-মায়ের ভাইরাস সংক্রমণ, রোজগার আর ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা নিয়ে উদ্বেগ। করোনাভাইরাসে শিশুরা খুব বেশি আক্রান্ত না হলেও এ থেকে মুক্তিরও যেন উপায় নেই। দিনভর সকল সম্প্রচার মাধ্যমে একই বিষয় নিয়ে আলোচনা। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে বিশ্বব্যাপী আশি লাখের বেশি মানুষের আক্রান্ত হওয়া, সাড়ে চার লাখের মতো মানুষের মৃত্যুর খবর নিয়ে চারপাশে বড়রাও সারাক্ষণ কথা বলছে। চারিদিকে শুধু শঙ্কার আবহ শিশুর মনোজগতের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।
যাদের ক্ষমতা আছে তাঁরা বাড়িতে শিক্ষক রেখে পড়াচ্ছেন , কিন্তু যারা দরিদ্র ? এই প্রতিযোগিতার বাজারে অনেক দূর পিছিয়ে পড়ল তারা। ছোট থেকেই মা - বাবার রোজগারের অনিশ্চয়তা শুনে এরা বড়ো হয় , বিদ্যালয় তাদের এই মানসিক চাপ থেকে কিছু সময়ের জন্য হলেও মুক্তি দিত। বর্তমানে সেই পথটাও বন্ধ।
এদের মধ্যে ক- জন আবার বিদ্যালয়মুখী হবে সেটা বলা মুশকিল। দরিদ্র পরিবারের শিশুরা নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সংস্পর্শে আসতে পারে।
দেশের কয়েক লক্ষ শিশুর জীবন থেকে কেড়ে নেওয়া হলো শৈশব , কেড়ে নেওয়া হলো বন্ধু , শিক্ষক , খেলার মাঠ, আকাশের রং , গাছের পাতা ,মাটির গন্ধ , বৃষ্টির আনন্দ , কাগজের নৌকা সব।
বাবা-মায়ের মানসিক চাপের কারণে শিশুদের উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে । যার ব্যথা হয়ত বুঝতে পারছে না শিশুর সরল মন। এতে বাবা-মায়ের উপরে তার ক্ষোভ তৈরি হতে পারে, তাদের সাথে সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
সবমিলিয়ে ক্ষুধা, অপুষ্টি, শিশু শ্রমের সাথে সাথে শিশুদের মনে নিশ্চিতভাবেই দীর্ঘমেয়াদি একটা ট্রমা রেখে যাবে করোনাভাইরাস সৃষ্ট মহামারী।
===============================
নিবন্ধ-৬
শিশুমনে অতিমারী-কাল
সুজাতা মিথিলা
অতিমারী সারা বিশ্ব
জুড়ে এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। এক ভরাবহ বর্তমান। ফল হিসেবে
গৃহবন্দি জীবন। লক ডাউন, সামাজিক দূরত্ববিধি , জনতা কারফিউ এই
ধরণের নতুন শব্দের সাথে আমাদের পরিচয়। এধরণের নতুন
শৃঙ্খলায় নিজেদের বেঁধে রাখা যাপন।
কিন্তু এসবের মধ্যে সব থেকে কষ্টে আছে অবুঝ শৈশব আর দামাল কৈশোরকাল । বাঁধাধরা গণ্ডির আগল এই বয়সের জন্য সত্যিই যেন কারাগৃহ। নেই খেলার মাঠে বন্ধুদের সাথে খেলাধুলো, আড্ডা ছোটাছুটির হুল্লোড়। নেই স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের আদর, অনুশাসনের পরিমণ্ডলে সহপাঠীদের সাথে এক সাথে বেড়ে ওঠা, বৌদ্ধিক ,মানসিক , দৈহিক, সামাজিক --- এই ধরণের সার্বিক বিকাশের সুযোগ।
এখন ঘুম থেকে উঠেই মোবাইলে পড়াশোনা, ক্লাস, স্কুল। একসময়ের নিষিদ্ধ মোবাইল এখন বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েদের অতি প্রয়োজনীয়ের আওতাভুক্ত ।
চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ মন ও শরীর। এর নেতিবাচক প্রভাব শিশু কিশোর মনে অনেকটাই গভীর। শঙ্কারও । সারাক্ষণ মোবাইল নির্ভর জগতে বাড়ছে ছোটদের মধ্যে এক ধরণের বিচ্ছিন্নতা। নিজেদের জগতে ইচ্ছেমত অভিভাবকহীন বিচরণের সুযোগের অপব্যবহার। পাবজি , ফ্রি ফায়ারের মতো গেমের গোপন হাতছানি ও আসক্তি।
বাড়ছে শিশু কিশোরদের ভীষণ অন্যমনস্কতা। পাঠে অমনোযোগ। বাড়ছে অকারণ জেদ, অসহযোগের মনোভাব আর অমান্যতা । দেখা দিচ্ছে শিশুমনে বিরক্তি । অবাধ্যতা। গোপন করার প্রবণতা। আর পিছু হটছে ক্রমশই পাঠ্য বই পড়ার মতো সুঅভ্যেস। নিত্য চর্চা, অনুশীলন, লেখার মতো সুঅভ্যেসের প্রতি বেশ অনীহা।
তারপর মোবাইল-নির্ভর শিক্ষার মাধ্যম নেটের মাহাত্ম্যে অনেকে নাগালে পাচ্ছে নিষিদ্ধ নীল দুনিয়ার নিষিদ্ধ সুখের খোঁজ।
অসহায় অভিভাবককূল তাই এই অতিমারীর আবহে দামাল অবুঝ নিষ্পাপ শৈশব-কৈশোরের ঠিকমতো লালনে দিশেহারা। সারাক্ষণ গৃহবন্দি যাপনে বাড়ছে শিশু-কিশোরদের স্থুলতার মতো সমস্যা। দেখা দিচ্ছে মানসিক অবসাদ । এমনকি গড়ে উঠছে অপরাধ-প্রবণতা।
তাই এই অতিমারীর নেতিবাচক আবহে শৈশব ও কৈশোর-কালকে সুঅভ্যেসে সুশিক্ষায় দীক্ষিত করতে দরকার অভিভাবকদের সচেতনতা। আরো আরো ওদের প্রতি মানসিক যত্ন। খেয়াল। সময় । আর দরকার অভিভাবকদের পক্ষ থেকে বন্ধুত্বপূর্ণ উদারমনস্কতা। আরো আরো দায়িত্ববোধ। আরো বেশী করে ইতিবাচক ব্যবহার।
একমাত্র অভিভাবক ও শিশুমনের সুনিবিড় বন্ধনে ,আলাপচারিতায় , আন্তরিক সহিষ্ণুতায়, সহমর্মিতায় অতিমারীর এই ঘন কালো মেঘ কাটিয়ে আগামীর মহীরুহদের সার্বিক বিকাশ ঘটানো সম্ভব হবে।
===============================
নিবন্ধ-৭
অতিমারী—
এক কালো সময়ের দস্তাবেজ
জয়তী অধিকারী
অতিমারী…শব্দটার সাথে এই প্রজন্মের সরাসরি পরিচয় হয়েই গেল। “মন্বন্তরে মরিনি আমরা, মারী নিয়ে ঘর
করি”,
এই বিষয়ে আমাদের ছোটবেলায় রচনা লিখতে হত, ভাব সম্প্রসারণ করতে হত। তখনই জেনেছিলাম ‘মারী’ আসলে কী। যদিও
মহামারী আর অতিমারীর মধ্যে অনেকটাই তফাত আছে। যখন সারা পৃথিবীর অগুন্তি মানুষ
ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসঘটিত রোগের কবলে পড়ে অসহায়ের মত প্রিয়জনের হাত চেপে ধরার
চেষ্টা করেও মুঠি আলগা করে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায়, প্রাণীকূলের শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপাধারী মানুষও সেই আণুবীক্ষণিক মারকের সামনে
অক্ষম হয়ে পড়ে…শতাব্দীর অন্ধকারতম দিন-মাস-বছর চিহ্নিত হয়ে ওঠে ‘অতিমারী’র তকমায়। মহামারী
যেখানে কিছুটা অঞ্চলেই নিজের দাদাগিরি দেখিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, অতিমারী তখন দাপিয়ে বেড়ায় আন্তর্জাতিক সীমারেখা অতিক্রম
করে। যেখানে আমরা সৌভ্রাতৃত্বের বার্তা ছড়িয়ে দিয়ে সারা বিশ্বকে হিংসামুক্ত করতে
চাই,
একে অপরের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পেরিয়ে আসতে চাই সমস্ত রকমের
বিদ্বেষ,
এক ভাইরাসের মারণ ছোবলে সেই আমাদেরই আবার সরে যেতে হয় একে
অপরের থেকে দূরে। সাবধানতামূলক দূরত্ব বজায় রাখতে রাখতে চার দেওয়ালের মধ্যে ঘনিয়ে
ওঠে ডিপ্রেসনের কালো মেঘ।
SARS-CoV-2 কে WHO
অর্থাৎ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা COVID-19 নামে নামাঙ্কিত করেছে। এখন অবশ্য আমরা সকলেই জানি কোভিড-১৯
কী,
তার জন্য কী কী সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে এবং তার করাল গ্রাস
থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য কী কী সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। দীর্ঘ দেড় বছরেরও বেশী
সময় লাগলেও এই ভাইরাসের প্রতিষেধক এখন আম-জনতার নাগালে এসে গেছে। কিন্তু দিনের পর
দিন,
মাসের পর মাস পেরিয়ে সাধারণ জনজীবন যেভাবে ‘নিউ-নর্মাল’ রুটিনে
নিজেদের অভ্যস্ত করে তুলতে পেরেছে, শিশু-কিশোররা
কিন্তু এখনও নিজেদের মানিয়ে নিতে পারছে না। আমরা জানি ছোট বাচ্চারা, শিশুরা অনেক তাড়াতাড়ি সবকিছু শিখে নিতে পারে। তাই একট
বাচ্চা পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সহায়তায় অনায়াসেই দুটো-তিনটে ভাষা শিখে ফেলতে পারে।
আজ এই অতিমারী পরিস্থিতিতে শিশুদের স্বাভাবিক জীবনধারাটাই বদলে গেছে। তারাও হয়ত
নতুন রুটিনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। কিন্তু তাদের মানসিক গঠনে আসছে এক অনতিক্রম্য
পরিবর্তন।
সারা বিশ্বব্যাপী যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে বড়দের মধ্যে, তার রেশ খানিকটা হলেও এসে পড়ছে শিশুমনে। যে শিশুরা সকাল
হলেই স্কুল ইউনিফর্ম পরে স্কুল-ব্যাগ নিয়ে ‘টা-টা’ করতে করতে চলে যেত তাদের ‘সেকেন্ড হোমে’,
আজ তাদের স্কুল একটা টেবল আর মুঠোফোনেই সীমাবদ্ধ হয়ে উঠেছে।
আগে বাড়ি ফিরে জামা-জুতো ছাড়তে ছাড়তেই তারা কলকল করে বলতে থাকত সেদিন ক্লাসে কী কী
হয়েছে,
কোন আন্টি বা কোন স্যার কীভাবে চোখ পাকিয়ে তার সহপাঠীকে বকে
দিয়েছে। এখন তারা ভার্চ্যুয়াল ক্লাসরুমের যান্ত্রিকতায় সেই উচ্ছ্বাসটুকু হারিয়ে
ফেলেছে। আজ তারা তাদের বেস্ট-ফ্রেন্ডের টিফিন শেয়ার করতে পারে না। তাদের বন্ধুদের
সঙ্গে কাটিয়ে আসা নির্মল আনন্দটুকু আজ স্মৃতির কৌটোয় বন্দি। যে বাচ্চাটা স্কুলে
পিটি ক্লাস থাকলে আনন্দে লাফাতে লাফাতে ফিরে এসে গল্প করত কীভাবে ‘ডজবল’ খেলায় সেদিন সে সবার
সেরা হয়ে উঠেছে,
আজ তাদের জীবন থেকে সেই খেলাধুলোটুকুও হারিয়ে গেছে।
সারা বিশ্বের জনসংখ্যার ২৮% হল শিশু। ১০-১৯ বছর বয়সী বাচ্চাগুলো আজ
অ্যাডোলেসেন্সের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ভাবে কবে আবার স্কুল খুলবে! যে বয়সে আমরাও
বন্ধুদের সাথেই ভাগ করে নিতাম একান্তই নিজস্ব অনুভূতিগুলো যা অভিভাবকদের কাছে বলা
যায় না…। আজ সেই বয়সে এসে ওই কিশোর-কিশোরীরা নিজেদের ডুবিয়ে দিচ্ছে
মোবাইল গেমস আর অনলাইন ভিডিও স্ট্রিমিংয়ে। এই পরিস্থিতির কথা তো তাদের কল্পনাতেও
ছিল না। দিনের পর দিন ঘরবন্দি থাকতে থাকতে মানসিক চাপ, অ্যাংজাইটি আর এক অদ্ভুত অসহায়তা গ্রাস করছে তাদের। আর এর
ফলে বড়দের তুলনায় তাদের মনের উপর অনেক বেশী দীর্ঘস্থায়ী কুপ্রভাব পড়ছে।
একটা বাচ্চা স্কুলের পড়াশোনার পাশাপাশি খোলা হাওয়ায় দৌড়ে বেড়িয়ে খেলা করার
মধ্যে দিয়ে যে উৎফুল্লতা নিয়ে ঘরে ফেরে, আজ সে সবই
স্বপ্নের মত। যে বাচ্চাটা নতুন গল্পের বই পেলেই মায়ের বকুনি উপেক্ষা করে পাতার পর
পাতা উলটে যেত,
আজ তার বই পড়ার ইচ্ছেটাও যেন ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। গান
শুনতে শুনতে ঘুমোতে যাওয়া বাচ্চাটা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে সুরের প্রতি। একটা একঘেয়ে
জীবনের প্রতিটা দিনের পাতা উল্টে চলেছে শুধুমাত্র নিয়ম বলেই। সেই স্বতঃস্ফূর্ততা
যেন লজ্জায় মুখ লুকিয়ে ফেলেছে এই শিশু-কিশোরদের সামনে। অতিমারীর এক সাংঘাতিক
প্রকোপের ছায়ায় তাদের সংবেদনশীলতা আঘাতপ্রাপ্ত। এমনকি মানসিক ও সামাজিক বিকাশও আজ
যেন থমকে গেছে। কোমল স্বভাবের পরিবর্তে দেখা দিচ্ছে খিটখিটে মনোভাব। এমনকি একটা
সাত-আট বছরের বাচ্চার মুখেও প্রায়ই শোনা যাচ্ছে “ভাল্লাগছে না”। স্বাভাবিক জীবনের পরিবর্তে একটা সমান্তরাল ভার্চ্যুয়াল
জগতকেই আঁকড়ে ধরছে তারা। যেখানে সাময়িক স্বস্তি আছে। তাই যতক্ষণ সেই দুনিয়ায় ডুবে
আছে,
ততক্ষণই উপভোগ করছে জীবনকে। কিন্তু বাস্তবে ফিরে এলেই আবার
তারা ডুবে যাচ্ছে হতাশায়। আর এর ছায়া গিয়ে পড়ছে তাদের আচরণে, কথা-বার্তায়, এমনকি কোন
কোন ক্ষেত্রে পড়াশোনাতেও। মাল্টিপল চয়েস প্রশ্নের উত্তরে শুধুমাত্র টিক মেরেই
পরীক্ষায় উতরে যাওয়ার এই পদ্ধতি নষ্ট করে দিচ্ছে তাদের স্বাভাবিক চিন্তা-ভাবনা এবং
নিজেদের লেখার ক্ষমতাও। সবসময় যেন একটা ছটফটানি কাজ করছে তাদের মধ্যে। অতিমারীর
প্রভাবে যখন লক-ডাউন শুরু হল, বাচ্চা থেকে বুড়ো
সকলেই মেতে উঠেছিল নতুন নতুন উদ্ভাবনী কর্মকাণ্ডে। নাচ, গান,
আঁকা, রান্না—যে যার মত করে আনন্দ খুঁজে নিচ্ছিল। কিন্তু একঘেয়েমি আসে ‘নিউ-নর্মাল’ জীবনেও।
আগ্রহ কমতে থাকে দৈনন্দিন বদ্ধ-রুটিনে।
আজ সহজেই চোখে পড়ে কী ভাবে অতিমারীর করাল ছায়া গ্রাস করে নিচ্ছে ফুটফুটে শৈশব। বাচ্চাদের ক্ষিদে কমে গেছে, ঘুম কমে গেছে। কমছে ধৈর্য, স্থৈর্য্য, বাড়ছে উপেক্ষা, অসাবধানতা, অমনোযোগিতা। দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠছে প্রায়ই। অস্থিরতা কাজ করছে প্রতিটি পদক্ষেপে। এক অজানা উদ্বেগে দিন কাটছে তাদের। বড়রা যতটা সহজে বদলে যাওয়া পৃথিবী, পালটে যাওয়া জীবনরীতিকে মানিয়ে নিতে পারে, একটা শিশুর পক্ষে সেটা করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য তো বটেই। আসলে তাদের সামনে বড়দের তৈরী করে দেওয়া যুক্তিরও কোন অর্থ থাকে না। আর এই সমস্ত বিরূপতা থেকে মুক্তি পেতে তারা খুঁজে নিচ্ছে সহজতম পথ…ভার্চ্যুয়াল জগৎ। পরিবারের মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য তারা অনেক সময় জেনে অথবা অজ্ঞাতেই ভুল কাজও করছে। আঁকড়ে ধরতে চাইছে এমন একটা অবলম্বন যা তাদের ভুলিয়ে দেবে একঘেয়ে জীবনের বিমর্ষতা। হয়ত এরপর যখন স্কুল খুলবে, তারা আর আগের মতো মিশে যেতে পারবে না বন্ধুদের সাথে। হয়ত শিক্ষকদের কাছেও মন খুলে প্রশ্ন করতে পারবে না। হয়ত সেই পুরনো রুটিনই তাদের কাছে আবার এক নিউ-নর্মাল হয়েই দেখা দেবে। যে মানসিক পরিবর্তনে তারা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে, সেই নির্মোক ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে আরও অনেক বেশী সময় লেগে যাবে। আমরা, বড়রা তাদের দিকে সবরকম সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করি…আসুন।
===============================
নিবন্ধ-৮
অতিমারী ও শিশু
ডা. দেবাংশু ঘোষ
এক অদ্ভূত পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে আমরা সবাই যাচ্ছি ৷ একজন চিকিৎসক হিসেবে
প্রতিনিয়ত সেই পরিস্থিতির সাথে যুঝতে যুঝতে দেখতে পাচ্ছি মানুষের অসহায়তা ৷ শুধু
স্বাস্থ্যগত দিক দিয়ে নয়,
আর্থসামাজিক, মানসিক দিক
দিয়েও আমরা পর্যুদস্ত হচ্ছি ক্রমশ ৷ তবে আমাদের মধ্যেও সবথেকে বেশি মানসিক কষ্টে
আছে আমাদের শিশুরা ৷
শিশুদের স্কুল যাওয়া বন্ধ মানে যুদ্ধকালীন ব্যাপার, কারণ করোনা যখন এক ভয়ংকর মারণ রোগ এবং তাতে শিশুরা কতটা আক্রান্ত হবে তার সম্যক ধারণা নেই চিকিৎসা বিজ্ঞানে ; এ হেন অবস্থায় মাঠে নামল শিশুদের রোজনামচা যাতে চালু থাকে তার আশু ব্যবস্থা ডিজিটাল স্কুল, যা কম্পিউটার বা স্মার্টফোনের মাধ্যমে স্কুলের প্রাত্যহিক ক্লাস |
এর সবচেয়ে খারাপ সমস্যা হলো গরীব ঘরের গ্রামের বা মফঃস্বলের শিশুদের যাদের অভিভাবকদের স্মার্টফোন বা ল্যাপটপ বা কম্পিউটার নেই, তারা শুরুতেই হোঁচট খেল এবং ডিজিটালাইজেশন তাদের কাছে অলীক স্বপ্ন হয়ে থেকে গেল ৷
ভয় ব্যাপারটা শিশুদের এমনিতেই কম থাকে ৷ তাই করোনা রোগ সম্পর্কে তাদের প্রধান ধারণা বাইরে বেরোলে হাত ধুতে হবে, বাইরের কিছু ধরলে হাতে স্যানিটাইজার দিয়ে ঘষে নিতে হবে, মুখে মাস্ক পড়তে হবে, জরুরী প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বেরোনো যাবে না বা বাইরের কোনো লোকের কাছাকাছি ছয় ফুটের মধ্যে যাওয়া যাবে না ইত্যাদি |
তাই ভয়ের রেশ না থাচলেও যাদের নিকট আত্মীয়-স্বজন গত হয়েছেন করোনা রোগে, তাদের সেই অকাল মৃত্যু শিশুদের মনে করোনা রোগ সম্পর্কে একটা
ভয় সৃষ্টি করতে পারে ৷
মায়েদের ক্ষেত্রে ডিজিটাল স্কুল আরো সমস্যা বাড়িয়ে দিল, যেহেতু বাচ্চারা বাড়িতেই থেকে স্কুল করছে এবং তাদের সাহায্যকারী হিসেবে মাকেই প্রধানত পাশে সর্বদাই থাকতে হচ্ছে ৷
স্কুলের ক্লাসরুম সমাজের একটা ক্ষুদ্র প্রতিচ্ছবি, যেখানে বিভিন্ন আর্থসামাজিক শ্রেণীর শিশুরা একসঙ্গে পড়াশুনা, খেলাধুলো,মানসিক ভাবের আদান প্রদানে সক্ষম হয় ও পড়াশুনার মধ্যে দিয়ে প্রতিযোগিতার মনোভাব গড়ে ওঠে, অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীরা কি করছে, কেমন ভাবে করছে এবং ভালো করলে শিক্ষকরা তাদের কেমন প্রশংসা করছেন তা শিশুমনে প্রভাব ফেলে এবং তারা নিজেরাও আরো উন্নত হওয়ার চেষ্টা করে যা ডিজিটাল ব্যবস্থায় উপলব্ধ নয় ৷
পারস্পরিক ভাবের আদান-প্রদানের মধ্যে দিয়ে বন্ধুত্বের মতো উৎকৃষ্ট সামাজিক নির্ভরতার সম্পর্ক স্কুলেই তৈরি হয় এবং যা আজীবনের মূল্যবান সম্পদ হিসাবে রক্ষিত হয় এবং ভবিষ্যৎ জীবনের বিভিন্ন চরম প্রয়োজনে তা মানুষকে উত্তীর্ণ হতে সাহায্য করে ৷ তাই ডিজিটাল ব্যবস্থা সাময়িক ভাবে কাজ চালিয়ে নিলেও তা সুদূরপ্রসারী নয় ৷
আবার এটাও বলা যায়, শিশুরা বড় হয়ে তাদের সময়ের এই সব বিভীষিকাময় মৃত্যুমিছিলের দিনগুলোর কথা স্মরণ করবে এবং গল্প করবে, কিন্তু তা তাদের মধ্যে কোন আতংকের সৃষ্টি করবে না এবং কিভাবে করোনা প্রতিরোধী ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের মাধ্যমে এই মহামারীকে জয় করা গেছিল এবং সেই প্রসঙ্গে চিকিৎসা বিজ্ঞানের অবদানকে স্মরণ করবে ও একইসঙ্গে অনেক আজকের শিশু পরবর্তী প্রাপ্তবয়স্ককালে বিজ্ঞানচর্চার প্রতি অধিকতর আগ্রহী হতে পারে এমনটাই স্বাভাবিক ৷
বাড়িতে চব্বিশ ঘণ্টা সময় কাটানো গৃহবন্দি থাকা— সে এক শাস্তি শিশুদের জন্য ৷ তার থেকে তাদের মানসিক অবসাদ হতে পারে ৷ তাই ইন্ডোর খেলার ব্যবস্থা, যেমন ক্যারাম, লুডো, চাইনিস চেকার, দাবা ইত্যাদি ; আঁকার সরঞ্জাম-রং,তুলি ,পেন্সিল, খাতা প্রভৃতি , কিছুটা বেছে টি.ভি.শো এবং কার্টুন কয়েক ঘণ্টা অবশ্যই দেখতে হবে রুটিন মাফিক ৷ তবেই লকডাউনও শিশুদের মনে ছুটির আনন্দ দান করবে ৷ আসলে শিশুরা আমাদের মতো করে নিজেদের সমস্যাগুলো প্রকাশ করতে পারে না বলেই তাদের মানসিক সুস্থতার দিকে বেশী নজর দিতে হবে, যাতে তারা কম মানসিক সংকটে ভোগে আর তাহলেই এই সংকটকাল পেরিয়ে আমরা আবার সুস্থ পৃথিবীর দিকে এগিয়ে যাব ৷
===============================
নিবন্ধ-৯
বিপন্ন শৈশব
অর্ণব গরাই
একটা সময় ছিল ,আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন পড়াশোনার পাশাপাশি নিয়মিত খেলাধুলো, শরীরচর্চা , টিভিতে
কার্টুন দেখতে ভালোবাসতাম l
এর মানে এই নয় যে দুষ্টুমি করতাম না l দুষ্টুমি মানে গাছে চড়া, পেটে ব্যথার
কারণে স্কুল না যাওয়া এই ধরণের ছোট ছোট দুষ্টুমি l এর থেকে বেশি কিন্তু কখনই নয় l আমাদের সময়ে
টিভিতে হত তখন বিক্রম বেতাল , চন্দ্রকান্তা, রামায়ণ , মহাভারত , আলিফ লায়লা সহ একাধিক বাচ্চাদের মনোরঞ্জনের অনুষ্ঠান l আর এই সব অনুষ্ঠান বিশেষত হত রবিবার l সপ্তাহের বাকি দিনগুলি ছিল আমাদের কাছে নিষিদ্ধ l সেই অর্থে রবিবার দিনটা ছিল আমাদের কাছে এক অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ দিন l
স্কুলে যাওয়া ছিল এক বিশেষ আনন্দের বিষয় , স্কুল গেলেই বন্ধুদের সঙ্গে টিফিন ভাগ করে খাওয়া , টিফিনে বা স্কুল ছুটির পরে খেলা ছিল বিশেষ আকর্ষণের
বিষয়বস্তু l
এরপর নিজে যখন বড় হয়েছি , বাবা হয়েছি , তখন নিজের সন্তানদের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছি নিজের স্কুল জীবনের গল্প l কত কত স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে শিখিয়েছি অনুশাসন , ঠিক যেভাবে আমাদের মা বাবারা আমাদের সমস্ত দুষ্টুমি সহ্য করেও এক সুশৃঙ্খল অনুশাসনের মধ্যে আমাদের বড় হতে সাহায্য করেছেন l কি করলে ভালো , কি করা উচিত , কি করা উচিত নয় , সেগুলো বুঝিয়েছেন সুন্দরভাবে l এর পাশাপাশি ছিল দাদু ঠাকুমার কাছ থেকে উপরি পাওনার মতো রূপকথা ও পঞ্চতন্ত্রের বিভিন্ন শিক্ষামূলক গল্প শোনা l সেই গল্প শুনতে শুনতে আমরা হারিয়ে যেতাম গল্পের বিভিন্ন চরিত্রগুলোর মধ্যে l মা বাবারা যখন কোনো দুষ্টুমির জন্য খুব বকতেন, তখন এই দাদু ঠাকুমারা সস্নেহে আড়াল করতেন আমাদের l আবার সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিতেন কেমন করে ভালো হতে হয় l
বর্তমানে আমরা সকলে যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি তা অত্যন্ত দুঃসময়ের কাল l বিগত দু' বছর ধরে মহামারীর প্রকোপে পৃথিবীর প্রায় অর্ধেকের উপর মানুষ বিপর্যস্ত l কেউ হারিয়েছেন তার আপনজন , কেউ হারিয়েছেন রোজগার , আবার কেউবা দুটোই l ভেঙে পড়েছে রাষ্ট্রের শিরদাঁড়া l এর পাশাপাশি স্তব্ধ হয়েছে পড়াশোনার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় l শিক্ষা হল জাতির আসল মেরুদণ্ড , আর সেই মেরুদণ্ডই আজ বিপন্ন l বিগত বছরের মতো এবছরেও স্কুল চলছে অনলাইনে l শিক্ষাদানের যথাযথ প্রচেষ্টা চলছে ক্রমাগত , যদিও সন্দেহ থেকেই যায় এভাবে কতখানি শিক্ষা লাভ সম্ভব l বিভিন্ন স্তরের শিক্ষক বা শিক্ষিকারা নিজেরাই সন্তুষ্ট নন এমন শিক্ষাদানে l একদিকে অনলাইনে ক্লাস চলছে, অন্যদিকে বাচ্চাদের কেউ কেউ আঁকছে, কেউ আপনমনে খেলছে l
এ বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত মতামত , বাচ্চাদের একেবারেই দোষ দেওয়া অনুচিত l আমাদের পাশাপাশি বাচ্চারাও কেউ কেউ তাদের অতি কাছের জনকে হারিয়েছে এই মারীর প্রকোপে l যে সময় আমরা সকলে গৃহবন্দি ছিলাম , টিভিতে মা বাবারা সর্বক্ষণ দেখেছেন অতিমারীর ভয়াল খবর l কখনো বাচ্চারা সরাসরি গিলেছে সেই খবর , আবার কখনো পরোক্ষভাবে মা বাবাদের আলোচনায় l অনেকেই জানিয়েছেন তাদের বাচ্চারা ধীরে ধীরে অমনোযোগী হয়ে উঠছে , কেউবা বলছেন তাদের বাচ্চারা ভুগছে অবসাদে l চোখ বন্ধ করে এসবের কারণ হিসাবে বলা যেতে পারে খেলাধুলোয় বাধানিষেধ ও বন্ধুহীনতা l শিশুদের চরিত্র গঠনে খেলাধুলো ও বন্ধু হলো বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ l বিভিন্ন স্তরে মেলামেশায় ঘটে মানসিক বিকাশ l
আজকের এই দুঃসময়ে বাচ্চারা সবাই গৃহবন্দি , বন্ধু সংসর্গ নেই বললেই চলে l মারীর ভয়াল প্রকোপে হারিয়েছে , মা , বাবা , দাদু, ঠাকুমা , দিদা অনেককেই l যেটুকু স্বাভাবিক সময় হয়েছে (যদিও সেটা একান্তই পেটের দায়ে ) সেখানেও কর্মজীবী মা বাবারা জড়িয়ে পড়েছেন নিজস্ব জগতে l অর্থাৎ শিশুমন সেই একলাই থেকে গেছে l অবসাদ ও অমনোযোগিতা যে আসবে সেটাই তো স্বাভাবিক l খেলার সাথী নেই, গল্প করার সাথী নেই , তারাই বা কি করবে সারাদিন ? পড়াশোনার মানও তথৈবচ !সুতরাং স্বাভাবিক নিয়ম মেনেই গ্রাস করেছে একাকিত্ব l আমরা যারা তাদের অভিবাবক , নিজস্ব গণ্ডি পেরিয়ে বাচ্চাদের বুঝতে পারি কতজনে ? আগে হলে না হয় স্কুলের তত্ত্বাবধানে বাচ্চারা অনুশাসিত হত , কিন্তু এখন সেই উপায় বন্ধ l অতএব আমরা এখন অতল গভীরে l আমাদের ভবিষ্যৎ, আমাদের বাচ্চারা ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে অন্ধকারের গভীরে l
মা বাবারা , আমরা প্রত্যেকেই এক একজন মনোবিদ , এর জন্য আলাদা করে কোনো বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়ার দরকার নেই l আমাদের উচিত , আমাদের বাচ্চাদের সঙ্গে যথাসম্ভব সময় কাটানো l তাদের সঙ্গে গল্প করা, খেলাধুলো করা l এক কথায় ওদের সঙ্গে ওদের মতো মিশে যেতে হবে l দীর্ঘ সময় মোবাইলে আসক্ত হতে হতে মারাত্মক কিছু যে ঘটে যায়, সে উদাহরণ ভুরিভুরি আছে l তাই মোবাইল নয় , বাচ্চাদের আসক্ত করতে হবে নিজেদের প্রতি l শিশুদের সুযোগ দিতে হবে কথা বলায়, অংশ নিতে হবে ওদের প্রশ্নে l শিশুমন যেন ভীত না হয় কোনো কারণে , তারা যেন সর্বদা প্রফুল্ল মনে থাকতে পারে l বন্ধু বলতে যেন পাশে পেতে পারে তাদের অভিবাবকদের l নচেৎ সে দিন খুব দূরে নেই যেদিন আমাদের ভবিষ্যতেরা হারিয়ে যাবে আগামীর গভীর সংকটে l
===============================
নিবন্ধ-১০
শিশুমনে অতিমারী, অতিমারীর শিশুমন
সুজিৎ দে
অতিমারী অতি
বিপজ্জনক। প্রাণের তাগিদ যে বড়ো বালাই।
কিন্তু ছোট্ট শিশুরা কি বোঝে অতিমারী কী? কেন আটকে থাকতে হবে ঘরে? সব থেকে কাছের বন্ধু যার সঙ্গে প্রতিদিন চারবেলা করে দেখা, গল্প, খুনসুটি তার
সঙ্গে দেখা হবে না, হাতে
হাত রাখা যাবে না কেন? বিদ্রোহে ফুটন্ত ফুল যেন ঝিমিয়ে পড়ে।
'ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে'- সব পিতার অন্তরেও কি শিশু নেই?
আছে। জীবনচর্যার টানাপোড়েনে যা বেমানান, অপ্রাসঙ্গিক,
বাড়াবাড়ি তাকে সুপ্ত রাখাই শ্রেয়। এ ধারণা এখন রাখুন।
শিশুকে রক্ষা করতে আপনার মনের শিশুকে জাগিয়ে তুলুন। স্কুলজীবনের পাওনাগুলো একটু
ভরুক।
মা,
বাবা, ঠাম্মির
ছেলেবেলার গল্প জাগিয়ে তুলছে শিশুমনকে। এ গল্প সিলেবাসে ছিল না বলে পড়া হয়নি আগে৷
মাকাল চন্দ্র, খাঁদু দাদুর সঙ্গে আলাপ হোক। পাঠ্য বইয়ের বাইরে একটি কবিতাও
মুখস্থ করতে বলা হয়নি আগে। সব শিশু মনের মনে আজ -
বাবার আছে কাজের বোঝা
অর্থনীতির
মাপ।
মায়ের আছে
দিনরাত জুড়ে
রান্নাঘরের
তাপ।
দাদুভাই তো
শুধু রোগে ভোগে
মনেও
নিরুত্তাপ।
ফ্ল্যাটবাড়িতে
বারো বাই দশ
আমার জীবনের
মাপ?
শিশুর বন্ধু মা, শিশুর বন্ধু বাবা, আসুন পরিবারের সবাই তার সঙ্গে খেলি। অতিমারির কলঙ্ক ধুয়ে যাক শিশু মন থেকে। বাস্তবের কঠোরতা তাকে যেন স্পর্শ না করে। ভার্চুয়াল জগতে সব শিশুর বাড়ি ভরে উঠুক বন্ধুত্বের সুগন্ধে।
===============================
কবিতা-১
ভাল্লাগে না
দেবব্রত ঘোষ মলয়
বন্দি ঘরের
কোণে
বন্ধু সবাই
হারিয়ে গেছে
দুঃখ ভীষণ
মনে।
জ্যৈষ্ঠ এলো
আমের সাথে
বন্ধ তবু
স্কুল
মুখটা ঢাকা, হাতটা ধুতেই
করছি নাকো
ভুল।
আষাঢ় মাসে
জাগল আশা
চলবে এবার
ট্রেন
ধ্যাৎতেরিকা
বেড়েই চলে
সংক্রমণের
চেন।
শ্রাবণ এলো
বর্ষা নিয়ে
মনখারাপের
দিন
বৃষ্টি ভিজে
খেলার মজা
ক্রমেই হল
ক্ষীণ।
ভাদ্র মাসে
জাগল আশা
পুজোর জামা
হবে
কোথায় সেসব, হে ভগবান
দোকান খুলবে
কবে।
আশ্বিন মাসে
ঢ্যাম কুড়াকুর
বাজল নাকো
ঢাক
ভাইরাসটি
পাজি এমন
কাটল সবার
নাক।
হালকা শীতে
কার্তিক এলো
চলল না ট্রাম
বাস
চিড়িয়াখানা, ভিকটোরিয়া
বন্ধ কত মাস।
অঘ্রানে নেই
মামার বাড়ি
যাবার উপায়
কোন
বারান্দা আর
ছাদের কোণে
বন্দী সময়
গোনো।
পৌষ এলো
কমলালেবু
জয়নগরের মোয়া
সেসব এখন
গল্প অতীত
শুধু মুখোশ
আর হাত ধোয়া।
মাঘ মাসটাও
চলে এল
ফুটল গাঁদার
ফুল
বীণাপাণির
বন্ধ পুজো
খুলল নাকো
স্কুল।
ফাল্গুনে আজ
জাগল আশা
খুলবে এবার
সব
কোথায় সে সব, বন্ধ হোলি
বন্ধ কলরব।
চৈত মাসেও
বন্ধ চড়ক
ভাল লাগে না
আর
মোবাইলে
পড়াশোনা
সবকিছু
ছারখার।
===============================
কবিতা-২
শিশু কাঁদে বিষ ফাঁদে
ডঃ রমলা মুখার্জী
স্কুলের ব্যাগ
কাঁধে নিয়ে টোটন ধরেছে বায়না-
যাবেই সে স্কুলেতে
আজ, কিচ্ছু খেতে চায়না।
টোটন সোনা রাগ
করোনা, স্কুলে যেতে মানা-
অদৃশ্য এক ভূত
এসেছে নাম তার করোনা।
তবে মা গো খেলতে
দাও বন্ধুদের সাথে-
বাইরে মোটে বেরুবো
না, খেলবো তো ছাতে।
শোন টোটন, একসাথে থাক না
মেলামেশা-
একটু বোঝ, অসুখটা বড্ডো
সর্বনাশা।
আমায় তবে নিয়ে চল
গ্রামের দেশের বাড়ি-
বাবা-মা চলো না গো, বার করো না গাড়ি।
ওরে বোকা বুঝিস না, গাড়ি-ঘোড়া বন্ধ-
বাতাসের গায়ে আজ যে
ভারি বিষাক্ত গন্ধ।
মাস্ক পরে থাকলেও
দূরে থাকা চাই-ই-
বেরোবার, খেলবার উপায় তো
নাই-ই।
বোঝে না ছোট্ট টোটন, সাথীহারা বেপরোয়া -
অতিমারীর মোটেও করে
না সে পরোয়া।
হাত-পা ছড়িয়ে সে
শুধু সারাদিন কাঁদে-
শিশুরা ভীষণ একা
অতিমারীর ফাঁদে।
===============================
কবিতা-৩
মনের কথা
ড. মধুমিতা ভট্টাচার্য
মনটা যে তার খারাপ বড়,
তাই লিখছে সে আজ চিঠি।
"মা দূর্গা-আর কোরোনা দেরি,
করোনাসুরের করো সংহার-
তোমার কাছে এই প্রার্থনা করি ।
দাদুন আমার হাসপাতালে-
সুস্থ তুমি করো তাকে,
জড়িয়ো না আর করোনা জালে।
বন্ধ যে স্কুল, খারাপ লাগে।
লকডাউনের বন্দী দশা-
ভাবি শুধু করোনা কবে আসবে বাগে?
পুজোর বাকি আর কয় মাস!
এবার পুজোয় সব ভালো চাই-
করোনাসুরের চাই যে বিনাশ।"
===============================
কবিতা-৪
রিমোর বায়না
শুভ্রা ভট্টাচার্য
দেখবে এবার বাইরে ঘুরে।
ছোট্ট রিমোর অবুঝ বায়না
তাকে আর ঘরে রাখা যায় না।
দূরে খোলা মাঠের হাতছানি
তাকে কেমনে ফেরায় সোনামণি।
নীল নীলিমায় আকাশ পানে
স্বপ্নভরা দু'চোখ টানে।
নানান সুরে কিচিরমিচির
বুকের মাঝে ডাকে তিতির।
শ্যাম বনানীর শ্যামলিমা
ভাঙলো বুঝি সহনসীমা।
বন্দী ঘরে টিভির স্ক্রিনে
দেয় কি ধরা রিয়েল সিনে ?
মন ভরেনা যান্ত্রিকতায়
প্রকৃতিতে মিশে যেতে চায়।
আজ সে বড় অসহায়
বন্দীদশায় মনমরা তাই,
বলে, দুষ্টু যে সেই করোনা
এবার ফেরার পথটা ধরো না,
তবু সে ফিরে দেখি যায় না
আমার মনও মানতে চায়না ৷
===============================
কবিতা-৫
হারিয়ে যাচ্ছি
হামিদুল ইসলাম
ধীরে ধীরে ভাঙছে জীবনের সাবেকি অখণ্ডতা
স্বাস্থ্যহীন
বিকেল
রঙচটা সূর্য টুকরো
কাগজের মতো উড়ে পড়ছে পাতার কুটিরে ৷
অজানা ভয় আতঙ্ক
ত্রাস হামাগুড়ি দিয়ে আসছে পৃথিবীর উপলভূমিতে ৷
কোভিড নাইন্টিন
আমাদের পেছনে ধাওয়া করছে,
আমরা পালাচ্ছি ভয়ে—
দৌড় দৌড় দৌড় দৌড়
দৌড় দৌড় ৷
কিন্তু পালাবো
কোথায় ?
পুজোর শঙ্খধ্বনি, মসজিদের আজান, গির্জার ঘণ্টা থেমে
যাচ্ছে ধীরে ধীরে !
চারদিকে মৃত্যুর
গন্ধ। হাতে হাতে বিলি হচ্ছে মৃত্যু ৷
মৃতের শরীর জুড়ে
বিষণ্ণতার শূন্য প্রান্তর। ধূ ধূ মরুভূমি,
খাঁ খাঁ করছে
পৃথিবী ৷
শিশুরা হতাশ।
সূর্যপোড়া রোদে গলছে ভাবনার গহন দেয়াল ৷
বন্ধ হয়ে গেছে
সমস্ত স্কুল। বন্ধ পঠন পাঠন ,
স্তব্ধ খেলাধুলো।
খেলার মাঠে লম্বা ঘাস, ক্যাকটাস, সাপেদের আড্ডা ৷
সহপাঠীদের সাথে
দেখা নেই কতোদিন,
নেই পড়াশোনা।
স্কুলের খবর
অন্ধকার পর্দার
আড়ালে,
আপন হয়ে যাচ্ছে পর।
হারিয়ে যাচ্ছে আকাশ ৷
এখন মোবাইলই
একমাত্র ভরসা। কথকতা আদান প্রদান
অনিয়মিত অন লাইন
ক্লাস। হতাশার চাঁদ চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে মহাসমুদ্রে
অন্ধকার অন্ধকার
অন্ধকার
অন্ধকারে হারিয়ে
যাচ্ছি আমরা। অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী
আমাদের প্রিয় ঈশ্বর...
===============================
কবিতা-৬
ফাঁকিবাজ
অদিতি ঘটক
আহা, বড্ড ভালো ছিল সেই সব দিনকাল
ক্লাসের থেকে বারান্দাতেই কাটত বেশি কাল,
তোমার দেওয়া নামটা মা ছিলনা কারুর মনে
''ফাঁকিবাজ" বলে ডাকত জনে, জনে ৷
কবে থেকে গেটের সামনে মস্ত তালা ঝুলে
আমার সেই নামটা বুঝি গেল সবাই ভুলে
কোথা থেকে উড়ে এসে বসল জুড়ে জীবাণু
ঘরের ভেতর থেকে থেকে গাছের মত হচ্ছি স্থানু ৷
আগে ছিল স্কুলের ধমক স্যারদের দেওয়া তকমা
এক লহমায় ঘুঁচে গেল একার সেই হক মা !
বদ্ধ ঘরে পড়ার নামে দিচ্ছে সবাই ফাঁকি
অন্তর্জালে ইচ্ছে মতো করছে হাঁকাহাঁকি
দেখতে পেয়ে হাত উঁচিয়ে আসছো কেন তেড়ে ?
দেখো, আমার কথা শুনছে সব কেমন মাথা নেড়ে
'খেতাব' টা মা রাখতে দাও আমায় তুমি ধরে
স্কুল খুললে স্যাররা আমায় ডাকবে কেমন করে !
===============================
কবিতা-৭
শ্বেতা সরকার গুপ্ত
একটা ছেলে দস্যি বেজায়,কিচ্ছুতে ভয় পায়না
বিকেলবেলায় খেলার মাঠে যাবেই যাবে,বায়না ।
সেই ছেলে আজ আটকে ঘরে
রোজ বিকেলে নামতা পড়ে
মনখারাপি হোক না যত, খেলতে মাঠে যায়না।
সেই মেয়েটা জুতোয় মোজায়, চুলের ক্লিপে, ফর্সা জামায়
ছোট্ট একটা পরীর মতো, রোজ সকালে ইস্কুলে যায়
বন্ধ হল সে সব এবার
মন কেমনের সঙ্গী সবার
মিলবে কবে বন্ধুরা তার?ছোট্ট মেয়ে ভেবে না পায়।
বাবার অফিস, মায়ের কলেজ খুলবে কবে কেউ জানে না,
দিন এনে দিন খাচ্ছে যারা খিদের জ্বালা বাগ মানে না
কাটবে কবে এদিনগুলো
ব্যস্ত পথে জমছে ধুলো
বন্দি যে যার ঘরের কোণে,বাড়িতে কুটুম আর আসে না।
কোভিড-জ্বরে কাঁপছে ধরা,যতই ওরা গণ্ডি কাটুক
করোনা হানা আটকাবে না, নমস্কারেই ভরসা থাকুক
কাছে যাওয়ায় গভীর অসুখ
মুখোশ ঢাকুক সব চেনা মুখ
নতুন কোনো দিনের ভোরে আমার শহর আবার বাঁচুক।
===============================
কবিতা-৮
একলা খুকি
অরুণ কুমার দাঁ
মনটা তাঁর
ভীষণ দুখি,
ডাকছে তাঁকে
সবুজ ঘাস-
ধরবে পোকা
বাইরে যাস ।
জ্বালায় পোকা
বারোমাস
উঠছে খুকির
নাভিশ্বাস,
পড়ার বইয়ে
রাঙা-পাখি
খুকির মনে
উঠছে ডাকি ।
এঘর ওঘর ক'রে খুকি
খেলছে শুধুই
লুকোচুকি,
দেখবে কবে
নীল আকাশ
মাখবে কবে
হিম বাতাস ।
===============================
কবিতা-৯
করোনা
তপনকান্তি মুখার্জি
শুনতে শুনতে
পাগল ,
এখন মরছি
করোনা - জ্বালায়
নড়ার নেই যে
হেলদোল ।
মাস্ক পরে
পরে শ্বাসকষ্ট
হাত ধুলে করে
জ্বালা ,
অন - লাইনে
চলছে ক্লাস
টালি থেকে
সেই টালা ।
বন্ধু - মুখ
ভুলতে বসেছি
ভুলছি খেলার
পথ ,
করোনা তুমি
এবার হটো
এনেছি
স্বর্গরথ ।
অনেক মানুষ
মেরেছো ছোবলে
ঢেউয়ের পরে
ঢেউ ,
এবার নাকি ' ছেলেধরা ' হবে
ভয়ে কাঁদি
ভেউ ভেউ ।
এইতো এলাম এই
পৃথিবীতে
এখনই নিচ্ছ
টেনে ,
তবে কেন আর
বলছি তোমায়
তুমি তো জোঁক
ছিনে ।
===============================
কবিতা-১০
করোনা জ্বালায়
জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়
পশুপাখি ছায়া
খুঁজে দেহটি লুকায়।
হাওয়াও অচেনা
লাগে দয়ামায়া নেই
ঘরদোর বন্ধ
সেই কারণেই।
আম জাম
জামরুলে ভরা ডালপালা
তাই দেখে
ছোটোদের মন যে উতলা।
জানি সব
বন্দি করোনার জালে
পারাপার বন্ধ
হাওয়া নেই পালে।
কতদিন পর এই
ভয় দূর হবে
আবার
মুক্তপ্রাণে দেখা হবে কবে?
===============================
কবিতা-১১
বাবার থেকে বড়
অমিত চট্টোপাধ্যায়
আদুরে এক
মেয়ে।
বকা দিলেই
অঝোরে জল
ঝরত দুচোখ
বেয়ে।
ঘরের কাজে
হাত লাগানো
সেসব গল্প
কথা!
তুলত মাথায়
সারা বাড়ি
লাগলে অল্প
ব্যথা।
হঠাৎ সেদিন
দেখি যে তার
বয়স গেছে
বেড়ে।
নিজে নিজেই
বাজার গেল
হাতের থলি
কেড়ে।
পাঁচ বন্ধু
মিলে তারা
রান্না করে
রোজ।
কার বাড়িতে
কোভিড রোগী
রাখছে তারই
খোঁজ।
জ্বর, কাশি বা
শ্বাসকষ্ট
কাউকে যদি
ভোগায়
ওষুধ, খাবার, অক্সিজেনও
সাধ্যমত
যোগায়।
ভাবছি মেয়ে
কেমন করে
হল এমন দড়!
বয়সে নয়, হৃদয়ে সে,
বাবার থেকে
বড়।
===============================
কবিতা-১২
বেলা ছোট হয়ে আসছে
মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায় রায়
নিঃসঙ্গতার পার ভরে উঠেছে নীরব কলমি ডগে।
বেলা ছোট হতে কোনো কাল লাগে না।
তারই ফাঁকে ছোট শিশু পর্দা সরিয়ে
আকাশ আঁকার চেষ্টা করছে।
দলছুট পাখি অভ্যাসের তাড়নায় সঠিক গন্তব্যে ভেসে যাচ্ছে।
পাখার নিচে যতটুকু আছে মাঠ আগাছায়
ভরে গেছে।
আমার ব্যালকনি ঝুলছে শূন্য লোহার
গরাদে।
আমি আড়াল দেওয়ার আগেই অন্ধকার
নেমে আসে।
তবু আলো আঁধারির ভ্রুযুগলের মাঝে
শত চেষ্টা করেও চোখ দুটো পৌঁছে যাচ্ছে
যেখানে মেলা আছে অসংখ্য রঙিন
অন্তর্বাস।
নীরব তীক্ষ্ণ
ভাবাবেগ আর কত ভাবে হতশ্রী করবে
কে জানে!
ছাত্রজীবনে স্কুলের বেঞ্চে ছুটির
ঘন্টায় অক্সিজেন চলছে ।
ভার্চুয়াল সংস্কৃতির ঘেরাটোপে শিশুর স্বপ্নগুলো আজ
রোবটিক্স ।
সামাজিক আক্রোশের কোনো স্যানিটেশন হয় না ।
একটা মাস্ক কত সহজেই শৈশব
থেকে যৌবন বেয়ে বার্ধক্যে পৌঁছিয়ে
দিচ্ছে।
কুলকিনারাহীন ভাবনায় বেলা ছোট
হয়ে আসছে।
অলস মস্তিকে নানা কাহিনী শান
দিচ্ছে ঘণ্টাখানেক ।
অথচ ভিতরে ভিতরে কত যে হারিয়ে
যাওয়ার ঝড় জন্ম নিচ্ছে তা নিয়ে কোনো ঘণ্টাখানেক হয় না।
===============================
কবিতা-১৩
ঠাকুর, চাইনা এ অতিমারী !!
গোবিন্দ মোদক
কী যে এলো
দিনগুলো ছাই, থাকতে
হচ্ছে বাড়ি,
বলছে সবাই --
আপদ এ এক, ভীষণ
অতিমারি !
যায় না তাকে
চোখে দেখা, যায়
না ধরা তাকে,
কে জানে সে
লুকিয়ে বসে কখন কোথায় থাকে !
ভীষণ-ই এক
আপদ সে, অণু-জীব
প্রাণঘাতী,
নিয়ম-কানুন
রীতি-নীতি সব পাল্টালো রাতারাতি !
কারও বাড়ি
যাওয়া বারণ, বারণ
মেলা-মেশা,
দূরের থেকেই
কথা বলা, যায়
না কাছে ঘেঁষা !
মুখেতে মাস্ক, হাতে সাবান, স্যানিটাইজার
দাও,
সামাজিক
অনুষ্ঠান থেকে নিজেকে গুটিয়ে নাও !
কি যে এলো
দিন গুলো ছাই, ইস্কুল-টাও
বন্ধ,
পঠন-পাঠন
শিকেয় তোলা, নেই
স্বাভাবিক ছন্দ !
মাঠে গিয়েও
খেলতে মানা, করোনা
জুজু আছে,
এমন ভাবে
শাসন করলে, প্রাণ
কি করে বাঁচে !
অষ্টক্ষণ
মুখোশ পরো, দাও
স্যানিটাইজার,
এটা করো না, ওটা ধরো না, বারণ শত
প্রকার !
বন্ধুদেরকেও
কাছে পাইনা, পাইনা
খেলার ছুটি,
খেলার মাঠ
হাতছানি দেয়, কেমন
করে জুটি !
কতোদিন যে
ইস্কুলে যাইনা, মোবাইলে
পড়াশোনা,
মন যে শুধু
বিদ্রোহী হয়, কতোকাল
দিনগোনা !
সামাজিক
অনুষ্ঠান? তাও
বারণ, বিধি-নিষেধ
আছে,
বন্ধু-র
বার্থডে ? তাও
হয় না, সংক্রমণটা
পাছে !
মামা-র
বাড়িও যাওয়া বন্ধ, বন্ধ
চিড়িয়াখানা,
জাদুঘরেও
যায় না যাওয়া, ওটাও
এখন মানা !
সাংঘাতিক সব
খবর শোনায় নিউজ-পেপার,
টিভি,
ডাক্তার-নার্সকে
লড়তে হচ্ছে, লড়ছে
স্বেচ্ছাসেবী !
আর কতোদিন এই
বেড়াজালে থাকতে হবে তাই,
লকডাউনের
গুঁতোর জ্বালায় প্রাণ করে হায় হায় !
হে ভগবান
দোহাই তোমার, একশো
প্রণাম নাও,
অতিমারির খরা
কাটিয়ে, ইস্কুল খুলে দাও !!
===============================
কবিতা-১৪
লক আউট
নৃপেন্দ্রনাথ
মহন্ত
সেই যে একদা এপ্রিলে
দুই পাখি
মেরে এক ঢিলে
বন্ধ ইস্কুল
এক পাখি ডানা
ঝাপটায়
এক পাখি বসে
খাবি খায়
কে জানে কার
ভুল!
এটা তো ছুটির
মাস জুন
তোমাদের কেন
মুখ চুন
ছুটি কোথায়
গেল?
ছোটদের নেই
হুটোপুটি
ইস্কুল খোলা
আর ছুটি
কি করোনাই
খেল?
আসে না তো
ইস্কুল বাস
ইস্কুলে
করোনা আবাস
কোয়ারান্টাইন
আমাদের
কাটেনা সময়
পড়া নেই, খেলা নেই, ভয়
কোভিড-আইন।
লক ডাউন
অবসান হয়
লক আউট দীর্ঘ
সময়
ক্লাসরুমে
তালা
ভোট হয়,জনসভা হয়
মেলাতেও
আপত্তি নয়,
ইস্কুলেই
জ্বালা!
===============================
কবিতা-১৫
অতিমারী
শ্যামল মণ্ডল
ছয় বছরের দুইটি বছর
থাকলো ঘরেই শুয়ে,
দেখলো
শুধু বেড়ার ঘরটি
কেমনে খেল উইয়ে।
মাঝে
মাঝেই প্রশ্ন করে,
উড়ছে তো সব পাখি !
বাইরে
কেন যাইনা মাগো,
ঘরেই কেন থাকি?
স্কুলে
আর দাও না কেন
পড়াও কেন ঘরে?
খেলার
মাঠে খেলার জন্য
মনটা কেমন করে।
সারাটা
দিন বই নিয়ে তো
থাকি ঘরের কোণে।
হাত
চলে না পা চলে না
ছটফটানি মনে,
দাও
না মাগো ছুটি এবার
যাই চলে ইস্কুলে ,
নয়
তো আমি হৃদয়টাকে
নিজেই যাবো ভুলে।
আর
পারিনা সইতে মাগো
কেঁদে ভাসাই বুক,
জানিনা
মা কাঁদিয়ে আমায়
কেমন তোমার সুখ।
আমি
তো মা ছোট্ট শিশু
তোমার বুকের ধন
বাইরে
যেতে দাওনা কেন?
কীসের তোমার পণ?"
"চলছে
এখন বিশ্বজুড়ে
কোভিড অতিমারী
বলতো
সোনা বাইরে যেতে
আজ্ঞা দিতে পারি?
রোগ
থামাতে লকডাউনে
চলছে সারা দেশ
তাই
তো সবাই সাবধানেতে
ঘরেই আছি বেশ।"
===============================
কবিতা-১৬
আজকের অমলরা
শিবেশ মুখোপাধ্যায়
"ডাকছে আকাশ, ডাকছে বাতাস।
ও ছেলেরা
বন্দি কেন?
"
কিংবা 'কী এমন অপরাধ করেছি
কথা বলতে
শেখার আগেই
মাস্ক দিয়ে
মুখ বন্ধ!'
সত্যিই আজকের
'অমলরা'
এক্কেবারে
গৃহবন্দি।
'লক্ষ্মণগণ্ডি' পেরিয়ে
বাইরে যাওয়ার
কথা ভাবতেই পারে না অমল- রা
দুষ্টু
রাবণের গল্প যে তাদের জানা।
জানলার গরাদ
ধরে করুণ চোখে
রাস্তার দিকে
তাকিয়ে
সঙ্গীদের
খোঁজে।
হয়তো পাশের
বাড়ির বিল্টু
পাপাইরা
কখনো বা উঁকি
দিচ্ছে ব্যালকনিতে।
বন্ধ স্কুলের
দরজা,
খেলার মাঠটা
ঘাসে ভর্তি।
দস্যি
ছেলেদের দাপিয়ে বেড়ানো,
অশান্ত
বাচ্চাদের ছটফটানি নেই।
কেমন সবাই
যেন একবছরে
অনেক বড়ো হয়ে
গেল।
স্কুলের
টিচার,
ম্যাম আর সহপাঠীরা
কত দূরে ...
মনে পড়ে
টিফিনে খাবার ভাগ করে খাওয়ার মজা।
ছোটাছুটি, ট্যাপ খুলে হাত পা ধোওয়া৷
তবু! কী
সুখের ছিল দিনগুলি !
এমনিতেই
আজকের বাচ্চারা শৈশবহারা।
শৈশবে সবুজের
হাতছানি
দিগন্ত
বিস্তৃত মাঠ,
পুকুরে
ঝাঁপানো,
গাছে চড়া,
বিকেলে মাঠে
ছুট...
সব উধাও।
এখন শুধু
প্রতীক্ষা।
পাঁচমুড়ো
পাহাড়,
শ্যামলী নদী, দইওয়ালারা
স্মৃতিতে
ভেসে বেড়ায়।
উঁকি মারে
মনের
ক্যানভাসে।
হারানো শৈশব
আর ফেরে না।
করুণ চক্ষু
মেলে যতদূর দৃষ্টি যায়
ওরা চেয়ে
থাকে।
ভাল লাগে না
বাক্সবাড়ি
ভাই বোন নেই
নেই
বন্ধু-বান্ধব
যেন সবার
সাথে আড়ি।
কষ্ট হচ্ছে, কষ্ট হচ্ছে ভারী।
কোথায় স্কুল
ব্যাগ,
টিফিন কৌটো,
ওয়াটার বোটল, স্কুলের গাড়ি।
আর তো কাটেনা
দিন
মন বসেনা
কোনো কাজে।
পড়াশোনা, লেখা, অঙ্ক কষা, আঁকাজোকা।
সুধার জন্য
অপেক্ষার নেই শেষ।
সেও তো
বন্দি।
আর তোলে না
ফুল।
অমলের কথা
তার মনে আছে
কি?
নাকি ভুলে
গেছে বিলকুল...
কবে যে
মুক্তি পাবে
এই 'শৈশবহারারা'!
কবে পারবে
যেতে স্কুলে,
পার্কে, খেলার মাঠে?
হাতছানি দিয়ে
ডাকছে ওদের
প্রকৃতি।
আর কি ঘরে মন
রয়?
মুক্ত বায়ু, চোখ জুড়ানো সবুজ
প্রান্তর আর
সোনা রোদ্দুর
ফেলে?
"ডাকছে আকাশ, ডাকছে বাতাস।
ও ছেলেরা
বন্দি কেন?
"
===============================
কবিতা-১৭
ছুটি
সুজান মিঠি
দাদা কেন বিধু মাঝির নৌকো নিয়ে ভেসে যায়না স্বপ্ন দেশের
ঘাটে?
তোমার গানের খাতা বন্ধ কেন মা?
স্নানের পরে তোমার ছুটন্ত মুখ কোথায় মা?
ফুলের মধ্যে টুক করে সেই লুকিয়ে নিতাম আমি!
কাব্য কথার সেই সে সকাল!
সেই সে খেলার বেলা!
কোথায় গেল মা?
দাদার মুখে হাসি নেই, আমার মনেও
ধুলো…
এ ঘর ও ঘর মধ্যিখানে ছুটি।
দাদার স্বপ্ন ছুটি
বাবার অফিস
তোমার গান
আমার স্কুল …
স্কুলের উঠোনের সেই রোদ্দুর
কতদিন সে ঘুমিয়ে আছে!
ঘুমিয়ে ক্লাসরুম
টিফিনবেলা…
আমার টিফিন কোথায় মা?
আমার জুতো মোজা?
স্ক্রিনের ওপারে দিদিমণির ঘর, পর্দা
খাবার টেবিল দেখি,
আমার আকাশ দেখি না কেন মা?
ওহ! বড্ড ভারী মা!
এই ছুটি বড্ড ভারী!
বাবা কেন অফিসে যায় না মা?
দাদা কেন স্বপ্ন দেখে না?
তোমার গানের খাতায় বিষাদ কেন ঝরে?
ভাতের থালায় এমন অভাব কেন ঘরে?
আচ্ছা মা,
আমার স্কুলের জুতোয় ঠিক কতটা ছুটি ধরে?
===============================
কবিতা-১৮
বিট্টুসোনার মেজাজ
রাজকুমার ঘোষ
লকডাউন আর অতিমারীতে
নেইকো কিছু কাজ
ঘরে বসেই বিট্টুসোনার
বিগড়েছে তাই মেজাজ !
দেড় বছরে স্কুল
খোলেনি, দেখেনি খেলার মাঠ
মা-বাবার শুধুই
বারণ, "যাবিনা কারোর সাথ"
নিজের ঘরেই মনে
হয় যেন জেলখানাতে বন্দি
অনেক ভেবে বিট্টুসোনা
বের করল জবর ফন্দি ৷
বাবা মাকে বোঝালো
সে স্কুল দিয়েছে টাস্ক,
রাখতে হবে হিসাব,
পাড়ায় ক'জন পরেনি মাস্ক।
এমন কাজ, তাই
ঘুরতে হবে নিজের সারা পাড়া
খেলা, ঘোরা সবই
হবে, ঘরে নেইকো ফেরার তাড়া ৷
সারাদিনের ফূর্তিতে
বিট্টুসোনার মেজাজ বেশ
মনে হয় তার, বহুদিন
পর বন্দি জীবন হল শেষ
হঠাৎ একদিন বিট্টু
দেখে বাবা এল খেলার মাঠে
মনের মাঝে ভয়ের
ধারা, বাবা বোধ হয় লাঠি হাতে
বাবা এসে রাখল
দরাজ হাত দু' খানা পিঠে,
"আজ থেকে আর বাবা নই রে, হব যে তোর মিতে।
===============================
কবিতা-১৯
হোম ইউর ওন হোম
অনুপ দত্ত
এ সময় বড়ো এক
কষ্ট সময়
যা যা দাগ
পড়ছে
সব কী ঠিকঠাক
মুছে যাবে?
কষ্টের পরে
কষ্ট সাজিয়ে দিনের আলোয় লিখি এ কবিতা৷
৹
বিজ্ঞাপনের
পরে বিজ্ঞাপন
এটা করোনা.
ওটা করোনা
জীবন এখন
"করোনা" একা এক যন্ত্রণা
মোবাইল
ক্যামেরার নজরে এখন
সবাই অন লাইন
ছবিতা৷
৹
কত কিছু
হারাচ্ছি দৈনন্দিন
অফিস, মাল্টি-কমপ্লেক্স
মুভি, সোসাইটি
স্ট্যাটাস
কত কিছু
ভেবেছি,আহা
একটু যদি পেতাম
এখন সময়
উপেক্ষা ভাঙ্গা ভাঙ্গা ঢেউ’এর
দোলায় রাত্রি
উষ্ণতা৷
৹
গৃহবন্দী
শেষে এসে টের পেয়েছি সবই এক
ক্ষণিক
বিবসতা
বুঝেছি ‘হোম ইউর ওন
হোম’ ফ্যামিলি
তোমার একাগ্রতা৷
===============================
গল্প-১
ফেরা
সুজাতা
বন্দ্যোপাধ্যায়
দুই ভাইয়ে হুটোপাটি করে।কখনো মারপিট। কখনো ওয়ার্ড মেকার বা অন্যকিছু।ওদের মা বাবা জয় আর রমলা দেখলেন বাচ্চারা ক্রমশ মনমরা হয়ে যাচ্ছে।ওদের মনমরা ভাব কাটানোর জন্য জয় ও রমলা নিজেদের ছেলেবেলায় ফিরে গেলেন।বের করা হল লুডো ও দাবার ছক আর গুটি। খুব মজা পেল পাপান ও তাতান।পড়াশোনা আর টিউশন ইত্যাদির চাপে বাবা মাকে এত বন্ধুর মতো করে ওরা কখনও পায় নি। জয় কলেজের প্রফেসর। মাঝেমধ্যেই কলেজের পরিচালন সমিতির ডাকে তাকে মিটিং-এ যোগ দিতে হলেও গুগল মিটে সেরে ফেলতেন । বাইরে যেতেন প্রয়োজনীয়তাটুকু মেটাতে।কিন্তু ভোটের সময় ডিউটি করেন অন্য শহরে। কাজ সেরে বাড়ি ফিরলেন প্রচন্ড গায়ে ব্যথা ও জ্বর নিয়ে।
বুঝতে পারছেন এই জ্বর মামুলি নয়। নিজেকে ঘরবন্দি করে নিলেন। খাবারে রুচি গিয়েছে চলে। যা খাচ্ছেন বমি হয়ে যাচ্ছে। শরীর ক্রমশ নেতিয়ে পড়ছে। বাচ্চারা বাবাকে এই অবস্থায় কখনো দেখে নি। ঘুমিয়ে পড়লে ওঠার ইচ্ছে থাকলেও পারছেন না। অগত্যা স্ত্রীর অনুরোধে ডাক্তার দেখাতে বাধ্য হলেন। তাঁর ব্যবহৃত জিনিস সব ইউজ অ্যান্ড থ্রো করা হচ্ছিল। স্যানিটাইজার দিয়ে শুদ্ধিকরণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। মনের জোরে এক সহৃদয় বন্ধুর সহযোগিতায় ওষুধ, ইনজেকশান নিয়ে, ডাক্তার দেখিয়ে বাড়ি ফিরলেন জয়।সব নিয়ম মেনেই চলতে থাকলেন ৷ আবারও ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেন।
অনেক সাবধানে থেকেও শেষ রক্ষা হল না। রমলা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। মারাত্মক শ্বাসকষ্ট নিয়ে ভর্তি হতে হল তাকে হসপিটালে। অনেক কষ্ট সহ্য করে দীর্ঘদিন পর কিছুটা সুস্থবোধ করতে বাড়িতে ফিরল রমলা। তাতান-পাপান মাকে ছুঁয়ে দেখল অনেকদিন পরে। রমলার মুখে হাসি ফুটেছে ছেলেদের দেখে।সৌভাগ্য সাময়িকভাবে মুখ ঘুরিয়ে নিলেও ধূলি-ধূসরমাখা দুঃসময়কে পিছনে ফেলে আবার বেঁচে উঠতে চাইছে জয় ও রমলা ।
===============================
গল্প-২
মুক্তি
সমাপন প্রামাণিক
অর্পণের জেদাজেদিতেই সবুজ এই বাড়িতে আসে। লকডাউনে ছেলেটা কেমন যেন চুপটি মেরে গিয়েছিল।ব্যালকনির গ্রীল বাঁ হাতে ধরে উদাস চোখে দূরের দিকে তাকিয়ে থাকত।দু বছর হল ওরা ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিয়ে আছে।ছেলেটাকে এমন চুপচাপ হয়ে যেতে কখনোও দেখেনি।সন্ধ্যা পাশে এসে দাঁড়ায়। ছেলেটা টেরও পায় না।খানিক পর গায়ে হাত দিয়ে স্নেহময় সুরে জিজ্ঞেস করে, "কী দেখছিস এতক্ষণ ধরে? একটু পর অনলাইনে ক্লাস শুরু হয়ে যাবে, চটপট রেডি হয়ে নে।"
অর্পণ এসব কথার ধার না ঘেঁষে বলে,"আমাকে একটা টিয়া পাখি এনে দেবে মা।"
---"কেন, কী করবি?"সন্ধ্যা সামান্য হাসে।ছেলেটার অদ্ভুত অদ্ভুত সব খেয়ালও আসে মাথায়।
কোনো উত্তর না দিয়ে সে চলে যায় পড়ার ঘরে।
আনন্দ সন্ধ্যাকে জিজ্ঞেস করে,"ছেলেটার কী হল বলো তো?দিন দিন গুমোট হয়ে যাচ্ছে। "
---"লকডাউনে বাইরে যেতে পারছে না, একটা স্ট্রেস তো থাকবেই। আজ একটা টিয়া পাখির বায়না ধরেছিল।"
---"টিয়া!কেন?"
---"তা আমি কী জানি? ছেলেকেই জিজ্ঞেস করো।"
আনন্দ উত্তর দেয় না। কেমন যেন গম্ভীর হয়ে যায়।
সেদিনও অর্পণ জানালা দিয়ে দূরের দিকে তাকিয়ে ছিল।পুকুরের ওপারে সার বেঁধে নারকেল গাছগুলো দাঁড়িয়ে। তার ওপর বিকেলের হলদে আভা ছড়িয়ে আছে। সূর্যাস্তের করুণ ছটা নারকেল পাতায় আলতো লেগে আছে।পিছনে ওর বাবা এসে দাঁড়ায়। ডান হাতে খাঁচা, তার মধ্যে ঘন সবুজ রঙের টিয়া;মুখে হাসি।অর্পণ ফিরে তাকাতেই সে বলে, "সারপ্রাইজ। "
অনেকদিন পর ছেলেটা হেসে ওঠে।চোখে মুখে খুশির ঝলক খেলে যায়।প্রায় লাফিয়ে ওঠে।আনন্দ জিজ্ঞেস করে,"কী নাম দিবি নতুন বন্ধুর?"
অর্পণ খুব বেশি ভাবে না,তাৎক্ষণিক ভাবে বলে,"সবুজ। "
সেদিন থেকেই সবুজ ওদের বাড়ির একজন সদস্য হয়ে যায়।
এরপর বেশ কদিন অর্পণ সবুজকে নিয়েই মেতে থাকে।ওর সাথে কথা বলার চেষ্টা করে। ওকে কথা শেখানোর চেষ্টা করে। দু এক বার খাঁচার মধ্যে আঙুল ঢুকিয়ে ওকে আদর করতে গিয়েছে। প্রতিদানে ঠোকর খেয়েছে। অর্পণ খেয়াল করে সে যতটা ওকে পেয়ে উৎসাহী, আনন্দিত ;সবুজ একদমই তার উল্টো। ব্যালকনির কোনে ঝুলন্ত খাঁচার মধ্যে গম্ভীর হয়ে বসে থাকে,মাঝে মাঝেই খাঁচার সরু লোহা ঠোঁট দিয়ে বাঁকাতে চেষ্টা করে।কখনো বা চুপচাপ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।এসব দেখে অর্পণও কেমন নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ে।
আজকাল অর্পণ সবুজকে নিয়ে একদমই মাতামাতি করে না।দু একবার হয়তো ব্যালকনিতে যায়।কিন্তু সবুজের সাথে কথা বলে না।
সন্ধ্যা ছেলেকে ডাকতে ব্যালকনিতে গিয়ে দেখে,ছেলেটা আবার বাঁ হাতে গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে দূরের দিকে তাকিয়ে আছে।পাশেই সবুজের খাঁচা। পাখিটিও কেমন উদাসী চোখে চুপটি করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।বিকেলের নীল আকাশে একদল বক উড়ে যাচ্ছে। পুকুরের ঘন কালো জলে নেমে পাশের বস্তির ছেলেরা হুটোপুটি করছে।সন্ধ্যা কিছু না বলে ফিরে গেল।
কিছুদিন পর মা বাবা অর্পণকে একটা জায়গায় নিয়ে গেল।অনেকটা ডাক্তারের চেম্বারের মতো।সে মাকে জিজ্ঞেস করে,"কার অসুখ করেছে মা?"
মা বোঝানোর সুরে বলে,"কারো অসুখ করে নি বাবা।একজন খুব ভালো আন্টি আছে,সে তোমার সাথে কথা বলবে।"
আন্টি ওর সাথে অনেকক্ষণ কথা বলে।ওর বাবা মার দিকে তাকিয়ে বলে,"মাঝে মাঝে বাইরে নিয়ে যান।ফাঁকা মাঠে অথবা কোনো নদীর ধারে।ওকে একটু নিজের মতো সেখানে ঘুরতে দিন।ওষুধ এখন দেব না।আগামী সপ্তাহে নিয়ে আসবেন।আশা করি, কয়েকটা কাউন্সিলিং-এ ঠিক হয়ে যাবে।"
---"বাবা,আমি সবুজকেও নিয়ে যাব।"
---"ঠিক আছে, নিয়ে চল।তাড়াতাড়ি কর।"
অর্পণ অনেকদিন পর সবুজের সাথে কথা বলে, "আজ আমরা বেড়াতে যাব।খুব মজা হবে।"
বাবার গাড়ি চেপে প্রায় আধ ঘণ্টা পর তারা একটা নদীর ধারে এসে পৌঁছায়।
উদার খোলা আকাশ।নদীর জল অনেকটাই শুকিয়ে গেছে। বিস্তৃত বালির চড়ায় ঘন সবুজ ঘাস।
অর্পণ ডান হাতে সবুজের খাঁচা নিয়ে ছুটে গেল। অনেকদিন পর মনটা কেমন চঞ্চল হয়ে উঠেছে। সন্ধ্যা চেঁচিয়ে বলল,"জলের কাছে একদম যাবে না কিন্তু। "
রেশমের মতো নরম ঘাসে অর্পণ বসে আছে।পাশে রাখা আছে খাঁচা।সবুজও এতো আলো পেয়ে কেমন যেন নেচে উঠেছে।বারবার ঠোঁট দিয়ে খাঁচার সরু লোহা ভাঙতে চেষ্টা করছে।অর্পণ অনেকক্ষণ ধরে সবুজের কাণ্ড কারখানা দেখছিল।তারপর কী মনে হতে,সে খাঁচার দরজা খুলে দিল।আনন্দ ঘটনাটি লক্ষ্য করছিল।সে বকুনির স্বরে কিছু একটা বলার চেষ্টা করে , সন্ধ্যা হাত ধরে বাধা দেয়।
সবুজ খোলা দরজা পেয়ে বেরিয়ে যায়।একচক্কর ওদের মাথার ওপর দিয়ে ঘোরে।অনেকদিন পর পাখিটি ডেকে ওঠে।আনন্দ রসিকতার সুরে বলে,"নাহ্, পাখিওয়ালা ঠকায় নি,সত্যি সত্যি টিয়াই দিয়েছিল।"
সন্ধ্যা কৌতুহলী হয়ে ওর মুখের দিকে তাকায়।আনন্দ আবার বলে,"বাড়িতে থাকতে ওর এই মধুর ডাক শুনিনি তো তাই।"ওরা হেসে ওঠে।
সবুজ কিছুক্ষণ ওড়ার পর অর্পণের হাততিনেক দূরে এসে বসে।সে ওর দিকে তাকিয়ে হাসে।সবুজও অনেকক্ষণ টিপটিপ করে ওর দিকে চেয়ে থাকে।তারপর হঠাৎ উড়ে যায়।
বিকেলের হলদে সূর্যের গা ঘেঁষে সবুজ নদীর ওপারে বিন্দুর মতো মিলিয়ে যেতে থাকে।অর্পণ একমনে সেদিকে তাকিয়ে থাকে।
===============================
গল্প-৩
বন্দি বিহগ
মিতালি রায়
তিনতলার ঘরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গলার টাইটা ঠিক করে নিতে নিতে ঘড়ির দিকে তাকাল রুমি , দশটা বাজতে আর মিনিট দশেক বাকি আছে । স্কুলের ইউনিফর্ম পরে সে তৈরি । দরজার বাইরে একবার উঁকি মেরে দেখল ,
না! মা এখনো আসেনি।
আজ চুমকি মাসি কাজে আসেনি। ওর নাকি জ্বর এসেছে , সকালবেলাতেই মোবাইলে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে চুমকি মাসির মেয়ে।
ঘণ্টা দেড়েক আগে স্নান খাওয়ার জন্যে নিচের তলায় নেমে মা আর ঠাম্মাকে বেশ চিন্তিত দেখেছে রুমি । শান্তিদেবীর গলায় রীতি মতন উদ্বেগ । চেয়ারে বসে আলুর খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে তিনি পুত্রবধূ মন্দিরাকে বলছিলেন –
“চুমকিটার আবার কি যে হল ! করোনায় ধরল নাকি ! কে জানে !”
মন্দিরা নুনহ্লুদ মাখানো মাছের পিসগুলো কড়াইয়ের গরম তেলে ছাড়তে ছাড়তে চিন্তিত মুখে বলল –
“তাহলে তো আমাদেরও ভয়। পাঁচ বাড়ি কাজ করে বেড়ায় ......”
জানলার ধারে টেবিলটায় গিয়ে বসল রুমি। আজ শুরুতেই হিস্ট্রি ক্লাস । ইতিহাসের বইটা টানতে গিয়ে জানলার বাইরে চোখ গেল রুমির । রোদ্দুর ঝলমল করছে। উল্টোদিকে অদ্রিজা কাকিমাদের বাড়ির ইটের দেওয়ালের ফাঁক থেকে গজিয়ে ওঠা নাম না জানা গাছটা সকালের ফুরফুরে হাওয়ায় কেমন মাথা দোলাচ্ছে দেখ।
রুমির মনটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল, ইসস, কত দিন হয়ে গেল স্কুলে যাওয়া হচ্ছে না।এমন রোদ ঝলমলে সকালে স্কুলে যাওয়ার আনন্দটাই যে আলাদা । স্কুলের ক্লাস, বন্ধুদের খুব মিস করে রুমি । কতদিন ক্যামেলিয়ার সঙ্গে সামনাসামনি দেখা হয় না। হোয়াটসয়্যাপের ভিডিও কলে কি ভালো করে কথা বলা যায় ? বাবা মা পাশে থাকলে মনের সব কথাও তো বলা হয় না । স্কুলের মাঠে কত রকমের খেলা হত বন্ধুদের সঙ্গে । রুমির মনে পড়ল ক্লাস টু-তে পড়ার সময় একদিন টিফিন ব্রেকে খেলতে খেলতে খুব দৌড়চ্ছিল ও । প্রায় দশ-বার জন মিলে খেলছিল ওরা । হঠাৎ সুগন্ধার সঙ্গে জোরে ধাক্কা লাগায় দুজনেই দুপাশে ছিটকে পড়ে গিয়েছিল । সুগন্ধার খুব একটা না লাগলেও মাঠের ঘেরা পাঁচিলে মাথা ঠুকে রুমির কপালের বাঁ পাশটা কেটে রক্ত বেরিয়ে গিয়েছিল । রক্ত দেখে ও চিৎকার করে কেঁদে উঠেছিল। অন্য বন্ধুরাও যখন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে তখন কোথা থেকে সদ্য শিক্ষিকা হয়ে আসা সুদীপ্তা ম্যাম দৌড়ে এসে রুমি আর সুগন্ধাকে নিয়ে গিয়েছিলেন স্কুলের ফার্স্টএড রুমে। সুদীপ্তা ম্যামের সঙ্গে রুমির তেমন পরিচয় ছিল না। রুমি তাই চুপ করে গিয়েছিল বকুনি খাওয়ার ভয়ে । কিন্তু , না ,সুদীপ্তা ম্যাম ওদের দুজনের কাউকে না বকে বরং খুব যত্নের সঙ্গে রুমির কাটা জায়গাটা পরিষ্কার করে ওষুধ দিয়ে ব্যান্ডেড লাগিয়ে দিয়েছিলেন । আর সুগন্ধাকেও মুখ চোখ ধুইয়ে দিয়েছিলেন সযত্নে । তারপর দুজনকে একগ্লাস করে জল পান করতে দিয়ে নরম আদর মাখানো গলায় বলেছিলেন –
“ খেলতে গেলে এরকম একটু আধটু ঘটনা ঘটতেই পারে। তোমরা কিন্তু খুব সাহসী, একদম ভয় পাবে না । তবে চোখ কান খোলা রেখে খেলবে । “
ততক্ষণে ঘণ্টা পড়ে গেছে। টিফিনের পরের ক্লাস শুরু হবে । সুদীপ্তা ম্যাম ওদের দুজনকে ক্লাস অবধি পৌঁছে দিয়েছিলেন । তারপর থেকেই সুদীপ্তা ম্যাম দেখা হলেই হেসে কথা বলেন , মাঝে মাঝে আদর করে গাল টিপে দেন আলতো করে । খুব হাসিখুশি ম্যাম কয়েকদিনের মধ্যেই ওদের প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন । এই ক্লাস ফাইভ থেকেই সুদীপ্তা ম্যামের ক্লাস পাওয়ার কথা ছিল রুমিদের , কিন্তু সে আর হল কোথায় !
********
উত্তর কলকাতার একটি কনভেন্ট স্কুলে পড়ে রুমি। এবারে সে ক্লাস ফাইভে উঠেছে । এবছর থেকে তার ভোরবেলায় ঘুম না ভাঙা চোখ রগড়াতে রগড়াতে স্কুলে যাওয়ার পাঠ চুকেছিল । খুব আনন্দে ছিল নতুন সময়ে স্কুলে যাওয়ার উত্তেজনায় । নতুন ক্লাসরুম, বন্ধুদের সঙ্গে কত নতুন গল্প – কিছুই তো হল না । মাঝে মাঝে এই একরকম বন্দি জীবনের একঘেয়েমিতে রুমির দুচোখ ভরে জল আসে ,মনটা ভারি হয়ে ওঠে । মাকে সামনে পেলে সব ক্ষোভ উগড়ে দেয় মায়ের ওপর । মা প্রথমে বোঝানোর চেষ্টা করলেও রুমি বেয়ারা বায়নায় মেতে থাকে । শেষে বিরক্ত হয়ে মন্দিরা ধমক দিয়ে উঠে যায় ঘরের কাজে । উপায়ান্তর না পেয়ে যখন ও হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসে, তখন শান্তি দেবী রুমিকে আদর করে কাছে টেনে বসান , চোখের জল মুছিয়ে বোঝাতে থাকেন ।
“ দিদিভাই, তুমি তো এখন একটু বড় হয়েছ । হয়েছ কিনা বলো ।“
কেউ তাকে বড় হয়েছ বললে রুমি খুব খুশি হয় । সত্যি তো, সে ক্লাস ফাইভে উঠেছে , সে তো বড় হয়েইছে । জলে ভেজা দুটো বড় বড় চোখে ঠাম্মার দিকে তাকিয়ে ইতিবাচক মাথা নাড়তে থাকে সে।
“এই করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে বলেই তো আমরা সবাই ঘরে আটকে রয়েছি, তাই না ?”
“ দিদিভাই, তুমি তো জান, সারা পৃথিবীতে কত মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়েছে এই করোনার জন্যে, কত মানুষ মারা গেছে । তাই তো আমরা এত নিয়ম মেনে চলতে বাধ্য হচ্ছি রে মা। আমরা সবাই যদি একটু নিয়ম মেনে চলি , তাহলে দেখবি আবার আমরা আগের মত বেড়াতে যেতে পারব ,তুই স্কুলে যেতে পারবি , ক্যামেলিয়া, আদৃতি , মৌপিয়ার সঙ্গে তুই খেলতে পারবি। “
শান্তিদেবীর নরম আদরে ধীরে ধীরে শান্ত হয় রুমি। রুমির মুখের দিকে তাকিয়ে শান্তি দেবীর বুকটা কেমন যেন হু হু করে ওঠে। তাঁর মনে হয় সত্যি তো এই ফুরফুরে সুন্দর ছোট্ট শিশুগুলো যে কি শাস্তি ভোগ করছে দিনের পর দিন, ঠিক যেন খাঁচায় বন্দি পাখি ।
রুমিকে চুপ করে যেতে দেখে তিনি বলেন –
“ দিদিভাই, অনেকদিন তোমার নাচ দেখিনি, কাল যে আমাকে বলছিলে মায়ের কাছ থেকে নতুন কি একটা নাচ তুলেছ , আমাকে একটিবার দেখাবে না?”
হঠাৎ রুমির দু চোখে আনন্দ নেচে উঠল ।
“হ্যাঁ ,তুলেছি তো , ঠাম্মা, তুমি দেখবে এখন! দাঁড়াও , শাড়িটা পরে আমি রেডি হয়ে আসছি ।“
বলে লাফিয়ে উঠে পাশের ঘরে মায়ের কাছে চলে গেল শাড়ি পরতে ।
শান্তিদেবী তাকিয়ে রইলেন সে দিকে। তাঁর চোখ দুটিও ঈষৎ ছলছল করে উঠল। মনে মনে বললেন –বড্ড ছোট ওরা ।
*********
সামনের টেবিলে ল্যাপটপের স্ক্রিনে বেদিকা ম্যাম কিছু বলছিলেন । রুমি শুনছিল মন দিয়ে। টেবিলের পাশে একটা চেয়ারে ডায়েরি আর কলম নিয়ে বসে নোট করে নিচ্ছিল মন্দিরা । আগে মেয়েকে স্কুলে পাঠিয়ে মন্দিরা টুকটাক নিজের কাজ সেরে নিত । এখন আর সে সময় পায় না । গত দেড় বছর ধরে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে স্কুল একেবারেই বন্ধ এবং তার ফলে ছেলেমেয়েরা অনলাইনের নতুন পদ্ধতিতেই পড়াশোনায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। প্রথম প্রথম মোবাইলের ছোট্ট স্ক্রিনে চোখ রেখে ক্লাস করতে করতে রুমির চোখের নানা সমস্যা দেখা দিতে লাগল । তারপর মাথার যন্ত্রণা এমন পর্যায়ে পৌঁছল যে প্রায় বাধ্য হয়েই অরুণাভকে একটা ল্যাপটপ কিনতে হয়েছে । বেশ কিছু টাকাও ব্যঙ্ক থেকে ধার করতে হয়েছে এর জন্য অরুণাভকে ।
এদিকে অরুণাভদের অফিসেও যে পরিমাণে ছাঁটাই চলছে ,তাতে কখন যে কি খবর আসে সে নিয়েও বাড়ির সকলে বেশ চিন্তিত।
মন্দিরা একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল । হঠাৎ দেখল রুমি ল্যাপটপ আনমিউট করে বলে উঠল
“ ম্যাম , আই ওয়ান্ট টু সে সামথিং ।“
“ লেট মি কমপ্লিট দ্য চ্যাপ্টার ফার্স্ট। “ – রূঢ় ভাবে বলে উঠলেন মিস বেদিকা ।
রুমি কিছু বলার আগেই মন্দিরা ঝাঁপিয়ে পরে মিউট সাইনে ক্লিক করল । রুমির দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাল ল্যাপটপের পিছন থেকে।
ওদিকে মিস বেদিকা পড়িয়ে যাচ্ছেন । রূঢ় স্বভাবের জন্য মিস বেদিকার বেশ বদনাম আছে ছাত্রী এবং অভিভাবক মহলে ।
ক্লাস শেষ হতেই মন্দিরা জানতে চাইল রুমির কাছে, ম্যামের পড়ার মাঝে সে কি বলতে চাইছিল ?
রুমি ঠোঁট ফুলিয়ে জানাল-
“দেখ না, তৃণা আমাকে ভেংচি কাটছিল”
“অ্যাঁ “ – মন্দিরা অবাক হয়ে কি বলবে ভেবে না পেয়ে হেসে ফেলল । মুখে বলল –
“তোরা স্কুলে কি করিস রে ।“
**********
মৃদু আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে গেল মন্দিরার । কোথায় যেন বিড়ালছানা ডাকছে ! ঘুমের ঘোরটা একটু কাটতেই ও বুঝতে পারল,
না! বিড়ালছানা নয় । কেউ যেন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে ।
বালিশ ছেড়ে বিছানার ওপর ধড়মড় করে উঠে বসতেই বুঝতে পারল কান্নার আওয়াজটা আসছে পাশের ঘর থেকে ।ওঘরে তো শান্তি দেবী আর রুমি ঘুমোচ্ছে।একটু বড় হতেই রুমি ওর ঠাম্মার কাছে ঘুমোয়। মন্দিরা অবাক হল । এত রাত্রে কে কাঁদছে ! তার শ্বশুর মশাই মারা গেছেন আজ বছর দুই হল । তাহলে কি রুমির ঠাম্মা এত রাতে …
মন্দিরা বিছানা ছেড়ে নামল । খাটের আর একদিকে অকাতরে ঘুমিয়ে আছে অরুণাভ । শান্তিদেবীর ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল মন্দিরা । ভেতরে নাইট ল্যাম্পের আলোয় মন্দিরা দেখল শান্তিদেবী ঘুমিয়ে আছেন পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে ।
তাহলে !
খাটের ভেতরের দিকে রুমি শুয়ে আছে। ওর দিকে খেয়াল করতেই মন্দিরা চমকে উঠল । ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজটা আসছে ওর কাছ থেকেই । দশ বছরের ছোট্ট শরীরটা ফুলে ফুলে উঠছে থেকে থেকে । দ্রুত ঘরে ঢুকে খাটের মাথার কাছে এসে রুমির মাথায় হাত রাখল মন্দিরা । শান্তিদেবীর যাতে ঘুম না ভাঙে তাই নিচু গলায় প্রশ্ন করল –
“কি হয়েছে রে রুমি ,এভাবে কাঁদছিস কেন ?”
খুব ছোট্ট বেলায়, রুমির যখন তিন কি চার বছর বয়স তখন মাঝে মাঝে ও রাতে ঘুমোতে ঘুমোতে জেগে উঠে কাঁদতে বসত । কি না, ওর খুব খিদে পেয়ে গেছে । মন্দিরা তখন ঘুম চোখে উঠে দুধ গরম করে দিত ।দুধ খেয়ে তবে মেয়ে ঘুমোত ।
কিন্তু এতদিন পরে রাত প্রায় ভোর হতে চলা সময়ে কি এমন ঘটনা ঘটল যা এভাবে কাঁদাচ্ছে মেয়েটাকে ।
মায়ের হাতের স্পর্শ পেয়ে রুমি বিছানা ছেড়ে মন্দিরার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে জোরে শব্দ করে কেঁদে উঠল । রুমির ঠাকুমার দিকে একবার তাকিয়ে মন্দিরা মেয়েকে টেনে নিয়ে বাইরে এসে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসলেন ।
“এত কাঁদছিস কেন ? কি হয়েছে ?
মন্দিরা দু'হাতে মেয়ের মুখটা তুলে দেখলেন জল ভর্তি লাল দুটো চোখে একরাশ অভিমান ভিড় করে আছে ।
“কাল রিমলির বার্থডে-তে আমি থাকতে পারলাম না , ওরা সবাই কত আনন্দ করেছে মা ।“
হতভম্ভ মন্দিরার কাছে এবার সব স্পষ্ট হল । রিমলি ওর ছোট পিসির মেয়ে ।এবারে পাঁচ বছর পূর্ণ করল সে । সকলের ভীষণ আদরের রিমলির জন্মদিন প্রতি বছরই খুব ধুমধাম করে পালিত হয় । এবছর আরো বড় আয়োজনের ব্যবস্থা করবে ভেবেছিল ওর বাবা-মা । কিন্তু এই অতিমারীর কারণে সে আয়োজন সম্ভব হয় নি । তাই রিমলির কেক কাটার মুহূর্তে সবাই অনলাইনেই তার জন্মদিন সেলিব্রেট করবে এমনটাই ঠিক হয়েছিল । ঠিক হয়েছিল সবাই কিছু না কিছু পারফর্ম করে দারুণ মজা করবে । তাই বেশ কিছুদিন ধরেই ওরা কে কি করবে ঠিক করছিল । রুমি খুব মন দিয়ে একটি নাচ তুলেছিল । উৎসাহে –উত্তেজনায় তার রাতের ঘুম চলে গিয়েছিল ।রিমলি তার বড় আদরের । কিন্তু অনুষ্ঠান সবে শুরু হয়েছে আর তখনই হঠাৎ লোডশেডিং । সকলেরই মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল । অপেক্ষায় ছিল হয়ত কিছুক্ষণের মধ্যে এসে যাবে কারেন্ট । ওপাশ থেকে ছোট পিসি –পিসেমশাইও ফোন করেছে বার বার । কিন্তু সব অপেক্ষায় জল ঢেলে কারেন্ট এসেছে রাত দশটার পরে । রুমি বেশ চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল । খাবার টেবিলে বসেও কারো সঙ্গে খুব একটা কথা বলেনি সদা বকবক করতে থাকা মেয়েটি ।
রুমিকে কি বলে সান্ত্বনা দেবে ভেবে পাচ্ছিল না মন্দিরা । মেয়েকে বুকে জড়িয়ে সে ভাবতে লাগল –
আর কতদিন চলবে এই যন্ত্রণা । এই একরত্তি মেয়েটা সব রকমের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়ে দিনের পর দিন কাটাচ্ছে বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে । মানুষের পাপের ফল ভোগ করছে এই ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলো । যে বয়সে প্রজাপতির মত খেলে আনন্দ করে কাটানোর কথা ,তারা এই একটা ভাইরাসের কারণে বাধ্য হচ্ছে বন্দি জীবন কাটাতে । না জানি জীবনের এই অধ্যায় কি প্রভাব ফেলবে ওদের ওপর ।
রুমির কান্নার আওয়াজে শান্তিদেবীর ঘুম ভেঙে গিয়েছিল । তিনি এসে দাঁড়িয়েছিলেন ওদের পিছনে । তিনি এগিয়ে এসে মন্দিরার কাঁধে হাত রাখলেন । মন্দিরা মাথা তুলে তাকাতে গিয়ে দেখল জানলার বাইরের অন্ধকারে আলোর আভাস ।
===============================
গল্প-৪
রবীন্দ্রজয়ন্তী ও একটা বই
সুদীপ পাঠক
আজ পঁচিশে
বৈশাখ । সকাল থেকেই আকাশ এবং পুকুলি বুড়ি দু'জনেরই মুখভার । গতকাল মধ্যরাত থেকে শুরু হয়েছে প্রবল বর্ষণ
আর সেইসঙ্গে গুড়ুম গুড়ুম মেঘের গর্জন ও চোখ ধাঁধানো বিদ্যুতের চমক । সেই থেকে
বিরামহীন বৃষ্টি পড়ে চলেছে । কখনো ঝিরঝির করে কখনো মুষলধারায় । রাগ দুঃখ হতাশা
সব যেন একসঙ্গে চেপে বসেছে পুকুলির মাথায় । অবশ্য তার সঙ্গত কারণ আছে । এই নিয়ে
পরপর দু'বছর
তাদের নাচের স্কুলের রবীন্দ্রজয়ন্তী স্থগিত রাখতে হলো । অতিমারী সেই যে থাবা
বসিয়েছে গোটা পৃথিবীর উপর ;
সেই থেকে দানবটা যেন আর নড়বার নামই করে না । আশা করা হয়েছিলো বছর ঘুরলে
পরিস্থিতির উন্নতি হবে । কিন্তু ফল হলো উল্টো । এখন লক ডাউনের নিষেধাজ্ঞা বা
কড়াকড়ি কমেছে বটে ,
তবে মারণ ব্যাধির প্রকোপ কমে তো নি ,
উল্টে বৃদ্ধি পেয়েছে । বিষাক্ত ছোবলের ভয়ে সবাই আতঙ্কে ঘরবন্দী । দ্বিতীয়
তৃতীয় ঢেউয়ের পর ঢেউ আছড়ে পড়ছে ।
সুমেরু ও চিত্রা দু'জনেই আই টি প্রফেশনাল । কর্মসূত্রে পরিচয় , সেই থেকে আলাপ প্রলাপ বিলাপ ; পরিশেষে শুভ পরিণয় । উভয়েই তাদের একমাত্র শিশুকন্যা সুমিত্রার মনবেদনার কথা ভালোই উপলব্ধি করতে পারে । বয়েস আট বছর হলে কি হয় সে নৃত্য অন্ত প্রাণ । সবে যখন টলোমলো পায়ে হাঁটতে শিখেছে তখন থেকেই কানে মিউজিক গেলে তালে তালে দুলতে থাকতো । তিন বছরে পা দিতে না দিয়েই তাকে ভর্তি করা হলো নাচের স্কুলে । অল্প সময়ের মধ্যেই দিদিমণির নজর কেড়ে নিতে সক্ষম হয় সেই পুঁচকে মেয়ে । পাঁচ বছরে প্রথম মঞ্চে অবতীর্ণ হওয়া দলগত ভাবে । পরের বছর একক নৃত্যে ক্লাস ওয়ানের সুমিত্রা বসু সকলকে অবাক করে দিলো তার অসাধারণ পারফরমেন্স দিয়ে । সবাই তাজ্জব বনে গেছে । জনে জনে এসে তার মা বাবাকে বলে গেলো "তোমাদের মেয়ে বড় হয়ে নির্ঘাৎ ফিল্মস্টার হবে দেখো" । বলা বাহুল্য সুমেরু ও চিত্রা এসব কথায় বিশেষ পাত্তা দেয় নি । বড় হয়ে কে কি হবে সে প্রশ্নের উত্তর ভবিষ্যতের গর্ভেই নিহিত আছে থাক । আসল কথা হলো মনের আনন্দ , মনের প্রফুল্লতা লাভ করা । চিন্তার ঔদার্য ও শিল্পবোধ তৈরী হওয়া । অন্তরস্থল বিকশিত হওয়া । অত্যন্ত গাদ্যিক নীরস কাজে ও জগতে যুক্ত থেকেও সেই বিরল গুণগুলি আজও বজায় রাখতে পেরেছে বোস দম্পতি । শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চাই বোধহয় ছিলো তাদের মেল বন্ধনের সেতু । একত্রে লিটিল ম্যাগাজিন করা , স্ট্রীট থিয়েটার কর্মী হওয়া , ভাঁড়ারে জমা পড়েছে অনেক রসদ ।
তবে সবই থমকে গেছে এখন । এক বছরের বেশি সময় ওয়ার্ক ফ্রম হোম করে তারা যেমন ক্লান্ত , অন লাইন ক্লাস করে পুকুলিরও সেই একই হাল । চিড়িয়াখানার পশুর মনে খুশি বা আনন্দ বলে কিছু থাকে কি ? যতই তাকে প্রতিদিন রাজভোগ দেওয়া হোক না কেন ! বড়দের মতো পুকুলি এখন ভার্চুয়াল জগত ও সোশ্যাল মিডিয়া সম্পর্কে যথেষ্ঠ ওয়াকিবহাল । সব কিছু তার নখদর্পণে । ফেসবুকে তার নিজের এ্যাকাউন্ট না থাকলেও অধিকাংশ সময় মায়ের মোবাইল ফোন থাকে তার হাতে । ফল স্বরূপ যা হওয়ার তাই হয় । লাইক কমেন্ট শেয়ার সবেতেই সে পটু । সেল্ফি তুলে পোষ্ট দেওয়া তো 'বাঁয়ে হাত কা খেল্' । সুমেরু ভাবলো সবই যখন হাতের মুঠোয় রয়েছে তখন এ্যাডভান্টেজ না নেওয়াটা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না । বুকশেল্ফ থেকে খুঁজে পেতে বের করে আনলো একটা বই । সযত্নে ধুলো ঝেড়ে পাতা উল্টে দেখলো আবছা হয়ে যাওয়া ফাউন্টেন পেনের নীল কালিতে লেখা রয়েছে :
সমুর দশ
বছরের জন্মদিনে সানন্দ উপহার ।
আশীর্বাদক
বাবা ।
তারিখ :
১৬/০৫/১৯৮৪ ।
অর্থাৎ
সাইত্রিশ বছর আগের কথা ।
পৃষ্ঠা গুলো
সব লালচে ও মুড়মুড়ে হয়ে গেছে কিন্তু এই বই কে ঘিরে স্মৃতি রয়ে গেছে অমলিন ।
সুমিত্রাকে কাছে ডেকে বলল
-
এই দেখ বুড়ি কি অমূল্য সম্পদ উদ্ধার করেছি ।
পুকুলি সঙ্গে
সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ল ।
-
কৈ কৈ দেখি !
-
পড় কি লেখা আছে ?
-
হাস্যকৌতুক , রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর । এটা কিসের বই গো বাবা ?
-
ইউরোপীয় শারাড্ । বাংলায় বললে হেঁয়ালি নাট্য । - মানে কি ?
-
খেলার ছলে মুখে মুখে বানানো ছোট্ট ছোট্ট নাটক । দুই তিন কি চার জনে মিলে
অভিনয় করবে এমন । যে কোনো একটা শব্দ বেছে নিতে হবে প্রথমে । ধরা যাক 'পাগল' । নাটকের
মধ্যে সংলাপে মাঝে মাঝেই সেটা ঘুরে ফিরে আসবে । কখনো পুরোটা আবার কখনো ভাঙ্গা
ভাঙ্গা । যেমন 'পা' অথবা 'গোল' । বাকী যারা
দেখবে ও শুনবে শেষ হলে তাদের বলতে হবে লুকোনো শব্দটা কি ? না বলতে
পারলে যারা অ্যাক্টিং করলো তাদের হার । কেমন আইডিয়া বলতো ?
-
দারুন , ফ্যান্টাস্টিক
!
-
হুম্ প্রায় সোয়াশ বছর আগে লেখা ,
বুঝলি ?
-
হোয়াট ইজ 'সোয়াশ' ?
-
একশ পঁচিশ , হান্ড্রেড
টোয়েন্টি ফাইভ । তবে এটা একশ চৌদ্দ বছর আগের ।
-
গট ইট । তার মানে নাইন্টিন জিরো ফাইভ ,
তাই তো ।
-
ভেরি গুড । সেই বছরই কুচক্রী লর্ড কার্জনের বাংলা ভাগ করার অপচেষ্টা রুখে
দিয়েছিলেন এই স্থিতপ্রজ্ঞ মানুষটি ।
-
উফ্ কি শক্ত শক্ত বাংলা বলছো তুমি !
-
হা হা হা তা বটে ,
তোর পক্ষে গুরুপাক হয়ে যাচ্ছে । তবে এ্যাপ্রক্সিমেটলি মিনিং টা বুঝেছিস নিশ্চই
?
-
কিছু কিছু অল্প অল্প । তুমি সহজ করে বলো ।
-
আচ্ছা বেশ তাই বলছি শোন । এই যে তোরা টিভিতে এতো কমেডি শো , লাফটার শো
এসব গবগব করে গিলিস ;
এই বই হলো সে সবের বাবার বাবার বাবার বাবা , বুঝলি ?
-
ও ব্বাবা ! তাই নাকি ?
-
হুম্ এই জানবি , এতো
কোনো অভভ্যতা নেই , কাতুকুতু
দিয়ে জোর করে হাসাবার চেষ্টা নেই ,
ভাঁড়ামো করা নেই । আছে শুধু বুদ্ধির খেলা । এ হলো বিশুদ্ধ ও নির্মল হাস্যরস ।
-
সেতো বুঝলাম , এবার
বলো তুমি হঠাৎ এটা বের করলে কেনো ?
সুমেরু উদাস মেদুর কণ্ঠে বলে
-
ছেলেবেলায় আমাদের দেশের বাড়ী করঞ্জলিতে প্রতি বছর আমরা রবীন্দ্রজয়ন্তী
উপলক্ষে দারুন উৎসবের আয়োজন করতাম । বসতবাড়ীর বাইরে যে দরদালান সেখানে হতো কবি
প্রণাম অনুষ্ঠান । আমরা খুড়তুতো জ্যাঠতুতো ভাই বোনেরা মিলে নাচ গান আবৃত্তি নাটক
সব কিছু করতাম । ওহ্ সে এক দুর্দান্ত ব্যাপার । হৈ হৈ রৈ রৈ কান্ড ! শুধু আমাদের
গ্রাম নয় আসে পাশের গ্রাম থেকেও লোকজন ভিড় করে দেখতে আসতো বুঝলি ?
-
করঞ্জলি কোথায় বাবা ?
-
সাউথ টোয়েন্টি ফোর পর্গনাস । তুই যখন খুব ছোট ছিলিস , এই এতটুকু
পুঁটলির মতো , তখন
তোর মায়ের কোলে শুয়ে শুয়ে গিয়েছিলিস একবার । তোর মনে নেই , থাকার কথাও
নয় । সব ঝড়ঝঞ্ঝা কেটে যাক আবার যাবো তোদের নিয়ে ।
-
সেখানে এখন কারা থাকে ?
-
যারা ছিলো বরাবর তারাই আছে । আমার দাদা ভাই তাদের বৌ ছেলেমেয়ে সবাই । তাদের
নিয়েই তো হবে আমাদের আজকের ভার্চুয়াল রবীন্দ্রজয়ন্তী !
-
রিয়েলি ? ওয়াও
গ্রেট !
-
এই দেখ বইতে মোট পনেরটা শটস্কিট আছে । টানা বছর সাতেক প্রোগ্রাম করেছিলাম আমরা
।
-
তারপর ?
-
তারপর আর কি এইচ এস পাশ করে করঞ্জলির পাট চুকিয়ে দিয়ে আমি কলকাতায় চলে এলাম । মানে আমি একা নয় , আমাদের
ফ্যামেলী । ব্যাস সব বন্ধ হয়ে গেলো ।
-
তুমি এই বই কোথায় পেলে বাবা ?
-
উপহার , কে
দিয়েছিলো আন্দাজ কর তো ?
-
নো আইডিয়া , তুমি
বলো !
-
তোর ঠাকুরদা মহাশয় ,
অর্থাৎ আমার পিতৃদেব স্বয়ং ।
পুকুলিকে
অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে সুমেরু আবার বলে
-
কিরে , ঘেবড়ে
গেলি মনে হচ্ছে ? ওরে
তোর দাদু মানে আমার বাবা । যিনি আমার আর তোর মায়ের নাম জুড়ে দিয়ে তোর নামকরণ
করেছিলেন । আর তোকে প্রথমবার দেখেই বলেছিলেন "ওয়ান ডে শী উইল বার্ন দ্য ফেস
ওফ্ আওয়ার কান্ট্রি ।"
-
মানে ?
-
মানে একদিন এই মেয়ে দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে । হা হা হা ...
পুকুলিও
অনুমান করতে পারে যে তার বাবা ইচ্ছে করেই বিদঘুটে ইংরেজি বলে রসিকতা করছে । তাই
সেও মুখে হাত চাপা দিয়ে খিক খিক করে হাসে ।
চিত্রা এতক্ষন গৃহস্থালির কাজ সারছিল আর মধ্যে মধ্যে উঁকি ঝুঁকি দিয়ে দেখছিল কি চলছে ! বাপ-বেটির আলোচনা সবটাই তার কানে গেছে । এবার সে কাছে এগিয়ে এসে বলল
-
এই যে খুব তো ফিল্মি ডায়লগ আওড়ানো হচ্ছে , তা তোমার মতলবটা কি খুলে বলতো ? দু'জনের কি
ষড়যন্ত্র হচ্ছে শুনি ?
-
যা হচ্ছে তাতে তোমারও পূর্ন সহযোগিতা বিশেষ প্রয়োজন হে দেবী । তুমি বিনা যে
কিছুই সম্ভব নয় । এই পরিকল্পনার স্বার্থক রূপদান করতে আমরা পিতাপুত্রী তোমার
শরণাপন্ন হলাম ।
-
তুমি কি পাগল হলে ?
বুড়ো বয়সে লোক হাসাবে নাকি ?
-
এক্সাক্টলি , রাইট
ইউ আর । রবিঠাকুর তো ঠিক এটাই চেয়েছেন । শোনো দাড়ি বুড়ো কি লিখেছেন ; এই বলে সে বই
হাতে তুলে নিয়ে পড়তে থাকে :
" 'আমোদ-প্রমোদ করো' এ কথা যে বলিতে হয় এই আশ্চর্য ! কিন্তু আমাদের দেশে একথাও বলা আবশ্যক । আমরা হৃদয় মনের সহিত আমোদ করিতে জানি না । আমাদের আমোদের মধ্যে প্রফুল্লতা নাই , উল্লাস নাই , উচ্ছ্বাস নাই । তাস পাশা দাবা পরনিন্দা ইহাতে হৃদয়ের শরীরের স্বাস্থ্য সম্পাদন করে না । এ সকল নিতান্তই বুড়োমি , কুনোমি , কুঁড়েমি । দায়ে পড়িয়া , কাজে পড়িয়া , ভাবনায় পড়িয়া সময়ের প্রভাবে আমরা তো সহজেই বুড়ো হইয়া পড়িতেছি , এজন্য কাহাকেও অধিক আয়োজন করিতে হয় না । ইহার উপরেও যদি খেলার সময় , আমোদের সময় , আমরা ইচ্ছা করিয়া বুড়োমির চর্চা করি , তবে যৌবনকে গলা টিপিয়া বধ করা হয় । যতদিন যৌবন থাকে ততোদিন উৎসাহ থাকে । প্রতি মুহূর্তে হৃদয় বাড়িতে থাকে , নতুন নতুন ভাব নতুন নতুন জ্ঞান সহজে গ্রহণ করিতে পারি --- নতুন কাজ করিতে অনিচ্ছা বোধ হয় না ।"
"বিশুদ্ধ আমোদ-প্রমোদ মাত্রকেই আমরা ছেলেমানুষি জ্ঞান করি --- বিজ্ঞলোকের , কাজের লোকের পক্ষে সেগুলো নিতান্ত অযোগ্য বলিয়া বোধ হয় । কিন্তু ইহা আমরা বুঝি না যে যাহারা বাস্তবিক কাজ করিতে জানে তাহারাই আমোদ করিতে জানে । যাহারা কাজ করে না তাহারা আমোদও করে না ।"
পড়া শেষ করে সুমেরু মিটমিট করে চিত্রার দিকে তাকিয়ে থাকে । এর একটাই অর্থ : এবার কি বলবে বলো ? চিত্রা কপট রাগ দেখিয়ে বলে
-
যা ইচ্ছে হয় তাই করো । তুমি আগাগোড়া পরিকল্পনা বিহীন একটা লোক । উঠলো বাই তো
কটক যাই । এই জন্য বসের কাছে নিয়মিত কথা শুনতে হয় ।
-
সত্য বচন ম্যাডাম । সেটা অফিসে এবং বাড়ীতে উভয়ত ।
এরপর আর কথা
বাড়ানো চলে না । রাগের ভাবটা ধরে রাখতে গিয়েও লাভ হয় না । ফিক করে হেসে ফেলে
চিত্রা বলে
-
আগে থেকে বলতে কি হয় বুঝিনা ! উঠলো বাই তো কটক যাই । বাপ বেটি মিলে ড্রইং
রুমটার কি হাল করে রেখেছে ! সমস্ত অগোছালো ,
কত কাজ যে এখন বাকি ! উফ্ আর পারি না বাপু ।
তবে মুখে যাই বলুক না কেন চিত্রা মনে মনে দারুন খুশি হয়েছে সেটা বলাই বাহুল্য । এই বোরডামের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার এর চাইতে ভালো আর কোনো উপায় হতেই পারে না । তা সে যত অল্প সময়ের জন্যই হোক না কেনো । এবার সুমেরু পরপর কয়েকটা কাজ সেরে ফেললো ।
এক নম্বর :
করঞ্জলিতে গণ্ডা কতক ফোন করে সবাইকে কনফিডেন্সে নেওয়া ।
দুই নম্বর :
নির্বাচিত হেঁয়ালিনাট্য গুলির মোবাইলে ছবি তুলে হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপে পাঠিয়ে
দেওয়া ।
তিন নম্বর :
নিজের ও চিত্রার প্রোফাইল থেকে এফ বি পোষ্ট দেওয়া । সে লিখলো : বন্ধু আজ ঠিক
সন্ধ্যা ছয়টায় আমরা লাইভে আসছি । আমরা অর্থাৎ বসু পরিবার , কসবা ও
করঞ্জলি সম্মিলিত । উপলক্ষ্য কবি প্রণাম । আমাদের একান্ত নিজস্ব ঘরোয়া উদ্যোগ ।
সকল শুভানুধ্যায়ী ও রবীন্দ্র অনুরাগীকে পাশে পেতে চাই , ধন্যবাদ
।
ব্যাস আপাতত
এই পর্যন্ত । এরপর চেঁচেছুলে মনুষ্য পদবাচ্য হয়ে উঠতে হবে । দিন তিন/চারেকের না
কমানো দাড়ি নিয়ে লাইভে আসতে চাইলে চিত্রা আর রক্ষে রাখবে না । চটপট স্নান খাওয়া
সেরে নিজের স্ক্রীপ্ট গুলো ঝালিয়ে নিতে হবে । শুধু চিত্রা ও সুমিত্রা নয় সুমেরুর
মা সত্তর ঊর্দ্ধা অর্চনাদেবী নিজে থেকেই সামিল হয়েছেন এই আনন্দযজ্ঞে । তিনিই
পৌরহিত্য করবেন বলে স্থির হয়েছে ।
দুই :
তিন ঘন্টার লাইভ হলো । এমন অভূতপূর্ব সাড়া পাওয়া যাবে তা কল্পনার অতীত ! এতো ভিউজ , লাইক , কমেন্ট এর আগে কখনো হয়নি । সবাই এ্যাঙ্করের প্রশংসায় পঞ্চমুখ । সাবলীল ভাবে কথা বলে গেলেন বৃদ্ধা । সেই সঙ্গে মাঝে মাঝেই দু'এক ছত্র কবিতা যুক্ত হওয়ায় আলাদা মাত্রা যোগ হয়েছে । খালি গলায় শুধু তানপুরা হাতে নিয়ে চিত্রা একের পর এক গান গেয়ে ভুবন ভরিয়ে তুললো । আর পুকুলি ? তার কথা যতো বলা যায় ততোই কম । মনের আনন্দে কি নাচটাই না নাচলো একরত্তি মেয়েটা ! এতটুকু ক্লান্তি নেই !
তবে সব কিছু
কে ছাপিয়ে মুখ্য আকর্ষণ হয়ে উঠলো কৌতুক নাট্যাভিনয় , একথা
অনস্বীকার্য । মোট তিনটে হেঁয়ালিনাট্য শ্রুতিনাটক রূপে উপস্থাপিত হয় যথাক্রমে :
রোগীর বন্ধু , সূক্ষ্ণ
বিচার এবং অভ্যর্থনা ।
অনুষ্ঠান শেষ
হওয়ার পর পুকুলি বাপের হাত চেপে ধরে জানতে চাইলো
-
আগে বল তুমি আর তোমার গ্রামের ভাই ও দাদারা কি করে এতো দিন পরেও এতো ভালো
অ্যাক্টিং করলে ?
-
কেনো এতে অবাক হওয়ার কি আছে ?
তুই নাচ করলি , তোর
মা গান করলো ঠাম্মি কবিতা বললো তার বেলা ?
-
সেটা তো আমাদের আগে থেকেই তোলা আছে ।
সুমেরু উত্তর
দেওয়ার আগেই ঠাম্মি বললো
-
ঐ নাটক গুলোও তোমার বাবার তোলা আছে । কোথায় জানো দিদিভাই ? এইখানে , হৃদয়ের
মনিকোঠায় ।
এই বলে তিনি
বুকের বাম দিকে হাত রাখলেন । তারপর ধীর শান্ত স্বরে বললেন
-
দাদাইয়ের কথা তোমার মনে নেই ?
-
হ্যাঁ আছে তো ।
-
থাকবারই কথা , এই
তো মাত্র বছর তিনেক আগে ... । তিনি ছিলেন ছেলেদের দলের প্রাণ পুরুষ । তিনি যা
শিখিয়ে গেছেন তা সারা জীবনেও ভোলবার নয় । যেমন আজ তোমার বাবার কাছ থেকে তুমি যা
পেলে তা তোমার মনে থাকবে চিরকাল । কারণ কি জানো দিদিভাই ? যাঁকে কেন্দ্র
করে এতো কাণ্ড তিনি স্বয়ং রবি ঠাকুর ।
সুমেরু বললো
-
যে যাই বলুক না কেন নাচ গান আবৃত্তি সব ছাপিয়ে আমাদের নাটকের পারফরমেন্স ইজ
দ্য বেস্ট । কমেন্টে সবাই তাই বলেছে ।
সঙ্গে সঙ্গে
চিত্রা বললো
-
ও আচ্ছা তাই বুঝি ?
বেশ , ভেবেছিলাম
রাত্রে লুচি ভাজবো । এবার লবোডঙ্কা ।
-
লে হালুয়া ! একি গেরো ?
সত্যি কথা বলার জো নেই ?
পুকুলি জোরে
হি হি করে হাসছে । অর্চনা দেবী বললেন
-
বেশ তো বৌমা পরোটাই হোক না হয় আজ । সব সময় অতো ভাজাভুজি খাওয়া ভালো নয়
খোকা । আমি বরং ছানাবড়ার ডালনা করি । আমার দিদিভাই খুব ভালোবাসে তাই না ?
-
ওহ্ ঠাম্মি তুমি গ্রেট !
এই বলে
পুকুলি গলা জড়িয়ে ধরলো ।
তিনি আবার
বললেন
-
রবীন্দ্রনাথ কটা উপন্যাস লিখেছেন জানো ?
-
উপন্যাস কি ?
-
অনেক অনেক বড় আয়তনের গপ্পো ।
-
ও আচ্ছা । না ঠাম্মি জানি না । তুমি বলো ।
-
মোট তেরোটা । আর বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন মোট চৌদ্দটা ।
-
সেকি কবিগুরু একটা কম লিখছেন কেনো ?
-
বঙ্কিম সাহিত্য সম্রাট কিনা তাই ওনার চাইতে একটা বেশি ।
-
ও তাই ?
-
হুম্ , ধরা
যাক এবার তুমি রবীন্দ্রনাথ পড়া শুরু করবে । প্রথমেই কি পড়বে বলো ?
-
তুমি বলো ।
-
ডাকঘর পড়তে পারো ,
আবার ছেলেবেলা পড়তে পারো । রবীন্দ্রনাথ ভোজন রসিক ছিলেন জানো তো দিদিভাই ?
অর্চনাদেবী
পুকুলিকে কোলে তুলে নিয়ে রান্না ঘরের দিকে পা বাড়ালেন । কানে ভেসে আসছে তাঁর গলা
...
-
একটা ছড়া বলি শোনো :
আমস্বত্ত্ব
দুধে ফেলি
তাহাতে কদলি
দলি
সন্দেশ
মাখিয়া দিয়া তাতে
হাপুশ হুপুশ
শব্দ
চারিদিক
নিস্তব্ধ
পিঁপড়া
কাঁদিয়া যায় পাতে ।
চিত্রা এতক্ষণে সুমেরুর পাশে এসে সোফায় বসলো । জড়িয়ে নিলো তার হাত নিজের হাতের মুঠোয় । সেন্টার টেবিলে রাখা চার দশকের পুরনো হাস্যকৌতুক বইয়ের পাতাগুলো ফরফর করে উড়ছে । সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও পরম্পরার এক প্রবহমান ধারা যেনো চাক্ষুষ করা যায় । দুজনেই নির্বাক , নিষ্পলক চেয়ে আছে পরস্পরের দিকে ।
===============================
গল্প-৫
নব কলা পত্রে
শিক্ষা চিন্তন
তপন তরফদার
আজি হতে শত বর্ষ পরে কে তুমি পড়িতেছ আমার
কবিতা খানি নামক বাণীটি আমাদের ঘাম,রক্তের
সঙ্গে মিশিয়া গিয়াছে। কিন্তু প্রায় একশত বর্ষ পূর্বের মহামারি স্প্যানিশ
ফ্লু আবার ভেক বদল করিয়া কোভিড নামক নামাবলী জড়াইয়া এমন খেল দেখাইবে বিশ্ববাসীর
কল্পনাতীত স্কুল। পাঠশালা। বিশ্ববিদ্যালয়
হইতে গোবিশ্ববিদ্যালয় সম্পূর্ণ লকডাউন করিতে হইবে, পরীক্ষণ ও তালা মারিতে হইবে স্বপনে ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের
মস্তিষ্কের মগজাস্ত্রে উদিত হয় নাই। কোবিদ পরবর্তীকালে নতুন চিন্তা ভাবনার প্রয়োজন
। নতুন শিক্ষা নীতিমালা প্রনীত হইবে।
প্রত্যেকে আমরা প্রত্যেকের তরে। অতএব আমরা
সবাই চিবুকে হস্তক্ষেপ করিয়া ভাবিত।
‘আহা কি আনন্দ
আকাশে-বাতাসে’ - সত্যজিৎ
ও রায় দিয়েছেন শিক্ষাপ্রণালীর পরিবর্তনের। আমাদের শিক্ষামন্ত্রী অনুপ্রাণিত হইয়া
স্থির করিয়াছেন, নতুন
শিক্ষাব্যবস্থ্যার এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ লইয়া ইতিহাসে উজ্জ্বল জ্যোতিস্ক হইবার
নজির রাখিয়া যাইবেন। সম্প্রতি ইচ্ছাটি প্রসব বেদনার মতোই চাগাড় দিয়া উঠিয়াছে।
বাংলা ভাষার বর্ণ পরিচয়ের জনক বিদ্যাসাগরের মূর্তিকে খানখান করিয়া চূর্ণনে জন
মানসের নজর কাড়িয়াছে। ইতি পূর্বে জাতির জনকের এক ও অদ্বিতীয় লাঠি অপহরণেও এই রূপ
শোরগোলের উত্তাপ বঙ্গবাসী পায় নাই। শিক্ষামন্ত্রীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল সরেজমিনে
সবিস্তারে জানিতে হইবে। নতুন ধাঁচে নব কলেবরে বিদ্যাসাগরকে স্থাপন করিতে হইবে।
বিদ্যাসাগরের দ্বিশতক খন্ডিত অংশ অবলোকন করিয়া সুপ্ত বাসনা জাগরিত হইল
শিক্ষামন্ত্রীর - আমাকেও শিক্ষা ব্যবস্থা লইয়া চিন্তা সূত্র প্রয়োগ করিতে হইবে।
আমার ও মূর্তি এখানে সেখানে স্থাপিত হইবে
একদিন। যথারীতি মূর্তি ভাঙিলেই সংবাদ মাধ্যমের খবর হইয়া মরিয়াও মরিল না, প্রমাণিত হইব।
কিন্তু কিরূপে কি মশলা দিয়া নতুন শিক্ষা সৌধ গড়িবেন সেই চিন্তায় প্রায়শই স্নানঘরে
নগ্ন হয়ে মগ্ন থাকেন। অদ্যাপি সেই বিজ্ঞানীর মতোন মত্ত হইয়া নগ্ন-শরীরে ইউরেকা
ইউরেকা বলিয়া বঙ্গবাসীর জ্ঞাতার্থে কোন সূত্র উদ্ভাবন করিতে পারেন নাই। মানসিকভাবে
সামান্য বিপর্যস্ত্য। কিন্তু বঙ্গদেশীয় বিদ্বজন শিক্ষকমন্ডলী শিক্ষামন্ত্রীকে
বঞ্চিত না করিয়া মহাশয়ের আজন্ম লালিত ভিন্ন এক ইচ্ছার ইচ্ছাপূরণ করিলেন।
উত্তরবঙ্গের কালিদাস বিশ্ববিদ্যালয় একটি
বিশেষ শিরোপা উপঢৌকন দিয়াছেন শিক্ষামন্ত্রীকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরন কালিদাস
ইহার নিমিত্তিই সৃষ্টি হইয়াছিল। যত্রতত্র বৃক্ষশাখা কর্তন করিয়া, নিজস্ব
কর্ন-নাসিকা মর্দন করিয়া প্রভাবশালী ব্যক্তিদের তৈলমর্দন করিতে পিছপা হইবেক না।
শিক্ষামন্ত্রীর নব্যউদ্ভাবনী শিক্ষাসূত্রর জন্য উনি পিতৃদত্ত নামাবলীর পূর্বে একটি
বিশেষ আলঙ্কারিক অক্ষর ব্যবহার করিবেন যাহার দ্যূতি হীরকের ন্যায় ঔজ্জ্বল্যের
ঝিলিক বিচিত্রস্থানে গমন করিবেক। এই শিরোপার তরে মনলোভা বিদ্বজন সহ মন্ত্রীরাও
লালায়িত।
অদ্য স্বয়ং রাজ্যপাল স্বহস্তে সেই উদ্ভট
পোশাকে মস্তকে তাসের দেশের রাজার মতো টুকটুকে রঙিন কাপড়ের ‘লিবার্টি
ক্যাপ’ শিরস্ত্রাণের
আদলে মস্তকে ধারন করিয়া শিক্ষামন্ত্রীর বক্ষে আলিঙ্গন করিয়া মহামূল্যবান তুলটের
কাগজটি প্রদান করিলেন। দূরদর্শন ও দৈনন্দিন দৈনিক বাজারি পত্রিকার চিত্র
সাংবাদিকরা পুনর্বার বক্ষ আলিঙ্গনের অনুরোধ করিলেন। তাঁহারা মন্ত্রীমহোদয়ের
ঐতিহাসিক ছবি প্রচার করিবেন। মন্ত্রীর একান্ত ইচ্ছা পূরণ করিয়া উনার সন্তুষ্টির
নিমিত্তই এই প্রয়াস।
শিক্ষামন্ত্রী সপার্ষদ উজ্জ্বল নীল
বর্ণের তৈল চালিত চার চাকার শীততাপ নিয়ন্ত্রিত বলেরো রথে উপবেশিত হইয়া ফণী ঝড়ের
ন্যায় নবযৌবন প্রাপ্তীর আনন্দে নবান্নের অলিন্দের তরে অগ্রসর হইতেছেন। মন্ত্রী
তাহার হাফ-হাতা নীল-সাদা ডোরা কাটা খদ্দরের পাঞ্জাবির বুক পকেট হইতে মুঠোফোন
নির্গত করিতে বাধ্য হইলেন। তারঃস্বরে ক্ষুদ্র যন্ত্রটি বলিতেছে - বন্দেমাতরম, সুজলাং-সুফলাম-মাতরম। যন্ত্রটিতে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠটি স্পর্শ করিয়া নিজ
কর্ন-কুহরে স্থাপন করিয়া বলিলেন - বল। অপর প্রান্ত হইতে উচ্চস্বরে ধ্বনিত হইল -
স্যার, আমি
শঙ্কুদেব দেববর্মন। এই নামটি এক্ষনে
বঙ্গদেশের অতি পরিচিত স্বনামধন্য মান্যবর মনিষীদের অন্যতম সার্বজনীন সংগ্রহযোগ্য
নাম। এই ব্যক্তি ও তার পুত্র বেলতলা বিদ্যানিকেতনের সহিত অতি সক্রিয় হইয়া জড়িত।
পিতা শঙ্কুদেব এই বিদ্যানিকেতনের ছাত্র সাংসদের মহাসচিব। পুত্রও ‘সক্রিয়’ ছাত্র।
বিস্তারিত রূপে অনুসন্ধান করিলে গিনেস রেকর্ডের অধিকারী হইবেক। বিশেষ সংবাদে
শঙ্কুদেব ঘোরতর শঙ্কায় ছিলেন - সরাসরি ছাত্ররা বৈদ্যুতিন মাধ্যমে মহাবিদ্যালয়ে
প্রবেশাধিকার অর্জন করিবেক। শিক্ষা শুরুর পূর্বে শিক্ষাঙ্গনে পদধূলি প্রদানের
প্রয়োজন নাই। শঙ্কুদেব ওই সময়ে শঙ্কাগ্রস্ত গলায় বলিয়াছিল - আমরা ছাত্র নেতারা
কিরূপে ‘রূপিয়া’ অর্জন করিব, বাল-বাচ্চা
সহ সংসার কি মন্ত্রে প্রতিপালিত করিব। মন্ত্রী মহাশয়ের পূজোয় প্রদান করিবার অর্থ
কোন যাদুমন্ত্রে সংগ্রহ করিব?
উক্ত সময়ে মন্ত্রী নির্ভিক কন্ঠে আশ্বস্ত করিয়াছিলেন - যতই বৈদ্যুতিন
মৈদ্যুতিন হউক, সবার
উপরে মানুষ সত্য। মানুষই ফাঁকফোকর রাখিবে এবং ফাঁকতাল দিয়া ভালই অর্থ উপার্জন
করিতে পারিবেক। সঠিক হিসাব কষিলে দেখা যাইবে শতকরা হিসাবে ন্যায়ত আমাকে আরও অর্থ
প্রদান করিবে। শঙ্কুদেব ছাত্র সমস্যার বিষয় উত্থাপন না করিয়া সজোরে শরবাণ নিক্ষেপ
করিল - স্যার, মমতাময়ী
ফরমান করিয়াছেন, আজ
হইতে ‘কাটমানি’ অবৈধ ঘোষণা
করিয়াছেন। আরও বলিয়াছেন কাটমানি হানিকারক হইয়াছে। উহা ওয়াপস করিয়া কালীঘাটের
মন্দিরে পূজা প্রদান করিয়া বিশুদ্ধ দেশহিতব্রতী হইতে হইবেক। মন্ত্রী দন্তবিকশিত হাসি হাসিয়া বলিলেন - সময়ে
সব ঠিক হইয়া যাইবেক। চিন্তা করিবেক না।
শিক্ষামন্ত্রীর মস্তকের কেশরাজি
কুচকুচে কালো। এই কালোতে ভূষন্ডীকাক বা ভুষিকালিও পরাজয় বরণ করিতে বাধ্য।
কর্নদ্বয়ের পার্শ্ব হইতে সাদা-সফেদ চুনকাম করা কাঁচি দিয়ে সূক্ষ্ম্য কারুকার্য করা
শ্বেত শুভ্র ফরাসিমার্কা দাড়ি। দেহবল্লরী ভালুকের সমগোত্রীয়। মন্ত্রী ভালুক মুখের
সাচ্চা শুভ্র দাড়িতে হস্তমর্দন করিতে করিতে ধূসর চক্ষু দুইটি চশমার ফোকর হইতে
প্যাটপ্যাট করিয়া দিগন্ত বিস্তৃত ধান ও পাট ক্ষেতের ধারে ধারে প্রোথিত বট-অশ্বত্থ
বৃক্ষের শীর্ষদেশ পারাপার করিয়া ফিরোজা আকাশ অবলোকন করিতেছেন। আজ বড় আনন্দের দিন।
শিক্ষামন্ত্রীর হৃদয়ে এক্ষনে পূর্বপুরুষদের স্মৃতি ও ভাবনা উদিত হইতেছে। পুরীর
মন্দিরের ন্যায় এক নকল মন্দিরের চূড়ায় গৈরিক পতাকা পতপত করিয়া ডানা ঝাপটাইয়া
উড্ডিয়মান। যাহা অবলোকন করিয়া মন্ত্রীর অক্ষিগোলক প্রায় নিথর হইয়া স্থির হইয়া যায়।
শিক্ষামন্ত্রীর বংশের পূর্ব প্রজন্মের প্রপিতামহ কৃষ্ণানন্দ ছিলেন রাজশাহীর
ভূমিপুত্র। বিধর্মীদের দ্বারা ধর্মচ্যূতি এবং সামাজিক অত্যাচার হইতে পরিত্রানের
নিমিত্ত সপরিবারে পালাইয়া আসিয়া ভদ্রাসন নির্মান করেন নবদ্বীপধামে। পবিত্র ভূমিতে
তাঁর পুত্র পরমানন্দ একই চতুষ্পঠিতে শ্রী চৈত্ন্যদেবের সহপাঠী হইয়া তালপাতার পুঁথি
সমুদয় গোগ্রাসে গিলিয়া,
মুখস্ত করিয়া হৃদয়ে ধারন করিতেন। পরবর্তীকাল ভাটপাড়ায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করিয়া
পরমানন্দ “অগম
বাগীশ” উপাধিতে
ভূষিত হইয়াছিলেন। তৎকালীন ভাটপাড়া ছিল বাংলার অক্সফোর্ড। ছায়ায় ঘেরা শান্তির নীড়।
দূর-দূরান্ত হইতে ছাত্ররা আসিত। আয়ূর্বেদ,
জ্যোতির্বিদ্যা,কাব্য
থেকে ন্যায়দর্শনের শিক্ষালাভের জন্য। এখানকার শিক্ষকেরা তর্কে পরাস্ত করেন
আর্যসমাজের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীকেও।
ওনার একান্ত মনস্কামনা ছিল মহামহোপাধ্যায়, উপাধ্যায় বা
বেদান্ত পন্ডিত-প্রবর উপাধি অর্জন করিয়া নামের অগ্রভাগ কর্নকুন্ডলীর মতো জ্বুল
জ্বুল করিবেক। তদানীন্তন উচ্চাশা বা উচ্চাকাঙ্খা পরিপূর্ণ হয় নাই। সমগ্র জীবিতকাল
ঐ টুলো পন্ডিতের পরিচয় লইয়া বৈতরণী নদী পার করিয়াছিলেন। বিষয়টি পরিবারের একাধারে
লজ্জা এবং জ্বালা। সমাজের নিকট ইহা লজ্জার বিষয়, নিজেদের হৃদয়ে-মনে শিল নোড়ায় পেষিত লঙ্কা বাটার ন্যায়
জ্বালায় সর্বদাই জ্বলিতে থাকিত। বংশ পরম্পরায় এক সুপ্ত ক্ষোভ সহ জ্বালা এইক্ষণেও
বিরাজমান। শিক্ষামন্ত্রীর মা মানদা দেবী, তির্যক ও
কর্কশ স্বরে হামেশাই বিষয়টি শিক্ষামন্ত্রীর গোচরে আনেন। বারংবার বিষয়টি সুপুত্রের
কর্নকুহরেপ্রবেশ করাইয়া স্মরণ করান। পূর্বপুরুষদের ক্ষমতা ছিলনা - উপাধির জন্য
প্রতিপত্তি, অর্থ
ইত্যাদি ব্যয় করিবার। অবশ্য তৎকালীন সময়ে ওই উপাধি ক্ষমতা বলে বা উৎকোচের দ্বারা
অধিগ্রহণ করিতে কেহ অগ্রসর হইত না।
সময় পরিবর্ত্তিত হইয়াছে। সামাজিক নিয়মনীতি, রীতিরও
পরিবর্তন হইয়াছে। বর্তমান শিক্ষামন্ত্রীর হাতের তালুতে সেই সুবর্ণ সুযোগ পকেটস্থ
করিবার, শিক্ষামন্ত্রীর
অঙ্গুলিনির্দেশেই টুকুস করিয়া খাজা কাঁঠাল মান্যবরের গোঁফের উপর টুপ করিয়া খসিয়া
পড়িল। মন্ত্রী মহাশয় গোঁফে সহর্ষে খাঁটি সরিষার তৈলমর্দন করিয়া ভক্ষণ করিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষক ধন্য ধন্য হইয়া মন্তব্য করিলেন - এমন শ্রুতিধর, জ্ঞানবান, কন্দর্পকান্তি
ছাত্র ভারতবর্ষে বিরল। আমরা এই মহান ব্যক্তিকে শিরোপা প্রদান করিতে পারিয়া মোরা
ধন্যপ্রাণ। খুশি, খুব
খুশি একশ শতাংশ খুশি।
দুরন্ত চলন্ত চার চাকার বলেরো স্থলযানে
সাপার্ষদ মন্ত্রী। মন্ত্রীর পার্ষদদের মুখমন্ডলে উজ্জ্বল হাসি। কিন্তু ভালুকমুখো
মন্ত্রীর কপালে এক সূক্ষ্ম ভাঁজ প্রস্ফুটিত। স্বকীয় প্রশ্ন অবচেতন মনে ঘুরিয়া
ফিরিয়া শুশুকের ন্যায় ভাসমান - সত্যি কি আমি ইহার যোগ্য। শুশুক গঙ্গায় ভুস করিয়া
ভাসিয়া উঠে পরমুহূর্তে ফুস করিয়া ডুবিয়া যায়। মন্ত্রীর মন্ত্রণায় অন্তর বীর রসে
প্লাবিত হইয়া বলিল - কোন সম্বন্ধীর পো বিচার করিবে, আমি যোগ্য না অযোগ্য?
প্রশ্ন তুলিলেই তাহাতে ‘সেন্টি’ না হইয়া সেই
চার অক্ষরকে ‘খাপে
খাপ’ ভরিয়া
দিব। কেহ বলিতে পারিবেক না ইহা “ভুয়ো
ডিগ্রী”।
বর্তমানে অনেক রাজনৈতিক নেতাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, নাগরিকতা লইয়া দগদগে প্রশ্ন উঠিতেছে। এই অলংকার লক্ষ্য
করিয়া কেহ কড়ে আঙুলও তুলিবার সাহস পাইবে না - কারন ইহা জলের মতো পরিষ্কার, ভুয়ো নহে।
ভারতবর্ষের তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ অবগত
আছেন উপাধিটা প্রদান করা হয় নতুন কিছু অবদান বা আবিষ্কার করার জন্য। উপাধি প্রাপ্ত
শিক্ষামন্ত্রী ভাবিতে থাকেন তিনি কি কি করিয়াছেন। বদন এবং বগল চুলকাইয়া মস্তকে
অঙ্গুলির দ্বারা হস্ত সঞ্চালন করিতে করিতে চিন্তা ভাবনা করিয়া কোন কূল কিনারা
পাইলেন না। থই পাইলেন না। ভুলিয়া গিয়াছেন কি বস্তুর রহস্য উন্মোচনের জন্য উপাধি
প্রদান করা হইয়াছে।
‘ভুলিয়া গিয়াছেন’। মহান
ব্যক্তির প্রধান গুণ ভুলিয়া যাওয়া। ওই ইউরেকা ইউরেকা বলিয়া নগ্ন গাত্রে মগ্ন হওয়া
সূতাহীন দেহে সব সমক্ষে আসিয়া ঘোষণা করেন তার অবিষ্কারের বিষয়। তাৎপর্যপূর্ন বিষয়
তিনি ভুলিয়া গিয়াছেন তাহার অঙ্গে একটিও সূতা নেই। সম্পূর্ণ নগ্ন, বিবস্ত্র -
ইহা ভুলিয়া গিয়াছেন। এই মগ্ন চিন্তার মাঝেই মুঠো ফোন গর্জাইয়া উঠিল। মন্ত্রী
যথারীতি বৃধাঙ্গুষ্ঠি ঘর্ষণ করিয়া বলিলেন - বল।
- স্যার, সাংঘাতিক
কান্ড হইতেছে। এই বৎসর যাহারা বেঙ্গল জয়েন্টে মেধা তালিকার প্রথম দশে নাম আছে, তাহারা
প্রত্যেকেই সাংবাদিকদের বলিয়াছে উহারা বঙ্গদেশে পড়াশুনা করিবেক না। এখানকার পরিবেশ
পড়াশুনার উপযুক্ত নহে। প্রথম স্থানাধিকারী ছাত্র ‘মিস্ত্রী’র
ন্যায় দক্ষ কন্ঠে দ্বিধাহীন ভাষায় দূরদর্শনে বক্তব্য পেশ করিয়াছে। গোদের উপর
বিষফোঁড়া, রাজ্য
জয়েন্ট এন্ট্রান্সে প্রথম দশে রাজ্য বোর্ডের এক মাত্র সবেধন নীলমনি ‘অর্ক’ নামধারী এক
বালক।
শিক্ষামন্ত্রী সদ্য সংগ্রীহিত শংসাপত্রের
উপর চক্ষু দ্বারা লেহন করিয়া মুখে এক স্বর্গীয় হাসির রূপরেখা প্রস্ফুটিত করিয়া
শিক্ষা অধিকর্তাকে মুঠোফোনে বলিলেন - আপনারা কি করিতেছেন, শুধু দুর্বা
কর্তন করিতেছেন। অগণিত ব্যক্তিবর্গদের বঞ্চিত করিয়া আপনাকে শিক্ষা সংসদের
সভানেত্রীর পদে আসীন করিলাম - প্রতিদানে কি করিলেন? সাংবাদিকদের দৃষ্টিকোন ওই মহুয়ার নেশার দাসে বশীকরণ করুন।
এখনই প্রকৃষ্ট সময় - নিজস্বতা দ্বারা প্রচার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার।
- আপনি সঠিক
পথের সন্ধান দিয়াছেন,
মান্যবর। আমি উহাদের কর্ণকুহরে কিছু বাণী প্রবেশ করাইব। তাহা এইরূপ - অর্ক
অর্থাৎ সূর্য। একটিমাত্র সূর্য আমদের ধরিত্রীকে আলোকিত করিতেছে, পৃথিবীর পথ
প্রদর্শক। একটিই আমাদের শত সহস্রের সমতুল্য। রাজ্য উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা সমাপনের
কিয়ৎক্ষণেই রাজ্য জয়েন্ট এন্ট্রান্সের তজদিগ হয়।
শিক্ষামন্ত্রীর কর্নে তজদিগ শব্দটি
বুলেটের ন্যায় কর্নমন্ডলীতে প্রবেশ করে হৃদয়ে আলোড়িত হইল। শিক্ষামন্ত্রী অথচ তজদিগ
শব্দের মর্মার্থ অবহিত নন - তাহা অপরজনের জ্ঞাতার্থে প্রকাশ্যে আসিলে জ্ঞানী
ব্যক্তিত্বের অনুকূল নহে। নিমিলিত চক্ষুদ্বারা মর্মকথা শ্রবণ করিয়া শশব্যস্ত হইয়া
ওঠেন। মৃদু স্বরে বলেন - অতঃপর পিঠোপিঠি দুইটি পরীক্ষার প্রস্তুতি পর্বে আমাদের
শিক্ষার্থীরা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষাকে অধিক গুরুত্ব দেয়। অধিকাংশ মেধাবীরা
রাজ্যবোর্ডের মেধাতালিকায় স্বীয় নাম সমুজ্জ্বল করিবার স্বপ্ন দেখেন। ইহার কারনেই
জয়েন্ট এন্ট্রান্সের জন্য ভিন্ন ধরনের প্রস্তুতি করেনা। মেধা তালিকায় আমাদের
একজনের নাম থাকিলেও শতকরা হিসাবে আমাদের পরীক্ষার্থীদের সাফল্যের হার ৯৯.৫ শতাংশ
যা অন্যান্য বোর্ডের থেকে অনেক অনেক বেশি। শুধু উচ্চমাধ্যমিক পাঠ্যসূচী অধ্যয়ন
করিয়াই সাফল্য পাইতেছে। উপরন্তু বিভিন্ন বোর্ডের পরীক্ষা বহু পূর্বে সমাপন হইবার
নিমিত্ত প্রচুর সময় ব্যয় করিতে পারে - এন্ট্রান্স পরীক্ষার নিমিত্ত। অধিকিন্তু
অন্যান্য বোর্ডের শিক্ষার্থীরা ধনীর সন্তান। জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষায় সফল হইবার
নিমিত্ত কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢালিয়া বিভিন্ন স্তরের প্রাইভেট টিউশন ও বিশেষ
প্রশিক্ষণের দারস্থ হয়। বিরক্ত
শিক্ষামন্ত্রী একটু রাজনৈতিক প্রলেপ লাগাইয়া কহিলেন - কৃতী ছাত্র-ছাত্রী, জ্যোতি বসু, সিদ্ধার্থ
শঙ্কর রায় ও ব্যারিস্টারি পড়িতে বঙ্গদেশের বাহিরে গমন করিয়াছিলেন।
‘প্রাইভেট টিউশন’ শব্দটি
ইথারের মাধ্যমে ভাসমান হইয়া শিক্ষামন্ত্রীর হৃদয়ে লক্ষণের শক্তিশেলের ন্যায় আঘাত
করিল। চক্ষু মুদিত করিয়া রাখিতে পারিলেন না। নয়ন মেলিয়া অবলোকন করিলেন স্থানটির
নাম - চাকদহ। অন্যতম ইতিহাস প্রসিদ্ধ ধাম। এই স্থানেই ভগীরথের রথের নিম্নাংশ
অর্থাৎ চাকা ভূমিতে নিমজ্জিত হইয়াছিল। চাকদহে আসিয়া চারচাকার চাকা শম্বুক গতিতে
ধীরে ধীরে অগ্রসর হইতেছে। রাগান্বিত শিক্ষামন্ত্রী - অতি সত্ত্বর নবান্নে বা গৃহে
গমন করা জরুরী। উদর ও তাহার তলদেশ গুরুতর বিদ্রোহ করিতেছে। উদ্যত উদর গহ্বরে
ঠাসাঠাসি করিয়া লোভনীয় খাদ্যবস্তু উদরস্থ করিবার ফলস্বরূপ বিদ্রোহ ঘোষণা করিতেছে।
শিক্ষামন্ত্রী বিরক্তির আঁখি মেলিয়া বুঝিতে পারিলেন ৩৪ নং জাতীয় সড়কের সেই
ফ্যানেলের চ্যানেলে প্রবেশ করিয়াছেন। পুরমন্ত্রীর মেজ শ্যালিকার দুনম্বরী মিঁঞার
মিডল্যান্ড মদিরালয় এই জাতীয় সড়কের পার্শ্ববর্তী জমি বেআইনি দখল করিয়া মহানন্দে
মদের দুনম্বরী ব্যবসা করিতেছে। তৎকালীন সময়ে স্বপ্নেও ভাবিতে পারেন নাই এই জীবনে
কোন দিন মন্ত্রী হইবেন। তৎকালীন প্রশাসনের মুখে চুনকালি মাখাইবার জন্য বিভিন্ন
দুর্বৃত্ত ও জবরদখলকারীদের এককাট্টা করিয়া যুগান্তকারী আন্দোলনের সলতে পাকান - জান
দেব, দেব
না সূচাগ্র মেদিনী। ওই আন্দোলনই এখন বুমেরাং হইয়া প্রকটিত হইতেছে। বোলেরো রথের গতি
একান্তই শূন্য। নয়নে জলচ্ছবির মতো স্পষ্ট হইয়া উদিত সেই হেলিয়া পড়া বটবৃক্ষ, যাহার তলদেশ
হইতে মোরাম রাস্তা মিলিত হইয়াছে কাঁকিনাড়ার রথতলার ময়দানে। উক্ত মাঠ হইতেই রথ দেখা
এবং কলা বেচার ক্রিয়া শুরু করিয়াছিলেন। বাঁশের দ্বারা নির্মিত মঞ্চ থেকে সজোরে
চোঙা ফুঁকিয়া বাণী ছড়াইয়াছিলেন - জান দেব,
রক্ত দেব তবু রাস্তার জন্য জমি দেব না। বেআইনীর সমর্থকরা, দখলদারেরা
উদার হস্তে স্বতস্ফূর্ত করতালি সহযোগে অভিনন্দন জানাইয়াছিল। কান্ডজ্ঞানহীন জনতা
জনার্ধনের মনে বা প্রাণে এ প্রশ্ন ঘুণাক্ষরেও উদিত হয় নাই - জান বিসর্জন সুসম্পন্ন
হইবার পর রক্ত কোথা হইতে আসিবে। প্রায় এক যুগ পূর্বের ঘটনা ছায়াচিত্রের ‘ফ্ল্যাশ
ব্যাক’ হইয়া
চক্ষুর সামনে ভাসিতেছে। ইহা জনগনের সম্মুখে স্বচ্ছ হইলে মোক্ষম আঘাত আসিত।
জনগণমনের ওই এক দোষ বা মহান গুণ - কিয়তকাল উদর গুরু গুরু করিলেও অবশেষে সব হজম
করিয়া ফেলে। বিলকুল ভুলিয়া যায় বটবৃক্ষের বৃহদাকার একটি স্থলশাখা ভূতলে ধরাশায়ী
হইয়া চির নিদ্রায় শায়িত।
শিক্ষামন্ত্রী গবাক্ষ হইতে অবলোকন
করিলেন - এক কন্যা নিবিষ্ট মনোজগতে শামিল হইয়া ঘোষি প্রস্তুতের আয়োজন করিতেছেন।
বাম হস্তে গোবরের এক তাল। দক্ষিণ হস্ত উর্দ্ধে তুলিয়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোল্লা
সযত্নে গুঁড়িতে লেপটাইয়া একাগ্র চিত্তে ঘুঁটে শিল্পের নির্মাণে নিমগ্না। গোবর
ধারণে ব্যস্ত থাকায় এ ধরার অন্যান্য বিষয়ে কোন হুঁশ নাই। না থাকারই কথা। গায়ের রঙ
খোসে পড়া শালপাতার সহিত তুলনীয়। আট হাত মিলের মোটা সুতোর শাড়ী দেহাঙ্গে আলুলায়িত
রূপে লেপটিয়া রহিয়াছে। উপযুক্ত পৃষ্ঠদেশে বৃক্ষের পাতলা শিকড়ের মতো ছড়াইয়া রহিয়াছে
রুক্ষঘন কেশরাজি। কপালের রক্তিম সিন্দুর বর্তমানের চিত্র-তারকাদের মতো উল্মব রেখা
হয়ে কপালে বিদ্যমান হইয়া এক ত্রিমাত্রিক রূপ ধারণ করিয়াছে। মাত্রাতিরিক্ত সাইরেনের
শব্দ তাহার মানসিক একাগ্রতাকে খানখান করিয়া দিল। সরাসরি অক্ষিগোলক সরলভূত বায়ুঝড়ের
ন্যায় আছড়াইয়া পড়িল ওই শৃগালচক্ষু ভাল্লুক দাড়িতে। পরপুরুষের সহিত চারচক্ষুর মিলনে
শিহরিত হইয়া লজ্জায় ‘এ্য
মা’ উচ্চারণ
করিয়া নিজ জিহ্বা প্রদর্শিত করিল কন্যা। এই মাহেন্দ্রক্ষণের মহাদৃশ্যটি চলচিত্রের
মহানায়িকার প্রতিবিম্ব হইয়া শিক্ষামন্ত্রীর হৃদয়ে দাগা দিল। হৃদয় গুনগুনিয়া উঠিল -
ঘোমটা মাথায় ছিল না তার মোটে,
মুক্তবেণী পিঠের 'পরে
লোটে। রবীন্দ্রনাথ প্রথমে লিখেছিলেন ‘কৃষ্ণকলি’ কবিতা। সেই
কৃষ্ণকলি গানে রূপান্তরিত হইয়া সুপার হিট। সব কালো মেয়েরাই হরিণ চোখা হইয়া উঠিল।
কালো মেয়েকে নয় আসলে মনে মনে লুক্কায়িত কালো ধনকে রক্ষা করিতে কালোর ভক্ত হইয়াছেন।
শিক্ষামন্ত্রীর চোখ কালো হরিণ গ্রন্থিত ঘুঁটে সমুদয়। উজ্জ্বল খাঁকি রঙের ঘুঁটেগুলি
এক অপার্থিব আলোক বিকিরণ করিতেছে। শিক্ষামন্ত্রী বুঝিলেন ঘুঁটে এক মহান শিল্প।
শিল্পমন্ত্রী হইয়া উক্ত শিল্পকে উদ্বুদ্ধ করিবেন। ঘুঁটে শিল্পে পশ্চিমবঙ্গকে
বিশ্বশ্রী পুরস্কৃত করাইবার সম্ভাবনা প্রবল। বর্তুলাকার উদর আবার ভুটভাট শুরু
করিল। মহার্ঘ্য মুঠোফোনটি পুনরায় মুখোরিত
হইল শ্রীকৃষ্ণের বাঁশির সূরের ন্যায়। ও প্রান্ত থেকে শরনিক্ষেপ হইল - স্যার, আপনার
বিরুদ্ধে কয়েকজন শিক্ষক অভিযোগ জানাইতে আসিয়াছিল। আপনি কাটমানি ভক্ষণ করিয়া উহাদের
শিক্ষকের চাকুরীতে নিয়োজিত করিবেন।
মন্ত্রীর ধূম্রলোচন শিহরিত হইলেও শক্ত কন্ঠে কহিলেন - আপনি কি করিয়াছেন?
- স্যার, আমি ডায়রি গ্রহণ
করি নাই।
- সঠিক কর্ম
করিয়াছেন। আদেশ করবেন প্রমাণপঞ্জী সহ পদার্পন করিবেক। কোন শ্যালক প্রমাণ করিতে
পারিবেনা কারন আমি নগদা-নগদি কারবার করি। আমি কয়েকদিনের মধ্যেই দলের নেতার আসন
হইতে ঘোষণা করিব আমাদের দলের নিরানব্বই দশমিক নিরানব্বই শতাংশ ক্যাডার সৎ। উহারা ঘুষ
-কাটমানিকে ঘৃণা করে।
গৃহ হইতে মন্ত্রীর শ্যালিকার মুঠোফনে তলব
করিতেছে। সমস্ত শক্তি প্রদর্শন করিয়া মধুক্ষরা কন্ঠে কহিলেন - বল।
যে যতই
শক্তিধারী মন্ত্রী হউন ওই নিজস্ব গৃহমন্ত্রীর কাছে সবাই কুপোকাত। অনুযোগ আসিল -
আজও গৃহশিক্ষক মন্ত্রীকন্যা পৃথাকে অধ্যায়ণ করাইতে গরহাজির। এক্ষণে হোমওয়ার্ক
কিরূপে সম্পন্ন হইবেক। মন্ত্রী কাতর স্বরে
বলিলেন - প্লীজ, ম্যানেজ
করিয়া লও। আমি ভীষণ ব্যাস্ত আছি। বিপদের
সময়ও ধীরস্থির গতিতে মস্তক সঞ্চালন করা রাজনৈতিক নেতৃত্বের মহামূল্যবান গুণ।
ইতিপূর্বে শোনা প্রাইভেট টিউশনি শব্দটি হৃদয়ে ধাক্কা মারিতেছিল, কিন্তু তাহা
উদর গুরগুর করিবার নিমিত্ত চিন্তাশক্তির শেকড় পাইতেছিল না। এবার সূর্যের ছটার
ন্যায় মনে মনে ছক কষিতে লাগিলেন - ওই ঘুঁটে ঘাঁটাঘাঁটি - গোবরে পদ্মফুল - নিজস্ব
শিল্প - অপরকে দায়ী করা যাবেনা। প্রাইভেট টিশনির টিউটর - অন্যকোন ব্যক্তির গর্দানে
দোষ দেওয়া সঠিক হইবেক না। নিজেই ইউরেকা ইউরেকা বলিয়া - ঐ গৌরাঙ্গের ন্যায় দুই হস্ত
উর্দ্ধে তুলিলেন - নিজেই নিজের বুদ্ধির প্রশংসা করিতে লাগিলেন। সর্বজন অবদিত, এ রাজ্যের
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় ৯৯ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রাইভেট টিউশনের দৌলতে শিক্ষালাভ করিতেছে।
ভাল ফলের আশায় সব অভিভাবকরা ষাঁড়ের ন্যায় ছুটিতেছেন। এক্ষণে বিদ্যালয় সমূহের
পঞ্চত্ব প্রাপ্তি করাইয়া প্রাইভেট টিউশনির জন্য লাইসেন্স প্রথা চালু করা যাইতে
পারে।
ওই ছোট ছোট ঘুঁটেরা একত্রিত হইয়াই আগুন
ধরায়। স্কুলের পরিবর্তে যদি প্রাইভেট টিউটরদের লাইসেন্স দেওয়া হয় - ইহারাই
পড়াইবেন। স্কুল বন্ধ করিতে পারিলে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ উদ্বৃত হইবে, যাহা উৎসবে
ক্লাবে অনুদান হিসাবে বিতরণ করা যাইবে। উপরন্তু লাইসেন্স ফি হিসাবে অনেক অনেক
রূপিয়া রাজকোষে জমা পড়িবে। লাইসেন্স প্রদান করিবার সময় বাম হস্তে অগুনতি “ইনকাম” হইবে।
গ্রীষ্মাবকাশ কয়দিনের হইবে - তাহা লইয়া গরমাগরম তর্কের অবসান হইবে। কেন্দ্রীয়
সরকারের ৪৮৪ পৃষ্ঠার শিক্ষাদলিলে প্রকাশিত - ধাপে ধাপে বেসরকারিকরণ করা হইবে
শিক্ষাব্যবস্থা। “১৯৮৬ সালের
জাতীয় শিক্ষানীতি বা ২০০৫ ও ২০০৯ সালের জাতীয় পাঠক্রম কাঠামোতে সুস্পষ্ট উল্লেখ
ছিল, সমস্ত
শিক্ষা প্রকল্প হইবে ধর্মনিরপেক্ষ,
মূল্যবোধের ধারক,
গণতন্ত্রের পাশাপাশি সাম্য,
ন্যায়, স্বাধীনতা, মানুষের
মর্যাদা-অধিকার, নাগরিকের
কর্তব্যর প্রতি শিক্ষার দায়বদ্ধতা থাকিবে।”
অতএব প্রাইভেট কোচিং ‘শিক্ষানীতি’ বৈধ। বকলমে
এই উদার ব্যবস্থায় তৃণমূলস্তরের টোলগুলির টুঁটি চাপিয়া ধরিতে কোন বেগ পাইতে হইবে
না।
শিহরণে শিক্ষামন্ত্রীর মাথায় কলপ করা
অকালপক্ক কেশরাজি ভালুকের লোমের ন্যায় খাড়া হইয়া গেল। নিজ দাড়ি নিজ হস্তে মোচড়াইয়া
মনে মনে ভাবিলেন - এত সুন্দর,
মসৃণ বুদ্ধিটা কেন এতদিন মস্তকাসীন হয় নাই। আগামী বিধানসভা অধিবেশনের পূর্বেই
অর্ডিনেন্স আনিব। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যখন প্রাইভেট টিউটর হইতেই লাভবান হইতেছে
- তাহা হইলে, অতঃপর
- এমতাবস্থায় স্কুলের কোন প্রয়োজন মনে করিতেছিনা। শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন
করিয়া আমরা এক নতুন দিগন্ত প্রসারিত করিব। শিক্ষার্থীকে কষ্ট করিয়া মোট বহিবার মতো
মোটাসোটা ব্যাগ লইয়া আর স্কুলে গমন করিতে হইবে না। পাড়ার প্রাইভেট টিউটররা কোচিং
করাইবে। কেবল লাইসেন্স প্রাপ্ত শিক্ষকরাই তাহাদের কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে বোর্ডের
ফাইনান পরীক্ষায় নির্ধারিত ‘ফি’ জমা করিয়া
অংশগ্রহনের অনুমতি পাইবে। সুব্যবস্থার সুব্যবহারে ছেলে-মেয়েদের কত মূল্যবান সময়
সাশ্রয় হইবে। সরকারকে শিক্ষকদের বেতন বা বেতনবৃদ্ধি, প্রাতিষ্ঠানিক নির্বাচন করাইবার দাবীতে কোন আন্দোলন সহিতে
হইবে না। শিক্ষকদের বদলির সমস্যা। বিশেষ করিয়া শিক্ষিকারা বিশেষ বিশেষ স্ত্রী রোগ
দেখাইয়া বদলির দরখাস্ত করিয়া শিক্ষাভবনকে বিড়ম্বনায় ফেলিবার অবকাশ পাইবে না।
বস্তুতঃ সব মাদ্রাসা,
টোল এমনকি বেসরকারী বিদ্যালয় গুলিতো বৃহদাকারের কোচিং সেন্টার বলিলে অত্যুক্তি
করা হইবে না।
আলোচ্য বিষয় শিক্ষা, আমরা যাহাকে
এডুকেশন বলি, কথাটা
ল্যটিন লেখা থেকে এসেছে। ‘ই
ডিউকো’ মানে
‘টু
ব্রিং আউট’ অর্থাৎ
বার করে আনা। ছাত্রদের মধ্যে যে সুপ্ত ক্ষমতা, তার বহিঃপ্রকাশ জরুরী। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ও বলিয়াছিলেন -
চার দেওয়ালের মধ্যে শিক্ষাকে আবদ্ধ রাখিলে উহা প্রসারিত হইবে না।
দিব্যচক্ষে শিক্ষামন্ত্রী দেখিলেন উপরোন্তু
সরকারী শিক্ষকরা প্রাইভেট টিউশনি করিতেছে বলিয়া সব অভিযোগে জল ঢালিয়া দেওয়া যাইবে।
জ্ঞানী ও বিবেচক শিক্ষামন্ত্রী - ওনাকে
অনেক খোঁজখবর রাখিতে হয় যাহা আম আদমীর গোচরে নাই। ২০২১ সাল থেকে এমনিতেই বিদ্যালয়ে
ভর্তি হইবার হার খুবই কম হইয়া যাবে। হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখন্ড বা অন্ধ্রপ্রদেশ - যে সব অঞ্চলে জনসংখ্যার ঘনত্ব
কম, সেখানে
ইতিমধ্যেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে পড়ুয়া সংখ্যা হ্রাস পাইতেছে। জাপান, চীন, দক্ষিণ
কোরিয়া, কানাডাতেও
স্কুলে ছাত্রাভাবের কারনে হয় বহু স্কুল বন্ধ নতুবা জুড়িয়া দেওয়া হইতেছে অনেক
স্কুলকে একসঙ্গে। তৈরি হবে নবকলেবরে শিক্ষাব্যবস্থা। যাদের ক্ষমতা থাকবে না - তারা
ঘরে বসে কম্পিউটারে সেলফ লার্নিং কোর্সে শিক্ষা নেবে।
এই নব্যব্যবস্থার ফলস্বরূপ জিডিপি দর চড়চড় করিইয়া বৃদ্ধি পাইবে, ঢিলে সফেদ পাঞ্জাবি ধারণ করিয়া অর্থমন্ত্রী শির ফুলাইয়া বিধানসভায় হিসাব দেবেন। দিব্যচোক্ষে শিক্ষামন্ত্রী দর্শন করিলেন - এই উদ্ভাবনী শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলন করিবার পুরষ্কার স্বরূপ হাভাতে ইউনিভার্সিটি বা অজানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশেষ সাম্মানিক ডি.লিট উপাধির জন্য মনোনিত করা হইয়াছে। গোল চশ্মার কাঁচটি সন্তর্পণে খদ্দরের রুমাল দিয়া মুছিয়া শান্তিনিকেতনী কারুকার্য্য করা সিল্কের নীল-সাদা হাফ-হাতা পাঞ্জাবির বুক পকেটে রাখিয়া শিক্ষামন্ত্রী আবার স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিয়া নয়ন মুদিতেই উদর ভুটভাট করিতে লাগিল।
===============================
গল্প-৬
ফিরিয়ে দাও
নীতিকা চ্যাটার্জী
— "কেমন আছ রোহন?"
—''ভালো নেই মণিমা।"
—"কেন?"
—"আমার মন খারাপ।"
—"কেন?বাবা,মা কেউ বকেছেন?"
—"না।"
—"তবে?"
—"আমার রিঙ্কি,
পাপাই, টুম্পী, সোহম কারও সঙ্গে দেখাই হয় না। কতদিন খেলতে যাইনি। তুমিই বলো
মণিমা,
এভাবে কেউ থাকতে পারে?"
—"তুমি ফোনে বুঝি কথা বলো না?"
—"আমাদের বাড়িতে তো একটাই ফোন মণিমা।
বাবার দরকার,
মায়ের দরকার, দাদাভাইয়ের
দরকার। আমাকে কেউ দিতেই চায় না। বলে আমি নাকি ছোট। আমার বুঝি মন নেই?একলা আমার সময় মোটেও কাটতে চায় না।"
—"তবে তুমি গল্পের বই পড় না কেন রোহন?"
—"পড়ি তো।সব সময় ভালো লাগে না। এই দেখো না, রথের মেলায়
যাওয়াই হল না। বাবা বললেন,
মেলা কোথায়? রথ তো টানাই
হয়নি। সামান্য কিছু পূজা হয়েছে রথের।
তাছাড়া বাইরে বেশি না যাওয়াই ভালো।
পড়াশুনা,পরীক্ষা কিছুই তো হচ্ছে না। একসময় পরীক্ষা,পড়াশুনা মোটেও ভাল লাগত না। আজ বলছি—
ও করোনা তুমি যাও-
স্কুলে যাওয়া,
পড়াশুনা, পরীক্ষা -ফিরিয়ে
দাও-
কথা দিচ্ছি - আর একদম দুষ্টুমি করবো না।
লক্ষ্মীটি আমাদের খেলাধূলা ফিরিয়ে দাও। আমাদের খুব কষ্ট।"
===============================
গল্প
ভয়
নির্মলেন্দু কুণ্ডু
একটা নামি বেসরকারি স্কুলে চলছে পার্সোনাল এক্সপেরিয়েন্স শেয়ারিং পিরিয়ড ৷
মূলতঃ বাচ্চাদের মধ্যে থেকে তাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্পর্কে তাদের অনুভূতি
তাদের ভাষায় যাতে তারা প্রকাশ করতে পারে, সেজন্যই এই
ব্যবস্থা ৷ এখন তো সবই অনলাইনে ৷ তেমনই এক ক্লাসে আরও অনেকের সাথে জয়েন হয়েছে সোহম
৷ এবছর ক্লাস ফোরে উঠেছে ও ৷ লক ডাউনের জেরে বেশ কয়েক মাস স্কুল বন্ধ ছিল, এখন শুরু হয়েছে ৷
ম্যাডাম অনলাইন হতেই একে একে জয়েন করেছে রিতিশা, সায়ন, সুমি, ভিকি সহ সোহমের বন্ধুরা ৷ ম্যাম এসেই জানালেন— "ডিয়ার স্টুডেন্টস, আজ আমরা একটু গল্প করবো ৷ "
গল্পের নাম শুনেই একগাল হাসি খেলে গেল বাচ্চাদের মুখে ৷
— "ম্যাম,
আপনি বলবেন গল্প ?" সুমির প্রশ্ন
—" না,
বলবে তোমরাই ৷ ইন ফ্যাক্ট, গল্প না,
এ তোমাদের পার্সোনাল এক্সপেরিয়েন্স শেয়ারিং"
—"ও,
সেই গত বছর যেমন পুজোর ছুটির পর বলতে বলেছিলেন কে কোথায়
ঘুরতে গেছিলাম.." ,
বলে উঠল ভিকি ৷
—" অনেকটা ওইরকমই ৷ তবে আজকের টপিক ভয় ৷"
—"ভয় !" ,
কৌতূহলী প্রশ্ন সায়নের ৷ কৌতূহলটা অবশ্য সবারই হয়েছে ৷
—" হ্যাঁ,
তোমাদের বলতে হবে কার কীসে সবথেকে বেশি ভয় করে আর কেন ৷ যে
বেস্ট বলবে,
তাকে আমি স্কুল খুললে একটা চকলেট খাওয়াবো ৷ তাহলে শুরু করো, প্রথমে রিতিশা ৷"
—" ম্যাম,
আমার হরর স্টোরিতে খুব ভয় করে, পড়ার পরেই মনে হয় এই বুঝি কোন ঘোস্ট আমার পাশে এসে দাঁড়ালো, আমার গায়ে শ্বাস ফেললো ৷ আমি তো ভয়ে রাতে একা একা টয়লেটেই
যেতে পারি না ৷" রিতিশার ছোট্ট উত্তর ৷
—"ধুস,
ভূত বলে কিছু নেই, এটা জানিস না
৷ আর অত যদি ভয়,
পড়িস কেন ?", ভিকি বলে উঠল ৷
—" কিপ কোয়ায়েট ৷ অন্য কেউ কথা বলবে না ৷ আচ্ছা, ভিকিই বল এবার ৷",
ম্যাম বললেন
—" ম্যাম,
আমার মা-র চোখকে খুব ভয় করে ৷"
—"মা-র চোখ !",
ম্যাম অবাক হয়ে বললেন
—" হ্যাঁ,
ম্যাম, আপনি মা-কে দেখেননি
৷ এমনিতেই বড় বড় চোখ ৷ তার ওপর রেগে গেলে আরও বড় হয়ে যায় ৷ সেদিনই তো বাপির ওপর
রেগে গিয়ে মা এইসা বড় বড় চোখ করলো, আমি তো চুপ
হয়েই ছিলাম,
বাপিও দেখলাম মুখ নিচু করে চলে গেল ৷"
ভিকির কথার ধরণে সবাই হেসে উঠল ৷
ম্যাম হাসি সামলে বললেন— "আচ্ছা, আচ্ছা, ঠিক আছে ৷ এবার সোহম
বলো ৷"
সোহম এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল ৷ ওর টার্ন আসতেই ও এক পলক থেমে বললো— "ম্যাম, আমার খিদেকে খুব ভয় লাগে !"
—"খিদের ভয়,
সেটা আবার কী ?" ম্যামও কৌতূহলী হলেন ৷
—" ম্যাম,
সোহম হচ্ছে পাক্কা ফুড লাভার ৷ ও সব খায় ৷" রিতিশা বলে
উঠল ৷ বাকিরাও হেসে ফেললো ৷
—"কিপ কোয়ায়েট ৷ বললাম না, কেউ কথা বলবে না ৷
সোহম,
পরিষ্কার করে বলো তো, কী বলতে
চাইছো ৷" ম্যাম জিজ্ঞেস করলেন
—" ম্যাম,
আমার পাপা আর মাম্মি আমায় ভীষণ ভালোবাসে ৷ আমি যা চাই, তাই এনে দেয় ৷ আমি খুব খেতে ভালোবাসি বলে আমায় নানারকম
খাবার খাওয়াতো—
হয় কিনে, নয় রান্না করে ৷
কিন্তু দু মাস আগে কি যে হল, বুঝলাম না ৷ পাপার
অফিস লকডাউনে কিছুদিন বন্ধ থাকার পর আবার খুলেছিল ৷ পাপাও যাচ্ছিল ৷ হঠাৎ করেই
দেখলাম,
পাপা কদিন ধরে বাড়িতে বসে ৷ মাঝে মাঝেই মাম্মির সাথে কিসব
কথা বলছে,
আমি কাছে গেলেই চুপ করে যাচ্ছে ৷ তারপর একদিন দেখলাম পাপা
আবার কাজে বেরোনোর ড্রেস পরছে, কিন্তু ঐসময় তো পাপা
অফিস যায় না,
পাপাকে জিজ্ঞেস করতে বললো, নতুন অফিসে নতুন কাজ পেয়েছে ৷ দিয়েই চলে গেল ৷ তারপর থেকে দেখছি, মাম্মি কম খাবার তৈরি করছে ৷ এই তো সেদিন ডোমিনোজের পিৎজা
কাউন্টার খুললো,
বাপিকে বললাম, বাপি বললো
ওসব ফাস্ট ফুড খেতে হয়না ৷ মাম্মি বললো আমায় বাড়িতেই করে দেবে ৷ কিন্তু তাও দিল না
৷ আমি যতবার বলি মাম্মি আজ করবো-কাল করবো বলে এড়িয়ে যায়, আর পাপা কিচ্ছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় ৷ গত মাসের শেষের
দিকে তো রাতে খিদে পেলেই মাম্মি দুধ-রুটি দিত, যত বলি আমার
ভালো লাগে না দুধ-রুটি,
তাও খাওয়ায় ৷ জানেন ম্যাম, একদিন তো আমি রেগে বলেই ফেললাম, আমায় আজ
তন্দুরি খাওয়াতে হবে,
নইলে কিচ্ছু খাবো না ৷ আমায় সেদিন মাম্মি চড় মারলো, ম্যাম ৷ মাম্মি কোনদিন আমায় মারেনি ম্যাম ৷ বাপিকে নালিশ
করলে বাপি আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো মাম্মিকে বকে দেবে ৷ জানেন ম্যাম, সেদিন দেখলাম বাপি
চোখ মুছছে ৷ সেদিন থেকে খিদেকে খুব ভয় লাগে ৷ বাপি-মাম্মিকে আমি খুব ভালোবাসি, ম্যাম ৷ কিন্তু কোন পছন্দের খাবার খেতে চাইলেই যে ওদের
মুখ-চোখ কেমন হয়ে যায়,
ম্যাম ৷"
একটানা কথাগুলো বলে থামলো সোহম ৷ কারও মুখে তখন কোন কথা নেই ৷ ম্যামও কোন উত্তর না দিয়ে বোবার মতো তাকিয়ে রইলেন কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে ৷
===============================
অনুবাদ গল্প
জ্যাক ও মটরশুটি
দীপক আঢ্য
(প্রাক-কথন—
প্রিয় ছোট্ট বন্ধুরা, এই লকডাউনের সময়ে তোমরা যেমন ঘরে বসে আছো, তেমনি আমরা যারা বড়, তারাও কমবেশি
তোমাদের মতই ঘরে আবদ্ধ। আমরা সকলেই জানি, করোনা ভাইরাস
নামক একটা ভাইরাস সারা পৃথিবীতে অতিমারির সৃষ্টি করেছে। এর ফলে আমাদের স্বাভাবিক
যাপন বন্ধ। স্কুল,
কলেজ, অফিস আদালত সবই
প্রায় থমকে আছে। কিন্তু থমকে নেই অপর একটা বিষয়। সেটা হল ঘরে বসে এটা-ওটা পড়া। বরং
স্কুলের পড়ার চাপ বেশি না থাকায় এই অতিমারি আমাদের কাছে সুযোগ এনে দিয়েছে আরও বেশি
বেশি করে পড়ার। আর আমরা সেই সুযোগ কেন হেলায় হারাবো? বরং চলো এই সুযোগে আমরা চট্ করে ঘুরে আসি আমাদের সাহিত্য জগতের কোনও এক নতুন
পাঠে।
তোমরা নিশ্চয় সকলেই রূপকথার গল্প পড়েছ বা শুনেছ। সাহিত্যে এই রূপকথার ইতিহাস
যেমন প্রাচীন,
তেমনই গৌরবময়। বিশ্বে এমন কোনও দেশ বা জাতি নেই যে তাদের
নিজস্ব রূপকথার গল্প নেই। কে বা কবে এই রূপকথার গল্পের সৃষ্টি করেছিলেন তা যদিও
জানা সম্ভব নয়,
তবে সেসব রূপকথার গল্প যে আমাদের মুহূর্তে সেই সময়ে আর সেই
সুদূর কালে নিয়ে গিয়ে ফেলে,
তা অস্বীকার করা যায় না। চলো—আজ আমি তোমাদের সেই রকম একটা রূপকথার গল্প শোনাই। তোমরা তো নিশ্চয়
ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমীর গল্প পড়েছ, লালপরী নীলপরীর গল্প
পড়েছ বা শুনেছ—এসবই হল আমাদের মানে ভারতবর্ষের রূপকথার গল্প। কিন্তু আজ
আমি তোমাদের শোনাব ভারতবর্ষের নয়, সুদূর আমেরিকার
রূপকথার গল্প। আশা করি তোমাদের ভালো লাগবে। তাহলে শুরু করি...)
জ্যাক এবং মটরশুঁটি
একসময় এক গ্রামে বাস করত এক দরিদ্র বিধবা মহিলা আর তাঁর ছেলে জ্যাক। তারা ক্রমশ এতই গরীব হয়ে উঠেছিল যে, একদিন জ্যাকের মা জ্যাককে বলল, তাদের গরুটা বাজারে বিক্রি করে তার পরিবর্তে কিছু নিয়ে আসতে। জ্যাক তার মায়ের কথা মত গোরুটাকে নিয়ে বাজারের পথে রওনা দিল। পথের মধ্যে একজন লোকের সঙ্গে জ্যাকের দেখা হল। সে বলল, সে গোরুটিকে কিনতে চায়। জ্যাক তাঁকে বলল, ‘তুমি আমাকে এই গোরুর পরিবর্তে কী দেবে?’
লোকটি উত্তর দিল,
‘আমি তোমাকে পাঁচটা জাদু মটরশুঁটি দেব।’
জ্যাক সেই লোকের কথা মত গোরুর বিনিময়ে পাঁচটা মটরশুঁটি নিয়ে বাড়ি চলে এল।
কিন্তু যখন সে বাড়িতে ঢুকল এবং সে তার মাকে বলল, সে গোরুর বিনিময়ে পাঁচটা মটরশুঁটি নিয়ে ফিরে এসেছে, তখন জ্যাকের মা জ্যাকের ওপর ভীষণ রেগে গেল। এতটাই রেগে গেল
যে সে জ্যাককে বোকা ,
হাঁদা বলে গাল পাড়ল। আর জ্যাকের হাত থেকে সেই পাঁচটা
মটরশুঁটির দানা নিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিল। এই ঘটনায় জ্যাক মনে মনে এতই দুঃখ
পেল যে সে,
সেই রাত্রে না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
পরের দিন যখন জ্যাক সকালে ঘুম থেকে জেগে উঠে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল, তখন সে দেখতে পেল একটা বিশাল মটরশুঁটি গাছ তার জানালার পাশ
দিয়ে বেড়ে উঠেছে। সে নিঃসন্দেহ হল, এটা তার ওই
জাদু মটরশুঁটির দানা থেকেই জন্মেছে। সে সঙ্গে সঙ্গে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসল। আর
দেখল গাছটা এত দীর্ঘ যে সেটা আকাশ ছুঁয়ে ফেলেছে। মাথা দেখা যায় না।
খুব বেশি না ভেবেই জ্যাক তখনই সেই মটরশুঁটি গাছে বেয়ে উপরে উঠতে লাগল। উপরে
উঠতে উঠতে সে একসময় পৌঁছে গেল আকাশের ভিতর এক রাজ্যে। সেখানে বাস করত এক দৈত্য আর
তার স্ত্রী। জ্যাক তার বাড়ির ভিতরে ঢুকল। সে দেখল, দৈত্যের স্ত্রী রান্না ঘরে রয়েছে। জ্যাক তাকে দেখা মাত্রই বলল, ‘আমার খুব খিদে পেয়েছে। আমায় কিছু খেতে দাও না।’ দৈত্যের স্ত্রী ছিল ভীষণ সহৃদয় মহিলা। সে সঙ্গে সঙ্গে
জ্যাককে কয়েকটা রুটি আর দুধ খেতে দিল।
যখন জ্যাক মহা আনন্দে তার ভোজ সারছে, তখনই দৈত্য
বাড়ি ফিরে এল। দৈত্য ছিল চেহারায় বিশাল এবং দেখতেও ভয়ংকর। জ্যাক তাকে দেখেই ভয়
পেয়ে গেল আর তৎক্ষণাৎ লুকিয়ে পড়ল ঘরের ভিতরে।
দৈত্য চিৎকার করে তার স্ত্রীর নাম ধরে বলল, ‘ফি-ফাই-ফো-ফাম,
আমি যেন ইংরেজ ছেলের গন্ধ পাচ্ছি। সে জীবিতই হোক আর মৃত, আমি তার হাড় গুঁড়ো গুঁড়ো করে রুটি দিয়ে খাবো।’
দৈত্যের স্ত্রী বলল,
‘না-না, এখানে কোনও ছেলেই নেই।’
দৈত্য তার কথা শুনে বিশ্বাস করল এবং
ডিনার শেষ করে নিজের ঘরে চলে গেল। সেদিন দৈত্য ঘরে আসার সময় এক-বস্তা
স্বর্ণ মুদ্রা নিয়ে এসেছিল। ডিনার শেষ করে সে সেই বস্তার স্বর্ণ মুদ্রাগুলো গুনে
পাশে রেখে ঘুমিয়ে পড়ল। রাত্রি যখন গভীর হল, জ্যাক তার
লুকানো জায়গা থেকে বেরিয়ে আসল। সে চুপি চুপি দৈত্যের পাশে গেল আর তার স্বর্ণ
মুদ্রার বস্তাটাকে নিয়ে দ্রুত নেমে এল মটরশুঁটি গাছ বেয়ে। বাড়িতে ফিরে সে স্বর্ণ
মুদ্রার বস্তাটাকে তার মা’র কাছে দিতেই তার মা খুব খুশি হয়ে উঠল।
এই ঘটনার বেশ কয়েক দিন পরে, জ্যাক আবার মটরশুঁটি
গাছ বেয়ে দৈত্যের বাড়িতে গেল। জ্যাক আবার তার বাড়ির ভিতরে ঢুকল। এবারও সে দেখল, দৈত্যের স্ত্রী রান্না ঘরে রয়েছে। জ্যাক তাকে দেখা মাত্রই
বলল,
‘আমার খুব খিদে পেয়েছে। আমায় কিছু খেতে দাও না।’ দৈত্যের স্ত্রী তার হাতের কাছে যা ছিল , তাই-ই স্নেহ ভরে তাকে খেতে দিল। যখন জ্যাক মহা আনন্দে
দৈত্যের স্ত্রীর দেওয়া খাবার খাচ্ছে, তখনই দৈত্য
ঘরের ভিতর ঢুকল। জ্যাক দৈত্যের আসা টের পাওয়া মাত্রই খাওয়া ছেড়ে লুকিয়ে পড়ল গোপন
আস্তানায়। দৈত্য ঘরে ঢুকেই তার স্ত্রীকে বলল, ‘ফি-ফাই-ফো-ফাম,
আমি যেন ইংরেজ ছেলের গন্ধ পাচ্ছি। সে জীবিতই হোক আর মৃত, আমি তার হাড় গুঁড়ো গুঁড়ো করে রুটি দিয়ে খাবো।’
দৈত্যের স্ত্রী বলল,
‘না-না, এখানে কোনও ছেলেই
নেই।’
রাত্রি যখন গভীর হল,
জ্যাক তার লুকানো জায়গা থেকে বেরিয়ে আসল। সে চুপি চুপি
দৈত্যের পাশে গেল আর তার জাদু মুরগিকে নিয়ে দ্রুত নেমে এল মটরশুঁটি গাছ বেয়ে।
জ্যাকের মা জাদু মুরগি পেয়ে ভীষণ খুশি হয়ে উঠল।
বেশ কয়েকদিন পরে জ্যাক আবার মটরশুঁটি গাছ বেয়ে দৈত্যের বাড়িতে গেল। জ্যাক আবার
তার বাড়ির ভিতরে ঢুকল। এবারও সে দেখল, দৈত্যের
স্ত্রী রান্না ঘরে রয়েছে। জ্যাক তাকে দেখা মাত্রই বলল, ‘আমার খুব খিদে পেয়েছে। আমায় কিছু খেতে দাও না।’ দৈত্যের স্ত্রী তার হাতের কাছে যা ছিল , তাই-ই স্নেহ ভরে তাকে খেতে দিল। যখন জ্যাক মহা আনন্দে
দৈত্যের স্ত্রীর দেওয়া খাবার খাচ্ছে, তখনই দৈত্য
ঘরের ভিতর ঢুকল। জ্যাক দৈত্যের আসা টের পাওয়া মাত্রই খাওয়া ছেড়ে লুকিয়ে পড়ল গোপন
আস্তানায়। দৈত্য ঘরে ঢুকেই তার স্ত্রীকে বলল, ‘ফি-ফাই-ফো-ফাম,
আমি যেন ইংরেজ ছেলের গন্ধ পাচ্ছি। সে জীবিতই হোক আর মৃত, আমি তার হাড় গুঁড়ো গুঁড়ো করে রুটি দিয়ে খাবো।’
দৈত্যের স্ত্রী বলল,
‘না-না, এখানে কোনও ছেলেই
নেই। এরকম বোকার মত কথা বোলো না তো।’
দৈত্য যেন একটু দমে গেল। আজ তার হাতে ছিল একটা জাদুর বীণা। সে বীণা অনন্য
সুন্দর সুরের মূর্ছনা জাগাতে সক্ষম।
আজও দৈত্য তার মাথার কাছে বীণাটিকে রেখে ঘুমিয়ে পড়ল। রাত গভীর হলেই জ্যাক তার
লুকানো জায়গা থেকে বেরিয়ে বীণাটিকে হাতে তুলে যে মুহূর্তে পালাতে যাবে, সেই মুহূর্তে বীণা নিজেই চিৎকার করে উঠল, ‘বাঁচাও প্রভু! একটা ছেলে আমাকে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে! আমাকে
বাঁচাও!’
বীণার চিৎকারে দৈত্যের ঘুম ভেঙে গেল। সে দেখতে পেল জ্যাকের হাতে বীণা। জ্যাককে
দেখা মাত্রই সে রাগে প্রায় উন্মত্ত হয়ে উঠল। জ্যাককে ধরার জন্যে সে ঘর থেকে বেরিয়ে
এল দ্রুততার সঙ্গে।
কিন্তু জ্যাক ছিল দৈত্যের থেকেও দ্রুতগামী। চটপটে। দৈত্য যখন তাকে ধরার জন্যে তাড়া করল তখন সে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছে। জ্যাক আরও দ্রুত ছুটতে শুরু করল। সে মটরশুঁটি গাছ ধরল আর একই ক্ষীপ্রতায় গাছ বেয়ে নামতে লাগল। যখন জ্যাক নিচে নেমে এল, সে দেখল দৈত্য তখন গাছের অনেক উপরে। জ্যাক তৎক্ষণাৎ তার ঘরে ঢুকে বড় কুড়ুল এনে মটরশুটি গাছের গোড়ায় কোপ দিতে লাগল। মুহূর্তে গাছটি কাটা পড়ল।
জ্যাক আর তার মা তারপর থেকে মহা সুখে বাস করতে লাগল।
===============================
দিনলিপি-লিখন
করোনাকালে পিঙ্কির দিনলিপি
অসিত কুমার পাল
১ লা জানুয়ারী, ২০২০ :
আমার নাম অন্বেষা দাস , ডাকনাম পিঙ্কি , বয়স 14 বছর । আমি হাওড়া জেলার গোকুলনগর গ্রামে থাকি , এখানকার সরোজিনী বালিকা বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি । আমি ক্লাশে প্রথম হই , তবুও আমার দাদা বলে আমার মাথায় নাকি গোবর পোরা আছে । অবশ্য আমি অঙ্কে আর ইংরেজিতে একটু কাঁচা , তাই ওই দুটি বিষয়ে প্রাইভেটে টিউশন নিই । এছাড়া আমি প্রতি শনিবার বিকালে আঁকা শিখি আর রবিবার সকালে নাচ শিখি ।
ভাবছেন এত কথা কেন বলছি ? আসলে গতকাল আমার মামা আমাকে একটা ডায়েরি উপহার দিয়ে বলেছে জীবনের বিশেষ বিশেষ ঘটনাগুলো লিখে রাখতে , এছাড়া মনের বিশেষ অনুভূতির কথাও লেখা যাবে । আমি হয়তো প্রতিদিন ডায়েরি লিখতে পারব না , তবে মাঝে মাঝে লেখার চেষ্টা করব । আজ এই পর্যন্ত থাক ।
১৫ ই মার্চ , ২০২০ :
অনেকদিন ডায়েরি লেখা হয়নি । যদিও আমি নিয়মিত খবরের কাগজ পড়িনা , তবু কিছুদিন ধরে শুনছিলাম চীনদেশে নাকি করোনা নামে নতুন এক ধরনের ভাইরাসের আক্রমণে বহু মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়েছে । কয়েকদিন ধরে সর্দি আর জ্বরে ভুগে অনেকে নাকি মারাও গেছে । এটি খুব সংক্রামক রোগ , যদিও জল বা বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায় না । কেবল হাঁচি কাশির মাধ্যমে আশপাশে থাকা মানুষরা আক্রান্ত হয় । বিশেষজ্ঞরা বলছেন - মুখে বিশেষ ধরনের মাস্ক পরে থাকলে আর পরস্পরের থেকে অন্তত তিনফুট দূরত্ব বজায় রাখলে রেহাই পাওয়া যেতে পারে । রোগটি যাতে ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেজন্য চীনারা উহান নামের একটি শহরের সাথে অন্য এলাকার যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে । তবুও রোগটি চীনদেশে থেকে নাকি অন্যদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে । বিদেশ থেকে আসা কিছু লোকের মাধ্যমে আমাদের দেশেও বেশ কিছু মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে । বিজ্ঞানীরা ওই রোগের প্রতিষেধক ওষুধ আবিষ্কার করার চেষ্টা করছে বলে শুনেছি ।
২৩ শে মার্চ , ২০২০ :
সবাই বলাবলি করছে ভারতে করোনা রোগ ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে । বিদেশ থেকে আসা মানুষের মাধ্যমেই এই রোগ ছড়াচ্ছে বলে মনে হয় । রোগের চিকিৎসায় সরকার উপযুক্ত ব্যবস্থা নিচ্ছে । আক্রান্ত মানুষদের আলাদা করে রাখার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে । যে সব ডাক্তার ও নার্স ওদের চিকিৎসা করছেন, তাঁরাও সাবধানে থাকছেন । প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধ মেনে গতকাল সন্ধ্যে ছটার সময়ে সারা দেশের মানুষ বাড়ির বাইরে এসে থালা বা ঘণ্টা বাজিয়ে করোনা রোগের চিকিৎসায় নিযুক্ত ডাক্তার ও নার্সদের উৎসাহ দিয়েছে । আজ সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী আগামী ২৪ তারিখ থেকে টানা একুশ দিন গাড়িঘোড়া দোকানবাজার স্কুলকলেজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন । এছাড়া বিনা প্রয়োজনে সাধারণ মানুষের বাইরে বের হওয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে । অবশ্য খাবার, ওষুধ ইত্যাদি কেনাকাটা করার জরুরি প্রয়োজনে মাস্ক দিয়ে নাক মুখ ঢেকে বাইরে যাওয়া যাবে । এটাকে ঘরবন্দি অবস্থা বা লকডাউন বলা হচ্ছে । এর ফলে যারা বাড়ির বাইরে দূর-দূরান্তে থাকে, তারা খুব অসুবিধায় পড়বে বলে মনে হচ্ছে । আমিও বাড়ির বাইরে গিয়ে বন্ধুদের সাথে দেখা করতে পারব না । এমন অবস্থা নাকি আগে কখনো ঘটেনি ।
২৮ শে মে, ২০২০ :
মার্চের শেষদিকে যে লকডাউন চালু হয়েছিল কয়েক দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে তা এখনো চলছে । বাসট্রেন দোকানবাজার স্কুলকলেজ এখনো বন্ধ আছে । কেবল দরকারি জিনিস কিনতে মানুষ মাস্ক পরে বাইরে বের হচ্ছে । আমার স্কুল, টিউশনি, নাচের, আঁকার ক্লাস সব বন্ধ । মা আমাকে বাড়ির বাইরে যেতে দেয়না , বাড়িতে যেন বন্দী হয়ে আছি । বাস বন্ধ থাকায় দাদা বাড়িতে বসেই অফিসের কাজ করছে । বাবাও দোকান খুলতে পারছে না বলে বাড়িতে মনমরা হয়ে বসে থাকে । মাঝে একদিন মিড ডে মিলের চাল আনতে বাবার সঙ্গে স্কুলে গিয়েছিলাম । সেখানে কজন বন্ধুর সঙ্গে দেখা হল, তাদেরও একই অবস্থা ।
এদিকে সপ্তাহখানেক আগে দক্ষিনণঙ্গে ভীষণ ঘূর্ণিঝড় আমফান বয়ে গেছে । দুদিন ধরে একটানা বৃষ্টি আর তার সঙ্গে ভীষণ ঝড়ে সুন্দরবন এলাকায় প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে । বাঁধ ভেঙে অনেক জায়গা ডুবে গেছে , ঘরবাড়ি পড়ে গেছে বলে শুনেছি । আমাদের বাড়িরও পাঁচ-ছ' টা গাছ পড়ে গেছে । বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে গেছে । সাতদিন ধরে বিদ্যুৎ নেই বলে পড়াশোনাও করতে পারছি না । এই অবস্থা কতদিন চলবে কে জানে ?
৩০ শে সেপ্টেম্বর ২০২০ :
করোনা নাকি বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে ।
কিছুদিন আগে লকডাউন উঠে গেছে । দোকান বাজার খুলেছে, অল্প অল্প বাস ট্রেন চলছে । দু' চারজন আশেপাশে কাজে যেতে পারলেও যাদের কিছুটা দূরে যেতে হয় তারা কাজে যেতে পারছে না । অনেকের নাকি কাজ চলে গেছে ।
কিন্তু স্কুলকলেজ এখনো বন্ধ । শুনেছি কোথাও কোথাও অনলাইনে পড়াশোনা চালু হয়েছে । কিন্তু আমাদের গ্রাম এলাকায় অনেকের কাছেই স্মার্টফোন নেই বলে অসুবিধা হচ্ছে ।
এখন বাড়িতে বসে নিজে নিজেই পড়ি, টিউশনি , নাচের ক্লাস এখনো বন্ধ । জানিনা এবছর পরীক্ষা হবে কি না ।
শুনছি এবছর দুর্গাপূজায় তেমন জাঁকজমক হবে না । মণ্ডপে নাকি ভিড় করা চলবে না । মাস্ক পরে দূর থেকে ঠাকুর দেখতে হবে । মানুষের হাতে নগদ টাকা কমে গেছে বলে অনেকেই বাড়ির ছেলেমেয়েদের নতুন জামাকাপড় কিনে দিতে পারবে না । অন্য বছর দু' সেট পোশাক পেলেও এ' বছর আমাকে একসেট পোশাক কিনে দেওয়া হবে বলে শুনছি ।
৩১ শে ডিসেম্বর, ২০২০ :
আজ ইংরেজী বছরের শেষদিন । ২০২০ সালটাতে দুটো ২০ আছে বলে সবাই বলছিল এটা নাকি বিষ অর্থাৎ বিষাক্ত বছর, কারণ এই বছরটা প্রায় সবারই খারাপ কেটেছে । অনেক করোনা আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছে , অনেকে কাজ হারিয়েছে , স্কুলকলেজ বন্ধ ৷ এমনকি আমার মত বয়সী ছেলেমেয়েরা বাড়িতে প্রায় বন্দীদশায় কাটাচ্ছি , খেলাধূলা করতে পারছি না , বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা করতে পারছি না । তাই এমন একটা বিচ্ছিরি বছর চলে যাচ্ছে বলে সবার মতো আমিও খুশি । স্কুলের পড়াশোনা প্রায় ন মাস বন্ধ থাকলেও সরকারের নির্দেশে সবাইকে পাশ করিয়ে দেওয়া হয়েছে । কোন পরীক্ষা না দিয়ে এই ভাবে প্রমোশন পেয়ে মোটেই আনন্দ হচ্ছে না ।
করোনার প্রকোপ কিছুটা কমলেও নতুন বছর শুরু হলেও এক্ষুনি স্কুল খোলার সম্ভাবনা নেই । এদিকে শুনছি বিজ্ঞানীরা করোনার টিকা আবিষ্কার করে ফেলেছে, এখন তার কার্যকারিতা পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে । সেই টিকা নিলে নাকি করোনার বিরুদ্ধে মানুষের শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউনিটি গড়ে উঠবে । অর্থাৎ টিকা নেওয়ার পরে কেউ করোনায় আক্রান্ত হলেও খুব বেশি ক্ষতি হবে না । আর মাস দুয়েক পর থেকে একে একে সবাইকে টিকা দেওয়া হবে । আশা করছি খুব শীঘ্রই মানুষ করোনা মহামারী থেকে মুক্তি পাবে ।
২০ শে এপ্রিল , ২০২১ :
আমাদের দেশে করোনার টিকা দেওয়া শুরু হয়ে গেছে । করোনা চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত ডাক্তার, নার্স ও চিকিৎসা কর্মীদের প্রথমে টিকা দেওয়া হচ্ছে, কারণ সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা তাঁদেরই বেশি । করোনা আবহাওয়ায় একসঙ্গে বহু মানুষের সমাবেশ নাকি সংক্রমণের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয় । কিন্তু ভোটপ্ৰক্রিয়া চলছে বলে আমাদের রাজ্যে প্রতিদিনই ছোটবড় জনসভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে , যেটা নিয়ে সচেতন মানুষরা চিন্তিত ।
এদিকে করোনার জন্য আরোপিত বিধিনিষেধ শিথিল হওয়ার পর মানুষ বাইরে বের হচ্ছে , নতুন করে সামাজিক মেলামেশা বেড়ে যাওয়ায় করোনা সংক্রমণ আবার বাড়তে শুরু করেছে । এটাকে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ বলা হচ্ছে । এতে অনেক বেশি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে এবং মহারাষ্ট্রের মত কিছু রাজ্যে বহু মানুষ মারা যাচ্ছে । উপযুক্ত ব্যবস্থা না নেওয়া হলে এই সংক্রমণ নাকি বিপজ্জনক মাত্রায় পৌঁছে যাবে । এই অবস্থায় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে । এক বছর ধরে স্কুল কলেজ বন্ধ , কবে যে স্বাভাবিক পড়াশোনা শুরু হবে কে জানে । আমার মনে হয় দীর্ঘদিন ঘরবন্দী থেকে সমস্ত ছাত্রছাত্রীই হতাশায় ভুগছে ।
২০ শে জুন , ২০২১ :
এপ্রিল-মে মাসে করোনা সংক্রমণের হার এত বেড়ে গিয়েছিল যে, বেডের অভাবে অনেকে হাসপাতালে ভর্তিই হতে পারেনি , প্রচুর মানুষ মারা গেছে শুনেছি । কোথাও কোথাও মৃতদেহ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছে । আমাদের গ্রামের আট-দশ জন লোক করোনার আক্রান্ত হয়েছিল বলে শুনেছি , তাদের মধ্যে একজন মারাও গেছে । এই অবস্থায় সরকার আবার লকডাউন
চালু করে ট্রেন-বাস বন্ধ করে অবস্থা কিছুটা আয়ত্তে আনার চেষ্টা করছে । তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন বহু মানুষের সমাবেশ বন্ধ করা না গেলে এবং প্রকাশ্যে মাস্ক ব্যবহার ও দূরত্ববিধি না মেনে চললে করোনার কয়েক মাস পরে করোনার তৃতীয় ঢেউ আসতে পারে, যা অনেক মানুষকে, বিশেষ করে বাচ্চাদের সংক্রমিত করবে বলে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা ।
এদিকে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবছর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা নেওয়া হবে না , পরিবর্তে পূর্ব পরীক্ষার ভিত্তিতে তাদের মূল্যায়ণ করা হবে । যে সব ছাত্রছাত্রী বাড়িতে বসেই পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়েছিল , তাদের অনেকেই এই সিদ্ধান্তে হতাশ । বুঝতে পারছি না এ বছরের মধ্যে আমি আবার স্কুলে গিয়ে পড়াশোনা করতে পারব কি না । ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছি, বসন্ত পোলিওর মত করোনাকেও পৃথিবী থেকে চিরতরে দূর করে দাও আর সমস্ত ছাত্রছাত্রীকে বন্দীদশা থেকে মুক্ত করো ।
===============================
পত্রসাহিত্য
ছোট্ট বন্ধুদের প্রতি
প্রণব ঘোষ
প্রিয় ছোট্ট বন্ধুরা,
আজ অনেকদিন পর তোমাদের একটা চিঠি লিখতে বসলাম ৷ তোমাদের একটা ছোট্ট গল্প বলি ৷
সেদিন আমাদের বাড়ির পাশে আমার বন্ধুর নাতনির জন্মদিনে গিয়ে ন বছরের অনুকে দেখে অবাক হয়ে গেলাম। উচ্ছল হাসিখুশি মেয়েটা কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছে। ওর নবম জন্মদিনের সন্ধ্যায় আমরা নিমন্ত্রিত হয়ে যখন গেলাম ও খুশিতে উদ্বেল হয়ে উঠল। বার্থডে কেক অনু যখন কাটল, আমরা সবাই মিলে গেয়ে উঠলাম, হ্যাপি বার্থডে টু ইউ অনু। কিন্তু কেক কাটার পরেই ও হঠাৎ বলতে লাগল, ওর বেষ্ট ফ্রেন্ড আসেনি কেন? আমরা যতই বোঝাতে লাগলাম, করোনার জন্য আসতে পারেনি, করোনা কেটে গেলে আসবে, ও ততই অবুঝ হয়ে কান্না শুরু করে দিল, আর বলতে লাগল কবে স্কুলে যাব, কবে ফ্রেন্ডদের সঙ্গে খেলব, কথা বলব? আমরা সবাই বললাম করোনা চলে গেলেই স্কুল খুলবে। সব বন্ধুদের সাথে দেখা হবে, গল্প হবে, খেলা হবে।
তোমরা তো জানোই, প্রায় দু বছর ধরে সারা পৃথিবী জুড়ে এক ভয়ঙ্কর অসুখ ঘরবন্দি করে রেখেছে তাবৎ শিশুদের। শুধু শিশু শরীরকে নয়, শিশু মনকেও বাক্সবন্দি করে রেখেছে এই করোনা দানব। বাড়ির গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থেকে থেকে শিশুরা হয়ে যাচ্ছে মনমরা। কোথায় গেল দু বছর আগের চনমনে হাস্যোজ্জ্বল স্কুল পড়ুয়ারা? অমলের মত বিষণ্ণ মনে জানলায় বসে দইওয়ালার কাছে খোঁজ নেয় বাইরের জগতের। আর পথচলতি মানুষদের কাছে মনে মনে বলে আমরা স্কুলে যেতে চাই, আমাদের বন্ধুদের ফিরে পেতে চাই।
এই অতিমারি-কালে তাই তোমাদের বলি, বাড়িতে থেকে পড়াশোনা কর, বাড়ির মধ্যে বা ছাদে একটু ছুটোছুটি কর,খেল। একটু বড়রা টবে ফুল গাছের যত্ন কর। আকাশ দেখ, পাখি দেখ। গল্পের বই পড়, ছবি আঁক, গান গাও। আর মনে মনে বেড়িয়ে এস মেঘ আর পাখিদের সঙ্গে পাহাড়ে, জঙ্গলে, সাগরে। মনে মনে বন্ধুদের সঙ্গে আড়ি কর, ভাব কর, ঝগড়া কর, গল্প কর। আর আশা নিয়ে থাকো স্কুল খুলল বলে, বন্ধুদের সঙ্গে মিলনের দিন এল বলে। সবাই ভালো থাকো, আনন্দে থাকো, হাসিতে খুশিতে থাকো ৷ আজ তাহলে এই পর্যন্তই ৷ টা টা ছোট্ট বন্ধুরা।
ইতি—
তোমাদের
মিষ্টি-জ্যেঠু
===============================
ছোটদের কলমে-১
দুই রাজপুত্রর গপ্পো
ঋদ্ধিমান ব্যানার্জী
একসময় একটি রাজার হিমাংশু নামে রাজপুত্র ছিল।সে ছিল এক মহাবীর।সে একদিন সন্ধে বেলায় আরো এক রাজকুমার ঋদ্ধিমানের সঙ্গে খুবই আনন্দিত হয়ে সাক্ষাতে গেল।কিন্তু ঋদ্ধিমান ছিল সেই দেশের সবথেকে বড়ো বীর।
হিমাংশু কলিং বেল বাজালো(ক্লিং ক্লিং!)
ঋদ্ধিমান বলল, "কে তুমি?"
হিমাংশু বলল, "আমি সবার থেকে বড়ো মহাবীর রাজার রাজকুমার, নাম আমার হিমাংশু"।
ঋদ্ধিমান বলল, "রাজসভায় আমার সাক্ষাতে কেউ এসেছে।যাও খুলে দাও দরজা আমার।"
রাজসভার সভাসদরা বলল, ''যথা আজ্ঞা রাজকুমার ঋদ্ধিমান।"
হিমাংশু ঢুকে এসে বলল, "কেমন আছো ভাই?"
ঋদ্ধিমান বলল, "চলছে একরকম ৷ বলো, তুমি কেমন আছো?"
হিমাংশু বলল, "বেশ আছি।আমার বাবা রাজা রাম।বাবাকে বলেছি আমার জন্য মুকুট কিনতে।যাই হোক, রাজা মহাশয় ও রাণী মাতা ভালো আছেন?"
ঋদ্ধিমান বলল, "চলছে একরকম।"
হিমাংশু বলল, "যাই হোক, ভালো থাকলেই ভালো।তো একদিন আমার রাজমহলে এসো।"
সেইমতো ঋদ্ধিমান রাজকুমার মহাবীর হিমাংশুর রাজমহলে গেল।
ঋদ্ধিমান কলিং বেল বাজালো(ক্লিং ক্লিং!)
রাজসভার সভাসদ দরজা খুলেই বলল, ''আসুন রাজকুমার ঋদ্ধিমান ৷ আমাকে রাজকুমার মহাবীর হিমাংশু বলেছেন আপনি আজ আসবেন।
(জোর গলায়) রাজকুমার, আপনার সাক্ষাতে রাজকুমার ঋদ্ধিমান এসেছেন।"
হিমাংশু- "ঠিক আছে।তাকে ওপরে আসতে বলো।আজ আমি খুব চিন্তিত।"
ঋদ্ধিমান- (ওপরে এসে) "আমি তোমার জন্য সাক্ষাতে এসেছি।আজ তোমায় বড় চিন্তিত চিন্তিত লাগছে।"
হিমাংশু- "হ্যাঁ।এই কয়দিন আগে আমাদের দেশে আরেক দেশের দৈত্য সেনা লড়াই করতে ঢুকেছে । করোনা-সেনা তাদের নাম ৷ সাধারণ মানুষকে এক এক করে ধরছে আর মারছে, যারা কোনক্রমে রক্ষা পাচ্ছে, তারাও খুব কষ্টে আছে ৷ এই যুদ্ধে সব কিছু লুপ্ত হয়ে যেতে পারে। আমায় এই দেশকে যেভাবেই হোক সুরক্ষিত রাখতে হবে। আমি তোমার সাহায্য চাই।"
ঋদ্ধিমান- "কিন্তু আমার দেশেও তো অনেক মানুষ আছে। তোমার দেশের ব্যাপারে যা বুঝছি তাতে আমার দেশকেও তো সুরক্ষিত রাখতে হবে।
তুমি যখন বলছো,তখন আমি নিশ্চয়ই সাহায্য করবো।"
হিমাংশু- "ধন্যবাদ। তোমায় অসংখ্য অসংখ্য ধন্যবাদ।"
ঋদ্ধিমান-"ঠিক আছে, ঠিক আছে।"
শেষে ঋদ্ধিমান কী হিমাংশুর সাহায্য করতে পারল?
তার কয়েকদিন পরই যুদ্ধক্ষেত্রে নিজেদের সেনা নিয়ে পৌঁছে গেল দুই রাজপুত্র ৷ সাথে অনেক শিশি ভর্তি ওষুধ, হাত ধোবার সাবান, মুখ ঢাকার মুখোশ ৷
হিমাংশু- "আজকে এই অঞ্চলে ঐ করোনা-সেনার আসার কথা।"
ঋদ্ধিমান- "আসুক! দেখাবো কাকে বলে যুদ্ধ ৷''
লড়াই শুরু হল।
হিমাংশুকে কী এমনি এমনি মহাবীর বলা হয়েছে? তলোয়ারের মধ্যে টিকা-বিষ মাখিয়ে তা চালিয়ে অনেক শত্রুকে মারলো।
আর ঋদ্ধিমানকেও কী এমনি যুদ্ধের খিলাড়ি বলা হয়েছে?বাণের গায়ে সেও ওষুধ মাখিয়ে সেগুলো চালিয়ে আরও অনেককে আঘাত করলো।
শেষে এক জন রইল।তার নাম কনেডোমারো।
ঋদ্ধিমান ও হিমাংশু একযোগে তাদের তরোয়াল আর বাণ চালাতে লাগলো ৷ বাকি সেনারাও ততক্ষণে আহত মানুষদের হাতে হাতে পৌঁছে দিচ্ছে সাবান, মুখোশ আর টিকা-ওষুধ ৷
কনেডোমারো আর পারবে কেন, কোনমতে সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচল ৷ তবে যাবার আগে হুঁশিয়ারি দিয়ে গেল— "কতদিন বাঁচাবে তোমাদের জনগণকে ? আমি আবার আসব ৷ কত টিকা ওষুধ কত তাড়াতাড়ি দেবে মানুষদের ?কতজন মুখোশ পরবে ? আমি ঠিক হামলা করব ৷"
এইভাবে এই যুদ্ধ শেষ হলেও দুই রাজপুত্রই ঘোষণা করল, দেশের সব মানুষকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব টিকা-ওষুধ দিতে হবে ৷ সবাই যেন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে, সে কথাও জানাল ৷ শেষে সবাই তাদের জয়জয়কার করতে লাগলো এবং তাদের মূর্তি বানালো।
===============================
ছোটদের কলমে-২
আনন্দ
সৃজনী সাহা
চতুর্থ শ্রেণী
হঠাৎ করে আমাদের বাড়িতে ইঁদুরের উৎপাত খুব বেড়েছে। প্রতি রাতে আমার সফট টয়গুলো ইঁদুর কেটে নষ্ট করছে। আমি তো কান্নাকাটি করছি। রান্নাঘর থেকে মা বললো, "এখন তোর খেলনা কাটছে, এরপর বই কাটবে, তারপর জামাকাপড় কাটবে।" বাবা বললো, "মহা মুশকিল! কিছু তো একটা করতে হবে, নাহলে গণেশের বাহনের জ্বালায় থাকা যাবে না।"
একদিন মা সকালে দেয়াল আলমারির ড্রয়ার খুলে দেখে ওষুধের পাতায় একটাও ওষুধ নেই। পাতাগুলো কে যেন টুকরো টুকরো করে রেখেছে। মা বললো, "এ নিশ্চয় ইঁদুরের কাজ।" আমি বললাম,"কী হয়েছে মা।" মা বললো, "ইঁদুর এবার ওষুধ খাচ্ছে দেখ।" বাবা বললো," ইঁদুরে ওষুধ খাচ্ছে! তুমি ঠিক বলছ তো?" মা বললো, "হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিকই বলছি। ইঁদুর দু'পাতা প্যারাসিটামল খেয়েছে।" আম্মা চা খেতে খেতে হেসে বললো, "মনে হয় করোনার ভয়ে ইঁদুর জ্বরের ওষুধ খাচ্ছে।" আম্মার কথায় আমি তো হেসে লুটোপুটি। তৎক্ষনাৎ পিসি-মাসি-মামা সবাইকে ফোন করে মজার খবরটা দিলাম। সবাই আমার কথা শুনে পাগলের মতো হেসে যাচ্ছে। দিদান বললো, "আ্যঁ,সে কিরে, ইঁদুরে মানুষের ওষুধ খাচ্ছে, এরকম কথা তো বাপের জন্মে শুনিনি।" আমি বললাম, "হ্যাঁ গো দিদান, আমিও কোনদিন শুনিনি।"
সারাদিন ধরে আমরা ইঁদুরের ওষুধ খাওয়ার কাণ্ড নিয়ে গল্প করছি, মজাও পাচ্ছি। বাবা বললো, "এবার ইঁদুর ধরার কল পাততেই হবে।" বিকেলে বাবা বাজার থেকে একটা ইঁদুর ধরার কল নিয়ে এলো। রাতে খাওয়া দাওয়ার পর এক টুকরো রুটির টোপ দিয়ে ইঁদুর ধরার কল বারান্দার মেঝেতে পেতে রাখা হল। কিন্তু পরের দিন সকালে দেখলাম কল ফাঁকা। রুটির টুকরো যেমন ছিল তেমনই আছে। আম্মা বললো, "এখনকার ইঁদুর খুব চালাক, সেজন্যই ধরা পড়ছে না।"
আর একদিন সকালে ড্রয়ার খুলতেই দেখা গেল অন্য একটি ওষুধের পাতা টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে আছে। মা বললো,"দেখেছ কাণ্ড ইঁদুর আবার ওষুধ খেয়ে ফেলেছে।" প্রতিরাতে বাবা কল পাতছে কিন্তু ইঁদুর কই! আমি বাবাকে বললাম," আমার মনে হয় ইঁদুরের রুটি পছন্দ না। আমার প্রিয় ক্রিম বিস্কুট দিয়ে দেখ না, হয়তো ইঁদুরের পছন্দ হতে পারে।"
রাতে খেয়েদেয়ে ঘুমোতে যাওয়ার আগে বাবা ইঁদুর-ধরা কলের ভেতর ক্রিম বিস্কুট রেখে দিল। অনেক রাত, বাবা-মা ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি কান খাড়া করে জেগে আছি। আজ যদি আমার পছন্দের বিস্কুটের লোভে ইঁদুর ধরা পড়ে। চারিদিকে চুপচাপ। হঠাৎ খটাস করে একটা শব্দ হল। আমি তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দার লাইট জ্বালিয়ে দেখি খুবই কিউট একটা ইঁদুর কলের মধ্যে আটকে পড়ে কুটুস কুটুস করে বিস্কুট খাচ্ছে। আমি তারপর বাবা-মাকে ডেকে তুললাম, "ওঠ ওঠ, ইঁদুর ধরা পড়েছে। ঘুমচোখে মা বললো, " যাক,শেষমেষ ইঁদুর ধরা পড়েছে।" বাবা-মা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। বাবা বললো, "এবার তাহলে ঘুমিয়ে পড় সোনামা।"
পরের দিন সকালে দেখি ইঁদুরটা পুরো বিস্কুটটা খেয়ে ফেলেছে। আমি বায়না করতে লাগলাম, "ইঁদুরটাকে পুষবো বাবা। দেড় বছর ধরে স্কুলে যেতে পারছি না। কোন বন্ধুর সঙ্গে খেলতে পারছি না। ওর সাথে আমি খেলব বাবা।" বাবা বললো," খেলবি কীভাবে, পুষতে হলে ওকে তো খাঁচা-বন্দী হয়েই থাকতে হবে। বাইরে বের করা যাবে না। আর কোনো পশুপাখিকেই খাঁচার বন্দী করে রাখা ঠিক না মা। বরং বিকেলে ওকে দূরে কোনো ফাঁকা মাঠে ছেড়ে দিয়ে আসবো। ওখানে ও মহা আনন্দে থাকবে। আমাদেরও জ্বালাতন করবে না।" মা বললো, "সেই ভালো।" মা-বাবার অনেক বোঝানোতে আমি ইঁদুরটাকে ফাঁকা মাঠে ছেড়ে দিয়ে আসতে রাজি হলাম। সকাল থেকে ইঁদুরের কাছে বসে আছি আর ভাবছি, কী সুন্দর ইঁদুর, চোখ দুটি কী বড়ো বড়ো আর কিউট। বিস্কুট ভেঙে ভেঙে দিচ্ছি, কিন্তু এখন আর খাচ্ছে না। শুধু পিটপিট করে তাকাচ্ছে।
আজ যেন খুব তাড়াতাড়ি দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল। আমি আর বাবা মুখে মাস্ক পরে, স্কুটিতে চেপে ইঁদুরটাকে ছাড়তে গেলাম। একটা ফাঁকা মাঠে এসে আমরা দুজনেই নেমে পড়লাম। কলবন্দী ইঁদুরটাকেও নামানো হল। ও পিটপিট করে আমাদের দেখছে। মনে হলো বলছে," আমায় মেরে ফেলো না।" আমি ওকে চুপিচুপি বললাম, "তোমায় মারব কেন! তোমাকে তো ছেড়ে দিতে এসেছি।" বাবা কলটা খুলে দিতেই ইঁদুরটি দৌড়ে ঝোপের আড়ালে যেতে গিয়ে পেছনে ফিরে তাকাল। মনে হল, ও আবার যেন বলছে, "তোমারা খুব ভালো, ভালো থেকো।"
বহুদিন পর এক খেলার সাথী পেয়েও তাকে এভাবে ছেড়ে দিয়ে আমার মন খুব খারাপ। আমার দুঃখী দুঃখী মুখ দেখে বাবা বললো, মুক্তির আনন্দই অন্যরকম মা। বাবা স্কুটি স্টার্ট দিল। পেছনের সিটে বসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে হাসিমুখে আমি বললাম,"ঠিকই বলেছ বাবা, দেখলে তো কী খুশিতে দৌড়ে যাচ্ছিল ও। করোনা চলে গেলে আমাদেরও আর বন্দী থাকতে হবে না। আমারও মাঠে আনন্দ করে খেলে বেড়াব।"
===============================
ছোটদের কলমে-৩
ভালো নেই
রাকা দে
ষষ্ঠ শ্রেণী
আমরা কেউ ভালো নেই। আমরা বলতে আমরা যারা ছোটরা। আমাদের মনটাও ভালো নেই। আমরা
কেউ নতুন ক্লাসে উঠেও নতুন ক্লাসে বসতে পারছি না। স্কুলে যেতে পারছি না, গানের স্কুলে, আঁকার স্কুলে, নাচের স্কুলে, সাঁতারে
কোথাও যাওয়ার উপায় নেই। বন্ধুদের সাথেও দেখা হচ্ছে না। টিচারদের সঙ্গে দেখা হচ্ছে
না,
যদিও অনলাইন ক্লাস শুরু হয়েছে। তাও ছুটির দিন সেটা বন্ধ
থাকার জন্য টিচারদের আর বন্ধুদের সাথে সেদিনের জন্য দেখা হয় না। অনলাইন ক্লাস
হচ্ছে বলে আমরা পড়াশোনা করতে পারছি, দুটো ক্লাস
টেস্টও হয়ে গেল। কিন্তু বন্ধুদের পাশে বসে গল্প করতে করতে অঙ্ক সল্ভ করা, মাঠে বসে একজোট হয়ে মনের কথা বলতে বলতে একসঙ্গে টিফিন খাওয়া, ম্যাম এবং স্যারদেরকে দেখলে গুড মর্নিং বলা বা সামনাসামনি
দাঁড়িয়ে নিজেদের প্রশ্নের উত্তর জেনে নেওয়া এইসব মজাগুলো হচ্ছে না।
এই লকডাউনের সময় আমার সদ্যোজাত মাসতুতো ভাইকে দেখতেও আমি যেতে পারিনি মাসির
বাড়িতে। ২৭শে এপ্রিল আমার জন্মদিন। সেদিনটাও আমি আমার বন্ধুদের সাথে, আত্মীয়স্বজনের সাথে উদযাপন করতে পারলাম না। এসব কিছু না
হওয়ার জন্য শুধুমাত্র এই করোনা দায়ী। কিন্তু এই করোনা ভাইরাস (COVID-19) কেন এল, কোথা থেকে এল, কী কারণে এল, তা আমরা
ছোটরা বুঝি না। কিন্তু এর জন্য কষ্টটা আমরা বুঝি। যাই হোক এইভাবেই দিন কেটে
যাচ্ছিল। সকালে উঠে ক্লাস করে পড়তে বসতাম। তারপরে স্নান করে খেয়ে সন্ধ্যায় ঠাকুমার
সাথে ছাদে যেতাম। সেখানে প্রচুর গাছে জল দিতাম। আমাদের বাড়ির রান্নাঘরের পাশে একটা
বড় করবী গাছ ছিল,
ফুলে ভরে থাকত গাছটা। অনেক পাখি বাসা বেঁধেছিল সে গাছে।
রান্নাঘরের কার্নিশে সকালে আমরা ওকে খেতে দিতাম, ওরা খুঁটে খুঁটে খেত। মা পাখি বাচ্চা পাখিকে খাবার তুলে খাইয়ে দিত, এগুলো আমি দেখতাম মুগ্ধ হয়ে।
এরই মধ্যে হঠাৎ কোথা থেকে এল “আমপান” সাইক্লোন, তছনছ করে দিল
মানুষের জীবন। সেই করবী গাছটা ভেঙে পড়ে যাওয়ার সাথে সাথে পাখিগুলোর বসার ডালটাকে
উড়িয়ে নিয়ে গেল “আমপান”। পাখীগুলো সব কোথায়
চলে গেল,
ওদের আর দেখতে পাচ্ছি না। মনটা তাই ভালো নেই।
তবে করোনা,
লকডাউন এই সব কিছু ভালো না লাগার মধ্যে আমার একটাই আনন্দের
ব্যাপার আছে,
তা হল আমার বাবাকে আমি সবসময় বাড়িতে পাচ্ছি দীর্ঘদিন ধরে।
===============================
আমাদের
পদক্ষেপ প্রকাশনী
যোগাযোগ-
৮০১৬০৮৩০১৩ / ৯৮৩৬৪৩৮৩৩৬
*কাব্যগ্রন্থ*
*যা নেই ভারতে—আর্যতীর্থ—৫০/-*(পঞ্চাশ)
মহাভারতের বিভিন্ন ঘটনা ও
চরিত্রকে আধুনিক ভারতের প্রেক্ষিতে তুলে ধরেছেন এ সময়ের জনপ্রিয় কবি
*ভারতবর্ষ এখন—আফজল আলি— ৪০/-*(চল্লিশ)
ভারতবর্ষের বর্তমান প্রেক্ষিত ও
কিছু নিজস্ব অনুভবের মিশ্রণ করেছেন জিরো বাউন্ডারি তত্ত্বের প্রবক্তা কবি ৷
*শ্রাবণের ধারার মতো— সুজান মিঠি— ৪০/-*(চল্লিশ)
জীবনের কিছু খুব চেনা মুহূর্তের
কোলাজ হৃদয়স্পর্শী আখরকথায় ধরেছেন এ সময়ের এক জনপ্রিয় কবি
*যদি ছুঁয়ে থাকো— মৌমিতা ঘোষ— ২০/-*(কুড়ি)
প্রেমের নানা রূপের ছোঁয়া পাবেন
কবির কলমে
*আরও এক মহেঞ্জোদাড়ো— অর্ণব গরাই— ৩০/-*(ত্রিশ)
বাস্তব অনুষঙ্গ থেকে অন্তর থেকে
উঠে আসা নিভৃতচারী কিছু অনুভবকে কবিতার মালায় সাজিয়েছেন কবি
*মেঘলা বিষাদ— প্রদীপ চন্দ— ২০/-* (কুড়ি)
মনের কিছু গহন কথা, নিরুচ্চারিত কিছু আবেগ রূপ পেয়েছে কবির কলমে ৷
*গল্পগ্রন্থ*
*ভোরের সূর্যোদয়— দেবব্রত ঘোষ মলয়— ৪০/-*(চল্লিশ)
জীবনের টানাপোড়েন ও নানা স্বাদের
গল্প নিয়ে মায়াজাল বুনেছেন বিশিষ্ট গল্পকার
*নেপোদাদুর গপ্পো— রাজকুমার ঘোষ— ৪০/-*(চল্লিশ)
আট থেকে আশি সব্বার প্রিয় নেপোদাদুর
নানা কীর্তিকাহিনী নিয়ে মজাদার গল্পের সম্ভার এনেছেন গল্পকার
*১৬ আনা— নির্মলেন্দু কুণ্ডু— ৩০/-*(ত্রিশ)
সামাজিক থেকে ভৌতিক, কিশোর-উপযোগী থেকে প্রাপ্তমনস্ক—নানা
স্বাদের ১৬ টা গল্পের সম্ভার নিয়ে এসেছেন গল্পকার
*উপন্যাস*
*অপাপবৃত— অজিতেশ নাগ— ৬০/-*(ষাট)
আমাদের খুব চেনা এক চরিত্রের
আপাত অচেনা জীবনের আখ্যান সাবলীল ছন্দে বুনেছেন এ সময়ের ব্যস্ততম ও জনপ্রিয়
সাহিত্যিক
*জীবন যখন যেমন— দীপক আঢ্য— ৪০/-*(চল্লিশ)
করোনাকালে আমাদের চারপাশের কিছু
চেনা চরিত্রের জীবনের দলিল এই উপন্যাসে তুলে ধরেছেন ঔপন্যাসিক
*অব্যক্ত অভিযান— সুজান মিঠি—২০/-*(কুড়ি)
এক সাধারণ মেয়ের বেঁচে থাকার
আখ্যান, লড়াইয়ের প্রতিটি মুহূর্তের সাথে হন একাত্ম
৷
*বাইপাস রহস্য— রাজকুমার ঘোষ— ২০/-*(কুড়ি)
বাইপাসের ধারে একটি মেয়ের মৃতদেহ
পাওয়া গেল ৷ পুলিশ খুনী সন্দেহে গ্রেপ্তার করল তার বন্ধুকে ৷ সেই বন্ধুটি যে কমন
ফ্রেন্ডের প্রতি সন্দেহের কথা জানালো, সে
হঠাৎ করে বসল সুইসাইড অ্যাটেম্পট ৷ তাহলে আসল খুনী কে ?
*নিবন্ধ-প্রবন্ধ*
*মহাকাব্যের আত্মজন— মৌ দাশগুপ্ত— ৫০/-*(পঞ্চাশ)
মহাভারতের ছয় অনালোচিত বা
স্বল্পালোচিত চরিত্র— দ্রৌপদী, পঞ্চ
উপপাণ্ডব, হিড়িম্বা, বর্বারক, উলূপী ও ইরাবান— নিয়ে তথ্যনিষ্ঠ আলোচনা করেছেন
প্রাবন্ধিক
*চেনা অচেনা মহান কথা— ড. রমলা মুখার্জী— ৩০/-*(ত্রিশ)
আমাদের প্রাতঃস্মরণীয় মহামানবদের
জীবনের কিছু স্বল্পালোচিত দিক তুলে ধরেছেন নিবন্ধকার
*পঞ্চসতীর উপাখ্যান— কুহেলী বিশ্বাস— ২০/-* (কুড়ি)
আমাদের মহাকাব্যে বর্ণিত পাঁচ
আদর্শ নারী— অহল্যা, তারা,
মন্দোদরী, কুন্তী ও দ্রৌপদীর যাপনকথা নিয়ে
রচিত এই নিবন্ধ-সংকলন
যেকোন বই (পিডিএফ) নিতে
*ফোন পে বা গুগল পে — ৮০১৬০৮৩০১৩*
*পেটিএম— ৯৮৩৬৪৩৮৩৩৬*
===================
আমাদের পদক্ষেপ প্রকাশনীর তরফ থেকে একটি কিশোর গল্প সংকলণ "কিশোরবেলার রোদ" প্রকাশিত হয়েছিল ২০২১ সালের জানুয়ারী মাসে। সংকলণে প্রকাশিত গল্পগুলি পড়তে পারেন 👇👇
কিশোরবেলার রোদ (টাচ/ক্লিক করুন)
আমাদের পদক্ষেপ প্রকাশনীর ফেসবুক পেজ
(ছবিতে টাচ/ক্লিক করুন 👇👇)
No comments:
Post a Comment