বাহনতত্ত্বে দেবকূল
পীযূষকান্তি ভট্টাচার্য
শাশ্বত সনাতন ধর্মের চূড়ান্ত রূপ সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় যে বৃক্ষ ও মনুষ্যেতর পশু-পক্ষীকূল কেন আমাদের আরাধ্য দেবতার পার্ষদরূপে পরিগণিত হয় ৷
দেবী দুর্গাকে নিয়েই আলোচনা শুরু করি ৷ বর্তমান নিবন্ধে দেবী দুর্গার পৌরাণিক কাহিনী ও বৃত্তান্ত নিয়ে আলোচনা না করে দেবী দুর্গার তাত্ত্বিক রূপ বিশ্লেষণে বোঝা যায় যে, বাহনগুলি ও মনুষ্যকূলে বিভিন্ন বৃক্ষ কেন পূজার অঙ্গীভূত হয়েছে ?
দেবী দুর্গা ক্রমে ক্রমে তাঁর আশ্রিতদের সর্বদোষ-মুক্ত করে তৎসদৃশ গড়ে তুলতে সদাই প্রয়াসী, যা হিন্দু সনাতন ধর্মের চূড়ান্ত পরিণতি, যা সোঽহং তত্ত্ব বা তত্ত্বমসী তত্ত্ব নামে পরিচিত ৷ যে যে দেবতা যে যে সিদ্ধি দেন, তাঁর বাহন বা পার্ষদগুলিও সেই সেই সিদ্ধি অনুসারে কাজ করার জন্য সদা তৎপর ৷ যাক, এই বিষয়ে আলোচনা করার পূর্বে দেবী দুর্গার স্বরূপ তত্ত্বের অনুসারী বিভিন্ন শিবসদৃশ ব্যক্তিবর্গের বাণী বা শ্লোক লিপিবদ্ধ করলাম—
সংসারার্ণব মগ্নানাং সর্বেষাং প্রাণিনামিহ
দুর্গৈকা হি পরমপোত নরাণাং মুক্তয়ে সদা || ১ ||
দুর্গৈকা পরমং জ্ঞানং দুর্গৈকা পরমং ফলম্
ন ত্বয়া রহিতং কিঞ্চিদ ভূত স্থাবর জঙ্গমম্ || ২ ||
দুর্গৈকা পরমং সত্যং দুর্গৈকা পরমাগতি
দুর্গৈকা পরমং দৈবং দুর্গৈকা পরমৌষধম্ || ৩ ||
দুর্গৈকা সুখমত্যন্তং দুর্গৈকা নিবৃত্তিপরা
দুর্গৈকা পরমা তুষ্টি দুর্গৈকা পরমং যশঃ || ৪ ||
ভূতানি দুর্গা ভুবনানি দুর্গা স্ত্রিয়োনরাশ্চাপি পশুশ্চ দুর্গা
যদ্যদ্ভি দৃশ্যং খলু সৈব দুর্গা দুর্গাস্বরূপাদ্ পরং ন কিঞ্চিৎ || ৫ ||
শ্লোক পাঁচটির ভাবানুবাদ দাঁড়ায়, সংসারে মোহবশে আকৃষ্ট জীবগণের প্রাণরূপে দুর্গাদেবী অবস্থিত ৷ দুর্গা নাম স্মরণই পরম জ্ঞান, পরম ফল, কারণ ভূত, স্থাবর, জঙ্গম যত বিভিন্ন দ্রব্য দেখা যায়, তা দুর্গারহিত নয় অর্থাৎ সবই দুর্গার রূপান্তরমাত্র ৷ দুর্গা পরম সত্য, পরম গতি, পরম দৈব, পরম ঔষধি, দুর্গাই সর্বসুখের আকর, দুর্গাই মোহরহিত নিবৃত্তির কারণ ৷ দুর্গাই আত্মতুষ্টি শ্রেষ্ঠ যশ মান সম্মান ৷ দুর্গাই দৃশ্যমান সকল বস্তু, অসংখ্য ভূষণাবলি দুর্গা ৷ স্ত্রীগণ, নরগণ, সমস্ত পশুসমূহ ৷ যা যা বস্তু দৃষ্টিগোচর হয় সবই দুর্গাস্বরূপ ৷ সেই স্বরূপ থেকে অতিরিক্ত কিছু নয় ৷
এই তত্ত্ব হৃদয়ঙ্গমকারী ব্যক্তি নিশ্চিত বুঝতে সক্ষম যে, দুর্গা জীবকূলকে তাঁর নিকটে আনার জন্য তৎপর ৷ তাঁর পরিবার-সঙ্গী বাহনগুলিও পশুরূপ প্রাপ্ত হলেও সেই সেই দেবতার গুণসান্নিধ্যে নিকটতম করার জন্য কলুষমুক্ত হওয়ার ইঙ্গিত প্রদান করে ৷
সাধারণত দুর্গা পরিবার বলতে দুর্গা, লক্ষ্মী, গণেশ, সরস্বতী, কার্তিক, শিব, মহিষাসুর, পশুরাজ সিংহ, পেচক, মূষিক, ময়ূর, বৃষ, রাজহংস, মহিষ, সর্প ইত্যাদি অঙ্গীভূত ৷ দুর্গার পুত্র-কন্যারূপে গণেশ, কার্তিক, লক্ষ্মী ও সরস্বতী নিশ্চয়ই প্রশংসনীয় গুণসম্পন্ন ৷ পাশাপাশি তাঁদের বাহনগুলিও প্রভূত গুণসম্পন্ন এবং মানুষের আত্মিক উন্নতিতে সহায়তা করে তারা তাদের প্রভুর নিকট অবস্থানে সহায়তা করে ৷
যাই হোক, এখন মহর্ষি সত্যদেবের আলোকে বাহনগুলিকে আলোকিত করার চেষ্টা করি—
" আয় মা সাধন সমরে, দেখি মা হারে কী পুত্র হারে" ৷
মূষিক— সিদ্ধিদাতার বাহন মূষিক ৷ অথর্ববেদের সায়নভাষ্যে জানা যায়, মুঞ্চতি (অপহরতি) কর্মফলানি ইতি মূষিকঃ ৷ জীবের কর্মফলসমূহ অজ্ঞাতসারে অপহরণ করে মূষিক ৷ প্রবল প্রতিবন্ধনরূপ কর্মফল বিদ্যমান থাকলে সিদ্ধিলাভ হয়না— মূষিক সেই কর্মফল কুটি কুটি করে কেটে সিদ্ধির দ্বারপ্রান্তে আনয়ন করে ৷
পেচক— দিবান্ধ প্রাণী ৷ দিবান্ধ উপলক্ষণে আত্মজ্ঞানহীন যে সাধক বা মানুষ আত্মানুসন্ধানের চেষ্টায় বিরত হয়ে সাংসারিক শ্রীবৃদ্ধির চেষ্টায় সদা তৎপর, তারাই পার্থিব সুখের অধিষ্ঠাত্রীরূপ ব্রহ্মশক্তির উপাসনা করে ৷ লক্ষ্মীদেবীর বাহন পেচক ৷
হংস— যে মানুষ বা সাধক দিবারাত্রে তাদের অজ্ঞাতে হংস মন্ত্র একুশ হাজার ছয় শত বার জপ করে চলেন, তাঁরা সরস্বতীরূপ ব্রহ্মশক্তির উপাসনা করেন ৷ বেদাধিষ্ঠাত্রী সরস্বতী দেবীর বাহন হংস ৷ হাঁসের একটা বিশেষ গুণ আছে যে, অসার বস্তু ত্যাগ করে সার বস্তু গ্রহণ করে ৷ দুধ ও জলমিশ্রিত পদার্থের মধ্যে থেকে দুধ খেয়ে নেয়, জল পড়ে থাকে ৷ সার বস্তুর গ্রহণকারী ব্রহ্মশক্তির উপাসনায় সার্থক হয়, জয়ী হয় ৷
ময়ূর— দেব-সেনাপতি কার্তিকেয়র বাহন ময়ূর ৷ ময়ূরের পাখনার মনোহারিত্ব ও অসংখ্য রূপ হচ্ছে মানুষের বিচিত্র অভিনব কামনা-বাসনা ৷ এই কামনা-বাসনার জাল-মুক্ত হতে না পারলে সাধন সমরে জয়লাভ অসম্ভব ৷ দেবসেনাপতি যুদ্ধে দক্ষ, তাঁর বাহনও রঙিন কামনা-বাসনার আবেষ্টনীতে সজ্জিত হয়ে তাঁকে পরাস্ত করতে ব্যস্ত ৷ তাই মানুষকে অবহিত হতে হবে ; ঈশ্বরমুখী হতে হলে, যুদ্ধে জয়ী হতে হলে কামনা-বাসনার ইতি ঘটানোর তৎপর হতে হবে ৷ অন্যান্য পশুপক্ষীর মতো ময়ূর নয়— তার যৌন মিলন হয় না ৷ ময়ূর পেখম বিস্তার করে নাচতে থাকলে তার ঘাম পায়ের নিকটে পড়ে, তখন ময়ূরী ঐ ভাব বুঝতে পারে ও নিকটবর্তী হয়ে পরিত্যক্ত ঘাম গ্রহণ করে পরবর্তীতে বাচ্চা প্রসব করে ৷ তাই কামনা-বাসনার পথ যতদূর রুদ্ধ হয়, ততই আত্মার ওপর আধিপত্য আসে ৷
অসুর— সাধনসমরে প্রবেশ করতে হলে সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ গুণ দিয়ে যে জগৎ বিধৃত, তা বুঝতে হয় ৷ এই ত্রিগুণের বিভিন্ন অনুপাতে সমন্বয় হয়ে বিভিন্ন মানসিকতার সৃষ্টি হয় ৷ তাই জীবে জীবে এত পার্থক্য ৷ একই জীবশ্রেণীর মধ্যে পার্থক্য হয় আচার, মত, পথ, মানসিকতায়, আচরণে ৷
অসুর শ্রেণীতে অশুদ্ধ রজঃগুণের প্রকাশ বেশি ৷ রজগুণান্বিত বস্তু যুদ্ধ-বিগ্রহ মারামারিতে দক্ষ হয় ৷ দেবী দুর্গা রজঃগুণ ধ্বংস করে শুদ্ধ সত্ত্ব গুণের অধিকারী হন ৷
মহিষ- রজঃগুণান্বিত— অসুরধর্মী ৷ তাই মহিষাসুরের জন্ম মহিষীর গর্ভে ৷ রম্ভাসুর মায়াবলে মহিষরূপ ধারণ করে ও মহিষীর সাথে রতিক্রিয়ায় মহিষাসুরের জন্ম হয় ৷
সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ গুণগুলির অবস্থিতি Genetic, ডি.এন.এ-তে অবস্থিত ৷ এর মাপ উন্নত বিজ্ঞান করতে সক্ষম হলেও সাধারণে অক্ষম ৷ তবে মানসিকতা, আচার আচরণ থেকে কিছুটা অনুমান করা যায় মাত্র ৷
সিংহ— দেবী যেমন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সবকিছুর মধ্যে অনুসৃত, তাঁর বাহন পশুরাজ সিংহ— হিংসা তার বৃত্তি, জীবাত্মার হিংসা ধ্বংস করে পরমাত্মায় প্রতিষ্ঠার প্রয়াস করে ৷ পরমাত্মাই পরম ব্রহ্মস্বরূপ ৷
বৃষ— মহাদেবের বাহন বৃষ ৷ এর অর্থ ধর্ম ৷ শ্বেত বর্ণ সাত্ত্বিক গুণ সম্পন্ন ৷ ধর্মের চারটি পা— তপঃ, শৌচ, দয়া ও দান ৷ বৃষেরও চারটি পা ৷ শিব জ্ঞানরূপী গুরু মঙ্গলময় এই জ্ঞানের সন্ধান যখন সাধক পান, তখন মৃত্যুভয় দূরীভূত হয় ৷ কারণ তিনি কালকে ফলন করে মহাকালস্বরূপ ৷ আর মহাকালকে যিনি কলন (গ্রাস) করেন তিনি মহাকালী ৷
গরুড়— শ্রীমদ্ভাগবতের দ্বাদশ খণ্ডে বলা হয়েছে, গরুড়ই স্বয়ং বেদ— বেদের কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড হচ্ছে গরুড়ের দুই পাখনা ৷ যা দিয়ে যজ্ঞপুরুষকে বহন করে ভুবন থেকে ভুবনান্তরে গমন করে ৷ যজ্ঞপুরুষ হচ্ছেন স্বয়ং বিষ্ণু ৷ ব্যাপ্নোতি ইতি বিষ্ণু ৷ জগৎ-ব্যাপিয়া যে চৈতন্যশক্তি তাই বিষ্ণু ৷
এছাড়া ব্রহ্মার বাহনও হংস ৷
পরিশেষে বলি, মানুষকে দেবত্বে উন্নীত হতে হলে প্রচলিত বাহনগুলির গুণের বিকাশ তার মধ্যে আনয়ন করে সেই দেবতার সাযুজ্য হতে হয় ৷ ভাবের মধ্যে দিয়ে এই পথে চলতে হয় ৷ তাই শাস্ত্র বলেন, "ন ভাবেন বীণাদেবী তন্ত্রমন্ত্র ফলপ্রদা ৷"
পুরাণে বাহন
মিতালি রায়
আকাশের বুকে স্তরে স্তরে জমে উঠেছে গভীর কৃষ্ণ মেঘরাশি। দিগ্বিদিক ফালাফালা করে চমক দিয়ে যাচ্ছে ক্ষণপ্রভা। আর মুহূর্মুহূ মেঘগর্জন এবং বজ্রপাতে আতঙ্কিত হয়ে উঠছে গুহাবাসী আদিম মানুষ। প্রচণ্ড বর্ষণ, বন্যা ,অস্থির ভূমিকম্প, দুর্নিবার ঝড় কারো হাত থেকেই যেন রক্ষা নেই তার। আদিম মানুষের মনের প্রচণ্ড ভয় থেকেই বোধহয় সৃষ্টি হল ভক্তির। ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে নিষ্কৃতির জন্যেই সে শুরু করল প্রকৃতির উপাসনা। প্রখ্যাত ভাষাবিদ্ যাস্ক আমাদের জানিয়েছেন, বেদের তিন দেবতার কথা – অগ্নি, বায়ু এবং সূর্য।
এই তিন দেবতা কালক্রমে রূপ নিয়েছে তেত্রিশ কোটি দেবতায়। হ্যাঁ, বাল্যকাল থেকেই হিন্দুদের তেত্রিশ কোটি দেবতার একটা ধারণার কথা শুনে আসছি। বেদের প্রাচীনতম অংশ সংহিতায় "৩৩দেব" র কথা বলা হয়েছে। ঋকবেদে আমরা পাই –
"ये देवासो दिव्येकादश स्थ पृथिव्यामध्येकादश स्थ ।
अप्सुक्षितो महिनैकादश स्थ ते देवासो यज्ञमिमं जुषध्वम् ॥"११॥[11]
অর্থাৎ,
O ye eleven gods whose home is heaven, O ye eleven who make earth your dwelling, Ye who with might, eleven, live in waters, accept this sacrifice, O gods, with pleasure. – (Translated by Ralph T. H. Griffith.)
Gods who are eleven in heaven; who are eleven on earth; and who are eleven dwelling with glory in mid-air; may ye be pleased with this our sacrifice. – (Translated by HH Wilson.)
সুতরাং তেত্রিশ কোটি দেবতা মানে তেত্রিশ কোটি জন দেবতা কিনা, সে ব্যাপারে একটু দ্বিধা তো থেকেই যায়। আসলে সংস্কৃতে "কোটি" শব্দটির অর্থ হল গুণ। তাহলে একথা পরিষ্কার যে তেত্রিশ কোটি দেবতা বলতে সংস্কৃতে তেত্রিশ গুণসম্পন্ন দেবতার কথাই বলা হয়েছে।
আর এঁরা হলেন — ত্রিলোকের দ্বাদশ আদিত্য, একাদশ রুদ্র, অষ্টবসু এবং বেদের ব্রাহ্মণ অংশে উল্লেখিত অশ্বিনীকুমারদ্বয়।
যাইহোক, বেদে কিংবা পরবর্তী যুগে দেবদেবীর সংখ্যা নিয়ে যা বলা হোক না কেন, বর্তমানে এই দেবদেবীরা নানা রূপে, নানা অবতারে পূজিত হয়ে থাকেন ।এছাড়াও তার সঙ্গে আছেন অসংখ্য লৌকিক দেবদেবী। সবমিলিয়ে তেত্রিশ কোটি জন দেবদেবী হতে বাধা নেই।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, আমরা কেবলমাত্র দেবতাদের রূপাবয়ব কল্পনা করেই ক্ষান্ত থাকিনি, গাছপালা এবং পশুপাখিকেও তাদের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছি। আসলে প্রকৃতির উপাসনা করতে গিয়ে প্রাকৃতিক উপাদানগুলিকে তো অবহেলা করা যায় না । গাছপালা এবং সমগ্র পশুপাখিও তাই দেবতাদের সঙ্গেই পূজিত হয়ে চলেছে যুগ যুগ ধরে।
পশুপাখিরা দেবতাদের সঙ্গী হয়েছে তাঁদের বাহনরূপে। সংস্কৃত वाहन, "Vāhanam " শব্দটি থেকেই বাংলা "বাহন" শব্দটি এসেছে। অর্থাৎ যা বহন করে নিয়ে যায়। যদিও বহন করার ব্যাপারে কোন কোন ক্ষেত্রে বেশ অবাস্তব বলেই মনে হয়। যেমন ছোট্ট মূষিকের কি ক্ষমতা বলুন তো যে সে গণপতিকে বহন করবে? তাই কেবল বহনই নয় , কোন দেবতার নির্দিষ্ট বাহনের দ্বিতীয় তাৎপর্যও যে আছে একথা অবশ্যই স্বীকার করে নিতে হয়। তেমনি এখানে মূষিক হল মায়া ও অষ্টপাশছেদনের প্রতীক। ব্রহ্মর্ষি শ্রী সত্যদেব জানিয়েছেন, জীবের কর্মফল হরণ করে মূষিক সিদ্ধিলাভে সহায়তা করে বলেই, জীবের সিদ্ধি লাভ হয়।
প্রথমেই বলে নেওয়া যাক, বেদোক্ত তিন দেবতা যথাক্রমে অগ্নি, বায়ু ,সূর্য –এঁদের মধ্যে অগ্নির বাহন হিসেবে পাওয়া যায় মহিষ অথবা ছাগ কে, বায়ুর বাহন হরিণ এবং সূর্যের বাহন হল সপ্তাশ্ব বাহিত রথ, যার চালক অরুণ।
প্রজাপতি ব্রহ্মার বাহন শ্বেতহংস। চতুরানন ব্রহ্মা সত্ত্ব ও রজোগুণের সমন্বিত রূপ। অন্যদিকে হংসের মধ্যেও লক্ষ্য করা যায় সত্ত্ব ও রজোগুণ। এই সমতাই বোধহয় হংসকে ব্রহ্মার বাহন করে তুলেছে । তাছাড়াও প্রজাসৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার সঙ্গে একমাত্র হংসকেই ভাবা যায় কারণ, হংসও তো অসাধারণ প্রজনন ক্ষমতা সম্পন্ন জীব। পুরাণকারেরা পক্ষীবর গরুড়কে নির্দিষ্ট করেছেন বিষ্ণুর বাহনরূপে। জানা যায়, মাতা বিনতার দাসত্ব মুক্তির উদ্দেশ্যে স্বর্গ থেকে অমৃত আনতে গেলে দেবতাদের সঙ্গে বীর বিক্রমে যুদ্ধ করেছিল সে। অমৃতভাণ্ড হাতে পেয়েও সে নিজে অমৃতপান করে অমর হতে চায় নি , সেখানে সে চরম নির্লোভতার পরিচয় দিয়েছে । শক্তি ,ভক্তি , নির্লোভতা —গরুড়ের এই সব অসাধারণ চরিত্রগুণ বিষ্ণুকে আকৃষ্ট করেছে। বিষ্ণু স্বয়ং তাকে নিজের বাহন করে স্থান দিয়েছেন নিজের ধ্বজায় এবং পরিচিত হয়েছেন গরুড়ধ্বজ নামে । একথা সর্বজনবিদিত যে পুরাণ অনুসারে মহেশ্বর মহাদেবের বাহন হল নন্দীষাঁড় । তবে হ্যাঁ, নন্দী কিন্ত পূর্বে শিবের বাহন হিসেবে নয়, এক শক্তিশালী স্বতন্ত্র দেবতা হিসেবে পশুপতির পাশে পূজিত হতেন। নানা কাহিনি উপকাহিনির মধ্যে দিয়ে নন্দী হয়ে উঠেছে রুদ্রের বাহন। রুদ্রের প্রলয়ংকর রূপের সঙ্গে মত্ত ষণ্ডের ধ্বংসাত্মক রূপের সাযুজ্য রেখেই বোধহয় কালক্রমে নন্দী শিবের বাহন হয়ে উঠেছে।
এ তো গেল পুরাণোক্ত ত্রিনাথের বাহনকথা। অন্যদিকে এই ত্রিদেবের শক্তি থেকে আবির্ভূত মহামায়া মা দুর্গার বাহন হল পশুরাজ সিংহ। তবে কিভাবে সিংহ মা দুর্গার বাহন হলেন সে ব্যাপারে বিভিন্ন পুরাণে বিভিন্ন কাহিনি প্রচলিত আছে। তার দুএকটি আমি এখানে উল্লেখ করছি। যেমন, মার্কণ্ডেয় পুরাণ অনুযায়ী হিমালয় দেবীকে সিংহ দান করেন। কালিকাপুরাণে আছে, দুর্গার বাহন হওয়ার জন্যে শিব শবদেহ, ব্রহ্মা রক্তপদ্ম এবং বিষ্ণু সিংহের রূপ ধারণ করেছিলেন। আবার পদ্মপুরাণে পাই দুর্গার ক্রোধ থেকে সিংহের জন্ম হয়েছিল।
তবে সিংহ একাধারে যেমন রজোগুণের এক প্রচণ্ড শক্তির উচ্ছ্বাসের প্রতীক, তেমনই মানুষের পশুত্ব বিজয়েরও প্রতীক। "প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই আছে পশুশক্তি। পুরুষকার ও সাধন-ভজনের দ্বারা মানুষ যখন যথার্থ মনুষ্যত্বে উপনীত হয় তখন তার পশুভাব কেটে গিয়ে দেবভাব জাগ্রত হয়। আর তখনই সে প্রকৃত শরণাগত হওয়ার যোগ্যতা লাভ করে, সার্থক জীবনের অধিকারী হয়। দেবীর চরণতলে সিংহ সেই ভাবেরই প্রতীক" (স্বামী প্রমেয়ানন্দ)।
এবার আসি লক্ষ্মী ও সরস্বতীর বাহনের কথায়। লক্ষ্মীর বাহন পেঁচা এবং সরস্বতীর বাহন হল শুভ্র রাজহংস। যদিও হিন্দুশাস্ত্রে কোথাও লক্ষ্মীর বাহন হিসেবে পেঁচার উল্লেখ নেই, এটি একেবারেই বাঙালির নিজস্ব ধারণা। পেচক নিশাচর, সবাই যখন ঘুমিয়ে থাকে সে থাকে জাগ্রত। অর্থাৎ সকলে যখন নিদ্রাচ্ছন্ন তখনই তো নিজেকে জাগ্রত রেখে শান্তিতে সাধনায় লিপ্ত হতে হবে। তাহলেই সিদ্ধি লাভ হবে। লক্ষ্মীমাতার বাহন হয়ে পেঁচা বোধহয় এই বার্তাই পৌঁছে দেয় আমাদের কাছে।
অন্যদিকে রাজহংস হিন্দুদের কাছে পবিত্র প্রতীক। বিদ্যাদাত্রী দেবী সরস্বতীর বাহন হিসেবে রজোগুণের অধিকারী হংস যথার্থ। শ্বেতরাজহংস অসারকে ফেলে সারকে গ্রহণ করার ইঙ্গিত দেয়। দুগ্ধ ও জলের মিশ্রণ থেকে দুগ্ধ কিংবা পঙ্ক থেকে নিজ খাদ্য অনায়াসে গ্রহণ করে নিতে পারে। বিদ্যাদেবীর বাহন হিসেবে রাজহংস এটাই প্রকাশ করে যে সংসারের সমস্ত অসার পরিত্যাগ করে সার গ্রহণ করতে হবে, ভালো-মন্দের মধ্যে থেকে বেছে নিতে হবে ভালোকে আর তবেই পরমার্থ লাভ হবে।
সুতরাং, পুরাণে আমরা দেবতাদের যে সমস্ত বাহনের সন্ধান পাই, তারা যে কেবল দেবদেবীকে স্থানান্তরে গমন করতে সহায়তা করে তা নয়। আমাদের ধারণানুযায়ী হিন্দু দেবদেবীরা সূক্ষ্ম শরীরে সর্বত্র অবাধ গমনে সক্ষম। তাই এক্ষেত্রে দেবতাদের বাহনকে কেবলমাত্র বাহক হিসেবে না দেখে বিশেষ অর্থদ্যোতক হিসেবেই দেখা উচিত বলে আমার মনে হয়।
বাহন নিয়ে সাতকাহন
সুজাতা বন্দ্যোপাধ্যায়
হিন্দুশাস্ত্রে পুরাণে দেবদেবীদের বাহন নিয়ে সাতকাহন কাহিনীগুলি রয়েছে৷ কিন্তু আমরা তো জানি, যা বহন করে তাই তো বাহন। তবে কি লক্ষ্মীপেঁচার লক্ষ্মীকে, রাজহাঁসের সরস্বতীকে , ইঁদুরের গণেশকে বয়ে নেওয়ার ক্ষমতা আছে? তা কিন্তু নয়, এই বাহনগুলি প্রতীকী। এদের চারিত্রিক দোষ ও গুণের উপরে নির্ভর করে একটি অন্তর্নিহিত অর্থ বহন করে।
গণেশকে দিয়েই শুরু করা যাক । গণেশের বাহন ইঁদুর। ইঁদুরকে সংস্কৃত ভাষায় বলা হয় মূষিক। মানে চুরি করা অর্থাৎ যারা চুরি করে বেড়ায়। ইঁদুরের মত এরা স্বভাবে খুব স্বার্থপর হয়। ধানের গোলা থেকে যখন এরা ধান চুরি করে খায় এবং যেখানে সেখানে গৃহস্থের ঘরে প্রবেশ করে ঘর নোংরা করে, তখন এরা একবারও গৃহস্থের কথা ভাবেনা ৷ এর উপরই বিরাজ করেন সিদ্ধিদাতা গণেশ। মানে সিদ্ধি ও জ্ঞানের দেবতা অর্থাৎ স্বার্থকে সংযত করে তাকে ত্যাগ করে আমাদের পথ চলতে হবে জীবনের । অন্যদিকে বলা হয় ইঁদুরের মত তীক্ষ্ণতা এবং দুর্বার গতিতে ভরা জীবন হওয়া উচিত আমাদের আর সাফল্যের পথে ষড়যন্ত্রের জাল ইঁদুরের মত কেটে বুদ্ধি দিয়ে বের করতে হবে আমাদের । এই জন্য সিদ্ধিদাতা গণেশ ইঁদুরের ওপর বিরাজ করেন, মানে নিয়ন্ত্রণে রাখেন সবকিছু।
শিবের বাহন হল নন্দীর ষাঁড়।ষাঁড়ের শক্তি প্রবল। জাগতিক জগতের সকল মোহমায়ার ঊর্ধ্বে। সৃষ্টি ও ধ্বংসের দেবতা তিনিই। ষাঁড় প্রাকৃতিকভাবেই ক্ষমতাশালী,জেদী,একবগ্গা ।সৃষ্টির জন্য লাগে একাগ্ৰতা, শুভচিন্তা, শান্ত মূর্তিও। ষাঁড়ও সচরাচর রাগে না। কিন্তু রেগে গেলে ভয়ঙ্কর। স্বয়ং মহাদেবও তাই। তাঁর প্রলয়ঙ্করী মূর্তিটিও ভয়ঙ্কর।
আবার দেখো, দুর্গার বাহন সিংহ। সিংহের শরীরে যে শক্তি ও ক্ষিপ্রতা সেইরকম শক্তি দিয়েই দেবী দুর্গা অশুভ শক্তি অসুরকে বধ করেন।তেজ ও ক্রোধেরও প্রতীক সিংহ। মা দুর্গার রাগ থেকেই সিংহের উৎপত্তি। সিংহের মতোই তেজ ও শৌর্য দিয়ে তিনি জগতের সকল অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করেন।
ময়ূর হল কার্তিকের বাহন।সাপ থাকে কার্তিকের পায়ের নীচে। সাপ হল গোপন তথ্য ও ষড়যন্ত্রের প্রতীক। আর কার্তিক হলেন চিরযুবক। যা তাঁর রূপের বাহক, তাই ময়ূরের সৌন্দর্যকেই প্রতীক করা হয়। ময়ূর আবার সাপকে খেয়ে নেয়। তার মানে শত্রুনিধন। সাপটাকে পায়ের নীচে রাখা মানে শত্রুকে দাবিয়ে রাখা।
সরস্বতীর বাহন রাজহাঁস। হাঁস কি পারে সরস্বতীকে বয়ে নিয়ে বেড়াতে? পারে না তো।কিন্তু যেটা পারে তা হলো দুধজল মেশানো খাবার থেকে জলটাকে আলাদা করে দুধটুকু খেয়ে নিতে। এর মধ্যেও একটি অন্তর্নিহিত অর্থ আছে। আমাদের সমাজ সংসারে ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় রয়েছে যে তার থেকে অন্যায়টাকে ত্যাগ করে, মন্দটাকে দূরে সরিয়ে ভালো ও ন্যায়ের আলোয় আলোকিত করতে হবে নিজেদের। আর তাঁর হাতে থাকা বই বলে পড়াশোনা করে জ্ঞানার্জন করতে। আর বীণা বলে , সকল শিল্পীকে কদর করো।শিল্পকলায় পারদর্শী হয়ে দেশকে গর্বিত করো।
লক্ষ্মীর বাহন লক্ষ্মীপেঁচা। এই পেঁচার প্রাকৃতিক শক্তি হল অন্ধকারেও সে দেখতে পায়।আবার রাতে জেগেও থাকতে পারে। পাহারা দিয়ে শত্রুকে মোকাবিলাও করতে জানে।আর লক্ষ্মী হলেন আমাদের ধনসম্পত্তির দেবতা। বাঁচতে গেলে অর্থের প্রয়োজন। লক্ষ্মী দেন ধনসম্পত্তি, সৌভাগ্য ।ঐশ্বর্যশালী করে তোলেন তিনি আমাদের। আর এইগুলিকেই গৃহস্থকে গুছিয়ে, রক্ষা করতে হবে, আগলে রাখতে হবে পেঁচার মতো।
সূর্যদেবতার বাহন সাতটি ঘোড়া। এই ঘোড়ার গতিতে ছোটে সূর্যের আলোকরশ্মি।আবার ঐ সাতঘোড়া কিন্তু রামধনু বলো, আলো বলো তার সাত রঙের সমন্বয়কে নির্দেশ করছে। জীবনে উচ্ছলতা, উজ্বলতার আলোক দ্যুতি সূর্যের দীপ্ত তেজের মতোই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আমাদের জীবনে। তাই না?
ঠিক এরকম পুরাণে আরও অনেক দেবদেবীদের বাহন কিছু না কিছু প্রতীকী অর্থ বহন করছে। কিন্তু সে গল্প অন্যদিন ৷
=======================
অচেনা দেববাহন : মকর
মৌ দাশগুপ্ত
আমাদের হিন্দুধর্ম মুলত দেবদেবী নির্ভর। তাও এক আধজন নয়। একাধিক। লোকমুখে প্রচলিত বিশ্বাস বলে হিন্দুদের নাকি তেত্রিশ কোটি দেবতা ( পড়ুন দেবদেবী), আসলে সংস্কৃতে কোটি শব্দের দুটি অর্থ, একটি হল 'প্রকার' এবং অপরটি হল 'কোটি' (Crore)। বেদে তেত্রিশ কোটি (সংস্কৃত: ত্রয়স্তিমাশতি কোটি) দেবতা বলতে বেদে তেত্রিশ রকমের দেবতার কথা বলা হয়েছে। অথর্ব বেদের দশম অধ্যায় সপ্তম সূক্তের ত্রয়োদশ শ্লোকে বলা হয়েছে—
যস্য ত্রয়স্ত্রিংশদ্ দেবা অঙ্গে সর্বে সমাহিতাঃ
স্কম্মং তং ব্রুহি কতমঃ স্বিদেব সঃ।।
অর্থাৎ, পরম ঈশ্বরের প্রভাবে এই তেত্রিশ জন দেবতা বিশ্বকে বজায় রেখেছে।
শুরুতে ঋগবেদ-এ তিন (৩) রকমের দেবতার কথা বলা হয়েছিল। এঁরা ছিলেন- অগ্নি, বায়ু এবং সূর্য। ঋক্ বেদে পরবর্তী অধ্যায়ে সেই দেবতার সংখ্যা বেড়ে তেত্রিশ (৩৩) রকমের হয়। এঁদের মধ্যে এগারো জন পৃথিবীতে, এগারো জন বায়ুতে এবং বাকি এগারো জন মহাকাশ বা অন্তরীক্ষে অবস্থান করছেন।
বৃহদারণ্যক উপনিষদ-এ আছে—
"অষ্টো বসব একাদশ রুদ্রা দ্বাদদিত্যাস্ত একত্রিঙ্গিশদিন্দ্রশ্চৈব প্রজাপ্রতিশ্চ ত্রয়ত্রিঙশা চিতি"
অর্থাৎঃ অষ্ট বসু, একাদশ রুদ্র, দ্বাদশ আদিত্য এই কয়জন মিলিয়া একত্রিশ ও বাকি দুইজন (অশ্বিনীকুমারদ্বয়) মিলে তেত্রিশ জন দেবতা।
একই দেবতা বা দেবী যুগভেদে, স্থান, কাল, লৌকিক বিশ্বাস, অথবা কর্ম বিশেষে, আলাদা আলাদা নামেও পূজিত/ পূজিতা হন। এইভাবে সময়ের সাথে গোনাগুনতি তেত্রিশ কোটি না হলেও দেবদেবীর সংখ্যাও বেড়েছে। একই দেবতা যে ভিন্ন ভিন্ন নামে পূজিত বা পরিচিত হন সেকথা শ্রীমদ্ভাগবতেও আছে।
শ্রীমদভগবদগীতায় আছে,
"আদত্যানামহং বিষ্ণুর্জ্যোতিষাং রবিরংশুমান্।
মরীচির্মরুতামস্মি নক্ষত্রাণামহং শশী।।"
(আদিত্যদের মধ্যে আমি বিষ্ণু, জ্যোতিষ্কদের মধ্যে আমি কিরণশালী সূর্য, মরুতদের মধ্যে আমি মরীচি এবং নক্ষত্রদের মধ্যে আমি চন্দ্র।)
"রুদ্রাণাং শঙ্করশ্চাস্মি বিত্তেশো যক্ষরক্ষসাম্।
বসূনাং পাবকশ্চাস্মি মেরুঃ শিখরিণামহম্।।"
(রুদ্রদের মধ্যে আমি শিব, যক্ষ ও রাক্ষসদের মধ্যে আমি কুবের, বসুদের মধ্যে আমি অগ্নি এবং পর্বতসমূহের মধ্যে আমি সুমেরু।)
একেশ্বরবাদ বা বহু-ঈশ্বরবাদ নিয়ে নয়, আমরা আমরা আলোচনা করছিলাম দেব বাহন নিয়ে, দেবতা বা দেবীর বিষয়ে ভাবলেই সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে ভেবে নিই তাদের মুদ্রা, আয়ুধ এবং বাহনের কথা।এমনকি সামান্য ফুল জল দিয়েই পুজো করি কি ষোড়শোপচারে করি, তাঁদের সাথে তাদের আয়ুধ এবং বাহনেরাও পুজোর ভাগ পান। অর্থাৎ আয়ুধ ও বাহন ছাড়া দেবদেবীর স্বরূপ অসম্পূর্ণ। বাহন অনুযায়ী দেবদেবীদের নামও ধার্য করা হয়, এতই তাদের মহিমা। যেমন সিংহবাহিনী ( দেবী দুর্গা), হংসবাহিনী ( দেবী সরস্বতী) গরুড়বাহন ( বিষ্ণুদেব), মকরবাহন ( জলদেবতা বরুণ) ইত্যাদি।
দেবতাগণ ও তাদের বাহনদের মাঝে অংশীদারিত্ব কিন্তু পুরাণেও আছে। সেকথায় পরে আসছি। তবে প্রথমেই বলি, বাহন কি। সংস্কৃতে বাহন বা বাহানা শব্দটির আক্ষরিক অর্থ "যা বহন করে, স্থানান্তরে নিয়ে যায়"। আমাদের লৌকিক বিশ্বাসে বাহন মানেই সাধারণত একটি আমাদের চোখে দেখা জীব বা অথবা পৌরাণিক কাহিনীনির্ভর কল্পনাশ্রিত জীবসঙ্কর। নির্জীব বাহনও যে নেই তা নয়। যেমন স্বয়ং সূর্যদেবের সপ্তাশ্ব রথ বা নারদের ঢেঁকি, কুবেরের পুষ্পক রথ। আমাদের সাধারণ বিশ্বাসে আমরা ধরেই নিই বাহন আসলে দেবদেবীদের যানবাহনের বিকল্প যার পিঠে চেপে তাঁরা স্বর্গ মর্ত্য পাতাল, ত্রিলোক পরিভ্রমণ করেন।
ভিন্ন ভিন্ন দেবদেবীদের সাথে বাহনও ভিন্ন ভিন্ন কল্পনা করে নিই আমরা। যেমন, সূর্যদেবের বাহন সাত ঘোড়ায় টানা সোনার রথ। (প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সূর্যরথের সাতটি ঘোড়া সংস্কৃত সাত ছন্দের নামে---গায়ত্রী, বৃহতি, উষ্ণিক, জগতি, ত্রিষ্টুপ, অনুষ্টুপ এবং পঙ্ক্তি) ।সূর্যপুত্র যমের বাহন বিশালকায় মহিষ, আরেক সূর্যপুত্র শনিদেবের বাহন কাক, সূর্যকন্যা যমুনার বাহন কচ্ছপ, মূল ত্রিদেব, ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরের বাহন যথাক্রমে রাজহাঁস, গরুড় এবং নন্দী। এদের মধ্যে গরুড় কল্পিত জীবসঙ্কর — ঈগলমানব, নন্দী দুধসাদা রঙের ষাঁড়। যদিও পুরাণে নন্দীর এই রূপটি বিরল। কূর্মপুরাণে বলা হয়েছে, মহাদেবের এই প্রধান অনুচরটি করালদর্শন, বামন, বিকটাকার, মুণ্ডিতমস্তক, ক্ষুদ্রবাহু ও মহাবল। তারপর দেবী দুর্গার বাহন বিশালকার পাহাড়ি সিংহ, লক্ষ্মীদেবীর বাহন সাদা পেঁচা, সরস্বতীর বাহন রাজহাঁস, গণেশের বাহন ইঁদুর, কার্তিকের বাহন ময়ুর, দেবরাজ ইন্দ্রের বাহন সাদা হাতি ঐরাবত,দেবশিল্পী বিশ্বকর্মার বাহন হাতি, অগ্নিদেবের বাহন ভেড়া ( মতান্তরে বাঁকা শিং-এর পাহাড়ি ছাগল), বায়ুদেবের এবং চন্দ্রদেবেরও বাহন হরিণ, কালভৈরবের বাহন সারমেয়, দেবী মনসার বাহন সাপ, দেবী শীতলার বাহন গাধা, ষষ্ঠীদেবীর বাহন মার্জার, রতি ও মদনদেবের বাহন পারাবত দম্পতি, এভাবে আমাদের চোখে দেখা সব রকমের পশুপাখিই কোন না কোন দেবদেবীর বাহন। এমনকি মানুষ অব্ধি। আশ্চর্যের হলেও কুবের দেবের বাহন নর। আর সূর্যপুত্র শনিদেব বাহনের ব্যাপারে বেশ বিলাসী স্বভাবের। একটি দুটি নয়, গোনাগুনতি নয়টি বাহন নিয়ে তাঁর কারবার। হাতি, ঘোড়া, খচ্চর, ময়ূর, রাজহাঁস, শিয়াল, সিংহ, কাক এবং বৃষ।
যা বলছিলাম। আমাদের পূর্বপুরুষরা বিভিন্ন পশুপাখিতে বাহনগুণ আরোপ করেই ক্ষান্ত হন নি, তাদের ওপর দৈবগুণ আরোপ করতে কিছু কল্পকথাও জুড়ে দিয়েছেন। উচ্চৈঃশ্রবার নাম কে না জানে। পুরাণ অনুসারে সমুদ্রমন্থনের সময় এই দৈবঘোটকটি মন্থনোত্থিত হলে দেবরাজ ইন্দ্র এঁর ওপর নিজের কর্তৃৃত্ব বিস্তার করেন৷ সেই হিসাবে এটি দেবরাজের অন্যতম বাহন। আবার কারো মতে এটি সূর্য দেবতার বাহন তথা তার রথে অবস্থিত সাতটি ঘোড়ার একত্র রূপ, আবার কারো মতে অসুররাজ মহাবলীর বাহন৷ সে যাই হোক, ঘোড়া, আমাদের চোখে দেখা জীব, কিন্তু সাতটি মাথা এবং উড়ন্ত স্বভাব তাকে অন্য ঘোড়াদের থেকে স্বতন্ত্র করে দিয়েছে ৷ তাই সে দেবতা বা অধিদেবতার বাহনের যোগ্যতা বা সম্মান পেয়েছে। বিষ্ণুদেব যার ওপর অনন্ত শয্যায় শুয়ে থাকেন, সেই অনন্ত নাগ বা শেষনাগও কিন্তু দেববিষ্ণুর বাহনই বলা যায়। তারও কিন্তু পাঁচ পাঁচটি ফণা বা মুখ। আদতে পাঁচ ফণার সাপ আর কজন ই বা দেখেছি! একই ভাবে দেব মহাকালেশ্বরের সেনাপতি দেব কালভৈরবের বাহন তিনমুখো কালো সারমেয়। তার তিন মুখে আলাদা,আলাদা ভাবে শান্ত, উগ্র ও লোল বার্ধক্যরূপ প্রকাশিত হয়। যা আমাদের চোখে দেখা সারমেয়র মধ্যে দেখা যায় না। সর্বত্রই দেবতার বাহন বলে এই বিশেষত্বগুলি আরোপিত হয়েছে।
একটু ভাবুন তো, দেব-দেবীদের এই বাহনের ধারণাটা কি সত্যিই বাস্তবসম্মত নাকি মিথ্যা বা ভুল ধারণা। কারণ, দেব-দেবীরা ইচ্ছাশক্তিধর, বা ইচ্ছাশক্তিধারী। তাঁরা তাঁদের নিজেদের ইচ্ছামতো সূক্ষ্ম শরীরে যেখানে সেখানে এমনিতেই যাওয়া আসা করতে পারেন; এরপরও তাদের চলাচলের জন্য কোনো বাহনের প্রয়োজন আছে কী? আবার, সিংহের হয়তো দুর্গাকে বহন করার ক্ষমতা আছে, কিন্তু ময়ূরের কি কার্তিককে বহন করার ক্ষমতা আছে, না ইঁদুরের গণেশের মত নাদুসনুদুস ভুঁড়িদার চেহারাকে বইবার সামর্থ্য আছে? তাহলে পুরাণ বা ধার্মিক কথকতায় ময়ূর ও ইঁদুরকে, কার্তিক ও গণেশের বাহন বলে কেন ? কারণ, কথায় বলে visuals can be deceptive অর্থাত্, আমরা যা কিছু আমাদের চোখে দেখছি তার সরাসরি অর্থ না থেকে কোন অন্তর্নিহিত অর্থও থাকতে পারে। দেবদেবীদের বাহনের ধারণাটা অনেকটা সেইরকমই। প্রকৃতপক্ষে এই সব জীবজন্তু ঐসব দেব-দেবীকে বহন করে না, তারা বহন বা প্রকাশ করে অন্য কিছু। একটু বুঝিয়েই বলি। সামনে দুর্গাপুজা, তাই দেবী দুর্গা এবং তাঁর বাহন সিংহকেই উদাহরণ নিই। সিংহ হলো ক্রোধ ও ক্ষিপ্রতার প্রতীক, তাই সে দেবীর পদানত। শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হতে গেলে যে সিংহের মতো শক্তি, রাগ, ক্ষিপ্রতা ও হিংস্রতার দরকার, সিংহকে সাথে রেখে দেবী দুর্গা সেই বার্তাই দেন আমাদের। আবার দেবীপুরাণ মতে, দেবীর ক্রোধ থেকে সিংহের জন্ম আর দেবী স্বয়ং সেই সিংহবাহনা। অর্থাৎ নিজের ক্রোধকে নিজের আয়ত্তে রাখতে না পারলে জীবনযুদ্ধে জয়লাভ সম্ভব নয়। এইভাবে প্রতিটি বাহনের আলাদা মর্মার্থ আছে। ভিন্ন ভিন্ন দেবদেবীর বিশেষতা তাঁর বাহন দিয়ে বোঝানো হয়।
বায়ু দেবতার বাহন হল মৃগ বা হরিণ , যে বায়ু ছাড়া কেউ জীবনধারণ করতে পারবে না , যে বায়ু ঝড় হয়ে বয়ে গেলে এলাকার পর এলাকা লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় , সেই অতি শক্তিশালী বায়ুর বাহন কিনা এক নিতান্তই নিরীহ প্রাণী হরিণ। আয়ুর্বেদ শাস্ত্র অনুযায়ী যে ৩টি জিনিষ মানুষের শরীরে সবথেকে জরুরি তা হল , পিত্ত , বায়ু এবং কফ। হরিণের শিংকে পুড়িয়ে গরুর দুধের ঘিয়ের সঙ্গে খেলে বায়ুজনিত হৃৎশূল পৃষ্ঠশূল প্রভৃতি রোগ নিরাময় হয় —
"মৃগশৃঙ্গম অগ্নিদগ্ধং গব্যাদম্ সমন্নিতং
পীতং হৃৎপৃষ্ঠ শুলানাং ভবেৎনাশকরং সদা"
বায়ু কূপিত হলে শূলরোগ উৎপন্ন হয়। মৃগমাংসের স্বেদ অর্থাৎ ভাপ্ লাগালে বাতের ব্যথা দূর হয়। হরিণ পাওয়া গেল , বায়ুও পাওয়া গেল : সুতরাং বায়ু হল দেবতা ও তাঁর বাহন হল হরিণ।
তবে সব দেবতা বা দেবী ও তাঁদের বাহন এত সাদাসিধা প্রতীকার্থ বহন করে না। যেমন গরুড়বাহন বিষ্ণু ও গরুড়। এদের সম্পর্ক কিন্তু গূঢ় তাত্ত্বিক। ভাগবত পুরাণ মতে গরুড় জ্ঞানের প্রতীক। গরুড় নির্লোভ এবং তত্ত্বজ্ঞানী। অমৃত আহরণে সক্ষম হলেও অমৃতে তার কোন লোভ ছিল না। গরুড়ের এই চরিত্রে খুশি হয়ে বিষ্ণু তাকে বর দিতে ইচ্ছা করেন। তখন গরুড় অমৃতপান ব্যতীত অমরত্বলাভ এবং সর্বদা বিষ্ণুর উপরে থাকার প্রার্থনা করেন। বিষ্ণু তা স্বীকার করেন এবং গরুড়কে নিজের উপরে স্থান দিতে তিনি নিজের ধ্বজায় গরুড়কে স্থান দেন। এরপর গরুড় নিজেই বিষ্ণুকে বর দিতে ইচ্ছা করেন। বিষ্ণু বর হিসেবে গরুড়কে তার বাহন হতে বলেন এবং গরুড়ও তা মেনে নেন। অর্থাৎ বিষ্ণু কিন্তু জ্ঞানকে জয় করেন নি। জ্ঞান স্বয়ং বিষ্ণুকে অর্থাৎ জীবকুলকে স্বেচ্ছায় ( জীবের স্থিতিই যে বিষ্ণুদেবের আজ্ঞাধীন) আশ্রয় করেছেন।
এবার আরেকটি দেববাহন জীবসঙ্করের কথা বলি, যা আমাদের মূল আলোচ্যও বটে, সেটি হল মকর। মকর হল রহস্যময় প্রবৃত্তির প্রতীক। হিন্দু ধর্মে মকর দেবী গঙ্গা ও জলদেবতা বরুণের বাহন। এছাড়াও মকর হিন্দুদের প্রেম ও কামনার দেবতা কামদেবের প্রতীক। মকরকে সাধারণত জলজ প্রাণী মনে করা হয়ে থাকে; কেউ কেউ একে কুমির, আবার কেউ কেউ একে গাঙ্গেয় শুশুক বা ডলফিনের স্বরূপ মনে করেন। চিত্রশিল্পী বা মূর্তিশিল্পীরা বিভিন্ন সময়ে মকরের বিভিন্ন রূপ সৃষ্টি করে গেছেন। দেবী গঙ্গার বাহন মকর কুমীরের মাথাবিশিষ্ট মাছের আকার, বরুণদেবের বাহন মকর আবার হাতির মাথা বিশিষ্ট মাছের মত। মকরধ্বজের মকরের রূপও তাই। ভারতের উত্তরপ্রদেশের মথুরার সরকারী সংগ্রহশালায় যে প্রাচীন পোড়ামাটির কামদেব মূর্তিটি রাখা আছে সেখানে মকরকে সমুদ্রঘোড়ার মত কল্পনা করা হয়েছে, ঘোড়ার মত ঊর্ধ্বাংশে মাছের লেজ জোড়া। চণ্ডীমঙ্গলের দেবী কমলেকামিনী, যিনি ঐরাবতকে গিলে ফেলেই উগড়ে দেন, তাঁর বাহন শ্বেতমকর কিন্তু আবার ঐরাবত ও তিমি মাছের সঙ্কর। হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী সকল জীবন ও উর্বরাশক্তির প্রতীক হিসাবে জলের সঙ্গে মকরকে যুক্ত করা হয়।
আবার জ্যোতিষশাস্ত্রমতে দ্বাদশ রাশির অন্যতম মকর রাশি, যার অধিপতি মঙ্গল। নিয়ন্ত্রক দেবতা স্বয়ং মহেশ্বর। সেই হিসাবে দেবাদিদেবের সাথেও মকরের যোগ আছে। তবে তিনি মকরবাহন নন। তিনি শ্রীবিষ্ণু বা দেবী চণ্ডীর মত মকরকুণ্ডলধারী। এর ব্যাখা কি? বলা হয়,মকরকুণ্ডল আসলে সাংখ্য ও যোগের প্রতীক। যিনি বা যাঁরা সাংখ্য দর্শন ও যোগশাস্ত্র সমুদায় সম্পূর্ণ আয়ত্ত করেছেন, তাঁরাই একমাত্র মকরকুণ্ডল ধারণের যোগ্য।
মকরের উল্লেখ আছে মার্কণ্ডেয় পুরাণে, ভাগবত পুরাণেও। মার্কণ্ডেয় পুরাণে আবার মকরের সাথে তিমিঙ্গিলের উল্লেখও আছে। পরবর্তীকালের সুশ্রুত সংহিতায় আছে, তিমি, তিমিঙ্গিল, কুলিশা , মকর, গর্গলাক, কন্দর্ক, মহামীন, এইসব প্রাণীরা একই সামুদ্রিক পরিবারের সদস্য। ফলে মকর পুরোপুরি কল্পলোকের বাসিন্দা কিনা, সেটা নিয়ে ধোঁয়াশা থাকেই। আদতে কোন প্রাণী যে পুরাকালের লিপিকার/ চিত্রকরদের বর্ণনায় অতিশয়োক্তির কারণে হাঁসজারুর মত হয়ে গেছে, তা খুঁজে পাওয়া আর একেবারেই সম্ভব নয়। কেননা, খাজুরাহোর গুহাচিত্রে আবার যে মকরের ছবি পাই, তার খর্ব তুণ্ড, মোলায়েম গাত্র, অনেকটাই সীলের সাথে মিল দেখায়। জলজ প্রাণীদের মধ্যে সীল বুদ্ধিমত্তার প্রতীক। মকরের চেহারায় শুঁড় বা খাটো করে বললে তুণ্ড খুবই লক্ষ্যনীয়। শুঁড়, হাতির বা মকরের বর্ষামেঘের প্রতীক। বর্ষামেঘ আবার ভালো ফসলের সাথে সম্বন্ধযুক্ত। তাই হাতি এবং মকর ( উভয়েই বিত্তের প্রতীক) বৈভবলক্ষ্মী ও শ্রীদেবীর সাথেও দেখা যায়। কুবেরের আট বিশ্বস্ত অনুচরের অন্যতমও কিন্তু মকর। তবে তা কোন উপদেবতা বা অধিদেবতার নাম না মকর শ্রেণীর কল্পজীব, তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল।
মকরের উৎপত্তি নিয়ে ভাগবত পুরাণে একটা সুন্দর গল্প আছে। হাতিদের রাজা গজেন্দ্র একবার তার যূথের সাথে গঙ্গানদীতে স্নানে নেমেছেন। সাধারণত জলজ প্রাণীরা স্নানরত হাতির পালকে ঘাঁটায় না। কিন্তু এক ক্ষুধার্ত কুমির গজেন্দ্রের পা কামড়ে ধরে নদীর দিকে টানতে শুরু করলে অনেক চেষ্টা করেও গজেন্দ্র বা তার সঙ্গীরা গজেন্দ্রকে তো ছাড়াতে পারলই না, উলটে সেই দানবাকৃতি কুমির একটু একটু করে গজেন্দ্রকে গিলে খেতে লাগলো। উপায়ান্তর না দেখে গজরাজ তার আরাধ্য ভগবান বিষ্ণুর স্মরণ নিলে তিনি গরুড় ও সুদর্শনকে সাহায্যের জন্য পাঠালেন। এক অসম যুদ্ধ শেষে সুদর্শন চক্র দিয়ে সেই দানবাকৃতি কুমির বা নক্রাসুরের মুণ্ডচ্ছেদন করেন গরুড়। সৃষ্টি হয় মকরের। শ্রী বিষ্ণু সেই মকরকে বাহন হিসাবে দান করলেন তাঁর কনিষ্ঠতমা পত্নী গঙ্গাদেবীকে। শ্রী বিষ্ণুর বরে নদীর মধ্যে যেমন গঙ্গা সেরা, তেমনি জলজপ্রাণীকুলে সেরা হল মকর।
বাহন হোক না হোক হিন্দু ধর্ম ও বৌদ্ধধর্মের মন্দির বা উপাসনাগারে মকর তোরণ কিন্তু খুব কমন ব্যাপার। মেঝে থেকে ছাদ ছোঁয়া সুউচ্চ স্তম্ভ, যা আর্চ শেপের ছাদের পুরো ভার ধরে রাখে, সেই স্তম্ভের খিলানের দুইপাশে অবশ্যই উঁকি দেয় দুই /চার/ জোড় সংখ্যার মকরমুখ। হিন্দু ধর্মে সেইসব মকরের সঙ্গে থাকে নাগ, হাতি, ময়ূর জাতীয় বিভিন্ন পশুপাখি অথবা নৃত্যরতা নারী, বাদক পুরুষ, কীর্তিমুখ প্রভৃতি। বৌদ্ধধর্মে থাকে ড্রাগন, সপক্ষসাপ, হাতি, যক্ষ এবং অবতারের বিভিন্ন রূপ, বৌদ্ধদেবীদের মিনিয়েচার। এভাবেই বলি জাভা ইন্দোনেশিয়ার মন্দিরে মকর, গরুড় আর পক্ষবিহীন ড্রাগন একাকার হয়ে যায়।
ইন্দোনেশিয়ার বৌদ্ধ ধর্মমতে মকর এক অধিশক্তি, যা কিনা তামস বা গাঢ় অন্ধকারের অধীশ্বর/ উপদেবতা। বুদ্ধদেব যাকে অহিংসা অস্ত্রে পরাভূত করে নিজের আশ্রয়ে নিয়েছিলেন। মকর সেখানে বুদ্ধের বাহন কম, ভৃত্য বেশি। মকরকে বোধি অবতারের পায়ের কাছে বা মাথার ওপর ছত্রছায়া হয়ে আঁকা বা খোদাই করা হয়েছে। মহাযান বৌদ্ধমতে মকর gurdian of gateway.. যিনি কিনা আলো ও অন্ধকারের ভারসাম্য রক্ষা করেন। ভালো ও খারাপের ব্যবধান বজায় রাখেন। তিব্বতি মতে দেবাস্ত্র বজ্রের উৎসও মকরমুখ। এখানে কিন্তু মকরের রূপ অন্যরকম।ক্রিস্টির নিলামগারে বিক্রি হওয়া ত্রয়োদশ শতকের এক তিব্বতি ব্রোঞ্জপাত্রে যে মকরের ছবি পাই, তার সাথে ড্রাগনের মিল বিশেষ নেই। কুমিরের মত মুখ, মাছের মত আঁশ সারা গায়ে, ময়ূরের মত পুচ্ছ, হাতির মত শুঁড়, আর বানরের মত চোখ, কুমির মুখে আবার বন্যবরাহের মত বেরিয়ে আসা দাঁত নিয়ে সে এক অদ্ভুত কল্পচরিত্র। তিব্বতীয় বৌদ্ধ কাহিনীতে এই ড্রাগন কিন্তু বুদ্ধের অন্যতম পার্শ্বরক্ষক তথা বাহন। যখন বুদ্ধের অহিংসা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল তখন প্রাণীকুলের অন্তঃসংগ্রাম, বিদ্বেষ, মারামারি লোপ পেয়েছিল, সবাই মিলেমিশে শান্তিতে সহাবস্থান করতে করতে তাদের বর্ণ সঙ্কর জীবেদের উদ্ভব হয়। এভাবেই জন্ম নেয় বুদ্ধদেবের জলজ বাহন "সমুদ্র ঘোটক" মকর। সমুদ্র ঘোটক কারণ মকরের তিব্বতীয় নাম চুতা। চু অর্থাৎ জল, তা অর্থাৎ ঘোড়া।
আবার, দক্ষিণ ভারত ছুঁয়ে সিংহলী পটভুমিকায় মকর এক কিম্ভুতকিমাকার রূপ নেয়। মকর সেখানে সমৃদ্ধি আর স্বাতন্ত্র্যতার প্রতীক। সিংহলিজ গল্পে বলে, মহাপ্রতাপশালী কিম্বিল যক্ষ ছিলেন সমুদ্রের অধিপতি। দেব মদেশ্বরের ( মহাদেব?) কৃপাধন্য হয়ে জলের দেবতাকে তিনি বন্দি করলে দেবরাজ ইন্দ্র তাঁর সেনাপতি ময়ূরবাহন মুরুগানকে নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। দৈবঅস্ত্রবিদ ও কূট যোদ্ধা কিম্বিল যক্ষকে সরাসরি পরাস্ত করা সম্ভব নয় বুঝে মুরুগান তার ছোটো ভাই বুদ্ধির দেবতা পিল্লাই ( গজাননের) সাহায্য চান। গজানন বলেন, কোন জলচর প্রাণী কিম্বিলের ক্ষতি করতে পারবে না, এমনকি জলের আওতাতেও কিম্বিলকে হারানো অসম্ভব। নিয়ে আসা হয় স্থলজ পশুদের রাজা সিংহকে। কূর্মাবতারের পিঠে এক পক্ষকাল অশ্রান্ত যুদ্ধের পর কিম্বিল যক্ষকে পরাস্ত করে তাকে শাস্তিস্বরূপ বরুণের দাস/ বাহন নিযুক্ত করা হয়। বাহন হয়ে কিম্বিল এইসব দেবতাদের বাহনের গুণাবলি দাবী করায় কুমিরের দেহে ঐরাবতের শুঁড়, ইঁদুরের কান, ময়ুরের পেখম আর সিংহের থাবা যোগ হয়। তাই এই দৈব সিংহলিজ মকর আমাদের চেনা মকরের থেকে যোজন দূরের বস্তু।
দেবদেবীরা বাহন ধারণ করে বুঝিয়েছেন যে, প্রতিটা প্রাণীর অস্তিত্ব সৃষ্টির নিয়মরক্ষায় সমান গুরুত্বপূর্ণ। নিজেদের সুরক্ষার কারণে হিংস্র মাংসভোজী প্রাণীদের মেরে ফেললে তৃণভোজী প্রাণীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে এবং তৃণ সংকটে বনাঞ্চল ধ্বংস হয়ে যাবে। আবার তৃণভোজীদের সংখ্যা কমে গেলে প্রাকৃতিক খাদ্যশৃঙ্খলে অস্বাভাবিকতা দেখা দেবে। তাই মাংসভোজী এবং তৃণভোজীদের দেবতার বাহন হিসাবে দেখিয়ে অহেতুক প্রাণীহত্যা বন্ধ করার চেষ্টা করেছেন আমাদের পূর্বজরা।পৌরাণিক কাহিনী, লৌকিক উপকথা, কল্পকাহিনি — এসবের পুরু খোলসের নীচে এই সত্যটাই শুধু আজ ধামাচাপা পড়ে গেছে।
=======================
সুন্দরবনের লৌকিক দেবদেবী ও বনবিবি : লোকসংস্কৃতির অন্যতম বাহন
চিত্তরঞ্জন দাস
দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার দক্ষিণাংশে নদী নালা, খেত-খামার, ব - দ্বীপ ও নিবিড় ম্যানগ্রোভ অরণ্য নিয়ে গড়ে উঠেছে সুন্দরবন । গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র নদীর নিম্নগতির ফলশ্রুতিতে ভারত-বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরের উপকূলে অবস্থিত এই সুন্দরবন প্রাকৃতিক সম্পদ ও সৌন্দর্যৈ পৃথিবীর অন্যতম আশ্চর্য !
দেশভাগের পর ভারতবর্ষে সুন্দরবনের যেটুকু অংশ পড়েছে তার আয়তন ৯৬৩০ বর্গ কিলোমিটার । বাকি দুই তৃতীয়াংশ অধুনা বাংলাদেশের অন্তর্গত । ভারতীয় সুন্দরবনের ১২০ টি দ্বীপের মধ্যে মানুষ বসবাস করে ৫৪টি দ্বীপে, যার মধ্যে উত্তর চব্বিশ পরগণায় রয়েছে ৬টি ব্লক এবং দক্ষিণ চব্বিশ পরগণায় রয়েছে ১৩টি ব্লক। বাকি ৪৮ টি বনময় দ্বীপ নিয়ে গঠিত হয়েছে সংরক্ষিত বনাঞ্চল, অর্থাৎ রয়েল বেঙ্গল টাইগারের অবাধ বিচরণ ভূমি। ২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে সুন্দরবনের মোট জনসংখ্যা ৪৪,২৬,২৫৯ জন। সুন্দরবনের প্রায় ৯০% মানুষ কৃষিজীবী, যার মধ্যে অর্ধেকের বেশি মানুষ ভূমিহীন কৃষক। জলা-জঙ্গল থেকে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করে এদের অনেকেই জীবিকা নির্বাহ করে থাকে । তাই জলে কুমির এবং ডাঙায় বাঘের সঙ্গে সুন্দরবনবাসীদের জীবন যুদ্ধ চিরকাল অব্যাহত।
এই সুন্দরবনের ভূমিপুত্র বলে আজও কাউকে চিহ্নিত করা যায়নি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ডিরেক্টর জেনারেল সি. রাসেলের নেতৃত্বে ১৭৭০ -১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ব্রিটিশ প্রশাসনের উদ্যোগে জঙ্গল সাফাই করার জন্যে ছোটনাগপুর, সাঁওতাল পরগণা ও কোলহান অঞ্চল থেকে আগত মুণ্ডা, হো, ওঁরাও, সাঁওতাল, ভূমিজ প্রভৃতি তপশীল জাতি ও উপজাতির মানুষরা এখানে এসে স্থায়ীভাবে থেকে গেছে, তারাই সুন্দরবনের প্রকৃত ভূমিপুত্র! তাদের সঙ্গে গরিব ও উদ্বাস্তু মুসলমান, সেই সঙ্গে জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় আসা ভাগ্যান্বেষণকারী দরিদ্র বর্ণ হিন্দু জনগোষ্ঠীর মানুষ মিলেমিশে সুন্দরবনে তৈরি হয়েছে এক মিশ্র সংস্কৃতি। সমাজ-সংস্কৃতিবিদদের মতে, সংস্কৃতি একটি জাতির সম্যক প্রতিনিধিত্ব করে, যেখান থেকে একটি নির্দিষ্ট ভূভাগের মধ্যে বসবাসকারী আমজনতার ধর্মীয়- সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আচার-আচরণের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় উঠে আসে। সুন্দরবন অঞ্চলের নিম্নবর্গীয় জনজাতির সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী এই লোকসংস্কৃতির মূল বৈশিষ্ট্য সমষ্টি চেতনা ও ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক মনোভাব। সুন্দরবনের বনজীবী মানুষের এই মিশ্র লোকসংস্কৃতির বিশাল অংশ জুড়ে আছে এখানকার লোকধর্ম, যে লোকধর্মের প্রাণকেন্দ্রে অধিষ্ঠিত একাধিক লৌকিক দেবতা।
আভিধানিক অর্থে লোকজন দ্বারা স্বীকৃত দেবতাকে বলা হয় লৌকিক দেবতা অর্থাৎ এইসব দেবতা বেদ, পুরাণ বা অন্য কোন ধর্মশাস্ত্র দ্বারা স্বীকৃত নয়। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সুন্দরবনের বনজীবী মানুষ যেসব লৌকিক দেবতার আরাধনা করে থাকেন, তাদের মধ্যে প্রধান হল -- বাদাবনের অধিষ্ঠাত্রী দেবী বনবিবি, বাঘের দেবতা দক্ষিণরায়, কুমিরের দেবতা কালু রায়, ইসলাম প্রচারক ফকির গাজী ও বনবিবির একান্ত ভক্ত শিশু দুখে বা দুখে সাহা।
কৃষ্ণরাম দাসের রায়মঙ্গল, হরিদেবের রায়মঙ্গল এবং রুদ্রদেবের রায়মঙ্গল, সেই সঙ্গে মুন্সি বয়নুদ্দীন অথবা মোহাম্মদ খাতেরের বোনবিবি জহুরানামা কাহিনী ও সুন্দরবনের লোকসংস্কৃতি বিষয়ক বিভিন্ন গবেষকদের কাছ থেকে এইসব লৌকিক দেব দেবীর যে বিবরণ পাওয়া যায় তা এই রকম—
বনবিবি : সুন্দরবনের প্রধান লৌকিক দেবতা হলেন বনবিবি বা বিবি মা, যিনি অরণ্য দেবতা রূপে পূজিতা হন। প্রচলিত লোকগাথা থেকে জানা যায় আঠারো ভাটির দেশ সুন্দরবনের অন্যতম ভাটি ভূরকুণ্ডা দ্বীপে বনবিবির আদি পীঠস্থান। সুন্দরবনের অন্যান্য লৌকিক দেবতা, যেমন --- মা মনসা বা মা শীতলার মত বনবিবি উগ্র, ভয়াবহ বা প্রতিহিংসাপরায়ণ নন, বরং তিনি সুশ্রী, লাবণ্যময়ী ও ভক্ত-বৎসল। যেহেতু হিন্দু এবং মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ বনবিবির আরাধনা করেন, তাই এলাকা ভিত্তিতে বনদেবী বনবিবির মৃন্ময় মূর্তির সাজ-সজ্জার কিছু পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।
হিন্দু এলাকায় বনবিবির মাথায় থাকে মুকুট, নানা অলংকারসহ সুন্দর সাজসজ্জায় দেবী সজ্জিত থাকেন। অন্যদিকে মুসলমান এলাকায় দেবীর মাথায় টুপি, চুল বিনুনী করে বাঁধা, মাথায় টিকলি, গলায় বনফুলের মালা, পরণে ঘাঘরা ও পায়ে জুতো - মোজা। উভয় ক্ষেত্রেই বনদেবী বাঘের পিঠে আসীন থাকেন, কোলে থাকে ছোট্ট দুখে। বনদেবীর পূজায় কোন ব্রাহ্মণ প্রয়োজন হয় না কিংবা কোনো রকম বৈদিক মন্ত্র পাঠের প্রয়োজন হয় না। বোনবিবির জহুরানামা বা ওই রকম কোন পুঁথি পাঠ করে সাধারণ মানুষ এই পুজো করে থাকেন। সহজ কথায় বলতে গেলে বলতে হয়, বনবিবি কোন উচ্চ সম্প্রদায়ের দেবী ছিলেন না, তিনি ছিলেন নিম্ন সম্প্রদায়ের দ্বারা পূজিতা বনদেবী।
মোহাম্মদ খাতেরের বোনবিবি জহুরানামা থেকে জানা যায় মক্কাবাসী বেরাহীমের স্ত্রী ফুলবিবি ছিলেন সন্তানহীনা । তাই বেরাহীম শাহ জলিলের চতুর্দশবর্ষীয়া কন্যা গোলালকে দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন। এই গোলাল বিবি সন্তানসম্ভবা হলে ফুলবিবি ষড়যন্ত্র করে গোলাল বিবিকে সুন্দরবনের শ্বাপদসংকুল জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে আসেন। বনের মধ্যে গোলালবিবি যমজ সন্তানের জন্ম দেন। এদের একজন বনবিবি, অন্যজন তার ভাই সা - জঙ্গলী।
দক্ষিণ রায় : সেই সময় যশোহর জেলার ব্রাহ্মণ রাজা ছিলেন মুকুট রায় এবং তাঁর সেনাপতি ছিলেন ব্রাহ্মণ দক্ষিণ রায়। মুকুট রায়ের রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল সুন্দরবন পর্যন্ত। তাই তিনি আঠারো ভাটির দেশ সুন্দরবন শাসন করার জন্য রাজা করে পাঠান দক্ষিণ রায়কে। দক্ষিণ রায় ছিলেন বলশালী এবং অপরিসীম শক্তির অধিকারী। তাঁর বিক্রমে বনের বাঘও ভয়ে পালিয়ে যেত, তাই সুন্দরবনের বনজীবীরা দক্ষিণ রায়কে বাঘের দেবতা হিসেবে পূজা করে থাকেন।
দুখে শাহ : শিশু দুখে বনবিবির কোলে তার একান্ত ভক্তরূপে আশ্রয় পেলেও আসলে দুখে ছিল সুন্দরবনের নিপীড়িত মানুষের প্রতিনিধি। প্রচলিত কাহিনী থেকে জানা যায়, বরিজহাটীর ধনা (ধোনাই) এবং মনা (মোনাই) নামে দু'জন মউলি বাস করত, যারা জঙ্গল থেকে মধু সংগ্রহ করে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করত। একবার অনেক বেশি মধু সংগ্রহের জন্য তারা এক হতভাগ্য বিধবার একমাত্র পুত্র দুখেকে সঙ্গে নিয়ে সপ্তডিঙা সাজিয়ে বনে গমন করে। বনে গমনকালে আনন্দের বশবর্তী হয়ে ধনা বাঘের দেবতা দক্ষিণ রায়কে পূজা দিতে ভুলে যায়। তাই দক্ষিণ রায় কুপিত হয়ে বনের মধ্যে ধনাকে আটকে রাখতে চায় অথবা তার বদলে দুখেকে চায়। ধনা ও মনা নিজেদের প্রাণ রক্ষার জন্য দুখেকে কেঁদোখালির বনে ছেড়ে বাড়ি ফিরে আসে। দক্ষিণ রায় বাঘের ছদ্মবেশে দুখেকে খেতে এলে দুখে কাতর স্বরে বনবিবির সাহায্য প্রার্থনা করে—
"কহে মা বোনবিবি কোথায় রইলে এ সময় ।
জলদি এসে দেখ তোমার দুখে মারা যায় ।।"
ভক্তের কাতর আর্তনাদ শুনে বনবিবি তাঁর ভাই সা জঙ্গলীকে নিয়ে তাকে রক্ষা করতে আসে এবং যুদ্ধে অলৌকিক ক্ষমতাবলে বিপুল পরাক্রমী দক্ষিণ রায়কে পরাজিত করেন। দৈব ক্ষমতাবলে দুখেকে রক্ষা করার পর বনবিবির বনজীবীদের কাছে দেবতার স্বীকৃতি লাভ করেন এবং শেষ পর্যন্ত দক্ষিণ রায় দেবী বনবিবির বশ্যতা স্বীকার করলে দেবীর সঙ্গে তিনিও দেবতা হিসাবে পূজা পাওয়ার অধিকারী হন। দক্ষিণ রায়ের মৃন্ময় মূর্তির বিশেষত্ব হল যোদ্ধা বেশে তাঁর উপস্থিতি। মাথায় রাজ-মুকুট, কানে কুণ্ডল, কপালে রক্ত তিলক, হাতে তির ধনুক। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেবীর পদতলে তাঁকে নতজানু হয়ে উপবেশন করে থাকতে দেখা যায়। সাধারণতঃ পৌষ সংক্রান্তি বা তার পরের দিন অর্থাৎ মাঘ মাসের এক তারিখে বনবিবির সঙ্গে একসাথে দক্ষিণ রায়ের পূজা হয়ে থাকে।
গাজী ও কালু শাহ : মধ্য যুগের কবিদের রচিত কালু রায়মঙ্গল প্রভৃতি থেকে জানা যায় --- বৈরাট বা বিরাট নগরের রাজা শাহ সেকেন্দার বলি রাজার দর্প চূর্ণ করে তার কন্যা আজুফাকে বিবাহ করেন। আজুফার পুত্র জুলহাস যৌবনে হরিণ শিকারে গিয়ে গভীর অরণ্যে হারিয়ে যান এবং রাজা জঙ্গবাহাদুরের কন্যা পাঁচতোলাকে বিবাহ করে সেখানেই থেকে যান।
সন্তান শোকাতুরা আজুফা পুত্রের খোঁজে পাতাল নগরে আসার পথে সাগরের বুকে ভাসতে থাকা সিন্দুকের ভিতর এক ছোট্ট শিশু কালুকে কুড়িয়ে পান এবং তাকে পোষ্য পুত্রের পরিচয়ে লালন পালন করেন।
এই ঘটনার পর আজুফার গর্ভে আর এক সন্তান জন্মায়, যার নাম রাখা হয় গাজী। রাজা শাহ সেকেন্দারের বয়স হলে গাজীকে তিনি রাজ্যের ভার নিতে বলেন। গাজী সেই ভার নিতে অস্বীকার করে এবং ফকিরের পথ বেছে নেয়। ক্ষুব্ধ রাজা সেকেন্দার জল্লাদ ডেকে গাজীকে হত্যার নির্দেশ দেন—
"জল্লাদ ডাকিয়া শাহ কহেন রুষিয়া ।
আমার সম্মুখে এরে ফেলহ কাটিয়া।।"
কিন্তু দৈব কৃপাবলে গাজী প্রাণে রক্ষা পান। এরপর গাজী ও কালু দুই ভাই বিরাট নগর ছেড়ে সুন্দরবনের চলে যায় এবং সেখানে মুসলমান ধর্ম প্রচার শুরু করে।
মুসলমান বিদ্বেষী দক্ষিণ রায় গাজী ও কালুকে হত্যার জন্য জঙ্গলে উপস্থিত হলে সেখানে উভয়ের মধ্যে ঘোরতর যুদ্ধ বাধে। সেই যুদ্ধে দক্ষিণ রায় পরাজিত হয়। ফলে গাজী ও কালু — দু'জনকেই সুন্দরবনের সাধারণ মানুষ তাদের রক্ষাকর্তা হিসেবে দেবতার আসনে বসায়। রক্ষাকর্তা এই গাজীকে স্মরণ করে আজও সমুদ্রযাত্রার সময় মাঝিরা বলে —
"আমরা আছি পোলাপান
গাজী আছে নিখাবান।
শিরে গঙ্গা দরিয়া
পাঁচ পীর বদর বদর ।।"
কুমিরের দেবতা কালুর দুই হাতে থাকে টাঙ্গি ও ঢাল, পিঠে থাকে তির-ধনুক, যোদ্ধার বেশ। কালু শাহের পূজার অন্যতম মূল উপকরণ মদ। অন্যদিকে রক্ষাকর্তা গাজীর পরণে থাকে লুঙ্গি অথবা পাজামা-পাঞ্জাবি এবং তার মুখভর্তি সাদা দাড়ি।
যে সকল ফকির বনবিবি, দক্ষিণ রায় কিংবা গাজী ও কালু — এদের আরাধনা করেন,স্থানীয় মানুষের ধারণা এইসব ফকিররা মউল ও কাঠুরিয়াদের সঙ্গে ব্যাঘ্রসংকূল বাদাবনে গিয়ে মন্ত্রবলে 'বাঘ বন্ধন', ' বন বন্ধন' বা 'বাঘ-জব্দ' প্রভৃতি করতে সিদ্ধহস্ত। যে কারণে বনজীবীদের মধ্যে এই সব ফকিরদের প্রভাব ছিল অত্যন্ত বেশি।
বনবিবির পূজা খোলা মণ্ডপে করা হয়, কারণ ভক্তদের ধারণা পূজার দিন গভীর রাত্রে মা বনবিবি গ্রাম পরিক্রমায় বের হলে বনের বাঘেরা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসে। বনবিবির পূজার সময় ভক্তরা মায়ের নাম করে বনে জ্যান্ত মুরগি ছেড়ে দিত দেবীর বাহন বাঘের জন্য। কোথাও কোথাও ছাগ বলিরও প্রচলন ছিল। মুসলমান পল্লীতে বনবিবির পূজায় ফকিররা আটা, ময়দা,গুড় ও দুধ সহযোগে সিরনী তৈরি করে নৈবেদ্য হিসাবে দেবীর উদ্দেশ্যে দান করতেন। এইভাবে শ্বাপদসংকুল সুন্দরবনবাসীদের জীবন চর্চা ও তাদের সংস্কৃতিতে বনবিবি এবং অন্যান্য লৌকিক দেবদেবী আজও সমর্যাদায় সুপ্রতিষ্ঠিত।
তাদের এই ধর্মীয় সংস্কৃতি শুধুমাত্র বিনোদনের উপকরণ বা নিছক ধর্মীয় সংস্কারের বিষয় ছিল না। এই ধর্মীয় সংস্কৃতি তাদের ক্ষেত্রে বাঁচার মন্ত্র। জঙ্গলের হিংস্র বাঘ, বিষাক্ত সাপ,নদীতে কুমির, স্থলে ডাকাত, প্রাকৃতিক দুর্যোগ সেই সঙ্গে সামাজিক ও রাজনৈতিক শোষন -- সবকিছুর মধ্যে বীরের মতো লড়াই করে বেঁচে থাকার লড়াই থেকেই এই সংস্কৃতির জন্ম।
তবে যুগের পরিবর্তনকে অস্বীকার করা যায় না। পরিবর্তনের এই হাওয়া আজ সুন্দরবনেও লেগেছে। ফলে বনজীবীদের অর্থনীতির ক্ষেত্রে এসেছে পরিবর্তন, পরিবর্তিত হচ্ছেন সংস্কৃতি । যে কারণে লৌকিক দেব দেবতার পূজা, পালা গান, পাঁচালী প্রভৃতির প্রতি বর্তমান প্রজন্মের আগ্রহ কমছে। তাই সুন্দরবনবাসীরা যে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি থেকে আজ অনেকটাই সরে গেছে, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই।
তথ্যসূত্র:
১) সুন্দরবনের ইতিহাস --- কানাইলাল সরকার (পাণ্ডুলিপি)
২) সুন্দরবনঃ দারিদ্র ও বঞ্চনার সমীক্ষা --- সুকুমার সিং ও আশিস কান্তি ভট্টাচার্য্য (মাল্টি বুক এজেন্সি)
৩) সুন্দরবনের মৎস্যজীবীদের জীবন, তাদের লোকসংস্কৃতি এবং লোকসাহিত্য --- ইন্দ্রানী ঘোষাল (গ্রন্থন, দক্ষিণ গড়িয়া)
=======================
লালগোলার রথযাত্রা : ঐতিহ্যের বাহন
সুমন কুমার মিত্র
লালগোলা একটি প্রাচীন জনপদ। পদ্মা,গঙ্গা ও ভৈরব - এই তিন নদী বিধৌত শ্যামল বনানী ঘেরা স্থানের রথযাত্রা বঙ্গদেশের কয়েকটি বিখ্যাত রথযাত্রা ও রথের মেলার মধ্যে প্রসিদ্ধ।আজ থেকে ১৯৭ বছর পূর্বে এর সূচনা হয়।
রাজপরিবারঃ-
উত্তর প্রদেশের গাজিপুর জেলার পালীগ্রাম থেকে মহিমা রায় নামে এক জনৈক ভাগ্যান্বেষী ব্যক্তি পদ্মা নদীর পূর্বে অবস্থিত সুন্দরপুর ( বর্তমান বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার নবাবগঞ্জ থানার অধীন) গ্রামে এসে বাস করতে শুরু করেন এবং সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। তিনি কোন সম্পত্তি রেখে যেতে পারেন নি, তবে দুটি তেজস্বী পুত্র রেখে যান।
সুন্দরপুর গ্রাম পদ্মার ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় দলেল রায় ও রাজনাথ রায় যখন পদ্মার অপর পারে মুর্শিদাবাদ জেলার লালগোলা গ্রামে বাসা বাঁধলেন , লালগোলা তখন নিবিড় জঙ্গলে পূর্ণ । লোক বসতি সামান্য , ব্যবসা -বাণিজ্য বিশেষ নাই ৷ কিন্তু এই ভাগ্য বিপর্যয়ের মাঝেই লুকিয়ে ছিল দলেল রায়ের ভাগ্যোন্মেষ ।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক আকাশে তখন অশান্তির কালো মেঘ। সেই কালো মেঘ থেকে বজ্রাঘাত হল মুর্শিদাবাদ নবাব বংশে, অন্য দিকে একই মেঘ থেকে বৃষ্টি ঝরে পড়ল লালগোলা রাজ পরিবারের ওপর ।এই মেঘের অবিরাম বর্ষণ রাজ পরিবারের অঙ্কুরকে মহীরুহ করে তুলল ।
বাংলাদেশের রাষ্ট্র বিপ্লবের সাথে দলেল রায়ের সৌভাগ্য শুরু হয়। ১৭৪০ খ্রিস্টাব্দে নবাব সরফরাজ খাঁকে সিংহাসন চ্যুত করে আলিবর্দ্দী খাঁকে বাংলার মসনদে বসানোর যে ঘৃণিত ষড়যন্ত্র চলছিল, তার ক্লাইম্যাক্স লেখা হয় গিরিয়ার যুদ্ধে ।
আলিবর্দ্দী আজিমাবাদ থেকে সুতী এসে উপস্থিত হলে নবাব সরফরাজ খাঁ লালগোলার দেওয়ান সরাইয়ে শিবির স্থাপন করেন । মুর্শিদাবাদ থেকে নবাব নির্মিত রাজপথ দেওয়ান সরাইয়ের বুক চিরে চলে গিয়েছে উত্তর দক্ষিণে। সেসময় এটিই নবাবদের যাতায়াতের মুখ্য পথের একটি ছিল।এ বিষয়ে একটি গ্রাম্য কবিতা রয়েছে-
" নবাবের তাম্বু পড়িল ব্রাহ্মণের স্থলে
আলিবর্দির তাম্বু তখন পড়িল রাজমহলে।
নবাবের তাম্বু যখন পড়িল দেওয়ান সরাই,
আলিবর্দির তখন আইল ফারাক্কায়।"
সে সময় দলেল রায় বহু উপঢৌকন নিয়ে নবাব শিবিরে উপস্থিত হন। নবাব তাঁর অনেক সদগুণ লক্ষ্য করে তাঁকে জিলাদারী (জলপথে শান্তি রক্ষার দায়িত্ব) কাজে নিযুক্ত করেন। জিলাদারী কাজ করে বহু অর্থ সঞ্চয় করে কিছু সম্পত্তি ক্রয় করেন । লালগোলাতে দুই ভাইয়ের শ্রী বৃদ্ধি হয় বলে এই গ্রামের নাম দেওয়া হয় শ্রীমন্তপুর । এভাবে প্রতিষ্ঠিত হল লালগোলা রাজ এষ্টেটের ।
লালগোলা রাজ পরিবারের উন্নতি সর্বাপেক্ষা যাঁর হাত ধরে হয়েছিল, তিনি হলেন রাজা রাও রামশঙ্কর রায়। লালগোলা রথযাত্রার প্রচলনও তাঁরই হাত ধরে।
সময়টা ১২২৯ বঙ্গাব্দ ইংরেজী ১৮২৩ সাল, রাজা রাও রামশঙ্কর রায় একটি বিশাল কাঠের কারুকার্যময় রথ তৈরী করান। সেই রথের দৈর্ঘ্য ছিল প্রতিদিকে ত্রিশ হাত, উচ্চতা ছিল একশ হাত। এবং তার পরের বছর অর্থাৎ ১২৩০ বঙ্গাব্দে ইংরেজী ১৮২৪ সালে এই রথযাত্রার সূচনা হয়। কুলদেবতা শ্রীশ্রী দধীবামন দেব, যাঁর অপর নাম সুদর্শন দেব, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য এই যাত্রার প্রচলন। বর্তমান রাজবাড়ির ( যেটি এখন মুক্ত সংশোধনাগার ) ভেতরে নাট মন্দিরের পেছনে দোতলায় উত্তর দিকে শ্রীশ্রী দধীবামন দেবের মন্দির। পূর্বে সেই মন্দির থেকে শ্রীশ্রী দধীবামন দেবকে পূজা করে লাল শালুতে করে ঢেকে নিয়ে এসে রথে তোলা হত। এখন তাঁর নিবাস ১৩৩১ বঙ্গাব্দে লালগোলা রাজ পরিবারের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত, জুম্মন সেখ দ্বারা নির্মিত নারায়ণ মন্দিরে। সেই মন্দির থেকে দধীবামনদেবকে, যাঁর অপর নাম নারায়ণও বটে, একই নিয়মে এনে রথে তোলা হয়। ভক্তরা দড়িতে হাত দিলে রথ বিকেলে রাজপথে বের হয় এবং এক কিলোমিটার দূরে মাসির বাড়িতে, যেটি রাজপরিবার দ্বারা নির্মিত নাট মন্দির, সেখানে পৌঁছায়।
কাঠের রথটি বহুদিন পর ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যেতে থাকলে রাজা রাও রামশঙ্করের পুত্র রাও মহেশ নারায়ণ রায় একটি সুদৃশ্য রথ নির্মাণ করেন লোহা ও পিতল দিয়ে। বর্তমানেও সেই রথ লালগোলার গর্ব হিসেবে চিহ্নিত, যদিও তাঁর জৌলুস অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে, তাও আজও এই পিতলের রথ লালগোলার ঐতিহ্য বহন করছে।
মাসির বাড়িঃ-
এটা সহজেই অনুমেয় যে, সেই বছরই লালগোলা রথের যাত্রা কোথায় গিয়ে থামবে সেটিও নির্ধারিত হয় অর্থাৎ লালগোলা দধীবামন দেবের মাসির বাড়ি ৷ লালগোলা রথবাজার নামে যা আজও প্রসিদ্ধ, সেইখানে দধীবামন দেবের মাসির বাড়ি বা মন্দির স্থাপিত হয়।
এই মন্দিরে সেই সময় লালগোলায় রাজপরিবারের পক্ষ থেকে মহা ধূমধামের সাথে পূজোর আয়োজন করা হত, এবং ছাপ্পান্ন ভোগের আয়োজন ছিল।
কালের সাথে সাথে রাজপাট সমাপ্ত হয় ৬০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়। তার পূর্ব থেকেই মন্দির ভগ্নদশা প্রাপ্ত হতে শুরু করে, সেই সময় লালগোলার বেশ কিছু সাংস্কৃতিক মনোভাবাপন্ন মানুষ ১৯৬৬ সালে মন্দির প্রাঙ্গণে স্থাপন করেন লালগোলা সাংস্কৃতিক সংঘ। সাংস্কৃতিক সংঘ বহু নাটক লালগোলার মানুষকে উপহার দেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সাধন সরকার,অবনী ব্যানার্জি, সর্বানী রাহা, প্রমুখ। ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত এই মন্দির প্রাঙ্গণ বহু নাটকের মহড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মুখরিত থাকত। কিন্তু মন্দিরের দশা হয়ে যাচ্ছিল ভগ্নপ্রায়।
এই সময় লালগোলার কিছু উদ্যোগী যুবক মন্দিরটির দায়িত্ব কাঁধে নেন। ১৯৯৮ সাল থেকে তাঁরা মন্দিরের সাথে জুড়ে যান। এঁদের মধ্যে কয়েকজন হলেন, সুমিত সরকার, ডোমন হরিজন, বরুন দাস, রঞ্জিত দাস,সন্দীপ চক্রবর্তী, উত্তম পাল,সাগর দাস প্রমুখরা।
তাঁরা মন্দিরের দায়িত্ব নিয়ে ২০০৩ সালের মধ্যে মন্দিরের ভগ্ন ছাদ ও দেওয়াল ভেঙে তার পুনর্নির্মাণ করান।
দধীবামন দেবের পুজো চিরকাল এখানে হয়ে আসছে, রাজ এস্টেট পুজোর একটি খরচ আজও বহন করে। গত পাঁচ বছর ধরে লালগোলার মানুষের দ্বারা নির্মিত কমিটি পুনরায় ছাপান্ন ভোগ ও খিচুরি প্রসাদ বিতরণের ব্যবস্থা করেছেন।
এবার আসি এই মন্দিরের সেবাইয়েতদের বিষয়ে। মন্দিরের বর্তমান সেবাইয়েত শ্রীরাম চন্দ্র পাঠক ও তাঁর পুত্ররা। রামচন্দ্র পাঠকের থেকে জানা যায়, উনি ১৯৬২ সালে এই মন্দিরের সেবাইত হন। তাঁর পূর্বে তাঁর দাদা শ্বশুর শ্রী রামসুখ তিওয়ারী এই মন্দিরের বংশানুক্রমিকভাবে সেবাইতের দায়িত্ব পালন করতেন। তাঁর মৃত্যুর পরে রামচন্দ্র পাঠক আজ পর্যন্ত সেবাইত নিযুক্ত ও তাঁকে সহায়তা করেন তাঁর পুত্র শ্রী গিরিধারী পাঠক ও অন্যান্যরা।
রথবাজারঃ-
লালগোলা রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে স্বাধীনতা পূর্ববর্তীকালে অবিভক্ত বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ আসত। পূর্বে উল্লেখিত মাসির বাড়ি, যা নাটমন্দির নামেও পরিচিত, তাকে কেন্দ্র করে প্রায় তিন মাস ধরে একটি বিশাল বাজার বসত যা রথবাজার নামে খ্যাত। সেই বাজারে মালদহ, মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন প্রান্ত ও পদ্মার ওপার থেকে বহু ব্যবসায়ীর সমাগত হত। চলত বেচাকেনা, শক্ত হত লালগােলার অর্থনীতি। রথবাজারে মাসির বাড়ি, যা নটরাজ মন্দির নামে খ্যাত, তার চারপাশ ঘিরে বসত বিস্তীর্ণ বাজার, মূল বাজার ছাড়া আলাদাভাবে এ বাজার বসত। একদিকে সারিদ্ধভাবে বসত বাহারি পাখার বাজার, এপার ওপার বাংলার বহু পাখার ব্যবসায়ী আসত তাদের সম্ভার নিয়ে। রথবাজারের পূর্বদিকে বসত বাসনের বাজার, অধুনা বাংলাদেশের নবাবগঞ্জ থেকেই শুধুমাত্র এই বাসনের সম্ভার নিয়ে হাজির হতাে ব্যবসায়ীরা। বাজারের পশ্চিম প্রান্তে রঘুনাথগঞ্জ থানার অন্তর্গত দয়ারামপুর গ্রাম থেকে আসত ময়রাদের দোকান। উৎকৃষ্ট মিষ্টি বিক্রি হতাে সেই বাজারে। ভেতরে প্রায় তিনটে সারিতে পর পর বসতাে মণিহারির দোকান। তিনমাস কাল ধরে চলতন কেনাবেচা। মানুষের ভিড় পড়ত উপচে। এর থেকে বােঝা যায়, এই অঞ্চলের মানুষের আর্থিক স্বচ্ছলতা যাই থাক না কেন, ইচ্ছে ছিল পরিপূর্ণ। উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি থেকেই লালগােলা নদী বন্দর হিসেবে বিশেষ খ্যাতি লাভ করেছিল। বিহার, উত্তরপ্রদেশ থেকে বড়াে বড়াে নৌকায় তেল, ঘি, গুড়, পাথরের শিল নােড়া ও থালা বাসন এখানে আসত। ওধারে পাবনা, ঢাকা, ফরিদপুর, বরিশাল থেকে পাট, ধান, শুটকি মাছের সম্ভার বহন করে আনত বড়াে বড়াে নৌকা। লালগােলা ঘাটেই হত আদান-প্রদান। বাজার মালিক লালগােলা এস্টেট থাকায় তার থেকে প্রচুর অর্থাগম হত, এভাবেই ক্রমশ লালে লাল হয়ে ওঠে লালগোলা।
২০২০ সাল থেকে পর পর অতিমারীর জন্য প্রশাসনিক অনুমতি না মেলায় অতি প্রাচীন এই রথযাত্রা স্থগিত রয়েছে,তবে দধীবামন দেবের শিলা সিংহাসনে বসে পুরোহিত ও ভক্তের হাতে হাতে পৌঁছয় তাঁর মাসির বাড়ি। মেলা এবছর বন্ধ, ফাঁকা থেকে গেছে লালগোলার সমস্ত ধর্মের মানুষের একটি মিলন ক্ষেত্র লালগোলা রাজবাড়ি প্রাঙ্গন। আশা করা যায় আগামীতে এ দুর্দিন কেটে গেলে আবার রথযাত্রা উৎসব তাঁর পুরনো রূপ ফিরে পাবে।
তথ্যসূত্র-
১) মহামানব জাতক - সুধাকর চট্টোপাধ্যায়
২) মুর্শিদাবাদ অনুসন্ধান দ্বিতীয় খণ্ড, সম্পাদনা— অরিন্দম রায়।
৩) মুর্শিদাবাদ অনুসন্ধান চতুর্থ খণ্ড , সম্পাদনা — অরিন্দম রায়।
৪) সাক্ষাৎকার- রামচন্দ্র পাঠক(বয়স-৮০ বছর), সেবাইত দধিবামনদেব মন্দির।
=======================
No comments:
Post a Comment