Thursday, September 30, 2021

প্রবন্ধ/নিবন্ধ-২

বেতার : বিনোদনের একদা বাহন

ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

২৬শে অগস্ট ছিল রেডিওর জন্মদিন । চুরানব্বই বছর বয়স হল তার । শুভ জন্মদিন হে, কলকাতা রেডিও ।

''যা হারিয়ে যায় তা আগলে বসে রইব কত আর'’ (রবীন্দ্রনাথ) । 

আমাদের শৈশবের সাংস্কৃতিক জীবনের অনেক কিছুর মতো, সেও হারিয়ে গেছে । তাকে আর আগলে বসে নেই শুধু স্মৃতিটুকু থেকে যায়, কিংবা আগলে রাখি — যতদিন রাখা যায় । বলছি রেডিওর কথা । ইতিহাস নয়, স্মৃতি – স্মৃতিচারণ । সেই স্মৃতিই হয়তো টেনে আনে ইতিহাসেরও তথ্য ।

আমাদের শৈশবে রেডিও ছিল পরম বিস্ময় । বিদ্যুৎ সংযোগ করলেই একটা চৌকো কাঠের বাক্সের ভেতর দিয়ে কথা, গান ভেসে আসত । আর আমরা অবাক বিস্ময়ে সেই চৌকো বাক্সটার দিকে চেয়ে বসে থাকতাম, তা থেকে বেরিয়ে আসা কথা, গান শুনতাম অনেকটা সেই গ্রামোফোন রেকর্ডে ছাপ মারা হিজ মাস্টার্স ভয়েসের সেই গ্রামোফোনের চোঙার সামনে বসে থাকা কুকুরটার মত । বিস্ময় বৈকি ! আর কি মাধুর্যময় শব্দ । ভাবতাম এতো মাধুর্যময় শব্দোচ্চারণও হতে পারে ! শৈশব থেকে কৈশোর পর্যন্ত কেটেছে সেই বিস্ময়ের ঘোরে । তখন তো বিনোদনের এমন বন্দোবস্ত আর কিছু ছিল না । ছিল শুধু দম দেওয়া কলের গান, আর ছিল চলচ্চিত্র । সেও তো তখন অপরিণত, সবেমাত্র কথা বলতে শেখা, শৈশবের আমরা তার নাগাল পাব কেন ? তাই আমার শৈশব-কৈশোরের প্রথম বিস্ময় রেডিও । আমাদের রেডিও কেনার সঙ্গতি ছিল না, জেঠিমার বাড়িতে আমার শৈশব-কৈশোরের রেডিও-স্মৃতি ।

পুরনো সেই দিনের কথা : ঘরে ঘরে এমন রেডিও সেট ছিল অত্যন্ত সহজলভ্য, চিত্র-সৌজন্য— গুগল

রেডিওর প্রচলন বিনোদন ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে দেশ ও দুনিয়ার কথা জানার একটা সহজলভ্য ও অপরিহার্য বন্দোবস্ত ছিল । রেডিওকে ঘিরে আমাদের অনেক স্মৃতি যা ফুরোবার নয় । এখন রেডিওর যুগ প্রায় শেষ হয়েছে, রেডিও তার আভিজাত্য হারিয়েছে । কিন্তু একটা সময় ছিল যেদিন মধ্যবিত্ত মানুষের বিনোদনের যাবতীয় সম্ভার রেডিও নামক এই শ্রাব্য মাধ্যমে পরিবেশিত হত । সঙ্গীত, দেশ-দুনিয়ার সংবাদ, সংবাদ পর্যালোচনা, মহিলাদের আসর, সঙ্গীত শিক্ষা, গল্প বলার আসর, শিশুমহল, পল্লীমঙ্গল, নাটক, অনুরোধের আসরে পছন্দের গান শোনা, খেলার সরাসরি সম্প্রচার, গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা – সব কিছুর জন্য রেডিওর আর কোন বিকল্প ছিল না । তখন রেডিও ব্যবহারকারীদের লাইসেন্স ফী দিতে হত । মনে পড়ে সম্ভবত ১৯৭০-৭১ সনেও বার্ষিক ১৫ টাকার লাইসেন্স ফী দিয়েছি । কবে থেকে লাইসেন্স ফী দেওয়া উঠে গেল আমার স্মরণে নেই ।

‘স্মৃতিপীড়া’ কথাটা নস্টালজিয়া শব্দটির সঠিক প্রতিশব্দ হবে কি না জানি না । কিন্তু একথায় বোধকরি কোন সংশয়ের অবকাশ নেই যে বেশি দিন নয়,  সত্তর দশকেও যাদের শৈশব কেটেছে তেমন মানুষ আজও রেডিওর কথা বলতে গিয়ে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন ।

১ নম্বর গার্স্টিন প্লেসে (ডালহৌসিতে টেলিফোন ভবনের উলটো দিকে) ছিল রেডিও স্টেশন ও স্টুডিও । ১৯২৭-এর ২৬শে অগস্ট কলকাতায় বেসরকারী উদ্যোগে বেতার সম্প্রচার শুরু হয়, করেছিল ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানী । কলকাতার একমাস আগে তারাই বম্বেতে দেশের প্রথম বেতার ব্যবস্থার সূচনা করে ১৯২৭-এর ২৩শে জুলাই । ১৯৩০-এর মার্চে বেসরকারী রেডিও কোম্পানিটি দেউলিয়া হয়ে যায় । ফলে ১লা এপ্রিল ১৯৩০ থেকে বেতার সম্প্রচার ব্যবস্থা সরকার নিজের হাতে নিয়ে নেয়, নাম হয় ‘স্টেট ব্রডকাস্টিং সার্ভিস’ । ৮ই জুন ১৯৩৬ থেকে সেই নাম পরিবর্তিত হয়ে হয় ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’ । স্বাধীনতা পরবর্তী কয়েক প্রজন্মের কে না শুনেছেন ‘দিস ইস অল ইন্ডিয়া রেডিও, দি নিউজ রেড বাই......’ আর সকাল ৫টায় রেডিওর সেই অনন্য সিগনেচার টিউন (তিমিরবরণ কৃত) ! পাশের বাড়ি থেকে ভেসে আসা সেই সিগনেচার টিউন শুনে আর ঘড়ি দেখতে হত না । রেডিওর সেই সিগনেচার টিউন ছিল যেন মানুষের কর্মব্যস্ততার দিন শুরু হওয়ার ছাড়পত্র । 

কলকাতায় আকাশবাণী ভবন, চিত্র-সৌজন্য — গুগল

কৈশোরের কথা আজও মনে আছে । তখন রেডিও স্টেশনে তরুণদের গার্স্টিন প্লেসের সেই বিস্ময় কেন্দ্র ঘুরিয়ে দেখানোর ব্যবস্থা ছিল । আমিও পাশ পেয়েছিলাম । আরো কয়েকজনের সঙ্গে আমিও বেতারকেন্দ্রের স্টুডিও থেকে অনুষ্ঠান কি করে সম্প্রচারিত হয় ঘুরে দেখেছিলাম । আর একবার সুযোগ পেয়েছিলাম ‘গল্পদাদুর আসরে’ যাবার । তখন ‘গল্পদাদুর আসর’ পরিচালনা করতেন সুকন্ঠ সুদর্শন জয়ন্ত চৌধুরী । 

এখন টেলিভিশনের নানান চ্যানেলের হরেকরকম টক-শো হয়, শিশু-কিশোরদের জন্য হরেকরকম অনুষ্ঠানও হয় । সে সব অনুষ্ঠান দেখে আমরা পুলকিত হই বটে, কিন্তু বেতারের সেইসব অনুষ্ঠান মার্জিত ও রুচিশীল সম্প্রচারগুলির কাছাকাছি আসতে পারে বলে অন্তত আমার মনে হয় না । হতে পারে তার একটা কারণ নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, শহুরে- গ্রামীণ সব শ্রেণীর মানুষের জন্য বিনোদনের আর কোন সহজলভ্য মাধ্যম তখন ছিল না । ইন্দিরা দেবীর পরিচালনায় রেডিওর ‘শিশুমহল’ শুনে শৈশব-কৈশোর কেটেছে যাদের, তাদের মনে পড়বে প্রতি রবিবার সম্ভবত সকাল সাড়ে ৯টায় ‘শিশুমহল’ শুরু হত, ইন্দিরা দেবীর কন্ঠে ‘কি ছোট্ট সোনা বন্ধুরা, ভালো আছো তো সব ?’ আর একদল কচিকাঁচা সমস্বরে বলত’ ‘হ্যাঁ’ । 

শিশুমহলের ঠিক আগে রবিবার সকাল ৯টায় হত পঙ্কজকুমার মল্লিকের পরিচালনায় ‘সঙ্গীত শিক্ষার আসর’ । পঙ্কজকুমার মল্লিক ছিলেন বাংলার সঙ্গীত জগতের প্রবাদ পুরুষ এবং বেতার সম্প্রচারের হাত ধরেই পঙ্কজ কুমারের ‘লিজেন্ড’ হওয়া । ১৯২৭-এর ২৬শে সেপ্টেম্বর পঙ্কজকুমার প্রথম রেডিওতে গান করেন । এর ঠিক একমাস আগে ২৬শে অগস্ট বেসরকারী উদ্যোগে ‘ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি’ চালু করে কলকাতার রেডিও সম্প্রচার । প্রতি রবিবার সকাল সাড়ে নটার যে সঙ্গীত শিক্ষার আসরের কথা বলছি, সেটির সম্প্রচার শুরু হয় ১৯২৯ সনের শেষের দিকে । দীর্ঘ ৪৬ বছর ধরে পঙ্কজ কুমার মল্লিক রেডিওর সঙ্গীত শিক্ষার আসরটি পরিচালনা করতেন । ১৯৭৫-এর সেপ্টেম্বরে রেডিওর কর্তৃপক্ষ একটা চিঠি ধরিয়ে পঙ্কজ কুমারকে জানালেন যে তাঁকে ‘সঙ্গীত শিক্ষার আসর’ পরিচালনা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হল। কলকাতা রেডিও থেকে পঙ্কজ কুমারের অনাদর বিদায় শিল্পীমহলকেও সেদিন বিচলিত করেছিল ।

রেডিওর আর এক প্রবাদপুরুষ ছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র । তিনিও শুরু থেকে কলকাতা রেডিওর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন । শুধু যুক্ত ছিলেন বললে কিছুই বলা হয় না, তিনি ছিলেন রেডিওর প্রাণ । আমাদের কৈশোর স্মৃতিতে রেডিও মানেই বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র । রেডিওর প্রচলন হওয়ার কালে বাঙালির বিনোদন বলতে ছিল নির্বাক চলচ্চিত্র (সবাক হয় ১৯৩১-এ), আর কিছু বিত্তবান মানুষের ঘরে কলের গান বা গ্রামোফোন । তিনি কিই না করেছেন রেডিওর জন্য । বস্তুত বীরেন্দ্রকৃষ্ণের হাত ধরেই হয়েছিল বাঙালির বেতার রুচি ও বেতার সংস্কৃতির নির্মাণ, নতুন নতুন বেতার অনুষ্ঠান উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে । তাঁর যোগদানের বছরে ১৯২৮-এ শুরু হয় বেতার নাটকের সম্প্রচার । ছেলেবেলার কথা মনে আছে প্রতি শুক্রবার সন্ধ্যা ৭-৪৫ থেকে রাত্রি ৯টা পর্যন্ত হত নাটক বীরেন্দ্রকৃষ্ণের প্রযোজনায় । বাংলার নাট্য ইতিহাসের প্রবাদ-প্রতিম সব নাটক রেডিওতে হত । 'সাহজাহান', ‘সিরাজদৌল্লা’, ‘চন্দ্রগুপ্ত’, 'দুর্গেশ নন্দিনী’, ‘কপালকুন্ডলা’, ‘কবি’, ‘কালিন্দি’, ‘দুই পুরুষ’, ‘প্রফুল্ল’ প্রভৃতি কালজয়ী নাটকের অভিনয় রেডিওতে শুনেছি । মঞ্চ ও চলচ্চিত্রের দিকপাল অভিনেতারা সেইসব নাটকে অভিনয় করতেন । অহীন্দ্র চৌধুরী, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, নরেশ মিত্র, ছবি বিশ্বাস, জহর গাঙ্গুলী, মলিনা দেবী, সরজুবালা, অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়, বিকাশ রায়, মঞ্জু দে, শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়দের বেতার অভিনয় যারা শুনেছেন তাঁরা নিশ্চিতভাবেই এখনও স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন । এখনকার নাট্যমাধ্যম শ্রুতি নাটকের যে ধারণা তার উদ্ভব হয়েছে রেডিও নাটকের মধ্য দিয়ে । বীরেন্দ্রকৃষ্ণের পরে তাঁর স্থানে আসেন জগন্নাথ বসু ।

পরের বছর অর্থাৎ ১৯২৮-এর ১৫ই জানুয়ারি বেতার কর্তৃপক্ষ একটি সাহিত্যপত্রিকা (পাক্ষিক না মাসিক মনে নেই) ‘বেতার জগৎ’ প্রকাশনা শুরু করেন । পত্রিকাটিতে থাকত বেতারের অনুষ্ঠানসূচির সঙ্গে গল্প উপন্যাস, প্রবন্ধ ইত্যাদি নানান সাহিত্যকর্ম । বেতার গ্রাহকদের কাছে খুবই জনপ্রিয় ছিল পত্রিকাটি । শারদীয়া বিশেষ সংখ্যাও প্রকাশিত হত । যতদূর জানি ১৯৮৬ সনের পর ‘বেতার জগৎ’এর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায় । 

গানপাগল আমাদের কাছে খুব জনপ্রিয় ও কাঙ্খিত অনুষ্ঠান ছিল অনুরোধের আসর । রেডিওই ছিল গান শোনার একমাত্র সর্বজনীন মাধ্যম , রেডিওতে শিল্পীরা স্টুডিওতে নিজে এসে গাইতেন অর্থাৎ টাটকা বা লাইভ অনুষ্ঠান, গ্রামোফোন রেকর্ডে বাজানো গান । ‘বেতার জগৎ’এ সমস্ত অনুষ্ঠানের সময়সূচি দেওয়া থাকত ৷ গ্রামোফোন রেকর্ডের গানের অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে শিল্পীর নামের পাশে একটা + চিহ্ন দেওয়া থাকত । এ ছাড়া আকাশবাণীর স্টুডিওতে রেকর্ড করা হত গানের, সেগুলিকে বলা হত ‘রম্যগীতি’  ৷  দুপুরের দিকে ‘রম্যগীতি’র অনুষ্ঠান হত । 

আকাশবাণীর স্টুডিওতে রেকর্ড করা বহু গান দারুণ জনপ্রিয় হয়ে গ্রামোফোন রেকর্ডে ধ্বনিবদ্ধ হয় । প্রবল জনপ্রিয় হওয়া পরেশ ধরের কথা ও সুরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গীত ‘শান্ত নদীটি, পটে আঁঁকা ছবিটি’ , ‘ফুলের মত ফুটলো ভোর ভাঙলো মাঝির ঘুমের ঘোর’, সলিল চৌধুরীর কথা ও সুরে সবিতা চৌধুরীর ‘হলুদ গাঁদার ফুল দে এনে দে’ গানগুলি আদতে রেডিওর রম্যগীতির আসরেই প্রথম প্রচারিত হয় ।

পঙ্কজ কুমার মল্লিক, চিত্র-সৌজন্য : গুগল

চণ্ডীপাঠরত বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র : বেতার জগতের প্রাণ, চিত্র-সৌজন্য — গুগল

১৯৩১-এ মহালয়ার দিন শুরু হয়েছিল কলকাতা রেডিওর কালজয়ী অনুষ্ঠান ‘মহিষাসুর মর্দিনী’ । বাণীকুমার-এর রচনা, পঙ্কজকুমার মল্লিকের সঙ্গীত পরিচালনা আর বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর চণ্ডীপাঠের সেই অনুষ্ঠান বাঙালির দুর্গাপূজা সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে গেল । গ্রাম-শহরের মানুষ অন্তত একদিন দেড়ঘন্টার জন্য রেডিও শোনার জন্য তাদের অকেজো রেডিও সেটটিকে সারিয়ে নিতে রেডিও সারাইয়ের দোকানে হাজির হন । ছিয়াশি বছর পরে আজও টেপ-এ ধরে রাখা সেই অনুষ্ঠান মহালয়ার ভোরে সম্প্রচারিত হয় । প্রবাদ হয়ে যাওয়া এই অনুষ্ঠান সম্পর্কে নতুন করে আর কিছু বলার নেই । বাঙালির কাছে এই অনুষ্ঠানের স্থান কোথায় তা অন্তত একবার বুঝেছিল কলকাতা বেতারের কর্তৃপক্ষ । অনুষ্ঠানে অভিনবত্ব আমদানি করতে চেয়েছিল তারা । বীরেন্দ্রকৃষ্ণকে না জানিয়ে তারা গোপনে ঠিক করলেন জনপ্রিয় চিত্রাভিনেতা উত্তমকুমার ভাষ্যপাঠ করবেন, সংস্কৃত শাস্ত্রে কৃতিবিদ্য ডক্টর গোবিন্দগোপাল মুখোপাধ্যায়ের রচনায় । যথা সময়ে মহালয়ার প্রাতে সে অনুষ্ঠান হয়েছিল এবং চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ বা সুপার ফ্লপ । বেতার কেন্দ্রে বিক্ষোভ আর সংবাদপত্রে পাঠকের চিঠি্র পাতাগুলি ভরে গেল সমালোচনায় । প্রবল ক্ষোভের মুখে বেতার কর্তৃপক্ষ বাধ্য হল সে বছরই মহাষষ্টির সকালে মহিষাসুর মর্দিনীর সম্প্রচার করতে । সেই একবার , পরের চল্লিশ বছরে এপর্যন্ত এই রকম অপ-সাহস আর হয়নি ।

১৯৪১-এর ৭ই অগস্ট এক আশ্চর্য কান্ড ঘটিয়েছিল কলকাতা রেডিও । রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণ হয়েছে । তারা রবীন্দ্রনাথের শোক মিছিলের ধারাবিবরনী সম্প্রচারের ব্যবস্থা করল । কলকাতা রেডিওর প্রাণপুরুষ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রই জোড়াসাঁকো থেকে নিমতলা মহাশ্মশান – পুরো শোক-যাত্রার ধারাবিবরণী দিয়েছিলেন । আকাশবাণীর সংগ্রহশালায় সেই বিবরণী ধ্বনিবদ্ধ করে রাখা আছে । সেই ধারা বিবরণীর শেষ কয়েকটি পংক্তি বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কন্ঠে – “......ও পারে দূরের ওই নীলাকাশে অস্তগামী সূর্য শেষ বিদায়ের ক্ষণে পশ্চিম দিগন্তে ছড়িয়ে দিল অগ্নিবর্ণ রক্তিম আভা, আর এপারে এই পৃথিবীর বুকে বহ্নিমান চিতার লেলিহান অগ্নিশিখায় পঞ্চভূতে বিলীন হল এক মহাপ্রাণের পূত-পবিত্র শরীর। রবি গেল অস্তাচলে...।” 

এটাই প্রথম কোন ঘটনার টাটকা বিবরণীর সম্প্রসারণ কি না বলতে পারবো না । 

ফুটবল খেলার ধারা বিবরণী সম্ভবত রেডিওর শৈশবেই শুরু হয়েছিল । আমার রেডিও শোনার শুরু পঞ্চাশ দশক থেকে । যারা খেলার মাঠে যেতে পারতাম না তাদের ভরসা ছিল রেডিও । মনে আছে পঞ্চাশ- ষাটের দশকে ইংরাজিতে ফুটবল ও ক্রিকেট খেলার ধারা বিবরণী দিতেন পিয়ার্সন সুরিটা, সিডনি ফ্রিসকিন, বেরী সর্বাধিকারী, দেবরাজ পুরী, শরদিন্দু সান্যাল প্রমুখ । ১৯৫৭ সাল থেকে বাংলায় ফুটবল খেলার ধারাবিবরণী শুরু হয় । ফুটবল ও ক্রিকেটের বাংলা ধারাবিবরণীর ক্ষেত্রে তিনটি নাম প্রবাদের মত হয়ে আছে – তাঁরা হলেন অজয় বসু , পুষ্পেন সরকার,আর কমল ভট্টাচার্য । বছর দুয়েক পরে ক্রিকেট খেলারও বাংলায় ধারাবিবরণী শুরু হয় । 

এখন রেডিওর সঙ্গে আমার এবং অনেকেরই সম্পর্ক নেই বললেই চলে । কেমন আছে সে ? আমার জানা নেই । কলকাতা ক খ গ কি এখনও আছে ? কে জানে ! রেডিও সারাইয়ের কারিগরকেও আর খুঁজে পাই না, অতয়েব মৃত পুরাতন যন্ত্রটি কোথায় পড়ে নিভৃতে ধুলো খাচ্ছে কে জানে ! এখন একটা এফ এম সেট কিনে রবীন্দ্রনাথের গান শুনি আর আঁকড়ে রাখি শৈশব-কৈশোর- তারুণ্য-যৌবনের রেডিও-স্মৃতি । স্মৃতিটুকু থাক !

=======================

একা একা বনাম রাই জাগো রাই জাগো অথবা অনিঃশেষের বাহন

রজত দাস

১.

ঠিক এই মুহূর্তে, যখন আমি লেখাটা প্রস্তুত করছি, তখন আমারই প্রতিবেশে কোথায় কারা যেন অদ্ভূত প্রাচীন সুরে গান গাইছেন ৷ দূর থেকে মাইকে ভেসে ভেসে দুলে দুলে এসে সে গান ঘিরে রেখেছে আমাদের ৷ সে গান গায়েন পালা করে গেয়ে চলেছেন অষ্টপ্রহর ৷ বত্রিশপ্রহর ৷ ছাপান্নপ্রহর ৷ অবিরাম ৷ সে গানে চার-পাঁচটি শব্দ ব্যতীত অন্য কোন বাণী নেই ৷ সে গানে প্রেম আর বিরহ, মিলন আর লীলা একাকার হয়ে আছে ৷ সে গান দূর থেকে, অতীত থেকে, কয়েকশো বছরের অতীত থেকে ফিরে ফিরে আসছে ৷ সন্ধেবেলায় বাতাসার লুট দিচ্ছে কেউ, সে বাতাসায় সকলের কাড়াকাড়ি ৷ চন্দনবাটি আর ফুল নিয়ে আকুল হয়ে বসে আছে কতজন, ঐ যে যাকে সে চেনে না জানে না তাঁর কপাযে ফুলফোঁটা চন্দনফোঁটা এঁকে দেবে বলে ৷ সঙ্গীত আর লীলাক্ষেত্রের ধুলোকণা মাটিতে গড়িয়ে নেবে কেউ কেউ, কারণ এ মাটি পবিত্র, কারণ এ মাটিতে পদচিহ্ন আছে তাঁদের, যারা মানে না কে হিন্দু আর কে মুসলমান, কারণ এ মাটিতে সংঘ বেঁধেছে তাঁরা যারা বিশ্বাস করেছেন, সংঘ কেবল নির্মিত হয় প্রেমের প্রয়োজনে ৷

আমরা ২৪ পরগণা, নদীয়ার লোক ৷ আমাদের প্রথম নিঃশ্বাসে অক্সিজেনের সাথে ফুসফুসে মিশেছিল সংকীর্তন ৷ আমাদের জ্ঞান হওয়ার আগে আমরা চিনে ফেলেছি পালা আর পার্বণ, নিমাই আর ভজগৌরাঙ্গ, গাজন আর হরিনাম ৷ শরীরের প্রতিটি জলবিন্দু আর রক্তকণায় এই সব ঝর ঝর মুখর বাদর বহমান ৷ এসব অস্বীকার করবে কে ? এসব অস্বীকার করলে প্রাণবায়ু খাঁচা ছেড়ে উড়ে পালাবে না !

২.

বাংলার গ্রামে গ্রামে অগণন ব্রতানুষ্ঠান (রিচুয়াল) প্রচলিত ছিল ৷ এ দেশের গ্রাম-সমাজে, বিশেষত নারীদের ভিতর যে সব ব্রতানুষ্ঠানের প্রচলন আজও রয়ে গেছে, তার অধিকাংশই অবৈদিক,  অস্মার্ত, অপৌরাণিক ও অব্রাহ্মণ্য ৷ এইসব প্রধানত প্রজনন শক্তির ব্রতানুষ্ঠান যা বাংলার কৃষিসমাজের সঙ্গে একান্ত সম্পৃক্ত (বাঙ্গালীর ইতিহাস, আদিপর্ব, নীহাররঞ্জন রায়, দে'জ পাবলিশিং দ্রষ্টব্য) ৷

কোন এক বা একাধিক উদ্দেশ্য সফল করার কামনায় এই রিচুয়ালগুলি আচরিত হয় এবং সাধারণত সেখানে গোষ্ঠীর প্রায় সকলেই অংশগ্রহণ করেন ৷ সেখানে বিশেষ বিশেষ কারো পোশাক (কস্টিউম), সাজ (মেকআপ), ব্যবহারিক উপাদান (রিকুইজিশন) নির্দিষ্ট করা থাকে ৷ নির্দিষ্ট দিনের নির্দিষ্ট সময়ে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় সকলে মিলিত হয়ে আচার অনুষ্ঠান পালন করে ৷ স্বভাবতই এমন একটি দলগত কাজে কেউ কেউ (অভিনেতা) প্রত্যক্ষ ভূমিকা গ্রহণ করে, বাকিরা তাদের সহযোগিতা এবং অনুসরণ করে বা নিছক দর্শকের ভূমিকা নেয় ৷ তবে রিচুয়ালে দর্শক আর অভিনেতার ভেদাভেদ অনেক সময়ই মুছে যায় ৷ দেখা যায় অভিনেতা আর দর্শকের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ৷ ভালো ফসল উৎপাদন বা পুরনো জীবন থেকে নতুন জীবনে প্রবেশ কিংবা বৃষ্টি বা সন্তান ইত্যাদি কামনায় যখন সকলে মিলিত হয়েছে তখন — কী অভিনেতা কী দর্শক — প্রত্যেকেরই উদ্দেশ্য এক ৷ হয়ত সে কারণেই তাদের মধ্যের ফারাক বিশেষ থাকে না ৷

ক্রমে রিচুয়াল থেকে থিয়েটার জন্ম নিয়েছে ৷ অভিনেতা - গায়েন - বায়েন এবং দর্শক তাদের নিজেদের কাজ বুঝে নিয়েছে ৷ কিন্তু তাদের মধ্যেকার ঘনিষ্ঠতা ছেড়ে দিতে পারেনি ৷ আজও গ্রামবাংলার পালাপাব্বনে মানুষের মেলামেশি বড় ঘনিষ্ঠ বড় নিবিড় ৷ পালাপাব্বন কথাটার মধ্যে থাকা 'পালা' শব্দটা জানান দেয় সেই মেলামেশায়, সেই নিবিড়তায় নাট্য বা থিয়েটার কী প্রবলভাবে বেঁচে রয়েছে ৷

৩.

গ্রাম আর শহরের ফারাকগুলো কী ? বিস্তর ফারাক ৷ প্রকৃতির সাথে সম্পর্ক তারই একটি উদাহরণ ৷ গ্রামের থেকে যত শহরে ঘেঁসছে মানুষ, ক্রমশ সে প্রকৃতি থেকে দূরে গেছে ৷ দূরে দূরে যেতে যেতে প্রায় বৈরিতায় মেতেছে সে প্রকৃতির সাথে ৷ চূড়ান্ত যান্ত্রিক উদ্ধত নাগরিক সমাজ উন্নয়নে ভেসেছে ৷ সেই যান্ত্রিকতা মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখে না, দেখতে পারে না ৷ মানুষ তখন উপভোক্তা ক্রেতা ৷ সে তখন সংখ্যা মাত্র ৷

এই যান্ত্রিকতা এই সংখ্যার হিসেব অসীমকে ধারণ করে না ৷ সে চায় সীমা ৷ বাউন্ডারি ৷ আকাশের মুক্তি, গাছেদের অবহেলায় বেড়ে ওঠা, বৃষ্টির জল চলতে চলতে ক্ষুদ্র নদীর বয়ে যাওয়া — শহর এসব মানে না ৷ সে তার মতো করে অট্টালিকার পাহাড় গড়ে আকাশকে সংকীর্ণ করে, কেয়ারি করা বাগানে ডিজাইনিং বৃক্ষসৃজন হয়, জল প্রথমে ড্রেনে তারপর ম্যানহোল হয়ে শুকিয়ে মরে ৷ নাগরিক চোখ দিগন্ত দেখতে ভুলে যায়, সে তো 'দশ ফুট বাই দশ ফুটে'র দূরত্বে ফোকাল পয়েন্ট এডজাস্ট করে নিয়েছে ৷

এর হাত ধরে নাগরিক থিয়েটার কংক্রিটের ঘেরাটোপে সেঁধিয়ে যায় ৷ একটা বড়সড় বাক্সে তার জায়গা হয় ৷ সেখানে আলো আসে সুইচের অন অফ বাটনে ৷ প্রতিটি দর্শক অন্ধকারে বসে বসে বাকি দর্শকের সাথে তার অস্তিত্বকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে ৷ অদ্ভূত একাকী সে থিয়েটার দেখে ৷ অভিনেতারা অন্য আর একটা বাক্সে অভিনয় করে চলে ৷ তারা অন্ধকারকে উদ্দেশ্য করে, উপস্থিত একক দর্শকদের উদ্দেশ্য করে তার অভিনয় চালিয়ে যায় ৷ সে ভয়ে ভয়ে অতি সাবধানে পাশ ফেরে, পাছে আলো তার মুখ থেকে সরে গিয়ে সাধের অভিনয়টা মাটি করে !

বলা বাহুল্য, দর্শক আর অভিনেতার সম্পর্ক এখানে লক্ষ মাইলের ফাঁক রচনা করে ৷ থিয়েটারের উদ্দেশ্য সেখানে চিত্তবিনোদন আর কালজয়ী 'শিল্প' (যদিও এর পরেও একে শিল্প বলে ধরে নেওয়া চলে) নির্মাণের আকাঙ্খা ছাড়া আর কিছুই নয় ৷ রাষ্ট্র তার খোপের মধ্যে থিয়েটারকে কেন্দ্রীভূত হতে দেখে ৷ অভিনেতাদের কয়েকজন স্টার হয়ে খবরের কাগজ আর টিভিতে জায়গা পান ৷ দর্শকেরা সারাদিনের ক্লান্তি থেকে বিযুক্ত হয়ে আমোদিত হন, পরের দিনের ডিজিটাল চাকুরীর দাসত্ব করতে অক্সিজেন জুটিয়ে বাড়ি ফেরেন ৷ সত্য ধামাচাপা পড়ে থাকে ৷ ফাঁকতালে কখন যেন আমার পাশের বাড়িটা, পাড়ার পুকুরটা, নদীটা, পাহাড়টা এমনকি আমার প্রেমিকা বাজারে বিকিয়ে যায় ৷

৪.

বলা হয়, গ্রামের পল্লীর থিয়েটার (যাকে আমরা ফোক থিয়েটার বলি) অবৈজ্ঞানিক চেতনার দ্বারা আজও আচ্ছন্ন ৷ আজও সে থিয়েটার ঠাকুর-দেবতা, অলৌকিক অস্তিত্বের প্রতি সমপর্ণের কথা বলে চলে ৷ কথাটায় হয়ত আংশিক সত্যতা আছে ৷ কীভাবে সেই থিয়েটারকে দেখব, তা বাদল সরকার তাঁর বিখ্যাত 'থিয়েটারের ভাষা' বইতে স্পষ্টভাবে বলেছেন ৷ 

কিন্তু তা বাদে আমাদের গ্রামের থিয়েটারে, আমাদের রিচুয়ালে, আমাদের পালাপাব্বনে আরও যে অনন্ত কিছু পড়ে রইল !

প্রধানত সে কোন কিছুর অস্তিত্বকে অস্বীকার করে না ৷ সেখানে অভিনেতা দর্শক উঠোন আকাশ গাছ সিঁদুর প্রজাপতি লাঙল কোলাহল বর্ষা এই সমস্ত কিছুকে স্বীকৃতি দিয়ে নাট্য নির্মাণ করে ৷ আর করে বলেই মানুষ আর নাট্য এই দুয়ের দূরত্ব প্রায় থাকেই না ৷ জীবন আর জীবনচর্যা, দৈনন্দিন আর উৎসব, পালা আর পার্বণ, থিয়েটার আর অভিনেতা-দর্শক একাকার হয়ে যায় ৷

৫.

আমরা বাদল সরকারের দেখানো পথে থিয়েটার করি ৷ প্রথম ও দ্বিতীয় থিয়েটারের যে সফল সিন্থেসিসের কথা তিনি বলেছিলেন, তাঁর দল শতাব্দীসহ আরও অনেক দল নিয়ে যে যাত্রা তিনি করেছিলেন তা আমাদের পথ দেখাক ৷ তবু কেবলমাত্র সে পথটুকুই তো শেষ পথ নয় ৷ পথ আসলে তো অন্য আরও অনেক পথের দিকেই ঠেলে দেয় শেষপর্যন্ত ৷ সে রাস্তা আঁকাবাঁকা হয় হোক ৷ এ কালসময়ে যে কোন রকম জ্যামিতিক ছক বর্জনীয় ৷

যে পথে প্রাণের এই কল্লোল স্রোত নিবিড় নিঃসীম, সেই পথেই তৃতীয় থিয়েটারের অনিঃশেষ যাত্রা ৷ সবরকম দেওয়ালের অনুপস্থিতিতে, মানুষের গল্পকে বহন করে মানুষের মাঝেই তাকে উপস্থাপিত করাই এই থিয়েটারের ধর্ম ৷

বাদল সরকার : থার্ড থিয়েটারের পুরোধা পুরুষ, ছবি-ঋণ : গুগল

থার্ড থিয়েটার : এখানে থাকে না অভিনেতা ও দর্শকের মাঝে কোন দেওয়াল অভিনীত হচ্ছে বাদল সরকারের 'হট্টমেলার ওপারে', ছবি-ঋণ : গুগল

আমাদের ছোটবেলায় ভোর ভোর অন্ধকারে কারা যেন খোলকরতাল বাজিয়ে 'রাই জাগো রাই জাগো' বলে গঙ্গার দিকে হেঁটে যেতেন ৷ আমরা সে গান শুনে ঘুম থেকে উঠে পড়তাম ৷ দেখতাম আমার দিদা একটা ঘটি আর গামছা নিয়ে দোর খুলতে খুলতে বলছেন, "ল ল চল, অরা আউগ্যাইয়া গ্যাছে" ৷ ঐ যাঁরা গান গেয়ে যেতেন তাঁদের আমি কোনদিনই দেখতে পাইনি ৷ এত দ্রুত হাঁটতেন ! আমার দিদাও না ৷ তবু সেই গায়েন আর আমাদের মধ্যে একটা না-দেখা সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল ৷ কোন প্রয়োজনে তাঁরা গান গেয়ে আমাদের জাগিয়ে দিতেন ? আমাদের পাশের বাড়ির পিসি যখন বলতেন, "তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো, আজ আমার প্রাণনাথ আসিতে পারে", তখন কী তিনি কেবল তাঁর স্বামীর সাথে আসন্ন মিলনের কথাই ভাবতেন শুধু ? আর ঐ যে কাদের উদ্দেশ্য করে কুঞ্জ সাজাতে বললেন যেন, তার মানে কী ? তার মানে কী এই যে, তিনি তাঁর বন্ধু সখীদের প্রতি এক অমোঘ বিশ্বাস হয়ত অজ্ঞাতেই ব্যক্ত করেছেন এবং তাঁর সখীরাও সে বিশ্বাস বয়ে নিয়ে গেছেন আমরণ ৷ যথা সময়ে কুঞ্জ সেজেছে ৷

এই আমাদের বাংলাদেশ ৷

ইংরেজের থিয়েটার, ইংরেজি থিয়েটার আমার এই বাংলাকে ধরবে কি করে !

=======================

আবৃত্তির অলিগলি : কবিতার অন্যতম বাহন

অনিন্দিতা চট্টোপাধ্যায় 

আমি আবৃত্তি করি। তবে এই নিয়ে কোন দিন কলম ধরতে হবে ভাবিনি। তার ওপর যা কিছু লিখেছি সবই ইংরিজিতে।  কাজেই ঠিক মতো গুছিয়ে বলতে পারব কি না একটু সংশয় লাগছে। কিন্তু ছোট ভাই নির্মলেন্দুর অনুরোধ, অগত্যা… 

কবিতা যদি বাহন হয়, তবে আবৃত্তিকার অবশ্যই বাহক। কিন্তু কবিতা কি? কবিতা, আমার মতে, কবির মনন, চিন্তন ও অনুভূতির প্রকাশ। একজন সাধারণ মানুষ আকাশে কালো ঘন মেঘ দেখলে ভাবে বৃষ্টি আসবে। একটু কল্পনাপ্রবণ হলে ভাববে এই তো একটু আগের নীল আকাশ কি অদ্ভুত ভাবে রঙ বদলাচ্ছে। সে চিত্রশিল্পী হলে রঙ তুলি দিয়ে হুবহু সেই দৃশ্য ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলতে সচেষ্ট হবে। আর আজকাল তো সঙ্গে সঙ্গে মুঠোফোনে বন্দি করে ফেলবে। কিন্তু মহাকবি কালিদাসের আষাঢ়ের মেঘকে দেখে মনে হয়েছিল, একজন মানুষ যে দূর দেশে যাত্রা করেছে। তাই মেঘকে তিনি যক্ষের দুত হিসেবে কল্পনা করেছিলেন। অর্থাৎ, মেঘকে তিনি personify করেছিলেন। কবি তাঁর চারপাশের জগৎকে যে ভাবে প্রত্যক্ষ করেন, তাঁর যে অনুভূতি হয় তা তিনি প্রকাশ করেন কালি ও  কলমে।

সেই পুরাতন কাল থেকে, যখন বই ছিল না, আমরা দেখেছি কবিদের সৃষ্টি কথকরা সুর করে পাঠ করে জনগণের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। মহাভারতে আছে ঋষি ধৌম্য পাণ্ডবদের বনবাসের সময় তাঁদের নানা কাহিনী শোনাতেন। সেই শ্রুতির মাধ্যমে আদিকাল থেকে মহাকাব্য লোকসমাজে ছড়িয়ে গেছে ৷ লোকসংস্কৃতিতে এইরকম সুর করে পাঠের সঙ্গে অভিনয়ও যুক্ত হয় পরে। পাণ্ডবানি (তীজন বাই যে শিল্পকলাকে দেশে বিদেশে জনপ্রিয় করে তোলেন সেই ১৯৮০র দশক থেকে), রামায়ণ গান (দুই বাংলা এবং আসামের গ্রামাঞ্চলে এই লোককলা প্রচলিত) বা কেরলের কথাকলি নাচ এই পরম্পরার অন্তর্গত — যা কুশলী শিল্পীদের দক্ষতায় জনপ্রিয় শিল্পমাধ্যম হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ, কবিরা যা রচনা করেছেন কথকরা সেই সৃষ্টির বাহক হয়ে জনপদে ঘুরে ঘুরে তা প্রচার করেছেন তাঁদের পাঠ ও অভিনয়ের মাধ্যমে এবং মানুষের মনোরঞ্জন করেছেন। মুখে মুখে আবৃত্তির মাধ্যমে মনে রাখতে হত বলে বলা হয়, “আবৃত্তি সর্বশাস্ত্রানাং বোধাদঅপি গরীয়সী”। যার মানে, আবৃত্তি হচ্ছে বোধোদয়ের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম।

আমার মতে নিজের মনে কবিতা পড়া কবিতার রস আস্বাদনের সব থেকে ভাল উপায়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, যদিও আমাদের দেশে কবির প্রাচুর্য (মুখবইতে কত যে সাহিত্য পত্রিকা আর কত যে কবি ক্লান্তিহীন ভাবে লিখে চলেছেন), গল্প ও উপন্যাসের তুলনায় কবিতার পাঠক কম। বই বিপণীতে, সঞ্চিতা বা সঞ্চয়িতা বাদ দিলে, কবিতার বইয়ের চাহিদা তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। রবীন্দ্র জয়ন্তী বা নজরুল জয়ন্তী এলে শহরে, গ্রামে, গঞ্জে, মফস্বলে কত যে আয়োজন, কিন্তু কত জন বাংলা সাহিত্যের এই দুই স্তম্ভের কবিতা মন দিয়ে পড়েছেন তা নিয়ে সংশয় জাগে। কারণ, গুটি কয়েক কবিতা ঘুরে ফিরে আবৃত্তি করা হয়ে থাকে। আমি লিপিকা'র কবিতা আবৃত্তি করার পর শুনেছি, “এটা কোন বইতে আছে? সঞ্চয়িতায় তো পড়িনি।” অর্থাৎ রবিপ্রেম সঞ্চয়িতায় সীমাবদ্ধ।

এইখানে আসে আবৃত্তিকারের ভূমিকা। তাঁর পরিবেশনা এমন হওয়া উচিত যেন কবির রচনা কান থেকে হৃদয়ে গিয়ে পৌঁছয়। কবি যে ভাবনা নিয়ে কবিতাটি রচনা করেছেন, সেই অন্তর্নিহিত ভাবনা যেন শ্রোতা উপলব্ধি করতে পারেন। কবিতার রস (যেমন, হাস্য, করুণ, বিস্ময় বা প্রেম ইত্যাদি) যেন শ্রোতার অনুভূতিতে সঞ্চারিত হয়। এই কাজটি সুচারু ভাবে করতে গেলে বাহন এবং বাহকের মধ্যে একটা তাল মিল বিশেষ জরুরী। যেমন ধরুন, প্রথম সাইকেল চালাতে শিখলে আপনি কয়েক বার পরে যাবেন। তারপর টাল সামলাতে না পারলে পা মাটিতে নামিয়ে ব্যালেন্স ঠিক করে নেবেন। ভাল শেখা হয়ে গেলে কিন্তু দু' হাত ছেড়ে গড়গড়িয়ে চালাতে পারবেন। অর্থাৎ,আবৃত্তিকারকে কবিতার অন্তর্নিহিত অর্থ ও রস ভালো করে হৃদয়ঙ্গম করতে হবে যাতে তাঁর আবৃত্তির মাধ্যমে রচনাটির ভাব, রস, ছন্দ, বিষয়বস্তু শ্রোতার হৃদয় স্পর্শ করে।  

এর জন্য কি প্রশিক্ষণের প্রয়োজন? আমি বলবো বোধের প্রয়োজন। আমি কারো কাছে প্রথাগত ভাবে আবৃত্তি শিখিনি। আকাশবাণীতে গিয়ে যুববাণীর অডিশন দিই। প্রথম বারেই নির্বাচিত হই। সেখানে শ্রদ্ধেয় দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় এবং  শ্রদ্ধেয় অমিয় চট্টোপাধ্যায়-এর সঙ্গে পরিচয় হয়। পরবর্তীকালে, আমি একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে এই সব বরেণ্য আবৃত্তিকারদের সঙ্গে একক আবৃত্তি করেছি। এমন কি, একই মঞ্চে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়-এর সঙ্গে দ্বৈত আবৃত্তি করেছি। কখনো আটকে গেলে জিজ্ঞেস করে নিয়েছি কবিতাটা এভাবে বললে কি ঠিক শোনাচ্ছে। ওঁরা শুধরে দিয়েছেন হয়তো। 

প্রশিক্ষণ নিতে পারলে ভালই। কিন্তু অনেক সময় দেখেছি শিক্ষার্থী জিজ্ঞেস করছে গলাটা ওপরে তুলবো? বা গলাটা কি নামাতে হবে? গানের মতো আবৃত্তির কোন স্বরলিপি নেই, যে গলা একটি বিশেষ জায়গায় তার সপ্তকে তুলতে হবে এবং অন্য একটি জায়গায় নিচের ‘ঋশভ’ লাগাতে হবে। প্রশিক্ষক মহাশয় বা মহাশয়া শুরুতে কি ভাবে এগোতে হবে সেই দিশা দেখাতে পারেন। কিন্তু, তারপর নিজেকেই তৈরি হতে হবে। কোনো কবিতা আবৃত্তি করার আগে সেটা বার বার পড়া উচিত। যতক্ষণ না নিজের কাছে কবিতার ভাব আর মানে স্পষ্ট হচ্ছে। বিশেষ করে দরকার শুদ্ধ উচ্চারণ, কণ্ঠস্বরের নিপুণ ব্যাঞ্জনা আর কবিতার সঠিক ছন্দটা ধরা। উচ্চারণ নিখুঁত না হলে, যত ভালো আবৃত্তিই আপনি করুন তা শ্রোতার কানে লাগবে। গজল গাইতে গিয়ে উর্দু শব্দের সঠিক উচ্চারণ না হলে যেমন রসভঙ্গ হয়, সেরকম। 

ছন্দের ক্ষেত্রে সতর্ক না হলে, নিখুঁত ছন্দজ্ঞান না থাকলে, কোথায় স্ক্যান করতে হবে বুঝতে অসুবিধে হবে। আমি টেকনিক্যালিটিস-এর মধ্যে যাব না, কারন ওই কচকচি কবিতা উপভোগ করার অন্তরায়। একটা কবিতা বার বার মনে মনে পড়লেই ছন্দটা ধরা সম্ভব। যেমন –

বিলাপ করেন রাম/ লক্ষ্মণের আগে । 

ভুলিতে না পারি সীতা/ শঙ্কা মনে জাগে।।

অথবা –

ঘর ফুটপাথ/ 

আহার বাতাস/

ন্যাংটো ছেলেটা/

দেখছে আকাশ।

অথবা -- 

লেলিয়ে দে মা/ সিংহটা তোর /কামড়ে ধরুক/ ঘাড়গুলো 

রক্তচোষা/ পিশাচগুলোর/ গুঁড়িয়ে দে মা/ হাড়গুলো।  

এই ছন্দটা বজায় রেখে গলায় ভাব এবং রসটা ফুটিয়ে তুলতে হবে। এমন কি, গদ্য কবিতার মধ্যেও একটা ছন্দ থাকে। 

এতক্ষণ, বাহকের কথা বললাম। এবার বাহনের কথায় আসি। সব কবিতা আবৃত্তিযোগ্য নয়। কিছু কবিতা অত্যন্ত ভালো লেখা হয়তো, কিন্তু তার গভীরতা বা শব্দব্যঞ্জনা বৃহৎ সমষ্টির কাছে তুলে ধরা কষ্টসাধ্য। সেই সব কবিতা ঘরোয়া আসরে পড়া ভালো। জনমানসে জায়গা করে নিতে হলে যে কবিতায় একটা গল্প আছে, বা সুন্দর ছন্দ আছে তাই বাছা উচিত কারণ শ্রোতারা সেই সব সহজবোধ্য কবিতা বেশি উপভোগ করেন। আবার, এমন সব কবিতা মুখবইতে অথবা বিভিন্ন সাহিত্য গোষ্ঠীতে পড়ি যা চোখে জল আনে। শব্দচয়ন, ছন্দ, পরিমিতিবোধ, ভাব, রস – সব কিছুরই অভাব প্রকট। এত কাব্যরসের অভাব থাকলে আবৃত্তিকার কি ভাবে তা মানুষের কাছে পৌঁছে দেবেন। যিনি ফর্মুলা ওয়ান রেসে নামবেন তাঁকে তো রেসের উপযুক্ত গাড়িই বাছতে হবে। সেই অর্থে, আবৃত্তিকার ও আবৃত্তিযোগ্য কবিতা একে অপরের পরিপূরক।

চিত্র-সৌজন্য : গুগল

=======================

ডিজিটাল মিডিয়া : নয়া প্রতিভূ, নয়া দিশা, নতুন চ্যালেঞ্জ

সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়

ঠিক দুই লাইনের খবর, তারপরেই লেখা: এরপর আমরা আপডেট দিচ্ছি, খবরে নজর রাখুন।

কিংবা ঠিক দুই মিনিটের খবর: চার পাঁচ লাইন, একটা ছবি।

দেশ বিদেশের সমস্ত বিষয়ের নানা সংবাদ এভাবেই উঠে আসছে মোবাইলের স্ক্রিন,কিংবা ডেস্কটপ , ল্যাপটপে। যদি পছন্দের কোনো ডিজিটাল নিউজ মিডিয়া সাবস্ক্রাইব করা থাকে,তাহলে তো কোনো কথাই নেই। মেসেজ বক্সে উপচে পড়বে এরকম অজস্র খবর সকাল থেকে রাত,  পরের দিন সকাল বা সন্ধ্যার টিভির নিউজ বুলেটিন পর্যন্ত অপেক্ষার দিন শেষ।

সংবাদ এখন শুধু দ্রুততম নয়, সাম্প্রতিকতম প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে সমস্ত ধরনের তথ্য পৌঁছে দিচ্ছে সকল শ্রেণির মানুষের কাছেই। খুব সহজে, বিনামূল্যে। ফলে দ্রুত একটা 'ফ্ল্যাট ' পৃথিবী গড়ে উঠছে। তথ্য ও জ্ঞানের ক্ষেত্রে  রাখছে না কোনো বিভাজন, অসাম্য। অর্থ, জ্ঞান, ক্ষমতার নিরিখে ভেদাভেদ থাকলেও ডিজিটাল মিডিয়ার দৌলতে তথ্যের অসাম্য নেই।  সকলেই পারে প্রতি মুহূর্তের সঙ্গে নিজেকে আপডেট রাখতে। তার জন্য অর্থ বা ক্ষমতার তারতম্যে কোনো বিভাজন নেই।

ডিজিটাল মিডিয়ার পাঠক মানে এক অর্থে তিনি কেবলই পাঠক নন, তিনি সমাজে মতামত নির্মাণে এক সক্রিয় উপাদান, যাকে বলা যায় "ওপিনিয়ন ক্রিয়েটর"। তিনি কেবল টিভির দর্শকের মতো তিনি একলাই খবর দেখেন না, বা সংবাদপত্রের পাঠকের মতো একা খবর পড়ে চারপাশের লোককে বলার মধ্যে সীমিত গণ্ডিতে বদ্ধ থাকেন না। ডিজিটাল মিডিয়ার পাঠক নিজে পড়েন, অন্যকে পড়ান। মুহূর্তের মধ্যে নিজের গণ্ডির মধ্যে এই বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে  পাঠিয়ে দেন, সঙ্গে থাকে তাঁর বা অন্যদের ফুটনোট, মন্তব্য। এতে শুধু খবর ঘোরে না, খবরের সঙ্গে সঙ্গে কত মানুষের লাইক বা পছন্দ, সেটাও ঘোরে। খবরের গুরুত্ব এবং ব্যাপ্তি বাড়াতে থাকে। এভাবেই প্রতিটি পাঠকের সামাজিক চেতনা সক্রিয় হয়ে  মতামত নির্মাণের কাজ করে চলেছে। গণ  অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে ডিজিটাল মিডিয়া অন্য রূপের মিডিয়ার চাইতে অনেক বেশি ও অনেক দ্রুত সামাজিক স্বর তৈরি করছে।  ফলে প্রচলিত ধ্যান ধারণা এবং লোকায়ত সংস্কৃতির মিশেলে যে ডিসকোর্স চালু রয়েছে তার প্রতিস্পর্ধী ভাবনার বিকাশও ত্বরান্বিত হচ্ছে। সামাজিক বিবর্তন ও রাজনৈতিক মতামত গঠনে  দ্রুততায় ও ব্যাপ্তিতে ডিজিটাল মিডিয়া তাই  সামাজিক পরিসরে দ্রুত পরিবর্তন আনতে পারছে। 

ডিজিটাল মিডিয়ার বৈশিষ্ট্য অন্য মিডিয়াগুলোর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। খবরের সঙ্গে সঙ্গে স্টিল ছবি ছাড়াও ভিডিও নিউজ এবং পডকাস্ট এনে দিয়েছে সংবাদ উপস্থাপনার নানান উপায়, ফলে বলা যেতে পারে, একটি সংবাদকে  ৩৬০°ডিগ্রি পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের উপায় আমাদের সামনে হাজির করে দিয়েছে ডিজিটাল মাধ্যম। সমাজ মননে খবরের প্রতিক্রিয়া বা ইমপ্যাক্ট তাই অন্য মিডিয়ার চাইতে অনেক বেশি।

আসলে এটাই স্বাভাবিক। সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলাবে তো সংবাদ এবং সংবাদ মাধ্যম নিজেও। সংবাদের সঙ্গে প্রযুক্তির সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবেই অত্যন্ত নিবিড়। প্রযুক্তি  বদলালে সংবাদ পরিবেশনের প্রকরণ বদলে যায়।  নানা কৌশল আগের মাধ্যমে যেমন জরুরি ছিল, যেটা না হলে অসম্ভব ছিল, সেটাও আজ বাদ দিয়ে সংবাদ তৈরি ও পরিবেশন করা যাচ্ছে। সংবাদ অনেক সাবলীল হয়েছে এবং আরো বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। প্রোটোটাইপ মিডিয়া হাউসের বাইরেও সমাজের মধ্যে থেকে উঠে আসা অনেক ডিজিটাল কন্ট্রিবিউটর  খবর পাঠাচ্ছেন। এটা সেই মাস ও কমন ম্যান রিপোর্টিংয়ের শুরুর দিনগুলো মনে করিয়ে দিচ্ছে, যেখানে ঢ্যারা পিটিয়ে মহারাজের হয়ে  প্রজাদের বার্তা  দেওয়ার  মতো। মাস মিডিয়ার এই জন্ম অনেক আগেই  যখন বনের আদিবাসী সমাজ সিঙ্গা ফুঁকে সকলকে সতর্ক করে দিত, অর্থাৎ যে যেভাবে যেখানে তার নিজের পরিবেশে সংবাদ পৌঁছে দিতে পারে সে সেভাবেই সংবাদকে পৌঁছে দিত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সংবাদ জানানোর ও পৌঁছনোর  প্রকরণ বদলেছে। বদলেছে একেক মিডিয়ার ভাষা তার নিজের মতো করে। সেটা কখন যে উচ্চকিত সংকেত  থেকে টেলিগ্রাফের তারে যাওয়া  খবরের আওয়াজ কিংবা এখনকার দিনের ডিজিটাল ভার্সনে ভার্চুয়াল নিউজের চেহারা ধারণ করে সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে, সেটা মানুষ বুঝতে পারে না। সময়ের সাথে সাথে বদলে যায় প্রযুক্তি, বদলে যায় সমাজ, বদল হয় সংবাদের কন্টেন্ট, ফর্ম, উপস্থাপনার রীতি। কিন্তু এর সঙ্গে সঙ্গে যখন নীতিটাও বদলে যায়, তখন বাঁধে  গোল। কারণ সংবাদের নীতির সঙ্গে নৈতিকতা মেনে চলার যে অবিচ্ছেদ্য শর্ত থাকে ডিজিটাল মিডিয়ায় সেটা মানবে যে তার সংস্কৃতির অভাব। ডিজিটাল মিডিয়ায় সেটারই চরম অভাব দেখা যাচ্ছে। সেটা যে  প্রযুক্তির জন্য হচ্ছে, তাও নয়। এমনটা ভাবাও ঠিক নয়।

আসলে ডিজিটাল নিউজের বিকাশ হচ্ছে ডিজিটাল অর্থনীতির অনুষঙ্গ হিসেবে।সেখানে উদ্দেশ্য ভোগ্যপণ্যের একটা নতুন সংস্কৃতি নির্মাণ, এবং নানা কৌশলে তার রিচ বাড়ানো, কন্টেন্ট  তাই সর্বদা সংবাদ নয়। নিউজের নামে যা ইচ্ছে খুশি একটা সেনসেশন তৈরি করা, যাতে চটজলদি  মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়। সেই উদ্দেশ্যের পিছনে আসল উদ্দেশ্য ভোগ্যপণ্যের সংস্কৃতি ভিত্তিক মূল্যবোধ গঠন। বিজ্ঞাপন যেটা যে কোনও মিডিয়ার একমাত্র প্রধান চাহিদা, সেটা এই মিডিয়ায় আসে অনেক রিচ হলে।  অনেক প্রচার বাড়লে তবেই যৎকিঞ্চিৎ বিজ্ঞাপন সম্ভব। তাই বিজ্ঞাপন পেয়ে টিকে থাকার মরিয়া প্রচেষ্টায় অনেক ডিজিটাল নিউজ পোর্টাল  বা ব্লগ রীতি নীতির সমস্ত স্বীকৃত লাইন থেকে বেরিয়ে গিয়ে নিজের জায়গা তৈরিতে মরিয়া। তার জন্যেই রীতি, নীতি, নৈতিকতা বর্জিত কন্টেন্ট শুধুমাত্র পাবলিক খাবে বলে দেওয়া হয়, রিচ বাড়ানোর জন্য। এর পিছনে মুখ্য কারণ এর রেভিনিউ সিস্টেম।

এই দুনিয়ায় নিউজ মিডিয়ার ব্যবসা অফলাইনের নিউজ মিডিয়ার চাইতে যেমন প্রযুক্তিগতভাবে আলাদা, তেমনি এর রেভিনিউ সিস্টেমও আলাদা। এখানে সার্কুলেশন মানে বিজ্ঞাপনে সাফল্য নয়, এখানে সার্কুলেশন হলেও পাঠক যদি বিজ্ঞাপনে আঙুল ছোঁয়া না দেন তাহলে সমস্ত উদ্দেশ্য 'অর্থ- হীন'। তাই বিজ্ঞাপনের প্রলোভনে ফেলে পাঠকের কাছে সংবাদ পরিবেশন হওয়া চাই, সেখানে সংবাদের বিশুদ্ধতা এবং সাংবাদিকতার নৈতিকতা নষ্ট করে মূল সংবাদের চটক তৈরি করতে অন্তর্নিহিত বার্তা বদলে যায়। ইচ্ছে করেই বিকৃত করা হয়। সংবাদ মাধ্যমের পবিত্রতা এই ডিজিটাল মিডিয়ার পাল্লায় পড়ে এখন অনেকটা চ্যালেঞ্জের মুখে। এর জন্য কড়া আইন জরুরি।

 

ডিজিটাল মিডিয়ার রকমফের, চিত্র-সৌজন্য — গুগল

এই জায়গাটা বাদ দিলে  দেখা যাবে,আজকের দুনিয়ায়  সংবাদ মাধ্যমের সামনে ডিজিটাল মিডিয়া একটা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। কোন সংবাদকে আমরা  কোন দৃষ্টিতে দেখব,  প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে তাই নিয়েই। যেমন আমাদের একজন মহিলা অ্যাথলিট অলিম্পিকে পদক পেলেন। তাঁর সেই সাফল্যের সংবাদ ডিজিটাল মিডিয়া মারফৎ মুহূর্তে পৌঁছে যাচ্ছে দুনিয়ার সকল মানুষের কাছে। এরপর অন্য মাধ্যমগুলোকে ভাবতে হচ্ছে!! যেমন , সন্ধ্যায় খবরের বার্তা সম্পাদক ভাবছেন,   নতুন কী দেখাবে টিভিতে? ভাবতে হচ্ছে কী দেখানো আর সম্ভব ২৪ ঘণ্টার নিউজ চ্যানেলে? পরের দিন সকালে যে দৈনিক পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়, তার বার্তা সম্পাদককে ভাবতে হয়, কোন অজানা খবর এই প্রসঙ্গে দিয়ে পাঠকের কাছে  তারা দিতে পারে যার মাধ্যমে ধরে রাখতে পারবে তার উপযোগিতা। ফলে যে কোনো সফলতার পিছনে যে রহস্য, বাধা, সংগ্রাম, অনুশীলন, কৌশলের না বলা নানা কিছু লুকিয়ে থাকে, ডিজিটাল মিডিয়াকেও তেমনি ভাবে সফল হতে এরকম করেই এগোতে হচ্ছে। তবে খবরের পিছনের খবর দিয়ে প্রিন্ট মিডিয়া সাংবাদিকতাকে এখন অনেক উচ্চস্তরে  ও গভীর বিশ্লেষণমুখী করে তুলেছে। তাদের অনেক দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে হচ্ছে। এক কথায়, খবরের দুনিয়ায় ডিজিটাল মাধ্যম আসার পর থেকে আনন্দ, উচ্ছ্বাসের খবর থেকে উদ্বেগ সংবাদ বা পাঠকের উৎকণ্ঠা নিরসনে সংবাদ মাধ্যমের উপযোগিতা যেমন শতগুণ বেড়েছে, তেমনই যে তথ্য জ্ঞানকে  গভীর করে, তার সীমা বিস্তৃত করে  নানা প্রশ্ন তোলে, উত্তর খুঁজতে তর্ক আহ্বান করে এবং বিতর্কের সেই আয়োজনে মন ও বুদ্ধিকে পরিশীলিত করে বোধকে আরো দীপ্ত করে তোলে, সেই উত্তরণের পথেও ডিজিটাল মিডিয়া আমাদের নিয়ে চলছে প্রতি মুহূর্তে।  আমরা চাই বা না চাই, ডিজিটাল মিডিয়া চালু হওয়ার পর একটা নিরন্তর আলাপের মধ্যে আছি। সোশ্যাল মিডিয়ায় আছড়ে পড়ছে  প্রতি মুহূর্তে ডিজিটাল মিডিয়ার শত শত লিংক, লাইভ, হাজার ঝড়, টেক্সট, টুইট। এবং তাই নিয়ে শুরু হয়ে যাচ্ছে একটা নিরন্তর আলোচনা, তর্ক, বিতর্ক

সারা বিশ্ব আজ বিভিন্ন ডিজিটাল মিডিয়া দ্বারা আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা পড়েছেচিত্র-সৌজন্য — গুগল

যা সমাজের কণ্ঠস্বরে এত বেশি প্রাবল্য এনে দিয়েছে যে সরকার পর্যন্ত টলে যাচ্ছে।তার নীতির বদল ঘটছে।

মানুষ ডিজিটাল মিডিয়ার হাত ধরে এখন অনেক বেশি  ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠছে। সেই ক্ষমতার নিত্য প্রসারে সমাজ অনেক বেশি উদার এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থা অনেক বেশি গণতান্ত্রিক হয়ে উঠছে। ফলে এতদিন এই সমস্ত ব্যবস্থার অন্দরে জমে থাকা ভাঁজে ভাঁজে স্তরে স্তরে নানা অসঙ্গতি যা ছিল তাও ফুটে উঠছে, ধরা পড়ছে সমাজ ব্যবস্থার ত্রুটি, তেমনই সমাজ ও ক্ষমতার মধ্যে এতকালের যে বোঝাপড়া চলছিল সেটাও ভেঙে দিচ্ছে  ডিজিটাল মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ার যুগলবন্দি। এক নতুন রাজনীতি ও সামাজিক ক্ষমতার বিন্যাস ঘটছে যেখানে অগণিত অসংখ্য মানুষের কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হচ্ছে শুধুমাত্র ডিজিটাল মিডিয়ার জন্য।

বলা যেতে পারে, মিডিয়ার সংজ্ঞা বদলে গেছে। আগে মিডিয়ার লোকেরা লিখতেন, বলতেন, সমাজ শুনত। সেখানে সম্পাদকের কাছে পাঠানো চিঠিতে পাঠকের দরবার যা সামান্য বক্তব্য রাখার বা আলোচনার সুযোগ পেত, সেটা নিমিত্ত মাত্র। এখন ডিজিটাল মিডিয়ার  নিউজ লিঙ্ক  আর সোশ্যাল মিডিয়া লিংক প্রকাশিত হচ্ছে একসঙ্গে। প্রতি মুহূর্তে খবর প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ শুধু জানছে না খবরটা, বরং তার নিজের মতটা খবরের নিচে লিখে দিচ্ছে হয়ত সম্পূর্ণ বিপরীত দৃষ্টিকোণ থেকে।ফলে দ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়েই সমাজে প্রতি মুহূর্তে ওপিনিয়ন তৈরি হচ্ছে। সামাজিক কণ্ঠ গড়ে ওঠার একটা প্রক্রিয়া তৈরি হয়ে গেছে। কেউ চাক বা না চাক সেটা  চালু হয়ে গেছে। ফলে আগের মতো একটা প্যাটার্ন থিঙ্কিং গড়ে তোলার সুযোগ নেই। বরং অতীতের নানা দৃষ্টিকোণ বা মতবাদ থেকে জন্ম নেওয়া ভাবনাগুলো ধাক্কা খাচ্ছে, সংবাদ এখন  ব্যক্তি ও সমাজ বোধের ভাঙা গড়ায় শতগুণ বেশি সক্রিয়। উচিত অনুচিত এর পুরনো মানদণ্ড ভেঙে  তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন ডিসকোর্স।

একই সঙ্গে সমাজে অনৈতিক জীবন, রাষ্ট্রীয় শয়তানি, গোষ্ঠীগত বদমায়েশি,  সিন্ডিকেটের শঠতা ও যাবতীয় নস্টামিও আশ্রয় করা শুরু করেছে এই ডিজিটাল মিডিয়াকে। অনেক সময় দেখা গেছে, সংগঠিত অপরাধচক্র ডিজিটাল মিডিয়াকে ব্যবহার করছে। এর পিছনে খাটছে ট্রিলিয়ন  ডলার অর্থ। অনিয়ন্ত্রিত যৌনাচার, সেক্স ট্যুরিজম, পর্ণোগ্রাফি এখন এক শ্রেণির মেইনস্ট্রিম বাণিজ্যিক ডিজিটাল মিডিয়ার প্রধান সংবাদ। সংবাদ ব্যবসায় এসবই এখন সংবাদের পাশাপাশি প্রধান উপজীব্য। এগুলো পাঠক খুব দ্রুত খায় । শুধু  খায় না, একেবারে গপ গপ করে গেলে। দলীয় প্রপাগান্ডা  কিংবা মেরুকরণের জন্য নিত্য সক্রিয় ডিজিটাল মিডিয়া। রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে যার ডাক নাম আই টি সেল। দাঙ্গা থেকে রাজনৈতিক হিংসা ছড়িয়ে ক্ষমতা দখলের জন্য প্রচুর এই জাতীয় নিউজ পোর্টাল তৈরি হয়েছে।  সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করে, পারস্পরিক বিশ্বাসের বাতাবরণ নষ্ট করে সমাজকেই বসবাসের অনুপযুক্ত করে তুলছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ডিজিটাল মিডিয়া। রাজনৈতিক দল আগেও প্রিন্ট মিডিয়ার মাধ্যমে তাদের প্রচার ও প্রভাব তৈরিতে মিডিয়াকে ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণ করত। কিন্তু এখন  যেটা হচ্ছে, তার তুলনায় সেটা ছিল নস্যি।  প্রযুক্তির বিকাশে ডিজিটাল মিডিয়া মানুষের কাছে অনেক দ্রুত পৌঁছে যাচ্ছে। তাতে রাজনৈতিক দখলদারি,হিংসা, ভোট কেন্দ্রিক সন্ত্রাসও  বেড়ে যাচ্ছে অনেকখানি। নানা মিথ্যে  সংবাদ তৈরি করে লিখে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।আগেও অন্য মিডিয়ায়  এই সমস্ত কিছুর চেষ্টা হত। কিন্তু এত বেশি ছড়ানো যেত না।ক্ষতি করার এত ক্ষমতাও ছিল না। আজকাল ডিজিটাল মিডিয়া সেই ক্ষতির ক্ষমতাও বাড়িয়ে দিয়েছে, মুহূর্তের মধ্যে হিংসা ছড়িয়ে দিতে পারে নির্দিষ্ট কোনো অপরাধ চক্র, ছড়িয়ে যাচ্ছে দাঙ্গা , কিংবা প্রতিরোধের নামে নৈরাজ্য। নেতিবাচক রাজনীতি ক্ষমতার নির্মাণে জন্ম দিচ্ছে এক নয়া ফ্যাসিবাদ যা ডিজিটাল মিডিয়ার হাত ধরেই জন্ম নিচ্ছে সমাজে একনায়কের।

গণতন্ত্র গণকণ্ঠ জোরদার করে যেমন, তেমনই ডিজিটাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে ফেক নিউজের কারবারি। সরকার পর্যন্ত নাজেহাল। এখানেই প্রশ্ন উঠছে মিডিয়ার নিয়ন্ত্রণ হোক। আবার প্রকৃত অর্থে মিডিয়ার নিয়ন্ত্রণ কখনোই কাম্য নয়। কিন্তু ফেক নিউজই বা মেনে নেওয়া যায় কি করে? অনলাইনের নিউজ মিডিয়া এই দুইয়ের মধ্যে এখন চিঁড়ে চ্যাপটা অবস্থায়।এই প্রসঙ্গে সরকারের আনা সাম্প্রতিক বিল নতুন পথে ডিজিটাল মিডিয়াকে একইসঙ্গে নিয়ন্ত্রণে রেখে স্বাধীনতা দিতে চায়, কিন্তু এই স্বাধীনতা কার্যত ডিজিটাল মিডিয়াকে ক্ষমতার অনুগামী ও অনুসারী করে তুলতে বাধ্য করছে। এই প্রসঙ্গে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বড় পুঁজির মিডিয়ার  সঙ্গে শাসক দলের সম্পর্ক ক্রমশ অম্লমধুর থেকে প্রপাগান্ডা মেশিনে পরিণত। এর প্রতিরোধে জনগণের ভাষ্য নিয়ে জনগণই হাজির হচ্ছে নিজেদের তৈরি হাজার হাজার নিউজ পোর্টালে। রাজনৈতিক ক্ষমতার এককেন্দ্রিক প্রবণতা যেমন সক্রিয় হয়ে উঠেছে ডিজিটাল মিডিয়ার সুবাদে, তেমনি ডিজিটাল মিডিয়া আরো বেশি প্রতিবাদের ক্ষমতা দিয়েছে সাধারণ মানুষকে। সমাজ তাই এখন ডিজিটাল মিডিয়ার মুহূর্তের পাঠক শুধু নয়, সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছে মতামত গঠনেও।


আমাদের সাবধান থাকতে হবে মুহূর্তে ভাইরাল হওয়া ভুয়ো খবর ও গুজবের ব্যাপারে, চিত্র-সৌজন্য — গুগল

ডিজিটাল মিডিয়া জনগণকে সঙ্গে নিয়েই অনেক বেশি সর্বব্যাপ্ত। যেমন অনেক বেশি নিজেও কৃতকৌশলে ইনক্লুসিভ, তেমনি মিডিয়া হিসেবে উন্নয়ন ও বিকাশের ক্ষেত্রেও অনেক শক্তিশালী ইনক্লুসিভ ভূমিকা রাখে। তবুও যা কিছু অসঙ্গতি আছে, অনৈতিক সংবাদ হচ্ছে, যা কিছু প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক স্বার্থে অপব্যবহার হচ্ছে এবং বাণিজ্যিক ও পেশাদারী শর্তের বাইরে অর্থনৈতিক উপাদান আছে তার সব স্তিমিত হবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এবং সমাজও নতুন ভাবনা ও মূল্যবোধে নতুন পথ খুঁজে নেবে ডিজিটাল মিডিয়ার সাহচর্যে। তাই দেশে দেশে রাষ্ট্র ব্যবস্থা ডিজিটাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রণে যে আইন আনছে তার মধ্যে কতটা সঙ্গত, কতটা ক্ষমতার হেজিমনি প্রতিষ্ঠার চক্রান্ত আছে,সেটা নিয়ে সতর্ক হওয়া দরকার। এসব বিশ্লেষণ করে  ডিজিটাল  নিয়ন্ত্রণে একটি আন্তর্জাতিক সনদ তৈরি হওয়া প্রয়োজন, কারণ ডিজিটাল মিডিয়া কোনো এক দেশের সীমান্তে আটকে থাকে না। এর প্রকৃত ব্যাবহার না হলে সমাজে ক্ষমতা ও অর্থের অসাম্যের বিস্তার ঘটবে। বিপন্ন হবে মানবাধিকার এবং মিডিয়ার স্বাধীনতা। সাম্য ও মানবতার স্বার্থেই সেটা রক্ষা করা আগে জরুরি ।

=======================

সিনেমা : রিল ও রিয়েলের মাঝের বাহন

কৌশিক দাস 

 

সিনেমাশব্দটা শুনলেই এক রূপকথার জগতের কথা মনে পড়ে ৷ ৭০ মিমির পর্দাজোড়া নায়ক-নায়িকাভিলেনের অট্টহাসি ও কুকর্মশেষে সৎ ও অসৎ-এর দ্বন্দ্বে সততার জয় — আমাদের বেড়ে ওঠার সময়ে এই ধরণের সিনেমা দেখতে দেখতেই সততার প্রতি এক বিশেষ ভালোলাগা জন্মায় ৷ জন্মায় নায়ক হওয়ার অদম্য ইচ্ছে ৷ আমাদের আগের প্রজন্ম প্রেয়সীর সাথে নদীর ধারে বসার সময় হয়তো চিন্ময় দে-র মতোই বলতেন, "একবার বলো আমি উত্তমকুমার"বা আমরাই প্রেমিকাকে ইমপ্রেস করতে ধার করতাম শাহরুখের সিগনেচার ৷ এর পাশাপাশি আমরা দেখলাম এমন কিছু সিনেমাযা আমাদের পরিচয় ঘটালো আমাদেরই আশেপাশে ঘটে চলা অথচ আমাদের নজর-এড়িয়ে-যাওয়া কিছু ঘটনার দিকে ৷ আর্থসামাজিক অবনতিরাজনীতির দোলাচলপণপ্রথাধর্ষণের মতো নিত্যনৈমিত্তিক কালো দাগগুলো আরও স্পষ্টভাবে দেখাতে শুরু করলো কিছু সিনেমা ৷ নাসিরুদ্দিন শাহের মতো আমরাও জীবনকে বলতে চাইলাম— "তুঝসে নারাজ নেহি জিন্দেগিহয়রান হুঁ ম্যায়" ৷ আবার এই সিনেমাই আমাদের দেখালো হেরে গিয়েও ফিরে আসার গল্পদেখালো সাহিত্যে পড়া আমাদের প্রিয় চরিত্রগুলোর পর্দায় বাস্তবায়ন ৷ সিনেমা যে যেকোন দেশের আর্থিক উন্নতির অন্যতম বাহন— একথা অনস্বীকার্য ৷ এই তুমুল বেকারত্বের যুগে সিনেমা ও সিরিয়াল যে প্রচুর মানুষের রুটিরুজি যোগাচ্ছেএকথা কী আমরা কেউ অস্বীকার করতে পারি এর পাশাপাশি পরোক্ষভাবে হলেও একটা সিনেমার কিছু দৃশ্য অন্য কোন দেশের পর্যটন শিল্পকেও জোরদার করেছে বহু ক্ষেত্রেই ৷ আগেকার বলিউড সিনেমায় ইউরোপের বিভিন্ন অংশকে যেভাবে চিত্রায়িত করা হয়েছেতা ঐ সমস্ত দেশ সম্পর্কে মানুষকে আকৃষ্ট করেছে ৷ অনেকে ঘুরে এসছেন সেইসব স্থানে ৷ আর যারা পারেননিতারা পর্দাতেই বিদেশভ্রমণের আশ মিটিয়েছেন ৷ 'কহো না প্যার হ্যায়নিউজিল্যান্ডের পর্যটন শিল্পকে কীভাবে শক্তিশালী করেছিল মনে আছে সিনেমার জগতে প্রচুর পরিবর্তন এসেছে— সাইলেন্ট সিনেমা থেকে টকিসাদা-কালো থেকে রঙিনটু-ডি থেকে থ্রি-ডি ৷ তবে এত কিছু পরিবর্তনের মাঝেও একটা শাশ্বত সত্য থেকেই গেছেতা হল গল্প ৷ গল্প যদি জোলো হয়তাহলে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরিবড় বড় স্টারভ্যালু সবই ফিকে হয়ে পড়ে ৷ আর এই গল্পের খোঁজে প্রায়শই সিনেমা হাত ধরেছে বাস্তব জগতের ৷ হয়ে উঠেছে বাস্তব ও কল্পনার জগতের মাঝের সেতুস্বরূপ ৷ 

কাইনেটোস্কোপ : এই যন্ত্র দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েই লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয় সিনেমাটোস্কোপ তৈরি করেন, চিত্র- সৌজন্য — গুগল

অগাস্ত ও লুই লুমিয়ের : চলচ্চিত্র শিল্পের জনক, চিত্র- সৌজন্য — গুগল

ওয়ার্কার্স লিভিং দ্য লুমিয়ের ফ্যাক্টরি : পৃথিবীর প্রথম চলচ্চিত্রাংশ (১৮৯৫), চিত্র- সৌজন্য — গুগল

প্রসঙ্গ : রকেট্রি : দ্য নাম্বি এফেক্ট

“I am sure that 95 percent of the country’s population doesn’t know about Nambi Narayanan, which I think is a crime .”

উপরিউক্ত এই বিস্ফোরক মন্তব্য  এমন একজন অভিনেতা করেছেন যিনি ভারতবর্ষের সেই অল্পসংখ্যক অভিনেতারদের মধ্যে পড়েন যাদের কোন নিন্দুক নেই !  ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে মাধবন জানান তাঁর আগামী প্রজেক্ট তার ক্যারিয়ারের "Biggest film ever" । এই সিনেমার গল্পের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে মাধবন বলেন  -  ”The extraordinary story of an unsung hero who was neither an actor nor a sportsman".

রকেট্রি : দ্য নাম্বি এফেক্ট সিনেমার পোস্টার

এই গল্পের প্রটাগোনিস্ট যাকে হিরো বললেও অত্যুক্তি করা হবে নাতিনি হলেন ISRO র প্রাক্তন বিজ্ঞানী Nambi Narayanan !

 এই গল্পকে যা গল্প হলেও সত্যিমাধবন কেন  Extraordinary বলেছেন ?আসলে এই গল্পে উন্মোচিত হবে এক দেশদ্রোহিতা এবং Espionage এর ঘটনা যার সাথে জড়িয়ে রয়েছে (বলে মনে করা হয়) এক আন্তর্জাতিক  ষড়যন্ত্র ! 

ভারতের সাথে রাশিয়ার বন্ধুত্ব কতটা স্ট্রং সেটা ভারতের মহাকাশ গবেষণা (সে প্রথম স্যাটেলাইট 'আর্যভট্টই হোক বা প্রথম মহাকাশচারী রাকেশ শর্মা)  বা ১৯৭১ এর যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের "Ghaazi" সাবমেরিনকে নাস্তানাবুদ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দিয়েই প্রমাণিত । এই রাশিয়ার হাত ধরেই ১৯৯০ সালে ভারত রাশিয়ান স্পেস এজেন্সি Glavkosmos-এর সাথে একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ (কেনবলেছি পরে)   ডিল সাইন করতে চলেছিল যা ভারতকে মহাকাশ গবেষণার প্রথম সারির দেশগুলোর মধ্যে স্থান করে দিতে চলেছিল ।

PSLV (Polar satellite launch vehicle) এর পর ISRO-র সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্ট ছিল - Cryogenic Project এবং এই প্রজেক্টের ডাইরেক্টর  ছিলেন বিজ্ঞানী Nambi Narayanan   এই Nambi Narayanan-ই ছিলেন ভারতের প্রথম ব্যক্তিযিনি Liquid fuel Engine আবিষ্কার করেন, এই সময় এ.পি.জে আব্দুল কালাম তাঁর টিমের সাথে solid motors-এর উপর কাছ করছিলেন ।  নাম্বি নারায়ণনের তৈরী "Vikas" ইঞ্জিনই "Chandrayan 1" এবং "Mangalyaan"-এ ব্যবহৃত হয়েছিল !   

 Cryogenic প্রজেক্টের সাফল্য ভারতকে এনে দিত আন্তর্জাতিক  খ্যাতিকিন্তু এমন একটা যুগান্তকারী সময়ে দাঁড়িয়ে ১৯৯৪ সালের শেষের দিকে নাম্বি নারায়ণন কেরালা পুলিশের দ্বারা গ্রেপ্তার হয়ে   যান !  তাঁর কপালে লেগে যায় দেশদ্রোহিতার কালিমা ! হঠাৎ কি এমন হল ! এটা জানতে হলে একটু পিছিয়ে যেতে হবে রাশিয়ার সাথে সেই Cryogenic ডিলের ঘটনায়  !

  -২৩৮° সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে বলে Cryogenic তাপমাত্রা । এই অত্যন্ত নিম্ন তাপমাত্রায় হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেনের মত গ্যাস তরলে পরিণত হয়৷ এবার এই তরলদের পোড়ালে এত ভয়ঙ্কর তাপশক্তি উৎপন্ন হয় যে সেটা রকেটকে ৪.৪ কিমি/সেকেন্ড গতিবেগে ছোটাতে পারে । রাশিয়া যে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলতাতে বলা হয়েছিল ২৩৮ কোটি টাকার বিনিময়ে রাশিয়া Cryogenic ইঞ্জিন দেওয়ার সাথে সাথে Cryogenic দাহ্য তৈরী করার প্রযুক্তিও দেবে ।  এই খবর জানতে পেরেই আমেরিকা এবং ফ্রান্স এই পথে বাধা হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল ।  কারণএই একই প্রযুক্তি ফ্রান্স এবং আমেরিকা যথাক্রমে ৬৫০ কোটি টাকা এবং ৯৫০ কোটি টাকার বিনিময়ে বিক্রি করছিল । রাশিয়া হয়ত আমেরিকার এই ধমকি কানে নিত না,  যদি না সেই সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের মুখে থাকত ।  আমেরিকার চাপে রাশিয়া ভারতকে প্রযুক্তি হস্তান্তর করতে মানা করে দিল এবং শেষমেশ ঠিক হল মাত্র ৪ টে Cryogenic Engine দেওয়া হবে ভারতকে ! 

একটা বড় ধাক্কা খেল ভারতকিন্তু ধাক্কা খেয়ে পিছিয়ে যাওয়ার বদলে আমেরিকা ও বিশ্বকে চমকে দিয়ে একধাপ এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করল ভারত !  ঠিক হল ভারত নিজেই Cryogenic Fuel বানাবেআর এই প্রজেক্টের হেড বানানো হল Liquid fuel technology-র আবিষ্কর্তা নাম্বি নারায়ণনকে ! সকলের উচ্চাকাঙ্খা গগনচুম্বিএমন সময় ১৯৯৪ সালের অক্টোবর মাসে কেরালার তিরুবনন্তপুরমে ঘটল একটা ঘটনাযা সবকিছু তছনছ করে দিল !

১৯৯৪ সালের অক্টোবর মাসে মারিয়াম রাশিদা নামের মালদ্বীপের এক নাগরিককে কেরালার পুলিশ তিরুবনন্তপুরম থেকে গ্রেপ্তার করল । ভিসা এক্সপায়ার হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও সেই মহিলা ভারতে বসবাস করছিলেনএটাই ছিল প্রাথমিক অভিযোগ । তবে জিজ্ঞাসাবাদের এক মাসের মধ্যে সেই মহিলা কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য জানায় পুলিশকে ! মহিলার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী নাম্বি নারায়ণন সেই মহিলাকে Cryogenic Engine-এর ড্র‍য়িং দিয়েছেন পাকিস্তানের হাতে দেওয়ার জন্য  ! 

এই স্বীকারোক্তির পর সঙ্গে সঙ্গে নাম্বি নারায়ণনকে গ্রেফতার করা হয়, CBI-এর তদন্ত শুরু হয় । গ্রেপ্তারের দিন থেকে পরপর ৫০ দিন তাঁকে পুলিশি হেফাজতে রেখে তদন্তের নামে মানসিক ও শারীরিক  অত্যাচার করা হয় (এসব কথা  অটোবায়োগ্রাফি   Ormakalude Bhramanapadham তে বলেছেন) । এই ৫০ দিনের মধ্যে একদিন তিনি সেন্ট্রাল জেলেও ছিলেন ।  এই সময়ে তাঁর পরিবার মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে । মন্দির থেকে প্রসাদ দিতে বারণ করে দেওয়া হত তাঁর স্ত্রীকেবৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে হত তাঁর ছেলেমেয়েদেরঅটোওয়ালা দেশদ্রোহীর সন্তানদের ওঠাতে চাইত না ।  ৫০ দিন পর বাড়ি ফিরে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েন তিনি । এমনকি আত্মহত্যার কথাও ভেবেছিলেন । তবে পরিবারকে পাশে পেয়ে পরিবারের কথায় ঘুরে দাঁড়ালেন আর এমনভাবে ঘুরে দাঁড়ালেন যে কেরালার সরকার কেঁপে উঠল ।

১৯৯৬ সালে CBI কোচির ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে এই কেসের closure report জমা দেয়যেখানে বলা

 হয় - allegations of espionage were unproven and false .  কিন্তু গল্প এখানেই শেষ হয়না ।  কেরালার সরকার আবার সেই কেস খোলে ! 

২০১৮ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্ট  নাম্বি নারায়ণনের বিরুদ্ধে আনা Espionage চার্জ খারিজ করে এবং এতদিনের মানসিক নিপীড়নের জন্য ৫০ লক্ষ টাকার ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেন ।

নাম্বি নারায়ণন তাঁর অটোবায়োগ্রাফিতে বলেছেন যেতিনি বিশ্বাস করেন এই কুখ্যাত "ISRO spy case"-এর পেছনে CIA-র হাত আছে ! ভারতের মহাকাশ গবেষণার এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ  সময়ে এমন এক মিথ্যে ষড়যন্ত্রে ফাঁসানো হল তাঁকেযার ফলে এই Cryogenic প্রজেক্ট একেবারে মুখ থুবড়ে পড়ল ।

২০১৪ সালের ২৪ শে সেপ্টেম্বর ভারত  মহাকাশ গবেষণায় বিশ্বের সমস্ত দেশকে ( ! )  পেছনে ফেলে দুটো ইতিহাস তৈরী করেছিল  -

 ১ - সব চাইতে কম খরচে (৪৫০ কোটি টাকা) নিজস্ব প্রযুক্তিতে মঙ্গলগ্রহে "মঙ্গলযান" পাঠানো !

   - প্রথম চেষ্টাতেই সাফল্য অর্জন করাযা এখনো পর্যন্ত বিশ্বের কোন দেশ করে উঠতে

পারেনি ! 

তবে ১৯৯৪ সালে নাম্বি নারায়ণনের সাথে এমন একটা ঘৃণ্য চক্রান্ত না হলে কয়েক দশক আগেই এমন একটা কীর্তি স্থাপন করে বিশ্বের সমস্ত দেশকে চমকে দিতে পারত ভারত । মনে হয় এই বিষয়টা আমেরিকা সেই সময় উপলব্ধি করতে পেরেছিল ! তবে -

দের সে আয়া লেকিন দুরুস্ত আয়া । 

নাম্বি নারায়ণন যে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন আজ ISRO দেশবাসীকে সঙ্গে নিয়ে সেই স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে উড়ছে !

উপসংহার :

সিনেমাটির সাফল্য-ব্যর্থতা আমাদের আলোচ্য নয় ৷ সাহিত্য যেমন সমাজের দর্পণঠিক সেভাবেই একটা সিনেমা আমাদের বাস্তবকে এমনভাবে আয়নায় দেখাতে পারেযা আমাদের মনে আরও গভীরভাবে রেখাপাত করে ৷ সিনেমার রিল এভাবেই যুগে যুগে রিয়েলের বাহন হয়ে ওঠেআজও উঠছেভবিষ্যতেও উঠবে ৷

তথ্যসূত্র :

 BBC news

 Zee news

 Study IQ youtube channel

 Wikipedia 

=======================

বাহন যখন গরুর গাড়ি

ব্যাসদেব গায়েন 

 

পৌরাণিক দেব-দেবীর বাহন বিভিন্ন পশু পাখি। এখানে বিজ্ঞানের একটা যুক্তি খাড়া করা যেতেই পারে। কারণ প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার্থে এর থেকে বড়ো ঢাল আর আছে বলে আমার অন্তত জানা নেই। এখন আসা যাক মূল প্রসঙ্গে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অধীশ্বর তিন দেবতা ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর। সৃষ্টি স্থিতি লয়। অর্থাৎ প্রজাপতি ব্রহ্মা জীব সৃষ্টি করেন। বিষ্ণু সেই জীবকে পালন করেন আর মহেশ্বর ধরাধামের সাম্য বজায় রাখতে সংহার করেন। এ পর্যন্ত আমরা সবাই জানি কিন্তু মজার ব্যাপার হল তাদের বাহনকে নিয়ে। ব্রহ্মার বাহন সাদা হাঁস। এখানেই লক্ষ্যণীয় বিজ্ঞানের ধারণা অনুযায়ী জীবের উৎপত্তি জলে আর সেই জলেই সৃষ্টিকর্তার বাহন ভেসে বেড়ায়। বিষ্ণুর বাহন গরুড় অবশ্য বিষ্ণুর অবতারী শ্রীকৃষ্ণ ও মহেশ্বরের বাহন একই গো-জাতি। শ্রীকৃষ্ণের গরু এবং মহেশ্বরের ষাঁড়। গরুর মধ্যে মাতৃসুলভ ভাব লক্ষ্য করা যায় তাই পালন কর্তার বাহন হিসেবে গরুও জীবকে সুষম খাদ্যের জোগান দিয়ে পালন করে চলেছে আদিকাল থেকে। ষাঁড়ের প্রকৃতি রুদ্রের মতই। এবার আসা যাক গরুর গাড়ির কথায়, যেটা জীবের প্রথম আধা-যান্ত্রিক বাহন। এই গরুর গাড়ির ক্ষেত্রে প্রকৃতি ও বিজ্ঞানের সহাবস্থান, অবশ্য প্রতিটি বিষয়ে প্রকৃতিকে সঙ্গে নিয়ে বিজ্ঞান হাজির হয়।

"কুমোর পাড়ার গরুর গাড়ি

বোঝাই করা কলসি হাড়ি"

       গরুর গাড়ি হল দুই চাকাবিশিষ্ট গরু বা বলদে টানা একপ্রকার যানবাহন। 'যানবাহন'-এর শেষ তিনটি অক্ষরই আমাদের আলোচ্য বিষয়। সাধারণত একটি মাত্র অক্ষের সাথে দুটি চাকা যুক্ত থাকে। সামনের দিকে একটি জোয়ালের সাথে দুটি গরু বা বলদ জুড়ে এই গাড়ি টানা হয়। সাধারণত চালক বসেন গাড়ির সামনের দিকে। তাঁর পিছনে বসেন যাত্রীরা। বিভিন্ন মালপত্র বহন করা হয় তারও পিছনের দিকে। বিভিন্ন কৃষিজাত দ্রব্য ও ফসল বহনের কাজে গরুর গাড়ির প্রচলন যথেষ্টই ব্যাপক। গ্রাম বাংলায় ঐতিহ্যগতভাবে গরুর গাড়ি কিছুদিন আগে পর্যন্তও যাতায়াত ও মালবহনের কাজে প্রভূত পরিমানে ব্যবহৃত হত। তবে বর্তমানে নানাধরনের মোটরচালিত যানের আধিক্যর কারণে অপেক্ষাকৃত ধীর গতির এই যানটির ব্যবহার অনেক কমে এসেছে।

        গরুর গাড়িতে গরু জুড়তে সাধারণত জোয়াল ব্যবহার করা হয়। গাড়ির চাকাগুলি হয় বড় বড়, সাধারণত কাঠের তৈরি। তবে এখন তাতে প্রায়শই লোহার রিম ব্যবহার করা হয়। সম্পূর্ণ লোহার তৈরি চাকার ব্যবহারও খুব বিরল নয়। যাত্রীদের রোদ ও বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য গাড়ির উপর অনেক সময়েই ছই'এর প্রচলনও আছে। গাড়ির পাটাতনটি সাধারণত বাঁশ বা কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়। ছইটি হয় সাধারণত বেতের বোনা। কখনও কখনও তা বাঁশ ও খড় দিয়েও তৈরি করা হয়ে থাকে। আর একটা কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ না করলে নয়, গাড়ির চালকের আসনে যিনি বসেন তাকেও শিখতে হয় নানান কলাকৌশল। নাহলে গাড়ি পার্শ্ববর্তী ডোবা বা খানায় পড়তে বাধ্য।

      বাহন যখন গরুর গাড়ি তখন তো গ্রাম্য ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠবেই। মোরামের রাস্তা ধরে এক কৃষক তার খাটুনির ফসল বাহন গরুর গাড়িতে চাপিয়ে ঘরে ফেরার দৃশ্য কৃষক-রমণীর মনে খুশির সঞ্চার করে। আমরাও খাদ্যশস্যের ঘ্রাণে মশগুল হয়ে লিখতে বসি গরুর গাড়ির ইতিবৃত্ত বা কথকতা।

আমাদের ঐতিহ্যের বাহন গরুর গাড়ি, ছবি-ঋণ : গুগল

=======================

No comments:

Post a Comment