Thursday, September 30, 2021

রম্যরচনা

"মারুত"

 রবীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী


ভাবলাম বাহন, অর্থাৎ বহন যে করে, তাকেই তো মানুষ বাহন ক্রিয়া করে এগিয়ে যায় ! তাকেই  মানুষ প্রয়োজনে , অপ্রয়োজনে , প্রমোদ ভ্রমণে , কী চিকিৎসার 

কারণে রাত গভীরে কিম্বা দিনে দুপুরে স্মরণ করে ! নয় কী ?

আমার চেনা মানুষ, শংকর, নিখাদ সাধা সিধে মানুষ , সে আমায় একটি বাহন  করে প্রায়শই নিয়ে যায় , যখন যেখানে প্রয়োজনের তাগিদ আসে ! হাসি মুখে নিয়ে যায় , অবশ্য কাঁধে করে নয় , গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে সে নিয়ে যায় !সেখানে  বাহন স্বরূপ গাড়িটির কোন ইচ্ছা,বা  অনিচ্ছা নেই ! এক্ষেত্রে, সেইতো "বাহন"! তার উপর ভরসা করেই তো  কাছের ও দূরের প্রয়োজন মেটাই ! আহা বড় প্রিয় সখা সে  আমার! কখনো তার আদরে ঘুমিয়ে পড়ি ! তার টানে ছুটে যাই, দূর থেকে বহু দূরে !

মন খারাপ হয়ে যায়!যখন আমার একান্ত বিশ্বস্ত বাহন, ধরা যাক তার নাম "মারুত", সে যখন অপারগ হয় , সে যে আমার  হৃদয়হরণ ! তার প্রেমে আবিষ্ট করে রেখেছে সর্বক্ষণ ! সেই সেদিন  চিৎকার করে বলে  উঠলো—

"আমা থেকে থাকো দূরে!

জানোনা কি 

তেলের দাম এখন আগুন !"

আমি হৃদয় দিয়ে বুঝলাম !আমার ব্যথা আমার এই বাহন "মারুত" যত বোঝে ,আর তো কেউ বোঝেনা ?

=======================

বাহন

 অগ্নিমিত্র 

মা দুর্গার বাহন সিংহকার্তিকের বাহন ময়ূরএকথা তো আমরা সবাই জানি। নারদের বাহন ঢেঁকিগণেশের ইঁদুর । বাহনের এক নির্দিষ্ট ভূমিকা রয়েছে আমাদের পুরাণে। গণেশের বাহন ইঁদুর বস্তা কেটেকাগজপত্র কেটে কুটিকুটি করে মানুষের অহমিকা চূর্ণ করেন। আবার লক্ষ্মীর বাহন প্যাঁচা শ্রী ও সমৃদ্ধির প্রতীক। মা সরস্বতীর বাহন রাজহাঁস দুধ ও জল মিশ্রণ থেকে আলাদা করতে পারেতাই সার ও অসার বস্তুর প্রভেদ করতে সে শেখায়।

তবে সাধারণ মানুষের বাহন কে বা কারা তার বাহনের গুরুত্ব নেই !

আমি কিন্তু কাউকে ছোট করছি না। মজার ছলেই নেবেন। একজন ভারতীয় বালক বা  বালিকা ছোটবেলায় দু তিন বছর ধরে আরো বেশি সময় বাবা মার কোলে চড়ে ঘুরে বেড়ান। সেক্ষেত্রে বাবা মা বা কাকা বা দাদা দিদি তাঁর বাহন। আবার একটু বড় হলে তিনি অনেক সময়ে সাইকেলে করে স্কুলে বা কলেজে পড়তে যান। একটু শহুরে ছাত্র বা ছাত্রী হলে বাইকে বা স্কুটিতে চড়ে যান । এখন দেখছেনএই অবধিই কত রকম বাহন হয়ে গিয়েছে?

এর পর প্রেমিক বা প্রেমিকা  আসতে পারে জীবনে। যদিও ঠিক প্রেমিক বাহন নয়তবে বিবাহ হলে সে বর হয়ে অবশ্যই বাহন হবেকারণ 'বিবাহশব্দের অর্থই বিশেষভাবে বহন করা। যদিও এটি তর্কসাপেক্ষ।

একটু পয়সা জমলে মানুষের বাহন হয় চারচাকা গাড়ি । যদিও দুচাকা হোক বা চারচাকামানুষকেই বাহনকে চালনা করতে হয়। মানুষের ক্ষেত্রে বাহন মূলতঃ গতিবিধির মাধ্যম। তার অন্য কোনো মহত্ত্ব নেই। যদিও বাইক বা চারচাকা গাড়ি মানুষের উৎকর্ষ বা বৈভবের প্রতীকচিহ্ন হতে পারে । তিন লাখ টাকার গাড়িতে কাজ চলে গেলেও মানুষ তাই প্রতিপত্তি দেখানোর লোভে দশ লাখ টাকার গাড়ি ও তিন লাখ টাকার বাইক কেনে!..

এইবার বাহন কথা সম্পূর্ণ হলো । তবে কলকাতায় দুর্গা পূজা ঘুরে দেখতে হলে বাহন নিষ্প্রয়োজন । এগারো নম্বর বাস মানে নিজস্ব দুই পা-ই তখন শ্রেষ্ঠ বাহন বা গতিবিধির মাধ্যম!!

=======================

লোকাল ট্রেনে দু-জনে

 অভিষেক ঘোষ 

আজ যখন করোনাসুরের আক্রমণে ভারতভাগ্যবিধাতা স্বর্গছাড়া, এবং তিনি ক্ষমতায় না ফেরা পর্যন্ত ট্রেন-চলাচল বন্ধ, তখন বারবার মনে পড়ে যায় আমাদের ছাত্র-জীবনের কথা । ট্রেনে যাতায়াত-কালে ছোটো থেকে কত বিচিত্র অভিজ্ঞতাই না হয়েছে !

শিয়ালদা থেকে ছুটতে ছুটতে ট্রেনে উঠে অফিস-ফেরতা ভদ্রলোককে ভরসা করে ট্রেন ছাড়ার সময় জানতে চেয়ে কীভাবে ঠকেছি মনে পড়ে !

"দাদা, ট্রেন-টা কটায় ছাড়বে ?"

"আমায় বলে নি জানেন... " - সহাস্য বিদ্রূপ শুনেও নিত্য-যাত্রী হায়েনার দলে একা বলে, রাগ গিলে নিয়েছি ।

আবার এই ট্রেনেই টিকিট না কেটে উঠে, দুরুদুরু বুকে গন্তব্যে পৌঁছানোর ঠিক একটা স্টপেজ আগে চেকারের কাছে হাতেনাতে ধরা পড়ে ল্যাজেগোবরে হয়েছি । অবশেষে কলেজে পড়ি, ভালোছেলে এবং মানি ব্যাগ ফেলে এসেছি, এইসব ভুজুং-ভাজুং দিয়ে নিস্তার ।

স্কুলের পুরোনো বান্ধবীকে সহসা আবিষ্কার করেছি ট্রেনেই নিত্যযাত্রীদের সাথে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করতে । অবাক হয়েছি, গর্বিতও ।

আবার এই ট্রেনে সপরিবারে বাড়ি ফেরার সময় একবার মায়ের চোখে জানালা দিয়ে তীব্র গতিতে মাটির শক্ত ঢেলা এসে লাগতেও দেখেছি - বদমাশ বাচ্চাদের ভয়ানক খেলা । একটুর জন্য মা-র চোখ বেঁচেছিল সেবার । চোখে জল-টল দিয়ে, ভাপ দিয়ে সবাই অস্থির, সে এক ভয়াবহ কান্ড !

বহু আগে, তখন আমি অনেক ছোটো, মেলা থেকে ফেরার পথে একবার বাবা মায়ের সঙ্গে লক্ষ্মীকান্তপুর স্টেশনে সারা রাত কাটাতে হয়েছিল । কারণটা আজ আর ভালো মনে নেই । হয়তো কোনো কারণে লাইনে সমস্যা হয়েছিল বা, কোনো দুর্ঘটনা, ফলে অত রাতেও ট্রেন আচমকা বন্ধ হয়ে যায় । শুধু যে ঘটনাটা স্পষ্ট মনে আছে তা হল, ব্যাগে মাথা দিয়ে শোয়ার সমস্যা হচ্ছিল আর ঠান্ডাও ছিল বেশ । ওয়েটিং রুম বলে সেকালে কিছুই ছিল না গ্রামাঞ্চলে, একালেও যে লোকাল ট্রেন-লাইনে সেরকম কিছু আছে, তা মনে হয় না । তো সেবার দয়ালু স্টেশন মাস্টার অত্যন্ত সহৃদয়তার সাথে, সেই রাতে, আমাদের তাঁর অফিস ঘরে ডেকে নেন । বড়ো ভালো মানুষ । আমার ঘুম পাচ্ছিল না বলে বই পড়তে দেন । বেশ মনে আছে, গোটা দুই বইয়ের ওপর মাথা রেখেই সে রাতে শেষ পর্যন্ত ঘুমিয়েছিলাম ।

এমন কত কত স্মৃতি !

একটা অত্যন্ত ব্যক্তিগত সুখের মুহূর্তও কৌশলে বলা যায় । ট্রেনেই প্রথম ভালো করে দেখেছিলাম তাকে। সহপাঠীই ছিল । তারপর...

তো এক বিকেলে তাকে ভিড়ের মধ্যেও কেবল গল্প বলে একলা করে দিতে পেরেছিলাম । মনে মনে ভাবতে ভালোবাসি, আমার এই ক্ষমতাটা আছে ! আমি এমনভাবে গল্প বলতে পারি, যাতে পাশের মানুষটার আর কিছু খেয়ালই থাকবে না - ভিড় আর হট্টগোলেও মনে হবে, আছি শুধু আমি-তুমি ।

কী গল্প বলেছিলাম ? একটা নয়, দুটো । দক্ষিণ কোরিয়ার এক বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক কিম কি-দুক সেই মুহূর্তে আমার প্রিয়তম পরিচালক । তাঁর দুটি ছবি, যা দেখার পর আমি কয়েকটা রাত স্বপ্নেও সেই ছবির দৃশ্যগুলোই দেখেছি, সেই ছবিদুটির প্লট শুনিয়েছিলাম তাকে । '3-Iron' আর 'The Bow' । 

উল্লিখিত প্রথম ছবিতে এক ভবঘুরে ছোকরা ফাঁকা বাড়িগুলির কী-হোলে দোকানের খাবারের মেনু কার্ড বা কোনো বিজ্ঞাপন সেঁটে দিত, তারপর কয়েকদিন বাদে বাদে এসে দেখত, কোন্ কার্ডগুলো যথারীতি, অক্ষত অবস্থায় স্ব-স্থানে রয়েছে । কারণ এর মানে ওই বাড়িগুলো ফাঁকা পড়ে আছে, কেউ থাকে না । তারপর সে সেই সব বাড়িতে মালিক না আসা পর্যন্ত দিব্যি থেকে যেত । অবশ্যি একেবারে এমনি নয়, বিনিময়ে সে যেচে উপকার করে দিত । খারাপ বা অচল ব্যবহার্য জিনিসপত্র থাকলে, অলক্ষ্যে সারাই করে দিত, জামা-কাপড় কেচে দিত, ইস্ত্রি করে রাখত ইত্যাদি । আর এভাবেই একদিন সে এক ধনীর বাড়িতে আবিষ্কার করে এক অসুখী গৃহবধূকে । তারপর...  প্রেম !

আর দ্বিতীয় গল্প এক বোবা মেয়ের সাথে এক বুড়োর আশ্চর্য সম্পর্কের - অধিকার বোধ আর অদম্য কামনা যেখানে দুই অসমবয়সী মানুষের মধ্যে এনে দেয় অপক্ক রক্তিম পরিণাম । সেই ছবিতে কী অপূর্ব সঙ্গীতের ব্যবহার ছিল আহা ! তেমনি চোখ জুড়োনো ক্যামেরা আর আলো ! আর গল্প শোনাতে শোনাতে কথক যদি শ্রোতার চোখেও তেমনই আলো দেখতে পায়, তাহলে তো কথাই নেই । অবশ্য জানি না ভান ছিল কিনা ! এই দুনিয়ায় ভাই সবই হয়... সব সত্যি ! সব সত্যি । কিন্তু সেই বিকেলের অনাবিল আনন্দ এখনো চলন্ত লোকাল ট্রেনের মতোই মৃদু দোলা দিয়ে যায় মনে । হাত অন্যমনস্কভাবে, বেখেয়ালি বাতাসে, কারো কপালে এসে পড়া চুল আপনি সরিয়ে দিতে উদ্যত হয় । তারপর ঘুম ভাঙে আর খেয়াল হয়, ট্রেন তো চলছে না আর; কবেই গিয়েছে  থেমে ।

=======================

No comments:

Post a Comment