অণুগল্প : সাহিত্যচর্চার নতুন বাহন?
মধুমঙ্গল বিশ্বাস
মাত্রই ১৩২ শব্দের একটি ‘দুর্লভ রত্নের’ আলোকমালায় অবগাহন করা নিন্দনীয় হবে না বোধকরি।
একটি দিন
মনে পড়ছে সেই দুপুরবেলাটি। ক্ষণে ক্ষণে বৃষ্টিধারা ক্লান্ত হয়ে আসে, আবার দমকা হাওয়া তাকে মাতিয়ে তোলে।
ঘরে অন্ধকার, কাজে মন যায় না। যন্ত্রটা হাতে নিয়ে বর্ষার গানে মল্লারের সুর লাগালেম।
পাশের ঘর থেকে একবার সে কেবল দুয়ার পর্যন্ত এল। আবার ফিরে গেল। আবার একবার বাইরে এসে দাঁড়াল। তার পরে ধীরে ধীরে ভিতরে এসে বসল। হাতে তার সেলাইয়ের কাজ ছিল, মাথা নিচু করে সেলাই করতে লাগল। তার পরে সেলাই বন্ধ করে জানলার বাইরে ঝাপসা গাছগুলোর দিকে চেয়ে রইল।
বৃষ্টি ধরে এল, আমার গান থামল। সে উঠে চুল বাঁধতে গেল।
এইটুকু ছাড়া আর কিছুই না। বৃষ্টিতে গানেতে অকাজে আঁধারে জড়ানো কেবল সেই একটি দুপুরবেলা।
ইতিহাসে রাজাবাদশার কথা, যুদ্ধবিগ্রহের কাহিনী, সস্তা হয়ে ছড়াছড়ি যায়। কিন্তু একটি দুপুরবেলার ছোটো একটু কথার টুকরো দুর্লভ রত্নের মতো কালের কৌটোর মধ্যে লুকোনো রইল, দুটি লোক তার খবর জানে।
গল্পের প্রতি মানুষের আগ্রহ চিরাচরিত। যে-শ্লোক আমাদের শ্রবণকে প্রথম উৎকর্ণ করেছিল,
‘মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ।
যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেবকমবধীঃ কামমোহিতম্।।’
--- নিটোল কাহিনিই তো!
জীবনযাপনের জন্য, জীবনধারণের জন্য, সাদামাটা বেঁচে থাকার বাইরে মানুষ যে শিল্প-সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করল — তা সে হোক না চর্যাপদ, অথবা মঙ্গলকাব্য, কিংবা রামায়ণ-মহাভারতের কথাও যদি স্মরণে আসে — সে তো আখ্যানই। এই আখ্যান বা গল্পের প্রতি আমাদের টানটি অমোঘ। ফলত তার চর্চা, বিস্তার, প্রসার, প্রকরণভাবনা — সবেতেই লেগেছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর প্রতিদিন নতুন থেকে নতুনতর হয়ে ওঠার অনিবার মাতম।
অণুগল্প নিয়ে যে-কোনও আলোচনার সময় অবশ্যম্ভাবীভাবে আমাদের মণিকর্ণিকায় বনফুল-এর ছোটো-ছোটো গল্পগুলি দল মেলে। যে-নামেই তিনি অভিহিত করুন না কেন, প্রায় সকল অণুগল্পচর্চাকারীই কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তাঁর পোস্টকার্ডগল্পগুলির মাহাত্ম্য দ্বিধাহীন স্বীকার করেন। ‘লিপিকা’-র যে নতুন লেখাগুলি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ নিজেই বিশেষভাবে ভাবিত ছিলেন, তাদের অনেকগুলিকে অনেক অণুগল্পকারই অণুগল্পের গুণসম্পন্ন বলে স্বীকার করেন ও মান্যতা দেন। এই রচনাটির প্রারম্ভে উদ্ধৃত গল্পটি (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সৃজিত) বিশ্বভারতী প্রকাশিত রবীন্দ্র-রচনাবলী, ত্রয়োদশ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩২৯ থেকে চয়ন করা হয়েছে।
প্রখ্যাত অণুগল্পকার প্রগতি মাইতি মনে করেন, '‘অণুগল্পের ক্ষেত্রেও রবীন্দ্রনাথ আমাদের আদর্শ’ এবং বনফুল ‘আমাদের অণুগল্পের আইকন’।"
রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব মাঝেমাঝেই ছোটো-ছোটো গল্প বলতেন, কোনো-কোনো প্রাবন্ধিক তথা অণুগল্পের সুলুকসন্ধানে নিয়োজিতজন অভিমত প্রকাশ করেন যে এগুলি বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে অণুগল্পেরই দোসর বা সমগোত্রীয়। তাঁর একটি আখ্যান এই অবকাশে আমরা পরখ করতেই পারি-
একটা ছাগলের পালে বাঘ পড়েছিল। লাফ দিতে গিয়ে বাঘের প্রসব হয়ে ছানা হয়ে গেল। বাঘটা মরে গেল, ছানাটি ছাগলের সঙ্গে মানুষ হতে লাগল। তারাও ঘাস খায়, বাঘের ছানাও ঘাস খায়। তারাও “ভ্যা ভ্যা” করে, সেও “ভ্যা ভ্যা” করে। ক্রমে ছানাটা খুব বড় হল। একদিন ঐ ছাগলের পালে আর-একটি বাঘ এসে পড়ল। সে ঘাসখেকো বাঘটাকে দেখে অবাক। তখন দৌড়ে এসে তাকে ধরলে। সেটাও “ভ্যা ভ্যা” করতে লাগল। তাকে টেনে হিঁচড়ে জলের কাছে নিয়ে গেল। বললে, “দেখ, জলের ভিতর তোর মুখ দেখ--- টিক আমার মতো দেখ। আর এই নে খানিকটা মাংস--- এইটে খা।” এই বলে তাকে জোর করে খাওয়াতে লাগল। সে কোন মতে খাবে না--- “ভ্যা ভ্যা” করছিল। রক্তের আস্বাদ পেয়ে খেতে আরম্ভ করলে। নূতন বাঘটা বললে, “এখন বুঝিছিস, আমিও যা তুইও তা; এখন আয়, আমার সঙ্গে বনে চলে আয়।” (শ্রীমা কথিত শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত, ১ম খণ্ড, ৫ম পুনর্মুদ্রণ এপ্রিল ২০১২, পৃষ্ঠা ৩২২)
প্রখ্যাত নরেন্দ্র দেব-এর একটি গল্প আমরা যদি পাঠ করি এখানে, অপ্রাসঙ্গিক মনে হবে না—
এক চোর এক দরবেশের মাথার টুপি চুরি করিয়া পলাইয়াছিল। দরবেশ তাকে ধরিতে না পারিয়া শেষে গোরস্থানে গিয়া বসিয়া রহিল। রাস্তার লোকেরা তাকে জিজ্ঞাসা করিল, “মহাশয়, চোর যে আপনার টুপি নিয়ে সহরের দিকে পালিয়েছে, আপনি গোরস্থানে এসে বসে রইলেন কেন?” দরবেশ তখন গম্ভীরভাবে মাথা নাড়িয়া বলিল, “যেখানেই যাক্ না বাপু, একদিন ত তা’কে এখানে আস্তেই হবে।”
এই অসামান্য গল্পটি যার শব্দসংখ্যা মাত্রই ছাপ্পান্ন, এবং তিনি নিজে এটিকে আধ-মিনিটের গল্প আখ্যা দিলেও, আমাদের কি সত্যিই অণুগল্প মনে হয় না? তাঁর আরও কয়েকটি এমনই ছোটো-ছোটোগল্প ‘মানসী’ ও ‘মর্মবাণী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। পাঠকমহোদয়গণ বিবেচনা করে দেখবেন এই ‘আধ-মিনিটের গল্প’গুলিকে অণুগল্পের কষ্টিপাথরে বিচার-বিশ্লেষণ করলে মন কি অণুগল্প অণুগল্প করে গুনগুনিয়ে ওঠে না! সংশয় কি দ্রুতচরণে অপসৃত হয় না!
অণুগল্প নিয়ে সামান্য চর্চার সুবাদে এবং স্বীয় কৌতূহলের কারণে বেশ কয়েকজন অণুগল্পকারের সঙ্গেই কথা বলেছি। কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় এই, কেউই বলতে পারেননি বাংলাভাষায় রচিত প্রথম অণুগল্পটির রচয়িতা কে।
যে স্তর থেকেই আলোচনা সংঘটিত হোক না কেন, ‘পত্রাণু’-র সোচ্চার প্রকাশ ও বহমানতা এবং তার লেখকগণের কথা একবার অন্তত বক্তামাত্রেই উচ্চারণ করে থাকেন।
অণুগল্পের শুরু ও শেষ নিয়ে অনেকরকম মত উচ্চারিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। অণুগল্পের শুরুতে চমক বা রহস্য সৃষ্টিতে তৎপর একদল। অনেকেরই উদ্যোগ আবার শেষের চমকে। একথা অস্বীকার করা যায় না, যে-কোনও লেখা, তা অণুগল্প হোক বা কবিতা, উপন্যাস, এমনকি প্রবন্ধ — শুরু এবং সমাপ্তির আকর্ষণীয় প্রকাশই প্রার্থিত! শুরু বা শেষটা নয়, সমগ্র লেখাটিই টানটান হবে, মোহিনী হবে, যে-কোনও লেখার মাহেন্দ্রক্ষণে এমনটিই লেখকের ভাবনায় থাকে বলে আমার বিশ্বাস।
নির্ভেজাল গদ্যভাষাই অণুগল্পের জন্য নির্ধারিত বলে অনেক গল্পকারই অভিমত প্রকাশ করেন। কেউ কেউ ভাষায় কাব্যগুণের পক্ষে সওয়াল করেন। এই সময়ে দাঁড়িয়ে নির্মেদ গদ্যভাষাতে দিব্য আমাদের কাব্যচর্চা চললেও, একটু নজরদারি করলে দেখা যাবে অনেক সময়েই লেখক সাধুভাষাকে বাহন করেন। তার জন্য কবির বিরুদ্ধে কোনও কথাই শ্রবণে আসে না। বরং, ভোক্তা হিসেবে অভাবিত ও অনাকাঙ্খিত একটি রসময় জানালা খুলে যেতে দেখে কৌতূহলী হই। ঠিক তেমনিভাবেই মদীয় ভাবনা, ভাষা নির্মেদ হবে, নাকি অলংকারঘন, কাব্যিক হবে নাকি কঠিন কঠোর গদ্য — তা ঠিক করুক গল্প নিজেই। লেখক তো নিমিত্ত মাত্র, ক্রীড়নক।
শব্দসংখ্যা নিয়ে নানা মুনির নানা মত আমাদের জ্ঞাত আছে। সাধারণত ৫০০ শব্দ পর্যন্ত বিভিন্ন গল্পকার মান্যতা দিয়ে থাকেন। যদিও ১০০ শব্দে গল্প, পোস্টকার্ডে গল্প, ৫০-২৫ এমনকি ১০ শব্দেও গল্পচর্চা চলছে। আমার ব্যক্তিগত লেখালেখিতে অণুগল্প ৩০০ শব্দের ভেতরেই ঘোরাফেরা করে। আবার আমাদের অণুগল্প চর্চার ‘সবুজের কাছাকাছি’ পত্রিকা অনধিক ২০০ শব্দের অণুগল্প চর্চায় নিয়োজিত। এই প্রসঙ্গে সুলেখক শিবরাম চক্রবর্তী-র একটি রসময় লেখার স্মরণ নেওয়া যায়ই---
ঝি!
কি—
ঘি!
দি।
উপন্যাস, ছোটোগল্প, এমনকি এইসময়ের কবিতা পাঠক তথা উপভোক্তাকে আলোড়িত করে, ব্যথিত বা আনন্দিত করে ঠিকই, কিন্তু পাঠকের জন্য নির্দিষ্ট থাকে একটি অদৃশ্য সীমারেখা। বিস্ময় এবং আনন্দের যে, অণুগল্প পাঠককে সাহিত্যকর্মটির কেন্দ্রে বা পরিধিতে রেখে সিনেমা দেখায় না; বরং পাঠকের অনুপ্রবেশ ও অংশগ্রহণের জন্য যথারীতি ভাস্বর একটি সূচিমুখ উন্মুক্ত করে যেন অপেক্ষায় থাকে। কেবলমাত্র ভালোলাগা মন্দলাগার অনুভূতিতে আবদ্ধ না রেখে সৃজনের সম্ভাবনা ক্ষেত্রটিকে অপেক্ষ্যমান রাখে। পাঠকমহামতি নিজের অজান্তেই যেন কাহিনিটিকে প্রসারিত করার অভিলাষে নিজেও অনেকাংশে লেখক হয়ে ওঠেন। একটি সম্পন্ন অণুগল্পে পাঠকের জন্য যে পরিসর উন্মুখ রাখা থাকে তাহা-ই অন্যান্য শিল্পমাধ্যম সাপেক্ষে অণুগল্পকে বিশিষ্ট ও ব্যতিক্রমী করে তোলে।
কবিতায় যেমন পাঠকের জন্য পরিসর থাকে, অণুগল্পের ক্ষেত্রে তা আরও আরও অধিকমাত্রায় পরিলক্ষিত হয়। অনেক না-বলা কথা থাকে, যা পাঠক নিজেই আবিষ্কার করতে করতে বা সৃজন করতে করতে অণুগল্পটির সঙ্গে ঐকান্তিকতায় জড়িয়ে পড়েন। ফলত অণুগল্প এবং পাঠকের মধ্যে নিশিডাকের মতো এক টান, কিংবা বলা যায়, একটি অলৌকিক সেতু জেগে ওঠে। তারা বিচ্ছিন্ন হতে চায় না, বরং জড়িয়ে জাপটে রং ছড়াতে ছড়াতে বর্ণিল হয়ে ওঠে।
অন্যান্য শিল্পমাধ্যম অপেক্ষা অণুগল্প যেহেতু পাঠককে অনেক বেশি সঙ্গে সঙ্গে পথচলায় আগ্রহী করে তুলতে সমর্থ হয়, এর ভবিষ্যতও এতদকারনে সুদূরপ্রসারী বলে মনে হওয়া স্বাভাবিক।
আগামীদিনে অণুগল্প লেখা, পাঠ এবং সর্বোপরি সার্বিক চর্চা যে জনপ্রিয় হয়ে উঠবে তার সম্যক ইঙ্গিত পরিলক্ষিত হচ্ছে।
যে-কোনও শিল্পমাধ্যমই পরীক্ষা-নিরীক্ষার নিরন্তর অনুশীলন কাঙ্খিত মনে করে। যে-সাধকের দল অণুগল্পচর্চায় মুগ্ধতা ও মুক্তির আহ্লাদ অনুভব করে, তাদের দায়িত্বও প্রভূত। নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর সৃজনানুশীলন সাহিত্যের এই অনন্য শাখাটিকে আরও আরও সুন্দর ও সমৃদ্ধ করে তুলবে, এমন বিশ্বাস লালন করাই সঙ্গত হবে।
ভাষার বৈচিত্র মানতেই হয়। আমাদের মাতৃভাষা অত্যন্ত সম্পন্ন। এক-একজন সাহিত্যিকের ভাষা ব্যবহারে আলো ও আঁধারের খেলা তথা চলাচল এক-একরকম। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের গদ্য আর সুনীলের গদ্য আলাদা ঘরানার। আল মাহমুদ আর শঙ্খ ঘোষের গদ্যে বিস্তর বৈচিত্র। কারুর গদ্য সহজপাঠ্য, ঝরঝরে; কারুর তীক্ষ্ণ। কারুর গদ্য মায়াবী; কারুর কাব্যিক। কারুর গদ্যে আড়াল, কারুর পেলবতাময়। আমাদের তো এই নিয়ে মাথাব্যথা থাকে না, বরং উপভোগ করি। লেখাটি যেন লেখা হয়ে ওঠে, এইটুকুই তো মাত্র কাঙ্খিত।
ভাষার যে শেড অণুগল্পটিকে সর্বাপেক্ষা উপস্থাপনযোগ্য করে তুলতে পারবে বলে মনে হয়, আমি সেই শেডকে প্রার্থিত জ্ঞান করি। হোক না সে-ভাষা দিনলিপির, অথবা কাব্যিক।
বিষয়ভাবনা বা গল্প কতটা থাকবে অণুগল্পের মধ্যে, আমার কোনও অভিমত নেই। সুধীজনেরা এ-বিষয়ে বিভিন্ন মতের পরিপন্থী বলেই মনে হয়েছে। অণুগল্পের মধ্যে গল্প থাকবে এ তো স্বাভাবিক কথা! তার পাশাপাশি বিষয়হীন বা গল্পহীন অণুগল্প কি হতে পারে না! নির্বিকল্প, নৈর্বক্তিক কোনও ভাবনা কি অণুগল্পের অবয়বে বেমানান!
কবিতা, ছোটোগল্প, উপন্যাস, গান, ছবি, নৃত্য প্রভৃতি শিল্পমাধ্যমগুলির যাবতীয় স্পর্শযোগ্য ও অনুভববেদ্য আলো এবং আঁধারমাত্রই অণুগল্পের অনুসারী হতে পারে বলেই আমার প্রতীতি।
কোনও নির্দিষ্ট শাসনে অণুগল্পের মোড়কবাঁধাইকৃত রূপ আমার অপছন্দের। অণুগল্প বলতে কেবলমাত্র গোলাপ বা পারিজাত ভাবতে চাই না। ‘শতফুল বিকশিত হোক’ আমাদের সাধের অণুগল্পবাগিচায়। পাঠকমহোদয় নিশ্চিতভাবে পরমহংস। তাহারাই ভাবনাতাড়িত হউন, দুধ ও জলের অনুপাত কী হইলে গ্রহণ করিবেন, অথবা বিমুখ…
‘আমাদের পদক্ষেপ’ কথিত সাহিত্যের নতুন বাহন আদৌ নতুন কিনা, এ-বিতর্ক এড়িয়ে মদীয় পক্ষপাতিত্ব এবং সওয়াল বিশুপাগলের অনুসারী। মুক্তির অম্লজান অণুগল্পকে আগামীদিনের জ্যোৎস্না করে তুলুক।
লেখক ও সাহিত্যিকদের নিজেদের মধ্যে অণুগল্প লেখা ও চর্চা করার উদ্যম ও প্রয়াস ইদানীংকালে নতুনভাবে গতিশীল হয়েছে ঠিকই, কিন্তু পাঠক, মানে নির্ভেজাল পাঠের আনন্দ নিতে যারা সাহিত্যের নানা শাখায় পরিব্রাজক, তাদের মধ্যে এখনও সেভাবে আগ্রহ ও উৎকণ্ঠা সঞ্চারিত হয়েছে বলে মনে হয়নি। অণুগল্পের বইয়ের খোঁজ বইপাড়াকে ব্যস্ত করতে পারেনি এখনও। প্রকাশককুলও অণুগল্পের বই প্রকাশে মনোরথ, আগ্রহ, ও উদ্যম প্রদর্শনে আশান্বিত হওয়ার মতো পদক্ষেপ নেননি। এর দায় কিছুটা যেমন প্রকাশকদের, লেখকদের ততধিক। সম্পাদকদের দায়িত্বও সমধিক। যা পেলাম ছেপে দিলাম — এই সহজ অভ্যাস এবং মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় আগ্রহী, সম্ভাবনাময় অণুগল্পকারদের খুঁজে বের করতে হবে, তাদের প্রশ্রয় ও উৎসাহ দিতে হবে। বেশি বেশি করে প্রকাশ করতে হবে সেইসব অণুগল্প, যাতে কেবলমাত্র আগুন নয় আলোও বিদ্যমান। আর আমরা, যারা অণুগল্প লিখছি, ভাবনায় রাখা জরুরি যে, সম্ভাবনাময় এই শিল্পশাখাটিকে কেবলমাত্র পল্লবিত নয়, ফুল্লকুসুমিত করার গুরুভার আমাদেরকেই বহন করতে হবে। বিচক্ষণতার সঙ্গে বিবেচনায় ও চর্চায় রাখতে হবে এর সার্বিক বিকাশ ও প্রসারের বিষয়টি।
আমাদের পাঠাভ্যাসে অণুগল্প একদিন স্বমহিমায় অনিবার্য হয়ে উঠবে — এই সম্ভাবনা ও বিশ্বাসকে সঞ্চারিত ও আলোকিত হতে দেখার স্বপ্নে ও অভিলাষে অণুগল্প নিয়ে মেতে থাকতে চাই।
লিটল ম্যাগাজিন : সাহিত্য চর্চার প্রথম বাহন
সুশোভন রায়চৌধুরী
'বাহন' শব্দটা মনে পড়লেই মনে পড়ে কার্তিকের ময়ূর, দুর্গার সিংহ, সরস্বতীর রাজহাঁস কিংবা গণেশের ইঁদুরের কথা ৷ মনে পড়ে অমর্ত্য সেনের সাইকেল, রাইট ভাইদের তৈরি প্রথম উড়োজাহাজ কিংবা কল্লোলিনী তিলোত্তমার বুকে বয়ে চলা গঙ্গায় ভেসে যাওয়া ফেরি ৷ পুরাণ হোক, মিথ হোক অথবা বিজ্ঞান, মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ব্যাপ্তিতে 'বাহন' বোধহয় আরও বৃহত্তর আকার ধারণ করে রয়েছে ৷ দূরদূরান্ত থেকে যখন প্রিয়জনের বার্তা আসত চিঠির মাধ্যমে, পোস্টম্যান পৌঁছে দিতেন বাড়ি বাড়ি, তিনি বহন করতেন মানুষের আশা-আকাঙ্খা-প্রত্যাশা, মানুষের ভালোবাসাকে ৷ বহন যখন করতেন, তাঁকে বাহক বলা বোধহয় ভুল হবে না ৷ এখন অবশ্য চিঠিপত্তরের যুগ শেষ ৷ আগ্রাসী প্রযুক্তি বদলে দিয়েছে জীবনও ৷ চোখের পলকে একটা ফোন কিংবা ভিডিওকল— ব্যস মুশকিল আসান ৷ তবে যে বিষয়টা আবহমান কাল ধরে এখনও অপরিবর্তিত আছে, তা সম্ভবত সাহিত্য ৷ প্রযুক্তির দৌলতে প্রকাশ বিন্যাসে পরিবর্তন ঘটলেও একজন লিখিয়ের সাহিত্য প্রকাশের প্রথম বাহন যে এখনও লিটল ম্যাগাজিন, তা বোধহয় লিটল ম্যাগাজিন দর্শনের অতি-বিরোধীও নির্দ্বিধায় স্বীকার করবেন ৷
অনেক সুহৃদ লিটল ম্যাগাজিনকে 'লেখক তৈরির আঁতুড়ঘর' বলে সম্বোধন করেন ৷ ব্যাপক অর্থে এই আপ্তবাক্যটাকে মান্যতা দেওয়া গেলেও অনেক সময়ে এই কথাটি নতুন প্রকাশিত পত্রিকার সম্পাদককে দ্বিধাগ্রস্ত করে তুলতে পারে ৷ কেন ? তা একটু খতিয়ে দেখা যাক ৷
লিটল ম্যাগাজিনের কাজই হল প্রতিনিয়ত নতুন লেখক ও লেখকের লেখা সংক্রান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষাকে তুলে ধরা ৷ লিটল ম্যাগাজিন হাঁটে পণ্য সাহিত্য-বিরোধিতার পথে ৷ এখানে পত্রিকার সম্পাদক সবসময়ে তাঁর লেখককে উৎকৃষ্ট সাহিত্য তুলে ধরতে সাহায্য করেন, দেন স্বাধীনতা ৷ একজন লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক কখনই নতুন লেখককে স্থান দেওয়া বা উদ্বুদ্ধ করবার জন্য তাঁর পত্রিকায় প্রকাশিত লেখার গুণগত মানের সাথে আপোষ করেন না ৷ প্রকৃত সম্পাদক তিনিই, যিনি একজন তরুণ লিখিয়েকে ততক্ষণ পর্যন্ত মৌখিক অনুপ্রেরণা জুগিয়ে চলবেন, যতক্ষণ না তার লেখা তাঁর পত্রিকার গুণগত মানে উন্নীত হচ্ছে ৷ সুতরাং সূতিকাগার বা আঁতুড়ঘরের কাজটা একজন সম্পাদক তাঁর ব্যক্তিজীবনে করেন, কখনই তাঁর পত্রিকার পাতায় নয় ৷
কিন্তু যদি বৃহত্তর আকারে দেখা হয়, তাহলে বিষয়টা কী এরকমই হয়ে দাঁড়ায় না যে, বিশ্বের যে কোন ভাষার সাহিত্যে প্রসিদ্ধ সাহিত্যিকেরা তাঁদের তরুণ বয়সে তাঁদের যাবতীয় লেখালেখি প্রকাশের মাধ্যম লিটল ম্যাগাজিনকেই করে তুলেছিলেন ? ব্যক্তিগতভাবে আমি বিশ্বাস করি, একজন লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদকের কৃতিত্ব ঠিক সেখানেই, যেখানে তাঁর সম্পাদনায় আত্মপ্রকাশ করা একজন লিখিয়ে পরবর্তীতে হয়ে ওঠেন সেই ভাষার সাহিত্যের মহীরুহ ৷
যা বহন করে তাকেই যদি আক্ষরিক অর্থে 'বাহন' বলা হয়, তাহলে লিটল ম্যাগাজিন যে সাহিত্য চর্চার বাহন, তা অস্বীকার করবার কোন উপায় নেই ৷ শুধু লিটল ম্যাগাজিন বলেই নয়, লিটলের পূর্বসূরী উনিশ শতকের সাময়িকপত্রের যুগ থেকেই আমরা বলিষ্ঠ ও সামাজিক প্রেক্ষাপটকে আন্দোলিত করতে পারে এরকম সাহিত্যের প্রকাশ এই বাণিজ্যবিমুখ পত্রিকার মধ্যেই দেখেছি ৷ প্রবন্ধ, গদ্য, উপন্যাস, গল্প, নাটক, কবিতা, আখ্যান, ভ্রমণকাহিনি — কোন কিছুই বাদ পড়েনি পত্রিকার পাতায় ৷ সবচেয়ে বড় কথা, পাঠকের মনোরঞ্জনের জন্য নয়, বরং সাহিত্যতত্ত্বের নিরিখে ভাষা ও শৈলীর পরিবর্তন হয়ে উঠেছে প্রতিপাদ্য বিষয় ৷ বিশ্বসাহিত্যের আঙিনায় আভাগার্দ হয়ে রোমান্টিসিজম, রিয়ালিজম, এক্সপ্রেসনিজম, সুররিয়ালিজম, মর্ডানিজম, পোস্ট মর্ডানিজম একের পর এক ধারাপাতে এগিয়ে চলেছে লিটল ম্যাগাজিন ৷ লিটল ম্যাগাজিন ব্যতীত যে বৃহত্তর সাহিত্যের পরিসর রয়েছে, যাকে কেউ কেউ জনপ্রিয় বা পপুলার সাহিত্য বলেন, আবার কেউ বলেন পণ্যসাহিত্যের প্রচারক, তাঁরাও কি সাহিত্যচর্চা করছেন না ? হ্যাঁ করছেন ৷ তবে যে দায়বদ্ধতা, যে সাহসিকতার সঙ্গে একটি লিটল ম্যাগাজিন তার অকুতোভয় সাহিত্য উপস্থাপন করে, সেই সাহসিকতা এবং বাণিজ্যের প্যারামিটারকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে প্রকাশের উদ্যোগ বোধহয় অন্য কোথাও পাওয়া যায় না ৷
তাই সিরিয়াস পাঠক এখনো ঘোরেন লিটল ম্যাগাজিন মেলার প্রাঙ্গনে, কোন এক অজপাড়াগাঁয়ের থেকে প্রকাশিত হলেও মনন, চিন্তন, কল্পনা ও বৌদ্ধিক প্রকাশে বিশ্বমানের সাহিত্য যে একটি সংখ্যায় প্রকাশিত হয়, সেটিকে সংগ্রহের তাগিদেই ৷
কিছু ব্যক্তিগত কথার অবতারণা করি ৷ তখন নবম শ্রেণীর ছাত্র ৷ উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার সদর বারাসাতে বাড়ি হওয়ার সুবাদে এই অঞ্চলে অনুষ্ঠিত কিছু সাহিত্য বৈঠকে যাওয়ার সুযোগ হত ৷ বৈঠক বসত আমাদের নিজেদের বাড়িতেও ৷ বাবা-মায়ের আবৃত্তি কিংবা শ্রুতিনাটক চর্চা যদি ছোট থেকেই সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি আমাকে আকৃষ্ট করে থাকে, তাহলে লেখালেখির ঝোঁক এবং লিটল ম্যাগাজিনের সংস্পর্শে এনেছে এই সাহিত্য বৈঠকই ৷ আঞ্চলিক স্তরের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখা প্রকাশ শুরু হলেও প্রকৃতপক্ষে আমার আত্মপ্রকাশ 'পরিচয়' পত্রিকার মাধ্যমে ৷ তখন সম্পাদক ছিলেন বিশ্ববন্ধু ভট্টাচার্য ৷ এরপর বহু পত্রিকাতেই লিখেছি ৷ তবে যে আত্মসম্মান বা আত্মবিশ্লেষণ আমাকে 'পরিচয়' দপ্তর শিখিয়েছে, তা ভোলবার নয় ৷ এই ব্যক্তিগত স্মৃতির ঝাঁপি খোলবার একমাত্র কারণ শুধু এটুকু বোঝানো— সাহিত্যের বাহন 'পরিচয়' সেদিন আমার মতো একজন তরুণকে যে সাহস যুগিয়েছিলেন তাঁদের প্রসিদ্ধ পত্রিকার গুণগত মানকে অক্ষুণ্ণ রেখে, তা লেখক হিসেবে যেমন আমাকে আদর্শের বার্তা দিয়েছে, তেমনই বার্তা দেয় ফ্র্যাটারনিটি অফ লিটল ম্যাগাজিন-কেও ৷
=======================
'শিক্ষা'_ বাহন নাকি বাহিত
পিয়ালী ভট্টাচার্য
"শিক্ষাকে আমরা বাহন না করিয়া বহন করিয়াই চলিলাম"-----সত্যিই তাই। শিক্ষা একটি চলমান প্রক্রিয়া। প্রথাগত বা পুঁথিগত শিক্ষা ও ব্যবহারিক জীবনে অভিজ্ঞতালব্ধ শিক্ষা--- এই দুইয়ের মেলবন্ধনেই জ্ঞানের উদয় হয়। প্রথাগত শিক্ষার যে প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা লাভ করার পর সারাদিনের খেলাধুলা, ক্লান্তি, বাড়ি ফেরা, হই হুল্লোর ইত্যাদির পর যেটুকু মনে রাখতে পারে সেটি তার সেদিনের প্রাপ্ত প্রকৃত শিক্ষা। আবার প্রথাগত শিক্ষার চৌহদ্দীর বাইরে দণ্ডায়মান ব্যক্তি ও তার জীবনের প্রতি মুহূর্তে জীবন যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় যে শিক্ষায় শিক্ষিত হয় তাই প্রকৃত শিক্ষা। মূলত প্রকৃত শিক্ষা মানুষের মানবিক, সামাজিক, প্রাক্ষোভিক, নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটিয়ে সর্বাঙ্গীণ উন্নতি সাধন করে। তারমধ্যে চেতনার উন্মেষ ঘটায় এবং জ্ঞানের বিকাশ ঘটে।
"Education is the manifestation of perfection already in man"----এই লাইনটির মধ্যেই শিক্ষার সারমর্ম নিহিত। মানুষের অন্তর্নিহিত পরিপূর্ণতার প্রকাশ ঘটে প্রকৃত শিক্ষার মাধ্যমে যখন তার উপর বেষ্টিত সংস্কার গুলির প্রলেপ ধীরে ধীরে সরানো হয়। মেঘের আড়ালে থাকা সূর্য যেভাবে প্রতীয়মান হয় মেঘের স্তর এর ক্রম বিমোচনের মাধ্যমে সেইরূপ শিক্ষাকে সেই কাজে লাগাতে পারলেই শিক্ষা প্রকৃত অর্থে বাহন হয়ে উঠবে। সেই শিক্ষা ই জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত করে আত্ম সাক্ষাৎকার এর পথ প্রশস্ত করবে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় আমরা প্রকৃত শিক্ষার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে 'সেকেলে 'উপাধি আরোপ করে পাশ্চাত্য শিক্ষার অনুকরণে পল্লবগ্রাহী হয়ে উঠতে বেশি আগ্রহী। ঐতিহ্যের প্রতি অবমাননা, নীতি নৈতিকতা মূল্যবোধ এর ধার না ধরে শুধুমাত্র পার্থিব ও বিষয়ের প্রতি আকর্ষিত হয়ে অর্থ ও ক্ষমতার লোভের জন্য অন্ধ হয়ে বর্তমান প্রজন্মকে বিদেশী ভাষা শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষিত করে সমাজের যে বিশাল ইঁদুর দৌড়ে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছি নিজেদের ব্যর্থতাকে পরবর্তী প্রজন্মের হাত ধরে সাফল্যের রূপ দিতে, তাতে শিক্ষা বাহনের কাজ না করে তাদের জন্য বোঝাস্বরূপ হয়ে উঠে বাহিত ই হচ্ছে।
পরিশেষে বলি, যে শিক্ষা অন্তরের অমৃত অনুধাবন করতে ব্যর্থ, সে শিক্ষা যুগ যুগ ধরে বাহিত ই থেকে যাবে।।
=======================
সাহিত্যে বাহন
অমিতাভ মাইতি
'সাহিত্যে বাহন' — দুটো শব্দ কিন্তু এর পরিধি বিশাল। 'সাহিত্য' কথাটার অর্থ এবং এর সঙ্গে সকলেরই পরিচয় আছে। কিন্তু 'বাহন' বলতে সেই ছেলেবেলা থেকে আমরা বিভিন্ন দেবদেবীর বাহনকে জেনে এসেছি। 'বাহন' শব্দের অর্থ কি? এক কথায় যাতে চড়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়া যায় অর্থাৎ মাধ্যম।
দেবদেবীর বাহন অর্থে দেবদেবীকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বহন করে নিয়ে আসা নয়। যেমন, ধরা যাক ভগবান গণেশের বাহন ইঁদুর বা মূষিক। সংস্কৃত শব্দ মুষ থেকে মূষিক শব্দের উৎপত্তি। মুষ শব্দের অর্থ লুঠ বা চুরি করা। আবার সাঙ্কেতিক ভাবে মানুষের মস্তিষ্ক মূষিক সমান। মূষিক যেমন বুদ্ধি বলে চুরি করে মানব মস্তিষ্কও তেমন বুদ্ধি বলে কার্য সম্পূর্ণ করে। ইঁদুর বা মূষিকের উপর দেবতা গণেশ বিরাজ করার অর্থ স্বার্থকে পরাস্ত করে জনকল্যাণই তাঁর লক্ষ্য। এইভাবেই অন্যান্য দেবদবীদের বাহন নির্বাচন হয়েছে।
আবার কিছু পৌরাণিক মতে দেবদেবীদের বাহন হিসাবে বিভিন্ন জীবজন্তুদের নির্বাচনের কারণ বিজ্ঞানের ইকোসিস্টেম অর্থাৎ পৃথিবীর ভারসাম্য বজায় রাখা।
আমাদের আলোচনার মূল বিষয়বস্তু হ'ল 'সাহিত্যে বাহন'। আগেই বলেছি 'বাহন' কথাটা ক্ষেত্র বিশেষে ব্যবহার করা হয়। বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে 'বাহন' হল পরম্পরা বা মাধ্যম অর্থাৎ সৃষ্টির আদি থেকে কিভাবে পরম্পরা বাহনের দ্বারা পরিচালিত হয়ে প্রাচীন সাহিত্য থেকে আধুনিক সাহিত্যে এল। সৃষ্টির আদি থেকে আজ পর্যন্ত সৃষ্ট সাহিত্যকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। যথা --
১) আদি বা প্রাচীন সাহিত্য (৬৫০ থেকে ১২০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত),
২) মধ্যবর্তী অর্থাৎ মধ্যযুগীয় সাহিত্য (১২০১ থেকে ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত) এবং
৩) আধুনিক যুগ বা আধুনিক সাহিত্য (১৮০১ থেকে বর্তমান বা এখনো চলছে)।
বাংলা সাহিত্যের ভ্রুণ থেকে আজ পর্যন্ত বিস্তারিত ব্যাখ্যা করতে গেলে, বাংলা 'সাহিত্যে বাহন' এই শিরোনামে একটা পুস্তক রচনা হয়ে যাবে। তাই 'সাহিত্যে বাহন' এই বিষয় বস্তুর উপর সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করব।
সৃষ্টির আদিতে সাহিত্য বলে তেমন কিছু ছিল না। আনুমানিক খ্রীষ্টিয় সপ্তম শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনার সূত্রপাত হয়। যদিও খ্রীষ্টিয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে রচিত বৌদ্ধ দোহা-সংকলন চর্যাপদ বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন। আবিষ্কারক হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আরো তিনটি গ্রন্থের সঙ্গে চর্যাগানগুলো নিয়ে সম্পাদিত গ্রন্থের নাম দেন 'হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় রচিত বৌদ্ধ গান ও দোহা'।
চর্যাপদকে বাংলা সাহিত্যের সূচনা যদি বলা হয়, তাহলে বাংলা সাহিত্যের প্রথম বাহন'রা হলেন শ্রদ্ধেয় লুইপাদ, কাহ্নপাদ, ভুসুকপাদ, শবরপাদ প্রমুখ এবং বাংলা সাহিত্যের শুরু খ্রিষ্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়। এ প্রসঙ্গে জেনে রাখা ভাল যে, আবিষ্কারক হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯০৭ সালে নেপালের রাজপরিবারের গ্রন্থশালা থেকে বৌদ্ধ চর্যার একটা খণ্ডিত পুঁথি উদ্ধার করেছিলেন। আবার পরবর্তীতে ভাষাতাত্ত্বিক আচার্য সুনীতিকমার চট্টোপাধ্যায় চর্যাপদই যে বাংলা ভাষার ভ্রুণ তা বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক যুক্তির সাহায্যে প্রমাণ করেছিলেন। আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগ সপ্তম শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে শুরু বললেও মূলত দশম শতাব্দীর মাঝামাঝি (৯৫০ খ্রীঃ) থেকে দ্বাদশ শতাব্দী (১২০০ খ্রীঃ) পযর্ন্ত অর্থাৎ প্রায় ২৫০ বছর।
চর্যাপদ : বাংলা সাহিত্যের প্রথম নিদর্শন, চিত্র-সৌজন্য — গুগল
বাংলা সাহিত্যের মধ্য যুগ বলতে গৌড়ে তুর্কি আক্রমণের সময় থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত সময়কে বোঝানো হয়। যদিও আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে গৌড়ে তুর্কি আক্রমণের ফলে প্রায় দেড়শ বছর (১২০১ খ্রীঃ থেকে ১৩৫০ খ্রীঃ পর্যন্ত) সেই সময়কার কবিরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। ফলে এই দীর্ঘ দেড়শ বছর তাঁরা কোন সাহিত্য রচনা করেন নি। তাই এই সময়কালকে সাহিত্যের অন্ধকার যুগ বলা হয়। যদিও গবেষণায় জানা যায় যে, এই অন্ধকার সময়ে রামাই পন্ডিত 'শূন্যপুরাণ' এবং হলায়ুধ মিশ্র 'সেক শুভোদয়া' রচনা করেছিলেন। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের বাহনরা হলেন বড়ু চণ্ডীদাস (শ্রীকৃষ্ণকীর্তন রচনা করেছিলেন), কবি বিদ্যাপতি, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস, বলরামদাস প্রমুখ বৈষ্ণব পদাবলির রচয়িতারা। কবি জয়দেব সংস্কৃত ভাষায় বৈষ্ণব পদাবলি রচনা করেছিলেন। এছাড়া 'পদসমুদ' গ্রন্থে বৈষ্ণব পদাবলি সংকলিত করেছিলেন বাবা আউয়াল মনোহর দাস। মঙ্গলকাব্য বিশেষ ধরনের ধর্মবিষয়ক আখ্যান কাব্য। মঙ্গলকাব্যের মূলত উপজীব্য দেব-দেবীর গুণগান। মঙ্গলকাব্যের উল্লেখযোগ্য বাহনরা হলেন কানাহরি দত্ত, নারায়ন দেব, বিজয় গুপ্ত, বিপ্রদাস পিপলাই, মাধব আচার্য, মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, ঘনরাম চক্রবর্তী, শ্রীশ্যাম পণ্ডিত, ভরতচন্দ্র রায় গুণাকর, দ্বিজ মাধব, ময়ূর ভট্ট, দ্বিজ বংশীদাস প্রমুখ। আবার চণ্ডীমঙ্গলের আদি বাহন বা কবি হলেন মানিক দত্ত। ষোড়শ থেকে আঠার শতক চণ্ডীমঙ্গল কাব্য বিস্তৃত ছিল। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি 'কবিকঙ্কন' উপাধিতে ভূষিত কবি মুকন্দরাম চক্রবর্তী। এরপর অন্নদামঙ্গলের বাহন 'রায়গুণাকর' উপাধিতে ভূষিত কবি ভরতচন্দ্র।
অন্নদামঙ্গল
চণ্ডীমঙ্গল
মধ্যযুগীয় সাহিত্যে বাউল একটা অন্যতম মাধ্যম বলা যায়। বাউল একটা বিশেষ লোকাচার ও ধর্মমত। বাউল শব্দটার উৎপত্তি নিয়ে মতান্তর থাকলেও অতিপ্রাচীনকাল থেকেই এর প্রচলন। আনুমানিক সপ্তদশ শতক থেকে বাউল নামের ব্যবহার ছিল বলে জানা যায়। চৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থে আদিলীলা অংশে এর ব্যবহার লক্ষ করা যায়। বাউলের আবার নানান শাখাপ্রশাখা রয়েছে, একেক সম্প্রদায়ের মতানুসারে এই ভাগ সৃষ্টি হয়েছে। মূলত গৃহী ও সন্ন্যাসী এই দুপ্রকার ভাগ দেখা যায়। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল বাউল উদার অসাম্প্রদায়িক মানবতার প্রতীক। সাধারণত বৈষ্ণবধর্ম ও সুফীবাদের প্রভাব বাউল দর্শনে দেখা যায়। বাউলের মুল প্রতিপাদ্য হল আত্মা। তাঁদের মতে আত্মাকে জানলেই পরমাত্মা বা সৃষ্টিকর্তাকে উপলব্ধি করা যায়। আত্মা দেহে বাস করে তাই তাঁরা দেহকে পবিত্র জ্ঞান করেন।
"বাড়ির কাছে আরশিনগর
সেথা এক পড়শি বসত করে..."
লালন ফকির এই গানের মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছেন যে আরশিনগর হল মানুষের মন, পড়শি হলেন সেই মনের ভেতর বাস করা ঈশ্বর বা পরমাত্মা অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা।
বাউল সাহিত্যে বাহনরা হলেন জালাল খাঁ, রশিদউদ্দিন, হাছন রাজা, রাধারমণ, সিরাজ সাঁই, পাঞ্জু সাঁই, পাগলা কানাই, দ্বিজদাস, মকুন্দ দাস, শাহ আব্দুল, ভবা পাগলা এবং অবশ্যই বাউল সম্রাট শিরোমণি ফকির লালন সাঁই ওরফে লালন ফকির।
মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্য মূলত কাব্যপ্রধান। সেই সময়কার হিন্দুধর্ম, ইসলাম ধর্ম ও বাংলার লৌকিক ধর্ম বিশ্বাসগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল এই কাব্যকেন্দ্রিক মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্য। মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব পদাবলি, শাক্তপদাবলি, বৈষ্ণব সন্তজীবনী, রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবতের বঙ্গানুবাদ, পীরসাহিত্য, নাথসাহিত্য, বাউল পদাবলি এবং ইসলামিক ধর্মসাহিত্য এই মধ্যযুগীয় সাহিত্যের মধ্যে পড়ে।
প্রসঙ্গক্রমে জানিয়ে রাখি বাংলা সাহিত্য প্রাচীন যুগ থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত মূলত পদ্য বা গীতিকাব্য ছিল। প্রথম বাংলা সাহিত্যে গদ্যের প্রচলন হয় আধুনিক যুগের শুরুতে।
বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার সূত্রপাত হয় খ্রীষ্টিয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে। তবে ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীকে বাংলা সাহিত্যের নবজাগরণের যুগ বলা হয়। এই যুগ মূলত রাজা রামমোহন রায় থেকে শুরু এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছয় বিশ্ববন্দিত নোবেল লরিয়েট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (৭ই মে,১৮৬১ - ৭ই আগস্ট, ১৯৪১) সময় পর্যন্ত। যদিও তাঁর পরবর্তীকালে বাংলা সাহিত্যের উৎকর্ষ বৃদ্ধিতে বহু সাহিত্যিকের সৃজনশীলতা ও শিক্ষা বাংলা সাহিত্যের বাহন হিসাবে ভিন্ন ভিন্ন ধারার জোয়ার এনেছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার সমাজ সংস্কার, ধর্মীয় দর্শনচিন্তা, সাহিত্য, সাংবাদিকতা, দেশপ্রেম ও বিজ্ঞানের এক অনন্য সাধারণ পথিকৃৎদের সমাবেশ ঘটেছিল এই বাংলায়। বাংলা সাহিত্যে আধুনিক যুগে প্রথম গদ্যের প্রচলন দেখা যায়। বাংলা সাহিত্যে আধুনিক যুগের প্রথম ও প্রধান বাহনরা হলেন ভারত পথিক রাজা রামমোহন রায় (২২শে মে, ১৭৭২ -- ২৭ সেপ্টেম্বর,১৮৩৩), প্যারীচাঁদ মিত্র (ছদ্মনাম টেকচাঁদ ঠাকুর) (২২শে জুলাই, ১৮১৪ -- ২৩শে নভেম্বর, ১৮৮৩), ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (২৬শে সেপ্টেম্বর, ১৮২০ -- ২৯শে জুলাই, ১৮৯১) এবং সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়(২৭শে জুন, ১৮৩৮ -- ৮ই এপ্রিল, ১৮৯৪)। রাজা রামমোহন রায়ের প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ফারসি ভাষায় লেখা (ভূমিকা লেখা হয় আরবিতে) তুহফাতুল মুহাহহিদিন। এই বইটাতে একেশ্বরবাদের সমর্থন পাওয়া যায়। এরপর রাজা রামমোহন ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৮১৫ থেকে ১৮১৯ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে বেদান্ত-সূত্র ও তার সমর্থিত উপনিষদগুলোর বাংলা অনুবাদ করেন— বেদান্তগ্রন্থ, বেদান্তসার, কেনোপনিষদ, ঈশোপনিষদ, কঠোপনিষদ ইত্যাদি। প্যারীচাঁদ মিত্র বাংলা সাহিত্যের নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃত ছিলেন। ১৮৫৭ সালে তাঁর ছদ্মনামে লেখা (টেকচাঁদ ঠাকুর) উপন্যাস "আলালের ঘরের দুলাল" বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস। এই উপন্যাসটা পরবর্তীতে ইংরেজিতে "The spoiled child" নামে অনুবাদ হয়েছিল। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা সাহিত্যের নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ। তিনি বর্ণপরিচয় রচনা করে প্রথম বাংলা বর্ণমালার সঙ্গে মানুষের পরিচয় ঘটিয়েছিলেন। এছাড়া কথামালা, বোধোদয়, আখ্যানমঞ্জরী, ব্যাকরণ কৌমুদী, বেতাল পঞ্চবিংশতি, শকুন্তলা ইত্যাদি রচনা করেছিলেন।
সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে আধুনিক বাংলার প্রথম পরিপূর্ণ বাংলা ঔপন্যাসিক বলা হয়। তবে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূলমন্ত্র 'বন্দেমাতরম' তাঁরই সৃষ্টি। বঙ্কিমচন্দ্রের সৃষ্ট কিছু বিখ্যাত উপন্যাস হল -- দুর্গেশনন্দিনী, কপালকুণ্ডলা, বিষবৃক্ষ, ইন্দিরা, কৃষ্ণকান্তের উইল, আনন্দমঠ, দেবী চৌধুরানী ইত্যাদি।
বঙ্কিমচন্দ্র পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে বেশি আলোড়ন সৃষ্টিকারী সাহিত্যের বাহন হলেন বিশ্ববরেণ্য বিশ্বকবি নোবেল লরিয়েট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন আধুনিক সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি, ঔপন্যাসিক, সঙ্গীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোট ও বড় গল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কন্ঠশিল্পী ও দার্শনিক। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের বাহন হিসাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেই সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক হিসাবে গণ্য করা হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যে অবদান লিখতে গেলে একটা রামায়ণ বা মহাভারত লেখা হয়ে যাবে।
আধুনিক বাংলা সাহিত্য এখনো বহমান তার নিজের ছন্দে, চিত্র-সৌজন্য — গুগল
রবীন্দ্র-সমসাময়িক ও পরবর্তী বাংলা সাহিত্য যাঁদের সৃজনী দ্বারা পরিপূর্ণতা লাভ করেছিল তাঁরা হলেন কাজী নজরুল ইসলাম, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, জীবনানন্দ দাশ, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, নীরন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, নারায়ন সান্যাল, শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং রবীন্দ্র পরবর্তী সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ।
তথ্য সূত্র :
১) বাংলা সাহিত্য পরিচয়, ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায়,
২) বাঙলা সাহিত্যের জীবনী, হুমায়ুন আজাদ,
৩) বাংলা সাহিত্যের সমগ্র ইতিহাস, ক্ষেত্র গুপ্ত,
৪) বিদ্যায় সাহিত্যে শিল্পে বঙ্গভূমি, ড. সুকমার সেন,
৫) বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, ড. অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়,
৬) "মহাত্মা লালন ফকির" -- বসন্ত কুমার পাল,
৭) "বাংলার বাউল ও বাউল গান" -- উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য,
৮) "Biography-Historical Development" -- Kendall, Paul Murray,
৯) The origin and development of the Bengali language, Dr. Suniti Kumar Chatterjee.
১০) Google wikipedia.
শিক্ষা ও চিন্তার স্বাভাবিক বাহন : আমাদের ভাষা
অনুপ দত্ত
সাহিত্য বলতে কী বুঝি?
সাহিত্য (Literature)-কে বলা হয় মানব ও সমাজ জীবনের দর্পণ বা প্রতিচ্ছবি। মানবজীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে সাহিত্যের বিকাশ ঘটে। সাহিত্যে মানব মনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা এবং মানবজীবনের শাশ্বত ও চিরন্তন অনুভূতি প্রতিফলিত হয়।
'সাহিত্য' শব্দটি বাংলা 'সহিত' শব্দ থেকে সৃষ্ট। 'সহিত' শব্দমূলের সঙ্গে 'য' প্রত্যয় যুক্ত হয়ে 'সাহিত্য' শব্দটি গঠিত হয়েছে। 'সহিত'-এর অর্থ-সংযুক্ত, সমন্বিত, সঙ্গে, মিলন, যোগ, সংযোগ, সাথে বা সম্মিলন। 'সাহিত্য' শব্দের আভিধানিক অর্থ-সহিতের ভাব, মিলন বা যোগ; অথবা-জ্ঞানগর্ভ বা শিক্ষামূলক গ্রন্থ; আবার-কাব্য-উপন্যাসাদি রসাত্মক বা রম্য রচনা, যাতে এক হৃদয়ের সঙ্গে অপর হৃদয়ের মিলন ঘটে।
প্রাচ্যের সাহিত্য সমালোচক শ্রীশচন্দ্র দাস তাঁর 'সাহিত্য সন্দর্শন' গ্রন্থের ১৭নং পৃষ্ঠায় সাহিত্যের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বলেছেন- ''নিজের কথা, পরের কথা বা বাহ্য-জগতের কথা সাহিত্যিকের মনোবীণায় যে সুরে ঝংকৃত হয়, তাহার শিল্পসংগত প্রকাশই সাহিত্য।''
সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) বলেছেন-''অন্তরের জিনিসকে বাহিরের, ভাবের জিনিসকে ভাষার, নিজের জিনিসকে বিশ্বমানবের ও ক্ষণকালের জিনিসকে চিরকালের করিয়া তোলাই সাহিত্যের কাজ।''
শিক্ষা ও চিন্তার স্বাভাবিক বাহন :
লেখক ভাষার মায়াজাল বিস্তারের মাধ্যমে সহৃদয় হৃদয়সংবেদী পাঠকের সঙ্গে লেখক বা সাহিত্যে বর্ণিত নর-নারীর সুখ-দুঃখময় জীবনের মিলন ঘটিয়ে থাকেন বলে 'সাহিত্যে'র অনুরূপ নামকরণ হয়েছে।
আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি চিন্তাশক্তিকে সর্বদা উদ্ঘাটন করেছে৷ আমাদের এই মননকে মানুষ করা কোনোমতেই ভিনদেশী ভাষায় সম্ভবপর নয়। বিদেশী ভাষায় হয়তো আমরা লাভ করবো কিন্তু সে লাভ আমাদের ভাষাকে পূর্ণ করবে না৷ আমরা চিন্তা করবো কিন্তু সে চিন্তার বাইরে আমাদের ভাষা পড়ে থাকবে৷ আমাদের মন বেড়ে চলবে, কিন্তু তার সঙ্গে আমাদের ভাষা অগ্রসর হবে না, সমস্ত শিক্ষাকে অকৃতার্থ করবার এমন উপায় আর কী হতে পারে।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমরা সেই ডিগ্রীর ছাপ নেওয়াটাই বিদ্যালাভ বলে মেনে চলি বা এসেছি৷ এটা আমাদের অভ্যাস হয়ে গেছে। আমরা বিদ্যা পাই বা না পাই, বিদ্যালয়ের একটা ছাঁচ পেয়ে গেছি । আমাদের মুশকিল এই যে, আমরা চিরদিন ছাঁচের উপাসক। ছাঁচে ঢালাই-করা রীতিনীতি চালচলনকেই নানা আকারে পূজার অর্ঘ্য দিয়ে এই ছাঁচ-দেবীর প্রতি অচলা ভক্তি আমাদের মজ্জাগত। সেইজন্য ছাঁচে-ঢালা বিদ্যাটাকে আমরা দেবীর বর দান বলে মাথায় করে নিই — এটার চেয়ে বড়ো কিছু আছে বলে কোনও কথা মনে করাও আমাদের পক্ষে শক্ত।
তার ফল হয়েছে উচ্চ-অঙ্গের শিক্ষা যদি-বা আমরা পাই, উচ্চ-অঙ্গের চিন্তা আমরা করি না। কারণ চিন্তার স্বাভাবিক বাহন আমাদের ভাষা। বিদ্যালয়ের বাইরে এসে পোশাকি ভাষাটা আমরা ছেড়ে ফেলি, সেই সঙ্গে তার পকেটে যা - কিছু সঞ্চয় থাকে তা আলনায় ঝোলানো থাকে, তারপরে আমাদের চিরদিনের আটপৌরে ভাষায় আমরা গল্প করি, গুজব করি, রাজাউজির মারি, তর্জমা করি, চুরি করি এবং খবরের কাগজে অশ্রাব্য কাপুরুষতার বিস্তার করে থাকি। এ সত্ত্বেও আমাদের দেশে বাংলায় সাহিত্যের উন্নতি হচ্ছে না এমন কথা বলি না, কিন্তু এ সাহিত্যে উপবাসের লক্ষণ যথেষ্ট দেখতে পাই। যেমন, এমন রোগী দেখা যায়, যে খায় প্রচুর, অথচ তার হাড় বের হয়ে পড়েছে, তেমনি দেখি আমরা যতটা শিক্ষা অর্জন করি তার সমস্তটা আমাদের সাহিত্যের সর্বাঙ্গে সঞ্চার করি না। খাদ্যের সঙ্গে আমাদের প্রাণের সম্পূর্ণ যোগ হয় না। তার প্রধান কারণ আমরা নিজের ভাষার রসনা দিয়ে সেবন করি না, আমাদেরকে ছলে বলে খাওয়ানো হয়, তাতে আমাদের পেট ভর্তি করে, কিন্তু দেহপূর্তি করে না।
সকলেই জানেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ইউ.কে-র বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাঁচে তৈরি। সেই ধরনের বিদ্যালয় থেকে পরীক্ষায় পাস করা ডিগ্রীধারীদের নামের উপর মার্কা মারার একটা বড়ো গোছের সিলমোহর। মানুষকে তৈরি করা নয়, মানুষকে চিহ্নিত করা তার কাজ। মানুষকে হাটের বিপণী করে তার বাজার-দর চিৎকার করা ব্যবসার সহায়তা সে করেছে।
তাই বলি, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের যদি একটা বাংলা অঙ্গের সৃষ্টি হয়, তার প্রতি বাঙালি অভিভাবকদের প্রসন্ন দৃষ্টি পড়বে কি না সন্দেহ। তবে কি না, ইংরেজি চালুনির ফাঁক দিয়া যারা গলে গলে পড়ছে এমন ছেলে এখানে পাওয়া যাবে। কিন্তু আমার মনে হয় তার চেয়ে একটা বড়ো সুবিধার কথা আছে।এমনি করে যা সজীব তা ক্রমে কলকে আচ্ছন্ন করে নিজের স্বাভাবিক সফলতাকে প্রমাণ করে তুলবে। আমাদের অনেককেই ব্যবসার খাতিরে জীবিকার দায়ে ডিগ্রী নিতে হয় — কিন্তু সে পথ যাদের অগত্যা বন্ধ কিংবা যারা শিক্ষার জন্যই শিখতে চাইবে তারাই এই বাংলা বিভাগে আকৃষ্ট হবে। শুধু তাই নয় যারা দায়ে পড়ে ডিগ্রী নিচ্ছে তারাও অবকাশ মতো বাংলা ভাষার টানে এই বিভাগে আনাগোনা করতে ছাড়বে না। কারণ, দুদিন না যেতেই দেখা যাবে এই বিভাগেই আমাদের দেশের অধ্যাপকদের প্রতিভার বিকাশ হবে। এখন যারা কেবল ইংরেজি শব্দের প্রতিশব্দ ও নোটের ধুলো উড়িয়ে আঁধি লাগিয়ে দেন তাঁরাই সেদিন ধারাবর্ষণে বাংলার তৃষিত চিত্ত জুড়িয়ে দেবেন।
আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চা : জাতি গঠনের বাহন
অরিন্দম রায়
"বহু দিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি' বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা
দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু ৷
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া,
একটি ধানের শিষের উপর
একটি শিশির বিন্দু ৷
(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
স্কুল-কলেজের বিভিন্ন শ্রেণীপাঠ্যে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক ইতিহাসের প্রাধান্য থাকলেও আঞ্চলিক ইতিহাসের অন্তর্ভুক্তি নেই বললেই চলে ৷ যদিও নিচু শ্রেণী থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ স্তরগুলিতে সেই বহমান ছবির যৎসামান্যই বদল ঘটেছে বিগত কয়েক বছর ধরে ৷
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নম্বর প্রাপ্তির হাত ধরে নিছক কেরিয়ার তৈরিকে পাখির চোখ করে পড়তে আসা বহমান সংস্কৃতির লাল ফিতের ফাঁসে আটকে আছে আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চার জয়যাত্রা ৷ যদিও এই অচলায়তনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে অনেক ব্যক্তি বা যৌথ প্রতিষ্ঠানের আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চার উদ্যোগ চোখে পড়ছে বাংলার বিভিন্ন জেলা থেকে একেবারে তৃণমূল স্তরের মহল্লায় মহল্লায় ৷ এই শেকড়ের সন্ধানে পরীক্ষার খাতায় নম্বর বা জীবনে চাকরি প্রাপ্তি না ঘটলেও এক সুন্দর সৃজনশীল ও মননশীল নাগরিক চরিত্র গঠনে দেশ বা জাতি যে লাভবান হবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই ৷
সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একদা বলেছিলেন, আমরাই আমাদের ইতিহাস লিখব ৷ কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, সুমহান ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অধিকারী আমাদের এই দেশে নিরপেক্ষ ইতিহাসচর্চার সূচনা বহু পরে ৷ অনেকে কলহনের লেখা 'রাজতরঙ্গিনী'-কে প্রথম যথার্থ আঞ্চলিক ইতিহাস বলেন ৷ এখানে কাশ্মীরের এক বৃহৎ সময়পর্বের ইতিকথা বর্ণিত হয়েছিল ৷ ভারতে ইংরেজরা আসার পর তারাই কতকটা নিজেদের স্বার্থেই এদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অনুসন্ধান শুরু করে ৷ গড়ে ওঠে এশিয়াটিক সোসাইটির মতো সংস্থা (১৭৮৪), প্রকাশিত হতে থাকে 'এশিয়াটিক রিসার্চেস' নামক পত্রিকা ৷
বাঙালি জাতি আত্মবিস্মৃতিপরায়ণ ইতিহাস-বিমুখ হিসেবে বহুকাল ধরেই এক কুখ্যাতি অর্জন করেছে ৷ কিন্তু সেই সাংস্কৃতিক বদলের চিত্র যখন সামান্য হলেও চোখে পড়ে, তখন এই নেতিবাচক ইতিহাস বদলের সম্ভাবনাও জেগে ওঠে নিশ্চিতভাবেই ৷ যে সদর্থক ছবিগুলো চোখে পড়ছে তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য নিজেদের গ্রাম ও নিজ পরিবারের ইতিহাস খোঁজার প্রয়াস ৷ সেই সঙ্গে নিজের প্রাথমিক বা উচ্চ বিদ্যালয়গুলির অতীত অন্বেষণের উদ্যোগ যথেষ্টই ইতিবাচক প্রবণতা, তাতে কোন সন্দেহ নেই ৷ এই মাটি ও শেকড়ের অনুসন্ধান প্রতিটি নাগরিকের মনকে ঐক্য, সংহতি ও জাতীয়তাবাদী ভাবনায় ভাবিত করবে এটাই স্বাভাবিক ৷ নিজের পিতা-মাতা, পরিবার থেকে বিদ্যালয়, সেখান গ্রাম, মহকুমা ও জেলার আঞ্চলিক ইতিহাস অনুরাগ যে ক্রমে রাজ্য ও দেশের জাতীয় ঐক্য সুদৃঢ় করবে, এটাও নিশ্চিত সত্য ৷
একেবারে তৃণমূল স্তর থেকে ইতিহাস চেতনা মননে ও মজ্জায় প্রবেশের ফলে দেশাত্মবোধ, এক জাতি এক প্রাণ ভাবনাকে ক্রমশই শক্তিশালী করবে ৷ প্রতিটি ব্যক্তি তাঁর এলাকার বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব, ঐতিহাসিক স্থাপত্য- পুরাসম্পদ, ঐতিহাসিক সামগ্রী সম্পর্কে আগ্রহী হলে এলাকার ভবিষ্যৎ উন্নয়নের রূপরেখাও তৈরি করা সম্ভব হবে ৷ এভাবেই এক অখণ্ড জাতি ক্রমান্বয়ে আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চার পথ ধরে শক্তিশালী হয়ে উঠবে ৷
অনুশীলন সমিতি : ভারতীয় বিপ্লববাদী আন্দোলনের অন্যতম বাহন
নির্মলেন্দু কুণ্ডু
"চিত্ত
যেথা ভয়শূন্য,উচ্চ যেথা শির
জ্ঞান যেথা
মুক্ত,যেথা গৃহের প্রাচীর৷
আপন
প্রাঙ্গনতলে দিবস-শর্বরী
বসুধারে রাখে
নাই খণ্ড-ক্ষুদ্র করি"
কবিগুরুর এই
অমোঘ উচ্চারণ বড় স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়েছিল এই বঙ্গদেশে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে
কেন্দ্র করে৷ ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এর দুটি
সমান্তরাল পর্বের কথা জানা যায়—একদিকে ছিল কংগ্রেস নিয়ন্ত্রিত নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন ও অন্যদিকে
বহিঃ-কংগ্রেসীয় সশস্ত্র ও সহিংস আন্দোলন৷ আমরা যদি কংগ্রেসী রাজনীতির ইতিহাসও দেখি, সেখানেও এক দ্বৈত সত্তার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়৷ ১৮৮৫ সালে কংগ্রেসের উদ্ভব
থেকে শুরু করে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গকালীন সময়ের মধ্যে কংগ্রেস নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে
তথা আবেদন-নিবেদন নীতিতে বিশ্বাসী ছিল৷ তবে এই নীতির ব্যর্থতা কংগ্রেসের মধ্যেই এক
বিরোধী গোষ্ঠীর সৃষ্টি করে, যারা নীতি-পরিবর্তনের পক্ষপাতী ছিলেন৷ তাঁরা বুঝেছিলেন,দুর্বৃত্ত ইংরেজদের কাছে ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য আবেদন-নিবেদন অরণ্যে নিস্ফল
রোদন ছাড়া আর কিছু নয়৷ বরং তাঁরা ইংরেজদের সমুচিত শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন৷ তাঁরা
চেয়েছিলেন,হিংসার মধ্য
দিয়ে ইংরেজদের হিংসার জবাব দিতে৷ আর তাই জন্ম নিল সহিংস চরমপন্থা৷ সলতে পাকানোর
কাজ শুরু হয় বাল গঙ্গাধর তিলক কর্তৃক New Party বা অজিত সিং কর্তৃক "ভারতমাতা সভা" গঠনের মধ্য দিয়ে৷ বঙ্গদেশেও
বরিশালের "স্বদেশ বান্ধব", ফরিদপুরের "ব্রতী",
মৈমনসিংহের
"সুহৃদ" ও "সাধনা" নামক সমিতি গড়ে ওঠে৷
যদিও বাংলায়
বৈপ্লবিক কার্যকলাপের প্রস্তুতি কোন অভিনব ঘটনা ছিলনা৷ ১৮৬০ ও ১৮৭০-র দশক থেকেই
আখড়া বা ব্যায়াম চর্চার কেন্দ্রগুলিতে শরীর গঠনের পাশাপাশি রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনাও
চলত৷ এইসব আখড়াই ছিল পরবর্তীকালের গুপ্ত সমিতির বীজ৷ ব্যায়াম ও শরীরচর্চার মাধ্যমে
বাংলার যুব সমাজকে বৈপ্লবিক কার্যকলাপের জন্য প্রস্তুত রাখার চেষ্টা শুরু হয়েছিল
নবগোপাল মিত্র প্রতিষ্ঠিত "হিন্দুমেলা"-য়৷ এই উদ্দেশ্যে তিনি শংকর ঘোষ
লেনে একটি আখড়া খোলেন৷ আবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "জীবনস্মৃতি" গ্রন্থে
দেখতে পাই কিভাবে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রাজনারায়ণ বসুর নেতৃত্বে ও ঠাকুরবাড়ির
পৃষ্ঠপোষকতায় স্বদেশপ্রেম ও স্বদেশীর মহড়া হত৷ শরীরচর্চার পাশাপাশি বঙ্কিমচন্দ্র ও
বিবেকানন্দর ভাবধারায় উদ্দীপিত হয়ে বাঙালি যুব সম্প্রদায় এ' সময় নৈতিক ও ধর্মশিক্ষার দিকেও নজর দিয়েছিল৷ ১৮৭৪ খ্রীস্টাব্দে যোগেন্দ্রনাথ
বিদ্যাভূষণ সম্পাদিত "আর্যদর্শন" নামক বাংলা মাসিক পত্রে প্রকাশিত
রচনাসমূহ তাদের অনুপ্রাণিত করে৷ বিপ্লবী চিন্তায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটি
সুশৃঙ্খল বিপ্লবী গুপ্ত সমিতি স্থাপনের প্রয়াসও লক্ষ্য করা যায়৷ বহির্ভারতের কিছু
ঘটনা,যেমন জাপানের চমকপ্রদ অভ্যুত্থান ও ভগিনী নিবেদিতার মতাদর্শও তাঁদের
অনুপ্রাণিত করে৷
অনেকের মতে, প্রথম গুপ্ত সমিতি স্থাপিত হয় মেদিনীপুরে৷ হেমচন্দ্র কানুনগো ও সত্যেন্দ্রনাথ
বসুর সহায়তায় জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসুর নেতৃত্বে এটি গড়ে ওঠে৷ যদিও আরেকটি বহুজনগ্রাহ্য
মত হল, বাংলাদেশের প্রথম গুপ্ত সমিতির সূতিকাগার ছিল ১০৮/এ বা ১০৮/বি আপার সার্কুলার
রোড৷ ১৯০১-০২ সালে বরোদা থেকে অরবিন্দ ঘোষ-প্রেরিত যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
ছিলেন এর গঠনকর্তা৷ মোট পাঁচজন সদস্য নিয়ে এর কার্যনির্বাহী সমিতি গঠিত হয়৷
ব্যারিস্টার প্রমথনাথ মিত্র ছিলেন এর সভাপতি, সহকারী সভাপতি ছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ ও অরবিন্দ ঘোষ এবং কোষাধ্যক্ষ ছিলেন
সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর৷ পঞ্চম সভ্য ছিলেন ভগিনী নিবেদিতা, যদিও এঁর অন্তর্ভুক্তি নিয়ে সন্দেহ আছে৷ এই সমিতির কাজকর্মে ইটালির কার্বোনারি
ও রাশিয়ার গুপ্ত সমিতিগুলির প্রভাব ছিল৷ আবার গীতার সংগ্রাম দর্শনও এতে
পরিষ্কারভাবে লক্ষণীয় ছিল৷ কিছুদিন পর আপার সার্কুলার রোডের এই আখড়া ভেঙে গ্রে
স্ট্রিটে সমিতির প্রধান ব্যায়ামাগার স্থাপিত হয়৷ সতীশচন্দ্র বসু কর্তৃক মদন মিত্র
লেনে প্রতিষ্ঠিত একটি ছোট্ট লাঠিখেলার ক্লাব ছিল তখন এই সমিতির ধাত্রীভূমি৷ তিনিই
বঙ্কিমি আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ক্লাবের নামকরণ করেন "অনুশীলন সমিতি"৷
চর্চা দ্বারা উন্নতিলাভ ও অভীষ্ট সিদ্ধ করতে হবে—এই ছিল এই নাম গ্রহণের গূঢ় উদ্দেশ্য৷
বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী
আন্দোলনের সময় এই সমিতি বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে ও অল্প দিনের মধ্যেই দর্জিপাড়া, পটলডাঙা, খিদিরপুর, হাওড়া, সালকিয়া, বালি, উত্তরপাড়া, শিবপুর, শ্রীরামপুর, তারকেশ্বর
প্রভৃতি স্থানে শাখা স্থাপন করেন৷ এই সমিতির মোট প্রায় ৫৮০ টি শাখা স্থাপিত
হয়েছিল৷ তবে শৃঙ্খলা ও বৈপ্লবিক কার্যকলাপের দিক থেকে শাখা কার্যালয়গুলির মধ্যে
ঢাকাস্থিত অনুশীলন সমিতি এক পৃথক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে৷ আর্মস্ট্রং-র মতে, এই সমিতিটি ১৯০৫-র ৩ রা নভেম্বর (মতান্তরে ১৯০৬-র সেপ্টেম্বর) প্রতিষ্ঠিত হয়৷
এর নেতা পুলিনবিহারী দাশ ছিলেন সরলাদেবীর আখড়া থেকে সুশিক্ষিত৷ তাঁর অসামান্য কর্মচাঞ্চল্যে
শীঘ্রই আসাম ও পূর্ববঙ্গ জুড়ে সদস্য সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩০০০৷ এমনকি কলকাতায়
বৈপ্লবিক কার্যকলাপে সাময়িক স্থিতি আসলেও পুলিনবিহারী দাশ ও পরবর্তীতে
ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী,অমৃতলাল হাজরা প্রমুখের নেতৃত্বে ঢাকা অনুশীলন সমিতি শৃঙ্খলা, ত্যাগ ও সাহসিকতার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বৈপ্লবিক কাজকর্ম চালিয়ে যান৷ ঢাকার
মানিকগঞ্জ, নরিয়া, রাজনগর, রাজেন্দ্রপুর, মোহনপুর প্রভৃতি স্থানে রাজনৈতিক ডাকাতি ঘটে৷ এর পরিপ্রেক্ষিতেই শুরু হয় ঢাকা
ষড়যন্ত্র মামলা ও বরিশাল ষড়যন্ত্র মামলা৷ তবে বিভিন্ন শহরে এই সমিতির শাখা
আখড়াগুলি স্থাপিত হলেও এরা ছিল কলকাতাস্থিত মূল প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এক সূত্রে
গাঁথা৷ তৎকালীন "বন্দেমাতরম" পত্রিকায় দেখা যায়— এই সমিতির স্বেচ্ছাসেবকরা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াত, তাদের হাতে লাঠি, মাথায় হলুদ রঙের পাগড়ি, গায়ে লাল শার্ট, ঘাড়ের কাছে বন্দেমাতরম ব্যাজ, ধুতির এক পাশ কোমরের চারদিকে রাজপুতদের মতো বাঁধা৷ তাঁদের কথাবার্তার মূল বিষয়
দেশপ্রেম ও দেশের জন্য জীবনদান৷
প্রথমদিকে
বিশেষত ১৯০৫ খ্রীস্টাব্দের আগে পর্যন্ত সমিতির কার্যকলাপে কোন অভিনবত্ব ছিলনা৷
রাসবিহারী ঘোষের মতো নরমপন্থী নেতা এই সময়ে এই সমিতির পৃষ্ঠপোষকতা করতেন৷ চিত্তরঞ্জন
দাশ,অশ্বিনীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো নেতারা নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ বা ট্রেড ইউনিয়ন
আন্দোলনে অধিক ব্যস্ত হয়ে পড়েন৷ কিন্তু এতে বৈপ্লবিক কাজকর্ম ব্যাহত হচ্ছে— এই মনোভাব দেখিয়ে অনেকেই অনুশীলন সমিতির কার্যপদ্ধতির বিরোধিতা করতে শুরু
করেন৷ বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখরা স্বাধীন পথে চলতে মনস্থ করেন৷ রচিত হয়
"No
Compromise", "সোনার
বাংলা" প্রভৃতি ইস্তাহার এবং প্রকাশিত হয় "যুগান্তর" নামক পত্রিকা৷
সন্ত্রাস ও গুপ্ত হত্যার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়৷
১৯১২-র গোড়ার
দিকে অনুশীলন সমিতির কর্মকেন্দ্র আবার কলকাতায় সরে আসে৷ তবে ততদিনে নানা পরিবর্তন
ঘটে গেছে৷ ১৯০৮-র শেষের দিকে স্বদেশী আন্দোলনের তীব্রতা কমে আসে৷ ১৯০৯-র
মর্লে-মিন্টো সংস্কার ও ১৯১১-র বঙ্গভঙ্গ-প্রত্যাহার নরমপন্থী নেতাদের খুশি করে৷
আবার শুরু হয় আবেদন-নিবেদনের রাজনীতি৷ একদিকে অনুশীলন সমিতির ক্ষীয়মান প্রভাব ও
অন্যদিকে বিপ্লবের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কযুক্ত নেতাদের রাজনীতি থেকে অবসর
গ্রহণ সামগ্রিকভাবে বিপ্লবী আন্দোলনকে কিছুটা স্তব্ধ করে৷ তবে এই অনুশীলন সমিতি ও
সমকালীন যুগান্তর দল, সুহৃদ সমিতি প্রভৃতির রাজনৈতিক ডাকাতি, গুপ্ত হত্যা ও সন্ত্রাস সৃষ্টি সমকালীন জনমানসে অনেকাংশে বিরূপ প্রভাব ফেললেও
ইংরেজদের তা সন্ত্রস্ত করে তোলে৷ আবার চরমপন্থী রাজনীতিকরাও বুঝতে পারেন,জনগণকে ব্যতিরেকে কোন আন্দোলন সফল হতে পারেনা৷ তাই পরবর্তীকালের আন্দোলনগুলি
ধীরে ধীরে গণ-জাগরণের রূপ নিয়েছিল৷ এই একই সময়ে পাঞ্জাব ও মহারাষ্ট্রেও শুরু
হয়েছিল বিপ্লবী আন্দোলন, তবে সে অন্য কাহিনী৷
চিত্রসৌজন্য — গুগল ও উইকিপিডিয়া
তথ্যসূত্র
১) বাংলায়
বিপ্লব প্রচেষ্টা— হেমচন্দ্র কানুনগো
২) স্বাধীনতার
মুখ— অমলেশ ত্রিপাঠী
৩) বিপ্লব
আন্দোলনের নেপথ্যে নানা কাহিনী— শিশির কর
৪) নথিপত্রে
স্বদেশী আন্দোলন— সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
৫) কোরক
সাহিত্য পত্রিকা — প্রাক শারদ ২০১৭— ভারতের স্বাধীনতা ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন
৬) অনুশীলন
সমিতির ইতিহাস — সম্পাদনা :
অমলেন্দু দে
৭) আধুনিক
ভারতের রূপান্তর (রাজ থেকে স্বরাজ)— সমর কুমার মল্লিক
=======================
No comments:
Post a Comment