Thursday, September 30, 2021

একান্ত আলাপচারিতা

উৎসবের মরশুম আসলেই ঘরছাড়া মানুষ ঘরে ফিরতে চায় ৷ চায় দীর্ঘদিন ধরে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা আত্মজনের সাথে পুনরায় সংযোগ স্থাপন করতে ৷ শেষ-না-হওয়া কথাগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ৷ জীবনের যে চড়াই-উতরাইয়ে একা এগোচ্ছে, তাতে সেই বহুদর্শী প্রাজ্ঞ বন্ধুর সুচিন্তিত পরামর্শ পেতে ৷ তাই আমাদের পদক্ষেপ পত্রিকা এই উৎসবের সময়ে ফিরে গিয়েছে তার দীর্ঘদিনের বিশিষ্ট বন্ধু তথা অভিভাবকসম শ্রী ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের কাছে ৷ 

পত্রিকার আবাল্য সঙ্গী তথা লিটল ম্যাগাজিনের জগতে প্রযুক্তির অধুনা-ব্যাপক-ব্যবহারের অন্যতম আদি প্রবক্তা এই সুসাহিত্যিকের সাথে আলাপচারিতা করেছেন পত্রিকার সম্পাদক শ্রী নির্মলেন্দু কুণ্ডু। 

আমাদের পদক্ষেপ পত্রিকা : প্রথমেই আমাদের পদক্ষেপ পত্রিকাকে আপনার মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানাই  এই দেড় বছর ব্যাপী অতিমারীতে কেমন আছেন আপনি ? এই সময়পর্ব কী আপনার লেখাগত  ব্যক্তিগত জীবনে কোন পরিবর্তন আনল ?

ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় : ধন্যবাদ । আমাদের পদক্ষেপ পত্রিকার প্রতি আমার কিছু দুর্বলতা আছে । সম্ভবত পত্রিকার প্রথম সংখ্যা থেকেই আমি এর সঙ্গে জড়িয়ে আছি এদের সংগঠনের সঙ্গে, কখনো বা লেখক হিসাবেও। দেড় বৎসরেরও বেশি সময় ব্যাপী অতিমারীতে কোন সংবেদনশীল মানুষেরই ভালো থাকা সম্ভব ছিল না আমার ক্ষেত্রে অন্যথা হবে কি করে ? দেড়মাস ব্যাপী অতিমারী শুধু নিয়েছে, দেয়নি কিছুই, মানুষে মানুষে বিচ্ছিন্নতা ছাড়া ।  সামাজিক, শিক্ষা, অর্থনৈতিক, সাহিত্য সর্ব ক্ষেত্রেই এসেছে শূন্যতা ।বিনা নোটিশে লকডাউনের কারণে লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক যে দুর্দশায় পড়েছিল তার সঠিক হিসাব আমরা পাইনি । আমরা দেখেছি শুধু মৃত্যুর মিছিল । সৃষ্টিশীল মানুষ নতুন সৃষ্টি থেকে সরে এসেছে, আসতে বাধ্য হয়েছে। মানব সভ্যতা এত বড় বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়নি কোনদিন । এ নিশ্চয়ই বড় সুখের সময় নয় । অতিমারী কেড়ে নিয়েছে অনেক প্রিয়জনকে ।অতিমারী জনিত বিপর্যয় আমাদের জীবনে কোন পরিবর্তন আনেনি এটা নেহাতই অনৃত ভাষণ। আমার লেখাগত ও ব্যক্তিগত জীবনে মৃত্যু-মিছিল দেখে দেখে চৈতন্য অসাড় হয়ে যায় , অসাড় চৈতন্য নিয়ে সৃষ্টিশীল কিছু করা যায় না।করতে পারিনি। হয়তো এটাই অনিবার্য পরিবর্তন ।

আমাদের পদক্ষেপ পত্রিকা : আপনার সাহিত্যজীবনের শুরুর কথা একটু বলুন..

ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় : ‘সাহিত্য জীবন’ কথাটাতে আমার আপত্তি আছে । আমি নিজেকে একজন ‘সাহিত্য কর্মী ভাবতেই ভালোবাসি । ছোট বেলা থেকেই নাটক, আবৃত্তি ইত্যাদি নানান সাংস্কৃতিক কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাই । স্কুলজীবনে হাতের লেখা পত্রিকা করতাম আর জলখাবারের পয়সা জমিয়ে স্বপনকুমারের ডিটেকটিভ বই কিনতাম ৷ লাইব্রেরি যাওয়া তো ছিলই ।কৈশোর থেকে থিয়েটার ও সাংস্কৃতিক কাজকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া এবং লাইব্রেরীর সঙ্গে সংস্পর্শই আমার মধ্যে সাহিত্যবোধ ও চেতনার জন্ম দেয় যার পরিণতি নিজের সাহিত্যকর্মী হয়ে ওঠা ।কলেজ শিক্ষা শেষ না করেই রেলের চাকুরী নিয়ে এখনকার ছত্তিশগড়ের বিলাসপুরে  চলে যাই । নাটক, আবৃত্তি ও সাহিত্যকর্মের প্রতি আমার আকর্ষণ ছোটবেলা থেকেই ।সুতরাং প্রবাসী বাঙালিদের সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিলাম সহজেই । সেটা ১৯৬৫ সালের কথা , সেখানে বাংলা প্রেস ছিল না, সুতরাং হাতে-লেখা পত্রিকা দিয়ে শুরু করি । ক্রমে কলকাতা থেকে ছাপিয়ে এনে দু-একটা বাংলা পত্রিকাও বেরলো । সেখানেই সামান্য লেখালেখির সূচনা করলাম ।১৯৯৪-এর অক্টোবরে কলকাতায় বদলি নিয়ে এলাম । কিন্তু এখানেও নিজের শিকড় ছড়াতে বেশ কিছুটা সময় চলে গেল ।

আমি মূলত নাটকের লোক, কখনো সখনো দু একটা গল্পও লিখেছি, কিন্তু না, জীবনে আধখানা কবিতাও লিখিনি, বলা ভালো লিখতে পারিনি । কবিতা আমার প্রিয় বিষয় বাল্যকাল থেকেই । সেই ভালোবাসা থেকেই অন্যনিষাদের প্রকাশের সূচনা । আমি চেয়েছিলাম বাংলা কবিতা আরো অনেক বশি পাঠকের ঠিকানায় পৌছে যাক । এবং সেটা হয়েছে । এই দশ বছরে সারা বিশ্ব জুড়ে অনেক পাঠক অন্যনিষাদ, গল্পগুচ্ছর সঙ্গে জড়িয়েছেন । তাঁরা কবিতার কাছে এসেছেন। এটুকুই আমার পাওয়া ।

আমাদের পদক্ষেপ পত্রিকা : আপনি দীর্ঘদিন ধরে সাহিত্য পড়ছেনসাহিত্যের সাথে যুক্ত আছেন  যুগের সাথে সাহিত্যের  ভাষার কীরকম পরিবর্তন ঘটেছে বলে মনে হয় ?

ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় :   সময়ের সাথে বিষয়ভাবনা এবং সাহিত্যের ভাষার বদল অনিবার্য । আমাদের প্রজন্ম স্বাধীনতা-উত্তর প্রথম প্রজন্মের প্রতিনিধি ।সাহিত্য-নাটকের সাথে বিস্তীর্ণ সময় ধরে জুড়ে থাকার ফলে অনেক বদল লক্ষ্য করার সুযোগ হয়েছে ।স্বাধীনতা-উত্তর কাল থেকে আজকের অন্তর্জাল সাহিত্য আঙ্গিনা পর্যন্ত পথচলা – অনেকটা পথ, সাতটি দশককে ফেলে আসা । সে পথে অনেক ভাঙা-গড়া, অনেক বাঁক । অনেক উথাল-পাথালেরও সাক্ষী সে পথ । আমার মত যারা স্বাধীনতার কয়েকবছর আগে জন্মেছেন, তারা স্বাধীনতা-উত্তরকালে সাহিত্যের কাছে আসা প্রথম প্রজন্মের মানুষ । তো সেই প্রথম প্রজন্মের আমরা বাংলা সাহিত্যের যে উত্তরাধিকার পেলাম তার সূত্রপাত আরো অন্তত দুটি দশক আগে। শেষ পর্বের রবীন্দ্রনাথও তখন বদলাচ্ছেন । বাংলা সাহিত্যের রবীন্দ্রপ্রভাব বলয়ের চৌকাঠ পেরনো শুরু হয়েছিল তিরিশের দশকে ‘কল্লোল, ‘কালিকলম, ‘পরিচয়’ পত্রিকার হাত ধরে । আধুনিক নগর জীবনের সংশয়, ক্লান্তি, বিতৃষ্ণা, মূল্যবোধের বিপর্যয়, নিঃসঙ্গতা বোধ ও বিশ্বাসের সংকট এইসব ছিল সেই সাহিত্যধারার উপকরণ ।

১৯৩০-এ জার্মানীতে হিটলারের উত্থান, ফ্যাসিবাদের মানবতা বিরোধী আগ্রাসন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে ওঠা, ১৯৩৬-এ রবীন্দ্রনাথের পৌরহিত্যে  কলকাতায় প্রগতি লেখক সঙ্ঘের প্রথম সম্মেলন — এ দেশে তখন এক তোলপাড় করা সময় । বিয়াল্লিশের আগস্ট বিপ্লব, তেতাল্লিশে মানুষের তৈরি করা মন্বন্তরে কলকাতার রাস্তায় মৃত্যুর মিছিল, গণনাট্য সঙ্ঘের প্রবল আবির্ভাব, ডাক ও তার ধর্মঘট, ছেচল্লিশের নৌ বিদ্রোহ, দাঙ্গা, সাতচল্লিশে দেশভাগ ও ছিন্নমূল উদ্বাস্তু স্রোত — এই উত্তাল সময়ের আবহে বাংলা সাহিত্য আর শুধু ‘কলা কৈবল্যবাদী’ থাকে কি করে ? থাকলো না, বিষয় ভাবনায় এলো আমূল পরিবর্তন। এই সাহিত্যধারার মূল কথা ছিল এই যে, সে শোনাবে সময়ের শব্দ, তার শরীরে থাকবে গণ মানুষের জীবন। সাহিত্যে থাকবে সহজ আবেদন, সমাজ বাস্তবতা ও সদর্থক আশাবাদের চিত্রকল্প, তার দায় নতুনতর এক বন্দোবস্তের স্বপ্ন দেখানো।

পঞ্চাশ পরবর্তী সময়কাল থেকে সত্তর দশক পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যে জীবনবাদী আশা-আকাঙ্খা আরো বিচিত্র বিন্যাসে সমৃদ্ধ হল । এবং তারপর… । তারপর মধ্যআশি থেকে বিশ্বায়ন নামক একটা শব্দ বদলে দিতে শুরু করল আমাদের যাপনচিত্র, আমাদের সমাজের বাঁধন আর মূল্যবোধগুলি । আমাদের সমাজটাও যেন হয়ে গেল স্থির বদ্ধ জলাশয়ের মতো । উথাল-পাথাল তো দূরের কথা, সামান্য ঢেউও ওঠে না । ভাঙছে কিন্তু গড়ছে না । সমাজ যেমন তার সাহিত্যও তেমন । আমাদের সাহিত্যও অতয়েব হয়ে উঠলো নিজের জন্য বাঁচা আর একা একা বাঁচার আত্মযুদ্ধের ক্লান্তিকর ছবি । অন্তর্জালে তাই আপাতত বিশ্বায়ন ও পণ্যায়ন জাত সাহিত্যেরই চাষ-আবাদ । ব্যতিক্রম সামান্যই । আমার পর্যবেক্ষন এমনই ।

আমাদের পদক্ষেপ পত্রিকা : আপনি নিজে যখন সাহিত্যসৃষ্টি করছেনতখন আপনার পারিপার্শ্বিক আপনাকে কতটা প্রভাবিত করেছিল ? কোন পূর্বতন বা বর্তমান লেখক কী আপনার সৃষ্টিতে প্রভাব ফেলেছিল ?

ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় : আমার আগের প্রশ্নের উত্তরের মধ্যে এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে । ব্যক্তিগতভাবে কোন লেখক অন্য কারো লেখায় প্রভাব ফেলতে পারে বলে আমি মনে করি না, তবে কারো লেখার স্টাইল কারো লেখার স্টাইলের সঙ্গে সামান্য  মিলে যেতে পারে । সেটা কোন দোষের নয় ।আমি যে সময়ে লেখার চর্চা শুরু করেছিলাম এবং পরবর্তী সময়েও লেখার বিষয় ভাবনা ও ভাষায় সমাজবাদী ভাবনার প্রবল প্রভাব অস্বীকার করতে পারি না । ব্যক্তিজীবনে আমি মার্কসবাদী জীবন দর্শনে বিশ্বাসী, আমার লেখার মধ্যে সেই জীবন দর্শনের প্রভাব থাকবেই ।

আমাদের পদক্ষেপ পত্রিকা : আপনার বেশ কিছু প্রবন্ধ পড়ার সুযোগ হয়েছে  প্রবন্ধ সাহিত্যের প্রতি এই ঝোঁকটা কী বরাবরের ? যে নিবিড় পড়াশোনার মধ্যে দিয়ে একজন প্রাবন্ধিককে যেতে হয়যাবতীয় ব্যক্তিগত  পেশাগত জটিলতা সামলে কীভাবে তা সম্ভব হল ?

ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় : আমার সাহিত্যকর্মের মূল আধার হল প্রবন্ধ। প্রবন্ধ আমি প্রচুর লিখেছি, অশক্ত শরীরে এখনও লিখে চলেছি বিশেষত ওয়েব পত্রিকায় ।এই প্রসঙ্গে একটি জিনিসের প্রভাবের কথা বলতেই হবে, সেটা হ’লো লাইব্রেরী ।১৯৬০-এ অগষ্টে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট বেরনোর পরদিনই থেকেই একশো বছরের পুরাতন আড়িয়াদহ এসোসিয়েশন লাইব্রেরীতে লাইব্রেরীয়ানের কাজ পাই সামান্য সাম্মানিকের বিনিময়ে । সেখানে সুবিশাল বইয়ের ভাণ্ডার আমার নাগালের মধ্যে এল ৷ সুতরাং অগাধ পড়াশোনার সুযোগ পেলাম ।১৯৬৫-র গোড়ায় রেলের চাকুরী নিয়ে বিলাসপুরে কর্মজীবনের শুরুতেই লাইব্রেরী পাই ৷ রেলের বাঙালি কর্মীদের রিক্রিয়েশন ক্লাবের লাইব্রেরী আমাদেরই হাতে গড়া । তারপর কলকাতায় বদলি হওয়ার পর ডানকুনিতে সরকার স্পনসর্ড লাইব্রেরী ছিল আমার বাড়ির সামনেই । বাসা বদল করে উত্তরপাড়ায় এলাম । সেখানে বাংলার অন্যতম সেরা গ্রন্থাগার জয়কৃষ্ণ লাইব্রেরীর রিডিং রুমেও নিবিড় অধ্যয়নের সুযোগ পাই ।তারুণ্য থেকেই গ্রন্থাগারের সঙ্গে নিবিড় সংস্পর্শ, নানান বিষয়ে বিভিন্ন গ্রন্থ অধ্যয়নের ব্যাপক সুযোগ পাওয়ার ফলে প্রবন্ধ সাহিত্যের প্রতি আমার বিশেষ আকর্ষণ তৈরি হয় ।বিষয় সম্পর্কে ইতিহাস বোধ এবং নিবিড় অধ্যয়ন ভিন্ন সার্থক প্রবন্ধ রচনার কোন শর্টকাট পদ্ধতি নেই । এটা বুঝলাম । অতিমারী জনিত লকডাউন এবং শরীর ভেঙে যাওয়ার কারণে দু বছর হল গ্রন্থাগারে গিয়ে বই পড়া আর হয়না, কিছু প্রয়োজনীয় বই কিনতে হয়। কিছু পিডিএফ সংগ্রহ করতে হয় ।

আমাদের পদক্ষেপ পত্রিকা : খন অনলাইন ম্যাগাজিন আজকের মতো রমরম করে শুরু হয়নিতখন থেকেই আপনি অন্যনিষাদ  গল্পগুচ্ছের মতো দুটি -ম্যাগাজিন চালাতেন  এই -ম্যাগাজিন দুটোর শুরুর কথা যদি একটু বলেন...

ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় : ২০১০-এর আগে কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট ব্যবহার সম্পর্কে আমার কোন ধারণাই ছিল না । বয়স তখন আমার সত্তর ছুঁতে চলেছে । আসলে মেয়েকে কম্পিউটার কিনে দিয়েছিলাম ২০০২-এ চাকুরী থেকে অবসর নেওয়ার পর । ২০০৯-এ মেয়ের বিয়ের পর কম্পিউটার আমার দখলে চলে আসে । বিন্দুমাত্র প্রযুক্তি জ্ঞান না থাকা সত্তর ছোঁয়া আমি প্রতিবেশী তরুণদের কাছে জিজ্ঞাসা করে করে কম্পিউটার ও  ইন্টারনেটের ব্যবহারটা শিখে নিলাম । ২০১১ নাগাদ কম্পিউটারে গুগল ঘাটতে ঘাটতে ফ্রি ব্লগ তৈরি করার কায়দাটা জানলাম । ইতিমধ্যে ২০০৯-এ ফেসবুকের সদস্য হয়েছি, বেশ কিছু সাহিত্য অনুরাগী উজ্জ্বল তরুণের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে । সাদামাটা  প্রচ্ছদে  দুটো ওয়েব ব্লগ বানিয়েও ফেললাম – একটি কবিতার সাপ্তাহিক 'সাপ্তাহিক অন্যনিষাদ' , আর একটি ছোট  গল্পের ব্লগ 'পাক্ষিক গল্পগুচ্ছ' ।প্রথমে সাদামাটা প্রচ্ছদেই বের করে ছিলাম অন্যনিষাদ ৷ আমার ওয়েব ডিজাইনের কোন প্রযুক্তিগত জ্ঞান ছিলনা, এখনও নেই । এ ব্যাপারে প্রযুক্তিবিদ বন্ধু সুমিতরঞ্জন দাস প্রভূত সাহায্য করেছেন । বছরে দুয়েক সাদামাটা প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণে অন্যনিষাদ ও গল্পগুচ্ছ প্রকাশ করার পর সুমিতরঞ্জন পত্রিকা দুটির নতুন ডিজাইন করে দেন ।পরে নবম বর্ষ থেকে বন্ধু শুভ্র ভট্টাচার্য কৃত প্রচ্ছদ ডিজাইনে পত্রিকা দুটি প্রকাশিত হতে থাকে । এই হল অন্যনিষাদ ও গল্পগুচ্ছ ওয়েবপত্রিকার দুটির শুরুর কথা । ১০ম বর্ষ চতুর্দশ সংখ্যা পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে অন্যনিষাদ প্রকাশিত হয়েছে । গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ভাষাদিবস সংখ্যার পর অন্যনিষাদের কোন সংখ্যা প্রকাশ করতে পারিনি শারীরিক অসুস্থতার কারণে । শুরুর পর অন্যনিষাদের বয়স দশ বছর বেড়েছে, আমার বয়সও ৮০ পেরোতে চলেছে ।শরীর অশক্ত । আসলে বয়স তার পাওনা-গণ্ডা বুঝে নেবেই ।

আমাদের পদক্ষেপ পত্রিকা : আজ অনলাইন ম্যাগাজিন দিক-দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ছে ৷ অতিমারী অনেক প্রিন্টেড ম্যাগাজিনকেও অনলাইনে আসতে বাধ্য করেছে ৷ এই ব্যাপারটাকে আপনি কীভাবে দেখেন ?

ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় : এটা অনিবার্য ছিল, তাই হচ্ছে । অতিমারীর প্রভাবেই যে এটা হচ্ছে তা নয় । অতিমারীর প্রভাবে প্রিন্ট পত্রিকার বিক্রি কমেছে এটা ঠিকই, আবার একথাও ঠিক যে প্রিন্ট লিটল ম্যাগাজিনের প্রচার বা বিক্রি এমন নয় না যে ছাপার খরচটা উঠে আসে । অপর দিকে ওয়েব পত্রিকার খরচ প্রায় নেই বললেই চলে । মূলত সাংগঠনিক এবং আর্থিক কারণে তারা অনলাইন পত্রিকার দিকে ঝুঁকছে ।কয়েক বছর আগেও ওয়েব পত্রিকার লেখকদের প্রতি প্রিন্ট পত্রিকার লেখকদের তীব্র তাচ্ছিল্য ছিল । আবার এটাও দেখা যাচ্ছে যে প্রতিষ্ঠিত প্রিন্ট পত্রিকা মোটামুটি প্রচার থাকা সত্ত্বেও তারা ওয়েব ভার্সন বের করেছে । জামশেদপুর থেকে প্রকাশিত কালিমাটি বেশ প্রতিষ্ঠিত পত্রিকা, তারা কালিমাটি অনলাইন নামে পত্রিকার ওয়েব ভার্সনও প্রকাশ করছে । এটাই একটা আদর্শ হতে পারে প্রিন্ট পত্রিকার ওয়েব ভার্সন দুটোই পাশাপাশি চলবে ।

আমাদের পদক্ষেপ পত্রিকা : লিটল ম্যাগাজিনের ক্ষেত্রে প্রিন্টেড, নাকি অনলাইন— কোন রূপটা আপনার কাছে লিটল ম্যাগাজিনের ভবিষ্যতের বাহন হবে ? আপনি ব্যক্তিগতভাবে কোন রূপে ম্যাগাজিন পড়তে ভালোবাসেন ?

ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় : অন্তর্জালের প্রভাব এখন অপ্রতিরোধ্য একথা ঠিক।হয়তো আগামী ৫০ বছরে বা তার আগেই ওয়েব পত্রিকা প্রিন্ট পত্রিকার জায়গা নিয়ে নেবে । তখন হয়তো প্রিন্ট পত্রিকা কোনদিন ছিল একথা মানুষ জানবেই না । তবে এখনই সেরকম সম্ভাবনা আমি অন্তত দেখতে পাচ্ছি না। আমি অন্তত মনে করি না অন্তর্জাল সাহিত্য-চর্চার বিপুল উন্মাদনা লিটল ম্যাগাজিন  আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতাকে বিপন্ন করতে পারে । আমি দেখতে চাই ওয়েব মাধ্যম মুদ্রিত মাধ্যমের পরিপুরক হয়ে উঠুক ।  আমার বিশ্বাস অদূর ভবিষ্যতে হয়তো অনেক ছোট মুদ্রিত পত্রিকা বা লিটল ম্যাগাজিনের অন্তর্জাল সংস্করণও দেখতে পাব ।

আমাদের পদক্ষেপ পত্রিকা : বর্তমানে বিভিন্ন বইয়ের আন-অথরাইজড্ পিডিএফ ভার্সন বেরোচ্ছে ৷ লেখক তথা প্রকাশক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ৷ একজন পাঠক হিসেবে বিষয়টাকে কীভাবে দেখছেন ?

ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় : এটা একটা উদ্বেগের জায়গা এটা ঠিক । আমি কঠোরভাবে পিডিএফের বিরোধী তা নয় ।বাজারে চালু গ্রন্থ, যেগুলি প্রকাশকের ঘরে বা বইয়ের দোকানে পাওয়া যায় এমন বই পিডিএফে সংস্করণের বিরোধী, কিন্তু দুষ্প্রাপ্য বই বা রেফারেন্স বইয়ের পিডিএফ ভিন্ন উপায় নেই । গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ বা রেফারেন্স বই প্রকাশকরা পুনর্মুদ্রণ কদাচ করেন । প্রাবন্ধিক বা গবেষণা গ্রন্থের লেখকদের পিডিএফের আশ্রয় নেওয়া ভিন্ন উপায় কি? আমি বিষয়টাকে এভাবেই দেখি । পিডিএফের ব্যাপারে আমি মোটেই একবগ্গা নই ।

আমাদের পদক্ষেপ পত্রিকা : এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আর কোন কোন পরিকল্পনা রূপায়ন করা বাকি আছে আপনার ? ভবিষ্যৎ আপনাকে কী হিসেবে মনে রাখবে বলে আপনার মনে হয় ?

ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় : অশক্ত শরীরে আমি এখন যে অবস্থায় রয়েছি, তার ওপর অতিমারীর প্রভাবে মানুষের সঙ্গে আলাপ ও মত বিনিময় করা যাচ্ছে না, সেখানে দাঁড়িয়ে নতুন পরিকল্পনা করা বা তার রূপায়নের চিন্তা করার মত অবস্থায় আমি নেই ।আপাতত আমার ভাবনা সাহিত্য কর্মী হিসাবে আরো কিছুদিন তোমাদের সঙ্গে জড়িয়ে থাকি, আরো কিছু শিখি ।

আমাদের পদক্ষেপ পত্রিকা : আরও একবার আমাদের পদক্ষেপ পত্রিকার তরফ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ জানাই ৷ আপনার নীরোগ দীর্ঘজীবনের কামনা করি ৷ এতদিন আমরা যেভাবে আপনার বিভিন্ন সৃষ্টিতে সমৃদ্ধ হয়েছি, ভবিষ্যতেও হব বলে আশা প্রকাশ করছি ৷

ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় : ধন্যবাদ ভাই । শুভেচ্ছা নিও ।যতদিন কম্পিউটার কী বোর্ডে আঙ্গুল ছোঁয়ানোর অবস্থায় থাকব, ততদিন তোমাদের সঙ্গে থাকব, এটুকু বলে রাখলাম ।

=======================

2 comments: