লক্ষ্মী ভুতুমের পাঁচালী
সঙ্গীতময় দাস
ভুতুম পেঁচী আর লক্ষ্মী পেঁচী, দুজনেই এক গ্রামে থাকে। লক্ষ্মী পেঁচী থাকে জমিদারের কোঠা বাড়িতে, চিলেকোঠার ঘুলঘুলিতে। আর ভুতুম পেঁচী থাকে গাছের কোঠরে। লক্ষ্মী পেঁচীর খুব নাক উঁচু। বলে বেড়ায় আমরা স্বয়ং লক্ষ্মীর পোষ্য জানো? তাই তো আমাদের খাবারের কোন অভাব নেই। আর তোমরা তো শুধুই পেঁচা-পেঁচীর দল। তোমাদের উপর মা লক্ষ্মীর কৃপা হবে কি করে? যাও যাও চড়ে খাও। আসলে ব্যাপারটা কি, জমিদারের বাড়ির ধানের গোলাটি বেশ বড়সড়, আর সেখানে তো ইঁদুর আসবেই। তাই আর লক্ষ্মী পেঁচীকে বাইরে যেতে হয় না। কিন্তু ভুতুম পেঁচীকে মাছের খোঁজে রাত-বিরাতে বেরোতেই হয়। মাছ ছাড়া তাদের চলে না। লক্ষ্মী পেঁচীর স্বভাবটাও খুব উড়নচণ্ডী। সব কিছুতেই তার খুঁতখুঁতুনি। একটা ইঁদুর মেরে পুরোটা খায় না কখনো। ফেলে ছড়ায়। সারা বাড়িময় রাতে ঘুরে বেড়ায়, এটা ঠোকরায়, ওটা ঠোকরায়। আর মনে মনে ভাবে, দেখ এগুলো সবই তো লক্ষ্মী মায়ের দান, আর লক্ষ্মী মায়ের বাহন হিসাবে সবই আমার। আমার জিনিসে আমি ঠোকরাবো না তো কে ঠোকরাবে! ভুতুম পেঁচীর বাজে কাজের সময়ই নেই। তাকে তো সারারাত আকাশে চক্কর খেতে খেতে শুনতে হয় জলের আওয়াজ, নজর রাখতে হয় কখন একটা মাছ ভেসে উঠল। কত অধ্যবসায়ে একটা মাছ শিকার করতে হয়।
এত তফাৎ হলে কি হবে, দুজনে কিন্তু খুব বন্ধু। তো একদিন কি হল, দুজনে বেরোলো ঘুরতে। কোজাগরী পুর্ণিমার রাত। চাঁদের উপর ছায়া ফেলে কি মজাই না লাগে উড়তে। উড়তে উড়তে, গ্রাম পেরিয়ে, ক্ষেত খামার পেরিয়ে, তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে ওরা চলে এল শহরে। লক্ষ্মী পেঁচী বলল “ ওরে ভুতুম, এখানে তো এখনো দিন শেষ হয় নি রে, কিছু যে দেখতে পাচ্ছি না”।
ভুতুম অনেক ঘোরে, তাই জানে। বলল “ না রে, এসব মানষের তৈরি আলো, রাত নেমেছে এখানেও”।
লক্ষ্মী খুব ভয় পেয়ে গেল। “ রাতেই এত আলো! এরপর দিন হবে, আমরা তো অন্ধ হয়ে গেলাম রে! ফিরব কি করে?”
ভুতুম বলল “ভাবিস না। এখন রাত ভোর। রাত দুপুরে অনেক আলো নিভে যাবে। মানুষগুলো ঘুমিয়ে পড়বে। আমরাও ভালো করে দেখতে পারব। ততক্ষণ চল, আমরা ঐ বড় গাছটার ফোকরে কাটাই।”
দুজনে খুঁজেপেতে একটা বড় কোটরে গিয়ে ঢুকল। চোখের পর্দা ফেলে, কান খাড়া করে ঝিমোতে লাগল।
রাত গড়িয়ে সবে রাত সকালে পড়েছে। এমন সময় চারিদিকে পুঁউউ- পুঁউউক আওয়াজ বেজে উঠল। লক্ষ্মী পেঁচী লাফিয়ে উঠে বলল “শুনতে পাচ্ছিস?”
“হ্যাঁ, শাঁখের শব্দ। আর সঙ্গে সবাই দাও মা, দাও মা করে চেঁচাচ্ছে।”
“আমার মনিব ঠাকুরনকে ডাকছে সবাই।”
“তাতে এত লাফাবার কি হল?”
“আরে মা লক্ষ্মীর দেখা পেলে মায়ের কাছে যা চাইব তাই পাব, বুঝলি না। মা আমাকে কিছুতেই না বলতে পারবে না”- লক্ষ্মী পেঁচীর বুক গর্বে ফুলে উঠল।
“বোন, আমার জন্য একটা গঙ্গার ইলিশ চাইবি? কতদিন খাইনি রে”, ভুতুমের আহ্লাদিত আবদার ফুটে উঠল।
লক্ষ্মী পেঁচী চোখ সরু করে বলল “ তোর নোলা আর গেল না”। তারপর ঘাড় বেঁকিয়ে উপর দিকে চেয়ে বেশ ডাঁটের সঙ্গে বলল, “ আমি তো বাবা একটা মোটা সোনার হার চাই”।
“সোনার হার কি হবে র্যা?”
“দেখিস না জমিদার গিন্নি কি রকম একটা মোটা সোনার হার পরে বেড়ায়”, লক্ষ্মী পেঁচী ঘাড় ঘুরিয়ে বলল।
“ও তোর জমিদার গিন্নি হবার সাধ গেছে- খ্যাঁক খ্যাঁক”
“খবরদার! ও রকম পেঁচীদের মত দাঁত বার করে হাসবি না বলে দিচ্ছি ভুতুম”, রাগে লক্ষ্মী অগ্নিশর্মা হয়ে উঠল।
“আচ্ছা আচ্ছা, রাগ করিস কেন বোন”। লক্ষ্মীকে শান্ত করতে তোয়াজ করল ভুতুম। “কিন্তু এত বড় শহরে তোর মনিবিনীর দেখা পাবি কোথায় বল তো?”
“ হু-উ, ঐ যে বিরাট গগনচুম্বী বাড়ীটা দেখছিস, ওখানেই পাব মা লক্ষ্মীকে” নিশ্চিন্তে বলল লক্ষ্মী পেঁচী।
“ঠিক জানিস। কি করে এত নিশ্চিন্ত হলি?” সন্দেহ প্রকাশ করে ভুতুম।
“আরে গাধা! বড় বাড়ি মানেই অগাধ ধন-সম্পত্তি। আর ধনের দেবী সেখানে থাকবে না তো কোথায় থাকবে শুনি?”
“তা বটে”। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভুতুম। মুখ পেঁচী করে বলল “ হুম। বুঝলাম। কিন্তু এদিকে যে পেট চোঁ চোঁ করছে”।
লক্ষ্মী বলল “ এদিকে যে আলো জ্বলছে দাউ দাউ করে। বেরোবি কি করে?”
“চল আকাশে উঠে দেখি। উপরে উঠলে অত আলোর আঁচ চোখে লাগবে না”- ভুতুম বলল।
উপরে উঠে ওরা দেখল রাস্তাগুলোয় আগুনের মত আলো জ্বলছে, কিন্তু গলি-ঘুঁজি আধা অন্ধকার। বাড়ীর ছাদ সব হাল্কা-গাঢ় আধাঁরে ঢাকা। আসলে সেদিন তো লক্ষ্মীপুজোর দিন, রাস্তার গায়ে গায়ে প্যান্ডেল হয়েছে। আলোর মালায় রাস্তা সেজেছে, কিন্তু বাড়ীর পুজোগুলো শেষ হয়ে গেছে। আস্তে আস্তে বাড়িগুলোর আলো নিভে এসেছে। তাই পেঁচীরা আকাশ থেকে ঐ রকম দেখল।
“দেখছিস ঐ বড় বাড়ীর ছাদটায় কি সুন্দর রাত পড়েছে। চল আগে দেখে আসি মা লক্ষ্মী আছেন কি না ওখানে”। লক্ষ্মী বলল।
“তা ঐ বাড়িটায় যে মা লক্ষ্মী আছেন, তুই জানলি কি করে?”
“ আরে বোকা! ঐ বাড়িটার নীচে কত বড় বড় গাড়ি আছে দেখেছিস”- লক্ষ্মী প্রশ্ন করল।
“ হ্যাঁ! তাতে কি”, ভুতুমের সিধে সরল উত্তর,
“আরে বাবা, তার মানে ওটা বড়লোকের আবাস, বুঝলি না”
“তো”- ভুতুমের অবিশ্বাসী উত্তর।
“আচ্ছা গাধা তো তুই! আরে বাবা লক্ষ্মী তো ধনের দেবতা, না কি? তা হলে দেবী ধনবানদের বাড়ী থাকবে না তো কি গরীব চাষাভুষাদের বাড়ী থাকবে?”
“তা কথাটা তুই মন্দ বলিস নি। তাহলে চল ঐ বাড়িটা দিয়েই শুরু হোক আমাদের লক্ষ্মী-অভিযান”।
হুশ করে ওরা চলে এল বড় বাড়িটার ছাদে। তারপর শুরু হল খোঁজা। অনেক মানুষ, অনেক ঘর। ঘরে ঘরে পুজো হয়েছে। বেশ কিছু ঘরে আলো নিভে গেছে। খুঁজে খুঁজে ওরা হয়রান হয়ে গেল, কিন্তু মা লক্ষ্মীর দেখা আর পেল না।
ভুতুম রেগে বলল “ তুই এত ম্যা ম্যা করিস আদৌ তোর লক্ষ্মী দেবী আছেন কিনা সন্দেহ। ওসব মানুষগুলোর উদ্ভট কল্পনা”
লক্ষ্মী আরো রেগে বলল, “ তা হলে আমি তার বাহন হই কি করে। ঐ দ্যাখ ড্যাকরা, ঐ লক্ষ্মী মুর্তির পাশে কি সুন্দর সাদা পেঁচার পুজো হয়েছে, সে কি এমনি এমনি”
ভুতুম মুখ গোমড়া করে বলল “ তা তুই যদি তার বাহন হোস তবে তোর ঘাড়ে চেপে দেবী ঘোরে না কেন?”
এবার লক্ষ্মীর হাসার পালা। হো হো করে হেসে উঠে বলল, “ গাধা! বাহন কি আর চড়ার জন্য। মর্যাদা বাড়ানোর জন্য। এই যেমন কোন মানুষের গাড়ি থাকলেই তার মর্যাদা বেড়ে যায়, তা সে চোর ছ্যাঁচড়, ডাকাত যাই হোক না কেন। আর তা ছাড়া দেব-দেবীদের সাথে আমাদের না জুড়লে মানুষ কি আমাদের একটুও শ্রদ্ধা ভক্তি করত? এমনিতেই ওরা বাকি সব প্রাণীদের মেরে লোপাট করে দিচ্ছে!”
“ছাড় এখন এ সব। আবার উপরে চল, দেখি কিছু খাবার দাবার পাওয়া যায় কি না”
একটু থেমে ভুতুম বলল, “তুই তো একটু চোখ কান খোলা রাখলে অনেক ইঁদুর পেয়ে যাবি। শহর বড় নোংরা। রাজ্যের ইঁদুরের বাস। কিন্তু আমি মাছ পাব কি না সন্দেহ”
“কেন?”
“আরে শহরে পুকুর থাকেই না বললে চলে”
“তাই না কি?” লক্ষ্মী অবাক হয়ে বলল।
“চল না। আকাশে উঠলেই বুঝবি”, এই বলে ভুতুম গা ঝাড়া দিয়ে উড়তে শুরু করল। সেই দেখে লক্ষ্মীও উড়তে লাগল। উড়তে উড়তে অনেক উঁচুতে, কোজাগরী পূর্ণিমার ফুটবলের মতো চাঁদটাকে ঘিরে ওরা পাক খেতে শুরু করল।
হঠাৎ ওদের চোখে পড়ল এক দেবী মূর্তি এক অতি জীর্ণ কুটিরের ভাঙাচোরা টালির চাল দিয়ে সুট করে ঢুকে গেল। এই দেখে তো ওদের ছানাবড়া চোখ রসবড়া হয়ে গেল।
লক্ষ্মী আনন্দে উত্তেজিত হয়ে আকাশেই একটা ডিগবাজি খেয়ে ভুতুমকে কড়া সুরে বলল, “ দেখলি। নিজের চোখে দেখলি তো? তবে যে বলছিলি ও সব মানুষের কল্পনা?”
ভুতুম কি রকম ব্যোমকে গিয়ে মিনমিন করে বলল, “তুই যে বলেছিলি মা লক্ষ্মী শুধু বড় বড় বাড়িতেই থাকেন?”
“আরে দেবদেবীদের মর্জি কি আর আমাদের মত ক্ষুদ্র প্রাণীদের বোঝা সম্ভব। ওটা আমার আন্দাজ ছিল। এখন তো দেখা পেলি, চল গিয়ে দেখাসাক্ষাৎটা সেরেই আসি”
এই বলে লক্ষ্মী পেঁচী সোজা তিরের মত নিচে নামতে শুরু করল। দেখাদেখি ভুতুমও নামতে থাকল। নামতে নামতে ওরা সোজা এসে সেই টালির চালে এসে বসল। চালে ছিল একটা ফাটল। সেই ফাটল দিয়ে তো দুই পেঁচী ঘরে ঢুকে বসল বাঁশের মাচায়।
যা দেখল তাতে তো ওরা অবাক। টিম টিম করে প্রদীপের আলো জ্বলছে। মা লক্ষ্মী পূজোর বেদীতে বসে আছেন। সারা ঘরে পদ্মের সৌরভ। সামনে এক ছিন্ন বসনা রমণী একটা পেয়ারা, একটু চিনি আর বাতাসা সাজিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলছে, “ মা—মা গো এই দেখ এই ভিক্ষার পয়সায় যা পেয়েছি, তাই দিয়ে পূজো করছি। ঠাকুরমশাই দিয়ে পুজো করার সাধ্য নেই মা। দয়া কর। ভিক্ষাবৃত্তি চাই না মা। তোমার কৃপায় ধন সম্পত্তি চাই না মা, সেও তো ভিক্ষা, কাজ দাও মা, সুযোগ দাও কাজ করার”, এই বলে মাটিতে মাথা রেখে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগল।
দুই পেঁচীতে অবাক হয়ে দেখল দেবীর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। ওরা শুনতে পেল দেবী বলছে,
“কি করব সোনা, আমি তো তোকে বলতেই চাই, কারণ তুই লোভীদের মত ভিক্ষা চাস না। কিন্তু তোদের চোখ কান যে সব বন্ধ। কি ভাবে তোকে সাহায্য করি বল তো”।
রমণী কিন্তু শুনতেও পেল না কিংবা মা লক্ষ্মীকে দেখতেও পেল না। হঠাৎ লক্ষ্মী দেবীর ভুতুম পেঁচীর উপর নজর পড়তেই ইশারায় তাকে ডাকল। ভুতুম তো ভয়ে ভয়ে ইতস্তত করতে করতে লক্ষ্মী দেবীর কাছে গেছে।
দেবী তাকে কাছে ডেকে বললেন. “ শোন ভুতুম ঐ যে ঘরের কোণে সুন্দর ক্রুশের কাজ করা আসনগুলো দেখছিস, ঐ গুলো আর এই কাগজটা ওর পাশে রেখে দে। তাড়াতাড়ি করবি। ওকে আর কিছুক্ষণ মাটিতে মাথা রেখে কাঁদাব। তোকে দেখতে পাবে না। তারপর চালে গিয়ে বস, আমি আসছি”।
ভুতুম আর লক্ষ্মী গিয়ে চালে বসতেই বৌটি মাটি থেকে মাথা তুলে পাশে রাখা আসনগুলো দেখতে পেল। দেখে তো অবাক। তারপর কাগজটাকে হাতে তুলে পড়ল। কাগজটাতে একটা ঠিকানা লেখা ছিল। মনে পড়ে গেল অনেক দিন আগের কথা। তখন তার স্বামী বেঁচে। স্বামী ছিলেন এক চটকল কারখানার কর্মচারী। মোটামুটি সচ্ছল অবস্থা ছিল। একদিন স্বামীর এক অধস্তন কর্মচারী বাড়ীতে এল। বয়স বেশী নয়। ২৩-২৪ বছর হবে। অফিস মেসে থাকে। এসেই তো বউদি পাতিয়ে ফেলল। মেসের খাবার দাবার ভাল নয়। তাই মাঝে মাঝেই এসে হানা দিত বউদির রান্নার লোভে। সেই একদিন দিয়েছিল কাগজটা। বলেছিল “ বউদি! তুমি এত ভাল ক্রুশের কাজ জানো! এরকম কাজ যে কেউ পেলে লুফে নেবে। তোমায় একটা ঠিকানা দিচ্ছি। আমার এক পিসে আছেন হ্যান্ডিক্রাফট ডিপার্টমেন্টে। তুমি গিয়ে দেখা করো। এ জিনিস লুফে নেবে, গ্যারান্টি দিচ্ছি”। আর যাওয়া হয় নি। তারপরই তো মারণ রোগ ক্যান্সারে ধরল স্বামীকে। ঘর সংসার, অল্প বিস্তর যা গয়না ছিল সব খেয়ে নিল ঐ মারণ রোগ। ও দিকে কারখানাও বন্ধ হয়ে গেছে। স্বামীর প্রাপ্য কিছুই কারখানা থেকে পাওয়া গেল না। সব হারিয়ে সে হল পথের ভিখিরি। আশ্রয় নিল রেলের দখলীজমির উপর। সরস্বতী পুজোর ফেলে দেওয়া দরমা, বাঁশ আর টালি দিয়ে ঘর বানিয়ে দিয়েছিল, পাশের ওসমান দাদা। কাগজটা যে কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল। আসনগুলোর কথাও মনে ছিল না। হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল রমণী। “ মা – মাগো তুমি আমার চোখ খুলে দিলে মা। আমি তোমার এই কৃপার কথা কখনো ভুলব না মা। যদি আমি এগুলো দেখিয়ে কাজ পাই মা, মানত করছি পরের বছর বড় করে তোমার পুজো করব”। কাঁদতে কাঁদতে বলল রমণী।
“ উফ! আমার সাথে ব্যবসা করতে তোকে কে বলেছে, দেনা-পাওনা ছাড়া কি কিছু বুঝবি না। জ্বালাতন”, এই বলে বেশ বিরক্ত মা লক্ষ্মী সেখান থেকে উঠে চালে গিয়ে দাঁড়াল।
লক্ষ্মী পেঁচীকে দেখে মা লক্ষ্মী তো বেশ অবাক। “ আরে শ্বেত পেঁচী। তোকে তো দেখতেই পাইনি। কোথায় ছিলি?”
লক্ষ্মী পেঁচীর বেশ একটু অভিমান হয়েছিল। মুখ ভার করে বলল, “ আমি আর কে বল তোমার, যে দেখতে পাবে”৷
ভুতুম মুচকি হেসে বলল, “ ও না কি তোমার বাহন মা। আর ওকে তো তুমি লক্ষ্যই করলে না! খুব দুঃখ হয়েছে ওর মনে”।
“ আহা রে! কি করব বল সোনা। তখন তো বৌটার দুঃখ দেখে চোখে জল ছিল। ঝাপসা চোখে কি আর ভাল দেখা যায়! আর বাহন কি শুধু শ্বেত পেঁচী না কি। জগতের সব পেঁচা পেঁচী আমার বাহন”, বললেন মা লক্ষ্মী।
“ছাই বাহন। তোমাকে বয়ে নিয়ে যাবার শক্তি আমাদের আছে! ও সব মানুষের কল্পনা”, লক্ষ্মী রেগেমেগে বলল।
“ওরে বোকা বাহন মানেই কি পিঠে করে নিতে হবে? বাহন মানে হল বহন করা”—স্মিত হেসে দেবী লক্ষ্মী বললেন।
“মানে”- দুই পেঁচীতে সমস্বরে বলে উঠল।
“ আচ্ছা বল তো মানুষ আমাদের পুজো করে কেন? কিছু পেতে তো? তা চাইলেই কি পাওয়া যায়? তা পেতে গেলে নিজের কি কোন গুণের কি দরকার নেই?”
“চাইব তাতে আবার গুণের কি দরকার?” –ভুতুম জিজ্ঞাসা করল।
“ চাইতে গুণের দরকার নেই, কিন্তু ফল পেতে গেলে গুণের দরকার। আর কি গুণের দরকার তার উত্তর হচ্ছে আমাদের বাহন”
“কিছুই বুঝলাম না। হেঁয়ালি ছেড়ে বলো তো তোমাদের বাহনের কি কাজ”- লক্ষ্মী ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল।
“আহা। চেঁচাস কেন? শোন আমার ভাই কার্তিক হল যুদ্ধের দেবতা, ওর বাহন হল ময়ূর। ময়ূর সাপকে ক্লান্ত করে জেতে, নিপুণ রণকুশল। তাই কার্তিকের দয়া তার উপরই হবে যে ঐ রকম রণকুশল। আর এক ভাই গণেশ। কি দেয়? সিদ্ধি। সাধনার সিদ্ধি। তা সাধনা করতে গেলে, সবার আগে দরকার ধৈর্য্য। ইঁদুর এইটুকু দাঁত দিয়ে অসীম ধৈর্য ধরে গোটা পাহাড়ে ছেঁদা করতে পারে-জানিস?”
“তা আর জানবো না। লম্বা সুড়ঙ্গ কেটে গোলাতে ঢোকে। কিন্তু আমাকে ফাঁকি দিতে পারেনা। মাটির তলায় থাকলেও যে আমি ওদের পায়ের আওয়াজ পাই”, চোখ ঢুলু ঢুলু করে লক্ষ্মী বলল।
“তোদের এই শোনার ক্ষমতা আর দেখার ক্ষমতা বহন করিস বলেই তো তোরা আমার বাহন। আমি তো তোদের দেখিয়ে মানুষগুলোকে বলি, ওহে শোনো, শুধু পুজো করলেই হবে না। চোখ কান খোলা রাখো, যে রকম গুণ পেঁচারা বহন করে, সেই রকম গুণ অর্জন করো, সময় সুযোগের সদব্যবহার করো। তবেই তো ধনার্জন হবে। প্রয়োজনীয় গুণের বাহক বলেই নির্দিষ্ট পশু নির্দিষ্ট দেবতার বাহন—বুঝলি এবার”।
“ ও তার মানে সবই ঢপের চপ। নিজেকেই খেটে নিতে হবে। তোমরা হাতে করে কিছুই দেবে না বল”- লক্ষ্মীর রাগ তখনও পড়ে নি।
“শ্বেত পেঁচী! তুই তো ভারি মুখরা হয়েছিস। অলক্ষ্মী হয়ে যাচ্ছিস দিন দিন। শোন, আয়েসিপনা ছাড় এখুনি। জমিদারদের ছেলেগুলো তোর মতো আয়েসি। সাতপুরুষের কষ্টের রোজগার আর দু বছরের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। তখন গোলায়ও ধান থাকবে না। বসে বসে ইঁদুরও পাবি না। কি করবি তখন? তাই বলছি এখন থেকে ভুতুমের মতো পরিশ্রমের অভ্যাস কর। না হলে মারা পড়বি”।
লক্ষ্মী বেচারা আর কি করে। মা’র কাছে বকুনি খেয়ে অধোবদনে বসে রইল। ভুতুম মাকে খুশি করতে বলল, “ মা আমি কিন্তু ভেবেছিলাম তোমার কাছ থেকে ইলিশ মাছের ঠিকানাটা নিয়ে নেব। যা বকুনি দিলে চাইতেই ভয় করছে”।
ভুতুমের কথার কায়দায় মা হেসে ফেললেন, “ বেশ কায়দা করে তো চেয়েই নিলি দেখছি। যা দক্ষিণ দিকে শেওড়াতলার ঘাটের কাছাকাছি ঘুরে বেড়া, তোর মনস্কামনা পূর্ণ হবে। এখন আমায় যেতে হবে। আর কাকে সাহায্য করা যায় দেখি। শ্বেতপেঁচী, আমি কিন্তু তোমার উপর নজর রাখব বলে দিলাম। কুঁড়েমি করেছো কি বকুনি খাবে আবার”।
এই বলে মা লক্ষ্মী চলে গেলেন। ভুতুম লক্ষ্মীকে বলল, “ নে নে চল। আর মুখগোমড়া পেঁচী হতে হবে না। শেওড়া তলার ঘাটে যাবি না। আজ একটু ইলিশ মাছ চেখেই দ্যাখ না। ভাল না লাগলে না হয় ইঁদুর ধরে খাস। ঘাটে কি আর ইঁদুর পাবি না!” এই বলে উড়তে শুরু করল। লক্ষ্মী আর কি করে, গোমড়া মুখেই ভুতুমকে অনুসরণ করতে লাগল।
আমার কথাটি ফুরোল, নটে গাছটি মুড়োল।
চিত্র-সৌজন্য— গুগল
=======================
পটলা ও বাহন হাঁস
বিশ্বজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়
ইস্কুলে আমাদের ক্লাসে দুরকম ছেলে আছে। একদল, যারা পড়াশোনায় খুব ভালো, আর অন্যদল, যারা পড়াশোনায় খুব খারাপ। মাঝামাঝি কেউ নেই। পটলা হল পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়া ছেলেদের একজন। মানে দ্বিতীয় দলের। অঙ্ক কষতে গিয়ে তার এক একবার একেক রকম উত্তর বেরোয়। ভূগোলে সে প্রাকৃতিক ভূগোলের প্রকৃতি বুঝতে পারে না। ইতিহাসে তার সাল তারিখ এমন গুলিয়ে যায় যে পটলা ভাবে রাজা-বাদশারা সবকটা যুদ্ধ একই সালের একই দিনে করে শেষ করতে পারলেন না! তার মধ্যে রাজবংশের তো শেষ নেই! ইংরাজি ভাষাটি পটলার বিশেষ খটমট লাগে। পটলা একটি বাক্য ইংরাজিতে সহজেই বলতে পারে - আই ডোন্ট নো। তা সে স্যার যাই জিজ্ঞেস করুন না কেন। স্যারেদের বেদম প্রহার এবং নীলডাউনে এক্সপার্ট লেভেলের দক্ষতা সত্ত্বেও পটলার পড়াশোনার বিশেষ উন্নতি হয় নি।
বাধ্য হয়ে তার মতো ছেলেরা যে শর্টকাট রাস্তা নেয়, পটলাও তাই করল। প্রত্যেক বছর মন দিয়ে সরস্বতী পুজোর অঞ্জলি দেওয়া শুরু করল। কিন্তু তাতেও বিশেষ সুবিধে হল না। ঠাকুর তাকে বিদ্যে-বুদ্ধি বিশেষ দিলেন না। পটলা কী আর করে। একবছর সরস্বতী পুজোর দিন সে কুল খেতে খেতে ইস্কুলের পেছনে গাছতলায় শুয়ে পড়ল। এবং ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সে একটা বিদঘুটে স্বপ্ন দেখল।
পটলা দেখল যে গাছতলায় সে বসে আছে এবং এক বিশাল লম্বা দাড়ি নিয়ে এক সাধু তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।
তাঁকে দেখে পটলা হাতজোড় করে বলল, "আপনি কে সাধুবাবা?"
সাধুবাবা ফিক করে হেসে বলল, "আমি দাড়িবাবা রে পটলা। তোর দুঃখের কারণ আমি জানি। তোর বিদ্যে-বুদ্ধির ভারী অভাব। তোকে এই ব্যাপারে জ্ঞানের পথ দেখাতেই আমার আসা।"
পটলা বলল, "তাড়াতাড়ি বলুন দাড়িবাবা। আমার ক্লাসের পরীক্ষা সামনেই। মা সরস্বতীকে কীভাবে তুষ্ট করব বলে দিন। আমি আপনার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করব।"
"আরে বোকা ছেলে, তুই কি ভি ভি আই পি ছাত্র নাকি যে তুই বর প্রার্থনা করলেই মা সরস্বতী তৎক্ষণাৎ মঞ্জুর করে দেবেন?"
"তবে উপায় বাবা?"
"উপায় একটা আছে। তোকে এজেন্ট ধরতে হবে।"
"এজেন্ট? এজেন্ট আবার কে?"
"ওই সরস্বতীর বাহন। উনিই হলেন এজেন্ট।"
"মানে হাঁস?"
"একদম।"
"তোকে হাঁসের মন জয় করতে হবে। তাহলেই কেল্লা ফতে!"
"হাঁস গিয়ে চুপিচুপি তোর কথাটা মায়ের কানে তুলে দেবে। তাতে দেবী সায় দিলেই তোর একটা হিল্লে হয়ে যাবে। বুঝলি?"
"তা, মায়ের এজেন্ট, থুড়ি বাহনকে কোথায় পাব দাড়িবাবা?"
"গ্রামে যে ছোটো নদীটা আছে, এখনই সেখানে চলে যা। এজেন্ট আপাতত ওখানেই হাওয়া খাচ্ছে।"
দাড়িবাবার কথা শুনে পটলা পাঁইপাঁই করে দৌড়ল নদীর দিকে। সেখানে পৌঁছে দেখে যে নদীর পাড়ে একটা হাঁস রয়েছে বটে! পটলা বেশ খুশি হল। গদগদ কণ্ঠে বলল, "হাঁসদাদা, শুনেছি যে আপনি নাকি সাক্ষাৎ বিদ্যাদেবীর বাহন। তা, আমার ভারী দুঃখ। পড়াশোনায় বিশেষ মাথা নেই। যদি একটু মা সরস্বতীকে আমার হয়ে তদ্বির করেন..."
হাঁসটি কেমন বিরক্ত স্বরে প্যাঁক-প্যাঁক করে উঠল। তারপর বলল, "আমি যে সরস্বতীর বাহন, সেটা তোমায় কে বলল? আমি তো ব্রহ্মারও বাহন হতে পারি।"
"অ্যাঁ, বলেন কী? ব্রহ্মার বাহন হাঁস?"
"দেখ, আমি তোমায় দুরকমই বলছি। সব শুনে তোমায় সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে আমি কার বাহন। সঠিক সিদ্ধান্ত নিলেই হাতে হাতে ফল পাবে।"
"বলুন তবে। শুনি।"
"হুম। প্রথমে বলি আমি সরস্বতীর বাহন কেন? দেবী সরস্বতীর দুটো রূপ আছে - নদীরূপ এবং দেবীরূপ। নদীর স্রোতের সাথে অসংখ্য হাঁস ভেসে বেড়াতে পারে। তাই বাহন হিসেবে আমি উপযুক্ত। এছাড়া বাহন হিসেবে আমি জলে ভাসতে পারি আবার ডাঙায় হাঁটতে পারি। জ্ঞান ও বিদ্যার মতোই আমি বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়তে সক্ষম। তাছাড়া দুধ ও জল মিশ্রিত করে দিলে আমি কেবল দুধটুকু খেয়ে জলটুকু ফেলে দিতে সক্ষম। অর্থাৎ জগতের যাবতীয় তথ্যের মধ্যে কোনটুকু প্রয়োজনীয় জ্ঞান, তা আমি বুঝি। আমি কেবল সেইটুকুই নিই, বাকিটুকু বর্জন করি। সুতরাং বুঝতেই পারছ। আমি দেবীর বাহন হওয়ার উপযুক্ত।"
"বাঃ, তাহলে তো হয়েই গেল। নিজেই স্বীকার করলেন যে আপনি দেবীর বাহন। আপনার সাথে আদি দেব ব্রহ্মার কোনও যোগই নেই।"
"উঁহু, ব্যাপারটা অত সোজা নয়। এবার শোনো, ব্রহ্মার কথা। দেবাদিদেব ব্রহ্মার মধ্যে দুটি গুণ বর্তমানঃ সত্ত্ব ও রজঃ। হাঁসের মধ্যে এই দুই ভাবের সমন্বিত প্রকাশ বিদ্যমান। এছাড়া 'হংসঃ' কথাটি হল 'অহং সঃ' কথাটির বীজরূপ। প্রজাপতি ব্রহ্মার সাথেও এই কথাটি যায়। যিনি 'সঃ', তিনি প্রজাপতি ব্রহ্মার মধ্যেও আদি 'অহং' রূপে আছেন। সুতরাং হাঁস প্রজাপতি ব্রহ্মারও বাহন।"
"বাপরে, মাথাটা কেমন যেন গুলিয়ে গেল।"
"হুম, গুলিয়ে গেলে চলবে না। চটপট বলো, আমি তবে কার বাহন?"
"দেখুন, আজকে সরস্বতীপুজো যখন, তখন মনে হয় সরস্বতীর বাহনেরই আশেপাশে ঘোরার কথা। তাছাড়া আপনার গায়ের রঙ বেশ ধবধবে সাদা। ব্রহ্মার বাহন অন্য হাঁস হতে পারে, কিন্তু বিদ্যাদেবীর বাহন আপনি, মানে সাদা হাঁস। ঠিক কিনা?"
"বেশ, বেশ। সঠিক উত্তর। খুশি হলাম। তোমার কথা আমি দেবীর কানে তুলে দেব। দেখি, দেবীর যদি দয়া হয়!"
এই কথোপকথন শেষে গাছের নিচে শুয়ে থাকা পটলার স্বপ্ন ভেঙে গেল। পটলা কপালে হাত ঠেকিয়ে হাঁস ও দেবীর উদ্দেশ্যে প্রণাম করে বাড়িমুখো রওনা দিল।
এর পরেও যে পটলা পড়াশোনায় বিশেষ উন্নতি করেছিল তা নয়। সেই দুঃখে পটলা বাজার থেকে মাঝেমাঝে হাঁসের ডিম কিনে আনত। কোথা থেকে পটলার ধারণা হয়েছিল যে হাঁসের ডিম সেদ্ধ খেলে নাকি জ্ঞান-বুদ্ধি বাড়ে!
চিত্র-সৌজন্য— গুগল
=======================
বিরহ
প্রদীপ গুপ্ত
একছাদ বাতাসের বুকে বসে ছিলো ওরা।আজ শুরু হয়েছে দেবীপক্ষ। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের ফাঁকেফাঁকে একটা দুটো তারা মেঘের সাথে লুকোচুরি খেলছে।
বন্যার শাড়ির আঁচলটা এসে অরুনালোকের মুখে লেপ্টে যাচ্ছে। মাড় দেওয়া সুতির শাড়ির একটা অন্যরকম গন্ধ থাকে। আর বন্যার শরীরের গন্ধের সাথে মিশে ---
--" নিকষকালো বলে কিছু হয় না। "
চুপচাপ বসে আছে ওরা। ছাদের ওপর একটা মাদুর পেতে মাঝেমাঝেই ওরা বসে থাকে। ফ্লাটের অন্যকেউ ছাদের দিকে আসেনা খুব একটা। অরুনালোক এ জন্যই এই চারতলার ফ্লাটটাকে বুক করেছিলো।
--" দেখো, এই অমাবস্যার রাতটাও কিন্তু নিকষকালো নয়।"
বন্যা আলোকের কোলে মাথা রেখে শুলো। এ সময় ছাতিম ফুলের একটা মন মাতাল করা সুগন্ধ কোত্থেকে যেন ভেসে আসে ওদের ছাদে।
--" আজ তো অমাবস্যা নয়, আজ প্রতিপদ। "
আকাশের দিকে বন্যার চোখ। আঁচলের বদলে চুলগুলো এখন খেলা করছে অরুনালোকের চোখে মুখে।
--" আর মাত্র চারদিন বন্যা। "
--" হু "
আবার ছাতিমের গন্ধ আর বৃষ্টিভেজা হাওয়া। বন্যার চুলগুলোকে শিউলির মতো কুড়োতে কুড়োতে অরুনালোক একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ে।
--" এ সময়তেই যে কেন ছাতিম ফুলগুলো ফোটে -- কেন যে ঠিক এই -- "
বন্যা হাতদুটোকে বাড়িয়ে আলোকের গলা ধরে মুখটাকে নীচের দিকে টেনে আনতে চায়। অরুনালোক ঘাড়টাকে শক্ত করে রাখে।
--" তুমি একদম শিশুর মতো আমায় ভালোবাসো আলোক "
--" আমি বুঝিনা। "
--" তাহলে এতো অভিমান কেন? মা ও তো চান যে পূজোর সময়টায় --"
--" আমি কি না করেছি? "
--" তাহলে --!"
--" তোমার ওপর আমার কোনো অভিমান নেই বন্যা, আমার সব অভিমান ওই --"
--" শোন, অষ্টমীর দিন আলমারির ওপরের তাকে রাখা -"
--" লালপেড়ে শাড়িটা আর পাঁচশো টাকা মন্দিরে দিয়ে আসবো। তাই তো! "
হঠাৎ করে বন্যার গালে একবিন্দু উষ্ণতার ছোঁয়া লাগে।
--" দেখো, আমি -- আমি একদিন ঠিক কেটে ফেলবো ওকে -"
চমকে ওঠে বন্যা। কাকে কেটে ফেলতে চাইছে আলোক?
--" আলোক! সোনা আমার! কি হলো তোমার সোনা? "
--" তুমি যখন থাকোনা তখনও ও কেন ওর এই মাতাল করা গন্ধ নিয়ে আমার কাছে আসে? ও কি জানেনা যে তুমি আমার কাছে নেই! জানেনা আমি একা বসে আছি পূর্ণিমার অপেক্ষায়? ও কি জানে না এ কদিন আমি একা বসে বসে আমার মনের ঘরে আলপনা আঁকি? আমার কোন সপ্তমী নেই - অষ্টমী নেই -- শুধু কোজাগরী আছে? আমার কোন দুর্গা নেই -- শুধু লক্ষ্মী আছে? ওকে তুমি বলে দিয়ে যাও বন্যা ষষ্ঠীর রাত থেকে ও যেন ওর পথ বদল করে। অন্য কারোকে গন্ধ বিলোয়, সে কদিন আমি শুধু তোমার এই মাড় দেওয়া শাড়ির গন্ধ শুঁকবো, তোমার চুলের তোমার ফেলে যাওয়া রাতগুলোর গন্ধ নিয়ে থাকবো আমি --- ওই ছাতিমের গন্ধকে --- "
দেবীপক্ষের সূচনার রাতের নিকষকালো আঁধারে দুটো শরীর ক্রমশ হারিয়ে যেতে থাকে। চিত্র-সৌজন্য— গুগল
=======================
চণ্ডীর রিনিউ
দীপক আঢ্য
ক’দিনই বা কাজ শিখেছে ছেলেটা? এখনও একবছর পূর্ণ হয়নি। মাধ্যমিক দিয়েই মোটর গ্যারেজের অ্যাপ্রেন্টিস। অ্যাপ্রেন্টিস শব্দটাও এই গ্যারেজে কাজ শিখতে এসে শেখা। তা-ও কাজে ঢোকার মাস-তিনেক পরে। কার কাছ থেকে যে শব্দটা প্রথম শুনেছিল সে আজ ঠিক মনে করতে পারে না। তবে সেই ইস্তক আর মোটর-সাইকেলের গ্যারেজে কাজ করি— বলে না সে। বলে, মোটর গ্যারেজের অ্যাপ্রেন্টিস। এই কথাটা বলতে গিয়ে একটু হলেও আত্মশ্লাঘা অনুভব করে সে।
চণ্ডী। মাধ্যমিকের অ্যাডমিট কার্ডে নাম নাম লেখা চন্দন দে। কিন্তু নামের কোন অপভ্রংশের ফলে সে চন্দন থেকে চণ্ডী হয়ে উঠেছিল, তা সে নিজেই বলতে পারে না। পানিতরের শেষ প্রান্তে যেখানে বাংলাদেশের সীমানা ছুঁয়ে গেছে কাঁটাতারের বেড়া, যেখান থেকে বিএসএফ-এর চেকপোস্টের সুরকি রঙের ছোট ঘর দেখা যায়, তার থেকে দুটো তালগাছের সমান দূরত্বে চণ্ডীর ঘর। মা, বাবা আর চণ্ডী। ছেলের মাধ্যমিক শেষ হলেই চণ্ডীর বাবা আর দেরি করেনি। ভর্তি করে দিয়েছিল সামসেরের মোটর সাইকেলের গ্যারেজে। ছেলে যে বিএ, এমএ পাশ দিয়ে জজ-ব্যারিস্টার হবে না, তা যেন চণ্ডীর বাপ বুঝে গিয়েছিল অনেক আগেই। সেজন্যে এই একই কথা ভাঙা রেকর্ডের মত সর্বক্ষণ চণ্ডীর কানের কাছে বাজাতে বাজাতে চণ্ডীর মনেও বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গিয়েছিল, আর যাই হোক লেখাপড়া তার জন্যে নয়। তাছাড়া লেখাপড়া তার ভালো লেগেছেই বা কবে? স্কুলের পাঠ্য বইয়ের বাইরের জগৎ তার কাছে চিরকালই ঢের বেশি সুখের। আনন্দের। এমনকি রোজগারেরও।
গ্যারেজের কাজে ঢুকেই সামসেরের হুকুমে চণ্ডীর কাজ হল মোটর সাইকেল পরিষ্কার করা। ট্যাঙ্কের জলের পাইপের মুখ খুলে চাকা থেকে শুরু করে মাড-গার্ডের ভিতর পর্যন্ত কাদা-মাটি-নোংরা ধুয়ে সাফ করা। তারপর ভালো করে মুছে ডিজেল চোবানো ন্যাকড়া দিয়ে গাড়িটার ওপর বুলিয়ে নেওয়া। কম খাটুনিতে চকচকে করে তোলা। সঙ্গে একটু চেন বা ব্রেক-শু টাইট দেওয়া।
দু’দিন যেতে না যেতেই মনে মনে উসখুস করে ওঠে চণ্ডী। সারাদিন আধপেটা খেয়ে লোকের গাড়ি মুছে আর চেন-টাইট দিয়ে মোটর মেকানিকের কাজ শেখা যে অসম্ভব, তা তার বুঝতে অসুবিধা হয় না। তার সঙ্গে কাজ করে হাজু আর বিদ্যা। এই গ্যারেজে ওদের তিন-চার বছর শেষ হলেও গাড়ির কাজ আদৌ ওরা শিখেছে কিনা সন্দেহ হয় চণ্ডীর। হাজু তাও পাংচারওয়ালা চাকা খুলতে পারে একাই। টায়ার থেকে টিউব বের করে ফটাফট পাংচার মেরামতির কাজটা শিখেছে ভালোই। আর বিদ্যা? তার তিন-চার বছরে কাজ শেখার মধ্যে কোনও বিদ্যেই ধরা পড়ে না চণ্ডীর চোখে।
একটা পুরনো লজঝড়ে বুলেট ক’দিন ধরে পড়েই ছিল গ্যারেজের এক কোণে। চণ্ডী প্রথমে ভেবেছিল এটা বুঝি কাটাইতে যাবে। সামসেরভাই সময় বুঝে ওর থেকে চলনসই পার্টস পত্র খুলে নিয়ে বাকি সব গ্যারেজের পিছনে ভাঙাইয়ের জন্যে রেখে দেবে। ভুল ভাঙল আজ সকালে, যখন সামসের চণ্ডীকে বলল, ভালো করে গাড়িটা ধো। আট নম্বর স্ক্রু-ড্রাইভার আর ছোট হাতুড়ি দিয়ে আস্তে করে জংগুলো তুলে দিবি। দেখিস, ইঞ্জিনে যেন কোনও বাড়ি না পড়ে। গাড়ির ইঞ্জিনটা বেশ তাগড়াই আছে বলে মনে হচ্ছে।
চণ্ডী উত্তর দিল, তাগড়াই হবে না? বুলেটের ইঞ্জিন যে।
সামসের তার কথার কোনও উত্তর করল না। কেবল মুখ তুলে নিষ্পলকে একমুহূর্ত তাকিয়ে রইল চণ্ডীর দিকে।
চণ্ডী সামসেরের মুখের দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে বলল, এর’ম এট্টা গাড়ি পেলি সারাদিন চক্কর মেরি বেড়াতাম।
সামসের একটু অবাক হয়ে মৃদু স্বরে বলল, এরকম গাড়ি!
***
লজঝড়ে বুলেটটাকে জল-ধোয়া করে চণ্ডী যখন তাকে গ্যারেজে নিয়ে এল তখন সেটাকে আর চেনার কোনও উপায় নেই। দু’-চাকার মাড-গার্ড ভ্যানিশ। সামনের হেডলাইটের কাচ আগে থেকেই ভাঙা ছিল। এখন সে জায়গাটা যেন গুহার মত হাঁ করে আছে। হ্যান্ডলের গ্রিপদুটো খুলে ফেলায় তার ভিতরের জংধরা জায়গায় জল লেগে কালচে হয়ে উঠেছে। থাকার মধ্যে চেন-কভারের সামনের অংশ কোনও ভাবে লেগে রয়েছে।
সামসের গাড়িটার দিকে তাকিয়ে বলল, করেছিস কী? একদম ন্যাংটা বানিয়ে এনেছিস তো।
গাড়ির গায়ে হাতুড়ির বাড়িও দিতে হয়নি, স্ক্রু-ড্রাইভার দিয়ে ঘসতেও হয়নি। কেবল জলের ধাক্কায় এর সাব কাপড়ই খুলে গেছ্, উত্তর দিল চণ্ডী।
সামসেরের গলা দিয়ে ‘হুম’ করে একটা শব্দ বের হল মাত্র।
চণ্ডী নিজে থেকেই বলল, চেন-কভারটাও খুলে দিতে পারি। ওর মধ্যে টিনের গুঁড়ো আর নোংরা ছাড়া কিছু নেই। তাছাড়া যে হারে জল লেগেছে, তাতে ক’রে চেনে পোড়া-মোবিল না দিলে যেটুকু আছে খসে পড়বে।
সামসের ছোট্ট করে বলল, তাহলে তাই কর।
চণ্ডী গাড়িটাকে ডবল স্ট্যান্ডে দাঁড় করিয়ে ঝপাঝপ হাতুড়ি আর কাটাই-পাতের সাহায্যে চেন-কভার ভেঙে ছাড়িয়ে আনল। চেন-কভারের ভিতরে কোনও এক জায়গায় আটকে থাকা এককোষ জল ছড় ছড় করে ছড়িয়ে পড়ল আধা-শুকনো মেঝের ওপর। সামসের সেদিকে তাকিয়ে একটু উষ্ণ গলায় বলল, জলগুলো ফেলেও আনতে শিখলি না?
একহাতে ভাঙা চেন-কভার আর একহাতে বুলেট ধরে রাখা হ্যান্ডল। চেন-কভার খোলার সময়ই চণ্ডী বুঝতে পারে ডবল-স্ট্যান্ডটাও ভেঙেছে গাড়ির। দু’-পায়ের একটাতেও জোর নেই যে একা দাঁড়িয়ে থাকবে। এদিকে চেন-কভার ভাঙা প্রায় শেষ। একদম শেষ বেলায় চেন-কভার ছাড়াতেই গাড়িটা তার সব ভার ছেড়ে দিয়েছে চণ্ডীর হাতে। এই মুহূর্তে যে সে গাড়িটা ছেড়ে চেন-কভারের ভাঙা অংশটা দোকানের পিছনে রেখে আসবে তার কোনও উপায় নেই।
সেদিকে তাকাতেই বিষয়টা সামসেরের চোখের আড়াল হল না। সে এগিয়ে এসে গাড়ির সিটকভারের পিছনের রড ধরে গাড়িটাকে সোজা দাঁড় করিয়ে রেখে চোখের ইঙ্গিতে চণ্ডীকে যেতে দিল। চণ্ডী ভাঙা চেন-কভার হাতে নিয়ে একপা এগোতেই ‘আহ্!’ ক’রে সজোরে চিৎকার করে উঠল সামসের। চণ্ডী পিছনে তাকিয়ে দেখে গাড়ির সিটকভারের পিছনের রড ভেঙে সামসেরের হাতের মধ্যে ঢুকে রক্তারক্তি। সে দ্রুত পায়ে ভাঙা জিনিসগুলো রেখে এসে গাড়ির হ্যান্ডল ধরতেই সামসের কেটে যাওয়া ডানহাত বাঁ-হাত দিয়ে চেপে ধরে ভ্যাবলার মত দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ।
***
ডানহাতের তালুতে চারটে সেলাই। মোটা করে গজব্যান্ডেজ বাঁধা। ডানহাতের তর্জনীটা সামান্য একটু ফুলেছে বলেও মনে হল।
বিকেলে গ্যারেজে যখন পা রাখল সামসের তখন কাজের চাপ দেখে সে আর স্থির থাকতে পারল না। প্রতিদিন দশ-বারোটা টায়ার পাংচার আসে গ্যারেজে। সুতরাং সেখান থেকে হাজুকে তুলে আনা প্রায় অসম্ভব। বিদ্যে আক্ষরিক অর্থে কোনও কাজেরই না। অতএব চণ্ডী। সামসের হাঁক পাড়ল, চণ্ডী-ই-ই।
চণ্ডী গ্যারেজের পিছনের অংশ পরিষ্কার করছিল। বিকেলের দিকে গাড়ি পরিষ্কারের কাজ সাধারণত থাকে না বললেই চলে। তাই আগুতি গুছিয়ে রাখা। সামসেরের ডাক শুনে হাতে জলের পাইপ ফেলে কলের মুখ বন্ধ ক’রে গ্যারাজের সামনে এল সে। সামসেরের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই সামসের বলল, যতদিন না আমার হাত ঠিক হচ্ছে, ততদিন আমার সামনেই থাকবি। সামনের পনেরো দিন গাড়িতে জল-সার্ভিসিং করার কাজ বন্ধ। কেউ আসলে ফিরিয়ে দিবি। বলবি পনের দিন পর। আর এই পনের দিন আমি ঠিক যেভাবে বলব কাজ করবি। গাড়ির অন্য সব কাজ। এমনকি ইঞ্জিনের কাজ-- তার চুড়ি পরানোর কাজ। বিয়ারিং-এ বল সাজানোর কাজ। গ্রীস দেওয়ার কাজ। হাত-টাইট দেওয়ার কাজ। পারবিনে তুই?
প্রায় এক-নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে সামসের চণ্ডীর দিকে তাকাল।
চণ্ডী মুখ ফুটে ‘হ্যাঁ’ বলবে কি! সামসেরের কথাগুলো শুনে তার চোখমুখ যেন খুশিতে ঝলক দিয়ে উঠল।
***
সামসের আজকাল চণ্ডীকে যত দেখে ততই অবাক হয়। এই ক’মাসে এই বয়সী একটা ছেলে যে গাড়ির সকল পার্টসপত্র থেকে শুরু করে তার কী ফাংশন, কী করলে কী হয় আর কী হয় না-- এত দ্রুত শিখে যাবে সে কল্পনাও করেনি। সে নিজে যখন কাজ শিখেছিল, সেও কি এত দ্রুত শিখতে পেরেছিল? স্মরণ করতে পারে না সে। সামসের আরও অবাক হয় যখন একটা তারে হাত দিয়ে সে ঝরঝর করে বলে, গাড়ির ইলেকট্রিক্যাল ফাংশনের কোথায় আর কেনই বা গণ্ডগোল? কে শেখাল তাকে এসব? সে নিজেও তো… খেই পায় না সামসের। দিন দিন তার নিজেরও যে চণ্ডীর প্রতি আস্থা ও নির্ভরতা ক্রমশ বাড়ছে তা সে আর অস্বীকার করতে পারে না।
***
শনিবার সামসেরের গ্যারেজ বন্ধ। আগে আগে শনিবার আসলেই চণ্ডীর ওপর প্রায় সারা সপ্তাহের কাজের দায় দায়িত্ব বর্তাত। রেশন তোলা, মুদির দোকানে যাওয়া, বাজারে যাওয়া এমনকি প্রতিবেশীরও দু-একটা ছুটছাট কাজ। আজকাল চণ্ডী আর সেসব দিকে মাড়ায় না। শনিবার আসলেই যেমন দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে তেমনি কেবলমাত্র খাওয়ার সময় ছাড়া তার টিকিটি মেলা ভার। চণ্ডীর মা রাগে গজ গজ করে। ছেলের উদ্দেশ্যে দু’-চারটে হাঁক পাড়ে-- গাল দেয় কিন্তু সেসব গায়ে মাখে না চণ্ডী। চণ্ডীর বাপ যদিও কিছু বলে না। বরং চণ্ডীর দিকে এগিয়ে দেওয়া কাজটা নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে বলে, থাকুক না ও ওর মত। হপ্তায়ে তো ওর এই একটা দিনই ছুটি। তার চেয়ে বড় কথা সামসের ইদানীং চণ্ডীর মাইনে বাড়িয়ে দিয়েছে পাঁচ হাজারে। শুরুতে যেখানে দেড় হাজারে ছিল আজ তার একবছরও পূর্ণ হয়নি। হাটে-বাটে সে তো আজকাল প্রায়ই শোনে চণ্ডীর গ্যারেজ! তখন গর্বে বুকটা যেন ফুলে ওঠে তার।
***
বিকেলে হেলথ সেন্টারের মাঠের এক কোণে শিরিষ গাছের তলায় আরও দুটো মোটর সাইকেল স্ট্যান্ড দেওয়া। মোটর সাইকেলের ওপর বসে আছে রহিম আর লুতফর। হাতে মোবাইল ফোন। হেলথ সেন্টারের মাঠে একদল ছোটছোট ছেলে ফুটবলে লাথি দিচ্ছে। লাথি দেওয়া পর্যন্ত সার। কে যে কোন দিকে লাথি দিচ্ছে আর কেনই বা দিচ্ছে তা দূর থেকে বোঝা অসম্ভব। হেলথ সেন্টারের গেটের কাছে চায়ের দোকানে বসে বসে মৌচ করে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিল মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক। একবার চায়ের কাপে চুমুক দেয় তো একবার বাঁ-হাতে ধরা জ্বলন্ত সিগারেটে টান দেয়। তার মুখের কাছে উড়তে থাকা সাদা ধোঁয়ার কুণ্ডলী লোকটাকে যেন কেমন ঝাপসা করে রেখেছে।
একটা বিকট শব্দকরে এগিয়ে আসছে সাদা মোটর সাইকেল। কাছে আসতে বোঝা গেল ওটা সাদা রঙ নয়। বরং রূপালি রঙের বলা ভালো। মোটরসাইকেলের চালকের মাথায় হাফ-হেলমেট সদৃশ একটা লাল টুপি উলটো করে পরা। তার থেকে বেরিয়ে আসা একটা সরু কালো ফিতে চিবুকের নিচ পর্যন্ত আটকে রেখেছে। মোটরসাইকেলটিতে কেবলমাত্র ইঞ্জিন হ্যান্ডল আর বসার জায়গা ছাড়া বিশেষ কিছু নেই বললেই চলে। চায়ের দোকানের সামনে দিয়ে আসার সময় আরও একবার কোৎ করে যেন এক-বুক ধোঁয়া ছেড়ে নিল মোটর সাইকলেটি। কিন্তু এ পর্যন্ত ঠিকই ছিল। মাঠে এতক্ষণ গাছতলায় অন্য মোটর সাইকেলে বসে গল্প করতে থাকা রহিম আর লুতফর যেন সচকিত হল। যে ছোট ছোট ছেলেগুলো এতক্ষণ যেমন খুশি ফুটবলটাকে লাথি মারছিল, তারা তাদের খেলা হঠাত করে থামিয়ে দিয়ে মাঠের এক কোণে সরে গেল। আর লাল টুপি পরা ছেলেটি ছুটন্ত মোটর সাইকেলটিকে কখনও সামনের চাকার ওপর ভর দিয়ে পিছনের চাকা ঊর্ধ্বে তুলে এগিয়ে যেতে থাকল মাঠের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। ফিরে আসার সময় কেবল মাত্র পিছনের চাকার ওপর ভর করে এগিয়ে যেতে থাকে নিজের মত। মাঠের কোণে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট ছোট ছেলেগুলো আনন্দে হাততালি দিতে থাকে। চিৎকার করতে থাকে। তবুও এসব বোধকরি সামান্যই মনে হচ্ছিল চা ও সিগারেট খেতে থাকা ভদ্রলোকটির। মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার বিস্ময় জেগে উঠল যখন ছেলেটি দু’- হাত ছেড়ে দিয়ে মোটর সাইকেল থেকে সম্পূর্ণ লাফিয়ে উঠে শূন্যে দুটো ডিগবাজি খেয়ে আবার সেই মোটর সাইকেলে চড়ে বসল অবলীলায়।
মোটরসাইকেল ও তার চালক উভয়ে যখন নিজেদের কসরৎ দেখিয়ে গাছ তলায় রহিম আর লুতফরের কাছে গিয়ে থামল তখন যেন মনে হল বিকট শব্দ থেকে পৃথিবী বুঝি নিষ্ক্রমণ লাভ করল। মাঠের ভিতর ধোঁয়া ক্রমশ যেন হালকা হচ্ছে। ক্রমশ পশ্চিমের সূর্যও মজে আসছে একটু একটু করে।
এক গাছতলায় একসঙ্গে চণ্ডী, রহিম আর লুতফর। দূর থেকে দেখে যেন মনে হচ্ছে একছাতার তলায় তিনজন। সমবয়সী। সমমনস্ক।
কতক্ষণ থেকে তারা একসঙ্গে কী নিয়ে যে হাসিঠাট্টায় মশগুল তা দূর থেকে বোঝা ভার। বোঝার চেষ্টাও করে না কেউ। এই বয়সী ছেলেরা যে একসঙ্গে থাকলে একটু গুজগুজ-ফুসফুস করবে তাতে আর বিস্ময়ের কী?
চায়ের দোকানে বসে দীর্ঘক্ষণ ধরে একমনে নিরীক্ষণ করছিলেন ভদ্রলোকটি। এবার দোকান ছেড়ে উঠলেন। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন গাছতলায় মোটর সাইকেলের ওপর বসে থাকা ছেলে তিনজনের দিকে।
ভদ্রলোক ঠিক মাঝবয়সী না, বরং তার চাইতে একটু বেশি বয়স্ক বলেই মনে হল। সারা মুখে অসংখ্য পক্সের দাগ। কানের দুপাশে জুলফি-জোড়া সম্পূর্ণ সাদা। নাকটা টিঁকালো। গলার স্বর বেশ গম্ভীর প্রকৃতির। ভদ্রলোক এসেই কোনও ভণিতা না করে বললেন, আমাকে তোমরা চিনবে না। এখানে বিশেষ এক দরকারে আজই আমার প্রথম আসা। আমি সহদেব সামন্ত। একটা ছোটখাটো সার্কাসের দল চালাই।
চণ্ডী, রহিম আর লুতফর কী বলবে সেই মুহূর্তে বুঝতে না পেরে এ ওড় মুখের দিকে তাকাতাকি করতেই ভদ্রলোক চণ্ডীর দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার নাম?
শেষ কবে কার কাছে নিজের নাম যুত করে বলেছে চণ্ডী স্মরণে আনতে পারল না। সে একটু তুতলিয়ে বলল, চো-চো-চণ্ডী।
--কী কর, পড়াশুনো?
চণ্ডী প্লুত স্বরে উত্তর দিল, অ্যাপ্রেন্টিস। মোটর গ্যারেজের।
ভদ্রলোকের চোখ দুটো যেন কুঁচকে এল। সঙ্গে সঙ্গে নাক টেনে যেন একটা হালকা গম্ভীর শব্দ করলেন।
অতঃপর একটু সময় নিয়ে চণ্ডীর উদ্দেশ্যে বলতে শুরু করলেন, তার মানে মোটর সাইকেল গ্যারেজে… না। না। ও তোমার কাজ নয়। তোমার আর তোমার এই বাহনের যেটুকু কসরৎ দেখলাম, তাতে আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি, তোমার মধ্যে অনন্য প্রতিভা রয়েছে। শিল্পীর প্রতিভা। যে প্রতিভার প্রদর্শনে তুমি কেবলমাত্র অর্থ নয়, নাম-যশ সব করতে পারবে…।
ভদ্রলোক রীতিমত ছোটখাটো লেকচার দিয়ে ফেললেন। যার একটা বর্ণও চণ্ডী কেন রহিম আর লুতফরের মাথায় ঢুকল কিনা বোঝা মুশকিল।
আর হ্যাঁ। তোমার এই বাহনটি কিন্তু খুব সুন্দর। তবে বড্ড ন্যাড়া। কী গাড়ি এটা?
কী গাড়ি? কী বলি বলুন তো? এ হল রিনিউ। আমার দেওয়া নাম। অ্যাসেম্বলিং মোটর বাইক। মৃদু হাসতে হাসতে উত্তর দিল চণ্ডী? ইঞ্জিনটা বুলেটের, চাকা দুটো সিবিজেড-এর, লাইটের পোরশানটা হোন্ডার, আর অন্য সব যখন যা যুতসই খাটে। তবে এই অ্যাসেম্বলিংটা একদম আমার নিজের হাতের। এমনকি…
চণ্ডী আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু ভদ্রলোকের গাড়ির গঠনগত বিষয়ে খুব একটা আগ্রহ আছে বলে মনে হল না। তিনি ঠিক সেই মুহূর্তেই চণ্ডীর কথা থামিয়ে বললেন, এখানে থেকে জীবন নষ্ট করে লাভ কী? তার চেয়ে বরং আমাদের দলে চলে এস। মাসে মাসে আট হাজার টাকা দেব। প্রতি শোতেও কিছু ইনসেন্টিভ পাবে। তার সঙ্গে থাকা খাওয়া তো আছেই। রাজী হলে বলো। আমি আগামী শনিবার আবার আসব। এই একসপ্তা ভাবার জন্যে সময় পেলে।
ধুর! চণ্ডী যেন গা ঝাড়া দিয়ে উঠল। আমাদের চোদ্দ পুরুষের কেউ কখনও সার্কাসে নাম লেখায়নি। তাছাড়া আমি খেলা দেখাবোই বা কী? গাড়ির ওপরে উঠে ডিগবাজি খাওয়া-– এ আর এমন কি কঠিন কাজ!
ভদ্রলোক ধীর গলায় বললেন, কার দিয়ে কী হবে, সে আমি বেশ জানি। এক সপ্তাহ সময় তো পেলে। ভাবো। এই নাও আমার কার্ড, বলে শার্টের পকেট থেকে একটা ভিজিটিং কার্ড চণ্ডীর হাতে দিলেন। এখানে আমার ফোন নম্বর আছে। প্রয়োজনে ফোন করে নিতেও পারো—- একথা বলে যে দিক থেকে এসেছিলেন সে দিক দিয়েই চলে গেলেন ধীর পায়ে।
লোকটি চলে যেতেই চণ্ডী যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। রহিম আর লুতফর একসঙ্গে বলে উঠল, তোর জীবন মনে হচ্ছে বর্তে গেল রে চণ্ডী।
রাত্রে বাবার সঙ্গে খেতে বসে বলব না বলব না করেও বিকেলের ঘটনার অনুপঙ্খিক বিবরণ দিল চণ্ডী। চণ্ডীর মা সব শুনে উৎফুল্ল হয়ে বলল, হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলা ঠিক হবে না। তুই কালই লোকটাকে ফোন কর। বল রাজী আছিস।
চণ্ডীর মা’র উৎসাহ দেখে তার বাবা আর নিজের মতামত প্রকাশের কোনও সুযোগই পেল না। কেবল একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, বছরে ক’দিন ছুটিছাটা আছে, সেসব ভালো করে শুনে নিস। ঘরে থাকলে তো আর আয় করা যায় না!
শনিবার বিকালে যথা সময়ে ভদ্রলোক আসলেন চণ্ডী, রহিম আর লুতফরের মাঠে আসার অনেক পরেই। চণ্ডী কিছুটা জোর করে হলেও মোটর সাইকেলের পিছনে বসিয়ে ভদ্রলোককে নিয়ে গেল তার বাড়ি। পরিচয় করিয়ে দিল তার বাবার সঙ্গে। ঘরের ভিতর থেকে মা শুনল বাবা ছেলে ও সার্কাস মালিকের কথা।
শীতের খুব বেশি দেরি নেই। শিউলিতলা রুক্ষ হয়ে উঠেছে। শিমুলগাছের পাতা হলুদ হয়ে যত না তার শাখায় রয়েছে তার চেয়ে বেশি মাটির ওপরে। ক’দিন আগেও যে কোকিলের ডাক অনবরত কান-মাথা ঝালাপালা করে দিত তারা সব যেন লুকিয়ে পড়েছে। আকাশ যেন আরও অনেক উপরে উঠে গেছে। সে এখন কেবল নীলাভ। ভাসা ভাসা মেঘের অস্তিত্বও আর নেই।
চণ্ডী রাজী হয়ে গেল। রাজী হওয়ার পিছনে কি ওর নিজের কোনও ইচ্ছে ছিল না? মনে মনে সে প্রশ্ন করল নিজেকে। কেবল গাড়ি সারাই! সে যে বিভিন্ন মডেলের পার্টসপত্র দিয়ে-- একদম ফেলনা মালপত্র দিয়ে এরকম জবরদস্ত একটা গাড়ি বানিয়েছে, তার কি কোনও গুরুত্ব নেই? আজ পর্যন্ত কোনও মেকানিক আছে, যে এক মডেলের মাল অন্যটাতে দিয়ে ফিট ক’রে নিয়েছে? হ্যাঁ, তার জন্যে তাকেও খড়কুটো কম ব্যয় করতে হয়নি। এই গাড়িটার জন্যেই তো কতবার সাহেবের লেদের কারখানায় ছুটতে হয়েছে তাকে। নিজের হাতের ফিটিংস রিনিউ-এর কথা ভাবলেই তার মন বরাবরই কেমন যেন খুশি হয়ে ওঠে। আর আজ সেই খুশিটাই যেন একটু বেশি রকম অনুভব করল সে। মনে মনে উম্ম্ করে চোখ বন্ধ করে রিনিউ-এর অয়েল ট্যাঙ্কে চুমু খেয়ে নিল চণ্ডী।
সামসেরের গ্যারেজের কথা ভুলে কলকাতার পার্কসার্কাসে চলে গেল চণ্ডী। সামনের সিজনের মহড়া চলছে প্রতিদিন। একসপ্তাহ না যেতেই হঠাত চণ্ডীর মনে কেমন যেন অন্য ভাবের উদয় হল। সে ম্যানেজারের ঘরে গিয়ে বলল, আচ্ছা, এই যে আমাকে টিমে রাখা হল, সেটা কি কেবল আমাকেই, নাকি আমার ওই রিনিউকেও?
ম্যানেজার হাসি মুখে বললেন, যে গাড়ি চালাতে জানে সে সব গাড়িই চালাতে পারে। অবশ্যই তোমাকে। তোমার ওই যে ভোল্ট খাওয়ার ক্যারিশমা, মোটর বাইকের চাকা তুলে চালানোর ক্ষমতা— তার জন্যেই তো…
চণ্ডীর মুখটা যেন তৎক্ষণাৎ পাংশু বর্ণের হয়ে উঠল। মৃদু প্রতিবাদের স্বরে বলল, তার মানে আমার রিনিউ-এর কোনও মূল্যই নেই এই টিমের কাছে?
ভদ্রলোক আরও কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু চণ্ডী সে কথায় কর্ণপাত না করে ম্যানেজারের সামনে থেকে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এসে সোজা তাঁবুর ভিতর ঢুকে পড়ল।
তাঁবুর এককোণে যেখানে তার খাটিয়া পাতা থাকে, তারই মাথার কাছে রাখা থাকে রিনিউ। খাটিয়ার ওপর বিস্রস্তভাবে ছড়িয়ে আছে তার জামা, গেঞ্জি, প্যান্ট, গামছা, ছোট্ট কালো ব্যাগ-- সবই। চণ্ডী সেগুলোর দিকে তাকাতে একটা শুকনো হাসির রেখা তার ঠোঁটের কোণে জেগে উঠতেই যেন মিলিয়ে গেল। রিনিউ-এর কাছে গিয়ে হাত বুলাল সে। বিড়বিড় করে বলল, যেখানে রিনিউ-এর সম্মান নেই সেখানে চণ্ডীরও কোনও স্থান নেই। ‘চল রিনিউ’, বলে পকেট থেকে চাবি বের করে রিনিউ-কে অন করে হুউউম—হুউউম স্বরে দু’বার এসক্যালেটর মোড়া দিয়ে হুঁশ করে মোটরবাইক চালিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর তাঁবু থেকে। রিনিউ-এর বিকট চিৎকারে আর সাদা ধোঁয়ায় তাঁবুর ভিতর যারা ছিল তারা ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল।
চণ্ডী হুস ক’রে বেরিয়ে যেতেই তাঁবুর ভিতরে থাকা কেউ একজন যেন তার নাম ধরে চিৎকার ক’রে গাল পাড়ল, কিন্তু সে শব্দ চণ্ডীর কাছে অশ্রুত হয়েই থেকে গেল চিরকাল।
চিত্র-সৌজন্য— গুগল
=======================
সাইকেল
দীপঙ্কর বেরা
সাইকেলটা ভাল করে তেল লাগিয়ে মুছে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে রাখে দীপক। ঘরে গিয়ে ভাল করে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে মিঠুকে বলে - দাও। এক কাপ চা দাও।
চা বাড়িয়ে দিতে দিতে মিঠু বলে - কি যে একটা ভাঙা সাইকেল পেয়েছো, এবার অন্য কিছু ভাবো?
দীপক এ নিয়ে অনেক কথা বলেছে। তবু চায়ে চুমুক দিয়ে বলে - কেন পেছনে লেগে আছো? অন্য মানে তো চারচাকা। তা ভাবতেই পারি।
বেশ উৎফুল্ল হয়ে পাশে বসে মিঠু। গায়ে ঢলে পড়ার মত করে বলে - কবে নিচ্ছো?
দীপক আবার গোড়া থেকে গান করে। বলে - প্রথমে দেখতে হবে গাড়ি আমাদের কি কি কাজে লাগবে? ছেলেমেয়ের স্কুল হাঁটা পথে। আমার অফিসে গাড়ি নিয়ে যাওয়ার মত আমি পদাধিকারী নই। তোমার বাপের বাড়ি বা কোথাও বেড়াতে যাওয়া সেও নয়ে ছয়ে। তাহলে?
মুখ বেঁকিয়ে এক প্রকার ঠেলা দিয়ে উঠে গেল মিঠু। ঠেলার চোটে চা পড়ে যাচ্ছিল তাও মনে মনে হাসতে হাসতে সামলে নেয় দীপক।
ভাড়া বাড়ি। গাড়ি বা মোটর সাইকেল রাখার জায়গা আছে। সাইকেল রাখতে দেয় না। বলে নাকি প্রেস্টিজ চলে যাবে। বাধ্য হয়ে বলে কয়ে রেখেছে। তাও মাঝে মাঝে হাওয়া খুলে দেয়। বেল খুলে নেয়। দীপক এসব পাত্তাই দেয় না।
বেরিয়ে পড়ে সাইকেল নিয়ে। হ্যান্ডেলের দুদিকেই দুটো বাজার করা ব্যাগ। সবসময় রাখা থাকে। হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়া বাজার করে সহজেই ফিরতে পারে।
আশেপাশে সমস্ত গলি চেনা। কোথায় ভালো সেলাইয়ে দোকান, কোন ছেলেটা ভালো জুতো পালিশ করে, কোথায় ফলস পিকো হয়, কোথায় চমৎকার চা বানায়, কোথায় বই পাওয়া যায়, কোথায় খাতা পেন, কোথায় সুন্দর ঝকঝকে জেরক্স হয়, ডাক্তারের খোঁজ, মোবাইলের দোকান, ভাল মাংসের দোকান ইত্যাদি আশেপাশে সব সব দীপকের চেনা জানা।
আস্তে আস্তে প্যাডেল করতে করতে গঙ্গার পাড়ে গজিয়ে ওঠা মানুষের বস্তি দেখেছে, মারামারি দেখেছে, আড়ি দেখেছে, ভাব দেখেছে, দেখেছে ঠাকুর দেবতার কাঠামো চুপচাপ ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।
এসব কথা অনেকবার অনেক ভাবে বলতে চায় দীপক। কেউ শোনে না। একটু শুনে বলে - মানুষের কত কাজ। এইসব ফালতু ব্যাপারে সময় নষ্ট করা বৃথা।
ফালতু? বৃথা? তাহলে আসল কি? উন্নতমানের হাজার বাহনের যুগে এই সাইকেলও কি বৃথা। দীপকের মত।
অথচ কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে। ছোটবেলায় পায় নি বলে চালানো শিখতে পারে নি। পরে শহরতলিতে চলে এল। নিজের দু চার পয়সা রোজগারে সাইকেল কিনে লুকিয়ে অন্ধকার মাঠে শিখত। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা জানতে পেরে কি প্যাঁক দিত। দীপক ওসব নিয়ে ভাবত না।
সেই প্রথমবার সাইকেল নিয়ে বড় রাস্তায়। সামনের একটা পুটকি ছেলে পা ঢুকিয়ে প্যাডেল করে আসছিল দীপকের বাঁ-দিক দিয়ে। দীপক ভাবল বাঁ-দিক দিয়ে ও বেরিয়ে যাবে। কিন্তু খুব দ্রুত দীপকের ডানদিকে আর ওর বাঁ-দিকের সঠিক রাস্তায় চলে এল। ফলে ধাক্কা লাগল। কারো কিছু হয় নি। লোকজন ছিল না। তাই ছেলেটাকে বুঝিয়ে দীপক জোরে সাইকেল চালিয়ে পালায়। গা দিয়ে ঘাম বেরিয়ে গেল।
কিছু শিখতে পারে নি। মোটরসাইকেল চারচাকা বাস লরি ট্রাম ট্রেন প্লেন কিছুই না।
বছর পনের আগের এক পুজোর মুখে এই সাইকেলে এক বিকেলবেলা এক কুকুরকে বাঁচাতে গিয়ে অন্য এক চারচাকার ধার ঘেঁষে আসা থেকে বাঁচতে মিঠু দীপকের সামনে চলে আসে।
দীপক ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে যায়। চোখে চোখ হয়। আর গড়গড়িয়ে জীবনের এতটা পথ চলে এল।
মিঠু ভুলে গেছে। দীপক ভোলেনি। ভুলেনি যেদিন মেয়ে নৈনি মাঝরাতে পেট ব্যাথায় ছটপট করেছিল আর এই সাইকেলে বসিয়ে সহজেই ডাক্তার দেখিয়ে ফিরেছিল। আর ছেলে রুহাকে অলিগলি পেরিয়ে টিউশনে নিয়ে যেতে হয়।
দুটো বাজার ভর্তি থলেসহ সাইকেল রাখার জায়গায় এসে দেখে ঝাড়ুপোচা ড্রাম ঝাঁটা ডাঁই করে রাখা। ফ্ল্যাটের কেয়ারটেকার এমনিতে ভালো ব্যবহার করে, সমীহ করে ৷ কিন্তু সাইকেল পছন্দ করে না। বলে - বাবুদের এসব মানায় না।
ও বোধ হয় এসব করেছে। কি আর করা যাবে। জিনিসপত্র সরিয়ে সাইকেল রেখে ঘরে ব্যাগদুটো রাখতেই মিঠু খ্যাঁক করে উঠল - এই তোমার আসার সময় হল ?
- আরে বাবা! আজ রবিবার। আর তুমি তো জানো, আমার বাহনে চেপে আজই তো বিশ্ব ঘুরে দেখার সময় পাই।
নৈনি আর রুহা ঘরেই ছিল। হ্যা হ্যা করে হেসে উঠল। বলল - মা দুর্গার মত। আগমন হলেই সিংহ থুড়ি সাইকেল বাহন।
সোফায় বসে দীপক। কেউ জলটুকু বাড়িয়ে দেয় না। নিজে বোতল থেকে জল খেয়ে বলে - নৈনি, ভুলে যেয়ো না মানুষের সবচেয়ে বড় বাহনের নাম এগারো নম্বর ।
- এগারো নম্বর?
দীপক বলে - আমাদের পা। পায়ে হেঁটে কত পথ পাড়ি দিয়েছি। যখন কোন যানবাহন আসেনি।
জানে আর কেউ শুনবে না। যখন এ রকম ভাবুক মনের বিস্তার ঘটে তখন কেউ শোনে না। দীপক তার অফিস মত কাজের জায়গাতেও এমন কি না কথা বলা রহস্যের জালে। কেউ বুঝতে চায় না। দীপকও বোঝাতে পারে না মনের এই আকাশ কথা।
তাই একদিন রুহা প্রতিষ্ঠিত হয়ে দীপকের সহযোগিতায় নিজের বাড়ি করল, গাড়ি করল। ঘরে এল খুশির জীবন। তখন খুশি হয়ে দীপক বেরিয়ে পড়ল সাইকেল নিয়ে। ভাঙড়িতে কিছুতেই বেচতে দেয় নি।
মাঠ ঘাট শহর গ্রাম সবুজ গাছগাছালি ছাড়িয়ে দূরে আরো দূরে চলেছে দীপক। প্যাডেল করেই যাচ্ছে করেই যাচ্ছে কিন্তু কোন কষ্ট নেই। একটু খিদে লাগছে না। জল তেষ্টা পাচ্ছে। মনের কোনে স্পষ্ট ভেসে উঠছে বাবা মা। যারা কোনদিন পায়ে হাঁটা ছাড়া আর কোন বাহনে যানে চড়েনি। তাদের দৌলতে আজ যানবাহন দীপকের। সব পেছনে পড়ে রইল। দীপকের পছন্দের সাইকেল তাকে আজ পৌঁছে দিচ্ছে শেষ জীবনের পথে।
=======================
বাহন বিড়ম্বনা
রাণা চ্যাটার্জী
"এবার অন্তত একটা বাইক কেন তুই কাজল", পিঠ চাপড়ে কিছুটা তাচ্ছিল্য করে সেদিন স্টেশনে বলেছিল প্রাণকৃষ্ণ । ট্রেন থেকে নেমে স্ট্যান্ডে দুই স্কুল বন্ধু নিজের নিজের বাহন বের করতে গিয়ে নানা কথার মধ্যেই কাজলকে আর একধাপ উঠে প্রাণকৃষ্ণ, "কি রে,নাহয় বল আমি সহজ কিস্তিতে ব্যবস্থা করছি গাড়ির লোন" । প্রত্যুত্তরে কাজল বিনয়ের সঙ্গে জানিয়েছিল, '' কিচ্ছু দরকার নেই ভাই, আমার পুরনো সাইকেলটা ছিল আবার গত পূজায় এই নতুন সাইকেলও কিনেছি"। শুনে প্রাণ এমন একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিল যেন কাজলটা কি না বোকা!
প্রাণ আর কাজল একসাথে স্কুল ও কলেজে পড়াশোনা করেছিল তারপর চাকরি সূত্রে দুজনের পথ আলাদা হয়ে যায় । কাজল স্বাস্থ্য দপ্তরের একটা প্রজেক্টে দিল্লিতে থাকার পর প্রায় বারো বছর পর ফিরেছে নিজের শহর বর্ধমানে। এখন তার কলকাতায় নতুন কাজ। কাজল প্রাইমারি স্কুলে চাকরির সুবাদে প্রতিদিন ডানকুনি যায় আর সেই সূত্রে মাঝে মধ্যে দুই বন্ধুর ফেরার পথে দেখা হয়।
প্রাণ তার বাবার পুরনো বুলেট গাড়িটা স্টার্ট দিয়ে আজও কাজলের সাইকেলের দিকে তাকিয়ে কি যেন বলতে যাচ্ছিল, কাজল গ্যাস বেলুনে পিন ফোটানোর মতো বলল, "বলি প্রাণ,যা দিন কে দিন কোলা ব্যাঙ হচ্ছিস বরং একটা সাইকেল কেন, ভালো ব্যায়াম হবে বুঝলি বন্ধু"।কোনো সাড়া না দিয়ে প্রাণ কেটে পড়তেই হো হো করে হেসে উঠল কাজল। এমনভাবে জব্দ না করলে এমন ধাতের মানুষগুলো বড্ড বেড়ে যায়, হিতাহিত জ্ঞান থাকে না কাকে কখন কি বলছে!
কাজলের ঠিক এটাই খারাপ লাগে, সে বোঝে আজকাল সবটাই প্রয়োজন ও অপ্রয়োজনীয়তার নিরিখে বিচার না করে স্ট্যাটাস দিয়ে মানুষকে দেখা হয়। একজন সাইকেল চাপছে মানেই তাকে নিচু দেখার কেমন যেন একটা প্রবণতা। একটা সহানুভূতি ঘুরপাক খায় মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে, যেন কেনার ক্ষমতা নেই, বেচারা গরিব এমন একটা ভাবনা অন্যদের বিষয়ে ভেবে নেওয়ার ভুল প্রবৃত্তি কাজ করে । অথচ দূষণ বিহীন, চালানোর পক্ষে বেশ ভালো এমন একটি দ্বি-চক্রযান সাইকেলের ভূমিকা নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠতেই পারে না পৃথিবী জুড়ে,বরং সাইকেলের প্রশংসার জুড়ি মেলা সত্যি ভার।
আজকাল এই ভাবনাগুলো মানুষের দৃষ্টিতে ঘুরপাক খায়, বরং কমার থেকে অন্যকে আন্ডার এস্টিমেট করার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে । পাশের বাড়ির ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রটি পড়াশোনা কমপ্লিট করে যখন টিউশন শুরু করল তার কাছে সন্তানদের পড়ানোর ইচ্ছা পোষণ করেও কাজল অভিভাবকদের মুখে শুনেছে অনির্বাণ স্যার খুব ভালো কিন্তু ওই যখন সাইকেল নিয়ে পড়াতে যায় তাদের নাকি অস্বস্তি হয়। খুব আশ্চর্য লেগেছে শুনে কাজলের, পরে নিজেকে সান্ত্বনা দিতে ব্যাখ্যা দিয়েছে, হ্যাঁ, প্রেস্টিজ তো লাগবেই, বিশাল সব মার্বেল খচিত
প্রাসাদের নিচে সাইকেল স্ট্যান্ড করা থাকলে স্ট্যাটাসের দফা রফা, তারপর স্কুলে যদি জানে কোনো এক গরিব মাস্টারমশাই পড়াতে যায় সাইকেল নিয়ে, সত্যিই তো মান সম্মান সব জলাঞ্জলি।
যারা সাইকেল চাপে তারা বেশ বোঝে এই বাহনটি কাছে পিঠে যাওয়ার জন্য বেশ ভরসা যোগ্য, যথেষ্ট খরচবিহীন পরিবহনের সেরা ভূমিকায় ৷ তবু একে কেন্দ্র করেই ঘুরপাক খায় একটা অবজ্ঞার চাহনি । এটাই কি তবে আমাদের সাধের ভারতবর্ষের সার্বিক চিন্তা ভাবনা! কাজল নিজেও কাজ বা বাজারে সাইকেল নিয়ে বেরুলে কেমন যেন একটা ভেতরে গিলটি ফিল করে! অথচ এটা তার কাছে অতিবাস্তব ঘটনা যে, তার দু'বেলা সেই সকাল আর সন্ধ্যায় ট্রেন চেপে স্কুল যাওয়া, বাড়ির সামনে স্টেশন তাতে বাইক অপ্রয়োজনীয়।কেবল হয়তো ছুটির দিনে ব্যবহার হবে, কিন্তু সে তো ওই দু'দিন তার স্ত্রী কন্যার কাছে যায় প্রায় দেড়শ কিমি দূরত্বের অন্য শহরে! সুতরাং তার বাইক নিত্য ব্যবহারের পরিবর্তে অকেজো হয়ে নষ্ট হবে বেশি।
আজকাল যে জিনিসটা মানুষের প্রয়োজন সেটা কেনার জন্য অত্যন্ত সহজ শর্তে ঋণ পাওয়া যায়। সেই কারণেই গরিব বস্তির মানুষগুলোও ঝুপড়িতে সহজ কিস্তিতে টিভি ,ফ্রিজ ,কুলার যা কিছু আধুনিক সরঞ্জাম কিনে ফেলছে। কাজলের সুপ্ত ইচ্ছে আছে যদি ট্রান্সফার নিয়ে সে ও বহু দূর জেলায় পড়ে থাকা তার সহধর্মিনী হোম টাউনে ফিরতে পারে তখন তো অবশ্যই কিনবে বাইক ৷ কিন্তু এই মুহূর্তে বাইক বা স্কুটি সত্যিই তার কাছে বোঝা। মানুষ তার প্রয়োজন অনুসারে কিনবে বাহন বা অন্যান্য কিছু, তার মানে এই নয় যে, সে সাইকেল চালাচ্ছে বলে তাকে হেয় করতে হবে বা সে বড্ড গর্হিত কাজ করছে!
একবার গরমের ছুটিতে মেয়েকে নিয়ে পার্কে গেছিল কাজল। সেখানে ছোট্ট সন্তান খেলতে খেলতে তারই ক্লাসের বন্ধুকে খুঁজে পায়। দুজনে চরম হুটোপুটি শেষে সন্ধ্যা নামতেই যখন তার মা স্কুটি স্টার্ট দিল, কাজল মেয়ের দৃষ্টি ঘোরাতে কিছুক্ষণ মাঠে ফুটবল খেলায় মন দিল।একমাত্র কাজলই জানে তার এমন সুকৌশল অবলম্বনের কি কারণ ! আসলে ওদের সামনে সাইকেল বের করে মেয়েকে চাপিয়ে নিয়ে আসতে তার যেন কোথায় একটা কুণ্ঠা বোধ কাজ করেছিল। সে ভেবেছিল তাকে নিয়ে যা বলে লোকে ভাবুক, কিন্পু এর প্রভাব যেন খুদে বাচ্চার মনে না পড়ে তাদের ক্লাসের বন্ধুদের ভাবনার মধ্যে।বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও এটাই আমরা , এটাই আমাদের ভাবনার পরিমণ্ডল। "ও বাবা চলো গো, মা চিন্তা করবে,ঠাম্মার সন্ধ্যা আরতি দেখবো তো"! কন্যার ডাকে সম্বিত ফিরতেই ঝেড়ে মেরে উঠেছিল কাজল যা আজও তার মনকে নাড়া দেয়।একদিন ছোট্ট কন্যা হঠাৎ ন্যানো গাড়ির কথা প্রশ্ন করে কাজলকে। "কেন রে কি করে শুনলি" বলতেই বাবাকে জড়িয়ে আবদার এল, "বাবা আমাদের গাড়ি কিনবে না! কাল প্রিয় বান্ধবী অনুসূয়ারা গাড়ি কিনে ক্লাসে সব্বাইকে খুশি হয়ে খবরটা দিচ্ছিল"।
"কই গো আজ তো বাজার যাব, বেশ কিছু কেনাকাটা আছে তুমি কি পারবে ফেরার পথে বাজার আসতে"? সহধর্মিনীর প্রশ্নে সায় দিতেই আবার অনুরোধ ভেসে আসে, '' যাই হোক ঐ সাইকেল নিয়ে আসবে না কিন্তু, প্রয়োজনে আজ টোটো করে স্টেশন যাও"। কি কারণ বা বৃত্তান্ত আর জানতে চায় নি কাজল, ভেতরে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেছিল। গত বার এমন একদিন বাজারে পাশে পাশে সাইকেলটা নিয়ে হাঁটছিল ওরা দুজনে, হঠাৎ ওয়াইফের এক কলিগ সামনে পড়ে যায়। যখন স্ত্রী তার হাজব্যান্ডের পরিচয় করাচ্ছিল ওই কলিগের মুখে কেমন যেন একটা তাচ্ছিল্য ভাব , বেশ বুঝেছিল কাজল ও তার স্ত্রী আসল গুণ যাই হোক মানুষের, বাহ্যিক চাকচিক্য বিচার করার প্রবণতা।
তবু এটা তো মানতেই হবে সময়ের তালে তাল মিলিয়ে মানুষের সখ আহ্লাদ এটা থাকাও জরুরি। তাই প্রায় একবছর হল যে স্কুটি কিনেছে কাজল, নিয়ম করে স্টার্টও দেয় পাছে ব্যবহারের সুযোগ না থাকায় ওটাতে জং না ধরে। লক ডাউনে অফিস দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় স্কুটির ব্যবহার বেড়েছে নানা কাজে যাওয়ার জন্য, কিন্তু সাইকেল জং ধরে একপ্রকার অকেজো অবস্থায়, যা এক মহা মুশকিল। তাই ঘরে ওভাবে সাইকেলটা ফেলে আরও নষ্ট না হয় তাই ভালো ভাবে সার্ভিসিং করে কাজের দিদিকে দিয়েছিল তার ছেলে ব্যবহার করবে এই আশায়।মানুষ এক ভাবে আর হয় অন্য, দুদিন কাজের দিদি কামাই করায় সে বাড়িতে আসে নি কেন খোঁজ নিতে গিয়ে কাজলের চোখ কপালে ওঠে। সে দেখে তার দেওয়া সাইকেলটা দু টুকরো হয়ে উঠোনে হতশ্রী অবস্থায় পড়ে আছে। দেখে বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে তার, ইস তার প্রিয় বাহনের শেষে কিনা এমন ভগ্ন দশা দেখতে হলো তাকে!এই কিনা সম্মান প্রদর্শন!
সময়ের সাথে সাথে পুরনো জিনিস বাতিল করতে হয় এটা ধরে নিয়েও সাইকেলের গুরুত্ব যে কি তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আজ সারা বিশ্ব এই দূষণবিহীন অত্যন্ত সহজ পরিবহনের বাহন সাইকেলকে বেশি বেশি বুকে টেনে নিচ্ছে নির্দ্বিধায়। বড়ো বড়ো মহারথী, নেতা মন্ত্রী রাষ্ট্রপ্রধানগণ তাদের পার্লামেন্ট যাওয়ার বাহন হিসাবে সাইকেলের ব্যবহার বাড়িয়ে চলেছে আর আমরা স্বাধীনতার পঁচাত্তরতম বছর অতিক্রম করে অন্যদের যা খুশি বলে নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভেবে আনন্দ পাই। লকডাউনের পরবর্তী কালে সামগ্রিক পরিবহন ব্যবস্থা স্তব্ধ থাকার সময় প্রচুর মানুষ তাদের যাতায়াতের সুবিধার জন্য সাইকেলের উপর শরণাপন্ন হয়। সেই সময় বেড়ে যায় সাইকেল কেনার হিড়িক, যা দেখে কাজল ভীষন খুশি হয়।সেও একটা কিনে ফেলেছিল বাহন সাইকেল, যা স্কুটির পাশে রেখে এখন খুব খুশি।নতুন সাইকেল কাজলের মধ্যে জমা ক্ষতগুলো মুছিয়ে দিয়েছে অনেকটা। কাজলের গর্ব করে বলতে ইচ্ছা করছে , "হ্যাঁ! আমি এখনো সাইকেল চালাই"।
=======================
কি সুন্দর। আরও পড়ছি।
ReplyDelete