মায়াজাল
দুলাল প্রামানিক
কবেকার স্মৃতি ঘেরা আমার শৈশব
বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া দিন
একদিন ভাবনারা দিশেহারা পথে
ফিরে ফিরে আসে ঘুম ঘুম চোখ
দৃষ্টি বিভ্রম সত্যি না মিথ্যে স্বপ্ন
বাস্তবের বাসরে মিথ্যে মিরের কাজল
আঁজলা ভরে অসহায় অস্তিত্বের মাঝে
মায়াজাল বুনি বুনোটের ফ্রেমে
দিক্-ভ্রান্ত পথিকের উদ্ভ্রান্ত চোখ
স্মৃতি ঘেরা শৈশবের অতল গহ্বরে
হারিয়ে যেতে যেতে ভাসি শেওলা হয়ে
গদ্যময় পূর্ণিমার চাঁদ খাটে বারোমাস ।
=======================
শিউলির বারমাস্যা
গদাধর দে
বারো মাসই শিউলি ফোটে বারোমেসে গাছে
নিত্যদিন মাও তোদের এই ঘরেতেই আছে ।
বারোমাসে তেরো অবস্থা চেয়ে দেখ তার
কর্মাসুরের নিধনলীলা দেখবি কত আর।
শরতের সে শিউলি-পথে কন্যা আসতে চায়
কন্যা কিংবা জায়াতে দেখনা
দুর্গা মায়।
আমার ঘরের কন্যা সে
অন্যের জায়া
আমার ঘরের জায়ায় দেখি
নিত্য মায়ের ছায়া।
সব সংসার হরের ঘর সংসার
জ্বালা নিয়ে
আনন্দ কয়দিন পাই শরত শিউলি দিয়ে।
শিউলির বারমাস্যায় শরৎ
ডাকে এসে
কন্যা জায়া মাতৃরূপ এক হয়ে
মেশে শেষে।
=======================
মন্থন
অম্লান বাগচী
পিছু পিছু এই যে ধাবন দ্রুত যার গতি
অথচ চোরাবালি থেকে কম কিছু তো নয়,
কিভাবে ভেঙে দেয় তোমার নিজ সংগতি
বইতে না পেরেই রাখি আমার বিস্ময়!
কে কার বাহন এ প্রশ্নে পরশ পাথর
আনুগত্য খোঁজে, যেমন দিন আর রাতি,
একে অপরের পিছু ঘুরে মুছাতেই ঘোর
বারিশ অনুগত হ'তে পেরেছে বর্ষাতি।
শিক্ষা গিয়েছে আগে তার পিছু নিয়ে আমি
আবর্তিত ছায়া গায়ে বুঝেছি সকালও,
দিবসের বাহন হয়ে চিরগোধূলিগামী
যেন দাবার ছকে প্রার্থিত সাদা ও কালো।
আমি কি সমাজ টানি নাকি সমাজ আমাকে?
লাগাম থেকে খসে গেছে যুক্তির ঘোড়াও,
প্রতিটি বহনের একটি স্রোতধারা থাকে
সে রেখা ধরেই নিজেকে চিনুক বাহনেরা।
=======================
অ-নাগরিক
বলাই দাস
ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পরিচয় পত্রহীন কতগুলো গাছ
তবু আছে শেকড়ের অমোঘ টান—
কুকুর কুণ্ডলী জীবন, বুভুক্ষু শিশুদের শুকনো করুণ মুখ
খোলা আকাশ ফুটপাত- হাটচালা রেলওয়ের প্ল্যাটফর্ম আস্তানা
স্বপ্ন দেখেনা মাটির নীচের স্বর্ণখনির
তবু অহরহ তাড়া দেয় পুলিশ প্রশাসন।
অনেকেই জানে না নিজের জন্ম ভিটে গোরস্থান
লাইগেশান্ ভ্যাসিকটমি—
চেনে না নেতা- মন্ত্রী, এম এল এ, এম,পি. অথবা স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটি।হয়তো একদিন সব ছিল- আজ উদ্বাস্তু যাযাবর
স্বাধীন দেশের পরিচয়পত্রহীন অনাগরিক ৷
উদরে আগুন জ্বলে, জ্বালাতে অক্ষম বিপ্লবের আগুন।
কাঁধে বাঁক দু'পাশে গোছানো অভাবী সংসার সম্পত্তি
নামমাত্র লজ্জাভূষণ, নেই কোন সঞ্চয় আমানত
মুছে গেছে জীবনের পৌষপার্বণ পূজা উৎসব
মিছিল হরতালে নেই, ওরা যেন গফুর আমিনা
নিঃশব্দ গভীর রাত নির্লিপ্ত ভাষাহীন চোখ অজানা স্রোতের
ভেসে আসা কচুরিপানা।
=======================
মাধ্যম
মৌমিতা পাল
স্বপ্ন দেখার নেশা ছিল তার দুই চোখে
স্বপ্নপূরণের জন্য করেছিল আত্মত্যাগ
করেছিল কতশত কঠোর প্রয়াস
স্বপ্ন পূরণ জন্য সঠিক মাধ্যম খোঁজে
ছিল তার নিরন্তর অনলস প্রচেষ্টা।
তবুও নিয়তির খেয়ালে
অবশেষে তাকে নিজেকেই
হতে হয়েছিল বাহন ; মাধ্যম
হতে হয়েছিল স্তাবক ; অনুচর
অন্যের খামখেয়ালী মনের
আকাঙ্খা মেটানোর দায়
তাকে নিতে হয়েছিল পিঠ পেতে।
স্বপ্নপূরণ হয়তো হয়েছিল
হয়তো কাছাকাছি পথ পাড়িও দিয়েছিল
কিন্তু তার জন্য অন্য কিছু নয়,
বাহন হতে হয়েছিল তাকে নিজেকেই,
দিতে হয়েছিল আত্মবলিদান।
পুরনো দিনের মতো ময়ূর এখন আসেনা,
যে কার্তিককে পৌঁছে দেবে তাঁর লক্ষ্যে
পেঁচার দেখা মেলেনা
এমনকি ইঁদুর, সেও গল্পকথা
আর পুষ্পক রথ কিংবা ময়ূরপঙ্খী নাও
সে তো অলীক কল্পনা।
এখন নিজেকেই বাহন হতে হয়
নিজেকেই বহন করতে হয়
স্বপ্নপূরণ করতে গেলে নিজেকেই
পথ খুঁজে নিতে হয়,
মাধ্যম হতে হয়।
এ যুগের বাহন তাই
স্বপ্নজাত কোন উপাদান নয়,
কঠোর কঠিন বাস্তব আর
জীবনে সঠিকভাবে বাঁচার
পথনির্দেশের মাধ্যম মাত্র।
=======================
এসো ভালোবাসার মন্ত্র পড়ি
বরুণ বসু
এই দেশ আলোময় এক চৈতন্যভূমি
এর মাটি, অরণ্য, পাহাড়, মরমীবাতাস
জাতপাত গন্ধহীন এক চন্দন-উপত্যকা
এই ভূমি ব্রজ-উচ্ছ্বাসময় এক অনন্য রূপকথা
আদিম অন্ধকার পুড়িয়ে সূর্যের উৎসব
প্রহরে প্রহরে আলোর দীপ্ত প্লাবন
এর আকাশ, বাতাস ঘিরে বাউল নূপুর নিক্কন
অনুক্ষণ মন্ত্রপাঠ অন্তরের গহনে গহনে
এ এক অলৌকিক অনুধ্যান ভূমি
সাম্যের অমৃতবীজ ছড়ায় মঙ্গলধ্যানে ৷
এই ভূমি ভারতভূমি চৈতন্যবার্তা পাঠায়
তমসা দীর্ণ করে সারা বিশ্বময়
মানুষ থেকে ঈশ্বরে উত্তরণ ঘটায়
এ ভূমি বুদ্ধতন্ত্রময় ৷
এই ভূমি বেদমন্ত্রময়
এর সৌম্য অরণ্য, বিভাবতী ক্ষেত
নদী ও নগরের আবাল্য আরতি
চেতনার মনোময় কোষ-অনুকোষে
প্রেমের পীযূষ-বার্তা, গৈরিক ফুল
মুঠোভরে দু' হাতে ছড়ায়
এখানে আল্লার আজান, খ্রীষ্টের প্রার্থনা, ঋক আরাধনা
মানুষের ধর্মে কর্মে মর্মে
অষ্টপ্রহর নন্দিত, বন্দিত — প্রতিধ্বনিময় ৷
এই ভূমি হিরণ্ময় এক বৌদ্ধবিহার
আজানে, সামগানে, দোহার টানে
কী অপরূপ এক অখণ্ড স্বর্গীয় ভূমি !
আহা কী রূপ ! পদ্মযোজন দীঘল মায়ের বুক
কী সুখ কী সুখ জ্যোৎস্নার গহীনে ডুব
নাও সবে শান্তিমন্ত্র অঞ্জলিভরে অমৃত গাহনে
সংহতির পবিত্র ওম ছড়িয়ে রয়েছে মৈত্রীবীজের ধ্যানে ৷
এসো অনাগত উত্তরসূরী, এসো ভালোবাসার মন্ত্র পড়ি,
এসো রক্তের ছন্দ, নাশ করি দ্রোহ - দ্বন্দ্ব — নির্মল মানুষ গড়ি
এসো ভালোবাসার মন্ত্র পড়ি
আমরা অভিন্নজাতি, উজ্জ্বলজ্ঞাতি— একই মায়ের ঘ্রাণ - প্রাণ
এ ভূমি ভারতভূমি,
মা-কে ভেঙেচুরে কোরো না খান খান ৷
=======================
পশুরাজ
ডা. মধুমিতা ভট্টাচার্য
দুর্গা মায়ের পায়ের কাছে,
আছেন বাহন সিংহ মশায়
বনের রাজা ,পশুর রাজা,
কেশরখানি মন ভুলায় ।
ছোট্ট মিনি দেখছে কেবল
বনের রাজা সিংহকে-
দেবীর সাথে এল সে যে
বাহনরূপে মর্তেতে।
দুর্গা মাকে দিচ্ছে প্রসাদ-
ফল ফলারি অন্ন যোগে,
সিংহ বাহন পাবেন কিছু
এরই সাথে মাংস যোগে ?
কালী থেকে গৌরী হতে
তপস্যাতে হলেন মগন,
সিংহ এলেন খাবার তরে
অবশেষে হলেন বাহন।
দেবীকে তিনি করেন বহন,
যে সে কথা নয় কো নয়-
পুরাণে দেবী ধর্মের প্রতীক ,
সিংহ — শক্তি ও প্রত্যয় ।
=======================
সম্মার্জনী
জগৎ পতি তা
সব কাজেতে সব সময়েই ভালো খুঁজি
আমার নেইকো কোনো তিথি,
তোমরা যেমন ভালো বোঝো আমিও বুঝি-
সময় - অসময়ে না আছে ক্ষতি ।
গ্রীষ্মের রোদে কাজ করাও যত খুশি
তাতে আমি নাহি কভু ডরি,
যদিও শীতের রোদে কাজ হয় বেশি-
পিকনিকে গেলে হইচই করি।
বর্ষাকালে ছাদের কোণে থাকি যখন একা
জুঁই ফুলের গন্ধে থাকি মেতে,
রজনী বলে নিঃসঙ্গ ভেবে হয়ো নাকো বোকা-
বিভোর হয়ে আমিও থাকবো সাথে।
শরৎকালে দেবী দূর্গার আগমন প্রাক্কালে
নিয়ম করে সংযত হয়ে থাকি,
সন্ধ্যাবেলায় যুক্তি করো কাটাও সক্কালে-
শুধু ভাবি মায়ের আসতে কত বাকি?
হেমন্ত আসার আগে কালী মা'কে মনে পড়ে
তোর রূপের ছটায় সবই দেখি কালো,
ক্ষ্যাপা বাবাও ধ্যানে থাকে, খেয়াল নাহি করে-
তোর রঙ্গ লীলায় সবই লাগে ভালো ।
অন্নপূর্ণার আহ্বানে লিপ্ত থাকি দিবারাত্র
ক্ষেত-খামার জুড়ে যত কাজ,
তৃপ্ত করি গৃহলক্ষ্মীকে শান্তি রচি সদা সর্বত্র-
ছুটে ফিরি শীতে ঊষা হতে সাঁঝ ।
বসন্তের ঐ আবির মেলায় মত্ত যখন নগরবাসী
আমি ছুটি শিমুল পলাশ বনে,
শিব-গাজনে মগ্ন যত সন্ন্যাসী রাশি রাশি-
সনাতনীর ছন্দে নববর্ষ সনে।
=======================
আমার বাহন
দর্শন সাহু
মায়ের বাহন সিংহ রাজা
বাবার বাহন নন্দী
আমার বাহন সাইকেল মশাই
দিনরাত আঁটে ফন্দি।
মিষ্টি হাওয়ায় গা ভাসিয়ে
যেই ছুটবো জোরে
ঘ্যাচর ঘ্যাচর শব্দ করে
সে ভিন্ন মূর্তি ধরে।
আবার যখন বেড়িয়ে পড়ি
বন্ধুরা দিলে ডাক
চুপসায় দেখি টায়ার দুটো
হাসে কুঞ্চিত করে নাক।
আসতে পুজো নেইকো দেরি
কান খুলে শোন দুষ্টুর ধাড়ি
বিগড়াস যদি মেলার পথে
পাঠাবো সটান যমের বাড়ি।
যেই বলেছি এমন কথা
মর্মে বুঝি লেগেছে ব্যথা
পাইনা সাড়া হাজার ডেকে
সে রাগ করেছে দুদিন থেকে।
=======================
দ্বিচক্রযান
মৃন্ময় ভৌমিক
তোমাকে ভালোবেসে স্বপ্নের সাঁকো বেয়ে মেঘেদের গ্যালারি থেকে দেখেছি কী উচ্ছ্বাস, কী বেপরোয়া দ্বিচক্রযান শ্রাবণের জল ভেঙে অসম্ভব প্রাণ উচ্ছল স্মৃতি আমাকে টানতে টানতে কলেজস্ট্রীট নিয়ে এসে চিনিয়ে দিল এলভিস প্রিসলে। শরীরের ঘামটুকুও রুমালে ছেঁকে বলেছিলাম - তুমি জাহ্নবী, তুমিই সাহারা পেরিয়ে পাওয়া আল্পসের চূড়া থেকে খসে পড়া পাথরের চাই যাকে লিওনার্দো খুঁজে বেড়িয়েছে বাড়তি সিলিকেট ছেনি দিয়ে কেটে তোমাকে ফ্লোরেন্স করে দেবে বলে।
সিগারেট ফুরিয়ে যায় একের পর এক, কথার মতোই পথ আমাদের কোন দিন ফুরবেনা। বুক চিরে সূর্যটাকে কেটে এনে আমিই পুব দিকে রেখে দিয়ে এটুকু বলব - আমার স্বপ্নের রঙ লাল, কাস্তে হাতে দাঁড়িয়ে আছে তিরিশ হাজার বছরের পুরাতন সোনালী ধানের গোধুলির মত মসৃণ ভবিষ্যৎ,
এবং কৃত্তিবাস থেকে বব ডিলান পর্যন্ত সেই মাটির গন্ধ আমার কবিতা হয়ে আটকে আছে গুহালিপির প্রাচীন দেওয়ালে।
=======================
দুঃসময়ের বাহক
দেবদীপ মৌলিক
বয়ে চলে সময়ের ক্ষত,
বাহিত হয় কিছু নিষ্ঠুর হাহাকার –
কেউ কি শুনেছিল ক্রন্দনধ্বনি ?
বহমান ধ্রুবতারার ব্যর্থ চিৎকার !
ওরা ছুটে আসে .......
ওরা দেখতে পায় বন্ধনের জ্বালা ,
মুহূর্তে পুড়ে চলে প্রেতাত্মার ক্ষুধা
শয়ে শয়ে শিশুমৃত্যু ওদের চারিপাশে
“সুস্থ ভবিষ্যৎ” সে যে কৃত্রিম ধাঁধাঁ ...
এ জটিল লোকতন্ত্র – সভ্যতার ক্ষয়
তার হাতে গোলাপ ,
আর পিঠে চাবুকের ক্ষত ;
দুঃসময় বয়ে চলে দৃঢ় প্রত্যয়ে
সভ্য হতে আদিমের মতো ।
=======================
No comments:
Post a Comment