Thursday, September 30, 2021

মুক্তগদ্য

বাহনের সাতকাহন

কুহেলী বিশ্বাস

দেবতার সৃষ্টিতে ধন্য সমস্ত প্রাণী জগৎ,

কৃতজ্ঞতায় পশুপাখিরা হয়েছে বাহন।

কোন্ দেবতার বাহন হয়েছে কে সেটা

আমি আজকে সংক্ষেপে করছি বর্ণন।

ভগবান গণেশের বাহন মূষিক বা ইঁদুরমুষ শব্দের অর্থ জানি লুঠ বা চুরি করাইঁদুরের ওপর গণেশের বিরাজ করার অর্থস্বার্থকে পরাজয়জনকল্যাণই তাঁর লক্ষ্য।

দেবাদিদেব মহাদেবের বাহন নন্দী ষাঁড় ৷ ষাঁড় শক্তিআস্থা এবং বিশ্বাসের প্রতীক। শিব মোহমায়া,ভৌতিক ইচ্ছার ঊর্ধ্বেনন্দী এগুলিকে পুরোপুরি চরিতার্থ করে। দেবী দুর্গার বাহন হলো পশুরাজ সিংহ ৷ সিংহ আক্রমণাত্মক শৌর্যের প্রতীকসিংহের গর্জনকে  মা দুর্গার ধ্বনি বলা হয়যার আওয়াজে জগৎ সংসার স্থির হয়। গরুড় স্বীয় বলে পেল শ্রীবিষ্ণুর বাহনরূপ,

গরুড় দিব্য শক্তি ও অধিকারের প্রতীক।

বিষ্ণুর বরে কার্তিকের বাহন হলো ময়ূরলক্ষ্মীর বাহন পেঁচা যার আঁধারে সুনজর।

জ্ঞান-সঙ্গীতের দেবী সরস্বতীর বাহন হাঁসহাঁস হল পবিত্রতা ও জিজ্ঞাসার প্রতীক।

=======================

হৃদয়-বাহন

কুণাল কান্তি দে 

দুজনের  কথোকপনের সংলাপ  দিয়েই  শুরু করছি। 

—"কইরে হৃদে (হৃদয়)  কোথায় গেলি বড্ড  ক্ষিদে পেয়েছে ।  নিয়ে  আয় তাড়াতাড়ি । কি যে করিস না?"

— "তোমারই তো সময়  নেই খাওয়ার। সব  সময় মা  মা  করে বেড়াও।  তোমার  খাবার হুঁশই তো  থাকে না।"

— (পরক্ষণেই)  "কৈ  রে  গামছা টা  নিয়ে আয় দেখি। গঙ্গায়  একটা  ডুব  দিয়ে  আসি। নইলে   মা  (  ভবতারিণী )  খুব  রাগ  করবে। মা-কে  আরতি  করতে  হবে।  ফুল  বেলপাতা  এখনো জোগাড়  হয়নি ।  কি  যে করিস  সারাদিন।''

বক্তাদের একজন  মামা,  অন্যজন ভাগনে।  দক্ষিণেশ্বরে  সদ্য  নিযুক্ত  হয়েছেন  পূজারী হিসেবে।  সহযোগী  ভাগ্নে হৃদয় ।

এমনি করে  জীবনের ঊষালগ্ন  থেকে জীবনের শেষপ্রহর  পর্যন্ত তাঁরা মায়ের সেবায় নিজেদের   উৎসর্গ করেছেন   ।    একজন পথ প্রদর্শকঅন্যজন সহযোগী বাহন বললে কম  বলা হয়।  শয়নে  স্বপনে  নিদ্রায়  জাগরণে ঠাকুরের পূজারীর  চরণে নিজেকে বিলিয়ে  দিয়েছেন  আনুগত্যের প্রতীক হিসেবেযার তুলনা বিরল এই  ধরাধামে।  মামা ভাগ্নের যুগলবন্দি হলেও প্রকৃত  বিচক্ষণ  দায়িত্বশীল   অনুরাগী।  বিশ্বের কোটি  কোটি ভক্তের প্রাণ পুরুষ  ঠাকুর  রামকৃষ্ণ। অবতার হয়ে এই ধরাধামে এসে মানুষের মুক্তির কথা বিলিয়েছেন অকাতরে।   হৃদয়  ঠাকুর বাহন হয়ে আমাদের প্রাণময় হয়ে উঠেছেন।   ঠাকুর ও তাঁর বাহনের  লীলা  আজও অম্লান। তাঁদের চরণে প্রণাম জানাই।

শ্রীরামকৃষ্ণদেব ও তাঁর ভাগনে হৃদয়, চিত্র-সৌজন্য— গুগল

=======================

বাহন প্রসঙ্গে

মীনা রায় বন্দ্যোপাধ্যায়  

বাহন বিষয়টি নিয়ে লিখতে বসেই মনে এলো যে কথাটিতাতে আপন মনে এই কঠিন সময়েও হাসি চাপতে পারলাম না বন্ধু । আমার ছোট্ট ভাইঝি আমার খুব ন্যাওটা ছিল। তাকে স্কুলে ভর্তি করেছি আমি। আমার বি এড পড়বার সময়ে তার বয়স তিন/চার । আমার বাইরে বের হবার সঙ্গী সে। আবার অন্যভাবে তাকে বাড়ির বাইরের জগত দেখানোর শুরুটা আমার হাত ধরেই। লাইব্রেরি চিল্ড্রেন পার্কখেলনার দোকান ,মেলা-উৎসব ,পুজো - পার্বনে সেই আমার সঙ্গী।

কলেজ থেকে পিকনিকএক্সকারশন যেখানেই যেতামঅন্যরা নিজের সন্তানকে সঙ্গে নিতআমি নিতাম আমার আদরের ভাইঝিটিকে। সেও অনেক খেলার সঙ্গী পেত। তাই যেতে আনন্দই পেত।

সে বছর কলেজের সরস্বতী প্রতিমা দর্শন করে ফেরবার পথে আমাকে তার প্রশ্ন -- সব দেব-দেবীদেরই বাহন থাকে বলো ছোটোপিসি ?

আমি বললাম থাকে তো ! লক্ষ্মীর বাহনের নাম পেঁচা। গণেশের ইঁদুর। কার্তিকের ময়ূর। সরস্বতীর ---আমাকে আর বলতে হলো না ।সে বলল --হাঁস।

রাজহাঁস বলো ছোটোপিসি ?

বাহনকে ঠাকুররা খুব ভালোবাসে । আমাকে তুমি যেমন সব জায়গায় নিয়ে বেড়াও তেমনি ঠাকুররাও নিয়ে নিয়ে ঘোরে বলো ছোটোপিসি ?

আমি বলিহ্যাঁ । তবে বাহনের পিঠে চড়ে ঘোরে।

তারপর হাসতে হাসতে আমি তাকে প্রশ্ন করি --আচ্ছা এই ধর্ আমি যদি দেবী হতামআমার বাহন করতাম কাকে ?

সে দু-হাত বাড়িয়ে বললো -- বলছি । তার আগে আমাকে কোলে নাও ।

-- অনেকটা হেঁটেছিস না বলেই আদর করে কোলে নিলাম ।

সে আমার কানে কানে জানালো --আমি তো তোমার বাহন ।

আমি বললাম-- আমাকে বইতে পারবি ?

-- সে চটপট উত্তর দিলো - বড়ো হয়ে পারব।

আমি আর তুমি তো সব সময় একসঙ্গেই ঘুরে বেড়াই। আর দেখো না ! বড়োরাই তো ঠাকুর হয়। ছোটোরাই তার বাহন।

বাড়িতে একদিন চেয়ারে বসে পড়ছি হঠাৎ সে তার মা-কে ডেকে এনে বলল--দ্যাখো মা ! বলেই আমার চেয়ারের নিচে বসে হাতদুটো জুড়ে মাথার ওপরে তুলে মুখে শব্দ করছে -- প্যাঁক্ প্যাঁক্ প্যাঁক্।

দেখে বৌদি তো হেসে কুটি কুটি। প্রশ্ন করলো এ আবার কি ?

সে উঠে উত্তর দিল -- ছোটোপিসি তো বই হাতে সরস্বতী আর আমি রাজহাঁস--বাহন ।

এখন সে দুই কন্যার জননী। আমি তাকে এখনো বাহন নামেই ডাকি।

=======================

আমার প্রিয় বাহন

 ডঃ রমলা মুখার্জী 

      বাহনএই অভিনব বিষয়টি নিয়ে লিখতে বসে অনেক দিন পর আমি আমার প্রিয় বাহনটির যেন স্পর্শানুভূতি পেলাম। আমার সেই বাহন-বন্ধুর কথাই আজ বলব।

        প্রথমে যে গ্রামের স্কুলে আমি সহশিক্ষিকা ছিলামসেটি ছিল বাড়ি থেকে সাত কিলোমিটার দূরে। বাসের রাস্তাবাস প্রায়ই থাকত নাআর থাকলেও প্রচণ্ড ভিড়ে বাসের গেটে বাদুড়ঝোলানয়তো বাসের ভিতরে চিঁড়েচ‍্যাপ্টা। তাই একটা স্কুটি কিনে চালানো শিখে স্কুলে যাতায়াত শুরু করলাম। স্বাধীন ভাবে যাওয়ার আনন্দে আমার মন ভরে যেত বাঁধন-হারা খুশিতে। আমাদের বাগানের অনেক সব্জি কলিগদের দিতে পারতামযা বাসের ভিড়ে ইচ্ছা থাকলেও দেওয়ার কথা ভাবতেই পারতাম না। ছাত্রীদের জন‍্য হাতে তৈরী  চার্টমডেল ও নানান জিনিসপত্র অনায়াসেই নিয়ে যেতে পারতাম। সব থেকে সুবিধা  হয়েছিল বিদ‍্যালয়ের মাঠে ভেষজ উদ‍্যান করার সময়। আমার বাড়ির নানান ভেষজ গাছগুলি অক্ষত অবস্থায় স্কুলে নিয়ে আসতে পারতাম বাহনে চাপিয়ে। বাহনটির সহায়তায় বিদ‍্যালয়ে ক্রমশই গড়ে তুলেছিলাম ভেষজ ছাড়াও নানান ফুলের ও বাহারি পাতার বাগান। বিদ‍্যালয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আর ফুল কিনতে হত না। বাগানের এই ফুল-পাতার তৈরী তোড়া দিয়েই অতিথি বরণ থেকে শুরু করে ফুলদানি সাজানোও হয়ে যেত। ছাত্রীরাও নিজের সৃষ্টিকর্মের আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠত।

      শুধুমাত্র স্কুল নয়বাহনটি আমাকে অনেক জায়গায় যাবার ও সামাজিক কিছু ক্রিয়াকলাপ করার সুযোগ করে দিয়েছিল। আমি বাহনটিতে চেপে নানান সামাজিক প্রতিষ্ঠানে অনায়াসেই যেতে পারতামযা বাসে করে যাওয়া অসম্ভব ছিল। স্কুলের পাশের  গ্রামের বেশ ভেতরে ছিল মেঘদূত ক্লাব। ওরা প্রতি বছর খুব সুন্দর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করত। ওদের সাদর আহ্বানে আমাকেও যেতে হত অনুষ্ঠান  পরিচালনার জন্য। ওদের অদম্য উৎসাহে 'চিত্রাঙ্গদা', 'লাল কমল নীল কমলইত্যাদি নৃত্যনাট্য তো করাতামইউপরন্তু নিজেও গান লিখে সুর দিয়ে দূষণ ও কুসংস্কারবিরোধী নৃত্যনাট্য,  শ্রুতিনাটকও করতাম। বাহনটি ছিল বলেই স্কুল-ফেরতা মহড়া দিয়ে ঠিক সময়ে বাড়ি ফেরা  সম্ভব হত এবং যেহেতু আমি নারী তাই সংসারে জমে থাকা কাজ-কর্মাদিও সামাল দিতে পারতাম। এইভাবে আরও অন্যান্য বিদ্যালয়ে ও ক্লাবে ছেলেমেয়েদের মধ্যে বিজ্ঞানস্বাস্থ্য ও সাংস্কৃতিক প্রসার ঘটাতে পেরেছিলাম।

     ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে বাহনটি চড়ার সুখ থেকে আমি একদিন  বঞ্চিত হলাম। গলায় সাংঘাতিক কর্কট রোগের অস্ত্রোপচারে বাম কাঁধটি অবশ হয়ে যাবার পর থেকে বাহনটিতে আর চড়তে পারি না। তবে আমার পরম উপকারী আদরের বাহন-বন্ধুটিকে আমি কখনও ভুলবো না।

চিত্র-সৌজন্য — গুগল
=======================

বাহন

 পল্লব মুখোপাধ্যায়

      'বাহন' নিয়ে আমার ব্যক্তিগত ধারণাটা আর পাঁচজনের থেকে হয়তো বা একটু অন্যরকম শোনাবে।

অমল জানলা দিয়ে দূরের আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছে, আহা, যদি একটা গাড়ি পেতাম, সে যেমনই হোক, তাতে করে এই চৌহদ্দির সীমানা ছাড়িয়ে দূরে কোথাও ঘুরে আসা যেত!

আবার ফুটপাতবাসী পিকলুর সামনে দিয়ে যখন হুশ্ করে কোন গাড়ি ছুটে চলে যায়, তখন তার মনের কোণে একটা স্বপ্ন উঁকি মারে। যদি সে নিদেনপক্ষে একটা ইঞ্জিনভ্যানও পেত, কোনও এক আলাদিনের আশ্চর্য চেরাগের দৌলতে, তবে তাকে আর ফুটপাতে অন্য পাঁচজনের মতো অনাহারে, অপমানে দিন কাটাতে হত না। সকাল-সন্ধ্যায় ঐ ইঞ্জিনভ্যানের দৌলতে সে তার কর্মজীবন শুরু করতে পারত। আবার কখনও বা স্বপ্ন উড়ানে চড়ে পাড়ি দিত তার না-দেখা স্বপ্নের শহরে। যেখানে প্রতিনিয়তই স্বপ্নেরা স্বপ্নভেলায় চড়ে নিত্যনতুন খেলায় মেতে থাকে। ছোট্ট অমল বা পিকলুরা তাই বুঝতে পারে না, স্বপ্নভেলাও কি সেই বাহন, যাতে চড়ে জীবনের প্রতিটা না-দেখা স্বপ্নগুলোকে বাস্তবায়িত করা যায়?

তবে আর পাঁচজন যে বাহনের কথা চিন্তাভাবনা ও বাস্তবায়ন করে, আজকে আমার স্বপ্নে সেইসব বাহন আসছে না। হয়তো বা আসবেও না কোনও দিন। কারণ, যে দেশে ফুটপাতের বাসিন্দাদের সংখ্যাটা নেহাত কম নয়; যেখানে দু'বেলা দু'মুঠো ভাতের জন্য চাষি থেকে শুরু করে মুটে, কুলি, দিনমজুর, আরও কত কত শ্রমিক নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে দূরে কোথাও পাড়ি দেয় তাদের স্বপ্নের সংসারকে ছেড়ে; সেখানে স্বপ্নের বাহনের কথা তাদের ভাবাটাই অপরাধ! তবুও তাদের স্বপ্নে কখনও যদি কোনওভাবে অজ্ঞাতসারে কোনও গাড়ির অনুপ্রবেশ ঘটে, তবে সেই গাড়িটা আর যাই হোক,  দু'চাকা, তিন চাকা, চার চাকা বা তারও অধিক চাকার বাহন কখনওই নয়, বরং তাদের স্বপ্নে নতুন কোনও এক বাহনের জন্ম হতে পারে। যে বাহনের কথা কোনোদিনও কেউ ভাবে না, যে বাহন কোনও শো-রুমের ঝাঁ চকচকে গণ্ডিতে কারও দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য সাজানো থাকে না। যাকে কখনও কেউ বাহনের আখ্যাই দেয়নি। চালকবিহীন সেই বাহনটা আরোহীকে বয়ে নিয়ে হুশ্ করে চিরদিনের মতো কোনও এক অজানা গন্তব্যে পাড়ি দেয়...

আমরা আমাদের সারাটা জীবনে বহু গাড়ির স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকি। সে যাই হোক না কেন, জীবনের কোনও না কোনও সময় স্বপ্নের গাড়ির সওয়ারি আমরা হয়তো বহুবার হয়েছি। কিন্তু জীবনের শেষ মুহূর্তে দাঁড়িয়ে একটাই গাড়ি প্রতিটা মানুষের জীবনে সত্যি হয়ে আসবে, আসবেই। যেটা শববাহী বাঁশের গাড়ি। যাতে চারজন বেয়ারা মিলে যাত্রীকে তার সঠিক গন্তব্যে পৌঁছে দিতে বদ্ধপরিকর। সে-ই হল জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ বাহন!

=======================

আমার বাহন

 জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়

বাহন নিয়ে আমার প্রাথমিক ধারণা, যা বহন করে নিয়ে যায়, তা হতে পারে যানবাহন বা কোনো প্রাণী যার পিঠে চড়ে দেবদেবীরা ভ্রমণ করেন,মানুষও করে।

অবশ্য আরও একটা হয়, ব্যঙ্গবিদ্রুপে বা হাস্য-রহস্যে ঘনিষ্ঠ অনুচর বা বন্ধুকেও বাহন বলা হয়।

যেমন, আমার দাদু(ঠাকুরদা)-র কাছেই ছিল আমার যত আবদার, অপরাধের আশ্রয় ছিলেন তিনি আর বাড়িতে থাকলে তাঁর কাছেই আমি বেশি সময় থাকতাম। তাই ঠাকুমা দাদুকে বলতেন, ' নাও তোমার বাহন এসে গ্যাছে।' অবশ্য আমি কী করে দাদুর বাহন হলাম, তখন সেটা বুঝতাম না।

দেবদেবীদের বাহন নিয়ে বিতর্ক আর ব্যঙ্গের শেষ ছিল না। ভুটকো পেটা গণেশ বাবাজি ওই দেহ নিয়ে যদি মূষিক অর্থাৎ ইঁদুরের পিঠে সত্যিই চেপে পড়েন, বেচারি বহন করা দূরের কথা চিঁড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে যাবে যে! কার্তিকের ময়ূর না পারে ভালো উড়তে, না পারে তেমন দৌড়তে, তাহলে দেবসেনাপতি যুদ্ধ করবেন কীভাবে? দোকানের তাকে বা কুলুঙ্গিতে পাশাপাশি লক্ষ্মী ও গণেশ, ভাইবোনে এত ভাব অথচ বাহন দুজন খাদ্য-খাদক, ইঁদুর দেখলে পেঁচা ঝাঁপিয়ে পড়ে কেন! ঢেঁকি যদি লাগানি-ভাঙানি দেবতা নারদকে নিয়ে ত্রিভুবনে উড়ে না বেড়াত, তবে দেবতাদের পারিবারিক বিবাদ ও দেবদানবের এত যুদ্ধ বাঁধতো না। আর ধানই বা কে ভাঙবে? এইসব নিয়ে সবাই খুব মজা করতাম।

নারায়ণের বাহন গরুড়ের প্রতিও আমাদের বেশ একটা আকর্ষণ ছিল। এছাড়া রূপকথার গল্পের পক্ষীরাজ ঘোড়া , রাবণের পুষ্পকরথ,  রাজা বিক্রমাদিত্যের গল্পে রানী ভানুমতীর গাছবাহন, আরব্য উপন্যাসের উড়ন্ত গালিচা, পক্ষীরাজ, রানা প্রতাপের চৈতক, সুবোধ ঘোষের কাহিনিতে ঋত্বিক ঘটকের অযান্ত্রিক -এর পঙ্খি... আরো কত মনোহরণ বাহনের কথা ভেবে আমরা মুগ্ধ হয়েছি।

আমার স্কুলের বাহনটি ছিল ঐতিহাসিক। আমি যখন ক্লাস ফাইভ-সিক্সে তখন দাদু আমার প্রয়োজনের কথা ভেবে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া তাঁর যে সাইকেলটি নির্দেশ করলেন তা মৃতপ্রায় এক অতিপ্রাচীন নিদর্শন বলা চলে। আমার বাবা ঝাঁ চকচকে সেনর‍্যালে সাইকেলে চড়েন আর আমার কপালে জুটল প্রপিতামহ মহানন্দবাবুর সাইকেল। সেটি মেড ইন ইংল্যান্ড,সামনে ও পিছনের দুটো মাডগার্ডে স্পষ্ট খোদাই করা  'Special Tram'। তার মানে কোলকাতায় যে ট্রাম চলত তার নাতিপুতি কিনা তা নিয়ে গবেষণা চলে, উত্তর মেলে না। কোনো মিল নেই জানি, দাদু এবং বাবাকে নামকরণের কারণ বলার জন্য উত্যক্ত করি, উত্তর পাই ওটা বিক্রির একটা কৌশল মাত্র। বাঁকুড়া জেলার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মাটি এঁটেল প্রকৃতির, বর্ষায় চিটেল কাদা যার বৈশিষ্ট্য, যানবাহন বলতে গরু-মোষ বাহিত গাড়ি আর সাইকেল।মোটর সাইকেল বা বাইকের গল্পই হয়ত শোনা যেত।হেমন্তকাল থেকে গ্রীষ্মকাল পর্যন্ত সাইকেল ও গাড়ি চলত। দূর গঞ্জ ইন্দাস ও শাশপুর দিয়ে দু-চারটি বাস ও তখনকার বি ডি আর ট্রেন যাতায়াত করত।

আমার সাইকেলটি ছিল ছোটো, সম্ভবত কুড়ি ইঞ্চি।তার ফ্রেমে দুটি ত্রিভুজ যাকে আমরা বলি, ' ব', মেইন ত্রিভুজ বা ব- য়ের উপরের পাইপের সামনের দিকটি ভাঙা, কী হবে তাহলে ?

মিস্ত্রিকাকা বলল, পিতল দিয়ে এমন ঝেলে দেব অক্ষয় অমর হয়ে যাবে।

মনের কাঁটা খচখচ করে,ব- য়ে ঝাল যদি ভেঙে যায় ?! 

মেরামত ও  রং করার পর বেশ সুন্দর রূপ পেল সাইকেলটি। শুরু হল হাফ প্যাডেলে সাইকেল চালানো শেখা। অর্থাৎ ব-য়ের ভেতর দিয়ে ডান পা গলিয়ে দুটো প্যাডেলে পা দিয়ে গিয়ার ঘোরানো, তাহলেই সাইকেল চলবে। বাঁ পা সহজেই নামানো যাবে, পড়ে যাবার ভয় কম। দু-তিন দিনের মধ্যেই খুব দক্ষ হয়ে উঠলাম আমি। পিছনে বন্ধুদের লাইন, অনুরোধ তাদের শেখার সুযোগ দিতে হবে। এতজন বন্ধুর মধ্যে আমিই একমাত্র ভাগ্যবান যার নিজের একটা আস্ত সাইকেল আছে। সে কি কম গর্বের কথা! সবাই আমাকে তোষামোদ করে, তা যে মন্দ লাগে এমন নয়, মায়া হয় আবার ভয়ও হয়, যদি ভেঙে যায়! 

খুব ঘনিষ্ঠ দেখে এক- দু জন বন্ধুকে শেখালাম হাফপ্যাডেলে চালানো।বন্ধুদের ভালোবাসাও বেড়ে গেল — মাছ লজেন্স,লেবু লজেন্স, গুলি লজেন্স, বাড়ির গাছের আম, পেয়ারা বেশ আসতে লাগল, সবাই মজা করে খাওয়াও চলতে লাগল।

একসময় বুঝতে পারি হাফপ্যাডেলে সাইকেল চালানো খুব আরামদায়ক নয়, সিটে বসে চালানো শিখতে হবে। সেটা কীভাবে সম্ভব ? সিট বেশ উঁচু, নাগাল পাই না,তাহলে? বুদ্ধি খাটিয়ে একটা উপায় বার করি, আমাদের স্কুলের কাছে চওড়া রাস্তায়, আমরা বলি বাঁধা রাস্তা, একটা ঢালু জায়গা ছিল, আমরা তাকে বলতাম - গড়গড়ান, সেখানে একটা মাটির ঢিবি ছিল, সেই ঢিবির পাশে সাইকেল ধরে বাঁ-পা ঢিবিতে রেখে সিটে বসলাম আর ডান পা ডান প্যাডেলে দিয়ে জোরে চাপ দিতেই সাইকেল ছুটল, আমিও গড়গড়ান থেকে দ্রুত সাইকেল নিয়ে ছুটলাম। নামার সময় একটু সমস্যা হলেও তা সামলে নিয়ে একদিনেই  সিটে চাপা শিখে গেলাম। বন্ধুদের সে কী উল্লাস! একদিনে সিটে চেপে সাইকেল চালানো এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার যে!

আজ এতবছর পরেও আমি চোখ বুজলে বন্ধুদের সেই উজ্জ্বল মুখগুলো দেখতে পাই।

আমার গ্রামের স্কুলটি ছিল জুনিয়র, তাই ক্লাস এইটের পর যেতে হল সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরের রাজখামার হাই স্কুলে। এবার বাহনের চাপ বাড়ল, মাঝেমাঝে বন্ধুদেরও চাপিয়ে নিতে হয়। খুব জোরে সাইকেল চালাই আমি, রাস্তা কাঁচা এবড়োখেবড়ো,   সাইকেল লাফায়, শব্দ হয়, তবু সে ছোটে ক্লান্তিহীন। কখনো ভাবি, এই বোধহয় ঝাল খুলে গেল! 

না তা হয়নি,আমাকে বাহন কখনোই কোন ঝামেলায় ফেলেনি।

একদিন বাহনের মালিকানা পরিবর্তন হল, আমি কলেজে ভর্তি হলাম, আর বাহন গেল ভাইয়ের হাতে।

কলেজে পড়ার সময় আমার যে সাইকেলটি জুটেছিল সেটি বেঢপ উঁচু, সে কোনোদিন আমার প্রিয় 'Special Tram' হয়ে উঠতে পারেনি।

প্রিয় বাহনের কথা মানুষ সারাজীবন ভুলতে পারে না, আমিও পারিনি। চোখ বুজে মনঃসংযোগ করলে এখনো তাকে দেখতে পাই।

চিত্র-সৌজন্য — গুগল
=======================

রম্যরচনা

"মারুত"

 রবীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী


ভাবলাম বাহন, অর্থাৎ বহন যে করে, তাকেই তো মানুষ বাহন ক্রিয়া করে এগিয়ে যায় ! তাকেই  মানুষ প্রয়োজনে , অপ্রয়োজনে , প্রমোদ ভ্রমণে , কী চিকিৎসার 

কারণে রাত গভীরে কিম্বা দিনে দুপুরে স্মরণ করে ! নয় কী ?

আমার চেনা মানুষ, শংকর, নিখাদ সাধা সিধে মানুষ , সে আমায় একটি বাহন  করে প্রায়শই নিয়ে যায় , যখন যেখানে প্রয়োজনের তাগিদ আসে ! হাসি মুখে নিয়ে যায় , অবশ্য কাঁধে করে নয় , গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে সে নিয়ে যায় !সেখানে  বাহন স্বরূপ গাড়িটির কোন ইচ্ছা,বা  অনিচ্ছা নেই ! এক্ষেত্রে, সেইতো "বাহন"! তার উপর ভরসা করেই তো  কাছের ও দূরের প্রয়োজন মেটাই ! আহা বড় প্রিয় সখা সে  আমার! কখনো তার আদরে ঘুমিয়ে পড়ি ! তার টানে ছুটে যাই, দূর থেকে বহু দূরে !

মন খারাপ হয়ে যায়!যখন আমার একান্ত বিশ্বস্ত বাহন, ধরা যাক তার নাম "মারুত", সে যখন অপারগ হয় , সে যে আমার  হৃদয়হরণ ! তার প্রেমে আবিষ্ট করে রেখেছে সর্বক্ষণ ! সেই সেদিন  চিৎকার করে বলে  উঠলো—

"আমা থেকে থাকো দূরে!

জানোনা কি 

তেলের দাম এখন আগুন !"

আমি হৃদয় দিয়ে বুঝলাম !আমার ব্যথা আমার এই বাহন "মারুত" যত বোঝে ,আর তো কেউ বোঝেনা ?

=======================

বাহন

 অগ্নিমিত্র 

মা দুর্গার বাহন সিংহকার্তিকের বাহন ময়ূরএকথা তো আমরা সবাই জানি। নারদের বাহন ঢেঁকিগণেশের ইঁদুর । বাহনের এক নির্দিষ্ট ভূমিকা রয়েছে আমাদের পুরাণে। গণেশের বাহন ইঁদুর বস্তা কেটেকাগজপত্র কেটে কুটিকুটি করে মানুষের অহমিকা চূর্ণ করেন। আবার লক্ষ্মীর বাহন প্যাঁচা শ্রী ও সমৃদ্ধির প্রতীক। মা সরস্বতীর বাহন রাজহাঁস দুধ ও জল মিশ্রণ থেকে আলাদা করতে পারেতাই সার ও অসার বস্তুর প্রভেদ করতে সে শেখায়।

তবে সাধারণ মানুষের বাহন কে বা কারা তার বাহনের গুরুত্ব নেই !

আমি কিন্তু কাউকে ছোট করছি না। মজার ছলেই নেবেন। একজন ভারতীয় বালক বা  বালিকা ছোটবেলায় দু তিন বছর ধরে আরো বেশি সময় বাবা মার কোলে চড়ে ঘুরে বেড়ান। সেক্ষেত্রে বাবা মা বা কাকা বা দাদা দিদি তাঁর বাহন। আবার একটু বড় হলে তিনি অনেক সময়ে সাইকেলে করে স্কুলে বা কলেজে পড়তে যান। একটু শহুরে ছাত্র বা ছাত্রী হলে বাইকে বা স্কুটিতে চড়ে যান । এখন দেখছেনএই অবধিই কত রকম বাহন হয়ে গিয়েছে?

এর পর প্রেমিক বা প্রেমিকা  আসতে পারে জীবনে। যদিও ঠিক প্রেমিক বাহন নয়তবে বিবাহ হলে সে বর হয়ে অবশ্যই বাহন হবেকারণ 'বিবাহশব্দের অর্থই বিশেষভাবে বহন করা। যদিও এটি তর্কসাপেক্ষ।

একটু পয়সা জমলে মানুষের বাহন হয় চারচাকা গাড়ি । যদিও দুচাকা হোক বা চারচাকামানুষকেই বাহনকে চালনা করতে হয়। মানুষের ক্ষেত্রে বাহন মূলতঃ গতিবিধির মাধ্যম। তার অন্য কোনো মহত্ত্ব নেই। যদিও বাইক বা চারচাকা গাড়ি মানুষের উৎকর্ষ বা বৈভবের প্রতীকচিহ্ন হতে পারে । তিন লাখ টাকার গাড়িতে কাজ চলে গেলেও মানুষ তাই প্রতিপত্তি দেখানোর লোভে দশ লাখ টাকার গাড়ি ও তিন লাখ টাকার বাইক কেনে!..

এইবার বাহন কথা সম্পূর্ণ হলো । তবে কলকাতায় দুর্গা পূজা ঘুরে দেখতে হলে বাহন নিষ্প্রয়োজন । এগারো নম্বর বাস মানে নিজস্ব দুই পা-ই তখন শ্রেষ্ঠ বাহন বা গতিবিধির মাধ্যম!!

=======================

লোকাল ট্রেনে দু-জনে

 অভিষেক ঘোষ 

আজ যখন করোনাসুরের আক্রমণে ভারতভাগ্যবিধাতা স্বর্গছাড়া, এবং তিনি ক্ষমতায় না ফেরা পর্যন্ত ট্রেন-চলাচল বন্ধ, তখন বারবার মনে পড়ে যায় আমাদের ছাত্র-জীবনের কথা । ট্রেনে যাতায়াত-কালে ছোটো থেকে কত বিচিত্র অভিজ্ঞতাই না হয়েছে !

শিয়ালদা থেকে ছুটতে ছুটতে ট্রেনে উঠে অফিস-ফেরতা ভদ্রলোককে ভরসা করে ট্রেন ছাড়ার সময় জানতে চেয়ে কীভাবে ঠকেছি মনে পড়ে !

"দাদা, ট্রেন-টা কটায় ছাড়বে ?"

"আমায় বলে নি জানেন... " - সহাস্য বিদ্রূপ শুনেও নিত্য-যাত্রী হায়েনার দলে একা বলে, রাগ গিলে নিয়েছি ।

আবার এই ট্রেনেই টিকিট না কেটে উঠে, দুরুদুরু বুকে গন্তব্যে পৌঁছানোর ঠিক একটা স্টপেজ আগে চেকারের কাছে হাতেনাতে ধরা পড়ে ল্যাজেগোবরে হয়েছি । অবশেষে কলেজে পড়ি, ভালোছেলে এবং মানি ব্যাগ ফেলে এসেছি, এইসব ভুজুং-ভাজুং দিয়ে নিস্তার ।

স্কুলের পুরোনো বান্ধবীকে সহসা আবিষ্কার করেছি ট্রেনেই নিত্যযাত্রীদের সাথে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করতে । অবাক হয়েছি, গর্বিতও ।

আবার এই ট্রেনে সপরিবারে বাড়ি ফেরার সময় একবার মায়ের চোখে জানালা দিয়ে তীব্র গতিতে মাটির শক্ত ঢেলা এসে লাগতেও দেখেছি - বদমাশ বাচ্চাদের ভয়ানক খেলা । একটুর জন্য মা-র চোখ বেঁচেছিল সেবার । চোখে জল-টল দিয়ে, ভাপ দিয়ে সবাই অস্থির, সে এক ভয়াবহ কান্ড !

বহু আগে, তখন আমি অনেক ছোটো, মেলা থেকে ফেরার পথে একবার বাবা মায়ের সঙ্গে লক্ষ্মীকান্তপুর স্টেশনে সারা রাত কাটাতে হয়েছিল । কারণটা আজ আর ভালো মনে নেই । হয়তো কোনো কারণে লাইনে সমস্যা হয়েছিল বা, কোনো দুর্ঘটনা, ফলে অত রাতেও ট্রেন আচমকা বন্ধ হয়ে যায় । শুধু যে ঘটনাটা স্পষ্ট মনে আছে তা হল, ব্যাগে মাথা দিয়ে শোয়ার সমস্যা হচ্ছিল আর ঠান্ডাও ছিল বেশ । ওয়েটিং রুম বলে সেকালে কিছুই ছিল না গ্রামাঞ্চলে, একালেও যে লোকাল ট্রেন-লাইনে সেরকম কিছু আছে, তা মনে হয় না । তো সেবার দয়ালু স্টেশন মাস্টার অত্যন্ত সহৃদয়তার সাথে, সেই রাতে, আমাদের তাঁর অফিস ঘরে ডেকে নেন । বড়ো ভালো মানুষ । আমার ঘুম পাচ্ছিল না বলে বই পড়তে দেন । বেশ মনে আছে, গোটা দুই বইয়ের ওপর মাথা রেখেই সে রাতে শেষ পর্যন্ত ঘুমিয়েছিলাম ।

এমন কত কত স্মৃতি !

একটা অত্যন্ত ব্যক্তিগত সুখের মুহূর্তও কৌশলে বলা যায় । ট্রেনেই প্রথম ভালো করে দেখেছিলাম তাকে। সহপাঠীই ছিল । তারপর...

তো এক বিকেলে তাকে ভিড়ের মধ্যেও কেবল গল্প বলে একলা করে দিতে পেরেছিলাম । মনে মনে ভাবতে ভালোবাসি, আমার এই ক্ষমতাটা আছে ! আমি এমনভাবে গল্প বলতে পারি, যাতে পাশের মানুষটার আর কিছু খেয়ালই থাকবে না - ভিড় আর হট্টগোলেও মনে হবে, আছি শুধু আমি-তুমি ।

কী গল্প বলেছিলাম ? একটা নয়, দুটো । দক্ষিণ কোরিয়ার এক বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক কিম কি-দুক সেই মুহূর্তে আমার প্রিয়তম পরিচালক । তাঁর দুটি ছবি, যা দেখার পর আমি কয়েকটা রাত স্বপ্নেও সেই ছবির দৃশ্যগুলোই দেখেছি, সেই ছবিদুটির প্লট শুনিয়েছিলাম তাকে । '3-Iron' আর 'The Bow' । 

উল্লিখিত প্রথম ছবিতে এক ভবঘুরে ছোকরা ফাঁকা বাড়িগুলির কী-হোলে দোকানের খাবারের মেনু কার্ড বা কোনো বিজ্ঞাপন সেঁটে দিত, তারপর কয়েকদিন বাদে বাদে এসে দেখত, কোন্ কার্ডগুলো যথারীতি, অক্ষত অবস্থায় স্ব-স্থানে রয়েছে । কারণ এর মানে ওই বাড়িগুলো ফাঁকা পড়ে আছে, কেউ থাকে না । তারপর সে সেই সব বাড়িতে মালিক না আসা পর্যন্ত দিব্যি থেকে যেত । অবশ্যি একেবারে এমনি নয়, বিনিময়ে সে যেচে উপকার করে দিত । খারাপ বা অচল ব্যবহার্য জিনিসপত্র থাকলে, অলক্ষ্যে সারাই করে দিত, জামা-কাপড় কেচে দিত, ইস্ত্রি করে রাখত ইত্যাদি । আর এভাবেই একদিন সে এক ধনীর বাড়িতে আবিষ্কার করে এক অসুখী গৃহবধূকে । তারপর...  প্রেম !

আর দ্বিতীয় গল্প এক বোবা মেয়ের সাথে এক বুড়োর আশ্চর্য সম্পর্কের - অধিকার বোধ আর অদম্য কামনা যেখানে দুই অসমবয়সী মানুষের মধ্যে এনে দেয় অপক্ক রক্তিম পরিণাম । সেই ছবিতে কী অপূর্ব সঙ্গীতের ব্যবহার ছিল আহা ! তেমনি চোখ জুড়োনো ক্যামেরা আর আলো ! আর গল্প শোনাতে শোনাতে কথক যদি শ্রোতার চোখেও তেমনই আলো দেখতে পায়, তাহলে তো কথাই নেই । অবশ্য জানি না ভান ছিল কিনা ! এই দুনিয়ায় ভাই সবই হয়... সব সত্যি ! সব সত্যি । কিন্তু সেই বিকেলের অনাবিল আনন্দ এখনো চলন্ত লোকাল ট্রেনের মতোই মৃদু দোলা দিয়ে যায় মনে । হাত অন্যমনস্কভাবে, বেখেয়ালি বাতাসে, কারো কপালে এসে পড়া চুল আপনি সরিয়ে দিতে উদ্যত হয় । তারপর ঘুম ভাঙে আর খেয়াল হয়, ট্রেন তো চলছে না আর; কবেই গিয়েছে  থেমে ।

=======================