Thursday, September 30, 2021

গুচ্ছকবিতা

আর্যতীর্থ

বাহন দেখে

বাহন দেখে চেনা যায় কে কত বড় দেবতা, না মেটা  আশাদের দেহি 

বলে কার কাছে বর চাওয়া যাবে।


সরস্বতীর কাছে কেউ পরীক্ষায় পাশ ছাড়া অন্য কিছুর আবদার করেছে বলে শোনা যায় না,

লক্ষ্মী আর গণেশও শুধু সম্পদ আর সমৃদ্ধির প্রার্থনা শোনেন,

তেজারতি থেকে শেয়ারবাজার অবধি তাঁদের ভক্তের দৌড়,

আর বেচারা কার্তিকের কথা আর তুললাম না, দেবসেনাপতির এমন অবনতি ক্ষমতা হারানো রাজনৈতিক নেতারও হয়না।

জীবনের আংশিক চাহিদা মেটানো দেবতাদের সবার বাহন নিতান্ত নিরীহ সাধারণ পশুপাখি,

রোজের জীবনে যাদের আমরা বিনা চেষ্টাতে বা কৌতুহলে দেখে থাকি।


পরিপূর্ণ দেবতা হলে, তবে তাঁর বাহন হয় বাঘ বা সিংহ ।  ষণ্ডবাহন মহেশ্বরের গলায় ঝোলে ভয়াল সর্প,

বাহনহীন কালিকার দুপাশে দাঁড়ান করালদংস্ট্রা হৃৎস্পন্দন-স্তব্ধকারিনী ডাকিনী যোগিনী।

সাথীদের এড়িয়ে যাওয়া আর সম্ভব নয় , প্যাঁচা বা ইঁদুরকে দুচ্ছাই করলেও,

সমস্যানির্বিশেষে আর্তি জানানোর ভগবানদের বাহনেরা অ-পোষ্য আর নরঘাতক। 

নেহাতই কি সমাপতনে কাকতালীয় যোগ অথবা নিহিত এতে প্রাচীন রূপক?


মজার ব্যাপার দেখো, মানুষের সমাজেও নেই এর ব্যত্যয়, 

পাড়ার খুচরো নেতা , যার কাছে হাসপাতালে ডিসকাউন্টের ফোন করাতে যাওয়া, 

অথবা পড়শির ঝগড়াকে মিটমাট করে দেওয়া ক্লাবের সেক্রেটারি বা প্রেসিডেন্ট,

তাদের গাড়ি বা বাইকে কোনো লালবাতি নেই, অমন সাদাসিধে বাহন বহু লোকের আছে।

কিন্তু আসল ক্ষমতাবান দেবতাদের বাহনের ওপরে বিকন, সামনে পাইলট গাড়ি ও সঙ্গে বন্দুকধারী পুলিশ,

আর ঈশ্বরের চেয়েও জনগণ- মনের অধিকারী যারা, তাদের পুস্পক হয়ে থাকে হেলিকপ্টার ও চার্টার্ড বিমান। 

দেহরক্ষীর অস্ত্র ও সংখ্যার অনুপাতে, মর্ত্যের দেবকুলের জনতার মনে কমে বাড়ে সম্মান।


বাহনের ওপরেই নির্ভর করে, কার ফটো কত লোক  দেওয়ালে সাঁটান।

********************* 

বাহনের বাণী

কখনো ভেবেছো দুর্গার ঘরে বাহন রয়েছে কারা?

ভক্ত পৃথিবী আজকে যখন  ঝগড়ায় দিশেহারা,

পড়শির সাথে পড়শি মেশেনা, বন্ধুতে শনি বক্রে

ভগবান নয়, মানুষই বদল  হয়ে গেছে দশচক্রে,

ঘাড়ে চেপে বসে লাভ হলে কোনো, ডাকলেই অদৃশ্য,

এত অনায়াস যোগাযোগে তবু ভীষণ একাকী বিশ্ব,

এসময় দেখো  কারা পুজো পায়  দেবতাদেবীর সঙ্গেই

চিরশত্রুরা পাশাপাশি তবু যুদ্ধের কোনো ঢং নেই। 

মহেশ্বরের ষাঁড়ের সাথেই আছেন দুর্গা মায়ের কেশরী,

সাপ না খেলেও সব্বাই জানে ময়ূর সাপের বেশ অরি।

মূষিক যেমন ঠাঁই পেয়েছেন তেমনই আছেন পেঁচকটি

শিকারী বনাম শিকার কাহিনী পুজোর সময় নেয় ছুটি।

হংস নিজের সামনে পেয়েও সিংহ তাকে মারেন কই

 হিংসাবিহীন শান্ত থাকে পুজোয় তামাম অরণ্যই ।


বাহনেরা দেয় শান্তির বাণী, আমরা শোনার যোগ্য নই।

********************* 

ধর্মঘট

মোষ বলে ও সিংহমামা, কাঁধের থেকে থাবা নামা,

ভাল্লাগে না চারখানা দিন বছর বছর এ হাঙ্গামা।

লড়ছে ওরা, লড়ুক বাবা, অসুর এবং দেবের দল,

তোর বা আমার যায় আসে কি এ যুদ্ধতে, সত্যি বল?

আমরা তো স্রেফ পোষ্য প্রাণী, মাটি যতই ধরুক রূপ,

ছপটি মেরে খাটায় যখন,  অসুর বা দেব তখন চুপ।

তোকেও মানুষ পোচিং করে নামিয়েছে প্রায় নিঃশেষে,

তবুও ঘাড়ে নিস যে ওদের , বল দেখি কি বিশ্বেসে?


সিংহ বলে চুপ করে থাক, করিস না আর হাম্বাটি,

মানুষ নেতার মতন করে দিস না বাপু আর কাঠি।

সব জানোয়ার এক হওয়া ডাক হাঁকলে হবে ঘোড়ার ডিম

আমরা সবাই দেবীর গোলাম, তুই একা স্রেফ অন্য টিম।

খাচ্ছি দাচ্ছি দোলাচ্ছি ল্যাজ, পাচ্ছি পুজো ফি বছর,

মালিক ছাড়ার বললে কথা থাবায় আবার পিষবো জোর।

ওই প্যাঁচা আর ইঁদুরকে দেখ, আছে  কেমন মস্তিতেই

একটু যে দেয় পাত্তা মানুষ, তাতেও কি তোর স্বস্তি নেই?


মহিষ বলে পশুর রাজা , আজকে তোমার হাল দেখো

হালুম কেকা চিঁচির কোরাস, সঙ্গে হাঁসের প্যাঁকপ্যাঁকও।

যতই তোরা ওদের বয়ে ভান দেবতার কর দাদা, 

দেবতাহীন দেখলে তোদের থোড়াই পাবি মর্যাদা।

মালিক যখন কাজে লাগে, বর চাওয়া হয় তার থানে,

বাহন তখন আদর পাবে, মান দেওয়া নয় তার মানে।

বরঞ্চ এই আমাকে দেখ, ভেক আমি সেই অসুর রাজার,

আমার নামেই ডাকে তাঁকে, নামটা কোথায় পশুর রাজার?

তবুও বলি সে মান পেয়েও,  যুগে যুগে পাচ্ছি যা টের,

পূজ্য এবং পূজোর ভিড়ে জায়গা কোথাও নেই আমাদের।


সিংহ বলে , যা বলছিস ভাবার  মতোই রে মহিষ,

দেবদেবীদের ইচ্ছেতে সব, যেমন ঘোড়ার হয় সহিস।

হঠাৎ মায়ের খেয়াল হলে চড়বো এবার শার্দূলে,

বাঘের নামই করবে সবাই , আমায় যাবে কাল ভুলে।

এসব ভেবে ভয় লাগে আজ, ওরাই পুজো পাচ্ছে ভাই,

আমরা শুধুই থাকছি সাথে, মানের বেলায় যাচ্ছেতাই।

আয় রে ময়ূর ,কই রে প্যাঁচা, হাঁস আর ইঁদুর যা ঝটপট,

পুজো পাওয়ার ‘পাওয়ার’ চেয়ে  এবার বাহন ধর্মঘট। 


মিটবে কবে এই ঝামেলা , দেবতারা স্পিকটি নট…

********************* 

বাহন

সিংহ না হয় দুগগামায়ের যুদ্ধে লাগে কাজে,

গণপতির ইঁদুর কেন কেউ তা বোঝে না যে।

শনিদেবের শকুন বাহন হওয়াই স্বাভাবিক,

কার্তিকেয় সাথে ময়ূর মানায় কোথায় ঠিক?

প্যাঁচা কেন লক্ষ্মীমায়ের  সাথে সাথে ওড়ে?

মা শীতলা কেন আসেন ধোপার গাধা চড়ে?

হংস বাণীর অংশ কেনশিবের কেন ষাঁড়,

বিশ্বকর্মা আবার দেখো হাতিতে সওয়ার।

কে ঠিক করে কার সাথে কী থাকবে পশুপাখি,

এসব কথা প্রাচীন কোনো শাস্ত্রে বলে নাকি?

 

হয়তো বা তাইহয়তো বা নাজানেন জ্ঞানীগুণী

আমরা নানান বাহন নিয়ে কল্পনাজাল বুনি।

কেউ ভেবে নিই দেবদেবীরা ওদের পিঠেই চড়েন

পুজোর সময় জলদি এসে প্যান্ডেলে ল্যান্ড করেন।

প্যাঁচা ইদুর ময়ূর চড়ার কাজটা যে নয় সোজা,

ভালো করে ভাবলে সেটা আপনি যাবে বোঝা।

লাগাম কোথায় পরায় বলো হাঁসটাকে তার ঠোঁটে?

গণেশ পিঠে চাপলে ইঁদুর কেমন ভাবে ছোটে?

ময়ূর চড়ে যুদ্ধে গেলে দেবের সেনাপতি,

ওড়েই না সে , বন্দী করা  সহজ হবে অতি।

শকুন তো খায় মাংস পচাকরলে বাহন তাকে,

পুজো পাওয়ার মানটুকু কি শনিদেবের থাকে?

 

বাহন মানে মোটেই জেনো বহনকারী নয়।

দৈব এবং বাস্তবতার নিখুঁত সমন্বয়,

ভক্তি যেন না চলে যায় শুধুই পুজোর দিকে,

প্রতিনিধি সেই কারণেই রয়েছে লৌকিকে,

আশেপাশেই ছড়িয়ে আছে , ভীষণরকম চেনা,

দেবদেবীকে করতে মনে মূর্তিকে লাগবে না।

সবার বাহন চারটে দিকের প্রকৃতিরই অংশ,

লোভী মানুষ লাভের লালায় না করে দেয় ধ্বংস,

সেটার জন্য কেউ ভেবেছেন বুদ্ধি করে উপায়,

দেবতাদের সাথে যদি এরাও পুজো পায়,

হয়তো তখন মারতে এদের কাঁপতে পারে হাত,

দেবতাদের কোপের ভয়ে করবে না আঘাত।

 

মানুষকে সেই পূর্বজরা চেনেননি নির্ঘাত

=======================

সমীরণ ঘোষ

শুশুক ও পিঠের কেদারা

১.

অপরিমেয় ঘূর্ণির ভেতর আমি আর আমার শুশুক


হয়তো মধ্যযাম।সন তেরোশো সাতাশ। শূন্য থেকে

দেরাজ নামছে। ধু-ধু জল। বায়ু প্রার্থনাহীন

নভস্তল চৌচির সাদা দুরাশার। শুশুকের পিঠে

এই কুহকযাত্রার ধুন বিরহপ্রবীণ


তত ফেনার শীৎকার। অসীম জলধি। ভাঙা


অন্তরীক্ষে ছায়া ফেলে দেরাজের অপস্রিয়মাণ রেখা


২.

লাভা ঠেলে জ্যান্ত রেখেছি ইঞ্জিন। বায়ুপথ। চাকার

পাষাণ। লালার রোদ্দুর পড়ে শুশুকের পিঠের

হাওদায়। সোহাগে বিলকিস

টং লেগে উথলে যাচ্ছে পারার আকাশ 


৩.

শুকনো কঙ্কাল পিঠে কতদূর, শুশুক ভাবছে

ওর কাঁধে কতদূর অঙ্কুশ সম্ভব, ভাবি

মৃত দস্তাবেজ। পাল্লা ঠেলতেই কলকব্জার ঘুম

ভাঙা গ্রামোফোন। হাড়ের দলিল। পরচা খতিয়ান

ওড়ে ধাতুভস্ম। প্রত্নজোনাকি। রাত্রি ফলার

জিভে চাঁদ তোলে। জলে অস্থিপঞ্জর


শুশুক আমাকে পিঠে ঢেউয়ের করাতে নেমে যায়


৪.

আমার ময়লা জামা কেচেকুচে শুশুক মেলছে

এই অন্তরীক্ষ। হয়তো কিছুই নয়। আঁকশি দিয়ে

টেনে নেবে হাসানের ঘোড়া। হয়তো সূর্যাস্ত বুনে

কারবালা খুলছে আজও হোসেনের শ্বাস


আচম্বিত মহাকাল। শুশুক নেমেছে জেনানাসুলভ

স্নানে।ঘুমের গোসল


জলের গন্ধে এত হাহাকার। আশমানে।পাতালছায়ায়


৫.

শুশুক আমাকে নিয়ে চলে যাবে ময়ূরভঞ্জ

শুশুক আমাকে পিঠে উটের জয়সলমির

শুশুক আমাকে ছেড়ে তামাকগাছের নীচে মরে যাবে


আমার ভ্রমরকল্প পুঁতে দেবে পানিসিঙাড়ায়

পচা হাড় ও মাংসের শীতে শুশুক বসেছে

কালো ধ্যান। কালো খুলির ইশারায় 

আল্লা রহম। যদি বিন্দুর খুন ফোটে অবিচ্ছিন্ন 

পানার আভায়

=======================

আফজল আলি

বাহন - ১

পাঁচ ঠাকুরের মতো আমার একটা বাহন থাকলে কী ভালোই না হত

কিন্তু ইঁদুর বা ময়ূর যদি আমার বাহন হত তাহলে

তাহলে কি আমি পারতাম অফিসের কাজে বা বাজারে

সেই বাহন নিয়ে যেতে

সিংহের কথা বাদ দিলাম কারণ সিংহকে বাহন করার মতো

শক্তি আমার নেই

তবে ওইরূপ প্রাণী বাহন হিসেবে পেতে আমাকে অবশ্যই

দেবত্বগুণ অর্জন করতে হবে

কারণ দেবতা ছাড়া মানুষদের ওরকম বাহন হলে

কী আর কাজে লাগবে

ময়ূর শোভা বর্ধক আর সাদা-ইঁদুরও তাই

তবে যাই হোক দেবতাদের বাহন -ধারণা থেকে মানুষ রপ্ত করেছে

কীভাবে দ্রুত গতিতে নিরাপদে যাওয়া যাবে

মোটরবাইক,  কার  এসব ব্যক্তিগত বাহন থেকে আরম্ভ করে

টোটো বাস ট্রেন এরোপ্লেন কত সব ডিভাইস

এতক্ষণ নিশ্চয় ভুলে গেলেন ওই দুর্বল প্রাণীদ্বয়ের কথা

আর কি ভাববেন ওদের বাহক হিসেবে , দেবতা তো আর হচ্ছেন না

********************* 

বাহন - ২

বাহন হল যে বহন করে নিয়ে যায়

একটা মানুষ তো আর একক অবলম্বী হতে পারে না

তার নানান কাজের জন্য নানান মাধ্যম প্রয়োজন

শ্রমিক কৃষক শিক্ষক ডাক্তার এরা কি বাহন নয়

সমাজের প্রতিটা মানুষই কি একে অপরের বাহন নয়

একজন কবি সুস্থ চিন্তার বাহক, 

একজন বিজ্ঞানী প্রগতির বাহন

রাজনীতি নেতাদের কোন গোত্রে ফেলা যাবে এ হেন

চিন্তার বাহন যদি বই এবং মগজ হয়

তাহলে শরীরও কি কম যায় নাকি

আবার শরীরের বাহন যদি মন হয় , মনের বাহন কে ?

আসলে মনকে বহন করতে হয় না

সে একা একক উড়ে চলে যথা খুশি যখন যেভাবে

বাহনের কথা বলতে বলতে মনের ভিতর ঢুকে পড়লাম

মন বাদ দিয়ে কী করে লিখতে পারি বাহন বিষয়ে কবিতা

একটা শক্তিশালী মানুষকে বয়ে নিয়ে চলে

একটা শক্তিশালী মন

নির্মলেন্দু কি জানে

এই গ্রহের যাবতীয় সামগ্রী বহন করে চলেছে একটা পৃথিবী

আমাদের সকলের একটা বাহন হলে কী ভালোই না হত

********************* 

একক অবলম্বী

আজ সকালে বলেছি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেব সব

কোমরের যন্ত্রণা ,পুরনো বাইক , বয়সের ভার

কয়েকটা শব্দ মিশে গেছে ভুলে , উড়িয়ে দেব ওদেরও

সমস্ত নির্ভরশীলতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করব

একক অবলম্বী

আমার দরকার শুধু একটা আমি , আমার বাহন

প্রবল যন্ত্রণায় ডুবেও যেন বলতে পারি আমিই হব কাণ্ডারি

সংকট শুধু ফালতু চোখ রাঙায়

এত ভরসা আছে এত উপমার আলোড়ন

আয়েশা নামে ডাকা সেই অপার্থিব মানবী তো ছিল একদিন

নিশ্চুপ আড়াল থেকে ওই যে দূরের আকাশ

নীল নীল ব্যথার সমুদ্র

কথা বলার মাঝে যখন শালিক উড়ে যায়

সেই ভাসমান পংক্তির খাঁজে বেচেন দিল , মুসকান করে দেব সব

যেন এক পলকের একটু দেখাই শুধু আমার রয়ে যায়

********************* 

ঢেঁকির সপক্ষে

বাহন নিয়ে সবচেয়ে ভালো কবিতা লিখতে গেলে

আমাকে ঢেঁকির সাহায্য নিতেই হবে

কারণ বুদ্ধি তথা খেলানো বুদ্ধির দৌড়ে নারদের ধারেকাছে কেউ নেই

নারদ ঠিক কোন পক্ষের হয়ে কথা বলেন তা কেউ সঠিক ধরতে পারবে না

কলহ সৃষ্টির দেবতা  নারদের কাজ সম্পর্কে কি আমরা অবহিত নই

এহেন ঋষি তথা দেবতার বাহন ঢেঁকি কিন্তু কম যায় না

সে তো মর্তেও ধান ভানে  এবং স্বর্গে গিয়েও

তখন আমি ছোট

তখন ঢেঁকি ছাঁটা চাল খেতাম আবার আটার গুড়ি ঢেঁকিতে কোটা হত

ঢেঁকির কথা উঠলেই আমার মায়ের কথা মনে আসে

আমি ঢেঁকিতে পা দিয়ে পাড় দিতাম , মা হাত দিয়ে চাল নাড়াতেন প্রতি পাড়ে

পায়ের জোর লাগত বেশ , কমজোরি হলে হবে না

মা যতদিন জীবিত ছিলেন , আমার মনকেমনের রোগ ছিল না

কারণ মা ছিলেন আমার একনিষ্ঠ বাহন

এখনও তো বিপদে পড়লে মনে মনে মায়ের নামটাই বেশি আসে

তাই ঢেঁকির সাথে যেমন নারদের তেমনি ঢেঁকির সাথে মায়ের কথা

আর মায়ের সাথে আমার

তাই ঢেঁকি নিয়ে যে কোনো কবিতাই আমার উৎকৃষ্ট হয়ে ওঠে

মাকে নিয়ে কোনও কবিতা কি খারাপ হতে পারে কখনও

=======================

মৌসুমী ভৌমিক

এবার পুজোয়

লক্ষ্মীর পেঁচা, রাত্রিবেলা ওড়ে 

সরস্বতীর হাঁস, প্যাকপ্যাকিয়ে ঘোরে 

তারা এবার জেদ ধরেছে থাকবে মুখোশ পরে।


গণেশের ইঁদুর, চুপটি করে থাকে 

কার্তিকের ময়ূর,শোভা তার পালকে

দেবে নাকি সাক্ষাৎকার তারা টিভি চ্যানেলকে।


নন্দী ষাঁড়ের নেই হেলদোল কারোর পরিহাসে 

মা দুর্গার সিংহ হুংকার দিয়ে আসে 

কাশফুলের ভয় নেই, মাথা হেলিয়ে হাসে।

********************* 

সাইকেল 

সাইকেল কে আবিষ্কার করেছিল তা জানার 

আগ্রহ না থাকলেও নতুন সাইকেলটা কোন রঙের

আর কোন কোম্পানির তা জানার আগ্রহটা তুঙ্গে।


যদিও তাতে সাইকেলটিরও আনন্দবর্ধন ঘটে

বিক্রেতা ও ক্রেতার হাতবদলেও তার সুখ

পাটিগণিতের কিলোমিটারেও তার দৌড়সুখ 

টিং টিং শব্দে তার শ্রবণসুখ


অবশ্য তার নিয়মানুবর্তিতায় অমনোযোগী হলে

উপহারে কী থাকে তা উহ্যই থাক


তবু পথ আর দৌড় - এর ক্যালকুলেশনের চেয়ে

সাইকেল চালানোর অনুভবটাই সুন্দর।

********************* 

বাহন 

শাস্ত্র অনুসারে নরকের বৈতরণী নদী পার হতে

গো বাহনের প্রয়োজন পড়ে ।

গো কথার অর্থ বুঝতে গেলে বিশ্বদর্শন হয়ে যাবে

সুতরাং সমীচীন হবে কীভাবে পারাপার করা যায় তা ভাবা।

স্বর্গ থেকে ট্রেনিং নিয়ে জেনে এসে শাস্ত্র লেখা হয়েছিল কিনা তার অনুসন্ধানে না যাওয়াই যখন বুদ্ধিমানের কাজ, তখন চোখ বন্ধ করে গরুর লেজে ভরসা রাখাই ভালো।


অবশ্য গরুর মৃত্যু হলে কার সাহায্য প্রয়োজন পড়ে সেটাই আপাতত ভাবনার বিষয়।

=======================

তমোঘ্ন চট্টোপাধ্যায়

না-হন বা হন

মাটির সন্তান সে

জীবনময় ধুলোর সংসার 

সে অবশ্য বলে ধুলোর ঝড়


দু'পাশে তার সদা-সতর্ক দেহরক্ষী যুগল -

অভাব আর অনটন 

তাদেরই কাঁধে হাত-রেখে নিজেকে সে সদর্পে 

ঘোষণা করেছে - "অমৃতের সন্তান"


দিন তার কাছে যুদ্ধক্ষেত্র 

রাত তার বিজয়ী সৈন্যশিবির 

শিবিরে দাঁড়িয়ে সে প্রতিদিন বিজয় ঘোষনা করে।

চিৎকার করে বলে - "আজও বেঁচে আছি আমি"


সেই চিৎকার শুনে গর্জন করে ওঠে তার বাহন।

পরাক্রমী বাহন তার, অনেকটা সিংহের মতো


সে তার প্রিয় বাহনের মাথায় হাত বোলায়

আর আদর করে তাকে স্বপ্ন বলে ডাকে ...


২.

বুঝতে খানিকটা দেরিই হয়েছে

ব্যাপারটা এতটাই নিখুঁত যে বোঝাটা কঠিনও ছিল

বলা যেতে পারে অকল্পনীয় ভাবে অসম্ভব


সত্যিটা হ'ল - আমরা ঠকে গিয়েছি

সব্বাই ডাহা ঠকে গিয়েছি


এতো ঝগড়াঝাঁটি, প্রেম-বিরহের পর

যুগযুগান্তর এত আয়োজনের পর

জানা গ্যালো আমরা সবাই একই দিকে হাঁটছি! 

অথবা আমাদের হাঁটানো হচ্ছে একই দিকে! 


যার শেষ প্রান্তের নাম মৃত্যু


অথচ আমরা মৃত্যুর দিকে যেতে চাইনি

আমরা সবাই জীবনের টিকিট কেটেছিলাম


আমরা জানতে পারিনি -

জীবন আসলে মৃত্যুর বাহন ...


৩.

সে আপনি যেখানেই ছুটি কাটাতে যান

আপনার জন্য সাজানো থাকবে 

'সেভেন পয়েন্ট' কিংবা 'ফাইভ্ পয়েন্ট' -

সেই জায়গার পাঁচ থেকে সাতটি দর্শনীয় স্থান


এগুলো না-ঘুরিয়ে গাইড আপনাকে ছাড়বে না


তা, জীবন আর বাদ থাকে কেন? 

ছুটি কাটানোর এমন স্থান আর কোথায় পাবেন! 


এর বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান আপনাকে ঘুরতেই হবে


সুখ দুঃখ প্রেম বিরহ ঘৃণা রাগ অভিমান 

জীবনের "সেভেন পয়েন্ট"


আপনাকে অবশ্য একটি বিশ্বস্ত বাহন দেওয়া হবে,

যে আপনাকে নিজের কাঁধে চাপিয়ে সবক'টা জায়গা ঘুরিয়ে আনবে।


ওর নাম সময়।


না, আপনাকে ডাকতে হবে না; ও নিজেই আপনাকে ডেকে নেবে। নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন।

=======================

রাজকুমার ঘোষ


বাঁধন

'এ বাঁধন আমার মা বেঁধে দিয়েছিলো, 

খোকা, তুই তা বুঝবি নারে... 

সে কোন ছেলেবেলায় মা বাবাকে রাজি করিয়ে,

এই বাঁধনের জিনিস কিনে দিয়েছিল 

এ বাঁধনে কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে। 

মা'র স্নেহ মমতা সবই লেপ্টে আছে.. '


দীর্ঘ ছয় বছর স্কুলে, এ বাঁধনেই বেঁধে ছিল

এখন তো ভুলে যাবেই। 

চমকের দুনিয়ায় বাবার রাগত আক্ষেপ তার ছেলের ওপর... 

বাবার এ বাঁধন তুচ্ছ মনে হয় ছেলের.. 

কলেজে ভর্তি হয়েছে, 

সকলের সামনে এই লড়ঝড়ে বাঁধন সম্মানহানি করে।


'এই সাইকেলের সাথে আমার অটুট বাঁধন, 

খোকা, তুই তা বুঝবি নারে...' 

********************* 

ছুটছে জীবন

লক্ষ্য নেই, তবুও ছুটছি এ-প্রান্ত হতে ও-প্রান্ত

পাওয়ার নেশায় মত্ত হয়ে জীবন যে আজ ক্লান্ত

হোঁচট খাচ্ছি বারেবারে তবুও হব না শান্ত?

প্রাপ্তি যোগ শূন্য হতেই গহীন এ মন অশান্ত।

 

স্মৃতিগুলো সারি সারি সেজে আছে তার ভেলায়

জীবন যুদ্ধে জয় পরাজয় মেতেছি কোন খেলায়

ছুটছে জীবন দিশাহীন, নতুন মোহের মেলায়

একাকিত্বের ঘেরাটোপে মন বন্দি হয়েছে হেলায়

 

শক্ত হাতে ধরার মানুষ হারিয়ে গেছে এখন

সবাই নিজেকে রাজা ভাবি, থাকেনা কোনো শাসন !

আলগা হয়েছে সম্পর্ক, থাকছে না কোনো বাঁধন,

দোলাচলে দোলে জীবন, সয় হরেক যাতন।

 

জীবন আবার ঠিকই পাবে সঠিক পথের খোঁজ

শক্ত বাহনে সংগ্রামী মন লড়ে নেবে হররোজ

********************* 

সংগ্রামী বাহন

কঠিন সময়, দুই মিতালীর সংগ্রামী সাতকাহন 

প্রতিদিনের যুদ্ধে গ্রাম থেকে যায় শহরে 

সুখ-দু:খের গল্পে জীবন স্রোতের বহরে 

নতুন আলোর দিশায় তাদের দুই চাকাটাই বাহন। 


অতিমারীর আবহে কোনো কাজই হয়না স্থায়ী

দুই মিতালী ছুটতে থাকে কর্মসন্ধানে 

পরিবারের বোঝা কাঁধে অটুট বন্ধনে 

ছোটার পথে তাদের সাথী, বাহন এই দু'চাকাই


ধীরে ধীরে হলেও জীবন ফিরবে নতুন ছন্দে 

দুই মিতালীর লড়াই থাকবে তবু জারি 

সুখ-আলোর সাথেই ফিরবে ঠিক বাড়ি 

দু চাকার ঐ বাহন সহ থাকবে সদা আনন্দে।

=======================


No comments:

Post a Comment