Monday, August 15, 2022

আমাদের পদক্ষেপ পরিবার আয়োজিত বিশেষ ইভেন্ট "স্বাধীনতা"

 

বহু রক্তক্ষয়ের পর স্বাধীনতা পেয়েছিলাম আমরা ৷ ঘটেছিল দেশ বিভাজন ৷ রাজনীতির পাশাখেলায় তারপর থেকে আমরা অর্থাৎ আম জনতা নানাভাবে পিষ্ট হতে হতে হয়তো আজ 'স্বাদহীন'ভাবে স্বাধীন রয়েছি ৷ এই স্বাধীনতা কতখানি পরাধীনতা থেকে মুক্তি আর কতখানি ক্ষমতার হস্তান্তর তা নিয়েও রয়ে গেছে বিতর্ক ৷ তবু আজকের দিনটা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ৷ তাই এই দিনটাকে উদযাপন করতে দেশজুড়ে গৃহীত হচ্ছে নানা কর্মসূচি ৷*

*আমাদের পদক্ষেপ পরিবারের পক্ষ থেকে আজকের দিনে পরিবারের সকলকে জানাই আন্তরিক শুভকামনা ৷ পূর্বঘোঘণা অনুযায়ী আজ আমাদের এই পরিবারের যৌথ দেওয়ালে আয়োজিত হবে বিশেষ ইভেন্ট— "স্বাধীনতা" ৷ ইতিমধ্যে আপনাদের পাঠানো লেখাগুলো আমরা একে একে পোস্ট করব এখানে ৷ সেই ধারাবাহিকতা যেন ক্ষুণ্ণ না হয়, সেজন্য ইভেন্ট চলাকালীন গ্রুপটি অনলি অ্যাডমিন করে রাখা হবে ৷ আপনাদের অনুরোধ, ধৈর্য রাখবেন ৷ সাথে থাকুন ৷* 

----+++---
স্বাধীনতা-৮৫
 ছাই
আর্যতীর্থ


ভোরের কুয়াশা মেখে একটা বিশাল মিছিল পথে নেমেছে।
নানা ভাষা নানা বেশে স্লোগান দিচ্ছেন যারা, তাঁদের দিব্যি চেনা যায়
কারোর মূর্তি আছে যত্নে সাজানো, কারোর  দেখেছি ছবি হিস্ট্রির বই-য়ে, 
আর আরো অনেককে  সেলুলার লাহোর ও আলিপুর জেলে ভারাক্রান্ত নামের তালিকায়। 
আজ তিয়াত্তর বছর স্বাধীনতা অতিক্রান্ত করে, কেন যেন ওরা নেমে এসেছেন অকস্মাৎ জীবিত পৃথিবীতে!
আর কি অদ্ভুত ,অলৌকিক মিছিল চলেছে এক আশ্চর্য শ্লোগান দিতে দিতে,
অগণিত অশরীরী সমস্বরে বাতাস কাঁপিয়ে বলে চলেছেন
‘ছাই চাই!  চাইনা ঠাঁই, ছাই চাই!’
কি প্রচণ্ড ক্রোধ সেই স্বরে, কি ভীষণ বিষণ্ণতা লেগে আছে মুখে,
চোখ থেকে মুছে গেছে সব রোশনাই।

মিছিলের পুরোভাগে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, পাশেই সুভাষ চন্দ্র বোস হাঁটছেন,
কি আশ্চর্য, তাঁদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ক্ষুদিরাম, তিন যতীন ,
মাস্টারদা সূর্য সেন..
আমি কি ভুল দেখছি? চোখ কচলে আবার দেখি হেঁটে যাচ্ছেন নেহরু, প্যাটেল, খান আব্দুল গফফর খান,
তাঁদেরই পাশে ভগৎ সিং আসফাকুল্লা খান চন্দ্রশেখর আজাদ,
সংগ্রামে কখনো ছিলোনা যাদের সহাবস্থান,
তাঁরাই আজকে মিছিলে এক! চিত্তরঞ্জন দাসের পাশাপাশি মানবেন্দ্র রায়, বাল গঙ্গাধর তিলক হাঁটছেল কানাইলালের সাথে,
সকলে দৃপ্তস্বরে তোলেন সেই একই স্লোগান, মুখগুলো বেঁকে যাচ্ছে অবর্ণনীয় কোনো যন্ত্রণাতে,
‘ছাই চাই! চাইনা ঠাঁই, ছাই চাই!’
আরো ভালো করে দেখার জন্য, ভাবলাম একটু সামনে যাই।

আমাকে দেখেই , শ্লোগান থামিয়ে ঘিরে ধরলেন ওঁরা। ‘পাওয়া গেছে, উত্তরস্বাধীনতা ভারতের এক নাগরিক’..
দুচারজন সংগ্রামী তখনো সন্দিহান, প্রফুল্ল চাকি বলে উঠলেন ‘কাগজপত্র দেখে নিয়েছেন তো ঠিক,
শুনেছি পঞ্চাশ বছরে তামাদি নথিতে অতীত না দেখা গেলে নয়-নাগরিক বলে ডাকে আজকাল’
মাতঙ্গিনী হাজরা আর প্রীতিলতা ওয়াদেদার একসাথে বিলাপের সুরে বলে উঠলেন ‘ কপাল, কপাল!’
‘সেই সব পরে হবে, আগে জিজ্ঞেস করি ওকে, দাঁড়াও’। আমার সামনে বাঘাযতীন সীমান্ত গান্ধী আর সূর্য সেন,
রুষ্ট মুখগুলো হতাশা ও বিষাদে মাখামাখি
‘আমাদের চোখে চোখ রেখে বলো, যে ভূমি স্বাধীন করতে আমরা লড়েছি,
তার খণ্ডরা পরস্পরের সাথে লড়ছে এখন। তাহলে আমরা কাকে দেশ বলে ডাকি?’

‘ওসব এখন থাক’। তীব্র গলার স্বরে ঘুরে দেখি বলছেন নাকামুরায়ার বসু ওরফে রাসবিহারী,
‘ত্রিবর্ণ উড়িয়ে এই এতগুলো বছরে কি স্বাধীনতা পেলে ব্যাখ্যা শোনাক ও তারই,
আগে ইংরেজ আর এখন ওপরে ওঠা কিছু নেতা ও ব্যবসায়ীর গোলাম রয়ে গেলো দেশটা,
এটা সেই স্বাধীনতা নয়, এই অগণিত লোক প্রাণ বাজি রেখে যার করেছে প্রচেষ্টা,
এই ভুয়ো স্বাধীনতা পুড়ে যাওয়া ভালো। আজাদির নামে এই ভণ্ডামী এখন সহ্যের ছাড়িয়েছে সীমা,
দেশ মানে চেতনা, সকলের ভালো থাকা সমানে সমানে, তোমরা ভেবেছো কিছু অক্ষ দ্রাঘিমা!’

অমনি সকলে মিলে আবার শ্লোগান.. ‘এ ব্যর্থ স্বাধীনতাপোড়া ছাই চাই! এই ধর্ষণখুন , জাতিদাঙ্গায় পেছনের দিকে যাওয়া ভূমি আমাদের নয়!’

আমি স্বপক্ষে কিছু বলবার আগেই , স্বপ্ন ভেঙে যায়।
অতীতের অগণিত সংগ্রামী মুখে স্বপ্নচ্যুতির শ্লোগান পাখার ঘড়ঘড় আওয়াজে মেলায়।

শুধু  কুয়াশার মতো ঘন হয়ে রয়ে গেলো ভয়।
-------------------------
স্বাধীনতা-৮৬
স্বাধীনতা
নির্মলেন্দু কুণ্ডু

আরো একবার আকাশে উড়বে তেরঙা
সগর্বে...
বিশ্লেষিত হবে অতীত,
পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে উঠে আসবে
যত কাসুন্দি...
সবার বুক ও মুখে থাকবে একটাই নাম৷
অথচ তার ফাঁকেই
নিঃশব্দে ঘটে চলবে কিছু ব্রেকিং নিউজ,
পরাধীন হতে থাকবো আমরা
আমাদেরই হাতে!
সবাই সোল্লাসে চিৎকার করছে,
তবু কোথাও যেন একটা খবরদারি—
"চুপ,আমরা স্বাধীনতা মানাচ্ছি!!"
----------------- 
স্বাধীনতা- ৮৭
অভাগিনী
আর্যতীর্থ

তখন ভোর হচ্ছে, দু হাজার বাইশের পনেরোই আগস্টের ভোর ।
কিছুক্ষণ বাদেই তেরঙ্গা পতাকার ঢল নামবে রাস্তাঘাটে।
স্টেজে স্টেজে নির্ঘুম শেষমুহূর্তের প্রস্তুতি চলছে জোর।
 তবে আপাতত, কয়েকটি শ্রান্ত শ্রমিক ছাড়া কেউ নেই তল্লাটে।
প্রায়ান্ধকার পথ ধরে হেঁটে আসছিলেন তিনজন আবছা মানুষ
দুজন ধুতি আর শার্ট, আর একজন সাহেবী টুপিসহ স্যুট,
শুনশান পথ ধরে ইতিউতি চাইছেন তিনজন দৃপ্ত পুরুষ,
বড় বড় বাড়ি আর চওড়া রাস্তা দেখে কিছু যেন অপ্রস্তুত।
চায়ের দোকানে সবে প্রথম কেটলিজল টগবগে ধোঁয়া উগরায়,
এ দৃশ্য তাঁদের চেনা; অতীতের বহু প্ল্যান এমনই দোকানে হতো বটে।
তিনজন বসে যান ফাঁকা বেঞ্চিতে। অবাক দোকানী তার নজর ঘোরায়,
মান্ধাতা আমলের এমন পোশাকে লোক তার এখানে কদাচিতই জোটে।
টাকপড়া ধুতি শার্ট , দোকানীকে দিতে বলেন চা। তারপর  প্রশ্ন করেন ধীরে ধীরে,
' আজ কি এখানে কোনো উৎসব হবে নাকি ,চারদিকে জমকের সাজ?'
দোকানী অবাক হয়, লোকগুলো মঙ্গল গ্রহ থেকে উড়ে এলো কি রে,
ঈষৎ বিরক্ত মুখে চা ছাঁকতে ছাঁকতে বলে, যাত্তেরি, স্বাধীনতা দিবস যে আজ!
' স্বাধীনতা! কাঙ্খিত স্বাধীনতা! , তিনটে আকুল স্বর সোচ্চারে বলে ওঠে,
'শোনাও শোনাও বন্ধু, কবে হলো? কতদিন ধরে দেশে ইংরেজ নেই আর, শুনি,বলো, বলো!
দোকানী প্রমাদ গোনে। উন্মাদ নাকি এরা? নাকি সব ভুলে গেছে খোয়ারির চোটে?
তবুও ধৈর্য্য রেখে , কিঞ্চিৎ হেসে বলে, নয় নয় করে আজ পঁচাত্তর হলো।
' তার মানে কলকাতা স্বাধীন? স্বাধীন তবে নদীয়া, কুষ্টিয়া, বালাসোর....'
বক্তা অন্য ধুতি শার্ট, কোঁকড়ানো চুল, পেশীবহুল চেহারা, বিহ্বল দৃশ্যত।
'সে তো বটেই,' দোকানী বলে। পুরো ভারতই স্বাধীন, কিন্তু কুষ্টিয়াকে আনলেন কেন এর ভেতর?
' কুষ্টিয়া নয়?' টাকমাথা বললেন, ' চট্টগ্রাম , ময়মনসিংহ, ঢাকা আজও তবে ব্রিটিশের পদানত?'
দোকানী বুঝতে পারে, অতীতেই আটকিয়ে থেকে গিয়েছেন কোনো ভাবে তিন খাপছাড়া।
' ওরাও স্বাধীন, তবে ভারতবর্ষ নয়। ও জায়গাগুলো বাংলাদেশে অধুনা।'
কেমন অবাক হয়ে, নির্বাক চোখে ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে থাকেন তাঁরা।
এতক্ষণ চুপ থাকা স্যুট টুপি বলেন, 'লাহোর বা অমৃতসর নিয়ে আছে কিছু শোনা?'
বাকিদের না চিনলেও, দোকানি ফেলেছে চিনে স্যুটটুপিকে। বহুবার বহু ছবি দেখে।
নিজেকে চিমটি কাটে, এও কি সম্ভব, স্বয়ং ভগৎ সিং বলছেন এসে কথা চায়ের দোকানে?
বাঘাযতীন ...সূর্য সেন.... ইতিহাস বই থেকে বাকি দুজনকেও চেনে একে একে,
অস্ফুট স্বরে বলে, 'অমৃতসর ভারতে হলেও, লাহোর অন্য দেশ, ওটা পাকিস্তানে।'
চোখ চাওয়াচাওয়ি করেন তিন বিপ্লবী। যে স্বাধীনতার জন্য তাঁরা জীবন দিলেন,
সেটা কোন দেশের? কোথায় তাঁদের সেই সোনালী স্বপ্ন দেখা অখণ্ড ভারতবর্ষ?
'এই তিনটুকরো স্বাধীনতা আমরা চাইনি!' হাহাকার করে কাঁদেন বাঘাযতীন, ভগৎ সিং , সূর্য সেন,
দিগন্তে তখন প্রথম সূর্যকিরণ, অভাগিনী ভূমির মাথায় দিলো কোমল সান্ত্বনাস্পর্শ...
------------------------ 
স্বাধীনতা- ৮৮
স্বাধীনতা
কৃষ্ণা পাল রায়

স্বাধীনতা তুমি কোথায়?
ফুটপাথের ঐ ময়লা বিছানায়, 
না, সুখ কবিদের সুখের কবিতায় ।

স্বাধীনতা তুমি কোথায়?
শ্রমিক কৃষকের রক্তঝরা ঘামে, 
না,  স্বেচ্ছাচারিদের হাতে থাকো নির্দ্বিধায়।

স্বাধীনতা তুমি কোথায়?
খুঁজছে নারী অসহায়, 
যেখানে ধর্ষিতা বিচার চায়।

তুমি কি আছো না পাওয়াদের  মিছিলে?
তুমি কি আছো মায়ের শীতল আঁচলে!
তুমি কি আছো যেখানে ছুটছে মানুষ পেটের টানে?
তুমি কি আছো চিন্তনে মননে শিক্ষণে!

তুমি কি সেই বুলেট বোমা আগুন রক্তমাখা স্বাধীন হবার স্বাধীনতা ?

স্বাধীনতা দে জ্বেলে দে বুকের ভেতর আবার দ্রোহের আগুন।
---------------------- 
স্বাধীনতা- ৮৯
মুক্তি
দেবব্রত ঘোষ মলয়

হারাধন আজ সকাল সকাল বাড়ি ফিরেছে। ভাঙাচোরা আলকাতরার টিনের দরজা ঠেলে এক চিলতে উঠোনে প্রবেশ করে হারাধন। পাঁচ ইঞ্চি ইটের দেওয়ালে টালির চালের ভাঙাচোরা বাড়ি তার। হারাধনের বউ শেফালী পাঁচ বাড়ির কাজ সেরে বাড়ি ফিরে দাওয়ায় বসে তাওয়ায় রুটি বেলছে। এত তাড়াতাড়ি হারাধনকে আসতে দেখে চোখ কুঁচকে তাকায় তার দিকে। বলে - ব্যাপারটা কি আজকে কি কোন ভাড়া পত্তর পাওনি?
মুচকি হেসে হারাধন বলে - আজ ভালোই হয়েছে ভাড়া। একজন পাঞ্জাবি পড়া বাবু অনেকগুলো বই নিয়ে রামতলায় কলেজে গেলেন। ওখানেই তো একশ টাকা পেয়ে গেলাম। তারপর দু তিনটে খুচরো ভাড়া পেলাম। কোথাও কিচাইন হয় নি রে। তারপর এইবিকেলে আমাদের নেতা বাবু উঠেছিলেন রিক্সায়। আজ দেনাকে বেশ খুশি খুশি লাগছিল। বাবু দেখতে তো সুন্দরই, পাট ভাঙ্গা পাজামা পাঞ্জাবিতে আরও ভালো লাগছিল। আমার সাথে অনেক গল্প করলেন। বললেন - আগামীকাল আমরা দুর্গাপুজোর মাঠে পতাকা উত্তোলন করব। এবার আমরা সমাজের নিপীড়িত কিছু মানুষকে সম্মানিত করবো। তুই কিন্তু একদম ভোর ভোর উঠে স্নান করে পরিষ্কার জামা কাপড় পড়ে দুর্গাপুজোর মাঠে চলে আসবি।
শেফালী হারাধনের মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে বলে - এই নিপীড়িত মানুষটা কি রে?
হারাধন হাত উল্টিয়ে বলে - কে জানে ওসব বাবুরা কি যে ভাষা বলে। তবে মনে হয় কিছু খাওয়াবে টাওয়াবে, সম্মান বলতে বোধহয় ওটাই বুঝিয়েছে। 
শেফালী দাওয়া থেকে রুটিগুলো নামিয়ে উনুনে  সেঁকতে থাকে। তারপর বলে - তা যাও। যখন নেতা বাবু ডেকেছেন। এতবার বলেও তো কই বিপিএল কার্ডটা হলো না। কাল একটু বলো তো কানে কানে যেন বিপিএল কার্ডটা করে দেয়।
হারাধন উঠোনের এক পাশে রাখা বালতির জলে হাত পা ধুতে ধুতে বলে - সে সব বলবো খন। এখন দে তো কয় খান রুটি, খুব খিদে পেয়েছে।
উনুনের পাশেই ছোট্ট দাওয়ায় কেরোসিনের আলোয় খেতে বসে হারাধন। ইলেকট্রিক বিল দিতে না পারার কারণে ছ মাস হল ওর বাড়ির লাইটের কানেকশন কেটে দিয়ে গেছে। রুটি আর আলুর তরকারি গোগ্রাসে গিলতে থাকে হারাধন। মুখরা শেফালী খাওয়ার এই সময়টায় হারাধনের দিকে মায়া ভরা চোখে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে বলে মুরদ নাইবা থাকলো সারাদিন তো খাটে মিনসেটা। আর সব থেকে বড় কথা এ লাইনে থেকেও মদো মাতাল হয়নি ও। 
ওদের কোন ছানাপোনা হয়নি। ঘরের মেঝেতে পাতা বিছানায় খাওয়া দাওয়ার পর হারাধন শুয়ে পড়ে। শেফালির আরো কিছু কাজ থাকে সেগুলো সেরে যখন ঘরে আসে তখন হারাধন গভীর ঘুমে অচেতন।
পরদিন হারাধনের ঘুম ভাঙ্গে পাখির ডাকে। ধরফরিয়ে উঠে পড়ে দেখে সকাল ছটা। এত সকালেই দূর্গা পূজার মাঠ থেকে মাইকে পাড়ার ঘোষক চিনুদার গলা শোনা যায় -  প্রিয় অধিবাসীবৃন্দ, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হবে ভারতের ৭৫ তম স্বাধীনতা দিবসের উদযাপন। আপনাদের সবাইকে দূর্গা পূজার মাঠে সত্বর চলে আসার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে।
ধরফর করে উঠে পড়ে হারাধন খুব তাড়াতাড়ি কলঘরের কাজ সেরে আসে। রাতের পড়া লুঙ্গি কেচে মেলে দেয় উঠোনের তারে। ঝটপট সেরে নেয় স্নান। দেওয়ালের ভাঙ্গা আয়নায় দিকে তাকিয়ে চুল আঁচড়িয়ে একটা ফর্সা জামা আর প্যান্ট পড়ে নেয়। গত তিন বছর ধরে এই একটাই একটু ভালো জামাপ্যান্ট আছে ওর। কোন অনুষ্ঠান বাড়িতে যেতে হলে এটাই পড়ে যায়।
শেফালী তো অনেক ভোরেই উঠেছে। তার ঘর ঝাঁট দেওয়া, বাসনপত্র ধোয়া এসব কাজ শেষ হয়ে গেছে আগেই। এখন শাড়ির আঁচলটা কোমরে জড়িয়ে ঠিকে কাজের উদ্দেশ্যে রওনা দেবার উপক্রম করছে সে। হারাধনের দিকে তাকিয়ে বলে - আচ্ছা এই স্বাধীনতা মানেটা কি বলতো? 
হারাধন বলে - স্বাধীনতা মানে ছুটি আর ফুর্তি।দেখো না সব ইস্কুল, কলেজ, অফিস, কাছারি সব জায়গায় ছুটি থাকে। পাড়ায় পাড়ায় ফিস্ট হয়। মাইকে গান বাজিয়ে কত অনুষ্ঠান হয়।
শেফালী খর গলায় বলে ওঠে - তা আমাদের তো কেউ ছুটি দেয় না। বাবুদের বাড়িতে বাসন মাজতে, ঝাঁট দিতে যেতেই হবে, না হলে পয়সা কেটে নেবে।
হারাধন বলে - এ তো যার কপালে যা লেখা আছে বউ। ছুটি তো পাবে বাবুরা। 
শেফালী হন হন করে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে -  যাও ঘুরে এসো। কি সব সম্মান টম্মান দেবে। সব বাড়ি নিয়ে এসো কিন্তু। আর হ্যাঁ, যাওয়ার আগে মনে করে সীতারামকে ছোলার বাটিটা ভরে দিয়ে যেও।
হারাধন শেফালির সংসারে তৃতীয় জন হল সিতারাম। মানুষ নয় একটি টিয়ে পাখি। হারাধনের মা যখন বেঁচে ছিল গত বছর তখন টিয়ে পাখিটা উড়ে এসে তার উঠোনে পড়ে। কেউ বোধহয় তার ডানাটা কামড়ে ধরে ছিল, ইঁদুর টিদূর হবে, পাখিটা উঠোনে পড়ে হা করে কাতরাচ্ছিল আর মুখে কোন আওয়াজ আসছিল না। হারাধনের বুড়ি মা পাখিটাকে জল দিয়ে, খাবার দিয়ে ধীরে ধীরে কিছুটা সুস্থ করে। তারপর হারাধনকে বলে দেখ হারু, আমার এই কৌটোতে কটা পয়সা পড়ে আছে। বাজার থেকে একটা খাঁচা কিনে নিয়ে আয়। আবার না হলে কোন ইঁদুর ভাম কামড়ে খেয়ে দেবে পাখিটাকে।
এতগুলো পয়সা খরচ হয়ে যাওয়ার জন্য মনটা একটু খচখচ করলেও হারাধন খাঁচা কিনে আনে পরের দিন। সেই পাখি দিনে দিনে কখন যেন তাদের পরিবারের একজন হয়ে গেছে। মা চলে যাবার পরেও পাখির যত্নে কোন খামতি নেই। নিঃসন্তান দম্পতি তাকে জল, ছোলা সময় মত খাইয়ে দেয়। পাখিও আস্তে আস্তে মুখের বোল ফিরে পেয়েছে। এখন সে শুনে শুনে বলতে পারে "সীতারাম"। 
হারাধন খাঁচার দরজাটা খুলে ছোলার বাটিটা পরিষ্কার করে এক মুঠো ভেজানো ছোলা তাতে দিয়ে দেয়। তারপর খাঁচার দরজা আটকে পাখির দিকে চেয়ে বলে - দেখ সিতু, আজ তোকে বেশি করে ছোলা দিলাম। আজ যে স্বাধীনতা দিবস।
স্কুলের মাঠে গিয়ে পৌঁছে দেখে সে এক রই রই ব্যাপার। মাঠে পাতা চেয়ারে ছেলে বুড়ো অনেকেই বসে আছে, মাইকে দেশাত্মবোধক গান বাজছে আর ধোপ দুরস্ত পাঞ্জাবি শোভিত নেতা বাবু এবং পাড়ার অন্যান্য ছেলেরা ছোটাছুটি করে সমস্ত আয়োজন করছে।
অল্পক্ষণের মধ্যেই নেতা বাবু মাইকের সামনে এলেন এবং দু চার কথা বলতে শুরু করলেন। 
"বন্ধুগণ আজ ভারতের ৭৫ তম স্বাধীনতা দিবস।। আজ এই শুভ মুহূর্তে আমরা স্মরণ করব সেইসব বীর সেনানিকে, সেই সব স্বাধীনতা সংগ্রামীদের, যারা তাদের জীবনকে বাজি রেখে ইংরেজদের আরোপিত পরাধীনতার হাত থেকে আমাদের ভারত মাকে মুক্ত করেছিলেন। আমাদের এই দেশের মেরুদন্ড খেটে খাওয়া গরিব মানুষজন। সেরকমই কিছু মানুষকে আমরা আজ পতাকা উত্তোলনের পর সম্মানিত করব। 
হাততালির ঝড় বয়ে যায় নেতা বাবুর কথায়। তারপর জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হয়। ফুল ঝরে পড়ে সবার উপর। মাঠের একপাশে দাঁড়িয়ে থাকা কিশোর বাহিনী ব্যান্ড পার্টিতে বাজাতে থাকে জাতীয় সংগীত।
এরপরই হারাধন ছাড়াও আরো চারজন ওরই মত মানুষকে মঞ্চে তোলা হয় এবং তাদের প্রত্যেককে একটা করে শাল, একটা ছোট্ট স্মারক আর কিছু জিনিসপত্রের একটা প্যাকেট দেওয়া হয়।
হারাধনের চোখের কোন বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। তার রিকশাচালক জীবনে গালাগালি লাথি ঝাঁটা ছাড়া কিছুই জোটেনি কোনদিন। সে নেতা বাবুর পায়ে নমস্কার করে। নেতা বাবু তাকে দুহাতে তুলে ধরে বলেন - দেখ, আজ আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। ইংরেজরা আমাদের সমস্ত সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে বন্দী করে রেখেছিল। কাউকে বন্দী করে রাখলে তার সমস্ত নিজস্বতা আস্তে আস্তে শেষ হয়ে যায়। তাই আজ আমরা এই স্বাধীনতাকে স্মরণ করব।
অনুষ্ঠানের শেষে মাটির এক পাশে পাড়ার ক্যাটারার মুকুলের তত্ত্বাবধানে লুচি আলুর দম আর বোঁদে তৈরি হয়েছিল। আর সবার সঙ্গে হারাধন সেখানে খাওয়া-দাওয়া করে বাড়ির পথে রওনা দেয়।
আলকাতরার টিনের দরজা ঠেলে বাড়িতে ঢোকার সময় হারাধন লক্ষ্য করে খাঁচার ভিতর সীতারাম খুব ছটফট করছে আর মুখ দিয়ে তারস্বরে চিৎকার করছে।হারাধনে এগিয়ে যায় তারপর বলে - কি হলো সিতু, চেচাচ্ছিস কেন? কাউকে দেখে ভয় পেয়েছিস? ইঁদুর টিদূর এসেছে নাকি?
সীতারামের ছটফটানি আর ট্যা ট্যা করে আওয়াজ থামতেই চায় না। তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে হারাধন বলে - ও বুঝতে পেরেছি। কাউকে বন্দি করে রাখলে তার নিজস্বতা নষ্ট হয়ে যায়। তোকে তো আমরা বন্দিই করে রেখেছি। যা আজ থেকে তুই স্বাধীন।
খাঁচার দরজা খুলে দেয় হারাধন। ডানা ঝটপটিয়ে আকাশে উড়ে যায সীতারাম।
তার উড়ে যাওয়ার দিকে লক্ষ্য রাখতে রাখতে হারাধনের চোখে পড়ে অনেক উঁচুতে স্কুলের মাঠে পত পত করে উঠছে ভারতের জাতীয় পতাকা।
--------------------------
স্বাধীনতা-৯০
বহির্ভারতে বিপ্লববাদ
নির্মলেন্দু কুণ্ডু

ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রাম এক জটিল প্রক্রিয়া ৷ বৈচিত্র্যময় এই ভারতভূমির পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের জন্য সেই ১৮৫৭-র পরবর্তীকাল থেকে বহু মুক্তিকামী মানুষ নানা বিচিত্র পথ গ্রহণ করেছেন ৷ কখনো চেয়েছেন আবেদন-নিবেদনের মাধ্যমে দাবি-দাওয়া আদায় করতে, কখনো নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধের মাধ্যমে চেয়েছেন অত্যাচারী শাসক শ্রেণীর সাথে সমস্ত যোগাযোগ ছিন্ন করতে, আবার কখনো নিজের জীবন তুচ্ছ করে নেমে পড়েছেন এক অজানা দুর্গম পথে, আনতে চেয়েছেন এক সর্বাত্মক বিপ্লব ৷ ভারতবর্ষে এই বিপ্লববাদ, যা সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদের চরমতম রূপ, শুরু হয়েছিল বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ৷ দেশের মধ্যে গড়ে ওঠা বিভিন্ন গুপ্ত সমিতি, তাদের দ্বারা প্রচারিত প্রচারপত্র, পুস্তিকা, সংবাদপত্র ও তাদের রুখতে ব্রিটিশদের সদা-তৎপরতা এটাই প্রমাণ করে যে, এই বিপ্লববাদ ব্রিটিশ প্রশাসনকে আলোড়িত করতে শুরু করেছিল ৷ আর গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো দেশের ভেতরের বিপ্লবী কার্যকলাপের পাশাপাশি তাদের যুঝতে হচ্ছিল বহির্ভারতে সংগঠিত বিভিন্ন বৈপ্লবিক কর্মপন্থার সাথেও ৷

সাধারণভাবে দেখা যায়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালীন পরিস্থিতি থেকে বহির্ভারতে বৈপ্লবিক তৎপরতা বেড়ে যায় ৷ তবে তার আগে কিছু ব্যক্তিগত উদ্যোগে বহির্ভারতে বিপ্লববাদের বীজ অঙ্কুরিত হচ্ছিল ৷ ১৮৭০ সাল থেকেই ভারতীয় ছাত্ররা ব্রিটেনে পড়াশোনা করতে যেতেন ৷ কিন্তু ব্রিটিশ শাসকদের আশঙ্কা ছিল অচিরেই এই ছাত্রদের একটা বড় অংশ ব্রিটেনেরই বিভিন্ন শহরে ব্রিটিশ-বিরোধী সংগঠন গড়ে তুলবে ৷ তাই তাদের কার্যকলাপের ওপর নজর রাখতে এক ধরণের গুপ্তচর চক্র গড়ে তোলা হয় ৷ এদের তত্ত্বাবধান করতেন উইলিয়াম কার্জন ওয়াইলি ৷ এই গুপ্তচর চক্রের কার্যকলাপ স্বাভাবিকভাবেই ভারতীয় ছাত্রদের বড় অংশকে প্রতিবাদী করে তুলল ৷ এমতাবস্থায় ১৯০৯ সালের ১ জুলাই সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-র ছাত্র মদনলাল ধিংড়া National Indian Association-র উদ্যোগে আয়োজিত ব্রিটিশ সংস্কৃতির সাথে ভারতীয় ছাত্রদের পরিচিত করানোর এক জমায়েতে উপস্থিত হয়ে ওয়াইলি সাহেবকে গুলি করেন ৷ সেখানেই তিনি ধরা পড়েন ৷ অবাক ব্যাপার এই যে, তাঁর কাজের কোনরূপ প্রশংসার সুর শোনা গেল না তৎকালীন কোন জাতীয় নেতার মুখে ৷ বরং বয়ে গেল নিন্দার ঝড় ৷ প্রত্যাশামাফিক মদনলাল ধিংড়ার ফাঁসির আদেশ হল ৷ ১৯০৯ সালের ১৭ আগস্ট লন্ডনের পেন্টনভিল কারাগারে মাত্র ২৫ বছর বয়সে ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েও নির্ভীক চিত্তে ধিংড়া বলে গেলেন— "This war of independence will continue between India and England, so long us the Hindu and the English races last ."

এবারে আসা যাক বহির্ভারতে ভারতীয় বিপ্লববাদের অন্যতমা মুখ্য প্রচারক তথা 'ভারতীয় বিপ্লববাদের জননী' হিসেবে খ্যাত মাদাম ভিখাজি রুস্তমজি কামার প্রসঙ্গে ৷ বোম্বে প্রেসিডেন্সির শিক্ষাব্রতী এই ভদ্রমহিলা ১৮৮৫-তে জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশনে যোগ দিয়েছিলেন ৷ ১৮৯৬-র ভয়ঙ্কর প্লেগে অক্লান্ত সেবা করার পর তিনি নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়ায় চিকিৎসার জন্য চলে যান লন্ডনে ৷ খানিকটা সুস্থ হয়েই তিনি সেখানেই ইংরেজ-বিরোধী সংগঠনের সাথে যুক্ত হন ৷ সহকর্মী হিসেবে পান দাদাভাই নৌরজিকে ৷ তাঁরা দুজন লন্ডনে বসবাসকারী আরও এক জাতীয়তাবাদী নেতা শ্যামজি কৃষ্ণবর্মার সাথে মিলে ১৯০৫-র ফেব্রুয়ারিতে গড়ে তোলেন Indian Homerule Society. ১৯০৭ সালে জার্মানির স্টুটগার্ট শহরে International Socialist Conference অনুষ্ঠিত হলে সেখানে উপস্থিত হয়ে মাদাম কামা তাঁর বক্তব্যে ভারতে ব্রিটিশ শাসন, ভারতের প্রকৃত স্বাধীনতা, সাম্য ও মানবাধিকারের প্রসঙ্গ তোলেন ৷ এখানেই তিনি ত্রিবর্ণরঞ্জিত ভারতের পতাকা প্রদর্শন করেন ৷ এতদিন ধরে প্রচলিত নরমপন্থী ধারা অপেক্ষা নবোত্থিত সশস্ত্র ধারার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানান ৷ স্বাভাবিকভাবেই ব্রিটিশ সরকার এই পদক্ষেপগুলি সদর্থকভাবে নিল না ৷ তাদের কুনজর ও কূটনৈতিক চাপ থেকে রক্ষা পেতে তিনি ও মুনচেরশা বুর্জোরজি গোদরেজ Paris Indian Society নামক ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সহায়তাদানকারী সংস্থা গঠন করেন ৷ এছাড়া সেখান থেকেই 'বন্দেমাতরম' নামে একটি ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ শুরু করেন (সেপ্টেম্বর, ১৯০৯) ৷ এর প্রথম সংখ্যাটি উৎসর্গ করা হয় শহীদ মদনলাল ধিংড়ার উদ্দেশে ৷

বহির্ভারতে বিপ্লববাদী আন্দোলন পরিচালনার ক্ষেত্রে যেসব সংগঠন বড় ভূমিকা নিয়েছিল, তার মধ্যে ইন্ডিয়া হাউসের নাম সর্বাগ্রে স্মরণীয় ৷ এর কথা উঠলেই আমাদের স্মরণে আসে এর প্রতিষ্ঠাতা শ্যামজি কৃষ্ণবর্মার কথা ৷ ১৯০৫-এ লন্ডন থেকে তিনি Indian Sociologist নামক একটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন ৷ এসময় ইংল্যান্ডে ভারতীয়দের দুটি সংগঠন ছিল— The British Committee of Indian National Congress এবং The London India Society . কিন্তু উভয়ের কাজকর্মেই বীতশ্রদ্ধ হয়ে শ্যামজি কৃষ্ণবর্মা ১৯০৫-র ১৮ ফেব্রুয়ারি গড়ে তুললেন Indian Homerule Society. পূর্বেই উল্লেখ করেছি, এ কাজে তাঁর প্রধান দুই সহযোগী ছিলেন মাদাম কামা ও দাদাভাই নৌরজি ৷ এই সংগঠনের উদ্দেশ্য ছিল—
i) ভারতের জন্য হোমরুল বা স্বায়ত্তশাসন অর্জন
ii) এজন্য ইংল্যান্ডে সবরকম প্রচার চালানো
iii) ভারতের জনগণকে স্বাধীনতা ও ঐক্যবদ্ধতা সম্পর্কে অবহিত করা
এরপরই তিনি প্রবাসী ভারতীয় ছাত্রদের ছাত্রাবাসরূপে India House গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেন ৷ ১৯০৫-র জুন মাসে United Congress of Democrats-র সভায় তিনি আয়ারল্যান্ড ও ভারতে হোমরুল চালুর প্রস্তাব দেন ৷ এর পরের মাসেই গড়ে ওঠে India House, যা নামে ছাত্রাবাস হলেও আসলে ছিল জাতীয়তাবাদীদের আঁতুড়ঘর ৷ স্বভাবতই ব্রিটিশ সরকারের চক্ষুশূল হন তিনি ৷ এরপর তিনি প্যারিসে চলে যান ৷ সেখানে থাকাকালীন প্রফুল্ল চাকী, কানাইলাল দত্ত, ক্ষুদিরাম বসু ও সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নামে চারটি বৃত্তি চালু করেন ৷ তাঁকে The Russian Review পত্রিকায় ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে লিখতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন ম্যাক্সিম গোর্কি ৷ তিনি শেষ জীবনে জেনেভাতে চলে যান ৷ তাঁকে প্রথম প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবী বলা যায় ৷ 

এই India House-এ অনুষ্ঠিত এক সভায় (১৯০৭) এক তরুণ স্বেচ্ছাসেবী সেনাপতি বাপৎ প্রস্তাব দেন, তিনি রাশিয়ায় গিয়ে সেখানকার জারবিরোধী সশস্ত্র বিপ্লবীদের কাছ থেকে বোমা তৈরির কৌশল শিখে তা ভারতে প্রয়োগ করবেন ৷ স্থির হয়, এ ব্যাপারে প্যারিসে আত্মগোপনকারী রাশিয়ান বিপ্লবীদের সাথে যোগাযোগ করা হবে ৷ বহু বাধাবিপত্তি পেরিয়ে অবশেষে সাইক্লোস্টাইল পদ্ধতিতে বোমা নির্মাণের ম্যানুয়াল সংগ্রহ করে লন্ডনে ফেরেন তাঁরা ৷

বহির্ভারতে বিপ্লববাদী নেতাদের মধ্যে অন্যতম লালা হরদয়ালও ইংল্যান্ডে পড়তে গিয়ে এই India House-র কর্মকাণ্ড দ্বারা আকৃষ্ট হন ৷ কৃষ্ণবর্মা ভারতে যেসব রাজনৈতিক দূত পাঠিয়েছিলেন, তাতে স্বেচ্ছায় যোগ দেন তিনি ৷ মাদাম কামার 'বন্দেমাতরম' পত্রিকা প্রকাশের দায়িত্বও তাঁর ওপরে বর্তেছিল ৷ ১৯১১ সালে আমেরিকায় এসে তেজা সিং-এর সাথে আলাপ হয় তাঁর ৷ তিনি সেখানে বসবাসকারী শিখদের সংগঠিত করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন ৷ অবশ্য ইতিপূর্বেই বিদেশাগতদের সম্পর্কে আমেরিকান আইনের কড়াকড়িতে তিতিবিরক্ত আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে বসবাসকারী ভারতীয়দের মধ্যে বিপ্লবের বাণী প্রচারের ভার নেন তারকনাথ দাস ৷ গড়ে তুলেছেন Indian Independence League (১৯০৭) ৷ এদিকে লালা হরদয়ালও প্রতিষ্ঠা করেছেন Radical Club ৷ প্রকাশ করেছেন পুস্তিকা Fraternity of Red Flag ৷ কিছুদিন পরেই তিনি গড়ে তুললেন Hindu Association of Pacific Coast, যার মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত হত 'গদর' পত্রিকা ৷ ধীরে ধীরে এই পত্রিকার নামানুসারেই দলটির নাম হল গদর পার্টি ৷ এর প্রথম সভাপতি ছিলেন বাবা সোহন সিং ও প্রথম সম্পাদক ছিলেন লালা হরদয়াল ৷ ১৯১৩ সালের ১ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত এই গদর পার্টির মূল কর্মকেন্দ্র সানফ্রান্সিসকো হলেও এর শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে পড়েছিল আমেরিকার সমগ্র উপকূল অঞ্চল ও দূর প্রাচ্যে ৷

India House-র সাথে জড়িত এমনই আরেকজন বিপ্লববাদী নেতা হলেন বিনায়ক দামোদর সাভারকর ৷ ভারতে 'অভিনব ভারত' নামে সংগঠন তৈরি করার পর তিনি ১৯০৬ সালে লন্ডনে যান ও সেখানে India House-র সাথে যুক্ত হন ৷ পরে তিনি ঐ সংস্থার পরিচালনার ভারও গ্রহণ করে সেখান থেকে গোপনে বোমা তৈরির নিয়মাবলি ও প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ভারতে পাঠান ৷ তিনি নিজে রুশ ভাষা থেকে ইংরেজি ভাষায় বোমা তৈরির কৌশল অনুবাদ করে তা ভারতে মির্জা আব্বাসের কাছে পাঠান ৷ মদনলাল ধিংড়ার ঘটনার পর ধরপাকড় শুরু হলে সন্ত্রাসমূলক কাজে জড়িত থাকার সন্দেহে বিনায়ককে লন্ডনে গ্রেপ্তার করে ভারতে পাঠানো হয় (মার্চ, ১৯১০) ৷

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আবহ তৈরি হলে, বিশেষত ১৯১২ সাল থেকে বিপ্লবীরা যুদ্ধের পরিস্থিতিকে স্বাধীনতা সংগ্রামের কাজে লাগাতে চাইলেন ৷ তাঁদের পরিকল্পনা ছিল, ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় বিপ্লবের কেন্দ্র গড়ে তুলে তাদের মাধ্যমে ভারত সম্পর্কে প্রচারকার্য চালাবেন ৷ তাছাড়া স্বদেশে বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করার জন্য বিদেশ থেকে অর্থ ও অস্ত্র সংগ্রহ ছিল তাঁদের অন্যতম লক্ষ্য ৷ বিদেশে ভারতীয় ছাত্র, ভারতীয় ব্যবসায়ী ও ভারতীয় শ্রমিকদের মধ্য থেকে তাঁরা নতুন সদস্য বেছে নিত ৷ বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তাঁদের প্রধান কাজ হল বিদেশে থাকা ভারতীয় সেনা ও যুদ্ধবন্দিদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা ৷ এ ব্যাপারে তাঁরা প্রথমেই 'শত্রুর শত্রু' জার্মানির মুখাপেক্ষী হন ৷ জার্মানিও একইরকম চিন্তাভাবনার শরিক ছিল ৷ ১৯১১ সালের অক্টোবর মাসে ফন বের্নহাটির 'Germany and the Next War' গ্রন্থে খোলাখুলিভাবে এই আশা প্রকাশ করা হয় যে, আসন্ন বিশ্বযুদ্ধে বাংলার বিপ্লবীরা সর্বতোভাবে ইংল্যান্ডকে ঘায়েল করার চেষ্টা করবে ৷ এ' কাজে বিশেষ ভূমিকা নেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও অবিনাশ ভট্টাচার্য ৷ সরোজিনী নাইডুর ভাই বীরেন্দ্রবাবু ১৯০৯ সাল থেকেই বিপ্লবী কার্যকলাপে জড়িত হন ৷ তিনি মাদাম কামার 'বন্দেমাতরম', শ্যামজি কৃষ্ণবর্মার 'Indian Sociologist' ও প্যারিস থেকে প্রকাশিত 'তলওয়ার' পত্রিকায় নিয়মিত লেখা পাঠাতেন ৷ বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে গড়ে ওঠে ভারতীয় বার্লিন কমিটি ৷ এর অপর নাম ছিল ভারতীয় স্বাধীনতা কমিটি ৷ এই কমিটি বাগদাদ, ইস্তানবুল, পারস্য, কাবুল প্রভৃতি স্থানে প্রতিনিধি পাঠাতে শুরু করলেন ৷ বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় হন এই কমিটির প্রথম সম্পাদক ৷ যুগান্তর দলের ভূপেন্দ্রনাথ দত্তও জার্মানিতে এসে এই কমিটিতে যোগ দেন ৷ স্থির হয়, আমেরিকায় অবস্থিত জার্মান দূতাবাস মারফত অস্ত্র সরবরাহ করা হবে ভারতে ৷ সেজন্য কেনা হয় ম্যাভেরিক জাহাজ ৷ কিন্তু ব্রিটিশ গুপ্তচরদের চোখ এড়িয়ে এত অস্ত্র সংগ্রহ সহজসাধ্য ছিল না ৷ উপরন্তু সংগঠকদের একজন ধরা পড়লে গোটা পরিকল্পনাটিই ব্যর্থ হয় ৷ 

বার্লিন কমিটির নেতৃত্বে ইরানে এক বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা করা হয়েছিল ৷ কেদারনাথ, বসন্ত সিং, প্রমথনাথ দত্ত ও দাদাচানজি ফেরসাম্প ইরানে উপস্থিত হন ৷ এছাড়াও ছিলেন পাণ্ডুরং কানখোজে ও আগোসে ৷ এদিকে ১৯০৯ থেকে ইরানেই আশ্রয় নিয়েছিলেন সুফী অম্বাপ্রসাদ ৷ এঁরা সকলে একজোট হন ৷ এঁদের উদ্দেশ্য ছিল ইরানের মধ্য দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে বেলুচিস্তানকে মুক্ত করা ৷ যদিও এই প্রচেষ্টা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছিল ৷ কেদারনাথ ও দাদাচানজি ইংরেজদের হাতে মৃত্যুবরণ করেন ৷ অম্বাপ্রসাদের ফাঁসি হয় ৷ প্রমথনাথ দত্ত ও পাণ্ডুরং কানখোজে বেলুচিস্তানের একটি অংশ মুক্ত করলেও তা বেশিদিন মুক্ত থাকেনি ৷ তবে তাঁরা পালাতে সক্ষম হন ৷

এই বার্লিন কমিটির উদ্যোগেই রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপ, মৌলানা বরকতউল্লা ও মৌলানা ওবেদুল্লা কাবুলে গিয়ে অস্থায়ী জাতীয় সরকার গঠন করেন ৷ এই অস্থায়ী সরকারের স্বরাষ্ট্রসচিব ছিলেন মৌলানা ওবেদুল্লা ও প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মৌলানা বরকতউল্লা ৷ কাবুল থেকে ভারতে ব্রিটিশ-বিরোধী প্রচার চালিয়ে যান মাহমুদুল হাসান ও মৌলানা ওবেদুল্লা ৷ প্রচারের মাধ্যম হিসেবে তাঁরা ব্যবহার করতেন রেশমি রুমাল ৷ কিন্তু এবারও তাঁদের পরিকল্পনা ভেস্তে গেল ৷ শুরু হল রেশমি রুমাল ষড়যন্ত্র মামলা ৷ মাহমুদুল হাসান ধরা পড়েন ৷ ভারতেও শুরু হয় ধরপাকড় ৷

এই বিশ্বযুদ্ধকালে গদর দলও উল্লেখযোগ্য কাজ করে ৷ বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে বিপ্লবে অংশগ্রহণের জন্য গদর দলের কয়েক হাজার সদস্যকে ভারতে প্রত্যাবর্তনের নির্দেশ দেওয়া হয় ৷ এসময় কোমাগাতামারু জাহাজের ঘটনা গদর বিপ্লবীদের মনে আরও ক্ষোভের সঞ্চার করে ৷ এসময় ব্রিটিশ সরকারের প্ররোচনায় কানাডা সরকার ভারতীয়দের প্রবেশাধিকারের ওপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল ৷ এমতাবস্থায় মালয় ও সিঙ্গাপুরের ধনী ব্যবসায়ী বাবা গুরদিৎ সিং 'কোমাগাতামারু' নামে একটি জাপানি জাহাজ ভাড়া করে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বসবাসকারী ৩৭২ জন পাঞ্জাবীকে নিয়ে কানাড উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন ৷ ১৯১৪ সালের ২৩ মে জাহাজটি ভ্যাঙ্কুভার বন্দরে পৌঁছলে কানাডা সরকার মাত্র কয়েকজন বাদে আর কাউকে জাহাজ থেকে অবতরণের অনুমতি দিল না ৷ দু' মাস ধরে অচলাবস্থা চলার পর জাহাজটি কানাডা থেকে বেরিয়ে আসে ৷ তবে হংকং, কোবে, ইয়াকোহামা ইত্যাদি বন্দরে অনুরূপ বাধার সম্মুখীন হয়ে ২৯ সেপ্টেম্বর জাহাজটি কলকাতার নিকট বজবজে পৌঁছালে ইংরেজ সরকার জাহাজের সকল আরোহীকে বিশেষ ট্রেনে পাঞ্জাব পৌঁছনোর ব্যবস্থা করেন ৷ যাত্রীরা তাতে আপত্তি জানালে সামরিক বাহিনী গুলি চালায় ৷ সেই সংঘর্ষে ২০ জন নিহত, ২০০ জন বন্দি হন ও তাঁদের জোর করে পাঞ্জাবে পাঠানো হয় ৷ সেই বছরের অক্টোবরে 'তোসামারু' নামে একটি জাহাজ আমেরিকা থেকে কলকাতায় এলে তার ৩৭৩ জন যাত্রীকে সঙ্গে সঙ্গে পাঞ্জাবে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ৷ পাঞ্জাবে পৌঁছনোমাত্র ৩০০ জনকে দীর্ঘমেয়াদী কারাদণ্ড দেওয়া হয় ৷ বাকি ৭৩ জন কোনক্রমে পালিয়ে বিভিন্ন বিপ্লবী দলে যোগদান করে ৷

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেও গদর দলের বৈপ্লবিক তৎপরতা পরিলক্ষিত হয় ৷ বর্মা, মালয় ও সিঙ্গাপুরে ব্রিটিশ-বিরোধী কার্যকলাপের জন্য গদর দলের সদস্য মোহনলাল পাঠক (মতান্তরে সোহনলাল) ১৯১৬ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুদণ্ড পান ৷ সায়ামে বুধ সিং শহীদ হন ৷ এসব অঞ্চলে সৈনিকদের মধ্যে বিদ্রোহী প্রচারকার্য চালানোর জন্য রামরক্ষা (মতান্তরে রামরঙ্গা) দ্বীপান্তরিত হন ৷ ইতিমধ্যে শ্যাম, মালয়, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি স্থানে শুরু হওয়া সংগ্রামের তীব্রতায় সেখানে ইংরেজ শাসন ৩-৭ দিন পর্যন্ত লোপ পেয়েছিল ৷ ১৯১৫-র ১৫ ফেব্রুয়ারি সিঙ্গাপুরের পঞ্চম লাইট ইনফ্যান্ট্রির জমাদার চিস্তি খান, সুবাদার দাউদ খান ও জমাদার আব্দুল আলির নেতৃত্বে সেনাবাহিনী বিদ্রোহ ঘোষণা করে ৷ বিদ্রোহীরা সিঙ্গাপুর শহর ও দুর্গ দখল করে, ইংরেজদের হত্যা করে ও জার্মান বন্দিদের মুক্ত করে দেয় ৷ ৪ দিন সিঙ্গাপুরকে ব্রিটিশ শাসনমুক্ত রাখার পর ইংরেজ ও জাপানি সেনার মিলিত বাহিনী ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালিয়ে সিঙ্গাপুর পুনর্দখল করেন ৷ মোট ১৩৬ জন বিদ্রোহীর মধ্যে ৩৭ জনকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা, ৪১ জনের দ্বীপান্তর এবং ৮ জনের কুড়ি বছর ও বাকিদের তার অধিক কারাদণ্ড হয় ৷

বহির্ভারতে বৈপ্লবিক আন্দোলন প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে রাসবিহারী বসুর অবদান স্মরণীয় ৷ এ' প্রসঙ্গে ভারতের অভ্যন্তরে সংগঠিত এক গণ-অভ্যুত্থানের পরিকল্পনার কথা বলি ৷ যতীন্দ্রনাথ মুখার্জী (বাঘা যতীন), নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, রাসবিহারী বসু প্রমুখরা পরিকল্পনা করলেন, প্রথমে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে উত্তেজিত করে তুলবেন, তারপর পেশোয়ার থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত সমস্ত পুলিশ লাইন ও ট্রেজারিতে আক্রমণ চালাবেন এবং সবশেষে জার্মান অস্ত্রের সহায়তায় ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে সার্বিক যুদ্ধ ঘোষণা করবেন ৷ ১৯১৫-র ২১ ফেব্রুয়ারি ছিল এই গণ-অভ্যুত্থানের প্রস্তাবিত দিন ৷ কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতার ফলে ষড়যন্ত্রের খবর ফাঁস হয়ে গেল ৷ দিন স্থির হল ১৯ ফেব্রুয়ারি ৷ কিন্তু তাতেও শেষরক্ষা হল না ৷ বিষ্ণু গণেশ পিংলে মিরাটের ক্যাভালরি লাইনস্-এ বোমা সমেত ধরা পড়লেন ৷ বিদ্রোহী সেনাদলগুলো ভেঙে দেওয়া হল ও ষড়যন্ত্রীদের অনেকে ফাঁসির মঞ্চে প্রাণ দিলেন বা দেশান্তরিত হলেন ৷ মার্চ মাসে শ্রীরামপুরের বিপ্লবী জিতেন্দ্রলাল লাহিড়ি জার্মানি থেকে ফিরে এসে জানান, তারা বাংলাদেশের বিপ্লবীদের অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করবে ৷ এজন্য যেন কোন বিপ্লবীকে বাটাভিয়ায় পাঠানো হয় ৷ সেই মোতাবেক নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য (যিনি মানবেন্দ্রনাথ রায় নামেই সমধিক প্রসিদ্ধ) সি. মার্টিন ছদ্মনামে বাটাভিয়া যান ৷ এদিকে রাসবিহারী বসু ১৯১৫ সালের ১২ মে কলকাতার খিদিরপুর বন্দর থেকে জাপানি জাহাজ সানুকি-মারু সহযোগে প্রিয়নাথ ঠাকুর ছদ্মনামে জাপানে চলে যান ৷ সেখানে পৌঁছে প্রথম আট বছর পলাতক জীবন যাপন করেন ৷ তবে তাঁর বিপ্লব প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিল ৷ এখানেই হেরম্বলাল গুপ্ত, লালা লাজপৎ রাই, তারকনাথ দাস প্রমুখ নেতার সাথে তিনি মিলিত হন ৷ এরপর তিনি জাপানের হাতে বন্দি ভারতীয় সেনাদের নিয়ে এক বাহিনী গড়ার পরিকল্পনা নেন ও এ' বিষয়ে পাশে পান ক্যাপ্টেন মোহন সিং-কে ৷ ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে আজাদ হিন্দ ফৌজ ৷ তবে সে অন্য গল্প ৷

আরও এক মহাপ্রাণ বিপ্লবীর কথা না বললে এই বৈপ্লবিক তৎপরতার কথা সাঙ্গ হবে না ৷ উধম সিং ছোট থেকেই জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের জন্য ব্রিটিশদের ঘৃণার চোখে দেখতেন ৷ ১৯২৪-এ তিনি আমেরিকায় গিয়ে গদর পার্টির সাথে যোগাযোগ করেন ৷ তিনি শিকাগো ও ডেট্রয়েটে গড়ে তোলেন 'আজাদ পার্টি' ৷ ১৯২৭-এ তিনি প্রচুর রিভলবার ও গুলি ভগৎ সিং-দের উদ্দেশ্যে  সংগ্রহ করে দেন ৷ তার কিছুদিন পর তিনি ধরাও পড়েন ৷ ১৯৩৩-এ তিনি আবার ইংল্যান্ডে পৌঁছান ৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে পরিকল্পনা হয়, ব্রিটিশ সরকারকে ধাক্কা দেওয়ার সুযোগ এবার এসছে ৷ এদিকে ব্রিটিশ আমলারা এসময়েই ভারতসহ অন্যান্য উপনিবেশ কীভাবে দখলে রাখা যাবে, তা নিয়ে এক সভা অনুষ্ঠিত করেন ৷ এখানে উপস্থিত হয়ে উধম সিং মাইকেল ডায়ার, জেটল্যান্ড. ল্যামিংটন ও ডান সাহেবকে গুলি করেন ৷ তাঁর ফাঁসি হয় ১৯৪০-র ৩১ জুলাই ৷ 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে ভারতীয় বিপ্লববাদী নেতারা বিদেশি সাহায্য লাভের যে সুযোগ পেয়েছিলেন, তা শেষ পর্যন্ত কাজে লাগাতে পারেননি ৷ স্বদেশী ও প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবীদের মধ্যে যোগাযোগ ও বোঝাপড়ার অভাব ছিল ৷ দুই প্রধান দল গদর পার্টি ও ভারতীয় বার্লিন কমিটির মধ্যে ঘনিষ্ঠ আদানপ্রদান ছিল না ৷ বেশ কিছু সংগঠন গড়ে উঠলেও কোন কার্যকরী সাফল্য তাঁরা পাননি ৷ ইংরেজ গুপ্তচর তথা ব্রিটিশ প্রশাসনের সদা-সতর্ক নজর এবং অন্যান্য দেশের সরকারের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ বিপ্লবীদের কাজকে আরও কঠিন করে তোলে ৷ তার ওপর কিছু বিপ্লবী বিশ্বাসঘাতকতা করায় ব্রিটিশদের কাজ আরও সহজ হয়ে যায় ৷ তথাপি দেশমাতার মুক্তিযজ্ঞে বিদেশ-বিভুঁই থেকেও যেভাবে কিছু দামাল সন্তান বৈপ্লবিক তৎপরতা দেখিয়েছিলেন, তা ব্রিটিশ সরকারকেও ব্যতিব্যস্ত করে তোলে ৷ তাই আপাত অসফলতা সত্ত্বেও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এই অধ্যায়কে ভুলে গেলে চলবে না ৷


তথ্যসূত্র —
১) কোরক সাহিত্যপত্র — প্রাক শারদ ২০১৭ — ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন
২) স্বাধীনতা সংগ্রাম — বিপান চন্দ্র, অমলেশ ত্রিপাঠী, বরুণ দে
৩) বিপ্লব আন্দোলনের নেপথ্যে নানা কাহিনী— শিশির কর
৪) নথিপত্রে স্বদেশী আন্দোলন— সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
৫) বাংলায় বিপ্লব প্রচেষ্টা— হেমচন্দ্র কানুনগো
৬) ভারতের মুক্তি সংগ্রামে চরমপন্থী পর্ব— অমলেশ ত্রিপাঠী
৭) আধুনিক ভারতের রূপান্তর — রাজ থেকে স্বরাজ ( ১৮৫৭- ১৯৪৭ ) — সমর কুমার মল্লিক


আমাদের পদক্ষেপ পরিবার আয়োজিত বিশেষ ইভেন্ট "স্বাধীনতা"

 

বহু রক্তক্ষয়ের পর স্বাধীনতা পেয়েছিলাম আমরা ৷ ঘটেছিল দেশ বিভাজন ৷ রাজনীতির পাশাখেলায় তারপর থেকে আমরা অর্থাৎ আম জনতা নানাভাবে পিষ্ট হতে হতে হয়তো আজ 'স্বাদহীন'ভাবে স্বাধীন রয়েছি ৷ এই স্বাধীনতা কতখানি পরাধীনতা থেকে মুক্তি আর কতখানি ক্ষমতার হস্তান্তর তা নিয়েও রয়ে গেছে বিতর্ক ৷ তবু আজকের দিনটা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ৷ তাই এই দিনটাকে উদযাপন করতে দেশজুড়ে গৃহীত হচ্ছে নানা কর্মসূচি ৷*

*আমাদের পদক্ষেপ পরিবারের পক্ষ থেকে আজকের দিনে পরিবারের সকলকে জানাই আন্তরিক শুভকামনা ৷ পূর্বঘোঘণা অনুযায়ী আজ আমাদের এই পরিবারের যৌথ দেওয়ালে আয়োজিত হবে বিশেষ ইভেন্ট— "স্বাধীনতা" ৷ ইতিমধ্যে আপনাদের পাঠানো লেখাগুলো আমরা একে একে পোস্ট করব এখানে ৷ সেই ধারাবাহিকতা যেন ক্ষুণ্ণ না হয়, সেজন্য ইভেন্ট চলাকালীন গ্রুপটি অনলি অ্যাডমিন করে রাখা হবে ৷ আপনাদের অনুরোধ, ধৈর্য রাখবেন ৷ সাথে থাকুন ৷*

----+++---

স্বাধীনতা-৭৩

স্বাধীনতা না স্ব-অধীনতা ?

- রূপাঞ্জনা ভৌমিক

ছিয়াত্তরতম স্বাধীনতা দিবস। পঁচাত্তর বছর বাক্ স্বাধীনতা, কর্ম স্বাধীনতা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে আমরা খেটে খেয়ে এসেছি। তবুও হিসেব মেলানো যায় না। বাস্তবতার আতস কাঁচে স্বচ্ছ ভাবে দেখি মনুষত্বের পরাধীনতা , মমতার পরাজয় আর দুর্ভাগার নীল আকাশ । প্রভাবশালীর নিছক ছেলে মানুষী হতদরিদ্রের কাছে একক আস্থা। নির্যাতিত আত্মারা ঘুমন্ত বিচারের নামতা গোনে। ভরসার সীমিত পরিসরে আজ ধোঁকা গুলো হাত মেলায়।

'আমার মুক্তি আলোয় আলোয়, এই আকাশে ...' । মনে দ্বিধা জাগে, সত্যি কি আমরা মুক্ত পাখি? ক্রমাগত আমাদের মুক্তির ইউফোনি ব্যথাতুর ক্যাকোফোনিতে হারিয়ে যায়। অবকাশের সাদা পাতায় ভুলবশত কালির শিশি উল্টিয়ে যায়। সমস্ত রং তখন ফিকে। চোখের সামনে ভাসে অমাবস্যার সদ্য শেষ করা একটি পোট্রেট ।


আমি স্বাধীনতার প্রচুর চড়াই উতরাই দেখেছি। দেখেছি ঠিক কেমনভাবে বিত্তবানের সুষম জীবনযাপনের স্বাধীনতা আর প্রতিধাপে নিঃস্বের এতটুকু মসৃণ পথের কাছে পরাধীনতা। আমি দেখেছি আর্থিক শক্তির অপচয়ের ‌স্বাধীনতা আর সমান্তরালে সেই স্বাচ্ছন্দের তৃষ্ণায় চাতক পাখির মতো মুখিয়ে থাকা কিছু মানুষেদের । দেখেছি বিবেকের দেহে আগুনের লেলিহানে মনুষত্ব ধুলিস্যাৎ হতে। দেখেছি স্পষ্টবাদীর মুখের উপর অদৃশ্য ব্ল্যাক‌ টেপ , যেন এটাই ‌তার ভবিতব্য।

এই স্বাধীনতা আমাকে প্রতারিত করে। নগ্ন করে সামাজিক কিছু রাক্ষসদের। এই আকাশে শুধুই মিশকালো ধোঁয়ার ফিনকি ওড়ে । তাকেই স্বাধীনতা ভেবে দেখি কখনো গেরুয়া, কখনো সাদা আর কখনো সবুজের রঙে‌।

--------------------------- 

স্বাধীনতা- ৭৪

স্বাধীনতা

কুণাল কান্তি দে

স্বাধীনতা প্রাপ্তির ৭৫ বছর পেরিয়ে  ৭৬ বর্ষে পদার্পণ  করে গর্বে আমাদের বুক ভরে যাচ্ছে, মন মুগ্ধতায় আবিষ্ট।দীর্ঘ  প্রায়  দুশো বছর  ব্রিটিশ শাসনের  অধীনে  আমাদের পূর্বপুরুষেরা  অনেক লাঞ্ছনা  গঞ্জনা, নির্যাতন সহ্য  করেছেন। ব্রিটিশরা আমাদের ন্যায্য অধিকারের দাবি বঞ্চিত করে রেখেছে । নিজেদের স্বার্থে আমাদের  খনিজ সম্পদ, প্রাকৃতিক সম্পদ ,কৃষিজ সম্পদ ,এমনকি মানব সম্পদ লুণ্ঠন  করে  সনাতন ভারতবর্ষের ঐশ্বর্যকে ম্লান করে রেখেছে।  যুগ যুগ ধরে অন্যায়ের প্রতিবাদে , গর্জে উঠেছে এদেশের তরুণ, যুবক দেশপ্রেমিক আবাল বৃদ্ধ বনিতার দল।  অনেক রক্ত ক্ষয়ের বিনিময়ে, জীবন বলিদানের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি।  চতুর ইংরেজ  সাম্প্রদায়িকতাকে অবলম্বন করে আমাদের দেশকে দুর্বল করতে দুটি রাষ্ট্রের  জন্ম দিয়েছেন।  আমরা রাজনৈতিক স্বাধীনতা পেলেও বহু বিষয়ে আমাদের দুর্বলতা ছিল। শিক্ষা , স্বাস্থ্য, অন্ন , বাসস্থান ,বিদ্যুৎ  , সড়ক , নারী মুক্তি, পরিবহন ইত্যাদি বিষয়ে অনেক ঘাটতি ছিল।  সনাতন ভারতবর্ষের ঐতিহ্য  ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে, ভারতকে    আবার জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লাভ করতে হবে।  ভারতের একজন নাগরিকও যেন  অভুক্ত না থাকে।  দুশো বছরের পরাধীনতা থেকে স্বাধীন হয়ে , ভারত কৃষি , শিল্প, সাহিত্য , সংগীত  প্রযুক্তি, খেলাধূলায়  প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে।  বিশ্বের কাছে ভারত  বিশেষ সাফল্যের মাপকাঠি  ছুঁয়েছে।   বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র ভারতবর্ষ।  পৃথিবীতে ভারতের যোগ চর্চা  বিশেষ স্থান অর্জন করেছে।   ভারতের সংবিধান সংশোধন সকলের কাছে  গ্রহণযোগ্য হয়েছে।  জনসংখ্যার দিক দিয়ে পৃথিবীর প্রথমদিকে রয়েছে।    মহাকাশ গবেষণায় ভারত বিশেষ স্থান অর্জন করেছে। বিচার ব্যাবস্থায় যথেষ্ট পরিণত।  গণতান্ত্রিক দেশ হওয়ায় ভারত  সুনামের সঙ্গে পৃথিবীতে  মর্যাদা পেয়েছে। সব সমস্যার সমাধান হয়েছে এই কথা বলার সময় আসেনি।  ৭৫ বছর পেরিয়েও অনেক সমস্যা থেকে গেছে।  যেদিন একজন মানুষও অভুক্ত থাকবে না, প্রতিটি নাগরিক অন্ন , বস্ত্র , বাসস্থান, বিশুদ্ধ পানীয় জল,  বিদ্যুৎ  ,কৃষি, শিল্পের বিকাশ দেশকে স্থায়ীভাবে  ভবিষ্যতের দিশা দেখাবে সেদিন  " স্বাধীনতার " প্রকৃত স্বাদ  পাওয়া যাবে। সময়ের সঙ্গে  সঙ্গে  পৃথিবীর পরিবর্তন হচ্ছে, ভারতের পরিবর্তন সফল ভাবেই হচ্ছে।  প্রকৃত  জাতীয় শিক্ষায় নতুন প্রজন্ম লালিত হবে এই বিশ্বাস আমার আছে।  শরীরে অসুখ যেমন দেখা দেয়, সমাজেরও অসুখ,  দুর্নীতি  দেখা দেয়। এই অসুখ দূর করার জন্য রাষ্ট্রের কর্ণধারদের কড়া পদক্ষেপ  নিতে হবে। স্বাধীনতা রক্ষা করার দায়িত্ব  কোটি কোটি জনগণেরও।  একজন স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়ে আমি গর্বিত । আজকের  শপথ হোক যে কোনো মূল্যে  দেশমাতাকে  রক্ষা করবো। ভারত মাতা কি জয়

------------------ 

স্বাধীনতা-৭৫

 সাইড এফেক্ট

আর্যতীর্থ


এই যে কিছু লোক মানেনা, নেতা রাজার প্রকার বিশেষ,

এই যে কিছু লোক জানেনা, ধর্ম আগে তার পরে দেশ,

নানান রকম ফেক ফরওয়ার্ড এই যে কজন যাচাই করে,

তকমা পেয়ে দেশদ্রোহীর দেশ বাঁচানোর জন্য লড়ে,

এই যে কিছু লোকের আজও প্রশ্ন করার আছে ডিফেক্ট,

এ সব বালাই আর কিছু না, স্বাধীনতার সাইড এফেক্ট।


এই যে চরম ক্ষমতাতেও বেশ করেছি যায় না বলা,

শাসক হবার জন্য লাগে ভোটে জেতার মোহন ছলা,

ভেদের বিষে মন ডুবিয়েও এই যে মুখে সবাই সমান,

এই যে আজও সংবিধানই নাগরিকের খাস দারোয়ান,

 ভালোবাসা যায় না মারা ভোটের লোভে জেহাদ বলে

এই যে দেশে সবার মগজ আই টি সেলের নয় দখলে,

মারীর মাঝেও রাজপ্রাসাদে এই যে মনে করে অ্যাফেক্ট

এই সব দোষ আর কিছু নয়,  স্বাধীনতার সাইড এফেক্ট। 


এই যে আজও শুনলে ভারত বুকের কাছে দলা পাকায়,

আগামীকাল স্বপ্ন আঁকে তিনটে রঙের ওই পতাকায়

এই যে এত দুর্নীতিতেও রাখছি আশা আসবে সুদিন,

দূর-নীতি কেউ করবে ভালো, বর্তমানের শোধ হবে ঋণ,

এই যে অসীম অনিশ্চয়েও ভাবছি আবার সব হবে ঠিক

ধর্মবিহীন জাতবিয়োগে সত্যি সমান সব নাগরিক,

একদিন ঠিক স্পষ্ট হবে দেশখেকোদের হাইড এফেক্ট,

এ রোগখানার চিকিৎসা নেই, স্বাধীনতার সাইড এফেক্ট।


অন্ধকারের মধ্যে পাওয়া লাইটহাউজের গাইড এফেক্ট..

---------------------- 

স্বাধীনতা-৭৬

স্বাধীনতা, তুমি 

 শিবেশ মুখোপাধ্যায় 


"তোমরা আমাকে রক্ত দাও আমি  তোমাদের স্বাধীনতা এনে দেবো।"

---------- রক্তদান শিবির দিকে দিকে।  কিন্তু কোথায় স্বাধীনতা? 

সেই, আগুনে পুড়ে শুদ্ধ হয়ে,শুদ্ধচিত্তে চাওয়া আমাদের কাঙ্খিত স্বাধীনতা। 


আজকের রক্তদান কোন স্বাধীনতার জন্য? এ-তো এক উৎসব, রক্তদান উৎসব। 

দিকে দিকে আওয়াজ, স্লোগান 

রক্তদান মহৎদান, জীবন দান।

আপনার রক্তে বাঁচবে অন্যের  প্রাণ। 


আজ প্রাণ বাঁচে কই, বাঁচে কই মান। কীসের তরে বলি দেয়েছি মোরা শত সহস্র প্রাণ? 

বিনয়- বাদল- দিনেশ, ক্ষুদিরাম 

মাতঙ্গিনী, ঝাসীর রাণী 

অকালে যারা ঝরে গেল।

দেশের তরে সঁপে দিল প্রাণ-

কে মনে রেখেছে তাদের অবদান? 


ঘুষখোর আর দুর্নীতিগ্রস্থরা আজ সমাজের উচ্চস্তরে। উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত আজ ক্ষমতা লোভী যক্ষরা। বিপুল সম্পত্তি আর বিপুল বপুতে পাইয়াছে শীর্ষে উঠিবার সিঁড়ি। নিম্নে আমরা বঞ্চিতের দল। 


কোথায় স্বাধীনতা?  কীসের স্বাধীনতা? ৭৫ বছরের এই মিথ্যে জৌলুস বয়ে বেড়ায় ভারতবাসী। উৎসব হিসেবে পালন করে। একটি বিশেষ দিন। কোথায় স্বপ্নের ভারতবর্ষ।যে মাটিতে সোনা ফলতো। আজ তা মজুত হয় ক্ষমতাসীন অর্থ লোলুপ মহারথীর ঘরে। স্বাধীনতার ৭৪ বছর পরেও আজ তাই 'খাদ্য চাই' 'বস্ত্র চাই,' 'চাকরি চাই 'এর হাহাকার ঘরে ঘরে। আজ আর কেউ লড়ে না মরে না দেশের তরে। 


দেশ তাই আজ আর "মা" নয়। 

দেশ এখন একটা ভৌগোলিক সীমানা মাত্র। স্বাধীনতার নামে ভাষণ আর তীব্রস্বরে বক্সে দেশাত্মবোধক সংগীতের সুরমূর্ছনা...

শুধু  উৎসব পালন।

-------------------- 

স্বাধীনতা- ৭৭

আমার স্বাধীনতা

   মনোজ কুমার রায়


       আমার স্বাধীনতা ঐ রাজপথে পড়ে আছে দীর্ঘমেয়াদি পথ ধরে,

      আমার স্বাধীনতা বিবেকের কাছে হার মেনে আস্তাবলে পড়ে থাকে।

    এ দেশের কোটি কোটি জনতা নিঃস্বার্থ মনে ছুটেছিল স্বাধীনতার সিক্ত সন্ধানে,

    বৃটিশ শাসকদের লেলিয়ে দেওয়া দাপট সংগ্রামী আকাশে বিলীন হয়ে যায়।

     আমার স্বাধীনতা শুধু বাক্স বন্দী ভোট নয়,আমার স্বাধীনতা গনতন্ত্রের পরিচয়।

     স্বদেশের স্বাধীনতা হয়,আমার ভীতির উদয়!

স্বাধীনতা পেয়েছি বটে, কিন্তু এই সহজ সরল মানুষগুলোকে আর যে খুঁজে পাই নি,তাই আমার স্বাধীনতা খুঁজি বধিরতা ও বিক্ষুব্ধদের কাঠগড়ায়।

   

  আমার স্বাধীনতা আজ বিবস্ত্র, উন্মাদ ও চলার পথে কাঁটা বিছানো,এক মুঠো আন্নের জন্য দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষে করতে হয়। ওঁরা কি মানুষ নয়? প্রশ্ন আমার স্বাধীনতার।

আমি আমার স্বাধীনতার গৌরবান্বিত বোধ করছি,সবার কাছে মুখ ফুটে,স্বাধীনতা যে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে পঁচাত্তরে ।

আমার স্বাধীনতা চিৎকার করে বলছে, আমাকে বাঁচাও শোষণের হাত থেকে।

ওরা বলছে আমাকে আমার মত থাকতে দাও নিজেকে গুছিয়ে,

তুমি ভাব কিনা তোমার উত্তরসূরী লড়াই করে দেশ আজাদ করেছিল প্রতিনিয়ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে।

আজ আমার স্বাধীনতা লুকিয়ে আছে নিরস্ত ভাগ্য দেবতার কাছে,

এখন ও চুপিচুপি আমার স্বাধীনতা উপভোগ করি আমার লাগানো গাছে।

অখন্ডিত দেশ হল খন্ডিত বিভেদের রাজনীতির হাত ধরে,

শত সহস্র তাজা প্রাণের আহুতি দিয়ে খুঁজে পেলাম আমার স্বাধীনতা কোন এক শুকিয়ে যাওয়া নদীর তীরে।

আমার স্বাধীনতা পথ খুঁজে অনাথ, উন্মাদ, বিকলাঙ্গ, ভিখারী আদি যাদের কে অনেকেই হেলা করে।

আমার স্বাধীনতা এখনও যন্ত্রণায় ছটফট করে, তবুও নিঃশ্বাস ফেলে মুক্ত হাওয়ায়।

জানি,আমি আছি, এখন ও তন্দ্রায়! ভোরের আকাশে ঊষার আলোয়, সন্ধ্যা  আসবে ঘনিয়ে কাছে  আকাশ ভরবে জোৎস্নায়।

------------------- 

স্বাধীনতা- ৭৮

স্বাধীন কিনা

আর্যতীর্থ


দেশ পড়েছে পঁচাত্তরে। 

ফোনে ফোনে প্রশ্ন ঘোরে, 

এই যে নাচা তা ধিন ধিনা,

 সত্যি এ দেশ স্বাধীন কিনা।


সত্যি বলতে, সন্দেহ হয়, 

চারদিকে যা জমেছে ভয়, 

সাংবিধানিক শব্দ মেনে নিন্দা করাও রাষ্ট্রদ্রোহ, 

 সামনে ভেবে পেছনে নেয় ধার্মিকতার অন্ধ মোহ, 

পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি পা দিচ্ছে মাথায় যোগ্যতারই, 

যখন তখন ঘটতে পারে জামিনবিহীন গেরেপ্তারি, 

জন্ম দেখেই ঠিক হয়ে যায় জীবনসাথীর ঝাড়াইবাছাই,

সত্যি বলতে , অনেক কাজেই খুব পরাধীন আমরা সবাই।


 তার মানে কি স্বাধীনই নই?

 যে সব জোয়াল দুই কাঁধে বই, 

এমন ভাবেই সেটার  ভারে বেঁকেছে শিরদাঁড়া,

 হুজুর বলেই কচলাবো হাত, কক্ষনো নই খাড়া? 

কে বেঁধেছে হাত পা বলো, মাথাই বা কার কেনা?

কে বলেছে ভাবছো যেটা করতে তা পারবে না?

 আজকে যদি করো তুমি ভিন্ন জাতে বিয়ে, 

কিংবা লেখো শাসক খারাপ মিডিয়াতে গিয়ে,

ঝামেলা যে হবে কিছু সেটা জানা কথা, 

স্রোতের বিপরীতে গেলে ঝাপটা খাওয়াই প্রথা, 

তাই বলে নয় করা সেটা এখন অসম্ভব,

 সংবিধানে অধিকারও দেওয়াই আছে সব,

 প্রশ্ন এটাই তুমি কি সেই ঝক্কি ঘাড়ে নেবে, 

নিজেই যদি বদল না চাও, লাভ কি তবে ভেবে?


 স্বাধীনতা বিশেষ্য নয়, ক্রিয়াপদের মতো,

 চলতে চাইলে অন্যদিকে মিলবে ঠিকই পথও।


  নিজের দোষটা দেশের ঘাড়ে দিও না অন্তত।

---------------------- 

স্বাধীনতা- ৭৯

ধৃতরাষ্ট্র

অসীম সেন


লোকটা জন্মান্ধ তবুও

এদিনটা এলেই সে নরম

পতাকার গায়ে হাত বুলোয়,

আর ভাবে, দেশটাও

বুঝি এরকম‌ই।


ভাগ্যিস সে দেখতে পায়না।।

------------------ 

স্বাধীনতা- ৮০

স্বাধীনতার মানে

রাজকুমার ঘোষ


প্রথম দৃশ্য

[আলোর দূত চ্যানেলের দুই রিপোর্টার নিজেদের মধ্যে কথা বলে নিচ্ছে আজকের স্বাধীনতা দিবসে তাদের চ্যানেলের লাইভ প্রোগ্রাম কিভাবে এগোবে। সাধারণ মানুষের মনে স্বাধীনতা দিবসে গুরুত্ব কতখানি।]  

রিপোর্টার-১ – 

আমাদের চ্যানেল আলোর দূত এর তরফ থেকে সকল দর্শকবৃন্দকে জানাই স্বাধীনতা দিবসের আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। আমাদের ভারতবর্ষ মানে বীর নেতাজির ভারতবর্ষ, দেশের প্রতি তাঁর আত্মত্যাগ এবং হাসিমুখে নিজের মাতৃভূমির জন্য প্রাণ বিসর্জন দেওয়া বীর বিপ্লবী শহিদ ক্ষুদিরাম বসুকে আজকের দিনে প্রণাম জানাই। এছাড়াও আরো অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামী বীর যোদ্ধাদের আত্ম বলিদানে ২০০ বছর ব্রিটিশদের হাতে বন্দী হয়ে থাকা মাতৃভূমিকে মুক্ত করেছেন৷ সেই মুক্তির আনন্দে আমরা দেশবাসীরা ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট স্বাধীনতা দিবস পালন করছি। তাই আজকের দিনটা আমাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও গর্বের দিন৷

রিপোর্টার-২ – 

একদম ঠিক। ১৫ই আগস্ট এর দিনেই আমরা ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান থেকে ইন্ডিয়ান হয়েছি। what is glorious day. আজকের দিনে আমরা চারপাশে দেশাত্মবোধক গান শুনতে পাচ্ছি, বিভিন্ন জায়গায় স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠান হচ্ছে। গর্বের সাথে তিরঙ্গা পতাকা উত্তোলন হচ্ছে৷ এসব দেখে আমার খুব আনন্দ হচ্ছে। 

রিপোর্টার-১ -  

ঠিক আছে এবার তাহলে চলে আসি আমাদের আজকের অনুষ্ঠানের মূল বিষয়, স্বাধীনতা মানে কি? আজ আমরা লাইভ টিভিতে দেখতে চাই যে আমাদের প্রিয় দেশবাসী তথা ভারতবাসী, তাদের কাছে স্বাধীনতা দিবসের গুরুত্ব কতখানি। তাদের মুখেই জানতে চাই স্বাধীনতা মানে কি? 

রিপোর্টার-২ – 

আশা করি দর্শকবন্ধুরা আপনারা এই অনুষ্ঠানটি উপভোগ করবেন এবং সঙ্গে থাকবেন চ্যানেল আলোর দূত এর সাথে। 


দ্বিতীয় দৃশ্য

[তরুণ দুই রিপোর্টার যখন তাদের চ্যানেলে স্বাধীনতা দিবসে সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া কেমন সেই নিয়ে লাইভ অনুষ্ঠান করা নিয়ে উৎসাহিত ঠিক সেই সময়ে শহরের এক পরিবারে বাবা-ছেলের কথোপকথন। বেলা ১০টা পর্যন্ত ছেলে ঘুমিয়ে আছে। বাবা বিরক্ত সহকারে ছেলের কাছে এসেছে।]  

বাবা- 

( নিজের সাথে কথা বলছে) কি হবে আজকালকার ছেলেদের, সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠেই না, রাত জেগে মোবাইলে কি যে করে কে জানে? ( ঘুমন্ত ছেলেকে ধাক্কা দিয়ে) এই মুখপোড়া, আজকে আমাদের স্বাধীনতা দিবস। আজ অন্তত সকাল সকাল ওঠ। ছাদে যা, পতাকা উত্তোলন কর। পাশের বাড়ির নিলুকে দেখে শেখ। কিছু শেখ... (ছেলেকে আবার ধাক্কা দেয়) 

[একরাশ বিরক্তি নিয়ে ছেলে তার বাবাকে]  

ছেলে- 

ধুত্তর, নিকুচি করেছে। স্বাধীনতা দিবস তো আমার কি? আমাকে একটু স্বাধীনভাবে ঘুমোতে দাও প্লিজ। কানের সামনে বেকার ফ্যাচ ফ্যাচ করছ কেন? 

বাবা- 

কি বাঁদর রে! বাবার সাথে এইভাবে কেউ কথা বলে? 

ছেলে- 

না, বলবে না। ঘুমটা ভাঙিয়ে দিয়ে স্বাধীনতা ফুটাচ্ছে। যাও যাও বাজারে গিয়ে খাসির মাংস কিনে নিয়ে এসো, তাহলেই স্বাধীনতা বেশ জমে যাবে। হ্যাপি স্বাধীনতা দিবস! ইনজয় বাবা, ইনজয়!!

বাবা- 

ছি ছি ছি... কুলাঙ্গার একটা! আমার কপালেই এরকম একটা জুটলো! হায় ভগবান।


তৃতীয় দৃশ্য

[রিপোর্টার দুজন প্রথমেই গেল শহরের একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের মধ্যে। সেখানে দুই ছাত্রের সাথে সাক্ষাৎ হয়ে গেল। তারা এগিয়ে গেল ছাত্রদের কাছে।]  

রিপোর্টার-১- 

হ্যালো student's 

ছাত্র-১-  

হ্যালো বলুন

রিপোর্টার-১- 

তোমরা নিশ্চই জানো যে আজ স্বাধীনতা দিবস  

ছাত্র-১- 

কি দিবস? আপনি কে? আর আপনাকে বলেই কি হবে? 

রিপোর্টার-২- 

আমরা আলোর দূত চ্যানেল থেকে কভার করতে এসেছি। আজ স্বাধীনতা দিবস নিয়ে তোমাদের থেকে মতামত জানতে চাই? 

ছাত্র-২- 

ও আচ্ছা! তাই নাকি? চ্যানেল থেকে এসেছেন! ওয়েট ওয়েট, একটু চুলটা ঠিক করে নিই। (একটু ঠিক করে নিল নিজের চুল এবং পরণের স্কুল ড্রেস ঠিক ঠাক করে নিল)  হুম বলুন..কি যেন সাধারণ দিবস জিজ্ঞাসা করছিলেন? 

রিপোর্টার-১- 

আরে স্বাধীনতা দিবস মানে ইন্ডিপেন্ডেন্স ডে। 

ছাত্র-১- 

ওই একই হলো। যা স্বাধীনতা, তাই সাধারণ। এই দিনে কি আমরা নাচবো নাকি গাইবো! 

রিপোর্টার-২- 

তোমাদের নাচতেও হবে না আর গাইতেও হবে না। স্বাধীনতা দিবসের গুরুত্ব কি তোমাদের কাছে জানতে চাইছি। 

ছাত্র-২- 

স্বাধীনতা দিবস মানে ছুটি ছুটি আর ছুটি। মানে ফুল মস্তি। বন্ধুরা মিলে শুধু পার্টি হবে!  

রিপোর্টার-১- 

একি! তোমরা নিশ্চই শুনেছো, ১৯৪৭ সালে আজকের দিনে আমরা ভারতবাসী অত্যাচারী ব্রিটিশদের হাত থেকে স্বাধীন হয়েছি। কত স্বাধীনতা সংগ্রামীদের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও তাদের প্রাণত্যাগের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছি। সেই দিবস কি আমরা পালন করব না?  

ছাত্র-১- 

তাতে আমাদের কি? ওই সময় লড়াই করার দরকার ছিল তাই তারা লড়ে দেশকে স্বাধীন করেছিল। 

ছাত্র-২- 

আপাতত আমরা আমাদের ছুটির সময় কাটাই নিজেদের মতো করে। ফুল মস্তি করে। এসব বেকার প্রশ্ন করে আমাদের বোর করবেন না। আজ শুধু ইনজয় আর জমিয়ে খানাপিনা। 

রিপোর্টার-২- 

ও আচ্ছা আচ্ছা, বুঝলাম।

[দুই রিপোর্টার ছাত্রদের কথা শুনে ভীষণ হতাশ। সেখান থেকে তারা চলে গেল।]  


চতুর্থ দৃশ্য

[ঐ স্কুলেই আজ একটি ক্যুইজ কন্টেস্ট ইভেন্ট হবে। রিপোর্টার দুজন  এসেছে ইভেন্টের স্থানে। পারলে আজ তারা স্বাধীনতা দিবসে স্কুলের এই ক্যুইজ কন্টেস্ট অনুষ্ঠান কভার করবে। ইভেন্টের আগে তারা উপস্থিত তিনজন প্রতিযোগী (যাদের মধে দু'জন ছাত্র ও একজন ছাত্রী)কে আজকের এই বিশেষ দিনের মাহাত্ম্য কি জানতে চায়...]  

রিপোর্টার-১- 

আজ আলোক দূত চ্যানেলের তরফ থেকে আমরা এসেছি তোমাদের স্কুলের ক্যুইজ কন্টেস্ট অনুষ্ঠান কভার করতে। তবে তার আগে আমরা চ্যানেলের একটি লাইভ অনুষ্ঠানের জন্য তোমাদের কাছে কিছু প্রশ্ন করতে চাই। 

ছাত্র-১- 

হ্যাঁ বলুন। 

রিপোর্টার-১- 

আজ আমাদের স্বাধীনতা দিবস। ১৯৪৭ সালে ১৫ই আগষ্ট আমাদের ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করে। তোমরা নিশ্চই জানো। তা, প্রিয় Student's, তোমাদের কাছে প্রশ্ন, স্বাধীনতা মানে কি?

ছাত্র-১- 

ও আচ্ছা। আজকের দিনে ভারতবর্ষের সংবিধান অর্থাৎ Indian Constitution গঠন হয়েছিল।  

রিপোর্টার-২- 

বলো কি? (আঁতকে ওঠে এবং লজ্জিত হয়ে) আচ্ছা বলো, ভারতের জাতীর জনকের নাম কি? 

ছাত্রী- 

জওহরলাল নেহরু। (জবাব শুনে দু'জন রিপোর্টার মাথায় হাত দিয়ে বিষ্ময় প্রকাশ করে)

রিপোর্টার-১- 

তাহলে মহাত্মা গান্ধী কে ছিলেন? 

ছাত্র-২- 

আরে ওইতো আমাদের টাকার নোটের ওপর যার ছবি আছে। 

রিপোর্টার-২- 

হ্যাঁ, ঠিকই। উনি ভারতবর্ষের জন্য কি ছিলেন, সেটা নিশ্চই জানো তো? 

ছাত্রী- ওই তো, উনি টাকার মেসিন আবিস্কার করেছিলেন। সেইজন্যই তো নোটের ওপর ওনার ছবি। 

রিপোর্টার-১- 

ওকে, ওকে। বুঝে গিয়েছি, তোমরা কি পড়াশোনা করছো... (বিরক্ত প্রকাশ করে) সহজ সরল জ্ঞান তোমাদের একদমই নেই। ভীষণ লজ্জার। ছিঃ 

ছাত্র-১- 

ঠিক আছে। এবার এখান থেকে যান তো। বেশি জ্ঞান দেবেন না। নিজেদের কাজ করুন। 

[ভীষণ হতাশ হয়ে দুই তরুন রিপোর্টার সেখান থেকে বেরিয়ে আসে।]  


পঞ্চম দৃশ্য

[দুই রিপোর্টার স্কুল থেকে বেরিয়ে রাস্তায় চলে আসে। দেখে একজন কিশোর রাস্তায় কানে হেড ফোন দিয়ে নাচতে নাচতে যাচ্ছে। রিপোর্টার দু'জন সেই কিশোরটির দিকে এগিয়ে যায়।]  

রিপোর্টার-১- 

ও ছেলে শুনছো...

কিশোর ছেলেটি – 

কে বাবা তুমি? দেখতে পাচ্ছো না আমি গান শুনছি। 

রিপোর্টার-১- 

আমরা আলোক দূত চ্যানেল এর তরফ থেকে আজ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে তোমাদের কাছে জানতে চাই, স্বাধীনতা দিবসের গুরুত্ব তোমার কাছে কতটা? স্বাধীনতা মানে কি? 

কিশোর ছেলেটি – 

স্বাধীনতা দিবস মানে আজ হলি ডে। আমার কাছে রক এন্ড রোল এন্ড ডিসক উইথ মিউসিক... ইয়ে ইয়ে (নাচতে নাচতে) 

রিপোর্টার-২- 

একি ১৯৪৭ সালে আজকের দিনে আমাদের দেশ ভারতবর্ষ স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। আজ সকল ভারতবাসীর কাছে একটি গর্বের দিন। জায়গায় জায়গায় ভারতের পতাকা উত্তোলন হচ্ছে। দেশাত্মবোধক গান হচ্ছে। 

কিশোর ছেলেটি- 

তো...! যারা করছে করছে, আমার কি? বেকার প্রশ্ন করে আমার ম্যুডটাই নষ্ট করে দিলেন। আমি আপাতত আপনাদের থেকে স্বাধীন হয়ে চাই। যান তো এখান থেকে... যত্তসব। 

[এরপর রিপোর্টারকে একরকম ধাক্কা দিয়ে সেখান থেকে চলে যায়]  

রিপোর্টার-১ – 

(রিপোর্টার-২ কে বলে) কেমন সব দেশবাসী আমরা। আমরা নিজেদের স্বাধীনতা দিবস নিয়ে কত উদাসীন। ভীষণ খারাপ লাগছে বন্ধু। 

[এরপর একজন বয়স্ক ব্যক্তি, (যার একটি হাত নেই) সেখান দিয়ে হেঁটে যান। কিছু দূরেই এক হকার তার ঝোলার মধ্যে একটি কাগজের তিনরঙের পতাকা রাখতে যায় এবং সেটা রাস্তায় পড়ে যায়। বয়স্ক ব্যক্তিটি তৎক্ষনাৎ সেই পতাকাটি অন্য হাতে তুলে নিয়ে হকারের হাতে দিয়ে দেন।]   

বয়স্ক ব্যক্তি – 

জয় হিন্দ। (স্যালুট করে) 

হকার – 

জয় হিন্দ! (স্যালুট করে)

বয়স্ক ব্যক্তি – 

পরিস্থিতি যেমনই হোক, মা'কে সবসময় রক্ষা করবে।

[দুই রিপোর্টার ওই ব্যক্তিকে দেখে তার কাছে চলে আসে।] 

রিপোর্টার-২- 

আজ আমরা যেখানেই গিয়েছি। শুধুই হতাশ হয়েছি স্যার। আপনাকে দেখে ভীষণ ভালো লাগল। আজ স্বাধীনতা দিবসের দিনে আপনাকে দেখে মনে ভীষণ শান্তি পেলাম। 

রিপোর্টার-১- 

স্যার আজ আমরা আলোক দূত চ্যানেল থেকে রাস্তায় বেরিয়েছি। সকল সাধারণ মানুষের কাছে জানতে চাইছি, আজ আমাদের স্বাধীনতা দিবস। এই স্বাধীনতার গুরুত্ব আপনার কাছে কতখানি? আপনার মতামত জানলে ভালো লাগবে। 

বয়স্ক ব্যক্তি – 

স্বাধীনতা মানে আমার মা'র মুক্তি, আমার মুক্তি, সমগ্র ভারতবাসীর মুক্তি। ১৯৪৭ সালে আজকের দিনে পরাক্রমশালী ইংরেজদের হাত থেকে আমার মাতৃভূমি তথা ভারতবর্ষ মুক্ত হয়। সেইদিনের কথা ভেবে আমার বুক গর্বে চওড়া হয়ে যায়। আজ স্বাধীনতা দিবসের দিনে যে সকল বীর সৈনিকরা মাতৃভূমির জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন বা এখনো সীমান্তে দিয়ে চলেছেন তাদের প্রতি আমার অন্তরের শ্রদ্ধা নিবেদন করি। সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই। জোর গলায় বলতে চাই জয় হিন্দ। বন্দেমাতরম। 

রিপোর্টার-২- 

স্যার আজ আমাদের ভীষণ প্রাপ্তি হল আপনাকে পেয়ে। 

রিপোর্টার-১- 

আপনার পরিচয় জানতে পারলে ভালো লাগবে স্যার। আর এই যে আপনি এই কাগজের পতাকাটি হাতে তুলে স্যালুট জানালেন, আপনার কাছে এই কাগজের পতাকাটির মূল্য কি? 

বয়স্ক ব্যক্তি – 

এই পতাকাটি মাথার ওপর ধরে রাখা এবং আমার মাতৃভূমিকে রক্ষা করাই আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ও কর্তব্য বলেই মনে করি। যতদিন বেঁচে থাকব তা রক্ষা করে যাব জীবনের মূল্য দিয়ে। আজ আমাদের দেশের হাল যেমনই হোক না কেন আমার এই জীবন মাতৃভূমিকে রক্ষা করার জন্য উজার করে দেব। তার কারণ আমি একজন যোদ্ধা। ইন্ডিয়ান আর্মির এক বিশ্বস্ত সৈনিক ছিলাম। আমি গর্ব বোধ করি। ইন্ডিয়াম আর্মিতে থাকাকালীন সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছি। প্রতিবেশী দেশের শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করেছি। আমাদের দেশকে রক্ষা করতে গিয়ে অনেক শত্রু সৈনিককে হত্যা করেছি। আমার একটি হাত আমার মা'কে রক্ষা করতে গিয়ে খোয়া যায়। তাতেও আমি দমে যায়নি। আর্মি থেকে অবসর নিয়ে আমি আজও  আমার ভারতবর্ষকে রক্ষা করতে চেষ্টা করে যাই। তাই পতাকাটিকে আমি রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখতে পারি না। আমাদের তিরঙ্গাকে সবসময় উঁচুতে দেখতে চাই। আমি সকল ভারতবাসীকে বলতে চাই এই তিরঙ্গার মূল্য বোঝো। নিজের দেশ তথা নিজের মা'কে বোঝো। সবাই এক হয়ে বলো, জয় হিন্দ, জয় ভারত, বন্দেমাতরম। 

[ওখানে উপস্থিত সকলে মিলে একযোগে বলল, জয় হিন্দ, জয় ভারত, বন্দেমাতরম।]  

রিপোর্টার-২- 

আপনার কথা শুনে আজ স্বাধীনতার মূল্য আমরা বুঝতে পেরেছি, আমাদের মন ভরে গেল। (বাকি সকলের উদ্দেশ্যে) স্বাধীনতা দিবসের দিনে আসুন সকলে ব্রতী হই, আমরা সবাই আমাদের প্রাণ দিয়ে আমাদের দেশকে বাইরের শত্রু বা আভ্যন্তরীন শত্রুদের হাত থেকে যেন রক্ষা করতে পারি। আমাদের তিরঙ্গাকে সবসময় মাথার ওপর রাখতে পারি। তিরঙ্গার অবমাননা কোনোভাবেই মেনে নেব না। আমাদের দেশ তথা আমাদের মা'কে সবাই মিলে যেন আগলে রাখতে পারি। জয় হিন্দ, জয় ভারত, বন্দেমাতরম।  

[দূরে কোথাও লতা মঙ্গেশকরের কন্ঠে "বন্দেমাতরম" গানটি হচ্ছে। সবাই স্যালুট করছে আর পতাকাটি নিয়ে হকারটি একটি উঁচু জায়গায় কাঠের খুঁটিতে আটকে দিচ্ছে।] 

-সমাপ্ত-

---------------------- 

স্বাধীনতা- ৮১

কেন মাঝরাতে

আর্যতীর্থ


মাঝরাতে  কেন শুরু বোঝোনি এখনো?

ভোর হয়ে গেছে কেউ না ভাবে যেন, 

কালিমা রয়েছে ছেয়ে তখনো যে গাঢ়, 

আলো হতে  আছে দেরি বহুকাল আরো, 

 পনেরো আগস্ট হওয়া মাঝরাত্তিরে,

 স্বাধীন তেরঙা এক মাথা তোলে ধীরে,

বুক চিরে কাঁটাতার চলে গেছে তার, 

ব্রিটিশ গিয়েছে ছেড়ে নিকষ আঁধার।


তাহলে কি এতদিনে হয়ে গেছে ভোর? 

আরে ধুর, রাত এখন আড়াই প্রহর,  

মশালের আলো দেখে বুঝতে পারো না?

 স্বাধীন ভাবতে পারে দুই চার জনা,

 বাকি সব নেতাদের প্রভু বলে ভাবে, 

ভক্তিবহর দেখে ব্রিটিশ পিছাবে, 

ধনী আজও আইনকে রেখেছে পকেটে, 

গরীবের চলে দিন চক্কর কেটে,

 জাতপাত আজও দেশে  কাটছে মানুষ,

 ধিকিধিকি পুড়ে চলে ধর্মের তুষ,  

স্বাধীনতা নেই আজও ভালোবাসবার, 

মাঝরাত নয় বটে, তবুও আঁধার।


মাঝরাত থেকে শুরু স্বাধীনতা তাই

এখনো অনেক বাকি আসা রোশনাই। 

চাঁদের আলোকে যদি ভোর বলে ভাবো, 

নিশাচর প্রাণীদের তাতে বেশ লাভও,

 আঁধারে ভয়াল লাগে শেয়ালের দল, 

দাবিয়ে রাখতে শুধু ভয় সম্বল, 

একটু একটু করে ফুরাবেই রাত, 

একদিন পাবো ঠিক নতুন প্রভাত।

 সে সকালে সকলেই স্রেফ ভারতীয়, 

যেমন গজব আলি, তেমন আমিও । 

সেখানে দলিত নেই, নেই উঁচু জাত,

 ভালোবাসা হলে কেউ বলে না জেহাদ, 

সেইখানে নেই কোনো শ্রেণী সংগ্রাম, 

দাম পায় ঠিক ঠিক সকলের ঘাম, 

খোয়ারি নয় এ জেনো কোনো নেশা করে, 

একদিন এইদেশ পৌঁছাবে ভোরে,

কে জানে তুমি আমি যাবো কি তা দেখে,

স্বপ্ন জ্বালাই মনে যেন প্রত্যেকে।


শুরু যার সেই কবে মাঝরাত থেকে..

--------------------- 

স্বাধীনতা- ৮২

আমাদের পদক্ষেপ পত্রিকার জন্য 

স্বাধীনতার 75 বছর পর সাধারণ মানুষের চোখে দেশের অবস্থা 

নরেন্দ্রনাথ নস্কর


ভারতের স্বাধীনতা পাবার পর প্রায় ৭৫ বছর কেটে গেছে। সেদিক দিয়ে এই বার ৭৬ তম স্বাধীনতা দিবস বলা যায়।

স্বাধীন ভারতের নাগরিক হিসাবে কি পেয়েছি বা কি পাইনি তার চুলচেরা বিশ্লেষন করতে এই লেখা নয়।


তবে রেডিও, টিভি, সংবাদপত্র ইত্যাদি দেখে ও পড়ে যা প্রতিফলিত হচ্ছে সেই নিয়ে কিছু কথা এখানে বলার চেষ্টা করব।


স্বাধীনতার বেশ কিছু বছর পর জন্ম এই পৃথিবীতে। 

ছোটবেলায় দেখেছি স্বাধীনতা সম্পর্কে কি গভীর দেশাত্মবোধ মনে জেগে উঠত। 

সিনেমার শেষেও দেখেছি জাতীয় পতাকা পর্দায় উড়ত। তখন দর্শকরা স্বতস্ফূর্তভাবে সবাই উঠে দাঁড়াত। 

মানুষের মধ্যে বেশ মূল্যবোধ বিদ্যমান ছিল।

 ছোটরা বড়দের যথা যোগ্য সম্মান করত। 

তখনও মানুষের মধ্যে কিছু ভাল ও অনেক খারাপ মানুষ থাকত। 

কিন্তু দিনের পর দিন ক্রমশ এই মুল্যবোধের অবনতি হতে থাকল।

খবর পড়ে যা দেখতাম, তখনও নেতাদের মধ্যে খারাপ ও ভাল দুটোই ছিল।  


এখন এমন অবস্থায় পৌঁচেছে যে, দুর্নীতি যেন হয়ে থাকে, এই মনোভাব সহে গেছে। 

টিভিতে দেখতে দেখতে মন খারাপ লাগে। 


টিভি দেখলে, শাসন ব্যবস্থায়  সাধারণের মনে বিতৃষ্ণা আসছে।


  ভাল সত নেতা খুঁজতে, ঠগ বাছতে যেন গাঁ উজাড় হয়ে লাগছে মনে হয় ।


স্বাধীনতার জন্যে দেশপ্রেমিক যোদ্ধারা যে ত্যাগ স্বীকার করেছিল, সেগুলো যেন কিছুটা হলেও ব্যর্থ মাঝে মাঝে মনে হয়।


নামেই স্বাধীনতা দিবস পালিত হচ্ছে।

 কিন্তু সেই দেশপ্রেম, দেশাত্মবোধ আর তো সত্যি দেখিনা কার্যক্ষেত্রে।


দেখানোর মত, উদাহরণ দেবার মতো সত, ত্যাগী, সাহসী নেতাও এখন যেন বিরল।


ভাল মানুষদের অযথা হয়রানি অনেক সময় করা হচ্ছে।

দুষ্ট মানুষের দমন ও শিষ্ট নরনারীদের পালন এখন কথার কথা যেন।


খারাপ কাজের প্রতিবাদ করা এখন যেন অন্যায় মনে হয়।

 তার পিছনেই নেতাদের রুষ্ট চক্ষু।

তাই প্রতিবাদ তার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। 


বেশিরভাগ শান্তিপ্রিয় মানুষ চুপচাপ থাকাই শ্রেয় মনে করছে।কারণ তাকে রক্ষা করার লোক খুব কম।

 প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ না থাকায় দুষ্কৃতীরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।


যার প্রাপ্য সে না পেলেও, কোথাও বলার বা শোনার মানুষ কম।

কত মানুষ যে বঞ্চিত হচ্ছে তার হিসাব পাওয়া মুশকিল। 

বিনা প্রতিরোধে, ও প্রায় বিনা বাধায়, যেন দিনের পর দিন সমাজের অবস্থা খারাপ ও  নিম্নগামী মনে হচ্ছে। 

দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি হলেও সাধারণের,বিশেষ করে সাধারণ নিম্ন মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র সত মানুষদের অবস্থা ও প্রাত্যহিক জীবন যাত্রা কেমন যেন সহ্যের বাইরে মনে হয়।


ইচ্ছা থাকলেও কিছু বলার উপায় ও জায়গা খুঁজে পাচ্ছে না।

স্বাধীনতার প্রাপ্তি যেন, শুধু শাসন ক্ষমতার পরিবর্তন।

নামে একটা আইন বা সংবিধান আছে। সাধারণের জন্য তার সঠিক প্রয়োগ বা প্রতিফলন কোথায়?


জিনিস পত্রের দাম উর্দ্ধমুখি।

 ক্রয় ক্ষমতা হয়ত আগের থেকে বেশ কিছু বেড়েছে। 

কিন্তু মূল্য সাধারণের আয়ত্বের থেকে সরে যাচ্ছে।


সংবিধানে থাকলেও বাক স্বাধীনতা কোথায়?

মৌলিক অধিকার কি সত্যি বাস্তবে প্রতিফলিত হয় ?


একতা বাদ দিয়ে চারিদিকে কেমন যেন প্রাদেশিকতা, বিচ্ছিন্নতাবাদ মাথা চাড়া দিচ্ছে। 

এর কারণ কি?


ধর্ম ভাষা নিয়ে কেন এত বিভেদ, বিদ্বেষ? এর সমাধান কোথায়?

অখণ্ড ভারতবর্ষ সেই ভাবনা যেন শুধু সংবিধানে।


বিদেশী শাসকদের থেকে মুক্ত হয়ে এ কোন নতুন সমস্যা?


শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, বাসস্থানের অধিকার থাকলেও তার সত্যি মিলছে কতটা, তার পরিসংখ্যান কতটা বিশ্বাস যোগ্য, তার সঠিক  মূল্যায়ন কে করবে?

শিক্ষিত বেকারদের কর্ম সংস্থানের নিশ্চয়তা কোথায়?


শোনা যায় ভারতের যা প্রাকৃতিক সম্পদ, তার সদব্যবহার হলে, দেশে দারিদ্রতা থাকার কথা নয়।

কিন্তু বাস্তবে কি হচ্ছে, কে বলবে?


সবার থেকে গুরুত্বপূর্ণ হল দেশের  মানুষের, ও শাসন ব্যবস্থার সততার সূচক।

উন্নত দেশগুলোর তুলনায়, ভারতের সূচক অনেক নিচে। 

এই সূচক নাগরিক ও শাসন ব্যবস্থ্যার সততার মূল্যায়ন অনেকটা প্রতিফলিত হয়। 

স্বাধীনতার এত বছর পরেও ভারত কেন উন্নত দেশ গুলোর কাছাকাছি যেতে ব্যর্থ?

তার উত্তর কোথায়? 


মানুষ আশাবাদী।

তবুও হয়ত এমন এক দিন আসবে, যখন ভারতের সাধারণ মানুষ স্বাভাবিকভাবে সবাই সত পথে চলবে। 

শাসকরা সেবা, সততা দিয়ে নাগরিকদের সেবার সত্যি চেষ্টা করে যাবে।

দেখা যাক কি হয়? 


সেদিন সত্যি হয়ত দেশপ্রেমিক স্বাধীনতা সংগ্রামীদের স্বপ্ন কিছুটা  হলেও বাস্তবায়িত হবে।

--------------------- 

স্বাধীনতা-৮৩

হে প্রজাতন্ত্র

আর্যতীর্থ


সাপ আছে আস্তিনে, নেই ওঝা মন্ত্র, 

 আর কত নীল হবে, বলো প্রজাতন্ত্র!

ওঝা বলে যাকে ডাকো, দেখা যায় নাগ সে,

তালা ভাঙা যাবতীয় প্যান্ডোরা বাক্সে,

এদিকে খিদের খাদ, বেকারির গর্ত,

ওই দিকে  ধর্মের ধমকের স্বর তো,

তুমি ভাবো দুধেভাতে থাক সব বাছারা,

ধারণাকে শব করে কিছু পাজী পাঝাড়া,

চালু আছে দেশ জুড়ে দাস খোঁজা যন্ত্র,

স্বাধীনতা কাকে বলে , বলো প্রজাতন্ত্র।


তুমি কি নিজেকে দেখো সময়ের আয়নায়?

কি ছিরি হয়েছে দেখো রাজনীতি বায়নায়।

শরীরে গয়না কত যুদ্ধের অস্ত্র,

অথচ আব্রু ঢাকে ছেঁড়াখোঁড়া বস্ত্র

বিরল হয়েছে আজ রিফুকার দর্জি

বরঞ্চ আরো ছেঁড়ে নেতাদের মর্জি,

ধুলিধুসরিত পায়ে পড়ে আছে শিক্ষা

রোজগার কেড়ে নিয়ে দেওয়া হয় ভিক্ষা

উড়োচুল ভরে গেছে জাতপাত উকুনে

আশীষে বলে না কেউ গর্ভতে খুকু নে

খুকু এলে মুশকিলে পড়ে যায় সকলে

আজীবন রাখা চাই পুরুষের দখলে,

ভোট ছাড়া আর নেই কোনোখানে সমতা

টাকায় খবর  কেনে এত তার ক্ষমতা,

ঘৃণারা ছড়ায় যেন মলে বোঝা অন্ত্র,

তুমি সে গন্ধ পাও, প্রিয় প্রজাতন্ত্র?


পথঘাট ছয়লাপ আজ দেশ-নিশানে,

বিপরীতে দেখে তবু রাষ্ট্র ও কিষাণে,

জি ডি পি ঋণাত্মকে সেনসেক্স আধা লাখ,

স্তম্ভেরা বাধ্যত গায় শেখা গাধাডাক,

ইতিহাস ছাঁটে লোকে যেরকম সুবিধে,

বিজ্ঞানে রয়ে গেছে জ্যোতিষের কু বিঁধে,

স্বাধীনতা এনে দিয়ে বলেছেন পিতারা

এখনও অনেক দূরে স্বপ্নের सितारा,

বলেছেন ঠিকঠাক  बनाना রিপাবলিক

বানান পিছলে বনে banana রিপাবলিক।

চেষ্টায় হয়তো বা যেতো বোজা রন্ধ্র,

তবু কারা চায় ডুবে যাক প্রজাতন্ত্র।


আমাদের পালানোর সব পথ বন্ধ,

দোহাই যেও না ডুবে, প্রিয় প্রজাতন্ত্র।

----------------- 

স্বাধীনতা- ৮৪

স্বাধীনতা 

নির্মলেন্দু কুণ্ডু


ঠিক ভোরবেলা

ঘুম ভাঙার অস্বস্তি কাটিয়ে

যখন উড়ে চলি পথে

একটা অদ্ভূত গন্ধমাখা হাওয়া

খেলে বেড়ায় মাথা-চোখ-মুখ-ঘাড়ে,

একটু ছোঁয়া হয়তো মনেও লাগে৷

পথে একটা ছোট্ট হাত

বাড়িয়ে দেয় তেরঙা—

"নে বাবু,শুধু দুটো টাকা দে

দুদিন কিচ্ছু খাইনি!"

তারপর হইচই,

বাঁশ পোতা,

ভাষণের চর্বিত-চর্বণ,

লজেন্স বিলি৷

একটু পরেই চায়ের দোকান—

"এই পচা,মাস্টারকে চা-বিস্কুট দে"

পচার পিঠে গতকালের কালশিটেটা তখনও দগদগে!

রাত্রি আসে,

শর্টকার্ট নিই এক নিষিদ্ধ গলিপথে—

"এই বাবু,যাবি!"

সময় কেটে যায়,

আমাদের বুলিও,

খুব চেনা কিছু খন্ডচিত্র আসলে একই থাকে,

স্বাধীনতা খোঁজে....

-------------------- 

আমাদের পদক্ষেপ পরিবার আয়োজিত বিশেষ ইভেন্ট "স্বাধীনতা"

 


বহু রক্তক্ষয়ের পর স্বাধীনতা পেয়েছিলাম আমরা ৷ ঘটেছিল দেশ বিভাজন ৷ রাজনীতির পাশাখেলায় তারপর থেকে আমরা অর্থাৎ আম জনতা নানাভাবে পিষ্ট হতে হতে হয়তো আজ 'স্বাদহীন'ভাবে স্বাধীন রয়েছি ৷ এই স্বাধীনতা কতখানি পরাধীনতা থেকে মুক্তি আর কতখানি ক্ষমতার হস্তান্তর তা নিয়েও রয়ে গেছে বিতর্ক ৷ তবু আজকের দিনটা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ৷ তাই এই দিনটাকে উদযাপন করতে দেশজুড়ে গৃহীত হচ্ছে নানা কর্মসূচি ৷*

*আমাদের পদক্ষেপ পরিবারের পক্ষ থেকে আজকের দিনে পরিবারের সকলকে জানাই আন্তরিক শুভকামনা ৷ পূর্বঘোঘণা অনুযায়ী আজ আমাদের এই পরিবারের যৌথ দেওয়ালে আয়োজিত হবে বিশেষ ইভেন্ট— "স্বাধীনতা" ৷ ইতিমধ্যে আপনাদের পাঠানো লেখাগুলো আমরা একে একে পোস্ট করব এখানে ৷ সেই ধারাবাহিকতা যেন ক্ষুণ্ণ না হয়, সেজন্য ইভেন্ট চলাকালীন গ্রুপটি অনলি অ্যাডমিন করে রাখা হবে ৷ আপনাদের অনুরোধ, ধৈর্য রাখবেন ৷ সাথে থাকুন ৷*

----+++---

স্বাধীনতা- ৬১

তিনখানা চশমা

আর্যতীর্থ

          

তিনখানা  চশমা হারিয়ে গিয়েছে আমাদের । এখনই খুঁজে না পেলে ভীষণ বিপদ,

ঝাপসা অন্ধত্বে পাশের নিরীহ ছেলেটাকে মনে হয় আগামীর হিংস্র শ্বাপদ,

অতীতের অর্ধেক দেখা যায় না, বানানো ইতিহাস সত্যি বলে মনে হয়,

তিনখানা  চশমা হারিয়ে গিয়েছে, হয়তো বা তাই, ঠেলেঠুলে ভুল দিকে নিচ্ছে সময়। 


একটা চশমা ছিলো, পুরোপুরি গোল গোল ফ্রেম, তার সাথে সরু দুটো ডাঁটি,

চশমার পিছে দুটো ব্যথাতুর চোখ.. নোয়াখালি, বিহার, কলকাতা হেঁটে যায় অসহায় লাঠি,

হিংসারা জিতে গেছে, লাশের স্তুপের মাঝে কখনো আসছে ভেসে

ধর্ষিত রমণীর শেষ গোঙানি,

তবুও অহিংস তিনি স্বপ্ন দেখেন, ভারত নামক দেশে এক হয়ে থেকে যাবে জল আর পানি,

একটা চশমা ছিলো, শেষবার দেশ দেখে  যার মালিকের স্বরে বন্দিত হয়েছেন রঘুপতি রাম,

 গোল গোল ফ্রেম আর সরু ডাঁটিওলা, তোমরা দেখেছো কেউ, সময়ের গোলমালে কই হারালাম?


আর একটা চশমার কাঁচটা অমনই গোল, ডাঁটিটা একটু মোটা, একটু বাহারী,

ভাসা ভাসা দুই চোখে স্বপ্নের পাকা বাসা , একদিন স্বাধীনতা আনবেনই বাড়ি,

হিন্দু মুসলমান খ্রীস্টান শিখ এক , আজাদ সে ফৌজটাতে যখন  কণ্ঠে শুধু হিন্দ যায় শোনা,

সেসময় লিগ আর মহাসভা পরস্পরের প্রতি বিষ উগড়িয়ে বলে ইংরেজ প্রভুদের কিছু বলবো না,

তাদের উহ্যে রেখে চশমাধারীর ধ্যানে আর ধারণায় ধরা দেয় ধর্মের কাঁটাহীন আগামীর ছবি,

কোথায় রেখেছো দেশ সেই চশমাটা, ওটা চোখ থেকে খুলে সেই একই বিভাজনে দেখো কেন সবই?


তিন নম্বর ছিলো বেশ মোটা ফ্রেমওলা, কাঁচ পুরো গোল নয়, ওপরে কিছুটা চ্যাপ্টানো,

যাঁদেরকে ছুঁতে মানা ছিলো সে সময়ে, ছায়াকে মাড়িয়ে গেলে ব্রাহ্মণ করে নিতো স্নানও,

তাঁদেরই প্রতিভূ  সেই চশমা-মালিক। কতিপয় চিতপাবন ব্রাহ্মণ ভেবেছিলো রাখবে দলিতদের দুপায়ের নিচে,

যেমন থেকেছে তারা সহস্র বছর ধরে । চশমার অধিকারী আগলে না দাঁড়ালে জানিনা আজ দেশে হতো ঠিক কী যে,

অন্তত খাতায় কলমে আজ জাতপাত নেই। তবু গোঁফ রেখে খুন হয় 

আজকের ভারতেও দলিত তরুণ,

 অনার কিলিং ঘটা অতি বাস্তব। সংবিধানও নাকি খুঁজছেন সে চশমা, সন্ধানে নাগরিকও একটু নড়ুন।


অন্ধের কালো ওই চশমাটা সানগ্লাস নয়, ওটা শুধু দেখবার ব্যর্থতা ঢেকে রাখে,

ওটাকে ফ্যাশন ভেবে পরতে যেও না, ওতে সব কালোই দেখাবে। চেনা দেশ হারাবে সে বিলাসের  ফাঁকে।


তিনখানা চশমা দেশ থেকে হয়েছে উধাও । চুরি করে কারা তুলে রেখেছে তালা মারা  কোনো এক আলমারি তাকে।


পাল্লাটা ভেঙে ফেলে তোলপাড় করে খোঁজো। দরকার ফেরা ওরা সকলের নাকে।

----------------------

স্বাধীনতা- ৬২

স্বাধীনতার আলো

দীপ্তি চক্রবর্তী 


লবণ লবণ স্বাদে ভেসেছে বুক

হৃদয় উপুড় করলে জ্বলে আলো

দক্ষিণের জানালা নিয়ে ভাবনা

কবেই ফেলা হয়ে গেছে ওই

বুনো ঝোপের ধারে গজিয়েছে বট


স্বাধীনতা এসেছে নিজের মতো

আকাশে উড়ন্ত পাখিদের ডানায় 

কতো তাজা প্রাণের আহুতির সাথে

স্বাধীনতা আসে তোমার আমার 


আলো জ্বলেনি ওই ভাঙা কুটিরে 

আছে জেগে কোনো মা

অপার ভালোবাসা বিষ্ময় চোখে

বিনিদ্র রাত 

লজ্জাবস্ত্র সাথে যে কন্যা কাল 

ছেড়ে গেলো "নিজ" ঘরে

অগ্নিদগ্ধ সে আজ লড়াই করে

হাসপাতালের করিডোরে।

---------------------

স্বাধীনতা- ৬৩

আমরা স্বাধীন

অমরেন্দ্র কালাপাহাড়


আমি স্বাধীন        আমরা স্বাধীন

        স্বাধীন আমার এই দেশ,

 বন্দে মন্ত্র               প্রভাত ফেরি

        নেই গর্বের সে লেশ।


  স্বাধীন বলে          অপরের ধন

            অনায়াসে চুরি,

খুন ও জখম              রাহাজানি

         পাকাই হাত সে ভুরি!


 রামের ধন            শ্যামের চুরি

        রাম বলার কিছু নাই,

 শ্যাম যে আছে     দাদার ছায়ায়

       অন্যায় শোধবোধ যে তাই!


 ভোট রাজনীতি     সাতখুন সে মাপ

        খুনি খালাস বেকসুর,

 নির্দোষ পচে         জেল ঘানিতে

          এই ঘটনা ভরপুর!


 শিক্ষিতের নেই       চাকরি দাবি

         ভিক্ষাই শেষের সম্বল,

বিদেশ ব্যাংকে         ফুড়ুৎ টাকা

       হাপিত্যেশ চোখের জল!


 আমজনতার       বিবেক যে আজ

           নেতার হাতে বাঁধা,

নিত্য নতুন              যাতনা সয়

           ছালা বওয়া গাধা!


 স্বাধীনতার           কি তার মানে

         দোকানে পাওয়া যায়!?

 দেখতে কেমন         মূল্য কি তার

       খোঁজে সূঁচ খড় গাদায়!


 ফিরে এসো          হে শহীদ সব

            দূষণ ভরা এ দেশ,

যে স্বপ্নেতে            দিলে সে প্রাণ

           মেলে তা অবশেষ!

----------------

স্বাধীনতা- ৬৪

 তবুও কেন  

                সামসুজ জামান


 গঙ্গা দিয়ে যে ধারা বয়, কাবেরীও তো বয়ে চলে সেই একই জল।

 আবেগ এলে তোমার বুকের রক্তধারা উথলে উঠে নাচে যেমন,

 এই মনেতেও নেই বাধা নেই, যখন-তখন আসতে পারে সেই শুভক্ষণ।

 তেমনি ভাবেই আমার বুকেও রক্ত নাচে উত্তেজনায় ছলাৎ ছলাৎ ছল।


 আপনজনকে কাছে পেয়ে তুমি যেমন নেচে ওঠো খুশির ধারায়,

 তেমনি ভাবেই আপন জনের আবির্ভাবে আমার প্রাণেও সাড়া জাগে।

 সুর ঝংকার বেজে ওঠে গোপন বীণায় মনের তারে নতুন রাগে।

 বুক ফেটে যায় ব্যথার ভারে প্রিয়জনকে তোমার মত যখন হারাই ।


  রক্তধারা যেমন রাঙ্গা, তোমার অঙ্গে অঙ্গে যেমন প্রবহমান,

  তেমনি ভাবেই আমার শিরায় ধমনীতে নিত্য যে তার আনাগোনা,

  আমার মতই তোমার কাছেও দেশের মাটির তুলনা যেন খাঁটি সোনা ।

  রোজ প্রভাতে তোমার-আমার গাছের শাখায় পাখিরা যে গায় একই সে গান।


  হয়তো তোমার মুখের বুলি আমার থেকে একটুখানি অন্যরকম।

  তবুও তো দুঃখ-শোকের অশ্রুজলটা লবণাক্ত দুজনেরই তোমার-আমার।

  আনন্দেতে চাষিরা গায়, নেচে নেচে ফসলে ভরে গোলা, খামার।

  পায়রাগুলোও দুঃখে-সুখে করে তবু একই রকম বকম বকম।


  তবুও কেন বল এক হবো না, এখনও কেন তোমার-আমার বিভেদ করবো?

  বুঝলাম না আজও কেন সঠিকভাবে আমি-তুমি এই দেশ, মানুষ আর ধর্মের সংজ্ঞা?

  ধর্ম নিয়ে আজও কেন যখন তখন আমরা সবাই লড়াই করি, বইয়ে যে দিই রক্তগঙ্গা?

  প্রাণ-প্রিয় সেই সম্প্রীতি-মাখা তেরঙ্গা টা কবে থেকে

বিভেদ ভুলে মাথার উপর সবাই মিলে মেলে ধরবো?

---------------------

স্বাধীনতা- ৬৫

স্বাধীনতা দিবস ও আমরা...

     পারমিতা ভট্টাচার্য


আজ কিছু আবেগকে একসূত্রে গেঁথে স্বাধীনতা দিবস আমার কাছে কী তা লিপিবদ্ধ করতে বসেছি।জানি লেখায় কিংবা ভাষায় কোনটাতেই এই আবেগকে লিপিবদ্ধ করা সম্ভব নয়। যা লিখছি সবটাই আমার একান্ত নিজস্ব অনুভূতি মাত্র।


                        এক সমুদ্র রক্ত আর অদম্য জেদের বিনিময়ে পাওয়া আমাদের এই স্বাধীনতা।ছিয়াত্তরতম স্বাধীনতা দিবসে মাথা নত করি দেশের সকল স্বাধীনতা সংগ্রামী মহা মানবের চরণে। অঞ্জলি দিই আমার যত মানবিক আবেগ ও শ্রদ্ধা।

আমরা 1947 সালের 15 ই আগস্ট ব্রিটিশদের নাগপাশ থেকে নিজেদের মুক্ত করে স্বাধীন হয়েছিলাম। আজ আমরা স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক। অনেক কিছু পেয়েছি বটে,হারিয়েছি হয়তো তার থেকেও বেশি। আমরা তৃতীয় বিশ্বের নাগরিক,যতটা চাই বাঁচার জন্য ততটা হয়তো পেয়ে উঠতে পারিনা জীবনে।তবুও আমরা সুখী।আমার দেশ মাতৃকার কোলে আশ্রয় পেয়ে জীবন কাটাতে পেরে,আমার কাদা-ধুলোর দেশে,বান-বন্যার দেশে, নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর দেশে,বাপ ঠাকুরদার নোনা ধরা পলেস্তরা খসা ভিটে বাড়ি কামড়ে পড়ে থেকেই আমরা বাঁচতে শিখেছি।এতেই আমাদের সুখ।এতেই আমাদের শান্তি।

    

                      আজ এই ডিজিটাল যুগে এসে আমাদের সামনে খুলে গেছে একটা গোটা পৃথিবীর দরজা।হাতের মুঠোয় এসেছে চাহিদা আর যোগানের সাপ লুডো খেলা। আমাদের অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগছে আমরা কি আদৌ স্বাধীন? আসলে "স্বাধীনতা" কী সেটার অর্থই আমাদের কাছে স্বাধীনতার ছিয়াত্তরতম বৎসরে এসেও স্পষ্ট নয়। আমরা ভুলে যাই স্বাধীনতা মুখে মাখা কোন প্রসাধন নয়,কিংবা পকেটের ওয়েট বাড়ানোর যন্ত্র নয়।সেটা যেমন নির্ভর করেনা পাশের বাড়ির মেয়েটার রাত 1 টায় বাড়ি ফেরার মধ্যে কিংবা নিজস্ব ক্ষমতা জাহিরের মধ্যে। আমার স্বাধীনতার ব্যাস অন্যের স্বাধীনতার ব্যাসের সাথে সমান মাপেরই হতে হবে এই ধারনাটিই অত্যন্ত আপত্তিজনক।


                       স্বাধীনতা চেতনা শুধু মাত্র একটি দিবসের বলয়ে বিচার্য নয়।তেমনই নয় ইতিহাস বইয়ের একটি অধ্যায় মাত্র।এর ব্যাপকতা ও বিশালতা আমাদের জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রোথিত হয়েছে এই দেশে জন্মগ্রহণ করে। আমাদের জীবন ধন্য এই মাতৃভূমির স্পর্শে। আমার দেশের মাটির প্রতি আমার অনুভব, প্রেম, ত্যাগ, গর্ববোধ যদি না থাকে তবে শুধুমাত্র স্বাধীনতা দিবসে একটা তেরঙা পতাকা বাড়ির ছাদে কিংবা পাড়ার মোড়ে উত্তোলন করার কোন অর্থই থাকেনা।স্বাধীনতা দিবস প্রত্যেক দেশবাসীর একটা অনুভুতি,অহংকার।জাতীয় সংগীত গাইতে গিয়ে চোখ আবেগে বুজে আসার নাম ই দেশপ্রেম। আমরা যারা সন্তানের পিতা মাতা তারা সন্তানকে বড় হবার শিক্ষা দিই,ছুটে চলার শিক্ষা দিই,আকাশ ছোঁয়ার শিক্ষা দিই। এর সাথে সন্তানকে দেশের মাটি চেনাতে হবে, ছোট্ট শিকড়ে স্বাধীনতার আবেগ প্রোথিত করতে হবে, শিক্ষার পাশাপাশি তার সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতন করতে হবে,দেশের মাটির প্রতি দেশের ইতিহাসের প্রতি শিশুমনকে শ্রদ্ধাশীল করে তুলতে হবে।এটাও অনেক বড় দেশপ্রেমের পরিচয়। এখন চারিদিকে দেখি পাড়ার কিছু ছেলে ছোকরা মুখে অশ্রাব্য বাক্য ঝরিয়ে সারা বছর নগরকেত্তন করে শুধুমাত্র এই দিনটায় বিশেষ অনুরাগীদের দলে ভিড়ে ভিড় বাড়িয়ে পতাকা উত্তোলন করে মাংস ভাত খেয়ে কাটানোকে স্বাধীনতা দিবস হিসাবেই মানে।বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে এটাই হচ্ছে। এই যদি হয় আমাদের স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের ঘটা তবে এটা পালন না করে নীরব থাকায় শ্রেয়।স্বাধীনতা মানেই এখন মিছিল ,সকাল থেকে ডিজের দেশাত্মবোধক গান,জমায়েত,একের পর এক আত্ম প্রচারময় বক্তৃতায় হারিয়ে যাওয়া স্বাধীনতা সংগ্রামী আর রাস্তায় খাবি খেতে থাকা আম জনতা ।


                      স্বাধীনতা ভোগের বস্তু নয়,স্বাধীনতা একটা অনুভূতির নাম। স্বাধীনতা দিবসে সবার একটাই প্রার্থনা হওয়া উচিত দেশ মৃত্তিকার কাছে, আমাদের জীবনে আরও ক্ষমা দাও,আরও ত্যাগ দাও, আরও সহিষ্ণুতা দাও মা। তোমার আঁচলে আমাদের সকল জড়তা,লোভ,ভয়,লজ্জা অঞ্জলি দিয়ে আমরা যেন মানুষের মত মানুষ হয়ে উঠতে পারি। কাপুরুষতার করাল গ্রাসে যেন আমার চেতনা হারিয়ে না যায়।কারোর কাছে বিক্রি হবার আগে যেন শিয়রে মৃত্যু আসে। শুধু 15 ই আগস্ট নয়, তেরঙা  উড়ুক পৃথিবীর সর্বক্ষেত্রে ,সবার আগে,সবার উপরে। 


    আমার দেশ ,আমার মাটি ,আমার স্বাধীনতা মহান হোক ,বিজয়ী হোক।।

-----------------------

স্বাধীনতা- ৬৬

স্বাধীনতা হীনতায়...

সুজাতা বন্দ্যোপাধ্যায়

 ভারতের আজ ছিয়াত্তরতম স্বাধীনতা দিবসে মানুষের দেশপ্রেম কিছুটা হঠাৎই জাগ্ৰত হয়েছে।কিছুটা সরকারি তৎপরতায়, কিছুটা আগস্ট পনেরোর ঘনঘটায় আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছেন মানুষ।

কজন মনে রাখি আজ শহীদের প্রাণত্যাগ ও আত্মত্যাগের কথা?দেশের মঙ্গলের  জন্য সার্বিকভাবে কজন ভাবি?আজকের প্রজন্ম কতটুকু আগ্ৰহী স্বাধীনতার ইতিহাস জানতে?ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জীবনী বলিদানের কাহিনী,দেশের সংস্কৃতির উপরে শিক্ষা দেওয়ার কোনও বাধ্যতামূলক ব্যবস্থা নেই।তাই আগামী প্রজন্ম জাতীয় পতাকার সম্মান জানাতে পারে না।স্বাধীনতা দিবসের তারিখটিও ভুল করে।দায়ী কারা?

দায়ী আমরাই।সন্তানকে ভাল মানুষ করার আগেই টাকা কামানোর মেশিন বানিয়ে ফেলি।অথচ বিদেশের মাটিতে ভারতীয়রা যখন স্বাধীনতা দিবস পালন করেন আমরা শুধুই বাহ বাহ বলে দায় সারি।নিজের দেশের মাটিতে ভারতবর্ষীয় ঐতিহ্য,সংস্কৃতির পরম্পরাকে বাঁচিয়ে রাখার ন্যুনতম চেষ্টা করিনা।

দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে শুরু করে সাধারণ জনগনের সুরক্ষা, দেশের সব ধর্মের জাতি-ধর্ম-বর্ণের মানুষের কাছে স্বাধীনতার ইতিহাসের সম্মান দেওয়া উচিত।ভারতের গৌরবময় সংস্কৃতির পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা উচিত।তবেই আজকের দিনের সার্থকতা।

-------------------

স্বাধীনতা- ৬৭

আমার স্বাধীনতা

মৌ দাশগুপ্ত


১৫ই আগস্ট, ১৯৪৭...স্বাধীনতা কে পেয়েছিল? মানুষের হাতে সীমানা এঁকে আলাদা করে নেওয়া খানিক্টা মাটি নাকি সেই সীমানার ভিতরে,সেই মাটির ওপর বেঁচে থাকা মানুষগুলো? 

মাঝে মধ্যে ভাবি, বুঝলেন, স্বাধীন দেশ হয়, নাকি দেশবাসীও স্বাধীন হয়? স্বাধীন হয়ে দেশ কি পেল, সে রাজনীতিকরা জানেন।ওখানে দাঁত ফোটাতে গেলে বড় মুশকিল। আমি বাপু অতি সাধারণ মানুষ, আরো সাধারণ আমার চিন্তাভাবনা।তাহলেও মাঝে মধ্যে জানতে ইচ্ছে করে কি পেলাম আমরা?

১। পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র আমার দেশ। ভোট দিয়ে আম জনতা দেশের রাজনৈতিক  নেতা বাছি। আমরা স্বাধীন ভাবে ভোট দিই তো?

২। খবরের কাগজ পড়েন নিশ্চয়ই? প্রতিদিন কোন-কোন খবরগুলো খাড়া- বড়ি- থোড়, থোড় -বড়ি -খাড়ার মত নাম-ধাম, স্থান-কাল- পাত্র পালটে পালটে কমন আইটেমের মত চোখের সামনে ভেসে উঠছে তাও খেয়াল করেছেন নিশ্চয়ই? হ্যাঁ আমি আম মহাভারতীদের হালচাল হাল হকিকত নিয়েই বলতে চাইছি। 

স্বাধীনোত্তর ভারতেও মেয়েরা দেবী হিসাবেই আলাদা সম্মান পায় বই কি! সাক্ষাৎ  দেবী কামাখ্যার অংশ মানা হয়। একদম যোনীসর্বস্ব। তিন-মাস থেকে তিন-বছর, ত্রিশ বছর থেকে ত্রিশ দু'গুনে ষাঠ বছর, কারো ক্ষেত্রে তার ব্যাতিক্রম নেই।এত স্বাধীন ভাবনা স্বাধীন দেশ ছাড়া কোথায় পাবেন বলুন।

৩। আমি বাবা আদার ব্যাপারী, জাহাজের ব্যাপারে স্পিকটি নট।তাই ব্যাংকের সুদের হার কমা, ভল্টের নিরাপত্তার ব্যাপারে ব্যাংক কতৃপক্ষের হাত ধুয়ে ফেলা, রোজকার দরকারী জিনিষপত্রের ক্রমশ বেড়ে চলা দাম, ডিমনিটাইজেশন, কর্মবিচ্যুতি ( বাব্বা, ইঞ্জিরিতে ভাবতে গিয়েই দাঁত নড়ে গেল, বেঁচে থাক আমার বাপ-মায়ের ভাষা), পথশিশু, বাল্যশ্রম, অনাহারে মৃত্যু, পরিযায়ী শ্রমিক, প্রাদেশিকতা, এসিড ছোড়া, ডাইনিপ্রথা,চিটফান্ড, হিউম্যান ট্রাফিক, অতি পুরাতন পণপ্রথা, ভ্রূণাহত্যা, ক্রমশ বেড়ে চলা অনাথআশ্রম আর বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা, শিক্ষাজগতে রাজনীতি ও চাঁদিয়াল সমাজের দাদাগিরি, সোনার চাঁদ / সোনার টুকরো তোষণ, শ্রীবিষ্ণুর অবতারকল্পের পুনর্জাগরণ, গোমাতা ও গোমাংস নিয়ে তরজা, নীলছবির মোবাইলে মোবাইলে রমরমা ব্যাবসা, তথাকথিত রাজনীতিক বা মন্ত্রী মশাইদের কোটি কোটি টাকা গোছানো, বৃন্দাবনীয় লীলাখেলা থেকে আজকের খবরের কাগজের হেডলাইন, গরুপাচার, কয়লা পাচার, শিক্ষা জগতের নৈরাজ্য, চাকরী পাইয়ে দেবার নামে ঘুষের রমরমা, যুবমানসের অস্থিরতা,   এ সব আমার চোখেও পড়েনা, কানেও শুনতে পাইনা তাই এসব নিয়ে কিছু বলতেও যাইনা। স্বাধীন বলেই তো কি শুনব, কি দেখব, কি বলব, এ স্বাধীনতাটুকু আমার আছে।

৪। আমার এক ছাত্রের নাম ছিল স্বাধীন। ভারতও শুনেছি ব্যাকরণ মতে পুং লিঙ্গ।তাই লেটেস্ট স্বাধীনতাটি চার দেওয়ালের ভিতর দাম্পত্য বিছানায় পুরুষের ভাগ্যেই শিকে ছিঁড়েছে। বিয়ে করা বউ আর যৌনদাসীর বিভেদটা আইনানুগভাবে তুলে দেওয়া হয়েছে।তা সে রোজগেরে বউই হোক কি বেরোজগেরে।লাভ ম্যারেজ হোক কি দেখে শুনে পরখ করে বিয়ে করা বউ।

৫। পরাধীন হবার আগে,পরাধীন হবার পরে/স্বাধীন হবার আগে এবং স্বাধীন হবার পরে 'চরিত্তির' জিনিষটা একচেটিয়া এদেশের মেয়েদের জন্য পুরুষদের তরফের মনমৌজি উপহার ছিল আছে আর থাকবেও, নিজের প্রয়োজনে আগে একটা 'সু' কি 'কু' বসিয়ে কপালে সেঁটে দিলেই হল। রাত বারোটায় একটা মেয়ে অফিস ফেরত নামানুষদের হাতে আক্রান্ত হলে প্রথমেই লোকে বলে - ' এত রাতে মেয়েটার কি দরকার ছিল রাস্তায় নামার? অত রাতে অফিস? হু হু বাবা, জানা আছে। কম তো আর দেখলাম না।  মেয়েটারই দোষ। নষ্ট মেয়েছেলে। '

 রাস্তা সুরক্ষিত করা যায় নি, ওই নামানুষগুলোকে মানুষ করা যায় নি,সেটা বাদ দিয়ে এই যে চিন্তাধারা, সেটা স্বাধীন বলেই ভাবা ও বলা সম্ভব।মেয়েরা আজও 'মেয়েছেলে'/ 'মাল'/'আইটেম'/ ছম্মকছল্লো বেশী, মেয়েমানুষ কম,সেটাও কিছু মানুষের স্বাধীন চিন্তাধারার জন্যই সম্ভব।

স্বাধীনতা কি তাহলে কাগজে কলমে শুধু একটুকরো জমির?সেই জমির ওপর শ্বাস নিয়ে হেঁটেচলা মানুষের আচার ব্যাবহার, চিন্তাধারা, কাজেকর্মে কোন স্বাধীনতা দেখছি আমরা? 

সে মরুগ গে যাক। আমি বাপু স্বাধীন সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতবর্ষের স্বাধীন নাগরিক।আজ আমার স্বাধীনতা দিবস। বছরে এই একটা দিনেই তো কেমন ফুরফুরে স্বাধীন স্বাধীন হাওয়াটা গায়ে লাগে। তায় এ বছর আবার কিনা 'আজাদী কি অমৃত মহোৎসব', নেই নেই করেও   'গণতান্ত্রিক', 'প্রজাতান্ত্রিক' উপাধি ঘাড়ে নিয়ে দীর্ঘ ৭৫ বছরের যাত্রাপথ পাড়ি দিয়ে ফেল্লো আমাদের দেশ। তাই একদিনের অমৃত মহোৎসবে আমরা জমিয়ে সেল্ফি তুলবো 'হর ঘর তেরঙ্গা' নিয়ে..তারপর একটা সার্টিফিকেট ডাউনলোড করেই সোস্যাল মিডিয়াতে লোকদেখানি দেশপ্রেমের পরাকাষ্ঠা জাহির করে ফেল্লেই কেল্লা ফতে। আপাতত এখানেই আমাদের দেশপ্রেমে দাঁড়ি। ভাগ্যিস আমাদের সেনারা যাবতীয় বিতর্ক ভুলে, সীমানায় অতন্দ্র প্রহরায়। যদিও আমার বাচ্চাদের আমি ডাক্তার/ ইঞ্জিনীয়ার/ ব্যারিস্টার /চার্টাড একাউন্টেট/ শিক্ষক, নিদেনপক্ষে কলমপেষা কেরাণী করাবো, কিন্তু সেনাবাহিনী তে? নৈবনৈব চ। পরের ঘরের ছেলেমেয়ের জন্যই ও পেশাটা বরাদ্দ থাক না। এটাও আমার ভাবনার স্বাধীনতা বই কি। স্বাধীন দেশের নাগরিকের নিজস্ব স্বাধীনতা। 

সব্বাইকে শুভ স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা।

---------------------

স্বাধীনতা- ৬৮

ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে বিপ্লবী মদনলাল ধিংড়া

রাজকুমার ঘোষ

ভারতের স্বাধীনতা অন্দোলনে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে কত স্বাধীনতা সংগ্রামীর নাম,  যারা ভারত ভূখন্ড থেকে ইংরেজদের উচ্ছেদ করার ব্রত নিয়ে নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন। সুভাষচন্দ্র বসু থেকে শুরু করে মাস্টারদা সূর্য সেন, ক্ষুদিরাম বসু থেকে শুরু করে বিনয়-বাদল-দীনেশের বৈপ্লবিক কার্যকলাপ আজও ভারতবাসী তথা বাঙালী মননে গেঁথে আছে। তারই মাঝে অনেকেই আছেন যাদের বৈপ্লবিক কার্যকলাপ ভীষণভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে, কিন্তু তাদের নাম অনেকেই হয়তো জানেন না বা স্মরণ করেন না। বিপ্লবী রাসবিহারী বসু তাঁদের মধ্যেই একজন যার মহান কার্যকলাপ সম্বন্ধে অনেকেই জানেন না। তেমন ভাবে আর একজনের নাম মদনলাল ধিংড়া, যিনি ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন অন্যতম বিশেষ ব্যক্তিত্ব এবং অগ্নিযুগের বিপ্লবী।

মদনলাল ধিংড়া ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অসামান্য বিপ্লবী ছিলেন। তিনি ইংল্যান্ডে অধ্যয়নরত ছিলেন যেখানে তিনি ব্রিটিশ কর্মকর্তা  স্যার উইলিয়াম হার্ট কার্জন উইলিকে গুলি করে হত্যা করেন। বিংশ শতাব্দীতে এই ঘটনাটি ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম ঘটনাগুলির মধ্যে একটি।  

১৮৮৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর পাঞ্জাবের অমৃতসরে একটি সমৃদ্ধ হিন্দু পরিবারে মদনলাল ধিংড়া জন্মগ্রহণ করেছিলেন।এক সিভিল সার্জন পিতার সাত সন্তানের ষষ্ঠ সন্তান ছিলেন মদনলাল ধিংড়া। তিনি তাঁদের পরিবারের  ইংরেজি শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে মানুষ হয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর মাতা একজন ধর্মীয় ও ভারতীয় সংস্কৃতির ভক্ত ছিলেন, যার প্রভাব তাঁর মধ্যে পড়েছিলো। তিনি ছাড়া তাঁর বাকি ভাইদের শিক্ষা ইংল্যান্ডে হয়েছিলো। মদনলাল ধিংড়া অমৃতসরের এম.বি ইন্টারমিডিয়েট কলেজে ১৯০০ সাল পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন। এরপর তিনি পড়াশোনার জন্য লাহোরের সরকারি কলেজের বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই সময় ছাত্ররা যে ব্লেজার পড়তো তা ইংল্যান্ড থেকে আমদানী হত। ১৯০৪ সালে ইংল্যান্ড থেকে ব্লেজারের কাপড় আমদানী করার প্রতিবাদে প্রিন্সিপালের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী আন্দোলন হয়, যে আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন মদনলাল ধিংড়া। তাঁকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়। সেই সময়ে ধিংড়া মাস্টার অফ আর্টসের ছাত্র ছিলেন। তিনি জাতীয়তাবাদী স্বদেশী আন্দোলনে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনি ভারতের দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষের ব্যাপক কারণগুলি নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং অনুভব করেন যে এই সমস্যাগুলির সমাধানের জন্য দরকার স্বদেশী আন্দোলন। ধিংড়া এরপর ক্লার্ক হিসেবে কাজ করেছেন, তারপর সিমলাতে ব্রিটিশ পরিবারগুলির মাল পরিবহনের জন্য কলকার একটি টাঙ্গা পরিষেবায় কাজ করেছেন।  তারপর একটি কারখানার শ্রমিক হিসেবেও কাজ করেছিলেন। এখানে তিনি একটি ইউনিয়ন সংগঠিত করার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তাঁকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। এরপর তিনি মুম্বাইয়ে কিছু সময়ের জন্য কাজ করেছিলেন।  তারপর তিনি তাঁর বড় ভাই ডাঃ বিহারী লালের পরামর্শে উচ্চশিক্ষা চালিয়ে যাওয়ার জন্য ইংল্যান্ড যান ১৯০৬ সালে। লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে তিনি পড়াশোনা করেন। পড়াশোনার জন্য প্রথমদিকে তাঁর বড় ভাই এবং পরে ইংল্যান্ডে কিছু জাতীয়তাবাদী কর্মী তাঁকে আর্থিকভাবে সাহায্য করেছিলেন।

লন্ডনে মদনলাল ধিংড়ার সাথে পরিচয় হয় সেই সময়ের প্রখ্যাত বিল্পবী নেতা বিনায়ক দামোদর সাভারকর এবং শ্যামজী কৃষ্ণ বর্মার সাথে। এই দুই বিপ্লবী ধিংড়ার প্রচন্ড দেশভক্তিতে মুগ্ধ হয়েছিলেন। জানা যায়, বিনায়ক দামোদর সাভারকরই মদনলাল ধিংড়াকে 'অভিনব ভারত' নামে একটি বৈপ্লবিক সংগঠনের সদস্য করান এবং বন্দুক চালানোর প্রশিক্ষণ দেন। মদনলাল ধিংড়া লন্ডনের 'ইন্ডিয়া হাউস'-এ বেশি থাকতেন।  সেইসময় এই হাউস ভারতীয় বিদ্যার্থীদের রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের মূল কেন্দ্র ছিল। এই সকল বিপ্লবী বিদ্যার্থীরা সেইসময় ভারতে ক্ষুদিরাম বোস, কানাইলাল দত্ত, সতিন্দর পাল এবং কাশীরামের মত বিপ্লবীদের মৃত্যুদন্ড দেওয়ার জন্য ভীষণ রকম ভাবে ইংরেজ সরকারের ওপর ক্ষুদ্ধ ছিলেন। কিছু ইতিহাসবিদ এটাই মনে করেন এই সকল মৃত্যুদন্ডের ঘটনাগুলো সাভারকার এবং ধিংড়াকে সরাসরি ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বদলা নেওয়ার জন্য ইন্ধন জুগিয়েছিলো। তাঁরা সশস্ত্র আন্দোলনের পথ বেছে নিয়েছিলেন। 

১৯০৯ সালের ১লা জুলাই সন্ধ্যায় লন্ডনের একটি হলে ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন’-এর একটি বার্ষিক সভার আয়োজন করা হয়েছিল। যে সভায় অংশগ্রহণ করতে বেশ কিছু ভারতীয়র সাথে ইংরেজরাও একত্রিত হয়েছিলো। ঐ সভায় মদনলাল ধিংড়াও উপস্থিত হয়েছিলেন। ঐ সভায় যোগদান করতে আসার কথা ভারত সচিবের পরামর্শদাতা রূপে ব্রিটিশ কর্মকর্তা স্যার উইলিয়াম হার্ট কার্জন উইলির। সভা শেষ হওয়ার পর যখন অতিথিরা যে যার মত হল ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন ঠিক সেইসময় ধিংড়া উইলিয়াম হার্ট কার্জন উইলিকে নিশানা করে পাঁচটি গুলি করেন। যার মধ্যে চারটি গুলি সঠিক নিশানায় লাগে। এছাড়াও তাঁর গুলিতে মারা যান ডাঃ লালকাকা, যিনি একজন পার্সিয়ান ডাক্তার। এরপর ধিংড়া নিজের জন্য বরাদ্দ রাখা একটি গুলি নিজের ওপর প্রয়োগ করতে যাবেন কি তিনি ব্রিটিশ পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যান।   

২৩শে জুলাই ১৯০৯ সালে ধিংড়ার শুনানি হয় লন্ডনের পুরোনো বেলি কোর্টে। আদালত তাঁকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়। তারপর ১৭ই আগষ্ট ১৯০৯ সালে লন্ডনের পেন্টবিলে জেলে তাঁকে ফাঁসী দেওয়া হয়। তাঁর এই মৃত্যু ব্যর্থ হয়নি। মদনলাল ধিংড়া স্বদেশী আন্দোলনের জন্য নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন। তাঁর এই আত্মবলিদান ভারতবর্ষের বৈপ্লবিক আন্দোলনে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিলো। মৃত্যুবরণ করেও মদনলাল ধিংড়া অমর হয়ে রয়েছেন। ভারতবর্ষের শহীদ বিল্পবীদের তালিকায় তাঁর নাম আজও উজ্জ্বল হয়ে আছে। হয়তো অনেকেই জানেন না তাঁর এই বলিদান, কিন্তু এখনো বিপ্লবী মদনলাল ধিংড়ার স্মারক রয়েছে রাজস্থানের আজমের রেলওয়ে স্টেশনের ঠিক সামনে।

আসুন, সবাই মিলে ১৫ই আগষ্টের দিন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে শহীদ হওয়া বিপ্লবীদের সাথে বিপ্লবী মদনলাল ধিংড়াকেও জানাই আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলী। 

তথ্যসূত্রঃ গুগল এবং উইকিপিডিয়া (হিন্দী এবং ইংরাজী)

-----------------------

স্বাধীনতা-৬৯

দেশপ্রেম 

   মুকুল বিকাশ মণ্ডল 


এ প্রেম, দেশ প্রেম কিনা জানি না----

তবু, দেশ জয়ের খুশিতে মন ভরে উঠে,

দেশ গৌরবে---মন গৌরবান্বিতে উদ্বেলিত হয়-- আনন্দের ফল্গুধারায়।

পরাজয়ে --- মন কান্নায় ভারাক্রান্ত হয়ে,

ফেটে পড়ে হাহাকারের বিষণ্ণতায়----

 অস্ফুট রবে।।


আমার সোনালী -রূপালী বাংলা,

আমার ভারত -ভারতীর বাংলা,

আমি তোমায়---- ভালোবাসিইইইইইই।

চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, তোমার শোভা---

আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।

আমার রূপসী- রূপময় বাংলা,

আমার ভারতমাতা ও সোনালী বাংলা,

আমার ঋষি মনীষীর বাংলা,

আমি-- তোমায় খুব খুব খুববববববব 

ভালোবাসিইইইইইইইইই।।


তুমি, আমার হৃদয়ের শোণিত ধারায় মিশে আছো----- প্রেমের মহিমায়,

           ও

ভালোবাসা-ভালোলাগার অটুট বন্ধনে ।

তুমি, আমার আত্মায়-----

আত্মশ্লাঘায় রোণিত হও

নব নব রূপে,

মননের অমৃতলোকে।।


তুমি, আমার যৌবনের উপবন ও বার্ধক্যের বারানসী।

তুমি, আমার বেঁচে থাকার চালিকা শক্তির---- মূলমন্ত্র,

তুমি, অনন্ত ধৈর্য্য, ক্ষমা,প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসার

 সুবর্ণ দেবীময়ী আত্মা।।

--------------------- 

স্বাধীনতা-৭০

 অধিকার

আর্যতীর্থ


অধিকার স্বাধীনতার । অধিকার স্বাধীন কথার । 

অধিকার নির্বাচনের । অধিকার নির্বাধ বাচনের। 

অধিকার রোজ রুটির। অধিকার রোজগারে রুটির। 

অধিকার সমানতার। অধিকার সম মান্যতার। 


প্রথমগুলো দেওয়ার  অভিনয় জারি। দ্বিতীয়তে থিতু অন্ধকার। 


অধিকার সাক্ষর হওয়ার। অধিকার স্বাক্ষর দেওয়ার।

অধিকার ধর্ম বাছার। অধিকার ধর্ম থেকে বাঁচার। 

অধিকার ভালবাসার।  অধিকার ভালো বাসার। 

অধিকার নিজের ঘরের। অধিকার নিজের শেকড়ের।


প্রথম দেওয়ার ভানগুলো আছে। দ্বিতীয়টা পেতে দেরী আছে ঢের।


অধিকার রোগের দিনে শুশ্রূষার। অধিকার রোগহীন সুস্থতার।

অধিকার জীবনে সাথী বাছার । অধিকার স্ব- ইচ্ছেয় সাথী বাছার।

অধিকার নাগরিক নথির । অধিকার শাসকের সাথে  অসম্মতির।

অধিকার  অনুদান ভিক্ষার। অধিকার রোজগেরে  শিক্ষার। 


প্রথম সারি গণতান্ত্রিক ফাউ। দ্বিতীয় চাইবে সে সাহসী জিভ কার?


অধিকার। সংজ্ঞাটা ঠিক করে যে সময়ে গদি যার। 


রাজার বদল হলে বদলায় বোধই তার।

-------------------

স্বাধীনতা- ৭১

কোথায় আমাদের স্বাধীনতা?

চন্দ্রকান্ত চক্রবর্তী


সেন্ট জেভিয়ার্স ইউনিভার্সিটির সাম্প্রতিক ঘটনা কি বলছে না যে আমরা এখনও মানসিক সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত হতে পারিনি। আমাদের বিকলাঙ্গতার মতো পুরুষতান্ত্রিক মনোবৃত্তি এখনও কোন মানসিক স্বাধীনতার পরিচয় দিচ্ছে? যেখানে একজন মহিলা অধ্যাপকের চাকরি চলে যায়, জনসমক্ষে তাকে অপমানিত হতে হয় , ৯৯কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয় তার কাছে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত জীবনের কিছু মুহূর্তের ছবি ( পড়ুন স্যুইম স্যুট) নিজস্ব ইনস্টাগ্রাম থেকে পাবলিক হয়ে যাওয়ার দরুন, সেখানে আমরা কোন সম্মান মেয়েদের প্রতি আজ এই স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও দিতে পারছি বলতে পারেন!! 


ধিক্কার লাগে!!


এবং এর হয়ে, মানে ইউনিভার্সিটির হয়ে কথা বলার মতো লোকজনও কম নন, আজ এই ২০২২-এও আমাদের এ-দৃশ্য দেখতে হচ্ছে বইকি। তাই তখন প্রশ্ন ওঠে আমাদের যথার্থ মানসিক বিকাশ ও স্বাধীনতা নিয়ে, কোথাও আমরা এখনও সেই পুরুষতান্ত্রিক মানসিক নৈরাজ্যের কাছে দাসত্ব করছি না কি ! এবং সেটা স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও! 



স্বাধীনতা! 

তবে স্বাধীনতা দাও শব্দকে,

দাসত্ব ছাড়ো, স্তাবকতা ছাড়ো,

বন্ধ করো অন্ধ অনুগামিতা--

চাটুকার হতে গেলে স্বাধীনতা লাগে না!


স্বাধীনতা দাও শব্দকে,

যা বলতে পারোনি,

যা ঠিক জেনেও বলনি এত দিন,

সেই সোজা কথা সহজে বলে ফেলার

স্বাধীনতা অত্র তত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে --

শুধু তাকে সময়মতো তুলে নিতে শেখো নিজের করে,

তবেই না স্বাধীনতা ফুল হয়ে ফুটবে তিন রঙে সেজে,

বিকোবে না

হেলায় পড়ে থেকে

আর শুধুই অনাদর মেখে!

---------------------

স্বাধীনতা- ৭২

স্বাধীনতা

কান্তীশ


স্বাধীনতাকে বললাম ,চল কাল 

একটা মিছিল করি-

সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক ,

স্বার্থান্বেষীদের কালো হাত

ভেঙে দাও,গুঁড়িয়ে দাও ।


স্বাধীনতা খুব খুশি হয়ে বলল,

দাঁড়া,দাদাকে বলে আসি ।

---------------------