Thursday, May 7, 2020

রাজকুমার ঘোষ


স্মৃতিচারণা-
হঠাৎ করেই ফিরে পাওয়া ভুবন

বর্তমান করুণ পরিস্থিতি মাথায় নিয়ে অনেক কিছুই ঘুর-পাক খাচ্ছে। এই বয়সে এসে 'রকম পরিস্থিতির সামনে পড়বো কল্পনাতেও ভাবিনি। হ্যাঁ অনেক হলিউড বা বিদেশী সিনেমায় চোখে পড়েছে সব ভাইরাসের কচকচানি... সেটা যে বাস্তবে হানা দেবে আমি কেন আমার অনেক সিনিয়র মানুষেরাও ভাবেননি। কাজেই সারা বিশ্বজুড়ে লকডাউন। সবাই গৃহবন্দী। তার মধ্যে আমিও আছি। গত দে’ড় মাস আমি আমার বাড়ির সামনে পিচের রাস্তাটা দেখেছি, তাও বাড়ির বারান্দা দিয়ে। যাই হোক, আসি অন্য প্রসঙ্গে, এই দে’ড় তাহলে আমার কিভাবে কাটছে? খেয়ে, বসে, ঘুমিয়ে... আজ্ঞে না মশাইয়েরা... একদমই না... নিয়মিত খোঁজ খবর রাখি, খবর কাগজে, কি টিভি কি মোবাইলে নিউস আপডেটে... কিন্তু মনকে শান্ত রাখতে হবে। বেছে নিলাম কিছু গ্রন্থ, দুটো মাত্র পড়লাম... ঠিক জমে উঠলো না, তারপর ছেলের সাথে গানের লড়াইয়ে নেমে গেলাম। তারপর হলো কি আমার... বেশ কিছু পছন্দের গানও আমি গেয়ে ফেললাম ছেলের টুকটাক ভাইটাল অভিভাবকত্বে। আমি যথারীতি নিজেকে গায়ক ভাবতে লাগলাম এবং ফেসবুকে ফলাও করে পোস্ট করতে লাগলাম... গানের ভুবনে নিজের মনকে পাখির মত ডানায় ঝাপটা দিতে দিতে ভেসে বেড়াতে লাগলাম... কিছু সহৃদয় মানুষজন আমাকে অনুরোধ করতে থাকলেন তাদের পছন্দের গান গুলো শোনাতে... , বাবা! সেই গানগুলোও আমি চর্চা করতে করতে নিমেষে গেয়ে ফেললাম... হ্যাঁ আমি হয়তো প্রকৃত সঙ্গীত শিল্পীর মত গাইছি না, কিন্তু প্রায়ই সফল। আমার ছেলে তো রীতিমত খুশি তার বাবার পারফরম্যান্সে, এমনকি ছেলের মাও... ফেসবুকে যারা আছেন তারা আমার শুধু ফেসবুকের বন্ধু তালিকায় থাকা শুধুমাত্র বন্ধু নন। তারা আমার আপনজন, বন্ধু-বান্ধব, ভাই-বোন-দিদি-দাদা-ছাত্র-ছাত্রী এবং বেশ কিছু শুভাকাঙ্খী মানুষ। সকলে না হলেও বেশ কিছুজনের সাথে এই লকডাউনে আমি যোগাযোগ রেখে চলেছি শুধুমাত্র এই নতুন ভুবনের সৌজন্যে। ভুলে গেছি আমি বর্তমান বিশ্বের এই হাল...  এই গানের ভুবনে কেন যে জড়িয়ে গেছি আমি জানিনা, জীবনে আমি সেভাবে গানের প্রতি ঝুঁকিওনি কোনোদিন... অনেক চিন্তা ভাবনা করে আমি ফিরে যেতে চাই পুরানো সেই দিন গুলিতে, যেখানে এই গানের ভুবন মাঝে মাঝে উঁকি দিয়েছিল বৈকি... সেই নিয়েই আমি আমাদের পদক্ষেপ পত্রিকা পরিবারের ব্লগের দ্বিতীয় সংখ্যার থিম "পুরানো সেই দিনের কথা" তে কিছু লেখার মাধ্যমে ঘুরে আসতে চাই আমার ফেলে আসে কিছু স্মৃতির সরণিতে...

যখন আমি উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী,  
জীবনের বড় পরীক্ষা, আমাদের পরিবারে আমিই প্রথম যে এই পরীক্ষা দেবে... সেই নিয়েই বাড়ির বড়দের টেনশন । আমার একটা খুব বাজে অভ্যেস ছিলো আমি যখন পড়াশোনা করতাম আমার সাথে আমার টেপ রেকর্ডার থাকতো যে বায়োলজির বই বলো, কি ক্যালকুলাসের বই বলো টেপ রেকর্ডারে গান চলতো আর আমি পড়াশোনা করতাম সেই নিয়েই কম অশান্তি হত না বাড়িতে! বিশেষ করে আমার দাদুর সাথে যুদ্ধং দেহি ব্যাপার শোলে সিনেমার বিখ্যাত গান, ‘মেহেবুবামেহেবুবা’… তখন দূরদর্শনে দেখানো হলেই আমি ছুটতাম দেখার জন্যহেলেনের সেই লাস্যময়ী নাচ আর আর ডি বর্মনের সেই সুরের মূর্চ্ছনা, দুর্দান্ত লাগতো আমারবর্মনের সেই স্টাইলের গান আমার মুখে মুখে লেগে থাকতো দাদু সেই শুনে বলতেন, “ওই হবে, পড়াশোনা কিছু হবে না, ছাই হবেমাগীদের ছোট ছোট ড্রেসের নাচ দেখবে আর গান করবে বাবা আসলেই দাদু বাবাকে লাগাতো বাবার ধমক খেতাম বাবাও বুঝতো, ছেলের এই বয়সে এইরকম একটু হবে শুধু কি তাই, জুলি সিনেমা দেখা নিয়ে কত কান্ড, বিশেষ করে সেই গানটা কিশোর কুমারের বিখ্যাত গান, “জুলিআই লাভ ইউ” … ব্যস আমিও জোরে গাইতাম গানটাবাড়ির সকলে এই মারে তো সেই মারে… ‘দেখেছো, ছেলের কান্ড, দেখো কোনো জুলির খপ্পরে পড়েছেকিন্তু সত্যি বলছি, সেই রকম ব্যাপারই নেই, গানের মাদকতাই প্রাণের সঞ্চার এনে দেয়এতো সুন্দর গানের কম্পোজিশন, পাগল না হয়ে পারা যায় বলুন আর বাথরুমে গেলেই তো নিজে কখন যে কিশোর কুমার হয়ে যেতাম নিজেই জানি না... তখন আমার কন্ঠে কি যে জাদু, কোনো মিউজিক ডাইরেকটর যদি দেখতে পেতেন, নিশ্চিত সুযোগ দিতেন। 

এরপর উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে...    
নতুন কলেজ, নতুন নতুন বন্ধু... আবার মেয়ে বন্ধু... বাড়িতে মেয়ে বন্ধু নিয়ে আসা নিয়ে কম সমস্যায় পড়তে হয়েছিলো! মা’কে আমি বোঝালাম, ‘মা, জানো তো... একটা মেয়ে থাকে অমুক পাড়ায়, পড়াশোনায় ভীষণ ভালো... আমার সাথে খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে...”... কি অস্বস্তি নিয়ে মা’কে রাজি করিয়েছিলাম, আজ ভাবলে নিজেরই হাসি পায়। ঠিক সেই সময় একটা সিনেমা আসে ‘রাজু বন গ্যায়া জেন্টলম্যান”... আর কুমার শানু সেই সময় মুম্বাইয়ে সাড়া ফেলে দিয়েছেন। আর আমার ডাক নাম রাজু। সিনেমার হিরো শাহরুখ একটা চশমা পড়েছিল, সেই চশমার স্টাইলেও আমার একটা চশমা ছিল... আর একটা গান ছিলো সিনেমার, “সিনে মে দিল হে, দিল মে হ্যায় ধড়কন... ধড়কন মে হ্যা তুহি তু /// এ মেরি আখরি তমন্না, আই লাভ ইউ”... আমার মুখে মুখে লেগে থাকতো গানটা... ব্যস হয়ে গেলো... সবাই মিলে আমার উপর দারুণ চটে গেলো... তাছাড়াও কুমার শানুর কিছু বিখ্যাত অ্যালবাম “প্রিয়তমা মনে রেখো”, “সুরের রজনীগন্ধা” এবং কিছু বিখ্যাত সিনেমা “আশিকী”, “দিওয়ানা”, বাজিগর”... কুমার শানুর হিট হিট গানগুলো আমার প্রাণের অত্যন্ত প্রিয়... আবার ঠিক সেই সময়ই চলে এলো, সুমন, নচিকেতা এবং অঞ্জন দত্ত’র অ্যালবাম... নচিকেতার নীলাঞ্জনা, অঞ্জন দত্তর ‘বেলা বোস’ যে তখন কতবার বাথরুমে গেয়েছি তার ঠিক নেই... আমার এই গানের পাগলামিতে বাড়িতে অতিষ্ঠ প্রায় সবাই... টেপ রেকর্ডারে জোরে চালিয়ে দিতাম। পাশের বাড়ির মেয়েগুলো জানলা বন্ধ করে দিতভাবতো আমি বুঝি গান চালিয়ে ওদের সাথে ঝাড়ি মারছি। আরেকটা ব্যাপার না বললে যে পুরো লেখাটাই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। বলেই ফেলি, তার জন্য আমার স্ত্রীর কাছে ঠাঙানি খাই তো কুছ পরোয়া নেহি... হয়েছে কি, সেই সময় মানে আমাদের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর গানের মার্কেটে নতুন তারা হিসাবে হাজির হল সোনু নিগম... তার একটা অ্যালবাম ‘দিওয়ানা’ দুর্দান্ত ভাবে হিট করেছিল। সেই অ্যালবামের একটা গান “আব মুঝে রাত দিন, তুমহারা হি খেয়াল হ্যায়”... এই গানটা আমার একেবারে মনের এবং হৃদয়ের কাছাকাছি। সেই সময় আমার একটা মেয়েকে ভালো লেগে যায়। তার সাথে বন্ধুত্বও হয়। তার জন্মদিনে আমি তাকে এই ‘দিওয়ানা’ ক্যাসেটটা গিফট করি। কেন গিফট করি, সেই মেয়েটি না বুঝলেও আমি তো জানি কেন আমি গিফট করেছিলাম... তাকে ভেবে আমি এই গানটা কতবার যে গেয়েছি তা গোনা হয়নি। সেই গানের সুর আমাকে এতো মোহিত করেছিল যে আজও আমি গানটা গাইতে পারবো। এবং বেশ কিছুদিন আগে এই লকডাউনের মার্কেটে গেয়েছি এবং ফেবুতে ভিডিও আপলোড করেছি। আমার গান শুনে বেশ কয়েকজন প্রশংসাও করেছেন।  

এরপর কলেজের ক্লাস রুমে টেবিল বাজিয়ে গান ...
এই সময় বলা যেতে পারে আমার গোল্ডেন টাইম। আমরা মানে আমি এবং আমার বেশ কিছু হুজুগে বন্ধু বান্ধব হয়েছিল যারা বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশনের পলিটেকনিক কলেজে প্রথম বর্ষ থেকেই কলেজে টেবিল পিটিয়ে গায়কদের দল হয়ে গিয়েছিলাম। টিফিন হলেই আমরা ক’জন মিলে গানের আসর জমে যেতকেউ শানু কন্ঠ, কেউ নচি কন্ঠ আবার কেউ কিশোর কন্ঠআমি মেকানিক্যাল শাখার ছাত্র ছিলাম। আমাদের ক্লাস রুম টিফিন টাইমে মিউজিক রুমে পরিবর্তন হয়ে যেতঅন্যান্য শাখার ছাত্ররাও আমাদের গান শোনবার জন্য চলে আসতযখন কোনো ক্লাস হত না, মানে কোনো প্রফেসর হয়তো কোনোদিন এল না, সেদিন তো পুরো মোচ্ছব হতমাঝে মাঝে প্রফেসর এবং ফ্যাকাল্টিরা এসে আমাদের শাসিয়ে যেতেন। এমনকি প্রিন্সিপ্যাল মহারাজের কাছেও রিপোর্ট যেতএকদিন তো প্রিন্সিপ্যাল আমাদের ক্লাসকেই সাসপেন্ড করে দিলেন। তারপর থেকে ক্লাসে কার্যত গান করা বন্ধ। এই গান গাওয়া নিয়ে একটা মজার ঘটনা মনে পড়ে গেলআমাদের কলেজের কাছেই একটা বই-খাতা-পেনের দোকান ছিলসেই দোকানের মালিক ভীষণ রকম চিটিংবাজ লোক ছিলসেই লোকের কলেজের সাথে কন্ট্যাক্ট ছিল, কলেজের বই বা ছাত্রদের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন সামগ্রী বিক্রি করতবেশি দাম নেওয়ার জন্য প্রায়ই ছাত্রদের সাথে সেই চিটিংবাজ মালিকের ঝামেলা লেগেই থাকত। যার ফলে আমাদের ভীষণ রাগ ছিল সেই পাবলিকের ওপর। সেই বিচিত্র পাবলিকের স্ত্রী বেশ মোটা ছিলএকটা গান ছিলো অমিতাভ বচ্চনের লাওয়ারিশ সিনেমার কিশোর কুমারের গান “জিসকা বিবি মোটি উসকা ভি বড়া নাম হ্যায়”। আমরা কলেজের মাঠে একসাথে প্রায় জনা দ’শেক ছেলে ছিলাম। দূর থেকে সেই চিটিংবাজ লোকটাকে আসতে দেখেই গান ধরলাম লোকটার নামে “জিসকা বিবি মোটি উসকা ভি বড়া নাম হ্যায়”। ব্যস! সঙ্গে সঙ্গেই সেই পাবলিক ভীষন রকম রেগে গেলো। আমাদের মারতে আসার উপক্রম। আমাদের বন্ধুদের একজন সেই পাবলিককে ধরে ঠেলে ফেলে দেয়। তারপর সবাই সেখান থেকে পালিয়ে যায়। লোকটা প্রিন্সিপ্যালকে অভিযোগ করে। কিন্তু প্রয়োজনীয় প্রমাণের অভাবে আমরা সকলে সে যাত্রায় বেঁচে যাই।   
এছাড়াও কলেজ ছুটি হলে আমরা বেলুড় থেকে হাওড়া ট্রেনেই ফিরতাম। একসাথে দঙ্গল মিলে আমরা হৈ হৈ করে কোনো ট্রেনের কামরায় উঠতাম এবং গান করতাম। আমাদের মিলিত গান কামরার লোকজন সবাই চুপ করে শুনতো। আমরা, কলেজের ছাত্ররা যে কামরায় উঠতাম, একসাথে উঠতাম, যার ফলে সেই কামরার বাকিরা কেউ কিছু বলার সাহস পেত না। কোনোদিন অপ্রীতিকর ঘটনা যদিও ঘটেনি।   

সেই দিনগুলোর কথা ভেবে মনটা আজ বড়ই অশান্ত। ভাবছি, কি দিন ছিল তখন। হাতে কোনো মোবাইল ছিল না, কোনো ল্যাপটপ ছিল নাছিল না কোনো ইলেকট্রনিক্স সরঞ্জাম। নেহাতই সাদামাটা জীবন ছিল। কোনো জটিলতাও ছিল না। একটা ভরপুর আনন্দ ছিলসুন্দর ভাবে উপভোগ করেছিলাম আমরা জীবনটাকে।  কিন্তু এখন এই পরিস্থিতিতে আমাদের ছেলেরা কিভাবে দিন কাটাচ্ছে ভাবলেই যেন মনটা অজানা আতঙ্কে শিউড়ে উঠছে। কিন্তু জীবন চলতে থাকবে। কোথায় গিয়ে থামবে কেউ জানেনা। আজকের এই কঠিন পরিস্থিতি আমরা কিভাবে কাটিয়ে উঠবো, জানা নেই। আজ শুধু আমরা মানে হাওড়াবাসী, তথা পশ্চিমবঙ্গবাসী তথা দেশবাসী তথা বিশ্ববাসী মনে অসংখ্য ভয় নিয়ে ঘরবন্দী। মনে একরাশ আশা নিয়ে আমরা অপেক্ষায় থাকি নতুন সূর্যের আলোয় পৃথিবী আবার নতুন করে বাঁচবে। আবার নতুন করে পৃথিবীর মানুষেরা যে যার কাজকর্মে লিপ্ত হবে। সৃষ্টিশীল মন নিয়ে নতুন করে বাঁচতে শিখবে। সর্বোপরি আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম নতুন করে গড়ে তুলবে তাদের নতুন সমাজ, নতুন জগত।