Monday, May 4, 2020

নন্দিনী পাল



নিবন্ধ -        
শ্রীরামপুর ও তার রাজবাড়ির ইতিহাস

নদীর ধার দিয়ে হেঁটে চলেছি। রাস্তার দুধারে বাড়িগুলো ইতিহাসের হলুদ পাতার ভঙ্গু্রতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে। আজ তারা আমার সামনে মেলে ধরবে তাদের না বলা ইতিহাস। যার খোঁজ কেউ রাখে না। সামনে ঐ কল্লোলিনী নদীবক্ষে ভাসমান ভেলা, কত ইতিহাসের সাক্ষী। এসেছে মোঘল,এসেছে পাঠান,তুর্কী। এসেছে ফরাসী,ডাচ,ব্রিটীশ। গড়ে উঠেছে এই জনপদ। তার মাটিতে লেগে থাকা সেই শতাব্দী প্রাচীন ইতিহাসের খোঁজে আমি নিভৃতে হেঁটে চলেছি পথ ধরে। গঙ্গার তীরে এসে দাঁড়ালাম আমার কত দিনের চেনা শ্রীরামপুরের রাজবাড়ি। কত জীর্নতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে। কতবার চলেছি এই পথ ধরে। যেন কোন রহস্যময়ী নারী, গাছগাছড়ার আড়াল থেকে হাতছানি দিয়ে ডেকেছে। সাবেকি বড়বড় খিলান, অলিন্দের গহ্বরে জমে থাকা আলো আঁধারিতে বলতে চেয়েছে তার না বলা কথা।     
 এর ইতিহাস জানার আগে জেনে নিতে হবে এ শহরের ইতিহাস। মুগল আমলের বহু আগে থেকেই সরস্বতী ও হুগলি নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলটি ছিল এই বর্ধিষ্ণু জনপদ। পনেরো শতকে লেখা বিপ্রদাস পিপিলাই-এর মনসামঙ্গল কাব্যে আকনা ও মাহেশ নামের উল্লেখ রয়েছে। শ্রী চৈতন্যের সমকালীন পুঁথিতে এই দুটি নাম ছাড়াও চাতরার উল্লেখ পাওয়া যায়। আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে রাজা  মানসিংহের পূর্ব-ভারতে আগমন (১৫৮৯-৯০ খ্রি) এবং শ্রীপুরে শিবির স্থাপনের বৃত্তান্ত থেকে এবং আবদুল হামিদ লাহোরির বাদশাহনামায় শ্রীপুরকে শ্রীরামপুর নামে চিহ্নিতকরণ থেকেও অনুমান করা যায় যে, মুগল আমলের আগে থেকেই উল্লিখিত স্থানগুলির প্রসিদ্ধি ছিল। পনেরো শতকে চৈতন্যের বৈষ্ণববাদের প্রভাবে এখানকার কয়েকটি স্থান হিন্দুদের তীর্থকেন্দ্র হয়ে ওঠে। শেওড়াফুলির রাজা মনোহরচন্দ্র রায় ১৭৫২ সালে শ্রীপুরে রামসীতার মন্দির স্থাপন করার পর তাঁর পুত্র রামচন্দ্র দেবসেবার জন্য শ্রীপুর, গোপীনাথপুর ও মনোহরপুর নামক ৩টি মৌজা গাঙ্গুলীদের নামে দেবোত্তর করে দেন। এভাবে শ্রীপুর’, ‘শ্রীরামইত্যাদি নাম থেকে শ্রীরামপুরনামটির উৎপত্তি হয়ে থাকতে পারে।
 তবে এই জনপদটির নগরায়ণ শুরু হয় দিনেমারদের ভূমি অধিগ্রহণের মধ্য দিয়ে। দিনেমার কোম্পানি আঠারো শতকের মাঝামাঝিতে দক্ষিণ ভারতের ট্যাঙ্কোবার কুঠি থেকে সোয়েটম্যান নামে একজন প্রতিনিধিকে বাংলার নওয়াবের কাছে প্রেরণ করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বাংলায় বাণিজ্য করার অধিকার সম্পর্কিত ফরমান লাভ। নওয়াব আলীবর্দী খানকে নগদ ৫০ হাজার মুদ্রা ও প্রচুর উপঢৌকন প্রদানের বিনিময়ে সোয়েটম্যান বাণিজ্য করার ফরমান লাভ করেন। ১৭৫৫ সালে সোয়েটম্যান এক লক্ষ আশি হাজার টাকায় শ্রীপুরে তিন বিঘা ও আকনায় সাতান্ন বিঘা জমি কিনে কুঠি-বন্দর স্থাপন করেন। এরপরই দিনেমারগণ শ্রীরামপুর, আকনা ও পিয়ারাপুর মহল বার্ষিক ১৬০১ টাকা খাজনায় শেওড়াফুলির জমিদারের কাছ থেকে অধিগ্রহণ করে। এইভাবে মোট ১৬৮০ বিঘা জমি সংগ্রহ করে তাদের কারখানাকে খড়ের ছাউনি দেওয়া একটি বিশাল মাটির পাঁচিল দিয়ে ঘিরে দেয়। উত্তর সীমানা বরাবর পিয়ারাপুর অবধি খাল খনন করে। ডেনমার্কের পঞ্চম ফ্রেডারিকের নাম অনুসারে সদ্য কেনা জায়গার নাম দেন ফ্রেডরিক্সনগর। এভাবে শ্রীরামপুরে দিনেমার কুঠির পত্তন হয়। ১৭৭৬ সালে কর্নেল ওলেবাই প্রশাসক হিসেবে শ্রীরামপুরের দায়িত্বভার গ্রহণের পর তাঁর দূরদর্শিতা, দক্ষ পরিচালনা ও কূটবুদ্ধি দিনেমার ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রভূত উন্নতি ঘটায়।
আঠারো শতকের শেষের দিকে বর্ধমানের পাটুলী থেকে হরিনারায়ণ এবং রামনারায়ণ গোস্বামী নামে দুই সহোদর তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় হাজির হন শ্রীরামপুরে। হরিনারায়ণ দিনেমার কোম্পানির অধীনে চাকরি নেন এবং রামনারায়ণ শুরু করেন মহাজনি ব্যবসা। এতে খুব কম সময়ের মধ্যেই এই দুই গোস্বামী প্রচুর অর্থ উপার্জন করে বিশাল ভূ-সম্পত্তির মালিক হন। তারা শ্রীরামপুরের পশ্চিমাঞ্চলে নিজেদের আত্মীয়-স্বজন সমন্বয়ে একটি অভিজাত পল্লী স্থাপন করেন।
গত সাত পুরুষ যাবৎ শ্রীরামপুরে বসবাসকারী এই গোস্বামী পরিবারের ইতিহাস সন্ধান করতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে বর্ধমান জেলায় ভাগীরথীর পশ্চিম তীরের পাটুলি গ্রামে। অষ্টাদশ শতকের চল্লিশের দশকের কথা। বাঙলার নবাব তখন আলিবর্দী খাঁ। এই সময়ে পাটুলিতে বাস করতেন গৌড়ীয় বৈষ্ণব সাহিত্য ও চৈতন্য দর্শনের বিখ্যাত শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত শ্রী লক্ষ্মণ চক্রবর্তী। লক্ষ্মণ চক্রবর্তীর বিবাহ হয় নদীয়ার শান্তিপুরের গোস্বামী বংশীয় দ্বিগ্বিজয়ী পণ্ডিত ভীম তর্কপঞ্চাননের কন্যার সাথে। ভীম তর্কপঞ্চানন ছিলেন শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর পার্ষদ শ্রী আচার্য অদ্বৈত গোস্বামীর বংশধর। পরবর্তীকালে লক্ষ্মণ চক্রবর্তীর পুত্র রামগোবিন্দ তাঁর মাতামহের কাছে বড় হন, সেখানেই ভাগবত শাস্ত্রে দীক্ষিত হন, এবং আরও পরে শিষ্যদের দীক্ষা দান করে গোস্বামীপদবী গ্রহণ করেন।
শোনা যায়, একবার রামগোবিন্দ গোস্বামী তাঁর গর্ভবতী স্ত্রীকে নিয়ে নৌকা করে শান্তিপুর থেকে কোলকাতার দিকে যাচ্ছিলেন। নৌকা শ্রীরামপুরের কাছে এলে রামগোবিন্দর স্ত্রীর প্রসববেদনা উপস্থিত হয়। নৌকা তীরে ভেড়ানো হলে রামগোবিন্দর স্ত্রী এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। এই সময়ে শ্রীরামপুর ছিল শেওড়াফুলির রাজাদের অধীনে এবং ঘটনাচক্রে শেওড়াফুলি ছিল পাটুলির রাজাদের কাছারি বাড়ি। শেওড়াফুলি রাজা দানধ্যানের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তাঁর রাজত্বে পরমভাগবত শ্রী রামগোবিন্দ গোস্বামীর পুত্রসন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে শুনে তৎকালীন রাজা মনোহর রায় ঐ সম্পত্তি রামগোবিন্দকে দান করতে উদ্যত হন। ব্রাহ্মণ রামগোবিন্দ সেই দান গ্রহণ করতে অস্বীকার করলে একটি কড়ির বিনিময়ে সেই সম্পত্তি শেওড়াফুলি রাজের থেকে কিনে নেন। এভাবেই পাটুলির লক্ষ্মণ চক্রবর্তীর পরিবার ভাগ্যচক্রে এসে উপস্থিত হল শ্রীরামপুরে। রামগোবিন্দ গোস্বামীর দুই পুত্র রামগোপাল এবং রাধাকান্ত। রাধাকান্তর তৃতীয় পুত্র রামনারায়ণ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আসাম প্রদেশের দেওয়ান ছিলেন। শোনা যায়, গৌরীপুর, বিজনী, বসরীপাড়া প্রভৃতি জায়গার জমিদারদের সনন্দে রামনারায়ণের দস্তখত ছিল। রাধাকান্তর কনিষ্ঠ পুত্র তিনি আরও বেশ কিছু জমিদারি সম্পত্তি ক্রয় করেন এবং গোস্বামীদের গৃহদেবতা শ্রীশ্রী রাধামাধব জীউ-এর প্রতিষ্ঠা হয় এবং রাসমঞ্চ ও স্ত্রীপুরুষের পৃথক স্নানঘাট ইত্যাদি নির্মিত হয়।
রামনারায়ণের পুত্র রাজীবলোচন বর্ধমানে সমুদ্রগড়ের দেওয়ানি পদে অধিষ্ঠিত থেকে বহু অর্থ ও প্রতিপত্তি অর্জন করেন। কলকাতার অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যে রাজীবলোচনের বিশেষ সমাদর ছিল। অন্যদিকে হরিনারায়ণের পুত্র রঘুরাম কলকাতার বিখ্যাত জন পামার কোম্পানির অধীনে মুৎসুদ্দির কাজ করে বিপুল অর্থ উপার্জন করেন। হরিনারায়ণ অষ্টাদশ শতকের সত্তরের দশকে শ্রীরামপুরে ড্যানিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে দেওয়ানের কাজ করতেন।রঘুরাম গোস্বামী এত বিপুল পরিমাণ অর্থের মালিক হয়েছিলেন যে ১৮৪৫ সালে ড্যানিশ সরকার শ্রীরামপুরের উপনিবেশ বিক্রি করে দিতে চাইলে রঘুরাম বারো লক্ষ টাকার বিনিময়ে তা কিনে নিতে চেয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রঘুরামের দেওয়া মূল্য থেকে এক লক্ষ টাকা বেশী দিয়ে তেরো লক্ষ টাকায় ড্যানিশদের থেকে শ্রীরামপুর কিনে নেয়। বর্তমানে শ্রীরামপুরের গোস্বামী পরিবারের আর্থিক প্রতিপত্তির মূল স্থপতি রঘুরাম গোস্বামী। তিনি তাঁর পৈতৃক ভদ্রাসনের কাছেই নিজের একটি প্রাসাদ নির্মাণ করেন।রঘুরাম গোস্বামীর পৌত্র কিশোরীলালরায় বাহাদুরউপাধি প্রাপ্ত হন এবং পরবর্তীকালে বাঙ্গালা গভর্নরের শাসনপরিষদের সদস্য হয়ে রাজাউপাধি লাভ করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তিনিই বাঙ্গালা শাসনপরিষদের প্রথম ভারতীয় সদস্য। তিনি রাজাউপাধি লাভ করার পর থেকেই রঘুরাম নির্মিত প্রাসাদ এই রাজ বাড়ির সব থেকে বড় ঐতিহ্য এখানকার বেশ কয়েকটি বিশালাকার থাম সহ বড় দালান।তবে আজ আমরা যে এই থাম সহ দালানটি দেখতে পাই, পুর্বে সেটি ছিল না। রাজ বাড়ির ভেতরে চারিদিকে বাসবাস করার ঘর রয়েছে,একটা সময়ে দালানের জায়গায় সেখানে পুকুর ছিল। একদিন সেই পুকুরে স্নান করার সময় ডুবে মারা যান পরিবারের এক সদস্য। এর পরই সেই পুকুর বুঝিয়ে তৈরী হয় বিশালাকার থাম সহ দালান।যা এখনো আকর্ষণীয় চাঁদনী বা নাটমন্দির নামে পরিচিত। নাটমন্দিরের সামনেই রয়েছে মা দুর্গার বেদি সহ পুজো দালান।একটা সময় ছিল ধুম ধাম করে হতো এই রাজবাড়ীর দুর্গাপূজো।  এই শ্রীরামপুর রাজবাড়ি র – North Block , South Block আছে, আলাদা এবং নিজস্ব বিচিত্র স্বম্পন্ন। এই রাজবাড়ি র ভেতরে নাটমন্দির টি প্রকাণ্ড , বিশাল , দেখার মতো, কালের নিয়মে, সেই জৌলুষ
আর নেই। এই চাঁদনী / নাটমন্দির ছিলো water tank মানে বাড়ির নিত্য প্রয়োজনীয় জল এখাণ থেকেই আসতো , প্রকাণ্ড এক জলাধার। এখানে ঠাকুর দালানে metal stand for lights ; দেখলে অবাক হবেন, কাঠের বিম গুলো নেপাল এর শাল কাঠ , প্রাচীন
ইতিহাস এর পাতায় বাংলার এক প্রায় অজানা রাজবাড়ি এবং ইতিহাস এর সাক্ষী।

No comments:

Post a Comment