Monday, May 4, 2020

আবদুস সাত্তার বিশ্বাস



গল্প -   

তাকে ক্ষমা করবেনা
                    
         পাড়ার ক্লাবের মাইকে হঠাৎ 'টুং' করে শব্দ হল।পরাগ অমনি লকডাউনের আগে কুড়ানো কাগজ গুলো ঘ‍রে বসে বাছাই করতে করতে কান খাড়া করে উঠে দাঁড়াল।আর তারপরই ক্লাবের সেক্রেটারি বিক্রমের সেই চেনা গলা দিয়ে বেরিয়ে এল,"একটি বিশেষ ঘোষণা।আমাদের তালবোনা পাড়ার পটল আলি আজ বেলা দশটা সময় শেষ নিঃশ্বাস ত‍্যাগ করেছে।তার সৎকারের যাবতীয় ব‍্যবস্থা চলছে।দুপুর পরে তার সৎকার শুরু হবে। আপনারা দুপুর পরে যে যেখানে থাকেন গোরস্থানে চলে আসবেন।"
         বিশেষ ঘোষণাটা শোনার পর পরাগ ফিক করে হেসে ফেলল,"ওয়াক থু!শালা এতদিনে মরল!"ও সঙ্গে সঙ্গে তার একটা কথা মনে পড়ে গেল যে,এর জন্যই সেদিন তার মাস্টারের চাকরিটা হয়নি।চাকরিটা হলে আজ তার কত সুখ!সারাবছর লকডাউন চললেও তাকে অন্নের চিন্তা করতে হত না।ঘরে বসে পাখার তলায় স্ত্রীর সঙ্গে খোশগল্প করে দিব্যি দিন কাটিয়ে দিতে পারত।একটা ফুটপাতের পাগলের মতো তার  জীবন আজ অতিবাহিত হত না।আবর্জনার স্তূপে স্তূপে কাগজ কুড়িয়ে বিক্রি করে পয়সা রোজগার করতে হত না।সমাজের মানুষের কাছে ঠিকই দাম পেত।ঠিকই মান পেত।বিত্তশালীদের মুখে,"শালা একটা কাগজ কুড়ানে পাগল!"গালিটা শুনতে হত না।
         কেননা আজ থেকে সেটা বিশ ত্রিশ বছর আগের কথা।পরাগ তখন এম.এ.পাশ করে বাড়িতে বসেছিল।কোন স্কুলে তার একটা চাকরি হয়েছিল না।বিভিন্ন স্কুল থেকে ইন্টাভিউয়ের ডাক পেলেও কোন স্কুল তাকে একটা চাকরি দিয়ে সন্তুষ্ট করতে পেরেছিল না।এদিকে চাকরির স্বপ্ন দেখতে দেখতে তার এজ প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল।থাকা বলতে হাতে তার আর একটা বছর সময় ছিল।এই সময় সে একটা স্কুল থেকে আরেকটা ইন্টারভিউয়ের ডাক পেয়েছিল। ইন্টারভিউ বোর্ড তাকে বিষয় ভিত্তিক কোন প্রশ্ন না করে তাকে শুধু জিজ্ঞেস করেছিল, "আপনি কি পার্টি করেন?"
         পরাগ কোন পার্টি করত না।কিন্তু ভোট এলে ভোট দিত।ভোট দেওয়া গণতান্ত্রিক অধিকার। সুতরাং সে ভোট দিত।বিভিন্ন প্রতীকের প্রার্থীদের বিচার করে তার বিচারে যে প্রার্থী জনগণের কাজ করবে বলে মনে হত তাকেই ভোট দিত।অর্থাৎ কোন পার্টির সে নিশ্চিত লোক ছিল না।তবু সে চাকরি পাওয়ার আশায় রাজ‍্যের শাসনভার তখন যে পার্টির ঘাড়ে ছিল সেই পার্টির নাম করেছিল। সেই পার্টির নাম করায় সেক্রেটারি সাহেব তার পিঠ চাপড়ে দিয়ে তাকে বাহবা দিয়েছিল,"সাবাস!" তারপর বলেছিল,"আপনার চাকরি হয়ে গেছে।আপনি শুধু আগামীকাল হোক অথবা পরশু হোক বা তারপরের দিন হোক পার্টির একটা চিঠি নিয়ে চলে আসবেন।ব‍্যস,সেদিনই আপনাকে চাকরিতে জয়েন করে নেওয়া হবে।"
        পরাগের আগে শোনা ছিল পার্টির কোন খোদ লোক ছাড়া পার্টির এই ধরনের চিঠি কেউ পায়না।তবু সে কমরেড রাজুকে ধরেছিল,"রাজু,তোমাকে আমার একটা উপকার করে দিতে হবে ভাই।"
        রাজু জিজ্ঞেস করেছিল,"কি উপকার?"
        পরাগ বলেছিল,"আমাকে পার্টির একটা চিঠি নিয়ে দিতে হবে।"
        "কি চিঠি?"
        "একটা স্কুলে আজ একটা ইন্টারভিউ দিয়ে এলাম।স্কুলের সেক্রেটারি পার্টির একটা চিঠি নিয়ে যেতে বলেছে।তাহলে আমার চাকরিটা হয়ে যাবে। তুমি আমার এই উপকারটা করে দাও।"
        রাজু হিন্দুর ছেলে।আর পরাগ মুসলিমের ছেলে।সুতরাং পরাগ ভেবেছিল,রাজু তাকে নিরাশ করে হয়ত ফিরিয়ে দেবে।পাত্তা দেবেনা।কিন্তু রাজু তাকে সেদিন নিরাশ করেছিল না।বরং জানতে চেয়েছিল,"কবে লাগবে?"
        "কাল পরশুর মধ্যে পেলেই হবে।"পরাগ বলেছিল।
        "ঠিক আছে,হয়ে যাবে।তুমি কাল একবার আসতে পারবে?"
        "কোথায়?তোমার বাড়ি তো?"
        "না।"
        "কোথায় তাহলে?"
        "পার্টি অফিস।"
        "কাল কখন বলো?"
        "দুপুর একটা দেড়টায়।আসতে পারবে?"
         "হ‍্যাঁ,পারবো।"পরাগ বলেছিল,"তুমি থাকবে তো?"
         "থাকবো।আমি আগে চলে যাবো।তুমি পরে এসো।"
          "কেন,দু-জনে একসঙ্গে যাবো?"
          "একসঙ্গে গেলে অসুবিধা আছে।" বলে রাজু বলেছিল,"তোমার এই চাকরি চিঠির বিষয়টা আমি ছাড়া গ্রামে আর কে কে জানে?"
          "আর কেউ জানেনা।শুধু তুমি ছাড়া।"
          "তাহলে আর কাউকে জানাতেও যেও না যেন।ভুল করেও না।তাহলে তোমার কাজটা আর হবেনা।"
          "ঠিক আছে,জানাব না।"পরাগ বলেছিল।
          এরপর সে পরের দিন পার্টি অফিস গিয়েছিল।গিয়ে দেখেছিল,দরজার দিকে পিছন করে সামনের টেবিলের উপর হাত রেখে  ছেলেমানুষ করে এক ব‍্যক্তি চেয়ারে বসে রয়েছে। আর টেবিলের ওপারে দরজা সোজা মুখ করে এক প্রবীণ ব‍্যক্তি বসে রয়েছে।তার সঙ্গে সে খুব নিচু গলায় কথা বলছে।বাজে লোক কেউ নেই। অবাঞ্ছিত লোক পরাগকে দেখতে পেয়ে সেই প্রবীণ ব‍্যক্তিটি তখন বলেছিল,"কাকে চায়?"
         পরাগ সরাসরি বলেছিল,"রাজুকে।"
         ছেলেমানুষ করে সেই ব‍্যক্তি অমনি পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে বলেছিল,"পরাগ?"
         "হ‍্যাঁ।"
         "সাগরদার সঙ্গে তোমার ব‍্যাপারেই কথা বলছি।"
         পরাগ বলেছিল,"পিছন দেখে আমি তোমাকে চিনতে পারিনি।"
         "ও রকম হয়।বসো।"
         রাজুর বাম পাশের একটা চেয়ারে পরাগ বসেছিল।রাজু তখন সেই প্রবীণ ব‍্যক্তিটির উদ্দেশ্যে বলেছিল,"সাগরদা,এতক্ষণ ধরে আপনাকে এই ছেলেটার কথাই বলছিলাম।এই ছেলেটার একটা চিঠি খুব দরকার।আপনি একে একটা চিঠি লিখে দিন!"
         সেই প্রবীণ ব‍্যক্তিটি তখন পরাগকে বলেছিল,"চিঠি আপনার কবে লাগবে?"
         পরাগ বলেছিল,"আজ পেলে খুবই ভালো হয়।কাল তাহলে স্কুলে গিয়ে চিঠিটা সো করতে পারতাম ।"
        "কিন্তু আজ যে হবেনা।"
        "না সাগরদা,আজকেই করে দিন!"রাজু সেদিনই করে দেওয়ার জন্য সুপারিশ করেছিল।
          সাগরদা তখন বলেছিল,"এই ধরনের চিঠি সঙ্গে সঙ্গে হয়না।পরের দিন নিতে হয়।"
          রাজু বলেছিল,"পরের দিন এলে পাবো তো?আবার পরের দিন বলে ফিরিয়ে দিবেন না তো?"
          "না না,এসে নিয়ে যেও।"তারপর সাগরদা বলেছিল,"আসলে সিস্টেম বলে একটা জিনিস আছে তো।"
         "ঠিক আছে,আমরা তাহলে কালকেই আসব।"
          "আচ্ছা,এসো।"
         পার্টি অফিস থেকে বেরিয়ে তারা এবার দু-জনে গল্প করতে করতে ধীর পায়ে সাইকেল চালিয়ে নদীর ধার ধরে বাড়ি চলে আসছিল। আসতে আসতে নদীর ধারে তারা পটল আলির সামনে পড়ে গিয়েছিল।গেলে পরে পটল আলি রাজুকে বলেছিল,"কি ব‍্যাপার রাজু,পরাগকে নিয়ে পার্টি অফিস গিয়েছিলে নাকি?"
          "কই,না তো।"
          পটল আলি এবার হেসে ফেলেছিল,"আমাকে গোপন করছ?ভাবছ,আমি কিছুই জানিনা না?আমি তোমাদের সব কথা জানি।"
          "কি সব কথা জানেন?"
          "তোমরা কোথায় গিয়েছিলে।এবং কেন গিয়েছিলে?"
         "কোথায় গিয়েছিলাম?"
         "পার্টি অফিস গিয়েছিলে।"
         "হল না।"
         "তুমি হল না বললে হবে?পরাগ কাল একটা স্কুলে ইন্টারভিউ দিয়ে এসেছে।স্কুলের সেক্রেটারি সাহেব পার্টির একটা চিঠি নিয়ে যেতে বলেছে। তাহলে তার চাকরিটা হয়ে যাবে।পরাগ আর তুমি সেই চিঠির জন‍্যই পার্টি অফিস গিয়েছিলে।"
        শুনে রাজু অবাক হয়ে পরাগের সঙ্গে মুখ তাকাতাকি করেছিল।পরাগও অবাক হয়েছিল,এ কি!পটল আলি এসব জানল কি করে!তারপর রাজু তাকে জিজ্ঞেস করেছিল,"আশ্চর্য!আপনি এসব জানলেন কিভাবে?"
          পটল আলি বলেছিল,"তোমরা চলো ডালে ডালে আর আমি চলি পাতায় পাতায়, বুঝলে?" বলে বলেছিল,"কাল সন্ধ্যা বেলায় আমি তোমাদের সব কথা শুনেছি।"
          রাজু জিজ্ঞেস করেছিল,"কিভাবে শুনেছেন?"
          "যেভাবে শুনি আমি শুনেছি।তোমাদের তা বলব কেন?"
          রাজু-পরাগ তখন অনুমান করে নিয়েছিল যে,নিশ্চয় পটল আলি কাল সন্ধ্যা বেলায় রাজুর বাড়ি গিয়েছিল।গিয়ে পরাগের কথা শুনতে পেয়ে রাজুর সঙ্গে সে আর দেখা করেনি।চুপি চুপি দাঁড়িয়ে তাদের শুধু কথা শুনেছে।...এবং এটাই যে সত‍্যি সেটা ধরে নিয়ে রাজু পরে বলেছিল,"আপনি একটা কঠিন লোক আছেন তো দেখছি।"
          আনন্দে হাসতে হাসতে তখন পটল আলি বলেছিল,"এমনি না বুঝলে?কঠিন লোক আছি বলেই উপর মহলের সমস্ত নেতা আমাকে চেনে।"
          রাজু তখন বলেছিল,"যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে।আপনি আর বিষয়টা নিয়ে বেশি হাইলাইট করেন না।বিষয়টা আমাদের মধ্যেই চাপা থাক।পরাগ চিঠিটা পেয়ে যাক।চাকরিটা হয়ে যাক।তখন জানাজানি হলে ক্ষতি নেই।"
        কিন্তু পটল আলি শুনেছিল না।সে বলেছিল,"কক্ষনো না।এটা চরম অন‍্যায়।এতবড় অন‍্যায় আমি করব না।"
        রাজু তখন তার সাইকেল থেকে নেমে পটল আলির কাছে গিয়ে তার হাত দুটো চেপে ধরেছিল,"আপনি আমার কথাটা শুনুন!পরাগ তো আপনাদেরই ছেলে।সুতরাং এ ক্ষেত্রে আপনার বিরোধিতা করা কি ঠিক হবে?"
          "সেটা আমি বুঝবো।বয়সে আমার থেকে তুমি বড় নও,তোমার থেকে বয়সে আমি বড়। সুতরাং তোমার থেকে জ্ঞান আমার ভালোই আছে।পার্টি অফিসে গিয়ে এক্ষুনি আমি সাগরদার সঙ্গে ঝামেলা লাগাব।পার্টির যারা লোক নয় পার্টির চিঠি তারা পায় কি করে?তাই জিজ্ঞেস করবো।"
         পরাগও তার সাইকেল থেকে নেমে ছুটে গিয়েছিল,"না চাচা,আপনার হাতে পায়ে ধরছি। আপনি----।"
          কিসে কি!কারো কথাই সে শুনেছিল না। পার্টি অফিসে গিয়ে সে যেটা করবে বলেছিল করেছিল।পার্টির সেই চিঠিটা তারপর তার আর পাওয়া হয়নি।
         অতএব পটল আলির মৃত্যুর দিনে পরাগ আজ তাকে জাহান্নামের কঠিন আগুনে পুড়ুক বলে শুধু অভিশাপই দেবে না।তার সৎকারে অংশগ্রহণও করবেনা।তাকে ক্ষমা করবেনা।

No comments:

Post a Comment