Monday, May 4, 2020

সৌমি মুখার্জি



গল্প-   

স্মৃতি

আজ ৪-ঠা বৈশাখ,দশ দিন হলো বাড়ি ফেরা হয়নি। কি করেই বা যাবো, যদি বাচ্চাটার সংক্রামন হয়ে যায় ?
ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না। সাময়িক ভাবনায় আচ্ছন্ন ছিলাম, নার্সের ডাকে চেতনা ফিরে পেলাম। নিজের কেবিন থেকে বেরিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে টিফিন করতে গেলাম। খাবার খেতে যেতে সময়ই পাওয়া যায়না আজকাল,প্রতিটি ওয়ার্ড ভর্তি কোনো বেড খালি নেই। এই মহামারি আর কতদিন থাকবে আর কতো পরিবার শেষ করবে  কেউ জানে না। তাও বিধাতার লেখা বদলানো যায়না মেনে চলতেই হবে। সব ভুলে চা-টোস্ট খেয়ে কেবিনে ফিরলাম। সবার রিপোর্ট দেখতে শুরু করবো ঠিক তখনই হঠাৎ দেখি মনি দিদি এই হাসপাতালের মেট্রন হাঁপাতে হাঁপাতে আমার চেম্বারে প্রবেশ করে বলে,
' অনুপম তাড়াতাড়ি ২৩ নম্বর রুমে চলো একজন নতুন রুগি ভর্তি হয়েছে,পরীক্ষা করে দেখা গেছে তার ক্যান্সারের শেষ পর্যায়।'
আমি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,' সে কি? আরো একজন!কি নাম তার?'
দিদি উত্তর দিলো,' আকাশ দত্ত নাম ওনার।'
নামটা আমার জানিনা কেন খুব চেনা লাগলো, কোথাও যেন শুনেছি এই নাম। সময় নষ্ট না করে তার সাক্ষাতে গেলাম আর প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু করলাম।তার বাড়ির কোনো লোকজন এসেছে কিনা খোঁজ নিতে গিয়ে জানতে পারলাম তার স্ত্রী এসেছে। স্বাভাবিক ভাবেই আমি ওয়ার্ড বয়কে দিয়ে তার স্ত্রীকে আমার কেবিনে আসতে বলে পাঠালাম।
ফিরে আমার অসম্পূর্ণ কাজ গুলো করতে বসলাম।
কিছুক্ষণ পর একজন আমার দরজায় দাঁড়িয়ে বলে,
' ডাক্তারবাবু, আসতে পারি?'
সেই গলা শুনে আমি থমকে যাই, আজ আট বছর পর সেই খুব চেনা গলার স্বর পেয়ে উপরে তাকালাম।
' স্মৃতি! তুমি? ' কিছুক্ষণ দুজনে তাকিয়ে রইলাম। কিছু পল্টাইনি সেই হরিণীর মতো চোখ, শ্বেত পল্লবের মতো গায়ের রঙ, কালো ঘন চুল আজও খোঁপা করা। সত্যি কিছুই বদলায়নি, এতো আমার সেই স্মৃতি! না। আমার না এখন অন্য কারোর ' স্মৃতি '। চোখ আমার অনেক কিছুই বলতে চাইলো কিন্তু কিছুই বলতে পারলাম না।
স্মৃতি বলে উঠলো,' অনু, ভালো আছিস?'
এই নাম শুনে হৃদয়ের সেই পুরনো ব্যাথা আমার জেগে উঠল। এই নামে একজনই তো ডাকতো আমায় বরাবর।
আমি উত্তর দিলাম,' তুই এখানে কি করছিস?সব ঠিক আছে তো?'
ও বলে উঠলো,' আকাশের ক্যান্সারের শেষ পর্যায়।'
আমি কিছু বলতে না পেরে বসে পড়লাম। শুধু এটুকুই বলে উঠলাম,' কেন? তুই কেন?'
স্মৃতি বলে,' অনু, বাঁচিয়ে নে। সব তোর হাতে তুই পারবি। প্লিজ সব ঠিক করে দে।'
কথোপকথন চলাকালীন মনি দিদি ছুটে এসে বললো,
' অনুপম,২ নঃ এর রুগি!'
আমি ভয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,' রুগি কি দিদি?বলো?'
মনি দিদি দুঃখে বললো,' মারা গেলো। কিছু করতে পারলাম না।'
কথাটা শুনে আমি আগে স্মৃতির দিকে তাকালাম, ও যেন কথাটা শুনে পাথর হয়ে গেল। আমি ওকে এই অবস্থায় দেখতে না পেরে বেরিয়ে গেলাম।কি করবো কিছু বুঝতে পারছিলাম না, জীবনে এতো অসহায় নিজেকে কখনো মনে হয়নি। এতো বছর পর আমার সেই স্মৃতি আমার কাছে কিছু চাইলো আমি সেটা দিতে পারলাম না। চোখের সামনে সেই আট বছর আগের সমস্ত মুহূর্ত, প্রতিজ্ঞা সব ভেসে উঠলো। আর..  দেখতে পাচ্ছি স্মৃতির লালিত্যহীন মুখ, সোহাগহীন মুখ। অজান্তেই আমার দুচোখ ভরে উঠলো।মনে হলো আমি তো আছি, স্মৃতির কিছু হবেনা ওকে আমি খুব ভালো রাখবো,সব সুখ দেবো। এসব ভাবতেই আমার একটা ফোন এলো, দিয়া ফোন করেছে। আমার সব স্বপ্ন ভেঙে গেল। আমি যে বিবাহিত সেটা ক্ষণিকের জন্য ভুলে গিয়েছিলাম পুরনো ভালোবাসা ফিরে আসায় । নিজেকে মনোবল দিলাম। স্মৃতি আমার কাছে এসে বললো,' ভালো থাকবি,আমিও ভালো থাকার চেষ্টা করবো।'
আমি কিছু বলতে পারলাম না শুধু তাকিয়েই থাকলাম। আমি বলতে গেলাম,' স্মৃতি!'
আমাকে ও থামিয়ে বললো,' অনু, সব ভালোবাসা পূর্ণতা পায়না। আমাদের গল্পের শেষ তো আট বছর আগেই হয়েছিল কিন্তু সমাপ্তি হয়তো বাকি ছিল। আজ সেটাও হয়ে গেল।'
আমি শুধু এটুকুই বললাম,"আট বছর আগে শেষ তুই করেছিলি তাই আজ সমাপ্ত করার অধিকারও তোর। আমি তখনও বলেছিলাম,' আমি আছি'। আজও বলছি,' আমি আছি'। "
স্মৃতির ছলছল চোখে বললো,' আমার সেই অনু, আজ বড়ো হয়ে গেছে। সময় আর পরিস্তিতি আমাদের সম্পর্ক শেষ করেছিল।'
আমি বললাম,' না স্মৃতি। পরিস্থিতি না, অবিশ্বাস আমাদের সম্পর্ক শেষ করেছিল। কিন্তু আমি আছি এটা মনে রাখবি। স্বামী না হয়ে তো কি হলো, তোর সেই অনু হয়ে আজীবন থাকবো।'

No comments:

Post a Comment