Monday, May 4, 2020

দেবব্রত ঘোষ মলয়



গল্প -           
সাথী

"আপনারা যারা এই দীর্ঘ সময় ধরে আমার অকিঞ্চিৎকর বক্তব্য শুনলেন এবং আমাকে আজ এই অনন্য সম্মান প্রদান করলেন তাদের প্রত্যেককে আমি আমার বুক ভরা ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা জানাই। নমস্কার।" - ভাষণ শেষ করলেন সাহিত্যিক অবিচল চট্টোপাধ্যায়। সমস্ত প্রেক্ষাগৃহ করতালিতে ভেঙে পড়ল। এরপর যথারীতি উত্তরীয়, মানপত্র, বিভিন্ন স্মারক উপহার এবং একটি মোটা অংকের চেক গ্রহণ করে সম্বর্ধনা মঞ্চ থেকে ধীর পায়ে নেমে এলেন তিনি। গিয়ে দাঁড়ালেন প্রেক্ষাগৃহের দক্ষিনে খোলা বারান্দাটিতে।
অবিচল চট্টোপাধ্যায়। এই সময়ের অন্যতম লেখক ও একটি ছোট্ট প্রকাশনা সংস্থার কর্ণধার। আজ তাঁর সাহিত্যজীবনকে সংবর্ধিত করল শহরের অন্যতম কর্পোরেট হাউজ ডিজি গ্রুপ। আর যাঁর হাত থেকে তিনি এই সংবর্ধনা গ্রহণ করলেন সে আর কেউ নয় তার বাল্যবন্ধু এই সংস্থার ভাইস প্রেসিডেন্ট সুমন বসু। সম্বর্ধনার পর কফির কাপ হাতে
প্রেক্ষাগৃহের দক্ষিণের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ান অবিচল। চলে যান স্মৃতির সরণি বেয়ে বহু পিছনে আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে তাঁর নিজের গ্রাম নিঝুমপুরে।
"মা, মা" - দৌড়াতে দৌড়াতে বাড়িতে ঢোকে সদ্য তরুণ অবিচল। হাতে তার মার্কসিট। রান্নাঘর থেকে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে তড়িঘড়ি করে এগিয়ে আসেন তার মা নিভাননী দেবী। বলেন - "এইতো বাবা, বল কি হলো।"
"আমি পেয়েছি মা। খুব ভালো রেজাল্ট হয়েছে। হেডস্যার নিজে বলেছেন আমি নাকি স্কুলের মুখ উজ্জ্বল করেছি।" - হাসতে হাসতে বলে অবিচল। হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে মায়ের মুখ। ছেলের মাথায় হাত রেখে বলেন - "আশীর্বাদ করি বাবা জীবনে অনেক বড় হও। তা বাবা সুমন কোথায়? ওর রেজাল্ট কি হল?" অবিচলের প্রানের বন্ধু সুমনকে মা খুব ভালোবাসেন, বলেন ওঁর আর একটি ছেলে। "মা সুমনও খুব ভাল ফল করেছে। ইনফ্যাক্ট আমরা দুজনেই স্কুলের মধ্যে সবথেকে ভালো রেজাল্ট করেছি। ও কাকু কাকিমাকে প্রণাম করতে গেছে, বিকেলে আসবে আমাদের বাড়ি।"
হরিহর আত্মা দুই বন্ধু অবিচল আর সুমন। স্কুলের ক্লাসে ছোট থেকে পাশাপাশি বসে তারা আর দুজনের কাছেই দুজনের বাড়ি নিজের বাড়ি। ওরা কখন কে কার বাড়ি থাকে, কার বাড়ি পড়াশোনা করে আর কার বাড়ি খায় ওদের বাড়ির লোকেরাও আগে থেকে সেটা জানতে পারে না। ওরা জীবনের প্রায় সমস্ত সিদ্ধান্ত একসাথেই নেয়।
পরেরদিন খাওয়া-দাওয়া করে দুই বন্ধু গল্পে মেতে যায় সুমনদের বাড়িতে। আজ সুমনদের বাড়িতে অবিচলদের সবার নিমন্ত্রণ। এখন বাড়ির বড়রা আড্ডায় মেতেছে বৈঠকখানা ঘরে। সুমনের ঘরে আয়েশ করে বসে সুমন অবিচল কে বলে - "কিরে কলেজে ভর্তির ব্যাপারে কী ঠিক করলি?" অবিচল হেসে জবাব দেয় - "কেন আমরা তো আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম কলকাতার কলেজে পড়বো। আমি আজ বাবাকে বলেছি বাবা রাজি হয়েছেন। তুইও আজ বাড়িতে জানিয়ে দে।"
শেষ পর্যন্ত দুই বন্ধু ভর্তি হয় কলকাতার নামী কলেজে। এই কলেজে বিভিন্ন জেলা থেকে এবং কলকাতা থেকেও মেধাবী ছাত্ররা ভর্তি হতে আসে। কলকাতায় এসে তারা দেখলো তাদের গ্রামে তারা খুব ভালো ছাত্রের তকমা পেলেও এখানে যারা এসেছে তাদের বেশির ভাগই তাদের থেকেও মেধাবী এবং বেশি নম্বর পেয়েছে। সুতরাং কলেজে সিট পেতে তাদের অসুবিধা না হলেও দুই বন্ধু একসাথে ক্লাস করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। নম্বর বেশি হওয়ার কারণে অবিচল ডে সেকশনে চান্স পায় আর সুমন চান্স পায় নাইট সেকশনে। ছোট থেকে এই প্রথম তারা পাশাপাশি বসতে পারবে না একই সেকশানে, তাই দুজনেরই মন খারাপ।
অবিচল বলে - " চল আমরা একবার অফিসে গিয়ে কথা বলি।"
"ঠিক আছে, তাই চল" - বলে সুমনও  অবিচলের সঙ্গে অফিসের দিকে এগিয়ে যায়। কলেজের অফিসের ভেতর ঢুকে পড়ে তারা দেখে তাদের গ্রামের স্কুলের অফিস ঘরের সঙ্গে এই অফিস ঘরের বিস্তর ফারাক। অনেক বড় এই অফিসে অনেক মানুষ জন বিভিন্ন টেবিলে বসে বিভিন্ন কাজ করছেন। ওরা অনেক কষ্টে প্রিন্সিপাল স্যারের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পায়। উনি জিজ্ঞাসা করেন - "তোমরা কার সঙ্গে দেখা করবে?"
সুমন বলে - "আমরা দুজনেই ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছি কিন্তু আমি নাইট আর ও ডে সেকশনে। আমরা দুজনেই একসঙ্গে চান্স পেলে আমাদের সুবিধা হয়।"
ওদের আবেদনে প্রিন্সিপাল স্যারের মন গলে। উনি বলেন - "দুজনকে এক সেকশনে ব্যবস্থা করা যেতে পারে কিন্তু সেটা ডে নয়, নাইট সেকশনে। কারণ নাইট সেকশনে চাপ একটু কম থাকে। এখানে মূলত কর্মরত ছাত্ররাই পড়তে আসে অফিস কাছারি সেরে।" সুমন অবিচলকে বলে - "কিরে তুই যদি নাইট সেকশনে আসিস তোর অসুবিধা হবে?"
অবিচল নির্দ্বিধায় উত্তর দেয় -"কিসের অসুবিধা? আমরা দুই বন্ধু ছোট থেকে একসাথে পড়েছি। আমি তোর সঙ্গে নাইট সেকশনেই ক্লাস করবো।" দুজনে সেকশন চেঞ্জ এর ফরম ফিলাপ করে ফিরে আসে।
অবিচল পড়াশোনায় ভালো হলেও সব সময় পড়াশোনা করতে তার ভালো লাগে না। সে কলেজের বিভিন্ন সোশ্যাল ওয়ার্ক এ যোগ দেয়, সেন্ট জন অ্যাম্বুলেন্স-এর সদস্য হয় এবং বিভিন্ন ক্যাম্পে মানুষের সেবা করে। কলেজের পত্রিকাতেও সে নিয়মিত তার লেখা দেয়।
এদিকে সুমন বরাবরই উচ্চাকাঙ্ক্ষী তার ক্যারিয়ার নিয়ে। সে খুব মন দিয়ে পড়াশোনা করে। দেখতে দেখতে এসে যায় প্রথম বর্ষের পরীক্ষা। দুজনেই ভালো পরীক্ষা দেয় কিন্তু এবারও অবিচল-এর রেজাল্ট বেশি ভালো হয়। এবার সুমন একাই যায় প্রিন্সিপাল স্যারের সঙ্গে দেখা করতে। তাঁকে জানায় নাইট সেকশনে চাকুরীজীবী ছাত্ররা কেবলমাত্র কোন রকমে পাশ করে ডিগ্রি নেওয়ার জন্যই এখানে পড়াশোনা করে। ভালো প্রফেসররা সবাই ডে সেকশনে। স্যার যদি কোনভাবে তাকে ডে সেকশনে ব্যবস্থা করে দেয় তাহলে সে পড়াশোনায় আরো মন দিতে পারবে।
তার আর্জি মঞ্জুর হয় কারণ চাকরির কারণে দুজন ছাত্র কলেজ ছেড়ে দেয় সেই জায়গায় দুটি সিট ফাঁকা হয়।
অবিচল এসবের বিন্দুবিসর্গ জানতে পারে না। হঠাৎই একদিন সে সুমনের কাছে জানতে পারে কাল থেকে সুমন ডে সেকশনে ক্লাস করবে। এই প্রথমবার খুব কষ্ট পায় অবিচল। সে বন্ধু অন্তপ্রাণ। বন্ধুর জন্যই সে একদিন ডে সেকশন ছেড়ে নাইট সেকশনে এসেছিল। আর আজ সেই বন্ধুই তাকে না জানিয়ে ডে সেকশনে চলে গেল। মনের কষ্ট মনে চেপে সে তার পড়াশোনা, সোশ্যাল ওয়ার্ক নিয়ে মেতে থাকলো।
একদিন কলেজ জীবন শেষ হলো দুজনের। দুজনেই সম্মানের সঙ্গে স্নাতক হয়েছে। এরপর সুমন গভীর মনোযোগের সঙ্গে পড়াশোনা শুরু করে এবং একদিন এমবিএ পাশ করে সসম্মানে চাকরিতে জয়েন করে। উচ্চাকাঙ্ক্ষী সুমন চাকরি জীবনেও উন্নতি করে এবং আস্তে আস্তে সে পৌঁছায় এই কর্পোরেট সংস্থাটির শিখরে, ভাইস-প্রেসিডেন্ট পদে। যে সংস্থাটি আজ অবিচল কে সংবর্ধনা দিল।
অবিচলের মনে পড়ে যায় তার নিজের কথা। কোনদিন সে উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিল না। আর কলেজ পাশ করার সঙ্গে সঙ্গেই তার বাবার চাকরি চলে যায়। এরপর শুরু হয়ে যায় বিধবা মা আর ছোট বোনকে নিয়ে তার এক অসম লড়াই। বাধ্য হয়েই একটি ছোট কোম্পানিতে চাকরি নেয়। ক্রমেই পিছিয়ে যেতে থাকে বন্ধুর থেকে। তাদের বন্ধুত্ব যদিও থেকে যায় কিন্তু অনেক ব্যাপারেই  অবিচল সুমনের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে না।
চাকরির পাশাপাশি অবিচল তার সব থেকে প্রিয় শখ সাহিত্য চর্চা চালিয়ে যেতে থাকে। এই সময়ে বিভিন্ন পত্রিকায় তার লেখা নিয়মিত প্রকাশ হতে থাকে। দেখতে দেখতে বেশ কিছু বছর কেটে যায়। অবিচলের মা কালের নিয়মে একদিন বিদায় নেন। মায়ের মৃত্যুর দু'বছরের মধ্যেই অবিচল ছোট বোনের বিয়ে দেয় খুব ভালো একটি ছেলের সঙ্গে। এরপর সে নিজেও বিয়ে করে। তার একটি মেয়ে হয়। সে এখন কলেজে পড়ে। সুমনও বিয়ে করে কলকাতায় ফ্ল্যাট কিনেছে, গাড়িও। দুই বন্ধুর মধ্যে যোগাযোগ থাকলেও দেখা-সাক্ষাৎ খুব কমই হয়। এরমধ্যেই অবিচল একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করতে শুরু করে।
ভাবনায় ছেদ পড়ে অবিচলের সুমনের ডাকে - "এই অবু, কি করছিস এখানে একা একা? চল কফি খাব একসাথে। হাসে অবিচল, বলে - "খুব ছোটবেলার কথা মনে পড়ছিল জানিস। আমাদের সেই স্কুল জীবনের বন্ধুত্বের কথা। তোর বাড়িতে কত রাত অংক করতে করতে গান গাইতাম আমরা, তোর মনে আছে সেসব দিনের কথা?" হঠাৎই আনমনা হয়ে যায় সুমন। বলে -"আসলে কি জানিস অবু, সারাটা জীবন আমি খালি দৌড়িয়ে গেছি, পিছন ফিরে তাকাবার সময় পাই নি। আমি সবসময় আকাশটাকে ছুঁতে চেয়েছি। আমাদের এই ভারত বিখ্যাত কোম্পানি প্রতিবছর সাহিত্যের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ পুরস্কার ও সম্মাননা দেয়। আমাদের বিচারকমণ্ডলী এবছর যখন তোর নাম সুপারিশ করেন তখনই প্রথম আমার মনে হয় তোর বইগুলো পড়ার কথা।  বিচারকমণ্ডলীর কাছ থেকে তোর সবকটি বই আমার কাছে আসে। আমি দু-তিন দিন ধরে সমস্ত বইগুলি শেষ করে ফেলি এবং ..."- চুপ করে যায সুমন। অবিচল একদৃষ্টে বন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শুনছিল। এখন বন্ধুর কাঁধে হাত রেখে বলে -" এবং কি?"
সুমন অবিচলকে জড়িয়ে ধরে অস্ফূট ধরা গলায় বলে -"আমি হেরে গেছি অবু। এই বাড়ি, গাড়ি, জমানো টাকা, সম্পত্তি এসবের কোনো দামই নেই। কিন্তু তুই যে সৃষ্টি রেখে গেলি তা অবিনশ্বর। বহু মানুষকে আনন্দ দিয়েছে এবং ভবিষ্যতেও দেবে। তাই কংগ্রাচুলসন মাই ফ্রেন্ড।"
ভিজে যায় অবিচলের চোখ। বুঝতে পারে তাদের বন্ধুত্বের অতীতের ভালোবাসা আজ আবার ফিরে এসেছে।

No comments:

Post a Comment