Monday, May 4, 2020

গোপা মুখোপাধ্যায়



গল্প -         
ক্ষত

সুকন্যার মনটা খুব অশান্ত গতকাল রাত থেকেই।মেয়েটা আজ বিকালে বাড়ি ফিরছে হোষ্টেল থেকে।বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে ইকোনমিক্সে অনার্স করছে। এখানে পড়ার খুব ইচ্ছে ছিল সুকন্যার, কিন্তু ঠাকুমার ইচ্ছে ছিল না বলে ওর বাবা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েই ভর্তি করেছিলেন। সুকন্যা তাই অঙ্গনাকে ওখানে ভর্তি করে নিজের মনের আশা কিছুটা হলেও পূরন করতে পেরেছে।এর আগে মেয়ের বাড়ি ফেরার কথা হলে আনন্দে সুকন্যার ঘুম আসতো না।রকম রকম রান্না, জিনিস কেনা এসব নিয়ে মেতে থাকতো। কিন্তু এবার আর সে ইচ্ছে নেই। মনের মধ্যে একটা দুশ্চিন্তা মাখানো ভয় ওকে ক্রমশঃ গ্রাস করছে। কিন্তু মেয়ের কাছে তার কোনোমতেই প্রকাশ করা চলবে না। আজকালকার মেয়ে, একটুতেই খুব অভিমান।তার উপর ছ মাস পর বাড়ি ফিরছে।বাবা সুকুমার বাবুর হৃৎপিণ্ড ঐ মেয়েটি।কোনো মতেই মেয়ের চোখে জল সহ্য করতে পারেন না।আর মানুষটাও খুব নরম মনের যে।এতো বড়ো অফিসার, কিন্তু কোনো অহংকার নেই। বরং সুকন্যার স্বামী, মেয়েকে নিয়ে বেশ গর্ব হয়।
বিকালের সোনা মাখা রোদে ফাল্গুন মাসের আকাশটা হোলির বার্তা দিচ্ছে।আর হোলি আসলেই সূকন্যার মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়।পিছনে একটা দগদগে ঘায়ের অতীত ওকে কুরে কুরে খায়। বিবেকের সাথে দ্বন্দ্ব করেও পেরে ওঠে না।
গেটে গাড়ির আওয়াজ। মেয়ে এলো।ছুটে বেরিয়ে আসে সুকন্যা। আলুর পরোটা ওর খুব প্রিয়। মায়ের সাথে কথা বলতে বলতে একটু খাবার খেয়েই মেয়ে ফোন নিয়ে চলে গেল নিজের ঘরে।রাতে হঠাৎ ফোনটা মাকে দিয়ে বলে,"মা,আন্টির সাথে কথা বলো।"
কিছু বুঝে উঠার আগেই সুকন্যার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো,"হ্যাঁ হ্যালো...।"
ওপার থেকে ভেসে এলো,"মিসেস রায়? ভালো আছেন?"
একটু ইতস্তত করে উত্তর দেয়,"হ্যাঁ, আপনারা ভালো তো?"
আবার ওপারের গলা,"একদম ফাইন, যাক্ গে সান্ ডে আসছেন তো সবাই?"
পুরোটাই অজানা।তাই অস্ফূট স্বরে সুকন্যা বলে,"হ্যাঁ যাবো।"
"ওক্কে,আজ রাখি।"এই বলে ফোনটা ওপার থেকে কেটে দেয়।
সুকন্যা মেয়ের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল,তার আগেই মেয়ে মায়ের গলা জড়িয়ে আদর করে বলে উঠলো,"মা,মা, আমার সোনা মা, প্লিজ না করো না। আমরা যাবোই।আজ এক বছর ধরে আমি অরিত্রকে কথা দিয়ে রেখেছি। এবার আর না বলো না।"
'অরিত্রর কথা মেয়ের মুখে আগেও শুনেছে সুকন্যা।তাও মনটা খুব একটা সায় দিচ্ছে না।ওর মনে ছিল নিজের ছোট বেলার বান্ধবী পূজার ছেলে অঙ্কিতের সাথে অঙ্গনার বিয়ে দেবে। সেরকম দু বান্ধবীর মধ্যে কথাও হয়েছিল। কিন্তু মেয়ের ভালোবাসার কাছে মায়ের মনের কথা মনেই রয়ে গেল।
রবিবার, সকালে স্নান পুজো সেরে তাড়াতাড়ি সমস্ত কাজ শেষ করতে হবে। বর্ধমান থেকে ঘাটশিলা অনেকটা পথ। গাড়িতে করে গেলেও ছয় সাত ঘন্টা লেগে যাবে।আর ওখানে থেকে একটু গেলেই 'জোড়া', উড়িষ্যার একটা ছোট ছোট পাহাড় ঘেরা সুন্দর জায়গা। এখানেই থাকে এখন পলাশ, সুকন্যার দাদা। বহুদিন হল দাদার বাড়ি যায়নি ওরা,তাই এবার ওখানে যাওয়ারও একটা সুযোগ হল।বেলা নটার মধ্যেই গাড়ি ছাড়লো। রাস্তায় একটু দাঁড়িয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে নিল।
খড়্গপুরের পর থেকেই রাস্তার দুধারে কি মনোরম দৃশ্য ! দেখে চোখ ভরে যায়। কোথাও ছোট পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ছোট্ট ছোট্ট হলুদ ফুলে ভর্তি গাছ। আবার কোথাও কুয়াশা ভরা বেলা।
সুকন্যা মনে মনে বলে উঠে,"বাহ্,কি সুন্দর জায়গা।"
খুশি ভরা চোখে অঙ্গনা বলে,"দেখছো তো আমার কেমন পছন্দ, জায়গাটা তোমার কতো পছন্দ হয়েছে।"
সুকন্যার মৃদু হেসে মেয়ের দিকে তাকায়।
অঙ্গনা বলে,আর অরিত্রকে দেখলে তুমি তো চোখ ফেরাতেই পারবে না মা।"
সুকন্যা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,"অনেকক্ষণ জল মুখে দিস নি। একটু জল নে মুখে।এতটা জার্নি।"
অঙ্গনার ফোনটা বেজে উঠল। কথা শেষ করে মাকে বলল," চলে এসেছি মা,আর দু কিলোমিটার। স্টপেজে অরিত্র দাঁড়িয়ে আছে আমাদের জন্য।"
খুশি হয় সুকন্যা।
ঘাটশিলা খুব সুন্দর আর স্বাস্থ্যকর শহর। অঙ্গনা গাড়ি থেকে নামতেই একটি সুন্দর লম্বা সুপুরুষ এগিয়ে এসে প্রণাম করে সুকন্যা আর সুকুমারকে। তারপর ওদের গাড়ি এগিয়ে যায় অরিত্রর বাড়ির দিকে।
বিরাট বড়ো বাংলো। দরজায় দারোয়ান। ভেতরে গেষ্ট হাউস। ওখানে তাদের পরিচর্যার জন্য ও লোক আছে।গোটা বাউন্ডারি ঘিরে সারি সারি নারিকেল গাছ। ভেতরে অনেক রকম ফুলে গাছগুলো ভর্তি। যেন ইন্দ্রের স্বর্গরাজ্য। মনে মনে খুশি হয় সুকন্যা।
অরিত্র বলে,"আন্টি, আপনারা ফ্রেশ হয়ে একটু রেস্ট করুন।মাম্মী,ড্যাড এক্ষুনি চলে আসবে।"
সুকন্যা বলে,"হ্যাঁ সেটাই ভালো।"
একটু অপ্রস্তুত হয়ে অরিত্র বলে,"আসলে আজ আমার এক আত্মীয়ের বাড়িতে নিমন্ত্রণ ছিল। আমি যাই নি, ওঁরা গেছেন। চলে আসবেন।"
ঘাড় নেড়ে সায় দেয় সুকুমারও।ওরা ফ্রেশ হলে জলখাবার,চা নিয়ে আসে বিন্দু।
আকাশটা বেশ মেঘাচ্ছন্ন। সুকন্যার ডান চোখের পাতাটা কেমন যেন কেঁপে উঠলো।
হঠাৎ গাড়ির জোর হর্ণ। সুকন্যা জানালার কাছে ছুটে গিয়ে দাঁড়ালো। বুঝতে পারলো অরিত্রর বাবা মা এলেন। দূর থেকে আগে একটু দেখবে এই আশা নিয়ে ভালো করে তাকিয়ে দেখেই চমকে গেল সুকন্যা। অস্ফুট স্বরে বলে ফেললো,"একী!!!!!!"
অঙ্গনা অবাক হয়ে বলে,"কি হলো মা?"
সুকন্যা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলে,"ওওওও ওই লোক্ টা, আমার আমার...."
কথাটা মুখেই রয়ে যায়, বাইরে আসে না। সুকুমার বাথরুম থেকে বের হয় নি তখনও। সুকন্যা বলে চলে,"না না, একদম না,ঐ রাক্ষসের রক্তের ঘরে আমার মেয়েকে,ন্ না কখনো না,!!"
একটা কিছু যে চরম সত্য মায়ের বুকে লুকিয়ে আছে তা বুঝতে দেরি হয় না অঙ্গনার। অরিত্রকে ফোনে বলে 'শরীর খুব ক্লান্ত। একেবারে ডিনার টেবিলেই কথা বলবে।'
সুকন্যা মেয়েকে বলে,"এ সত্য তোর বাবাকেও বলতে পারি নি। তখন সবে কলেজে ঢুকেছি। ইলেকশনের জন্য ডায়াস করতে এসেছিল কয়েকটি সিনিয়র ছাত্র। তাদের মধ্যে এই রাক্ষসও ছিল। হোলির আগের দিন ট্যুইশন থেকে ফিরছি, মনে পড়ে গেল তন্দ্রার নোট খাতাটা দেওয়া হয় নি ওকে।ওর বাড়িতে খাতাটা দিয়ে বাড়ি ফিরবো। আকাশটা মেঘে ঢাকা ছিল কিন্তু ওদের বাড়ির একটু আগেই জোরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। আমি বেল টিপতে ই দরজা খুলে বলল ,'আসুন।'  ভিজে শাড়ি বাগিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখি এই রাক্ষস। ওদের বাড়িতে তখন কেউ ছিল না। তন্দ্রার দাদা এই বিকাশ চৌধুরী। আমাকে টেনে সোজা বিছানায় নিয়ে গেল। আমার কান্না, চিৎকার কিছুই কারো কানে গেল না। এমনকি ঈশ্বরের কানেও না।সারা শরীরে যন্ত্রণা নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।চারদিন উঠতে পারি নি।আগামীর অন্ধকারের কথা ভেবে মাকে  সব বললাম।ভয়ে ভয়ে কাটলো একটা মাস। মেয়েদের মাসের বিশেষ একটা সময় পেরিয়ে গেলে এই বিপদটা কাটলো মনে হল। কিন্তু আমার আর কলেজ যাওয়া হলো না।কারন ঐ পাষন্ডটা আমাকে পেলে আবার ছাড়বে না।আর ওর আমরা তখন কিছু করতেও পারতাম না। নেতাদের সাথে ওর ওঠাবসা।তাই সবদিক ভেবে মা বাবাকে অন্যভাবে বুঝিয়ে প্রাইভেটে পরীক্ষা দেওয়ার কথা বলে রাজি করিয়ে ছিলেন।এই সেই বিকাশ চৌধুরী। হ্যাঁ ওকে আমি কখনোই ভুলতে পারবো না।"
এদিকে সুকুমার বাবু কখন স্নান সেরে ওদের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন,তা ওরা বুঝতেই পারে নি।
তারপর হাসিমুখে সুকন্যার কাঁধে হাত রেখে পরম ভরসায় বলেন,"এতবড় একটা কষ্ট এতো বছর ধরে কি করে মনে পুষে রেখেছিলে সুকু? এমনকি আমাকে ও বলতে পারো নি?"
সুকন্যা অঝোরে কাঁদছে,ওর সাথে কাঁদছে গোটা ঘাটশিলার প্রকৃতি। অঙ্গনা মাকে বুকে জড়িয়ে রেখেছে। মুক্তোর মতো মায়ের অশ্রু বিন্দুগুলোতে অঙ্গনা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে বিকাশ চৌধুরীর মুখ।
এবাড়ির জল ও স্পর্শ করতে ইচ্ছে হল না সুকন্যার।তাই ডিনারে শরীরটা ভালো নেই বলে চালিয়ে দিল।অরিত্রর বাবা মা দুজনেই ওঁকে দেখতে এলেন। অজস্র নারী‌র বিছানা ভেজানো বিকাশ চৌধুরীর পক্ষে সুকন্যার মুখটা মনে রাখাটা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি তুলসীপাতার মতো পবিত্র স্নিগ্ধ সুকন্যার পক্ষেও বিকাশ চৌধুরীকে ভুলে যাওয়া অসম্ভব।তাই এত কাছে এসেও সুকন্যাকে একটুও‌ মনে পড়লো না বিকাশের।
সারাটা রাত মন আর মস্তিষ্কের চরম যুদ্ধ চলতে থাকে অঙ্গনার। শেষে পাশে মায়ের ঘুমন্ত নিস্পাপ মুখটার দিকে তাকিয়ে নিজের মনকেই সমর্থন করে অঙ্গনা। মনে মনে বলে,"আমাকে ক্ষমা করো অরিত্র, তোমাকে ভালোবেসে আমি মায়ের এতবছরের ক্ষতকে আর বাড়াতে চাই না।"চোখের কোণে জল এসে জমে। অরিত্র সত্যিই ভালো ছেলে। কিন্তু,রক্ত যে কথা বলে।ও যদি পরে আরেকটা বিকাশ চৌধুরী হয়! না, এটা কোনো ভাবেই সম্ভব নয়। নিজের হাতে চোখের জল মুছে ফেলে।
সুকন্যার ঘুমটা ভেঙে যায়। মেয়েকে দেখে অবাক হয় বলল,"ঘুমুস নি?"
মাকে জড়িয়ে কেঁদে ফেলে অঙ্গনা।ধরা গলায় বলে,"কাল ভোরেই এখান থেকে চলে যাই মা।"
সুকন্যা সব বোঝে। মেয়ের পিঠে হাত বোলায়।
অঙ্গনা বলে,"আমি অরিত্রকে কখনো এসব বলতে পারবো না মা। কিন্তু বলবো,ওরা অনেক বড়লোক। আমার চেয়ে অনেক ভালো মেয়ে ও পাবে।"
সুকন্যা বলে,"কাঁদিস না,যা হয়,তাই ভালোর জন্যই হয়।"
অঙ্গনা বলে,"মাগো আমার ভালোবাসার থেকেও আমার মায়ের চোখের জল অনেক দামি আমার কাছে।"
ভোরে অরিত্র কে ফোন করে ডেকে নেয় অঙ্গনা। ওদের বিদায় জানাতে আসে অরিত্র।তখনো ও জানে না এটাই ওদের শেষ দেখা। ভালোবাসা হারায় না। হয়তো সারাজীবন অরিত্র রয়ে যাবে অঙ্গনার মনে।
গাড়ি এগিয়ে চলেছে।দেখছে অঙ্গনা গাড়ির ভেতর থেকে। অরিত্র কেমন ছোট হতে হতে কখন হারিয়ে গেল।তখনো মা ওর হাতটা ধরে আছে। কুয়াশা মাখা ভোরে শেষ হয়ে গেল একটা নির্মল ভালোবাসার অধ্যায়। কিন্তু নতুন করে সূর্য উঠে খবর দিলো মায়ের ভালোবাসা তুলনাহীন। অঙ্গনা তাকায় সূর্যের দিকে।ওর মনে হলো আজ সূর্য টা যেন অনেক বড়ো।

No comments:

Post a Comment