Monday, May 4, 2020

ধরিত্রী গোস্বামী



নিবন্ধ -  
স্মৃতি বড় মায়াময়

লক ডাউনের অখন্ড অবসর। এমন অদ্ভুত এক অভিজ্ঞতা যার কথা কেউ কখনো শোনেনি। দেখেনি বটেই। কেউ বিরক্ত, কেউ বিমর্ষ, হতাশ কেউ বা। আবার অনেকেই এই সুযোগে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মনে করছেন ফেলে আসা সময়ের কথা। এ্যালবাম খুলে বের করছেন ফেলে আসা দিনের ছবি। পরিবারের, বন্ধুবান্ধবের কিংবা নিজের। রোমন্থন করছেন সুসময়ের কথাগুলি। কারু মুখে ফুটে উঠছে মৃদু হাসি, কারু বুক নফেটে বেরিয়ে আসছে জমাট দীর্ঘশ্বাস। একেই বলে স্মৃতি বেদনা। আমরা যাকে ইংরেজিতে বলে থাকি Nostalgia. ফেলে আসা দিনের স্মৃতির সঙ্গে কিছুটা সময়ের জন্য একাত্মতা। পরিবারের সঙ্গে খাবার টেবিলে, কিংবা বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে চায়ের আড্ডায়, সন্তান সন্ততিদের কাছে স্মৃতি চারণায় আমরা সহজ কথায় হামেশাই বলে থাকি পুরনো সেই দিনের কথা।এই স্মৃতি বেদনার প্রাধান্য আমাদের প্রতিদিনের জীবনে কিরকম সেটা অল্প কথায় একটু আলোচনা করে নেওয়া যাক।
প্রথমেই বুঝে নেওয়া দরকার স্মৃতি বস্তুটি কি? মানুষের স্মৃতির স্বরূপ বোঝার চেষ্টা আজকের নয়, আরম্ভ হয়েছে অন্তত ,০০০ বছর আগে আ্যারিস্টটলের সময়ে। আ্যারিস্টটল মানুষের মনটাকে তুলনা করেছিলেন একটি সাদা স্লেটের সঙ্গে। জন্মের সময়ে মানুষ কোনপ্রকারের জ্ঞান নিয়ে জন্মায় না। সমস্ত অভিজ্ঞতাই সে আয়ত্ব করে তার জীবদ্দশায়। মোমের ওপরে যেমন ছাঁচ ফেলা যায়, সেভাবেই সমস্ত অভিজ্ঞতা আমাদের মনের ওপরে ছাঁচ ফেলে ফেলে গড়ে তোলে আলাদা আলাদা স্মৃতির ভান্ডার। তাই প্রত্যেক মানুষের স্মৃতি তার কাছে বিশেষ। একক। এই স্মৃতির ওপরে নির্ভর করেই গড়ে ওঠে আমাদের অনেকখানি ব্যক্তিত্ব। কিছু স্মৃতি স্বল্প সময়ের জন্য স্থায়ী থাকে, কিছু হয় দীর্ঘমেয়াদী, কিছুবা সারা জীবনের সম্পদ।
আ্যারিস্টটলের সময়ে থেকে অনেক এগিয়ে এসেছি আমরা। ১৯০৪ সালে জার্মান সায়েন্টিস্ট রিচার্ড সিমন, ১৯৩০ এর দশকে ব্রিটিশ সায়েন্টিস্ট স্যর ফেডেরিক বারটলেট এবং আরও অনেকের বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণের হাত ধরে একটু একটু করে স্পষ্ট হয়েছে স্মৃতি কি এবং কেন, তার স্বরূপ এবং সংজ্ঞা। প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে নিউরো সাইকোলজি বলে যে বিষয়টি উঠে এসেছে বিজ্ঞানের জগতে, তার হাত ধরেই স্মৃতির রহস্য অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে যায় মানুষের কাছে। ১৯৪৯ কানাডার বৈজ্ঞানিক ডোনাল্ড হেব যে থিওরি প্রস্তাব করেছিলেন, যাকে বলা হয় হেব থিওরি, সেটাই পরবর্তী সময়ে (১৯৭০) আরও পরিমার্জিত অবস্থায় স্থায়ী স্বীকৃতি আদায় করে আজ অব্দি বলবৎ হয়ে আছে। স্মৃতির একত্রীকরণ, দীর্ঘমেয়াদী শক্তিবৃদ্ধি এবং স্নায়ুতন্তুর নমনীয়তার জ্ঞানের ওপরে ভিত্তি করে স্মৃতির প্রকৃত স্বরূপ এখন অনেকটাই পরিষ্কার আমাদের কাছে। এরপরে ১৯৫০-৬০ এর দশকে বাজারে এসেছে কম্প্যুটার। কম্প্যুটারের কাজের ধরন বোঝার ফলে আমাদের মস্তিষ্কের কার্যকলাপের সঙ্গে তুলনামূলক আলোচনা সহজ হল। মেমরি এনকোডিং, স্টোরেজ এবং রিট্রাইব্যাল বিষয়ে জ্ঞান জন্ম দিল এক বিপ্লবেরযাকে বলা যেতে পারে বুদ্ধিগম্যতার বিপ্লব।অনেক থিওরি, অনেক মডেল, অনেক স্টাডির পথ পেরিয়ে এখন আমরা জানি যে স্মৃতি হল সেই ক্ষমতা যার সাহায্যে আমরা অতীতের অভিজ্ঞতাগুলিকে সঞ্চয় করে রাখতে পারি, ভবিষ্যতে প্রয়োগের জন্য। মানুষের বিবর্তনের পথ ধরেই এই পরিপূর্ণতা এসেছে হাজার হাজার বছরের পথ ধরে। সেই স্মৃতি হতে পারে সাময়িক, স্বপ্লমেয়াদী কিংবা দীর্ঘমেয়াদী।
বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সবারই স্মৃতি কম বেশি হ্রাস পায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সে অবস্থা প্রায় অক্ষমতার পর্যায়ে চলে যায়, যেমন আমরা ডিমেনশিয়া কিংবা অ্যালজ্যাইমার্স রোগের নাম শুনেছি। তবে স্মৃতিহারা অবস্থা কোন সুস্থ জীবনের ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। সাধারণ অবস্থাতেও বয়সের প্রকোপে কিছু না কিছু স্মৃতিলোপ সবারই হয়, তাই মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যের প্রতি নজর রাখাটা খুব আবশ্যক। সুস্থ চিন্তা ভাবনা, লেখাপড়ার মধ্যে থাকা, শব্দজব্দের মত ব্রেণ গেম খেলা, আর পর্যাপ্ত ঘুম, এই সবের মাধ্যমেই নিজেদের মস্তিষ্ককে সুস্থ রাখতে এবং স্মৃতিকে তাজা রাখতে সক্ষম হতে পারি আমরা।
            এবারে আসা যাক স্মৃতিবেদনা নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায়। দৈনন্দিন জীবনের জটিলতা আর ব্যস্ততার থেকে ছুটি নিয়ে মাঝেমাঝেই পুরনো দিনের স্মৃতিতে ডুব দিয়ে নেয়ে উঠতে কার না ভাল লাগে? ইচ্ছে কি হয় না ফেলে আসা সেই দিনগুলিতেই আবার ফিরে যাই? শীতের মিঠে রোদ্দুরের ওমের মত স্মৃতিরা জড়িয়ে ধরে রাখুক, আগলে রাখুক ভবিষ্যতের অনিশ্চিতের হাত থেকে? ছেলেবেলার ফেলে আসা নির্ভাবনার দিন আর দ্বায়িত্বহীনতার হাতছানি কাকে না পিছু ডাকে? জেনে রাখা জরুরি আগামী দিনের স্বপ্নগুলি যতখানি ছলনাময়, অতীতের স্মৃতিও কিন্তু ঠিক তাই। বাস্তবতার ব্যথা বেদনার হাত থেকে আড়াল করতে এগুলি এক সুরের মূর্ছনায় জড়িয়ে রাখে মনকে। এই স্মৃতিগুলি সব সময়ই যেন বড় মধুর বড় দৃঢ় বড় সত্য বলেই মনে হয় আমাদের বর্তমানের বাস্তবের অবস্থান থেকে। বর্তমানের পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, অতীতের হারিয়ে ফেলা সময় যেন পিছু টানতেই থাকে। যা ফেলে এসেছিতা অতুলনীয়, তা দুর্লভ। 
কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হল এই হারিয়ে ফেলা দিনের যে স্মৃতি আমরা সযত্নে আমাদের মনের মধ্যে সঞ্চয় করে রাখি, সেগুলি কিন্তু প্রকৃত ঘটনার অনুরূপ নাই হতে পারে। আমরা ঠিক ততটাই ধরে রাখি স্মৃতিতে যেটুকু আমাদের ভাল লাগে, মন ভরাতে পারে। মস্তিষ্ক তার পছন্দমত সাজিয়ে গুছিয়ে নেয় স্মৃতি। এই অদলবদলের জন্যই না স্মৃতির মাহাত্য, যার নেশায় বুঁদ হয়ে অনেক সময় পার করে দিতে পারি আমরা। একেই বলে স্মৃতি মেদুরতার কামড়।
            তার গবেষণা পত্রে আ্যালান আর. হিরস্রিখ বিবরণ হিসেবে লিখেছিলেন--- অতীতের একটা পরিপাটি ধারণা, যাকে সাইকো এনালিসিসের ভাষায় বলে হয়, স্ক্রিন মেমরি---ঘটনার সঠিক পুনর্গঠন নয়, বরং বিভিন্ন তৃপ্তিদায়ক মুহূর্তের একটা সংযুক্তি এবং মন্দ অনুভূতিগুলিকে ছেঁকে বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়া।
আমরা সাধারণত যে স্মৃতিগুলি নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করি, সেগুলি কিছু ক্ষণস্থায়ী অনুভূতি, কিছু আবেগ, কিছু উল্লাস। ঠিক তার আগের মুহূর্তগুলির কোন যন্ত্রণার কিংবা বেদনার কথা আমাদের কিন্তু মনে পড়েনা সাধারণত। সেইটুকুই মনের আধারে ধরা থাকে যা আমাদের পক্ষপাতদুষ্ট মন ধরে রাখতে চায়। স্মৃতিমেদুরতার সঙ্গে সাধারণ স্মৃতির ফারাক এইখানেই। প্রত্যক্ষভাবে স্মৃতির সঙ্গে এর যোগ নেই, বরং অনেক বেশি একাত্ম মনের আবেগের সঙ্গে। এর সঙ্গে যুক্ত হতে পারে কোন জড় বস্তু, কোন পশু, কোন দৃশ্য কোন বিশেষ জায়গা, কিংবা গন্ধের স্মৃতি পর্যন্ত। নিজেদের ছোট ছোট টুকরো আমরা জমা রেখেছি কত কত টুকরো সময়ের কোঠরে। সেই সব সুখানুভূতি আমরা সময় সুযোগ মত অবসরে নিয়ে নাড়াচাড়া করে রসাস্বাদন করি  ঘুরে ফিরে, বারেবারে।
এই বিষয়ে তার গবেষণায় এরিকা হেপার, ইংল্যান্ডের সারে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গবেষক, আলোচনা প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, স্মৃতিমেদুরতার প্রয়োজনীয়তা ব্যক্তির বয়স বিশেষে বিভিন্ন রকমের। প্রাপ্তবয়স্ক যৌবনের মানুষজনের ক্ষেত্রে এর ব্যবহার সব থেকে বেশি লক্ষ্য করা গেছে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এটা অনেক কমে আসে, হয়ত সর্বাঙ্গীণ স্মৃতিক্ষয়ের জন্যই। আবার বৃদ্ধ বৃদ্ধারা নিজেদের বয়সকালের কথা রোমন্থন করে সুখ পাচ্ছেন, জিনিসও অদেখা নয়। 
নস্টালজিয়া নিয়ে গবেষণা যত এগিয়েছে, এর প্রয়োজনীয়তার দিকটি ক্রমে ক্রমে ততটাই স্পষ্ট হয়েছে আমাদের কাছে। এখন এটা প্রায় নিশ্চিত জানা গেছে যে নস্টালজিয়া প্রধানত আমাদের মনেরই একটি প্রতিরোধ ব্যবস্থা, মানসিক অবসাদের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াইকে সাহায্য করে। অতীতের সুখস্মৃতি নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে মানুষ তার বর্তমানের দুঃখ কষ্টকে ভুলে গিয়ে ভবিষ্যতের জন্য আশাবাদী হবার ক্ষমতা খুঁজে পায়। কখন কখন বর্তমানের পায়ের তলায় পিষ্ট কোন ব্যক্তি অতীতের কোন স্বীকৃতি লাভ কিংবা জয়ের কথা মনে করে আত্মমর্যাদা ফিরে পেতেও পারে। ফিরে পেতে পারে বাঁচার সাধ।
আনন্দ কিংবা বিষাদের মতই স্মৃতিবেদনার অনুভূতি সর্বজনীন। দেশ কাল ধর্ম নির্বিশেষে সমস্ত মানুষ জীবনের কোন না কোন সময়ে অতীতের স্মৃতিতে সাঁতরে বেড়িয়ে সময় কাটিয়েছে। নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ক্লে রাউতলেজের মতে স্মৃতিমেদুরতা অস্তিত্ববাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্রিয়া। সুখের অনুভূতিগুলিকে ফিরিয়ে ফিরিয়ে এনে সে আমাদের মনে করিয়ে দেয় আমাদের সুসময়গুলিকে, আমাদের জীবনের মূল্যকে। স্মৃতিমেদুরতা আমাদের একাকীত্বের সঙ্গে লড়াই করতে সাহায্য করে। সাহায্য করে একঘেয়েমি কিংবা উদ্বেগ কাটাতে। স্মৃতিমেদুরতা বোধ আমাদের মনের সহনশীলতা বৃদ্ধি করে, অপরিচিতের সঙ্গে একাত্ম বোধ করতেও সাহায্য করে। বৈবাহিক জীবনের অনেক ভুল বোঝাবুঝি কেটে যায় ফেলে আসা দিনের স্মৃতি রোমন্থনে।
২০শ শতকের গোড়াতেও স্মৃতিমেদুরতা নিয়ে চিকিৎসক এবং গবেষকদের মনে অনেক দ্বন্ধ ছিল। একে প্রায় মানসিক অসুখের সমতুল্য বিবেচনা করা হত। স্মৃতিমেদুরতা আমাদের মনে প্রবল আবেগের জন্ম দিতে পারে। আবেগতাড়িত হয়ে কেউ এমন ব্যবহার করে ফেলতে পারে যা হয়ত আপাত দৃষ্টিতে অস্বাভাবিক বলেই মনে হবে। গভীরতম অনুভূতির বশে কেউ হয়ত কান্নাকাটি করল কিংবা আচমকা এত উৎফুল্ল হয়ে পড়ল যার ব্যাখা বর্তমানকে বিবেচনা করে খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে না। কিন্তু অনেক গবেষণার পরে এটাই পরিষ্কার হয়েছে যে স্মৃতিমেদুরতা কোন মানসিক ব্যধি নয়, বরং সেটা আমাদের হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে দিতে সাহায্য করতে পারে, বিষাদের কালো মেঘ কাটিয়ে মনকে বার করে আনতেও পারে। নস্টালজিয়া একটি মিশ্র আবেগ, যে আবেগ মূলত ইতিবাচক, বিশেষ করে যদি কেউ স্বেচ্ছায় কিংবা কারু অনুরোধে কোন বিশেষ সুখদায়ক সময়কে মনের মধ্যে ফিরিয়ে আনতে চায়। তবে আপনি থেকেই যে সব বিষাদের স্মৃতিও মনের আনাচে কানাচে উঁকি দিয়ে আমাদের আনমনা করে তোলে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের নেতিবাচক প্রভাব যে একেবারে নেই তা বলা উচিত হবে না।



No comments:

Post a Comment