Monday, May 4, 2020

পারমিতা ভট্টাচার্য



পত্রসাহিত্য -               
 ফিরে দেখা মেয়েবেলা

আমার চোখে আমার মেয়েবেলা গোটা জীবনে একখন্ড হীরকদ্যুতির মতোই জাজ্বল্যমান এক অধ্যায়। স্মৃতি সততই সুন্দর।আমার মাটিমাখা গ্রাম,কাদামাখা মেঠোপথ,গাছগাছালির জঙ্গল,জীর্ণ শ্যাওলা ধরা পুকুর ঘাট,পাখির কুজন,মাঠ ভর্তি ফসল আর বড়দের শাসনের আবডালে বেড়ে ওঠা আমার কিশোরীবেলা। সেই কিশোরীবেলার এক আশ্চর্য নক্ষএকে,আমার প্রিয় বন্ধুকে একটা চিঠি লিখলাম বহু বছর বাদে।এই আশায়,যদি একটিবার তার হৃদয় দরবারে এই লেখা পৌঁছয়।

প্রিয় অনিকেত,
কেমন আছিস তুই? সে আমার জানা নেই
কোথায় থাকিস এখন?গ্রামের বাড়িতেই?
বাউন্ডুলেপনা ছেড়েছিস?নাকি এখনো কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বেড়িয়ে পড়িস অচেনা,অজানার খোঁজে?
মনে আছে তোর? মহাসাগরের কথা পড়তে পড়তে তুই কি বলতিস?
বলতিস আমি কলম্বাসের মত নাবিক হয়ে
একটা নতুন দ্বীপ আবিষ্কার করবো,
আর তোর নামে নাম রাখবো সেই দ্বীপের,
সারা দ্বীপে ছড়িয়ে দেবো তোর হাসির মুক্তমালা,
 দ্বীপে আমি গেছি অনি,
কিন্তু আন্দামানের নীল জলে কিংবা হ্যাভলকের সূর্যোদয়ে আমি শুধু তোর মুখ খুঁজেছি মন দিয়ে।

বিয়ে করেছিস জানি আমি
তোর বিয়ের দিন আমি রাস্তা থেকে তোদের বাড়ির সামনে আলোকমালার লেখায় তোদের নাম দেখেছিলাম
অনিকেত ওয়েডস সোনালী......

যাকগে সেসব কথা,
জানতে চাইবি না অনি,আমি কেমন আছি?
আমিও যতটা ভালো থাকার
ঠিক ততটাই ভালো আছি জানিস,
থোর বড়ি খাড়া যন্ত্রের জীবন,
ধুলো ঝাড়াঝুড়ি আর রেসিপিময় দিনলিপি,
প্রাণে নদী আছে,কিন্তু সেটাও স্রোতহীন,বদ্ধ,
শাড়ি কাচতে ,মাড় দিতে,শুকাতেই জীবনের অর্ধেকটা চলে গেলো,এরপর আবার বাকি কাজ .....

মাকড়সার জালের মোহে আষ্টেপৃষ্ঠে
নিজেকে সঁপে দিয়েছি ল্যাপিটার বুকে,
জানিস সংসারের কাজ সেরে ডুবে যাই আমি মস্কো থেকে মরক্কো,কাশ্মীর থেকে কাজাখস্তান,
দেশ থেকে দেশান্তরে ঘুরতে আমার যে কত ভালোলাগে সেটা তো তুই আগে থেকেই জানিস।
আমি এখনও কবিতা লেখা ছাড়িনি অনি,
এখনও আমার কবিতার প্রতিটা অক্ষর
তোর বিশ্লেষণের অপেক্ষায় দিন গোনে,
কতকাল তোর ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠেনি আমার কবিতা কোলাজ,
আমার কবিতারা তোকে এখনও ভোলেনি।

মনে আছে ভূগোল স্যার এর কাছে পড়তে যাওয়ার সময় কানা দামোদরের পারে সূর্যোদয় দেখে তুই কি বলতিস?
বলতিস আমি যেনো হ্যামারফেস্ট এ
প্রথম সূর্যোদয় দেখছি।
তোর মতো করে দেখতে শিখলাম কই বল?
ভিতর নিংড়ে তোর মতো করে প্রকৃতির সারমর্ম বুঝতে পারলাম কই?
জীবনকে সরল পথেও তরতরিয়ে বইয়ে দেওয়া যায় ,সেটাও তোর মতো করে বুঝতে পারিনি আমি,
তবু আজও আমি সূর্যোদয় দেখি,সূর্যাস্তও দেখি,কোত্থাও না গিয়ে ঘরে বসেই দেখি,
আমার ল্যাপটপের স্ক্রিনে ভেসে ওঠে সব কিছু,
আর আমি অনুভব করি সেই ফেলে আসা দিন,ফেলে আসা মনখারাপ,ফেলে আসা ঝগড়া, একটা দিন একটি বার না দেখার হৃদয় নিংড়ানো যন্ত্রণা,

বিজ্ঞান সব দিতে পারে, যা চাইবে সব
তুমি চাইলেই টেমসের তীরে যেতে পারো,
ভেনিসের জলে ভাসাতেই পারো ভেলা,
কিংবা দেখতে পারো ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলপথের দুধারের সুদৃশ্য,
তুমি মিশর থেকে মিসিসিপি ঘুরে একটু জিরোতেও পারো মাসাইমারায়।
শুধু ল্যাপির তার জুড়ে দিতে পারেনা তোর আর আমার জীবনটাকে।
বিজ্ঞান ফিরিয়ে দিতে পারেনা ফেলে আসা অনুভূতিগুলোকে,
বিজ্ঞান ভরিয়ে দিতে পারেনা মনের আকাশে চিল ওড়া শূন্যতাকে,
আমরাও আবার গিয়ে দাঁড়াতে পারিনা অনি, কৈশোরের জল পিঁড়িতে,
যেখানে তুই আর আমি প্রতিদিন সূর্যোদয়ের প্রথম আলো মেখে নিজেদের নতুন করে আবিষ্কার করতাম একটু একটু করে।

No comments:

Post a Comment