Monday, May 4, 2020

শক্তিপদ মাইতি



স্মৃতিচারণ -     

মোহাড় বাটিটাকী প্রাথমিক বিদ্যালয় (আমার শৈশব স্মৃতি)

শৈশবের সেই ফেলে আসা দিনগুলি রঙে রঙে কত ছবি আঁকে আমার ব্যস্ত দিনের অস্থির মনে। বারে বারে মনে পড়ে আমার জীবনের প্রথম স্কুলের কথা। আসলে আমার শৈশব স্মৃতির বেশির ভাগ অংশ জুড়ে সেই স্কুল, স্কুল সংলগ্ন ছোট্ট খেলার মাঠ, আসে পাশের গাছ পালা, ঝোপঝাড় আর অবশ্যই শৈশবের বন্ধু সকল। গাছের আড়ালে আর ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে চোর পুলিশ খেলাটা ছিল আমাদের নিত্য নৈমিত্তিক খেলা। স্কুলের দালান লাগোয়া বকুল গাছটার ডালে আমরা রোজই দোল খেতাম। ডাল ভেঙেও পড়েছি বেশ কয়েক বার। বকুল ফুলের সুবাস আমার খুব পছন্দ। গীতা, মমতা,  কল্যাণী, বুলবুলি, টুনটুনিরা বকুল ফুলের মালা গাঁথতে গাঁথতে আপন মনে গান গাইত "মমচিত্তে নিতি নৃত্যে"। ছোট্ট ছোট্ট পরীর মতো মনে হত ওদের। কি জানি এখন কোথায় তারা!

পূর্ব দক্ষিণ প্রান্তে মেঠো রাস্তার ধারে কয়েকটা বড় বড় করঞ্চা গাছও ছিল। তাতে অবশ্য সবাই চড়ে উঠতে পারত না। শীতের শেষে ঝরে পড়ত সব পাতা, সঙ্গে করঞ্জা ফলও। এই করঞ্জা ফল সংগ্রহ করতাম প্রায় সকলেই। করঞ্জা বীজ মোহাড় বাজারে বিক্রি করে দু-চার টাকা জমিয়ে কি না আনন্দ পেতাম! সবচেয়ে মজার ব্যাপার ঠিক বসন্তের প্রারম্ভে সবুজে সবুজ শাখায় শাখায় ভরে যেত থোকা থোকা নীল-বেগুনি রঙের করঞ্জা ফুল। অন্য একটা সুবাস, অন্য এক অনুভূতি। গুনগুন মৌমাছির গুঞ্জনে মুখরিত এই পথে হাঁটা আমাদের শৈশব।

উত্তর দিকে, মানে স্কুলের ঠিক পিছনে ধুতরা গাছের  সারি। চড়কের আগে আগে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে
সাদা সাদা ধুতরা ফুল ফুটত। আমরা দুষ্টু ছেলেরা কাঁটা কাঁটা ধুতরা ফল ছুড়তাম একে অপরের দিকে। কখনো বা কারুর মাথায় চিরুনির মতো টেনে দিতাম। বিশেষত বান্ধবীদের লম্বা চুলে। তারপর যা হওয়ার তাই হতো। ভানু মাস্টার মশাইয়ের অনিবার্য বকুনি।

স্কুলের একদম সামনে রাস্তা লাগোয়া বট গাছ। বটের ছায়ায় কলতলা। পাশের দুটো গাঁয়ের বধূরা পানীয় জল আনতে ভিড় করত পড়ন্ত বিকেলে কিংবা সাঁঝের বেলায়। একদিকে রাস্তা আর একদিকে ধানের খেত। স্বাভাবিক কারণেই বনস্পতিটি খুব বেশি বিস্তার লাভ করতে পারে নি। তবে তার অজস্র ঝুরি নেমে এসেছে মাটি পর্যন্ত। আর সেই ঝুরি ধরে ঝুলতে ঝুলতে কেটেছে আমাদের অনাবিল আনন্দের শৈশব।

বর্ষাকালে সবচেয়ে বেশি মজা পেতাম আমরা। বৃষ্টি জমা জলে ভাসিয়ে দিতাম কাগজের নৌকা। স্কুল খুলত  সকাল এগারোটার সময়। আর আমরা পৌঁছে যেতাম দশটার আগেই। পুরো একঘন্টা গাছে ওঠা, দৌড়ঝাঁপ, খেলাধুলা। বউ বাসন্তী খেলতে খেলতে পাশের ধান জমিতে পড়েছি ও অনেক বার। প্যান্ট ভিজেছে, জামা ছিঁড়েছে। জল কাদা যে কত বার মেখেছি সে হিসেব না করাই ভাল। আসলে এই ডানপিটে ছেলেগুলোর কতই না অত্যাচার সহ্য করেছে আমাদের পাড়া প্রতিবেশী, স্কুলের শিক্ষক মহাশয় আর স্কুল সংলগ্ন গাছ পালা তার ইয়ত্তা নেই।

স্কুলে তিনজন শিক্ষক মহাশয় ছিলেন। ভানুবাবু আমাদের জীবনের ভিত গড়তে বর্ণপরিচয় পড়াতেন সুর করে পড়াতেন ধারাপাত। দ্বিতীয় শ্রেণীর অঙ্ক বোঝাতে ভানুবাবু বলতেন, 'জীবনে যত জটিল অঙ্কের সমাধান করতে হোক না কেন যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ ঠিক মতো শিখলেই যথেষ্ট।" আজও সেই অমোঘ সত্য উপলব্ধি করি জীবনের প্রতি পদে। রবীবাবুর তৃতীয় শ্রেণীর ক্লাসে প্রথম ইংরেজি অক্ষরের সঙ্গে আমাদের  পরিচয় করান। যদিও আমাদের পাঠক্রমে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ইংরেজি ছিল না। বেতের ব্যবহার যথেষ্ট করতেন বলেই খুব ভয়ে ভয়ে থাকতাম সারাক্ষণ। বিষ্ণুপদ বাবু চতুর্থ শ্রেণীর পাঠক্রমের সাথে সাথে বিভিন্ন বই থেকে গল্প পড়ে শোনাতেন। কখনো কখনো শোনাতেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত। শরৎচন্দ্র চেট্টাপাধ্যায়ের লালু গল্পের ধারাবাহিক পাঠ তন্ময় হয়ে শুনতে শুনতে কোথায় হারিয়ে যেতাম আমি ঠিক জানি না। তবে দুষ্টুমির নতুন নতুন ধারনা পেয়ে যেতাম। আর তৎক্ষণাৎ প্রয়োগ করার অদম্য ইচ্ছা পেয়ে বসত সকলেরই। জয়দেব, মহাদেব, তাপস, মঙ্গল, সনাতন এই নিয়ে ছিল আমদের বদমাশ কোম্পানি। কেন জানি না বন্ধুত্বের অটুট বন্ধন ছিন্ন করে সনাতন অকালে হারিয়ে গেল চাঁদ তারার দেশে! হয়তো ওর আত্মা আজও ঘুরে বেড়ায় আমাদের শৈশবের বালুচরে।

বাবা এবং পাড়ার কাকু-জ্যেঠুদের কাছে শোনা , আমাদের গ্রামে নাকি কোনো ইস্কুল ছিল না। অনেক দুর হেঁটে হেঁটে সঙ্ঘের স্কুলে যেতে হত তাঁদের। আর বর্ষা কালে এক হাঁটু কাদা। ভয়ংকর দুর্গম সে পথ।
তাই কিছু শুভানুধ্যায়ী মানুষ আমাদের গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা করেন। আমাদের পাড়ার অন্যতম প্রতিপত্তি সম্পন্ন পঞ্চানন( স্বর্গীয়) জ্যেঠু প্রয়োজন মাফিক জমি প্রদান করেন । অন্যান্য অনেকই গাদার খড়, ঝাড়ের বাঁশ এবং শ্রম দিয়ে মাটির স্কুলবাড়ি নির্মাণ করেন। কয়েক বছরের মধ্যেই ঝড়-বৃষ্টির কারণে মাটির বাড়ি ভেঙ্গে পড়ে । আমি তখন শিশু শ্রেণীর ছাত্র । বাবা-কাকু-জ্যেঠুরা হাল ছাড়লেন না। কয়েক দিনের মধ্যেই বাঁশের কাঠামো আর টালির( বর্তমানে টাইলস বলতে যা বোঝায় তার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলবেন না) ছাউনি দিয়ে অস্থায়ী শ্রেণী কক্ষের ব্যবস্থা করলেন। গ্রাম পঞ্চায়েতে এবং বিডিও অফিসে পাকা স্কুলবাড়ি নির্মাণের আবেদন ও করলেন । কিন্তু, তা সময়সাপেক্ষ। আপাতত কাদা মাটির প্রলেপ দেওয়া ক্লাস ঘরেই আমরা মাদুর আর চাটাই পেতে বসতাম । বৃষ্টি পড়লে আমরা যতটা মজা পেতাম, শিক্ষক মহাশয় আর অভিভাবকদের দুশ্চিন্তা ততটাই বেড়ে যেত। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো পরের বছর বন্যায় ভেসে গেল সেই স্কুল বাড়ি।
কিন্তু, তাতেও কেউই একটুও দমলেন না। আমাদের অভিভাবক বৃন্দ সমবেত ভাবে সিদ্ধান্ত নিলেন করঞ্জা  তলাতেই স্কুল চলবে। শিক্ষক মহাশয়গণ ও বন্যার জল পেরিয়ে স্কুল চালু রাখতে মরিয়া হলেন। টানা চার-পাঁচ মাস গাছতলায় বসে আমরা স্কুল করলাম। রোদ বৃষ্টি মাথায় নিতে আমরা কেউ একটুও কষ্ট অনুভব করি নি। পরের শীতেই শুরু হল নতুন স্কুল বাড়ি নির্মাণ। এ বার কিন্তু ইঁটের। তার পরেও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। লাইব্রেরি ও বেশ সমৃদ্ধ এখন। আমাদের সময়ের শিক্ষক মহাশয়গন ও কর্ম জীবন থেকে অবসর নিয়েছেন। এসেছেন নতুন শিক্ষক বৃন্দ। প্রতি বছর কত না নতুন ছাত্রছাত্রীরা স্কুলে আসে, জীবনের ভিত গড়ে তারা আজ বিভিন্ন ভাবে প্রতিষ্ঠিত।
উচ্চ শিক্ষা এবং কর্ম জীবনের কারনে আমার সে ভাবে আর গ্রামে থাকা হয় না। তবে, প্রায়ই বাড়ি যাই। আর বাড়ি গেলেই পায়ে পায়ে চলে আসি স্কুলের সামনে। করঞ্জা গাছগুলো আর নেই। কলতলা সরে গেছে একটু দূরে। আর সেই বটতলায় বসে এক বুক প্রশান্তির শ্বাস নিই। জীবনের জ্যামিতিক ছেদ বিচ্ছেদ ভুলে, সময়ের অস্থিরতা কাটিয়ে আমি ফিরে যাই আমার শৈশবে।

6 comments:

  1. অত্যন্ত মনের ভেতরের কথা বেরিয়ে এসেছে । পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে দেখাটাই হল আসল কবিতা । খুব সুন্দর লাগলো ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আন্তরিক ধন্যবাদ।

      Delete
  2. Very good. Pharmacy r din guli kemon chhilo Akbar mane kar. Akhan kothay acchis?

    ReplyDelete
  3. আন্তরিক ধন্যবাদ

    ReplyDelete