Monday, May 4, 2020

দেবযানী গাঙ্গুলী



স্মৃতিচারণা-  
 ফিরে এসো শৈশব
    
         জনারণ্যের মাঝেও যখন আকাশের ফিকে নীল পর্দাটা সরিয়ে একান্তে নিজেকে ফিরে দেখার চেষ্টা করি, তখন কোন্ সুদূরের ওপার থেকে টালমাটাল পায়ে ছুটতে ছুটতে হঠাৎ উড়ে আসে একচিলতে শৈশব -কৈশোর । বিশ্বায়নের ছোঁয়াচ বাঁচা আমার একচিলতে মেয়েবেলা....আজকের বাংলা থেকে প্রায় হারিয়ে যাওয়া ছোট্ট চড়াই পাখির মতোই কোমল -চঞ্চল -ভীরু সেই নিজের প্রতিবিম্বকে দূরে যেতে যেতেও ছুঁয়ে থাকতে চেষ্টা করি একান্ত ভালবাসায়।
                       
                  চাকরিরতা মায়ের তৃতীয় কন্যাসন্তান ...শেষ শ্রাবণের ধারার সাথে যেদিন পৃথিবীর আলো দেখলাম, পরিবারেও ধারাবর্ষণ । রান্না দূরের কথা, আমার জন্মের শোকসংবাদে ঘরে সেদিন টাটকা জলটুকু ভরা হয়নি ।  দুই দিদির নামের আদ্যক্ষর আর আমার নামের প্রথমে ব্যবহারের সৌখিনতা দেখায়নি পরিবার । আমার মুখেভাতে মামা নন, ভাত খাইয়েছেন বাবা ....এসব গল্প শুনে একরত্তি মেয়ে বুঝে নিয়েছিল আমি কতটা অনাহূত ।আদরের অভাব অনুভব না করলেও আমাকে কিছু চাইতে নেই, আমাকে কিছু আশা করতে নেই এমন একটা ধারণা বদ্ধমূল হয়েছিল নিজের অজান্তেই । তার সাথে ছিল রুগ্ন শরীর । বছরে অধিকাংশ সময়ই শয্যাশায়ী । বুলি ফোটা থেকেই কবিতায় আগ্রহ । দু'বছর বয়সে অসুখে ট্যারা আর তোতলা হয়ে গেলাম।আধোবুলিতে ছড়া বলার আনন্দটুকুও ঈশ্বর কেড়ে নিলেন ....তোতলামিতে  বহু চেষ্টায় মুখ লাল করেও কথা, কবিতা বেরোতো না .... সে সঙ্গে অসম্ভব ট্যারা চোখের কারণে মুখ তুলে তাকাতে লজ্জা ....ফলত, বড়ই মুখচোরা আর লাজুক সে মেয়েবেলা ।

                   বাড়িতে ছিল গানের পরিবেশ, আমার মধ্যে আছে এক সহজাত ছন্দবোধ । মনের মাটিতে ছন্দের এই সরসতা গড়েছিল সঙ্গীত । সেকালে ঘরে ঘরে দূরদর্শন ছিল না, প্রতি শনিবার সন্ধ্যায় ছাদে গানের আসর বসত ।ততোদিনে তোতলামি থেকে আরোগ্য লাভ ঘটেছে, কথায় -গানে -কবিতায় - তবলায় -বাঁশিতে -ছাদের টবে ফোটা রজনীগন্ধা -বেলিফুলের সুগন্ধে সেসব সন্ধ্যা শৈশব স্মৃতির সম্পদ । ছ’বছর বয়সে এই কবিতা -গানে কর্ষিত মনের মাটিতেই আমার  প্রথম কবিতার জন্ম ...
                        
                           বাড়িতে ঠাকুমা ছিলেন, অসম্ভব সূক্ষ্ম তাঁর হাতের সেলাই।সারা দুপুর নকশী কাঁথা সেলাই করতেন ।এখনো সযত্নে রাখা আছে সেই সব অমূল্য ঐতিহ্য। গল্প বলতেন সেলাই করতে করতে ।দুপুরে দিদিরা স্কুলে, বাবা -মা অফিসে । আমি জানলায় বসে সামনের খোলা আকাশের বুকে মেঘের কারুকাজ দেখতাম । ঘড়ি দেখে আঙুলে করগুণে হিসাব করতাম আর কত ঘন্টা পরে মা বাড়ি আসবে । ঘরের লাল মেঝেতে মাঝে আর পাশে দেয়ালের ধারে ছিল কালো রঙ । একলা থাকা লাফালাফির দুপুরে কল্পিত বন্ধুদের সাথে চলত কুমীরডাঙা খেলা ।মেঝের লাল রঙে জল আর কালোতে উঠে পড়া মানেই ডাঙার নিরাপত্তা । বর্ষার বিকেলে খেলার অঙ্গ ছিল কাগজের নৌকা বানিয়ে ভাসানো ।কাগজ দিয়ে আর একটা জিনিস বানিয়ে অনির্দেশের দিকে ছুঁড়ে মারতাম, সেটা হলো 'এরোপ্লেন ' ....যদিও সেই প্রয়াস খানিকদূর উড়ে মুখ থুবড়ে পড়ত। তবু পরম উৎসাহে পরবর্তীটা বানাতাম তার ভবিষ্যত আর একটু ভাল হবে সেই প্রত্যাশায় । ভালবাসতাম ছবি আঁকতে, কল্পনা মূর্ত হতো ।  

           আমার ঠাকুরদা বাবার খুব ছোটবেলাতেই গত হয়েছিলেন ।তাঁকে আমি চোখে তো দেখিনি,কিন্তু তাঁর নামটা নিয়ে ছোট্ট আমি খুব বিড়ম্বনায় পড়তাম । ওনার নাম ছিল শিবচরণ মুখার্জী । আমাদের বাড়িতে এক মিস্ত্রি কাজ করেছিল, তার নাম ছিল কালীপদ । আমার শৈশবে একজন আমাদের বাড়িতে কাজের জন্য এসেছিল বাংলাদেশ থেকে, বলেছিল তার বাবার নাম শিবপদ ভট্টাচার্য । এবার এই শিব -কালী -পদ -আর চরণ সবকিছু তালগোল পাকিয়ে আমি কিছুতেই নিজের ঠাকুরদার নামটি যথাযথ মনে করতে পারতাম না । ওনার নাম শিবচরণ মুখার্জী নাকি কালীচরণ মুখার্জী অথবা শিবপদ মুখার্জী এ নিয়ে আমার ঘোরতর সংশয় তৈরী হতো  (পদ আর চরণ যে সমার্থক সেই জ্ঞানটুকুও এই নামসমস্যার মূলে আমাকে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে ফেলত )। আর তাই আমাকে লোকসমক্ষে ঠাকুরদার নাম জিজ্ঞাসা করে দিদিরা রসিকতা করতে ছাড়ত না ।মনে পড়ে পড়া মুখস্থ করার মতো কত চেষ্টা করে যথাযথ নামটা মস্তিষ্কে গেঁথে ফেলার আপ্রাণ প্রয়াস চালিয়েও বারবার .. শিবচরণ বলে জিভ কেটে কালীচরণ আবার ঢোক গিলে কালীপদ বলে শিবপদ কিনা প্রশ্ন করেছি প্রশ্নকর্তাকেই ।

              বাবার হৃদয় ছিল স্নেহের সাগর । প্রতিদিন ভাত মেখে বাবা নিজে খেয়েই মেয়েদের মুখে ভাললাগা স্বাদের ভাগ দেবার জন্য ডাকতেন । মা বকতেন, বাবার ভাগে ভাগ বসাচ্ছি বলে, কিন্তু আমরা ঘুরঘুর করতাম ঐ ভালোবাসার দলাটুকুর আস্বাদ নেবার জন্য । কোলের মেয়ে বলে আমি বছর দশেক বয়স পর্যন্ত মা বসলে মায়ের কোল ছাড়া কোথাও বসতাম না ।  রকমারি রান্না, পিঠে পুলি, আচার এমনকি সস, জেলি ইত্যাদিও মা ঘরে বানাতেন ।শীতকালে গাছের পাকা চালকুমড়ো বেটে বড়ি দিতেন মা । ধান - দুর্বা মাথায় দিয়ে, সিঁদুর পরিয়ে উলু দিয়ে প্রথমে বড় দুটো বড়ির বিয়ে দিয়ে শুরু হতো 'বড়িহাত'  করা । অক্ষয়তৃতীয়াতে মা করতেন কাসুন্দি । কী অপূর্ব তার স্বাদ -গন্ধ! আজ এই লকডাউনের সময়ে মাঝে মাঝে মনে পড়ে ইন্দিরা গান্ধী হত্যার পর আসানসোলে টানা কার্ফুর দিনগুলোর কথা। দিনের একটা সময় কয়েকঘন্টা একশো চুয়াল্লিশ ধারা জারি হতো, আবার কার্ফু। তখন খুব ছোট, তবু মনে আছে সে সময়ে মা আলুর খোসা ফেলতেন না। কালো জিরে কাঁচালঙ্কা ফোড়ন দিয়ে পোস্ত ছড়িয়ে মচমচে আলুর খোসা ভাজা হতো। অপূর্ব তার স্বাদ। দোকানপাট বন্ধ, দুটো ডিম দিয়ে বড়া করে তরকারি করতেন মা... ছ'জনের তাতেই তৃপ্তি আমিষ খাবার তো পাওয়া গেল!

                  অনেকটা বড় বয়স পর্যন্ত বাড়ির দেওয়ালে টাঙানো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবিতে ভক্তিভরে প্রণাম করে কত প্রার্থনা জানিয়েছি ....তিনি যে অন্য দেবতাদের থেকে কিছুমাত্র আলাদা --এমন ভ্রম আসেনি কখনো । তবে এই ঠাকুর যে কবিতার ঠাকুর সেই জ্ঞানটুকু ছিল কবিতা মুখস্থ করার সুবাদে । অষ্টম শ্রেণীতে পড়তে পঁচিশে বৈশাখে তাঁকে প্রণাম করতে করতে বলেছিলাম --

        "আমি কভু চাইনা হতে তোমার সমতুল
         অতি তুচ্ছ আমি, তোমার প্রতিভা অতুল
         আজকে শুধু দাও গো আমায় আশীর্বাদ তোমার -
         হে মহামানব! তুমি নাও গো প্রণাম আমার ।"

তখন যদিও মানুষ রবীন্দ্রনাথকে চিনতে শিখেছি ।

               জীবনের তার কখনো কড়ি, কখনো কোমলে বাঁধা ।কৈশোরেই চোখের ত্রুটি দূর হয়েছে, শরীর সুস্থ হলে নিজেকে মেলে ধরতে শিখেছি । স্বভাবত ভাবুক আর রোমান্টিক মেয়েটা এক্কা-দোক্কার তালে তালে কখনো নেচে উঠেছে সহচরীদের সাথে ,কখনো মেঘলা মনে জল সইতে গেছে তিতাসের ধারে, দীঘি থেকে কলসে জল তুলে আনার থেকে আকাশে ঠোঁট মেলে দীঘি হওয়াতেই তার চিরদিনের সুখ -- শ্রাবণী বৃষ্টির সাথে যেমন তার পৃথিবীতে আসা, তেমনই শান্তির বারিধারায় সে সবুজ বনান্তে মিশে গেছে মনে মনে । অর্থ খুঁজেছে পাখির কাকলির । কখনো মেঘ হয়ে ঝরেছে ঊষরে, কখনো গাছ হয়ে দিয়েছে বন্ধুত্বের আশ্রয় ,কখনো মাধবীলতা হয়ে চেয়েছে ফুল ফোটানোর আশ্বাস --- এভাবেই পায়ে পায়ে মেয়েবেলা পার হয়ে নারী হয়ে ওঠা । সংসার -সন্তান - কর্মজীবনে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার !

        প্রাত্যহিকতার অভ্যাস যখন অলসতার আসন বিছায় , জীবনের অভিনয়ে যখন ক্লান্তির আবছায়া ঘেরে মননে, সেই প্রায়ান্ধকার অস্বচ্ছতার ঘোরে আজও ফিরে পেতে চাই আমার ছোট্ট আমিকে। আপন মনে বলি ---

ফিরে এসো শৈশব আহ্লাদি দিন
পালতোলা ইচ্ছেরা স্বপ্ন রঙিন ...
ফিরে এসো ধূপছায়া ঝিকিমিকি গান
চাঁদের পাহাড় ঘেরা রূপকথা স্নান ।

ফিরে এসো ফ্রক দিন, লুকোচুরি বেলা
স্কুল থেকে ফিরে ছুট্,  কিত্কিত্ খেলা...
স্কুল গেটে বনকুল, আলুকাটা ঝাল
অল্পেতে খুশি মন-- সবুজ সকাল ।

ফিরে গেছে 'আড়ি' আর চোখমুছে 'ভাব'
জীবন বদলে দিল পুরোনো স্বভাব ।
বাসি মালা গেঁথে পরি নতুনের ছলে
মনের আড়াল গড়ি প্রতি পলে পলে ।

ঝরে যায় ঝাউপাতা , বৈকালী ফুল
অবিরত পথ চলা, বাঁকে তবু ভুল ...
অবকাশ মুছে গেছে, জীবনের দায়
বসন্ত দ্বারে এসে একা ফিরে যায়।

No comments:

Post a Comment