Monday, August 15, 2022

আমাদের পদক্ষেপ পরিবার আয়োজিত বিশেষ ইভেন্ট "স্বাধীনতা"

 

বহু রক্তক্ষয়ের পর স্বাধীনতা পেয়েছিলাম আমরা ৷ ঘটেছিল দেশ বিভাজন ৷ রাজনীতির পাশাখেলায় তারপর থেকে আমরা অর্থাৎ আম জনতা নানাভাবে পিষ্ট হতে হতে হয়তো আজ 'স্বাদহীন'ভাবে স্বাধীন রয়েছি ৷ এই স্বাধীনতা কতখানি পরাধীনতা থেকে মুক্তি আর কতখানি ক্ষমতার হস্তান্তর তা নিয়েও রয়ে গেছে বিতর্ক ৷ তবু আজকের দিনটা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ৷ তাই এই দিনটাকে উদযাপন করতে দেশজুড়ে গৃহীত হচ্ছে নানা কর্মসূচি ৷*

*আমাদের পদক্ষেপ পরিবারের পক্ষ থেকে আজকের দিনে পরিবারের সকলকে জানাই আন্তরিক শুভকামনা ৷ পূর্বঘোঘণা অনুযায়ী আজ আমাদের এই পরিবারের যৌথ দেওয়ালে আয়োজিত হবে বিশেষ ইভেন্ট— "স্বাধীনতা" ৷ ইতিমধ্যে আপনাদের পাঠানো লেখাগুলো আমরা একে একে পোস্ট করব এখানে ৷ সেই ধারাবাহিকতা যেন ক্ষুণ্ণ না হয়, সেজন্য ইভেন্ট চলাকালীন গ্রুপটি অনলি অ্যাডমিন করে রাখা হবে ৷ আপনাদের অনুরোধ, ধৈর্য রাখবেন ৷ সাথে থাকুন ৷* 

----+++---
স্বাধীনতা-৮৫
 ছাই
আর্যতীর্থ


ভোরের কুয়াশা মেখে একটা বিশাল মিছিল পথে নেমেছে।
নানা ভাষা নানা বেশে স্লোগান দিচ্ছেন যারা, তাঁদের দিব্যি চেনা যায়
কারোর মূর্তি আছে যত্নে সাজানো, কারোর  দেখেছি ছবি হিস্ট্রির বই-য়ে, 
আর আরো অনেককে  সেলুলার লাহোর ও আলিপুর জেলে ভারাক্রান্ত নামের তালিকায়। 
আজ তিয়াত্তর বছর স্বাধীনতা অতিক্রান্ত করে, কেন যেন ওরা নেমে এসেছেন অকস্মাৎ জীবিত পৃথিবীতে!
আর কি অদ্ভুত ,অলৌকিক মিছিল চলেছে এক আশ্চর্য শ্লোগান দিতে দিতে,
অগণিত অশরীরী সমস্বরে বাতাস কাঁপিয়ে বলে চলেছেন
‘ছাই চাই!  চাইনা ঠাঁই, ছাই চাই!’
কি প্রচণ্ড ক্রোধ সেই স্বরে, কি ভীষণ বিষণ্ণতা লেগে আছে মুখে,
চোখ থেকে মুছে গেছে সব রোশনাই।

মিছিলের পুরোভাগে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, পাশেই সুভাষ চন্দ্র বোস হাঁটছেন,
কি আশ্চর্য, তাঁদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ক্ষুদিরাম, তিন যতীন ,
মাস্টারদা সূর্য সেন..
আমি কি ভুল দেখছি? চোখ কচলে আবার দেখি হেঁটে যাচ্ছেন নেহরু, প্যাটেল, খান আব্দুল গফফর খান,
তাঁদেরই পাশে ভগৎ সিং আসফাকুল্লা খান চন্দ্রশেখর আজাদ,
সংগ্রামে কখনো ছিলোনা যাদের সহাবস্থান,
তাঁরাই আজকে মিছিলে এক! চিত্তরঞ্জন দাসের পাশাপাশি মানবেন্দ্র রায়, বাল গঙ্গাধর তিলক হাঁটছেল কানাইলালের সাথে,
সকলে দৃপ্তস্বরে তোলেন সেই একই স্লোগান, মুখগুলো বেঁকে যাচ্ছে অবর্ণনীয় কোনো যন্ত্রণাতে,
‘ছাই চাই! চাইনা ঠাঁই, ছাই চাই!’
আরো ভালো করে দেখার জন্য, ভাবলাম একটু সামনে যাই।

আমাকে দেখেই , শ্লোগান থামিয়ে ঘিরে ধরলেন ওঁরা। ‘পাওয়া গেছে, উত্তরস্বাধীনতা ভারতের এক নাগরিক’..
দুচারজন সংগ্রামী তখনো সন্দিহান, প্রফুল্ল চাকি বলে উঠলেন ‘কাগজপত্র দেখে নিয়েছেন তো ঠিক,
শুনেছি পঞ্চাশ বছরে তামাদি নথিতে অতীত না দেখা গেলে নয়-নাগরিক বলে ডাকে আজকাল’
মাতঙ্গিনী হাজরা আর প্রীতিলতা ওয়াদেদার একসাথে বিলাপের সুরে বলে উঠলেন ‘ কপাল, কপাল!’
‘সেই সব পরে হবে, আগে জিজ্ঞেস করি ওকে, দাঁড়াও’। আমার সামনে বাঘাযতীন সীমান্ত গান্ধী আর সূর্য সেন,
রুষ্ট মুখগুলো হতাশা ও বিষাদে মাখামাখি
‘আমাদের চোখে চোখ রেখে বলো, যে ভূমি স্বাধীন করতে আমরা লড়েছি,
তার খণ্ডরা পরস্পরের সাথে লড়ছে এখন। তাহলে আমরা কাকে দেশ বলে ডাকি?’

‘ওসব এখন থাক’। তীব্র গলার স্বরে ঘুরে দেখি বলছেন নাকামুরায়ার বসু ওরফে রাসবিহারী,
‘ত্রিবর্ণ উড়িয়ে এই এতগুলো বছরে কি স্বাধীনতা পেলে ব্যাখ্যা শোনাক ও তারই,
আগে ইংরেজ আর এখন ওপরে ওঠা কিছু নেতা ও ব্যবসায়ীর গোলাম রয়ে গেলো দেশটা,
এটা সেই স্বাধীনতা নয়, এই অগণিত লোক প্রাণ বাজি রেখে যার করেছে প্রচেষ্টা,
এই ভুয়ো স্বাধীনতা পুড়ে যাওয়া ভালো। আজাদির নামে এই ভণ্ডামী এখন সহ্যের ছাড়িয়েছে সীমা,
দেশ মানে চেতনা, সকলের ভালো থাকা সমানে সমানে, তোমরা ভেবেছো কিছু অক্ষ দ্রাঘিমা!’

অমনি সকলে মিলে আবার শ্লোগান.. ‘এ ব্যর্থ স্বাধীনতাপোড়া ছাই চাই! এই ধর্ষণখুন , জাতিদাঙ্গায় পেছনের দিকে যাওয়া ভূমি আমাদের নয়!’

আমি স্বপক্ষে কিছু বলবার আগেই , স্বপ্ন ভেঙে যায়।
অতীতের অগণিত সংগ্রামী মুখে স্বপ্নচ্যুতির শ্লোগান পাখার ঘড়ঘড় আওয়াজে মেলায়।

শুধু  কুয়াশার মতো ঘন হয়ে রয়ে গেলো ভয়।
-------------------------
স্বাধীনতা-৮৬
স্বাধীনতা
নির্মলেন্দু কুণ্ডু

আরো একবার আকাশে উড়বে তেরঙা
সগর্বে...
বিশ্লেষিত হবে অতীত,
পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে উঠে আসবে
যত কাসুন্দি...
সবার বুক ও মুখে থাকবে একটাই নাম৷
অথচ তার ফাঁকেই
নিঃশব্দে ঘটে চলবে কিছু ব্রেকিং নিউজ,
পরাধীন হতে থাকবো আমরা
আমাদেরই হাতে!
সবাই সোল্লাসে চিৎকার করছে,
তবু কোথাও যেন একটা খবরদারি—
"চুপ,আমরা স্বাধীনতা মানাচ্ছি!!"
----------------- 
স্বাধীনতা- ৮৭
অভাগিনী
আর্যতীর্থ

তখন ভোর হচ্ছে, দু হাজার বাইশের পনেরোই আগস্টের ভোর ।
কিছুক্ষণ বাদেই তেরঙ্গা পতাকার ঢল নামবে রাস্তাঘাটে।
স্টেজে স্টেজে নির্ঘুম শেষমুহূর্তের প্রস্তুতি চলছে জোর।
 তবে আপাতত, কয়েকটি শ্রান্ত শ্রমিক ছাড়া কেউ নেই তল্লাটে।
প্রায়ান্ধকার পথ ধরে হেঁটে আসছিলেন তিনজন আবছা মানুষ
দুজন ধুতি আর শার্ট, আর একজন সাহেবী টুপিসহ স্যুট,
শুনশান পথ ধরে ইতিউতি চাইছেন তিনজন দৃপ্ত পুরুষ,
বড় বড় বাড়ি আর চওড়া রাস্তা দেখে কিছু যেন অপ্রস্তুত।
চায়ের দোকানে সবে প্রথম কেটলিজল টগবগে ধোঁয়া উগরায়,
এ দৃশ্য তাঁদের চেনা; অতীতের বহু প্ল্যান এমনই দোকানে হতো বটে।
তিনজন বসে যান ফাঁকা বেঞ্চিতে। অবাক দোকানী তার নজর ঘোরায়,
মান্ধাতা আমলের এমন পোশাকে লোক তার এখানে কদাচিতই জোটে।
টাকপড়া ধুতি শার্ট , দোকানীকে দিতে বলেন চা। তারপর  প্রশ্ন করেন ধীরে ধীরে,
' আজ কি এখানে কোনো উৎসব হবে নাকি ,চারদিকে জমকের সাজ?'
দোকানী অবাক হয়, লোকগুলো মঙ্গল গ্রহ থেকে উড়ে এলো কি রে,
ঈষৎ বিরক্ত মুখে চা ছাঁকতে ছাঁকতে বলে, যাত্তেরি, স্বাধীনতা দিবস যে আজ!
' স্বাধীনতা! কাঙ্খিত স্বাধীনতা! , তিনটে আকুল স্বর সোচ্চারে বলে ওঠে,
'শোনাও শোনাও বন্ধু, কবে হলো? কতদিন ধরে দেশে ইংরেজ নেই আর, শুনি,বলো, বলো!
দোকানী প্রমাদ গোনে। উন্মাদ নাকি এরা? নাকি সব ভুলে গেছে খোয়ারির চোটে?
তবুও ধৈর্য্য রেখে , কিঞ্চিৎ হেসে বলে, নয় নয় করে আজ পঁচাত্তর হলো।
' তার মানে কলকাতা স্বাধীন? স্বাধীন তবে নদীয়া, কুষ্টিয়া, বালাসোর....'
বক্তা অন্য ধুতি শার্ট, কোঁকড়ানো চুল, পেশীবহুল চেহারা, বিহ্বল দৃশ্যত।
'সে তো বটেই,' দোকানী বলে। পুরো ভারতই স্বাধীন, কিন্তু কুষ্টিয়াকে আনলেন কেন এর ভেতর?
' কুষ্টিয়া নয়?' টাকমাথা বললেন, ' চট্টগ্রাম , ময়মনসিংহ, ঢাকা আজও তবে ব্রিটিশের পদানত?'
দোকানী বুঝতে পারে, অতীতেই আটকিয়ে থেকে গিয়েছেন কোনো ভাবে তিন খাপছাড়া।
' ওরাও স্বাধীন, তবে ভারতবর্ষ নয়। ও জায়গাগুলো বাংলাদেশে অধুনা।'
কেমন অবাক হয়ে, নির্বাক চোখে ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে থাকেন তাঁরা।
এতক্ষণ চুপ থাকা স্যুট টুপি বলেন, 'লাহোর বা অমৃতসর নিয়ে আছে কিছু শোনা?'
বাকিদের না চিনলেও, দোকানি ফেলেছে চিনে স্যুটটুপিকে। বহুবার বহু ছবি দেখে।
নিজেকে চিমটি কাটে, এও কি সম্ভব, স্বয়ং ভগৎ সিং বলছেন এসে কথা চায়ের দোকানে?
বাঘাযতীন ...সূর্য সেন.... ইতিহাস বই থেকে বাকি দুজনকেও চেনে একে একে,
অস্ফুট স্বরে বলে, 'অমৃতসর ভারতে হলেও, লাহোর অন্য দেশ, ওটা পাকিস্তানে।'
চোখ চাওয়াচাওয়ি করেন তিন বিপ্লবী। যে স্বাধীনতার জন্য তাঁরা জীবন দিলেন,
সেটা কোন দেশের? কোথায় তাঁদের সেই সোনালী স্বপ্ন দেখা অখণ্ড ভারতবর্ষ?
'এই তিনটুকরো স্বাধীনতা আমরা চাইনি!' হাহাকার করে কাঁদেন বাঘাযতীন, ভগৎ সিং , সূর্য সেন,
দিগন্তে তখন প্রথম সূর্যকিরণ, অভাগিনী ভূমির মাথায় দিলো কোমল সান্ত্বনাস্পর্শ...
------------------------ 
স্বাধীনতা- ৮৮
স্বাধীনতা
কৃষ্ণা পাল রায়

স্বাধীনতা তুমি কোথায়?
ফুটপাথের ঐ ময়লা বিছানায়, 
না, সুখ কবিদের সুখের কবিতায় ।

স্বাধীনতা তুমি কোথায়?
শ্রমিক কৃষকের রক্তঝরা ঘামে, 
না,  স্বেচ্ছাচারিদের হাতে থাকো নির্দ্বিধায়।

স্বাধীনতা তুমি কোথায়?
খুঁজছে নারী অসহায়, 
যেখানে ধর্ষিতা বিচার চায়।

তুমি কি আছো না পাওয়াদের  মিছিলে?
তুমি কি আছো মায়ের শীতল আঁচলে!
তুমি কি আছো যেখানে ছুটছে মানুষ পেটের টানে?
তুমি কি আছো চিন্তনে মননে শিক্ষণে!

তুমি কি সেই বুলেট বোমা আগুন রক্তমাখা স্বাধীন হবার স্বাধীনতা ?

স্বাধীনতা দে জ্বেলে দে বুকের ভেতর আবার দ্রোহের আগুন।
---------------------- 
স্বাধীনতা- ৮৯
মুক্তি
দেবব্রত ঘোষ মলয়

হারাধন আজ সকাল সকাল বাড়ি ফিরেছে। ভাঙাচোরা আলকাতরার টিনের দরজা ঠেলে এক চিলতে উঠোনে প্রবেশ করে হারাধন। পাঁচ ইঞ্চি ইটের দেওয়ালে টালির চালের ভাঙাচোরা বাড়ি তার। হারাধনের বউ শেফালী পাঁচ বাড়ির কাজ সেরে বাড়ি ফিরে দাওয়ায় বসে তাওয়ায় রুটি বেলছে। এত তাড়াতাড়ি হারাধনকে আসতে দেখে চোখ কুঁচকে তাকায় তার দিকে। বলে - ব্যাপারটা কি আজকে কি কোন ভাড়া পত্তর পাওনি?
মুচকি হেসে হারাধন বলে - আজ ভালোই হয়েছে ভাড়া। একজন পাঞ্জাবি পড়া বাবু অনেকগুলো বই নিয়ে রামতলায় কলেজে গেলেন। ওখানেই তো একশ টাকা পেয়ে গেলাম। তারপর দু তিনটে খুচরো ভাড়া পেলাম। কোথাও কিচাইন হয় নি রে। তারপর এইবিকেলে আমাদের নেতা বাবু উঠেছিলেন রিক্সায়। আজ দেনাকে বেশ খুশি খুশি লাগছিল। বাবু দেখতে তো সুন্দরই, পাট ভাঙ্গা পাজামা পাঞ্জাবিতে আরও ভালো লাগছিল। আমার সাথে অনেক গল্প করলেন। বললেন - আগামীকাল আমরা দুর্গাপুজোর মাঠে পতাকা উত্তোলন করব। এবার আমরা সমাজের নিপীড়িত কিছু মানুষকে সম্মানিত করবো। তুই কিন্তু একদম ভোর ভোর উঠে স্নান করে পরিষ্কার জামা কাপড় পড়ে দুর্গাপুজোর মাঠে চলে আসবি।
শেফালী হারাধনের মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে বলে - এই নিপীড়িত মানুষটা কি রে?
হারাধন হাত উল্টিয়ে বলে - কে জানে ওসব বাবুরা কি যে ভাষা বলে। তবে মনে হয় কিছু খাওয়াবে টাওয়াবে, সম্মান বলতে বোধহয় ওটাই বুঝিয়েছে। 
শেফালী দাওয়া থেকে রুটিগুলো নামিয়ে উনুনে  সেঁকতে থাকে। তারপর বলে - তা যাও। যখন নেতা বাবু ডেকেছেন। এতবার বলেও তো কই বিপিএল কার্ডটা হলো না। কাল একটু বলো তো কানে কানে যেন বিপিএল কার্ডটা করে দেয়।
হারাধন উঠোনের এক পাশে রাখা বালতির জলে হাত পা ধুতে ধুতে বলে - সে সব বলবো খন। এখন দে তো কয় খান রুটি, খুব খিদে পেয়েছে।
উনুনের পাশেই ছোট্ট দাওয়ায় কেরোসিনের আলোয় খেতে বসে হারাধন। ইলেকট্রিক বিল দিতে না পারার কারণে ছ মাস হল ওর বাড়ির লাইটের কানেকশন কেটে দিয়ে গেছে। রুটি আর আলুর তরকারি গোগ্রাসে গিলতে থাকে হারাধন। মুখরা শেফালী খাওয়ার এই সময়টায় হারাধনের দিকে মায়া ভরা চোখে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে বলে মুরদ নাইবা থাকলো সারাদিন তো খাটে মিনসেটা। আর সব থেকে বড় কথা এ লাইনে থেকেও মদো মাতাল হয়নি ও। 
ওদের কোন ছানাপোনা হয়নি। ঘরের মেঝেতে পাতা বিছানায় খাওয়া দাওয়ার পর হারাধন শুয়ে পড়ে। শেফালির আরো কিছু কাজ থাকে সেগুলো সেরে যখন ঘরে আসে তখন হারাধন গভীর ঘুমে অচেতন।
পরদিন হারাধনের ঘুম ভাঙ্গে পাখির ডাকে। ধরফরিয়ে উঠে পড়ে দেখে সকাল ছটা। এত সকালেই দূর্গা পূজার মাঠ থেকে মাইকে পাড়ার ঘোষক চিনুদার গলা শোনা যায় -  প্রিয় অধিবাসীবৃন্দ, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হবে ভারতের ৭৫ তম স্বাধীনতা দিবসের উদযাপন। আপনাদের সবাইকে দূর্গা পূজার মাঠে সত্বর চলে আসার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে।
ধরফর করে উঠে পড়ে হারাধন খুব তাড়াতাড়ি কলঘরের কাজ সেরে আসে। রাতের পড়া লুঙ্গি কেচে মেলে দেয় উঠোনের তারে। ঝটপট সেরে নেয় স্নান। দেওয়ালের ভাঙ্গা আয়নায় দিকে তাকিয়ে চুল আঁচড়িয়ে একটা ফর্সা জামা আর প্যান্ট পড়ে নেয়। গত তিন বছর ধরে এই একটাই একটু ভালো জামাপ্যান্ট আছে ওর। কোন অনুষ্ঠান বাড়িতে যেতে হলে এটাই পড়ে যায়।
শেফালী তো অনেক ভোরেই উঠেছে। তার ঘর ঝাঁট দেওয়া, বাসনপত্র ধোয়া এসব কাজ শেষ হয়ে গেছে আগেই। এখন শাড়ির আঁচলটা কোমরে জড়িয়ে ঠিকে কাজের উদ্দেশ্যে রওনা দেবার উপক্রম করছে সে। হারাধনের দিকে তাকিয়ে বলে - আচ্ছা এই স্বাধীনতা মানেটা কি বলতো? 
হারাধন বলে - স্বাধীনতা মানে ছুটি আর ফুর্তি।দেখো না সব ইস্কুল, কলেজ, অফিস, কাছারি সব জায়গায় ছুটি থাকে। পাড়ায় পাড়ায় ফিস্ট হয়। মাইকে গান বাজিয়ে কত অনুষ্ঠান হয়।
শেফালী খর গলায় বলে ওঠে - তা আমাদের তো কেউ ছুটি দেয় না। বাবুদের বাড়িতে বাসন মাজতে, ঝাঁট দিতে যেতেই হবে, না হলে পয়সা কেটে নেবে।
হারাধন বলে - এ তো যার কপালে যা লেখা আছে বউ। ছুটি তো পাবে বাবুরা। 
শেফালী হন হন করে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে -  যাও ঘুরে এসো। কি সব সম্মান টম্মান দেবে। সব বাড়ি নিয়ে এসো কিন্তু। আর হ্যাঁ, যাওয়ার আগে মনে করে সীতারামকে ছোলার বাটিটা ভরে দিয়ে যেও।
হারাধন শেফালির সংসারে তৃতীয় জন হল সিতারাম। মানুষ নয় একটি টিয়ে পাখি। হারাধনের মা যখন বেঁচে ছিল গত বছর তখন টিয়ে পাখিটা উড়ে এসে তার উঠোনে পড়ে। কেউ বোধহয় তার ডানাটা কামড়ে ধরে ছিল, ইঁদুর টিদূর হবে, পাখিটা উঠোনে পড়ে হা করে কাতরাচ্ছিল আর মুখে কোন আওয়াজ আসছিল না। হারাধনের বুড়ি মা পাখিটাকে জল দিয়ে, খাবার দিয়ে ধীরে ধীরে কিছুটা সুস্থ করে। তারপর হারাধনকে বলে দেখ হারু, আমার এই কৌটোতে কটা পয়সা পড়ে আছে। বাজার থেকে একটা খাঁচা কিনে নিয়ে আয়। আবার না হলে কোন ইঁদুর ভাম কামড়ে খেয়ে দেবে পাখিটাকে।
এতগুলো পয়সা খরচ হয়ে যাওয়ার জন্য মনটা একটু খচখচ করলেও হারাধন খাঁচা কিনে আনে পরের দিন। সেই পাখি দিনে দিনে কখন যেন তাদের পরিবারের একজন হয়ে গেছে। মা চলে যাবার পরেও পাখির যত্নে কোন খামতি নেই। নিঃসন্তান দম্পতি তাকে জল, ছোলা সময় মত খাইয়ে দেয়। পাখিও আস্তে আস্তে মুখের বোল ফিরে পেয়েছে। এখন সে শুনে শুনে বলতে পারে "সীতারাম"। 
হারাধন খাঁচার দরজাটা খুলে ছোলার বাটিটা পরিষ্কার করে এক মুঠো ভেজানো ছোলা তাতে দিয়ে দেয়। তারপর খাঁচার দরজা আটকে পাখির দিকে চেয়ে বলে - দেখ সিতু, আজ তোকে বেশি করে ছোলা দিলাম। আজ যে স্বাধীনতা দিবস।
স্কুলের মাঠে গিয়ে পৌঁছে দেখে সে এক রই রই ব্যাপার। মাঠে পাতা চেয়ারে ছেলে বুড়ো অনেকেই বসে আছে, মাইকে দেশাত্মবোধক গান বাজছে আর ধোপ দুরস্ত পাঞ্জাবি শোভিত নেতা বাবু এবং পাড়ার অন্যান্য ছেলেরা ছোটাছুটি করে সমস্ত আয়োজন করছে।
অল্পক্ষণের মধ্যেই নেতা বাবু মাইকের সামনে এলেন এবং দু চার কথা বলতে শুরু করলেন। 
"বন্ধুগণ আজ ভারতের ৭৫ তম স্বাধীনতা দিবস।। আজ এই শুভ মুহূর্তে আমরা স্মরণ করব সেইসব বীর সেনানিকে, সেই সব স্বাধীনতা সংগ্রামীদের, যারা তাদের জীবনকে বাজি রেখে ইংরেজদের আরোপিত পরাধীনতার হাত থেকে আমাদের ভারত মাকে মুক্ত করেছিলেন। আমাদের এই দেশের মেরুদন্ড খেটে খাওয়া গরিব মানুষজন। সেরকমই কিছু মানুষকে আমরা আজ পতাকা উত্তোলনের পর সম্মানিত করব। 
হাততালির ঝড় বয়ে যায় নেতা বাবুর কথায়। তারপর জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হয়। ফুল ঝরে পড়ে সবার উপর। মাঠের একপাশে দাঁড়িয়ে থাকা কিশোর বাহিনী ব্যান্ড পার্টিতে বাজাতে থাকে জাতীয় সংগীত।
এরপরই হারাধন ছাড়াও আরো চারজন ওরই মত মানুষকে মঞ্চে তোলা হয় এবং তাদের প্রত্যেককে একটা করে শাল, একটা ছোট্ট স্মারক আর কিছু জিনিসপত্রের একটা প্যাকেট দেওয়া হয়।
হারাধনের চোখের কোন বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। তার রিকশাচালক জীবনে গালাগালি লাথি ঝাঁটা ছাড়া কিছুই জোটেনি কোনদিন। সে নেতা বাবুর পায়ে নমস্কার করে। নেতা বাবু তাকে দুহাতে তুলে ধরে বলেন - দেখ, আজ আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। ইংরেজরা আমাদের সমস্ত সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে বন্দী করে রেখেছিল। কাউকে বন্দী করে রাখলে তার সমস্ত নিজস্বতা আস্তে আস্তে শেষ হয়ে যায়। তাই আজ আমরা এই স্বাধীনতাকে স্মরণ করব।
অনুষ্ঠানের শেষে মাটির এক পাশে পাড়ার ক্যাটারার মুকুলের তত্ত্বাবধানে লুচি আলুর দম আর বোঁদে তৈরি হয়েছিল। আর সবার সঙ্গে হারাধন সেখানে খাওয়া-দাওয়া করে বাড়ির পথে রওনা দেয়।
আলকাতরার টিনের দরজা ঠেলে বাড়িতে ঢোকার সময় হারাধন লক্ষ্য করে খাঁচার ভিতর সীতারাম খুব ছটফট করছে আর মুখ দিয়ে তারস্বরে চিৎকার করছে।হারাধনে এগিয়ে যায় তারপর বলে - কি হলো সিতু, চেচাচ্ছিস কেন? কাউকে দেখে ভয় পেয়েছিস? ইঁদুর টিদূর এসেছে নাকি?
সীতারামের ছটফটানি আর ট্যা ট্যা করে আওয়াজ থামতেই চায় না। তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে হারাধন বলে - ও বুঝতে পেরেছি। কাউকে বন্দি করে রাখলে তার নিজস্বতা নষ্ট হয়ে যায়। তোকে তো আমরা বন্দিই করে রেখেছি। যা আজ থেকে তুই স্বাধীন।
খাঁচার দরজা খুলে দেয় হারাধন। ডানা ঝটপটিয়ে আকাশে উড়ে যায সীতারাম।
তার উড়ে যাওয়ার দিকে লক্ষ্য রাখতে রাখতে হারাধনের চোখে পড়ে অনেক উঁচুতে স্কুলের মাঠে পত পত করে উঠছে ভারতের জাতীয় পতাকা।
--------------------------
স্বাধীনতা-৯০
বহির্ভারতে বিপ্লববাদ
নির্মলেন্দু কুণ্ডু

ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রাম এক জটিল প্রক্রিয়া ৷ বৈচিত্র্যময় এই ভারতভূমির পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের জন্য সেই ১৮৫৭-র পরবর্তীকাল থেকে বহু মুক্তিকামী মানুষ নানা বিচিত্র পথ গ্রহণ করেছেন ৷ কখনো চেয়েছেন আবেদন-নিবেদনের মাধ্যমে দাবি-দাওয়া আদায় করতে, কখনো নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধের মাধ্যমে চেয়েছেন অত্যাচারী শাসক শ্রেণীর সাথে সমস্ত যোগাযোগ ছিন্ন করতে, আবার কখনো নিজের জীবন তুচ্ছ করে নেমে পড়েছেন এক অজানা দুর্গম পথে, আনতে চেয়েছেন এক সর্বাত্মক বিপ্লব ৷ ভারতবর্ষে এই বিপ্লববাদ, যা সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদের চরমতম রূপ, শুরু হয়েছিল বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ৷ দেশের মধ্যে গড়ে ওঠা বিভিন্ন গুপ্ত সমিতি, তাদের দ্বারা প্রচারিত প্রচারপত্র, পুস্তিকা, সংবাদপত্র ও তাদের রুখতে ব্রিটিশদের সদা-তৎপরতা এটাই প্রমাণ করে যে, এই বিপ্লববাদ ব্রিটিশ প্রশাসনকে আলোড়িত করতে শুরু করেছিল ৷ আর গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো দেশের ভেতরের বিপ্লবী কার্যকলাপের পাশাপাশি তাদের যুঝতে হচ্ছিল বহির্ভারতে সংগঠিত বিভিন্ন বৈপ্লবিক কর্মপন্থার সাথেও ৷

সাধারণভাবে দেখা যায়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালীন পরিস্থিতি থেকে বহির্ভারতে বৈপ্লবিক তৎপরতা বেড়ে যায় ৷ তবে তার আগে কিছু ব্যক্তিগত উদ্যোগে বহির্ভারতে বিপ্লববাদের বীজ অঙ্কুরিত হচ্ছিল ৷ ১৮৭০ সাল থেকেই ভারতীয় ছাত্ররা ব্রিটেনে পড়াশোনা করতে যেতেন ৷ কিন্তু ব্রিটিশ শাসকদের আশঙ্কা ছিল অচিরেই এই ছাত্রদের একটা বড় অংশ ব্রিটেনেরই বিভিন্ন শহরে ব্রিটিশ-বিরোধী সংগঠন গড়ে তুলবে ৷ তাই তাদের কার্যকলাপের ওপর নজর রাখতে এক ধরণের গুপ্তচর চক্র গড়ে তোলা হয় ৷ এদের তত্ত্বাবধান করতেন উইলিয়াম কার্জন ওয়াইলি ৷ এই গুপ্তচর চক্রের কার্যকলাপ স্বাভাবিকভাবেই ভারতীয় ছাত্রদের বড় অংশকে প্রতিবাদী করে তুলল ৷ এমতাবস্থায় ১৯০৯ সালের ১ জুলাই সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-র ছাত্র মদনলাল ধিংড়া National Indian Association-র উদ্যোগে আয়োজিত ব্রিটিশ সংস্কৃতির সাথে ভারতীয় ছাত্রদের পরিচিত করানোর এক জমায়েতে উপস্থিত হয়ে ওয়াইলি সাহেবকে গুলি করেন ৷ সেখানেই তিনি ধরা পড়েন ৷ অবাক ব্যাপার এই যে, তাঁর কাজের কোনরূপ প্রশংসার সুর শোনা গেল না তৎকালীন কোন জাতীয় নেতার মুখে ৷ বরং বয়ে গেল নিন্দার ঝড় ৷ প্রত্যাশামাফিক মদনলাল ধিংড়ার ফাঁসির আদেশ হল ৷ ১৯০৯ সালের ১৭ আগস্ট লন্ডনের পেন্টনভিল কারাগারে মাত্র ২৫ বছর বয়সে ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েও নির্ভীক চিত্তে ধিংড়া বলে গেলেন— "This war of independence will continue between India and England, so long us the Hindu and the English races last ."

এবারে আসা যাক বহির্ভারতে ভারতীয় বিপ্লববাদের অন্যতমা মুখ্য প্রচারক তথা 'ভারতীয় বিপ্লববাদের জননী' হিসেবে খ্যাত মাদাম ভিখাজি রুস্তমজি কামার প্রসঙ্গে ৷ বোম্বে প্রেসিডেন্সির শিক্ষাব্রতী এই ভদ্রমহিলা ১৮৮৫-তে জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশনে যোগ দিয়েছিলেন ৷ ১৮৯৬-র ভয়ঙ্কর প্লেগে অক্লান্ত সেবা করার পর তিনি নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়ায় চিকিৎসার জন্য চলে যান লন্ডনে ৷ খানিকটা সুস্থ হয়েই তিনি সেখানেই ইংরেজ-বিরোধী সংগঠনের সাথে যুক্ত হন ৷ সহকর্মী হিসেবে পান দাদাভাই নৌরজিকে ৷ তাঁরা দুজন লন্ডনে বসবাসকারী আরও এক জাতীয়তাবাদী নেতা শ্যামজি কৃষ্ণবর্মার সাথে মিলে ১৯০৫-র ফেব্রুয়ারিতে গড়ে তোলেন Indian Homerule Society. ১৯০৭ সালে জার্মানির স্টুটগার্ট শহরে International Socialist Conference অনুষ্ঠিত হলে সেখানে উপস্থিত হয়ে মাদাম কামা তাঁর বক্তব্যে ভারতে ব্রিটিশ শাসন, ভারতের প্রকৃত স্বাধীনতা, সাম্য ও মানবাধিকারের প্রসঙ্গ তোলেন ৷ এখানেই তিনি ত্রিবর্ণরঞ্জিত ভারতের পতাকা প্রদর্শন করেন ৷ এতদিন ধরে প্রচলিত নরমপন্থী ধারা অপেক্ষা নবোত্থিত সশস্ত্র ধারার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানান ৷ স্বাভাবিকভাবেই ব্রিটিশ সরকার এই পদক্ষেপগুলি সদর্থকভাবে নিল না ৷ তাদের কুনজর ও কূটনৈতিক চাপ থেকে রক্ষা পেতে তিনি ও মুনচেরশা বুর্জোরজি গোদরেজ Paris Indian Society নামক ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সহায়তাদানকারী সংস্থা গঠন করেন ৷ এছাড়া সেখান থেকেই 'বন্দেমাতরম' নামে একটি ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ শুরু করেন (সেপ্টেম্বর, ১৯০৯) ৷ এর প্রথম সংখ্যাটি উৎসর্গ করা হয় শহীদ মদনলাল ধিংড়ার উদ্দেশে ৷

বহির্ভারতে বিপ্লববাদী আন্দোলন পরিচালনার ক্ষেত্রে যেসব সংগঠন বড় ভূমিকা নিয়েছিল, তার মধ্যে ইন্ডিয়া হাউসের নাম সর্বাগ্রে স্মরণীয় ৷ এর কথা উঠলেই আমাদের স্মরণে আসে এর প্রতিষ্ঠাতা শ্যামজি কৃষ্ণবর্মার কথা ৷ ১৯০৫-এ লন্ডন থেকে তিনি Indian Sociologist নামক একটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন ৷ এসময় ইংল্যান্ডে ভারতীয়দের দুটি সংগঠন ছিল— The British Committee of Indian National Congress এবং The London India Society . কিন্তু উভয়ের কাজকর্মেই বীতশ্রদ্ধ হয়ে শ্যামজি কৃষ্ণবর্মা ১৯০৫-র ১৮ ফেব্রুয়ারি গড়ে তুললেন Indian Homerule Society. পূর্বেই উল্লেখ করেছি, এ কাজে তাঁর প্রধান দুই সহযোগী ছিলেন মাদাম কামা ও দাদাভাই নৌরজি ৷ এই সংগঠনের উদ্দেশ্য ছিল—
i) ভারতের জন্য হোমরুল বা স্বায়ত্তশাসন অর্জন
ii) এজন্য ইংল্যান্ডে সবরকম প্রচার চালানো
iii) ভারতের জনগণকে স্বাধীনতা ও ঐক্যবদ্ধতা সম্পর্কে অবহিত করা
এরপরই তিনি প্রবাসী ভারতীয় ছাত্রদের ছাত্রাবাসরূপে India House গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেন ৷ ১৯০৫-র জুন মাসে United Congress of Democrats-র সভায় তিনি আয়ারল্যান্ড ও ভারতে হোমরুল চালুর প্রস্তাব দেন ৷ এর পরের মাসেই গড়ে ওঠে India House, যা নামে ছাত্রাবাস হলেও আসলে ছিল জাতীয়তাবাদীদের আঁতুড়ঘর ৷ স্বভাবতই ব্রিটিশ সরকারের চক্ষুশূল হন তিনি ৷ এরপর তিনি প্যারিসে চলে যান ৷ সেখানে থাকাকালীন প্রফুল্ল চাকী, কানাইলাল দত্ত, ক্ষুদিরাম বসু ও সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নামে চারটি বৃত্তি চালু করেন ৷ তাঁকে The Russian Review পত্রিকায় ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে লিখতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন ম্যাক্সিম গোর্কি ৷ তিনি শেষ জীবনে জেনেভাতে চলে যান ৷ তাঁকে প্রথম প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবী বলা যায় ৷ 

এই India House-এ অনুষ্ঠিত এক সভায় (১৯০৭) এক তরুণ স্বেচ্ছাসেবী সেনাপতি বাপৎ প্রস্তাব দেন, তিনি রাশিয়ায় গিয়ে সেখানকার জারবিরোধী সশস্ত্র বিপ্লবীদের কাছ থেকে বোমা তৈরির কৌশল শিখে তা ভারতে প্রয়োগ করবেন ৷ স্থির হয়, এ ব্যাপারে প্যারিসে আত্মগোপনকারী রাশিয়ান বিপ্লবীদের সাথে যোগাযোগ করা হবে ৷ বহু বাধাবিপত্তি পেরিয়ে অবশেষে সাইক্লোস্টাইল পদ্ধতিতে বোমা নির্মাণের ম্যানুয়াল সংগ্রহ করে লন্ডনে ফেরেন তাঁরা ৷

বহির্ভারতে বিপ্লববাদী নেতাদের মধ্যে অন্যতম লালা হরদয়ালও ইংল্যান্ডে পড়তে গিয়ে এই India House-র কর্মকাণ্ড দ্বারা আকৃষ্ট হন ৷ কৃষ্ণবর্মা ভারতে যেসব রাজনৈতিক দূত পাঠিয়েছিলেন, তাতে স্বেচ্ছায় যোগ দেন তিনি ৷ মাদাম কামার 'বন্দেমাতরম' পত্রিকা প্রকাশের দায়িত্বও তাঁর ওপরে বর্তেছিল ৷ ১৯১১ সালে আমেরিকায় এসে তেজা সিং-এর সাথে আলাপ হয় তাঁর ৷ তিনি সেখানে বসবাসকারী শিখদের সংগঠিত করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন ৷ অবশ্য ইতিপূর্বেই বিদেশাগতদের সম্পর্কে আমেরিকান আইনের কড়াকড়িতে তিতিবিরক্ত আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে বসবাসকারী ভারতীয়দের মধ্যে বিপ্লবের বাণী প্রচারের ভার নেন তারকনাথ দাস ৷ গড়ে তুলেছেন Indian Independence League (১৯০৭) ৷ এদিকে লালা হরদয়ালও প্রতিষ্ঠা করেছেন Radical Club ৷ প্রকাশ করেছেন পুস্তিকা Fraternity of Red Flag ৷ কিছুদিন পরেই তিনি গড়ে তুললেন Hindu Association of Pacific Coast, যার মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত হত 'গদর' পত্রিকা ৷ ধীরে ধীরে এই পত্রিকার নামানুসারেই দলটির নাম হল গদর পার্টি ৷ এর প্রথম সভাপতি ছিলেন বাবা সোহন সিং ও প্রথম সম্পাদক ছিলেন লালা হরদয়াল ৷ ১৯১৩ সালের ১ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত এই গদর পার্টির মূল কর্মকেন্দ্র সানফ্রান্সিসকো হলেও এর শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে পড়েছিল আমেরিকার সমগ্র উপকূল অঞ্চল ও দূর প্রাচ্যে ৷

India House-র সাথে জড়িত এমনই আরেকজন বিপ্লববাদী নেতা হলেন বিনায়ক দামোদর সাভারকর ৷ ভারতে 'অভিনব ভারত' নামে সংগঠন তৈরি করার পর তিনি ১৯০৬ সালে লন্ডনে যান ও সেখানে India House-র সাথে যুক্ত হন ৷ পরে তিনি ঐ সংস্থার পরিচালনার ভারও গ্রহণ করে সেখান থেকে গোপনে বোমা তৈরির নিয়মাবলি ও প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ভারতে পাঠান ৷ তিনি নিজে রুশ ভাষা থেকে ইংরেজি ভাষায় বোমা তৈরির কৌশল অনুবাদ করে তা ভারতে মির্জা আব্বাসের কাছে পাঠান ৷ মদনলাল ধিংড়ার ঘটনার পর ধরপাকড় শুরু হলে সন্ত্রাসমূলক কাজে জড়িত থাকার সন্দেহে বিনায়ককে লন্ডনে গ্রেপ্তার করে ভারতে পাঠানো হয় (মার্চ, ১৯১০) ৷

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আবহ তৈরি হলে, বিশেষত ১৯১২ সাল থেকে বিপ্লবীরা যুদ্ধের পরিস্থিতিকে স্বাধীনতা সংগ্রামের কাজে লাগাতে চাইলেন ৷ তাঁদের পরিকল্পনা ছিল, ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় বিপ্লবের কেন্দ্র গড়ে তুলে তাদের মাধ্যমে ভারত সম্পর্কে প্রচারকার্য চালাবেন ৷ তাছাড়া স্বদেশে বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করার জন্য বিদেশ থেকে অর্থ ও অস্ত্র সংগ্রহ ছিল তাঁদের অন্যতম লক্ষ্য ৷ বিদেশে ভারতীয় ছাত্র, ভারতীয় ব্যবসায়ী ও ভারতীয় শ্রমিকদের মধ্য থেকে তাঁরা নতুন সদস্য বেছে নিত ৷ বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তাঁদের প্রধান কাজ হল বিদেশে থাকা ভারতীয় সেনা ও যুদ্ধবন্দিদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা ৷ এ ব্যাপারে তাঁরা প্রথমেই 'শত্রুর শত্রু' জার্মানির মুখাপেক্ষী হন ৷ জার্মানিও একইরকম চিন্তাভাবনার শরিক ছিল ৷ ১৯১১ সালের অক্টোবর মাসে ফন বের্নহাটির 'Germany and the Next War' গ্রন্থে খোলাখুলিভাবে এই আশা প্রকাশ করা হয় যে, আসন্ন বিশ্বযুদ্ধে বাংলার বিপ্লবীরা সর্বতোভাবে ইংল্যান্ডকে ঘায়েল করার চেষ্টা করবে ৷ এ' কাজে বিশেষ ভূমিকা নেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও অবিনাশ ভট্টাচার্য ৷ সরোজিনী নাইডুর ভাই বীরেন্দ্রবাবু ১৯০৯ সাল থেকেই বিপ্লবী কার্যকলাপে জড়িত হন ৷ তিনি মাদাম কামার 'বন্দেমাতরম', শ্যামজি কৃষ্ণবর্মার 'Indian Sociologist' ও প্যারিস থেকে প্রকাশিত 'তলওয়ার' পত্রিকায় নিয়মিত লেখা পাঠাতেন ৷ বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে গড়ে ওঠে ভারতীয় বার্লিন কমিটি ৷ এর অপর নাম ছিল ভারতীয় স্বাধীনতা কমিটি ৷ এই কমিটি বাগদাদ, ইস্তানবুল, পারস্য, কাবুল প্রভৃতি স্থানে প্রতিনিধি পাঠাতে শুরু করলেন ৷ বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় হন এই কমিটির প্রথম সম্পাদক ৷ যুগান্তর দলের ভূপেন্দ্রনাথ দত্তও জার্মানিতে এসে এই কমিটিতে যোগ দেন ৷ স্থির হয়, আমেরিকায় অবস্থিত জার্মান দূতাবাস মারফত অস্ত্র সরবরাহ করা হবে ভারতে ৷ সেজন্য কেনা হয় ম্যাভেরিক জাহাজ ৷ কিন্তু ব্রিটিশ গুপ্তচরদের চোখ এড়িয়ে এত অস্ত্র সংগ্রহ সহজসাধ্য ছিল না ৷ উপরন্তু সংগঠকদের একজন ধরা পড়লে গোটা পরিকল্পনাটিই ব্যর্থ হয় ৷ 

বার্লিন কমিটির নেতৃত্বে ইরানে এক বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা করা হয়েছিল ৷ কেদারনাথ, বসন্ত সিং, প্রমথনাথ দত্ত ও দাদাচানজি ফেরসাম্প ইরানে উপস্থিত হন ৷ এছাড়াও ছিলেন পাণ্ডুরং কানখোজে ও আগোসে ৷ এদিকে ১৯০৯ থেকে ইরানেই আশ্রয় নিয়েছিলেন সুফী অম্বাপ্রসাদ ৷ এঁরা সকলে একজোট হন ৷ এঁদের উদ্দেশ্য ছিল ইরানের মধ্য দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে বেলুচিস্তানকে মুক্ত করা ৷ যদিও এই প্রচেষ্টা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছিল ৷ কেদারনাথ ও দাদাচানজি ইংরেজদের হাতে মৃত্যুবরণ করেন ৷ অম্বাপ্রসাদের ফাঁসি হয় ৷ প্রমথনাথ দত্ত ও পাণ্ডুরং কানখোজে বেলুচিস্তানের একটি অংশ মুক্ত করলেও তা বেশিদিন মুক্ত থাকেনি ৷ তবে তাঁরা পালাতে সক্ষম হন ৷

এই বার্লিন কমিটির উদ্যোগেই রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপ, মৌলানা বরকতউল্লা ও মৌলানা ওবেদুল্লা কাবুলে গিয়ে অস্থায়ী জাতীয় সরকার গঠন করেন ৷ এই অস্থায়ী সরকারের স্বরাষ্ট্রসচিব ছিলেন মৌলানা ওবেদুল্লা ও প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মৌলানা বরকতউল্লা ৷ কাবুল থেকে ভারতে ব্রিটিশ-বিরোধী প্রচার চালিয়ে যান মাহমুদুল হাসান ও মৌলানা ওবেদুল্লা ৷ প্রচারের মাধ্যম হিসেবে তাঁরা ব্যবহার করতেন রেশমি রুমাল ৷ কিন্তু এবারও তাঁদের পরিকল্পনা ভেস্তে গেল ৷ শুরু হল রেশমি রুমাল ষড়যন্ত্র মামলা ৷ মাহমুদুল হাসান ধরা পড়েন ৷ ভারতেও শুরু হয় ধরপাকড় ৷

এই বিশ্বযুদ্ধকালে গদর দলও উল্লেখযোগ্য কাজ করে ৷ বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে বিপ্লবে অংশগ্রহণের জন্য গদর দলের কয়েক হাজার সদস্যকে ভারতে প্রত্যাবর্তনের নির্দেশ দেওয়া হয় ৷ এসময় কোমাগাতামারু জাহাজের ঘটনা গদর বিপ্লবীদের মনে আরও ক্ষোভের সঞ্চার করে ৷ এসময় ব্রিটিশ সরকারের প্ররোচনায় কানাডা সরকার ভারতীয়দের প্রবেশাধিকারের ওপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল ৷ এমতাবস্থায় মালয় ও সিঙ্গাপুরের ধনী ব্যবসায়ী বাবা গুরদিৎ সিং 'কোমাগাতামারু' নামে একটি জাপানি জাহাজ ভাড়া করে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বসবাসকারী ৩৭২ জন পাঞ্জাবীকে নিয়ে কানাড উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন ৷ ১৯১৪ সালের ২৩ মে জাহাজটি ভ্যাঙ্কুভার বন্দরে পৌঁছলে কানাডা সরকার মাত্র কয়েকজন বাদে আর কাউকে জাহাজ থেকে অবতরণের অনুমতি দিল না ৷ দু' মাস ধরে অচলাবস্থা চলার পর জাহাজটি কানাডা থেকে বেরিয়ে আসে ৷ তবে হংকং, কোবে, ইয়াকোহামা ইত্যাদি বন্দরে অনুরূপ বাধার সম্মুখীন হয়ে ২৯ সেপ্টেম্বর জাহাজটি কলকাতার নিকট বজবজে পৌঁছালে ইংরেজ সরকার জাহাজের সকল আরোহীকে বিশেষ ট্রেনে পাঞ্জাব পৌঁছনোর ব্যবস্থা করেন ৷ যাত্রীরা তাতে আপত্তি জানালে সামরিক বাহিনী গুলি চালায় ৷ সেই সংঘর্ষে ২০ জন নিহত, ২০০ জন বন্দি হন ও তাঁদের জোর করে পাঞ্জাবে পাঠানো হয় ৷ সেই বছরের অক্টোবরে 'তোসামারু' নামে একটি জাহাজ আমেরিকা থেকে কলকাতায় এলে তার ৩৭৩ জন যাত্রীকে সঙ্গে সঙ্গে পাঞ্জাবে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ৷ পাঞ্জাবে পৌঁছনোমাত্র ৩০০ জনকে দীর্ঘমেয়াদী কারাদণ্ড দেওয়া হয় ৷ বাকি ৭৩ জন কোনক্রমে পালিয়ে বিভিন্ন বিপ্লবী দলে যোগদান করে ৷

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেও গদর দলের বৈপ্লবিক তৎপরতা পরিলক্ষিত হয় ৷ বর্মা, মালয় ও সিঙ্গাপুরে ব্রিটিশ-বিরোধী কার্যকলাপের জন্য গদর দলের সদস্য মোহনলাল পাঠক (মতান্তরে সোহনলাল) ১৯১৬ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুদণ্ড পান ৷ সায়ামে বুধ সিং শহীদ হন ৷ এসব অঞ্চলে সৈনিকদের মধ্যে বিদ্রোহী প্রচারকার্য চালানোর জন্য রামরক্ষা (মতান্তরে রামরঙ্গা) দ্বীপান্তরিত হন ৷ ইতিমধ্যে শ্যাম, মালয়, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি স্থানে শুরু হওয়া সংগ্রামের তীব্রতায় সেখানে ইংরেজ শাসন ৩-৭ দিন পর্যন্ত লোপ পেয়েছিল ৷ ১৯১৫-র ১৫ ফেব্রুয়ারি সিঙ্গাপুরের পঞ্চম লাইট ইনফ্যান্ট্রির জমাদার চিস্তি খান, সুবাদার দাউদ খান ও জমাদার আব্দুল আলির নেতৃত্বে সেনাবাহিনী বিদ্রোহ ঘোষণা করে ৷ বিদ্রোহীরা সিঙ্গাপুর শহর ও দুর্গ দখল করে, ইংরেজদের হত্যা করে ও জার্মান বন্দিদের মুক্ত করে দেয় ৷ ৪ দিন সিঙ্গাপুরকে ব্রিটিশ শাসনমুক্ত রাখার পর ইংরেজ ও জাপানি সেনার মিলিত বাহিনী ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালিয়ে সিঙ্গাপুর পুনর্দখল করেন ৷ মোট ১৩৬ জন বিদ্রোহীর মধ্যে ৩৭ জনকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা, ৪১ জনের দ্বীপান্তর এবং ৮ জনের কুড়ি বছর ও বাকিদের তার অধিক কারাদণ্ড হয় ৷

বহির্ভারতে বৈপ্লবিক আন্দোলন প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে রাসবিহারী বসুর অবদান স্মরণীয় ৷ এ' প্রসঙ্গে ভারতের অভ্যন্তরে সংগঠিত এক গণ-অভ্যুত্থানের পরিকল্পনার কথা বলি ৷ যতীন্দ্রনাথ মুখার্জী (বাঘা যতীন), নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, রাসবিহারী বসু প্রমুখরা পরিকল্পনা করলেন, প্রথমে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে উত্তেজিত করে তুলবেন, তারপর পেশোয়ার থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত সমস্ত পুলিশ লাইন ও ট্রেজারিতে আক্রমণ চালাবেন এবং সবশেষে জার্মান অস্ত্রের সহায়তায় ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে সার্বিক যুদ্ধ ঘোষণা করবেন ৷ ১৯১৫-র ২১ ফেব্রুয়ারি ছিল এই গণ-অভ্যুত্থানের প্রস্তাবিত দিন ৷ কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতার ফলে ষড়যন্ত্রের খবর ফাঁস হয়ে গেল ৷ দিন স্থির হল ১৯ ফেব্রুয়ারি ৷ কিন্তু তাতেও শেষরক্ষা হল না ৷ বিষ্ণু গণেশ পিংলে মিরাটের ক্যাভালরি লাইনস্-এ বোমা সমেত ধরা পড়লেন ৷ বিদ্রোহী সেনাদলগুলো ভেঙে দেওয়া হল ও ষড়যন্ত্রীদের অনেকে ফাঁসির মঞ্চে প্রাণ দিলেন বা দেশান্তরিত হলেন ৷ মার্চ মাসে শ্রীরামপুরের বিপ্লবী জিতেন্দ্রলাল লাহিড়ি জার্মানি থেকে ফিরে এসে জানান, তারা বাংলাদেশের বিপ্লবীদের অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করবে ৷ এজন্য যেন কোন বিপ্লবীকে বাটাভিয়ায় পাঠানো হয় ৷ সেই মোতাবেক নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য (যিনি মানবেন্দ্রনাথ রায় নামেই সমধিক প্রসিদ্ধ) সি. মার্টিন ছদ্মনামে বাটাভিয়া যান ৷ এদিকে রাসবিহারী বসু ১৯১৫ সালের ১২ মে কলকাতার খিদিরপুর বন্দর থেকে জাপানি জাহাজ সানুকি-মারু সহযোগে প্রিয়নাথ ঠাকুর ছদ্মনামে জাপানে চলে যান ৷ সেখানে পৌঁছে প্রথম আট বছর পলাতক জীবন যাপন করেন ৷ তবে তাঁর বিপ্লব প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিল ৷ এখানেই হেরম্বলাল গুপ্ত, লালা লাজপৎ রাই, তারকনাথ দাস প্রমুখ নেতার সাথে তিনি মিলিত হন ৷ এরপর তিনি জাপানের হাতে বন্দি ভারতীয় সেনাদের নিয়ে এক বাহিনী গড়ার পরিকল্পনা নেন ও এ' বিষয়ে পাশে পান ক্যাপ্টেন মোহন সিং-কে ৷ ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে আজাদ হিন্দ ফৌজ ৷ তবে সে অন্য গল্প ৷

আরও এক মহাপ্রাণ বিপ্লবীর কথা না বললে এই বৈপ্লবিক তৎপরতার কথা সাঙ্গ হবে না ৷ উধম সিং ছোট থেকেই জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের জন্য ব্রিটিশদের ঘৃণার চোখে দেখতেন ৷ ১৯২৪-এ তিনি আমেরিকায় গিয়ে গদর পার্টির সাথে যোগাযোগ করেন ৷ তিনি শিকাগো ও ডেট্রয়েটে গড়ে তোলেন 'আজাদ পার্টি' ৷ ১৯২৭-এ তিনি প্রচুর রিভলবার ও গুলি ভগৎ সিং-দের উদ্দেশ্যে  সংগ্রহ করে দেন ৷ তার কিছুদিন পর তিনি ধরাও পড়েন ৷ ১৯৩৩-এ তিনি আবার ইংল্যান্ডে পৌঁছান ৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে পরিকল্পনা হয়, ব্রিটিশ সরকারকে ধাক্কা দেওয়ার সুযোগ এবার এসছে ৷ এদিকে ব্রিটিশ আমলারা এসময়েই ভারতসহ অন্যান্য উপনিবেশ কীভাবে দখলে রাখা যাবে, তা নিয়ে এক সভা অনুষ্ঠিত করেন ৷ এখানে উপস্থিত হয়ে উধম সিং মাইকেল ডায়ার, জেটল্যান্ড. ল্যামিংটন ও ডান সাহেবকে গুলি করেন ৷ তাঁর ফাঁসি হয় ১৯৪০-র ৩১ জুলাই ৷ 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে ভারতীয় বিপ্লববাদী নেতারা বিদেশি সাহায্য লাভের যে সুযোগ পেয়েছিলেন, তা শেষ পর্যন্ত কাজে লাগাতে পারেননি ৷ স্বদেশী ও প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবীদের মধ্যে যোগাযোগ ও বোঝাপড়ার অভাব ছিল ৷ দুই প্রধান দল গদর পার্টি ও ভারতীয় বার্লিন কমিটির মধ্যে ঘনিষ্ঠ আদানপ্রদান ছিল না ৷ বেশ কিছু সংগঠন গড়ে উঠলেও কোন কার্যকরী সাফল্য তাঁরা পাননি ৷ ইংরেজ গুপ্তচর তথা ব্রিটিশ প্রশাসনের সদা-সতর্ক নজর এবং অন্যান্য দেশের সরকারের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ বিপ্লবীদের কাজকে আরও কঠিন করে তোলে ৷ তার ওপর কিছু বিপ্লবী বিশ্বাসঘাতকতা করায় ব্রিটিশদের কাজ আরও সহজ হয়ে যায় ৷ তথাপি দেশমাতার মুক্তিযজ্ঞে বিদেশ-বিভুঁই থেকেও যেভাবে কিছু দামাল সন্তান বৈপ্লবিক তৎপরতা দেখিয়েছিলেন, তা ব্রিটিশ সরকারকেও ব্যতিব্যস্ত করে তোলে ৷ তাই আপাত অসফলতা সত্ত্বেও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এই অধ্যায়কে ভুলে গেলে চলবে না ৷


তথ্যসূত্র —
১) কোরক সাহিত্যপত্র — প্রাক শারদ ২০১৭ — ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন
২) স্বাধীনতা সংগ্রাম — বিপান চন্দ্র, অমলেশ ত্রিপাঠী, বরুণ দে
৩) বিপ্লব আন্দোলনের নেপথ্যে নানা কাহিনী— শিশির কর
৪) নথিপত্রে স্বদেশী আন্দোলন— সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
৫) বাংলায় বিপ্লব প্রচেষ্টা— হেমচন্দ্র কানুনগো
৬) ভারতের মুক্তি সংগ্রামে চরমপন্থী পর্ব— অমলেশ ত্রিপাঠী
৭) আধুনিক ভারতের রূপান্তর — রাজ থেকে স্বরাজ ( ১৮৫৭- ১৯৪৭ ) — সমর কুমার মল্লিক


No comments:

Post a Comment