Tuesday, June 25, 2019

রীতা রায়



কবিতা -

এলাটিং বেলাটিং সই লো
                 
*************************

   "এলাটিং বেলাটিং সই লো,"
খুব ছোটবেলার খেলাটা মনে পড়ে...
পাশের বাড়ির দিদিরা এলে খেলা উঠতো জমে, আমাদের বাড়ির ছাদে।

তারপর ... খেলাটা খেলিনি কখনো,
দিদিরা সব বিয়ে হয়ে গেছে শ্বশুরঘর
খেলাটা তবু মনে ঘর করে নিয়েছে ..
   "এলাটিং বেলাটিং সই লো,
     রাজার খবর আইলো...
     কী খবর আইলো
     একটি বালিকা চাইলো.."

আমাদের বাড়িটা ক্রমে ভরে উঠলো 
বালিকার মেলায় ... 
হৈ হৈ আর আনন্দ কলরোলে,
তারপর... একে একে রাজার খবর আসতে লাগলো..
এক একটা করে বালিকা কমতে লাগলো |

আমার প্রথম বন্ধু ছায়া, যে ছায়ার মতো সঙ্গী ছিল
সপরিবারে উঠে গেল নিজেদের বাড়িতে।
আভাদি বিভাদি এসে জানিয়ে যেত তারা ভাো আছে
একাত্তরের উদ্বাস্তু পূর্নিমাদিরা, এপারে আমাদের বাড়িতেই উঠেছিল,
মাস কয়েক নাচে গানে মাতিে ফিরে গেল 
ওদের স্বাধীন বাংলাদেশে।
শুনেছি, ওরা আবার বিতারিত হয়ে ফিরে এসেছিল এদেশে।

এলাটিং বেলাটিং সই লো...
পয়া ক্লাস এইটে পূজোয় মিনিস্কার্ট নিয়েছিল.. দুধফর্সা গায়ে নীল আর সাদায় 'ডল' সেজেছিল,
সে বছরই ফাল্গুনে ফ্রক আর স্কুল দুটোকে বিদায় জানিয়ে.. 
বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছিল তাকে।

সবিতা বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করে ফেলল..
টীন এজের সাহস! বরটা হঠাৎ অ্যাক্সিডেন্টে..
না... বরাত তাকে হারাতে পারেনি
প্রথম পক্ষের পুত্র বিতীয় পক্ষের বর,
দুয়ের আদরযত্নে পেল স্বর্গসুখ

অঞ্জলীদি একদিন টিউশনি পড়াতে গিয়ে ফিরলো না ... সে না কী কোন এক 
নেপালী বাহাদুরের সাথে ঘর বেঁধেছিল।
উমাদির বিয়েটা বাড়ি থেকেই হয়েছিল, তারপর আর খবর নিই নাই।
বেলার বর জুটলেও, ঘর জুটলো না..
সারাজীবন ভাড়াবাড়ি পাল্টে পাল্টে কাটলো।

মীণাক্ষীর বিয়েতে ঘটা হয়নি,
অথর্ব বাবার অর্থসঙ্কুলান ...
ছোটভাইটা ধারদেনা করে পার করেছে দিদিটাকে,
শ্বশুরঘরে মান জোটেনি..
পুরোনো বিছানায় কেটেছিল বিয়ের প্রথম রাত।
মলির পড়াশুনা হল না...ভাগ্যিস ভাগ্যটা সঙ্গে ছিল,
ভালো ঘর .. বর.. দুইই জুটেছে।

মীনারা পাকুড়ে ফিরে, লিখেছিল ... 
বাঙালি বলে কেউ তাদের দলে নেয় না,
বড়ঘরে বিয়ে হলেও জীবন কাটলো নিঃসঙ্গে, একাকীত্বে

পুষ্পদিকে মনে পড়ে?
কালো কুচকুচে গায়ের রঙ! সবাই বলতো--
বয়স গড়িয়েছে.. ওর আর বিয়ে হবে না। 
কিন্তু, পুষ্পদিরও একদিন বিয়ে হল.. দোজবরে, বিহারের কোন এক অবস্থাপন্ন ঘরে..
শুনেছি, ওর বরের নাকি ছেলে-বৌমা, মেয়ে-জামাই
নাতি-নাতনী সব আছে.. সবাই শুনে বলল, আহা..তবুতো ঘর পেল।

মহামায়ার মন মজেছিল বিজাতি ছোঁড়ার সঙ্গে
থানা পুলিশ কত কী!
বাড়ির লোক রাতারাতি বিয়ে দিয়ে পাচার করে দিল.. 
বিহারের প্রত্যন্ত গ্রামে,
বিয়ের পর সংসারে মন বসাতে বাধ্য হল।

রীণারও একদিন বিয়ে হয়ে গেল ..
বন্দী হল সংসারের গন্ডীতে।
ছোটবোনটা হঠাৎ কাউকে কিছু না বলে কোথায় হারিয়ে গেল..
উমাকে খেল সুগারে,
রমা ওর ছেলের কাছে.. দিল্লিতে

শেষপর্যন্ত উত্তরা বিয়েতে মত দিলেও..
ফিরে এল দুদিন বাদেই  ..
বুড়োটার নাকি  অন্য  সম্পর্ক আছে |
উজ্জ্বলার আইবুড়ো নাম ঘুচলো না..
কিন্তু সংসারটা টিকে রইল তার আয়ের টাকায়।

ছোটবেলার বন্ধুরা সবাই হারিয়ে গেল,
ফুরিয়েও ফুরোলো না তাদের গল্প ..
  "
এলাটিং বেলাটিং সই লো,
   
রাজার খবর আইলো ..."

ছোটবেলার খেলাটা তো শুধু খেলা নয়?
বড় হয়ে বুঝেছি তার মানে
রাজারা কেন খবর পাঠাত?
বালিকারা কীভাবে গুম হয়ে যেত গুমঘরে ...?

রাজারা এখন আর খবর পাঠায় না,
সেপাই .. মন্ত্রী .. সবাই এখন রাজা,
বালিকারা এখনও গুম হয় গুমঘরে।
ফাঁকা হয়ে যায় পাড়া.. ফাঁকা হয়ে যায় দেশ..
একরাতে ধস নামে ঝরনার পথ রোধ করে ..
একরাতে বালিকারা ধর্ষিতা হয়ে যায়,
শুধু বুকভাঙা কান্নায়.. গেয়ে বেড়ায় নিয়তিকন্ঠ..
মেয়েদের মুখে মুখে খেলার সুরে ...

  "
এলাটিং বেলাটিং সই লো,
  
রাজার খবর আইলো...
  
কী খবর আইলো?
  
একটি বালিকা চাইলো,
  
কোন বালিকা চাইলো?
  
অমুক বালিকা চাইলো,
  
নিয়ে যাও, নিয়ে যাও বালিকাগণ।"

  --
না! .. আর কোনো বালিকা নয় !
এসো, প্রতিবাদ মিছিলে পা বাড়াই...

No comments:

Post a Comment