যান
প্রণব ঘোষ
সময়টা ১৯৭৪ সাল ৷ বিশুদার দোকান থেকে নতুন চকচকে অ্যাভন সাইকেলটা ৩১৫ টাকা দিয়ে যখন বাড়িতে নিয়ে এলেন সাধনবাবু, তখন তাঁর মা সাইকেলের দু' চাকায় জল ঢেলে ধুপ জ্বেলে বরণ করে নিয়েছিলেন ৷ তারপর থেকে সাধনবাবুর নিত্য সঙ্গী এই সাইকেল ৷ তা কালে কালে সাতচল্লিশ বছর কেটে গেল ৷ মা, বাবা দুজনেই চলে গেছেন, কিন্তু সাইকেলটা রয়ে গেছে ৷ কত শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, বষন্ত কোথায় না গিয়েছেন সাইকেলটা নিয়ে ৷ কত সুখ-দুঃখের সাথী এই সাইকেল ৷ মাইলের পর মাইল ঘুরে বেড়িয়েছেন এই সাইকেলে চেপে ৷ কত মালপত্র, কত বাজার হাট বয়েছে ওর ওই যান ৷ থাকতে থাকতে ওকে আর যান বলে মনে হয়নি সাধনবাবুর ৷ সবাইকে বলতেন, ও আমার জান ৷ ওই সাইকেলটাকে সাধনবাবু এত ভালোবাসতেন যে, অনেকে বলতেন, সাধন আর ওর সাইকেল হরিহর আত্মা ৷ দোকান, বাজার তো বটেই, এমনকি ওর গ্রাম থেকে পনের মাইল দূরে বিয়ের মেয়ে দেখতে গিয়েছিলেন ওই সাইকেলে চেপে ৷ বাবা, মা, দিদি, জামাইবাবু গিয়েছিলেন গরুর গাড়িতে ৷ ওর প্রিয় বন্ধু শ্যামল বলেছিল, হ্যাঁ রে সাধন, এটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না, সাইকেলে করে মেয়ে দেখতে যাওয়া ! উত্তরে সাধনবাবু সাইকেলকে দেখিয়ে বলেছিলেন, ও রাগ করবে না ? শ্যামল শুধু বলেছিলেন, পাগল ! এর আগে পঞ্চগ্রাম প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করার দিনেও সাধনবাবুর সঙ্গী ছিল ওই সাইকেল ৷ এভাবেই দিন কাটে ৷ বয়স বাড়ে সাধনবাবুর, সেই সঙ্গে তাঁর সাইকেলেরও ৷ একে একে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন বাবা, মা৷ একমাত্র সন্তান বীথিও শিক্ষকতা করে দূরে শহরের হাই স্কুলে ৷ সেখানেই এক সহশিক্ষককে বিয়ে করে থিতু হয়েছে ৷ বীথি তার স্বামীকে নিয়ে প্রতি মাসে একবার করে আসে মা-বাবার খোঁজ নিতে ৷ এরকম একদিন বীথি ওর বাবাকে বলল, তোমার ওই মান্ধাতার আমলের সাইকেলটা ফেলে দাও তো ৷
—বলিস কী, তুই কি আমাকেও ফেলে দিবি নাকি ? আমিও তো বুড়ো হয়ে গেছি ৷ আর তুই তো কত চেপেছিস এই সাইকেলে, যেমন চেপেছিস আমাদের কোলেপিঠে ৷ আজ তুই একথা বলিস কী করে ?
বীথি আর কিছু বলল না ৷ পরের মাসেই একটা নতুন মোপেড নিয়ে হাজির ৷ কোম্পানির লোক এসে ডেলিভারি দিয়ে গেল ৷ বীথি ওর ঠাকুমার মতো মোপেডের দু' চাকায় জল ঢেলে বরণ করে নিল নতুন অতিথিকে ৷ আসন্ন বিদায়ের বিয়োগ ব্যথায় নির্বাক সাধনবাবু তাঁর প্রিয় সাইকেলকে জড়িয়ে ধরে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন দূর আলপথের দিকে ৷
চিত্র-সৌজন্য— গুগল
=======================
বাহক নাকি বাহিত
নীতিকা চ্যাটার্জী
ঝুমাই বসে বসে দেখছে কেমন সুন্দর খড়ের উপরে প্রলেপ পড়ছে মাটির। এভাবেই আস্তে আস্তে ঠাকুর তৈরী হবে। বাবা বলবে, প্রণাম করো ঝুমাই । মা বলবে, অঞ্জলি দিতে হয়। সকাল বেলা কিছু খাবে না।
যিনি ঠাকুর তৈরী করেন তাঁর কি অসম্ভব নিষ্ঠা – ঝুমাই অবাক হয়ে দেখে। নিষ্ঠা বিষয়টি সে ঠিক না বুঝলেও এটুকু বোঝে একমনে তিনি যখন কাজ করেন তাঁকে বিরক্ত করা যায় না। তিনি অবশ্য স্নেহের স্বরে বলেন— মামনি কোন জিনিষে হাত দিও না কেমন। চুপ করে বসে দেখো।
এইভাবে ঠাকুর তৈরীর কাজ যখন চলছে ঝুমাই প্রশ্ন করে— ও দাদু শোন না ৷
সেই মৃৎশিল্পী উত্তর দিলেন— বল নাতনী কি বলতে চাও
– আচ্ছা বাহন কাকে বলে গো?
উনি উত্তর দিলেন— যাঁরা তাঁদের বহন করে নিয়ে যায়।
— কেন ঠাকুর দেবতা কি নিজেই চলে আসতে পারে না? তাঁদের বহন করে আনতে হবে কেন?
মৃৎশিল্পী দাদু আপন মনে বলে চলেন— আসলে কি জানো নাতনী, পৃথিবীর নিয়মই বোধ হয় এই সবলের দ্বারা দুর্বলেরা বাহিত হন। আমরা সবকিছু মেনেও নি। তবে ঠাকুর দেবতার কথা এভাবে ভাবতে বোধ হয় নেই। আমরা যখন শুনি মা দুর্গা এবার পালকিতে আসবেন, ভাবি কি ? যে সেই বেহারারা তো আগেকার দিনে কি কষ্ট করে পালকি বয়ে নিয়ে যেতেন। আবার ধরো তোলা রিক্সা। একটি মানুষ কি কষ্টে রোদে জলে আর একজন মানুষকে বয়ে নিয়ে চলেছেন। যিনি বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তিনি অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল । আর যিনি বসে আছেন তিনি অর্থনৈতিক ভাবে সবল। এ বিষয়ে কলুর বলদের কথা বলা যায়। বলদটি চোখ বাঁধা অবস্থায় বুঝতেও পারে না, সে কি কাজ প্রতিনিয়ত করে চলেছে।
তবে মা দুর্গার যখন চক্ষু আঁকি তখন বলি, মা গো দুর্বলেরা কেন বঞ্চিত হয়? তুমি কি একবারও ভাবতে পার না? কি জানি মা হয়তো ভাবেন, আমরাই বুঝতে পারিনা।
ঝুমাই কিছুই না বুঝতে পারার কারণে বলে ওঠে— আমি যাচ্ছি দাদু। তুমি মন দিয়ে কাজ করো, কেমন।
শিল্পী সংবিৎ ফিরে পান। নিজের কাজে মন দেন। দু'ফোঁটা চোখের জল গড়িয়ে পড়ে মাটি ভিজে যায়। বাড়িতে অসুস্থ সন্তান ও বৃদ্ধা মা। সকলের জন্য অর্থের বড় প্রয়োজন। আবেগ তাকে মানায় না।
চিত্র-সৌজন্য— গুগল
=======================
এম এইট্টি
তমাল কুণ্ডু
ব্যস্ততার মধ্যে এই ভাবে হঠাৎ মাঝরাস্তায় মাল বোঝাই এম এইট্টির স্টার্ট বন্ধ হয়ে যাওয়াতে যারপরনাই বিরক্ত বোধ করলো শিবু। আর বিরক্ত হবে নাই বা কেনো? যার প্রতি ওর ভালোবাসায় কোন খাদ নেই সেই যদি এমন বিশ্বাসঘাতকতা করে তবে কার মাথা ঠিক থাকে?
আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব এমনকি ওর বউ ও পর্যন্ত, যে যখন সুযোগ পাচ্ছে ওকে চাপ দিচ্ছে এই এম এইট্টি ছেড়ে নতুন বাইক কেনার জন্য। একবার তো বউ এর সঙ্গে এই নিয়ে অশান্তি এমন পর্যায়ে গেলো যে আর একটু হলে ডিভোর্স ফাইল হয়ে যেতো। সে যাত্রায় শিবুর শরীর খারাপটাই ওদের সম্পর্কটা বাঁচিয়ে দিয়েছিলো।
বউ তো রাগ করে এক কাপড়ে বাপের বাড়ি চলে গেলো। এদিকে শিবুও পণ করে বসলো ও নিজে কখনই আনতে যাবেনা। কিন্তু যা হয় আর কি! বউহীন সংসারে অখাদ্য, কুখাদ্য খেয়ে এবং খাওয়া দাওয়ার অনিয়ম করে একসপ্তাহ যেতে না যেতে ডায়রিয়া বাধিয়ে বসলো শিবু। নিজের স্বামীকে এই অবস্থায় কোন বাঙালি নারী একা ছেড়ে দিতে পারে? সে যতই অভিমান থাকুক। অগত্যা, ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত বাতিল হলো। বউ আবার ঘরে ফিরে এলো এবং বউ এর সেবা যত্নে আমাদের শিবুও সুস্থ হয়ে উঠলো কিছু দিনের মধ্যে।
কিন্তু এই যে বউ এর সঙ্গে ঝগড়া করলো। নিজে অনিয়ম করে শরীর খারাপ করলো। সে কার জন্য? এই এম এইট্টির জন্যই তো। আর আজ যখন প্রয়োজনের সময় তখনই তার খারাপ হতে হলো? শিবু রাগে গজগজ করতে লাগলো।
আধ ঘন্টা ধরে যথাসাধ্য চেষ্টা চরিত্র করেও যখন কোন ফল হলো না হাল ছেড়ে ক্লান্ত হয়ে মাঠের পাশে কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো। যদি কোন গাড়ি পাওয়া যায়, তাহলে সেই গাড়িতে করে মাল গুলো নিয়ে যেতে পারলে হরিদাস মুদির কাছে মানটা থাকে। পকেট থেকে মোবাইল বার করে দেখে। এখনো হাতে ঘন্টা খানেক সময় আছে।
বছর খানেক হলো শিবু এই পাইকারি ব্যবসাটা শুরু করেছে। মোটামুটি চলছিলো। কিন্তু বড় আর মনের মতো পার্টিও পাচ্ছিলো না। অর্ডারও পাচ্ছিলো না। ওর এক শুভাকাঙ্খী দাদা ওকে হরিদাস মুদির খোঁজ দিয়েছিলো। তেঁতুলিয়া বাজারে বিশাল মুদিখানার দোকান এই হরিদাস মুদির। যেমন অর্ডার তেমন পেমেন্ট। ঠিক যেমনটি শিবু চাইতো, তেমন। কিন্তু শুনেছে ইনি একেবারে এক কথার মানুষ। কথার খেলাপ তিনি একেবারেই বরদাস্ত করেন না। প্রায় তিনমাস ধরে লেগে থেকে গতকাল প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকার অর্ডার পেয়েছে শিবু ওনার কাছ থেকে। আজ বেলা একটার মধ্যে মাল ডেলিভারি দেওয়ার কথা। কিন্তু হায়রে কপাল! ও এম এইট্টির দিকে একবার দেখে। আসার পথে খারাপ হলে তাও একটা কথা ছিলো। এই সময়ে খারাপ হওয়ার কোন যুক্তি আছে? বিরক্তিতে একটা ঢিল এম এইট্টির দিকে ছুঁড়তে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো শিবু।
ছোটবেলার কতো স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই এম এইট্টির সঙ্গে। ছোটবেলায় ওর বাবা প্রতিদিন বিকেলে ওকে নিয়ে এই এম এইট্টি করে ঘুরতে যেতো নানা জায়গায়। এম এইট্টি করে যেতে যেতে কতো রকম গল্প শোনাতো বাবা। দেশ বিদেশের কতো গল্প। বাবার হাত ধরেই বাইরের পৃথিবীটাকে চিনেছিলো শিবু। বাবাকে খুব ভালোবাসত ও। বাবা মারা যাওয়ার পর সেই ভালোবাসাটা পরিবর্তিত হয়েছে এই এম এইট্টির ওপর। তাই যতো সমস্যাই হোক । যে যাই বলুক। ও এই এম এইট্টি হাতছাড়া করেনি কখনো। এখনও এই এম এইট্টিতে বসলে ওর মনে হয় ওর বাবা পিছনে বসে ওকে দেশ বিদেশের গল্প শোনাচ্ছে।
ওর চোখের সামনে ছোটবেলার সেই সব স্মৃতিগুলো ক্রমেই ভেসে উঠতে থাকে। ওর মুখে একটা হালকা হাসি খেলে যায়। গাছের নীচের শীতলতায় ওর চোখ লেগে আসে। হঠাৎ ঘুমের মধ্যে ও শুনতে পায় ওর বাবার গলা। ও ধড়পড় করে উঠে পড়ে। কিন্তু চারিদিকে কাউকে দেখতে পায়না। মনের ভুল ভেবে আবার চোখ বন্ধ করতে যাবে এমন সময় ওর চোখে পড়ে খারাপ হয়ে যাওয়া এম এইট্টির সামনে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে ওর বাবা। চমকে ওঠে ও। অস্ফুটে বলে
" বাবা ! তুমি…"
ওর বাবা হাসতে হাসতে ওর কাছে এগিয়ে আসে। তারপর ওর পাশে বসে বলে,
" হ্যাঁ আমি। তুই আর আমাকে মুক্তি দিলি কই?"
" কিন্তু বাবা আমি তোমার শ্রাদ্ধ-শান্তি খুব ঘটা করে করেছিলাম …"
" ওতে কি আর মুক্তি হয় রে পাগল ছেলে।"
" তবে? "
ওর বাবা হাসতে হাসতে এম এইট্টির দিকে দেখিয়ে বলে,
" ওই যে। ওটাকে তুই যতদিন আঁকড়ে থাকবি আমার তো শান্তি হবেনা। তুই যখনই ওই গাড়ি চালাস। আমার মন অজানা আশঙ্কায় বিচলিত হয়ে ওঠে। মনে আছে ছোট বেলায় জেদ করে চালাতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলি।"
" হ্যাঁ আমার পা ভেঙে গিয়েছিল। তুমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলে।"
" সেই ভয় তো আজও আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। আমি মুক্তি পাবো কি করে বল?"
" তাহলে কি করলে মুক্তি পাবে তুমি বাবা ?"
ওর বাবা হাঁটতে হাঁটতে এম এইট্টির পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
" এবার তুই নতুন বাইক কেন একটা। এটা আর চালাস নে।"
শিবু কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু হঠাৎ যেন বৃষ্টি শুরু হলো। ও মূহুর্তের জন্য ওপর দিকে তাকালো। কিন্তু তারপর নীচে তাকিয়ে আর ওর বাবাকে দেখতে পেলোনা। ও পাগলের মতো বাবাকে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু বাবাকে আর দেখতে পেলোনা। শুধু শুনতে পেলো ওর বাবা যেন বলছে "বেচে দে শিবু, গাড়িটা বেচে দে।"
হঠাৎ এক তীব্র ঝাকুনিতে ওর ঘুম ভেঙে গেলো। ও দেখলো, ও সেই কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে বসে আছে। আর ওর সামনে দাঁড়িয়ে হরিদাস মুদি। মুখে একগাল হাসি নিয়ে বললেন,
" কী ব্যাপার শিবু বাবু? এখানে দিবা নিদ্রা দিচ্ছেন? আমার মালগুলো কে পৌঁছে দেবে?"
শিবু আমতা আমতা করে বলে,
" আসলে বাইকটা খারাপ হয়ে গেছে…"
" এবার ওটা বেচে দিন শিবু বাবু। যদি বলেন আমি সেকেন্ড হ্যান্ড বাইক দেখে দিতে পারি।"
" হ্যাঁ দাদা ভাবছি এবার নতুন বাইক নিয়েই নেবো।"
" যাক শুভ বুদ্ধি হয়েছে তাহলে।…"
একটু মুচকি হেসে শিবু বলে,
" কিন্তু এই মালগুলো নিয়ে যাবো কি করে তাই ভাবছি।"
" ভাবতে হবে না। মাল গুলো আমার গাড়িতে তুলে দিন। আপনাকে আর কষ্ট করে যেতে হবে না। ভাগ্যিস আমাকে একটা জরুরী কাজে বসিরহাট যেতে হয়েছিল। না হলে কি হতো বলুন তো?"
শিবু মাথা নীচু করে। সত্যিই তাই! না হলে প্রথম অর্ডারেই একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়ে যেতো। হরিদাস মুদি ওর পিঠ চাপড়ে হাসতে হাসতে বললেন,
" ভাববেন না। ভগবান যা করে ভালোর জন্যেই করে। নিন এবার হাতে হতে মাল গুলো আমার গাড়িতে তুলে দিন।"
দুজন মিলে হাত লাগিয়ে মাল গুলো হরিদাস মুদির গাড়িতে তুলে দিয়ে এম এইট্টির পাশে গিয়ে দাঁড়ালো শিবু। হরিদাস মুদির গাড়ি দূরের বাঁকে মিলিয়ে গেলো। শিবুর কানে এখনও ওর বাবার কথা গুলো বেজে চলেছে ।
" বেচে দে শিবু। আমায় মুক্তি দে…"
চিত্র-সৌজন্য— গুগল
=======================
বিদ্যুৎ বাহন
মৌমিতা ঘোষ
ঝন ঝন করে সাইকেল নিয়ে ক্লাবের সামনে এসে দাঁড়াল শুভ্র ৷ দেয়ালে হেলান দিয়ে রেখে লক করতে গিয়ে দেখল লকটা খারাপ হয়ে গেছে, কিছুতেই দেওয়া যাচ্ছেনা ৷ পিছন থেকে সমু হেসে বলল, "তোর ঐ লজঝড়ে সাইকেলে আর লক করতে হবেনা , এমনিতেই ওটা কেউ নেবেনা !" শুভ্রও এক গাল হেসে বলল, "তা যা বলেছিস ৷ এ সাইকেলে সহজে কেউ হাত দেবেনা ,কিন্তু লকটা হঠাৎ খারাপ কী করে হল বুঝতেই পারলাম না ,যাক গে চল ভিতরে যাই, ওদের বোধহয় দু' রাউন্ড খেলা হয়ে গেল ?"
ক্লাবে ঢুকেই আর সবার মতো ক্যারামের স্ট্রাইকারে মন দিল শুভ্র ৷ দু' বারেই প্রায় পাঁচটা ঘুঁটি পকেটে পুরে তারপর থামল ৷ পীযূষ বলল, "আচ্ছা শুভ্র তোর বাবার এত টাকা তুই একটা বাইক কিনতে পারছিস না ? আর কতদিন ঐ দাদুর আমলের সাইকেল নিয়ে নিয়ে ঘুরবি ? আমি হলে তো ঐ সাইকেল ছুঁয়েও দেখতাম না , বাবা বলেছে HS এ ভালো মার্কস পেলে এবছরই বাইক কিনে দেবে ৷"
"বাবাকে কি বলিনি ভাবছিস !বললো তেল কেনার টাকা কে জোগাবে শুনি ? আমি কতবার বললাম সে আমি ঠিক ম্যানেজ করে নেব ! ধুর শুনল কই আর !! দিলই না ! তবে আমার এই বিদ্যুৎ কিন্তু দারুণ সার্ভিস দেয় , আজ পর্যন্ত ওর জন্য কোনো টাকাই খরচ করতে হয়নি ৷"
শুভ্র ওর সাইকেলের নাম রেখেছে "বিদ্যুৎ "৷ ঐ সাইকেল নিয়ে বিদ্যুৎ বেগে সে চলে যায় এদিক সেদিক ৷
শুভ্র খুব বড় শিক্ষিত পরিবারে জন্মেছে ৷ বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে সে , আর আছে তার বোন ৷ বাবা খুব বড় অফিসার , আর তাছাড়া প্রাইভেট টিউশন করেও প্রচুর ইনকাম করেন ৷ পাড়ার প্রায় বেশিরভাগ ব্রিলিয়ান্ট ছেলেরা শুভ্রর বাবার কাছে সায়েন্স গ্ৰুপ পড়ে ৷ শুভ্রর বাবার ছাত্ররা প্রত্যেকেই এক একটা জুয়েল , কেউ ডাক্তার কেউ ইঞ্জিনিয়ার কেউ বা বড় বড় পদে চাকরি করছে ৷ কিন্তু তাঁর নিজের ছেলেকেই প্রায় তিনবার চেষ্টা করেও মাধ্যমিক পাশ করিয়ে উঠতে পারেননি ৷ এখন তো চেষ্টাই ছেড়ে দিয়েছেন ৷ এসব নিয়ে শুভ্রর বাবার আক্ষেপের সীমা নেই ৷ তাঁর ভাইয়ের ছেলেরাও সবাই ভালো ভালো নম্বর পেয়ে ডাক্তারি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে ৷ কিন্তু নিজের ছেলেকে কিছুতেই মনের মতো করে গড়তে পারলেন না আর ৷ ছেলেও ছাড়বার পাত্র নয় , বাবার থেকে জোরাজুরি করে হাত খরচের টাকা ,ফোন সবই বাগিয়ে নেয় ৷ যদিও সেসব টাকার অধিকাংশই খরচ হয়ে যায় বন্ধুদের পিছনে ৷
বেশ কয়েকদিন যাবৎ শুভ্র কেমন মনমরা হয়ে আছে ,কী এক রোগ করোনা ,সেটা ছড়িয়ে পড়তেই চারিদিকে লকডাউন ৷ দোকানপাট , ক্লাব ,আড্ডা সবই বন্ধ হয়ে গেছে ৷ সবাই বাড়িতে সেঁধিয়ে গেছে ভয়ে ৷ কিন্তু শুভ্র কিছুতেই বাড়িতে মন বসাতে পারছেনা ৷ বাড়ি থাকলেই খালি বাবার গজগজানি , মায়ের মুখনাড়া আর বোনের জ্বালাতন সহ্য করতে হয় ৷ এসব তার বিরক্তিকর লাগে ৷ একদিন সারা দুপুর ধরে তার বিদ্যুৎকে ধোয়ামোছা করল , বাবার দেওয়া স্মার্ট ফোনটা নিয়ে বসে বসে ঘাঁটল একদিন , এমনিতে শুভ্র ফোন নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করেনা , বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতেই তার বেশি মজা লাগে, কিন্তু এখন তো সম্পূর্ণ একা তাই ফোন নিয়ে সময় কাটাতে চেষ্টা করল ৷ কিন্তু কিছুতেই ঠিক মন ভালো হচ্ছেনা আর ৷ তিন চার দিন এভাবে কোনোক্রমে কাটিয়ে একদিন সকালে বিদ্যুৎকে নিয়ে বেরোবে ভেবে যেই বের করেছে সাইকেলটা , বাবা বলে উঠলেন, "চারিদিকে সবার করোনা অ্যাটাক হচ্ছে , ক্লাব দোকান সবই তো বন্ধ ,তা সাইকেল নিয়ে কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনি ?"
"বাড়িতে থাকতে আর ভালো লাগছে না , যাই একটু সাইকেল নিয়ে হারুদের বাড়ি থেকে ঘুরে আসি !"
"বাড়িতে থাকতে ভালো লাগবে কেন ? বাবার হাতের কিছু কাজ করে দিই ,বাগান পরিষ্কার করি ,সেসব তো করবে না , নবাবপুত্তুর চললেন হাওয়া খেতে , যাও! যাও ! মোড়ে পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে, ধোলাই খেলেই মজা টের পাবে ৷ যাচ্ছো যাও, কিন্তু মুখে মাস্ক পরে যাও ৷"
অগত্যা অনিচ্ছাতেই একটা মাস্ক মুখে দিয়ে শুভ্র বেরিয়ে পড়ল ৷ হারুদের বাড়ি যাবার পথে অনিল কাকুদের বাড়ির দিকে চোখ পড়তেই দেখল বাড়িটা কেমন অদ্ভুত ভাবে বেড়া দিয়ে ঘেরা ৷ হারুর বাড়ি পৌঁছে ওকে জিজ্ঞেস করে জানল অনিল কাকু , কাকিমা আর ওদের ছেলে অশোক তিনজনেরই করোনা হয়েছে , তাই পৌরসভা থেকে ওদের বাড়িটা অমন ঘিরে দিয়েছে ৷ হারু বলল, "তুইও আর বেশিক্ষণ এখানে থাকিসনা শুভ্র ,এসময় বেশি বাইরে থাকা ঠিক নয় ৷"
হারু চলে গেলে শুভ্র সাইকেল নিয়ে অনিল কাকুর বাড়ির সামনে যেতেই দেখে অনিল কাকু জানলার গ্রিলে মাথা দিয়ে কাউকে যেন খুঁজছে ৷ শুভ্র বেড়ার কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, "ও কাকু কিছু বলবে নাকি ?"
অনিল কাকু হাতের ইশারায় শুভ্রকে ডেকে বলল, "শুভ্র বাবা, আমাদের কয়েকটা জিনিস লাগবে একটু বাজার থেকে এনে দিবি ? পৌরসভার লোকেদের কতবার ফোন করলাম এখনো তো কেউ এলনা ৷"
শুভ্র বলল, "এই কথা ? হ্যাঁ হ্যাঁ বলোনা কী আনতে হবে আর টাকা দাও আমি এক্ষুনি এনে দিচ্ছি !"
বাজার থেকে জিনিসগুলো এনে অনিল কাকুকে দিয়ে শুভ্র বলল, "এই নাও কাকু, আর এই আমার ফোন নম্বর তোমার যখন দরকার হবে একটা ফোন করে ডাকলেই চলে আসব !"
এরপর থেকে মাঝে মাঝেই অনিল কাকুর ফোন পেতেই শুভ্র চলে যেত ওদের বাড়ি আর যা যা দরকার সব এনে দিত ৷ আস্তে আস্তে সুবীর জ্যেঠুর বাড়ি ,রমেন কাকার বাড়ি যারাই করোনার কারণে আটকে পড়ছে শুভ্র তার বিদ্যুৎকে নিয়ে ছুটে যাচ্ছে সেখানে ৷ কারো বাড়ির বাজার এনে দেওয়া কিংবা কারো অক্সিজেন সিলিন্ডার বয়ে নিয়ে আসা , বিদ্যুতে সওয়ার হয়ে এসব সমস্যা মুহূর্তের মধ্যে সমাধান করে দিচ্ছে শুভ্র ৷ শুরুতে বাড়ির লোকে টের পায়নি কিছুই, কিন্তু পাড়ার বিভাসবাবু কথাটা শুভ্রর বাবার কানে তুলতেই শুভ্রর বাবা একেবারে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন |সেদিন শুভ্র বাড়ি ফিরতেই ধমক দিয়ে বলে উঠলেন, "কোথায় গিয়েছিলি রাস্কেল ? "
শুভ্র মুখ নিচু করে বলল, " পরিতোষদার বাড়ি , পরিতোষদার মায়ের জন্য অক্সিজেন সিলিন্ডার আনতে !"
গলার স্বর আরও চড়িয়ে শুভ্রর বাবা বললেন, "ও! আজকাল দেশোদ্ধার করতে যাওয়া হচ্ছে! ঐ ছোঁয়াচে রোগের বাড়ি থেকে ঘুরে এসে খবরদার আমার বাড়িতে ঢুকবি না , যা বেরিয়ে যা বাড়ি থেকে, যেখানে খুশি থাকগে যা, কিন্তু এই বাড়িতে আর তুই পা দিবি না , নিজে তো মরবে , বাড়ি শুদ্ধু সবাইকে মেরে ছাড়বে দেখছি ৷"
শুভ্র বারান্দায় রাখা কয়েকটা টি শার্ট আর প্যান্ট নিয়ে ওর গামছাটা কাঁধে ফেলে নিয়ে সাইকেলের স্ট্যান্ডটা তুলে মাথা নিচু করে চলে গেল ৷
পল্টুদার বাড়ি গিয়ে ডাকল দু তিন বার ,পল্টুদা বেরোতেই শুভ্র বলল, "ক্লাবের চাবিটা দাও তো পল্টুদা !"
"ক্লাবের চাবি নিয়ে কী করবি রে ? করোনার জন্য কেউই তো এখন ক্লাবে আসছে না ,তুই ক্লাবে একা একা কী করবি এখন ?"
" আমি ক্লাবে থাকব পল্টুদা !"
"থাকবি মানে ?"
"বাবা বলেছে বাড়িতে ঢুকতে দেবে না ,আর এই সময় কারো বাড়িতেই তো কেউ আমায় থাকতে দেবেনা , তাই ভাবলাম ক্লাবেই থাকি , ক্লাবটা পাহারা দেওয়াও হবে ,আর আমি মাঝে মাঝে ঝাড়া মোছাও করে রাখতে পারব, কী বলো ??"
"দেখ যা ভালো বুঝিস ! এই নে চাবি !"
সেদিন থেকে ক্লাবেই রইল শুভ্র | পাশের পাড়ায় একজায়গায় গরিবদের জন্য কমিউনিটি কিচেন খোলা হয়েছে, সেখান থেকেই দু'বেলা খাওয়াটা জুটে যেত ,এবার আরও নতুন উদ্যমে শুরু হল শুভ্রর কাজ ৷ এলাকার মানুষের পাশে থাকার সাথে সাথে পাশের এলাকার মানুষদের সাহায্যেও ছুটল শুভ্র ৷ হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার জন্য কোনো গাড়ি না পাওয়া গেলে শুভ্রর বিদ্যুৎ-এর বড় ক্যারিয়ারে চাপিয়ে তাদের সে হসপিটালে পৌঁছে দিত ৷ এমনকি ধীরে ধীরে হসপিটালের অনেক দরকারি কাজের জন্যও যখন কাউকে পাওয়া যেত না তখন স্টাফেরা ভরসা করত শুভ্রর উপরেই ৷ এভাবেই করোনা যুদ্ধে একেবারে স্বেচ্ছায় নিজেকে সঁপে দিল শুভ্র ৷ না, কোনো লাভের আশায় নয় , এমনকি চাকরির কর্তব্য পালনের প্রয়োজনেও নয় , কেবলই মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রবল টানেই সে দিনের পর দিন ছুটে চলল তার বিদ্যুৎকে নিয়ে ৷ পরিতোষ যেদিন শুভ্রর আনা অক্সিজেন সিলিন্ডারের জন্য মা-কে বাঁচাতে পেরেছিল, সেদিনই কৃতজ্ঞতায় মাথা নিচু করেছিল শুভ্রর কাছে , কিন্তু তারপর যখন শুনল ঐটুকু একটা ছেলে যাকে বাবা বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে সে কেমন অকাতরে বিলিয়ে যাচ্ছে সেবা নিশ্চিন্তে হাসিমুখে , তখন বিস্মিত না হয়ে পারল না ৷ পরিতোষ একসময় শুভ্রর বাবার ছাত্র ছিল ,এখন কলেজের প্রফেসর ৷ কিন্তু এত পড়াশোনা করে এত ভালো চাকরি পেয়েও তো কই শুভ্রর মতো এতো বড় মন পায়নি সে ৷ অনুতপ্ত মনে ভাবল শুভ্রর জন্য কিছু করা উচিৎ ৷ পাড়ায় অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে ,বাজার নিয়ে লোকের বাড়ি পৌঁছে দেবার সময় পরিতোষ গোপনে কয়েকটি ছবি তুলে নিল শুভ্রর ৷ আর তারপর আগাগোড়া সমস্ত কথা গুছিয়ে লিখে শুভ্রর ছবিগুলো দিয়ে পোস্ট করে দিল সোশ্যাল মিডিয়ায় ৷ প্রফেসর হবার দরুণ পরিতোষের প্রোফাইলটা বেশ পপুলার , সাথে সাথে সে পোস্ট ছড়িয়ে পড়ল শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ৷ ঝড়ের গতিতে শেয়ার হয়ে গেল সে লেখা ৷ কমেন্টের নোটিফিকেশন ভরে গেল পরিতোষের ফোনে | কিছুজন তো এই ঘটনার ভিডিও বানিয়ে ফেলল ৷ পাড়ায় তখন সবার মুখে মুখে শুভ্রর প্রশংসা ৷ এলাকার কাউন্সিলার নিজে এসে শুভ্রর বাবাকে ধন্যবাদ দিয়ে গেলেন ৷ শুভ্র এসবের কিছুই টের পেল না ৷ সেদিন তাড়াহুড়োতে স্মার্ট ফোনটা বাড়ি থেকে আনতেই ভুলে গেছে ও ৷ সবসময় ব্যবহারের জন্য একটা কী প্যাড ফোন থাকত ওর কাছে , সেটাই ওর কাছে আছে এখন ৷ সেদিন কমিউনিটি কিচেন থেকে খেয়ে ক্লাবে ফিরতেই দেখে ক্লাবের সামনে বাবা দাঁড়িয়ে | আর ওর কয়েকজন বন্ধু |বাবাকে দেখেই সবে সাইকেল ঘুরিয়ে উল্টো দিকে পালাতে যাবে সমু চেঁচিয়ে বলল, " শুভ্র শোন ! দাঁড়া ! যাসনি ! কাকু তোকে কিছু বলবে না শোন ! একটু দাঁড়া !"
সমুর ডাকে দাঁড়িয়ে পড়তেই সমু ছুটে গিয়ে ওকে আটকাল , হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, "শুভ্র কাকুর কাছে চল ! কাকু তোকে বাড়ি নিয়ে যেতে এসেছেন !"
সমুর কথায় ধীরে ধীরে মাথা নিচু করে বাবার সামনে এসে দাঁড়াল শুভ্র ৷ শুভ্রর বাবা বুকে জড়িয়ে ধরল ছেলেকে তারপর ভেজা ভেজা চোখে শুভ্রর দিকে তাকিয়ে বলল, " বাড়ি চল ! ক্লাবে থাকতে হবেনা আর ৷ "
"কিন্তু বাবা তুমিই তো ...."
"হ্যাঁ আমি জানি, আমিই তোকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম , আমি নিজের ভুলটা বুঝেছি বাবু ! পরিতোষ আমার চোখ খুলে দিয়েছে ! তুই বাড়ি চল বাবা ৷ "
বাবার হাত ধরে যখন বাড়ি ফিরল শুভ্র , দেখল অনিল কাকু , রমেন জ্যেঠু , পরিতোষদা , বিভাস কাকা দাঁড়িয়ে আছে ওদের বাড়ির সামনে ! শুভ্রকে দেখেই গলা জড়িয়ে বলল, " তুই আমাদের গর্ব শুভ্র, তোর জন্য আজ কত মানুষ প্রাণে বেঁচে গেল রে !" পরিতোষদা বলল, "স্যার আপনি জীবনে যত ছাত্র মানুষ করেছেন তার মধ্যে সেরা ছাত্রটি হল আপনার ছেলে , সবচেয়ে বড় শিক্ষা , মনুষ্যত্বের শিক্ষাটা আপনি ওকেই দিয়েছেন |"
কয়েক মাস পরে পৌরসভার বার্ষিক অনুষ্ঠানে সেরা নাগরিকের সম্মানে ভূষিত করা হল শুভ্রকে ৷ কাউন্সিলারের রেকমেন্ডেশনে রাজ্যস্তরে সেরা কোভিড যোদ্ধা হিসাবে যাঁরা পুরস্কৃত হলেন সেই ডাক্তার, নার্স ,পুলিশ, অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভারের তালিকায় নাম উঠল শুভ্রর ৷ সেই উজ্জ্বল মুহূর্তে যখন সম্মাননা নিতে উঠছে শুভ্র ,হাততালিতে ফেটে পড়ছে টিভির সামনে চোখ দিয়ে বসে থাকা শুভ্রর পাড়া , শুভ্রর ক্লাব ৷ শুভ্রর উজ্জ্বলতার কাছে ফিকে হয়ে যাচ্ছে তার বন্ধুদের ৯০% নম্বর , ফিকে হয়ে যাচ্ছে ডাক্তারি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে চান্স পাওয়া ছেলের বাবার গর্ব ৷
বাড়ি ফিরে বিদ্যুৎকে মেডেলটা পরিয়ে দিয়ে শুভ্র বলল এ মেডেল তো আসলে তোরই প্রাপ্য রে , তোর পিঠে চেপেই তো এসব করতে পেরেছি আমি ৷ রোদ্দুরের ঝিলিকে চক চক করে উঠল সাইকেলের হ্যান্ডেলটা, মনে হল মনিবের সাফল্যে সেও যেন খুশিতে উচ্ছ্বসিত আজ ৷
=======================
বুংকুলুং-এর একটি রাত
মিনাক্ষি মণ্ডল
সদ্য বিবাহিত দম্পতির স্বাভাবিকভাবে রোমান্টিকতার বহর অনেকটা বেশি থাকে, সেই কারণেই মধুচন্দ্রিমার মতন একটা স্পেস বেশিরভাগ দম্পতিই খুঁজে নেয়।
সুকন্যা আর ভাস্কর এর জীবনে এরকম কোন কিছুই ঘটেনি, বিয়ের ছয় মাস আগে ভাস্কর সদ্য ডিফেন্সের চাকরির ট্রেনিং শেষ করে এসেছে। পোস্টিং বাড়ি থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে একটি অফিসে, কিন্তু বৌভাতের সাত দিনের মাথায় ভাস্করকে অফিসের কাজে যেতে হয় দিল্লি।
তাদের রোমান্টিকতার আদান প্রদানের তখন একমাত্র মাধ্যম ছিল চিঠি । সুকন্যা ভাবত দিল্লি থেকে ফিরে এসে তারপর তো কাছেই থাকবে।
তিন মাস পর দিল্লি থেকে ফিরে এল ভাস্কর ৷ যেহেতু অফিস থেকে বাড়ি দূরত্ব পাঁচ কিলোমিটার সেহেতু ভাস্করের বাড়ি থাকার পারমিশন নেই, থাকতে হবে অফিস ক্যাম্পে।
প্রায় দুটো বছর আজ এখানে কাল ওখানে করে কেটে গেছে ভাস্করের।
সুকন্যা আয়নার সামনে দাঁড়ালে নিজেই বুঝতে পারত তার চেহারায় উদাসীনতার ছাপ ।
একদিন দুপুর বেলা প্রচণ্ড বৃষ্টি , শ্বশুরবাড়ির বাকি সদস্য ঘুমোচ্ছে , ডাইনিংয়ের যে দরজাটা উঠোনের দিকে যায় সেখানে গিয়ে সুকন্যা দাঁড়ায়, চাঁপা টগর গাছে ইষ্টি কুটুম পাখি ডেকে চলেছে ...
সুকন্যার মনে হঠাৎ খুশির ঝলক ওঠে, নিজের মনে প্রশ্ন জাগে, 'তাহলে কি আজ ভাস্কর বাড়িতে আসবে'?
ধ্যাত, ভাস্কর কি এ বাড়ির অতিথি নাকি?
আবার ভাবে,' অতিথিই তো বটে দু বছরে কটা দিন ও বাড়ি থেকেছে গোনা যাবে'।
' কি করছো এখানে দাঁড়িয়ে'?
সুকন্যা পিছন ফিরে দেখে ভাস্কর !
এত আনন্দ হয় যে সুকন্যা কেঁদে ফেলে, সেই রাতেই শিলিগুড়ি ট্রান্সফারের কথা ভাস্কর বাড়িতে জানায় ,সাথে এটাও জানায় এবার সুকন্যাকে সে সাথে নিয়ে যেতে চায়।
জায়গাটার নাম ফুলবাড়ি, আজ চার দিন একটা ভাড়া বাড়িতে ভাস্কর সুকন্যার নতুন সংসার । খুব কাছেই ভাস্করের অফিস।
নিয়মিত কাজের চাপের ফলে একজন আরেকজনের প্রতি সহনশীলতা হারিয়ে ফেলার আগেই ভাস্কর কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে এক মোটর বাইক কিনে বাড়ি আসে।
সেদিন সুকন্যা খুব খুশি হয়েছিল কারন বিয়ের আগে ভাস্করের বাহন ছিল তার সাইকেল । ইচ্ছে থাকলেও তখন মোটর বাইক কিনতে পারেনি, অথচ এক সময় ভিকেলস-এ কাজ করার জন্য তার লাইসেন্স আছে বাইক চালানোর। আজ তা সার্থক, ভেবেই আনন্দ পায় সুকন্যা।
দুপুরে খেতে বসে প্ল্যান করে ভাস্কর মোটরবাইক নিয়েই কাছাকাছি কোথাও ঘুরতে যাবে। হঠাৎ সুকন্যা বলে, কলেজে এক বন্ধুর মুখে এই নর্থবেঙ্গলেই কোথাও বুংকুলুং নামে একটি গ্রামের কথা শুনেছিলাম ।
ভাস্কর বলল,' ঠিক আছে, আমি দেখে নিচ্ছি সেটা কোথায়। তার আগে আমরা যে বাহনটি তে যাব সেটির পুজো করতে হবে।
পরদিন খুব ভোরে এক কালীমন্দিরে বাহনের পুজো সেরে, নিজেরা এক রেস্টুরেন্টে আলু পরোটা, ধনেপাতার চাটনি, মাটির ভাঁড়ে চা খেয়ে ,এক পেট্রোল পাম্পে গিয়ে বাহনকে তার খাবার খাইয়ে রওনা দিল বুংকুলুং-এর দিকে। জায়গায় জায়গায় থেমে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার পর পৌঁছলো প্রায় সন্ধ্যায়।
বুংকুলুং যেতে যেতে তাদের নজরে এল অনেক চাষের জমি ও পুকুর , পথের পথিকদের থেকে শোনা কথা প্রায় উনিশটি পুকুর গ্রামটিকে ঘিরে রয়েছে। খুব শান্তশিষ্ট পরিবেশ, পথে যে কজন মানুষের সাথে কথা হল , বোঝা গেছে মানুষগুলোও খুব সহজ-সরল।
তারা আগেই ঠিক করেছিল রাত্রিবাস টেন্টে করবে । সে রাতে সুকন্যা আর ভাস্কর টেন্টের ভিতর আর তাদের বাহন মোটরবাইক দরজার কাছে বডিগার্ড হয়ে তাদের পাহারা দিচ্ছে, বিয়ের পর যেন সুকন্যার জীবনে পরম পাওয়া এই বুংকুলুং এর রাতটি।
পরদিন খুব ভোরে তারা বেরিয়ে পড়ে গয়াবাড়ি চা বাগান দেখতে... ৷ পথে যেতে যেতে চোখ জুড়ানো অবাক করা দৃশ্য। একদিকে পাখির কলতান অন্যদিকে গ্রামের মেয়েরা চায়ের বাগানে পাতা টিপাই-এর সাথে সাথে গুনগুন গান করে চলেছে।
কিছুটা যেতেই ময়ূরের ঝাঁক। তাদের বাহনের আওয়াজে সরে সরে গেল ময়ূরের দল।
কিছুটা গিয়েই বালাসুন নদী।
ইকো হাট, সেখানে কিছু কেনাকাটার পালা চলল।
এবার ঘরে ফেরার পালা, সুকন্যার তখন সবথেকে ভালো লাগছিল যখন ভাস্কর আর সে পাহাড়ের উপরে উঠে ছবি তুলছে আর নিচে তাদের বাহন মোটরবাইক অপেক্ষা করছে তাদেরকে ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
সুকন্যা- ভাস্কর সংসার জীবনে বেশ কয়েকটা বছর পেছনে ফেলে এসেছে, কিন্তু তাদের বাহন মোটরবাইক এখনো তাদের সঙ্গী হয়ে রয়েছে।
চিত্র-সৌজন্য— গুগল
=======================
লং ড্রাইভ
মানসী গাঙ্গুলী
নীল আর অহনার ভালবাসা এতদিনে বেশ পরিণত। গত ৭বছর ধরে ওরা ভালবাসে একে অপরকে। প্রথম শুরু হয় যেমন ভাবে ওদেরও শুরু সেভাবেই। অহনা তখন কলেজে আর নীল নতুন কলেজে লেকচারার হয়ে ঢুকেছে। লাল রঙের একটা পোলো গাড়ি নিয়ে ও যখন ঢুকত কলেজে, গাড়ি থেকে নামতেই জোড়া জোড়া মেয়েদের চোখ যে ওর ওপর পড়ে আছে, তা ও পিছন থেকেই বুঝতে পারত। মহিলা কলেজ। অনেক মেয়েই ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করত, কিন্তু অহনার মধ্যে সেটা ছিল না। সে মন দিয়ে ক্লাস করত, ক্লাসের অবসরে লাইব্রেরীতে গিয়ে পড়াশুনা করত। নীল বুঝত অহনা আর পাঁচটা মেয়ের মত নয়, একটু স্বতন্ত্র। আস্তে আস্তে ও অহনার প্রেমে পড়ে যায়, কিন্তু হাবেভাবে অহনাকে বুঝিয়ে উঠতে পারে না কিছুতে। আসলে অহনার সেদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ ছিল না। নীল ছটফট করত কিভাবে অহনাকে বোঝানো যায়। অবশেষে সুযোগ বুঝে একদিন অহনাকে প্রেম নিবেদন করে ফেলে ও। অহনা খুব লজ্জা পায়, নীলকে এড়িয়ে চলতে চায়। এতে নীলের অহনার প্রতি আকর্ষণ আরো বেড়ে যায়। আকর্ষণ তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে ক্রমে এবং তা অহনার মধ্যে সংক্রামিত হয়। অবশেষে অহনা সমর্পণ করে নিজেকে নীলের কাছে।
তবু প্রথম প্রথম অহনা দেখা করতে চাইত না নীলের সঙ্গে, পাছে কেউ দেখে ফেলে, পাছে বন্ধুরা জেনে ফেলে। কিন্তু বেশিদিন লুকানো সম্ভব হয়নি। কলেজে ফিসফাস শুরু হয়ে যায়। বন্ধুরা রসিকতা করে। পাস করে কলেজ থেকে বেরিয়ে অহনা স্বস্তি পায়। তারপর ইউনিভার্সিটি। পিএইচডি করে অহনাও কলেজে লেকচারার হয়ে জয়েন করে। দুজনের কলেজ আলাদা। অবসরে দুজনে দেখা করে, ঘোরেফেরে, সিনেমা, রেস্টুরেন্ট ভালই চলছিল। মাঝেমধ্যে ছুটি পেলে নীলের এনফিল্ড বাইকে চেপে হারিয়ে যেত দুজনে ওরা অজানা কোনো পথে, অচেনা কোনো জায়গায়। এতে ওরা খুব আনন্দ পেত। অহনা ফাঁকা রাস্তায় নীলকে জাপটে জড়িয়ে ধরত। বাইক তো নয় যেন পক্ষীরাজ। এই বাইক রাইডিংটা অহনা খুব উপভোগ করত। ফাঁকা রাস্তা দিয়ে যাবার সময় সে গলা ছেড়ে গান গাইত। নীলের পিঠে মুখটা রেখে কখনও "এই পথ যদি না শেষ হয়", আবার কখনও " হারিয়ে যেতে যে ইচ্ছে করে, কেন লজ্জা এসে যে জড়িয়ে ধরে", গাইত। নীল আনন্দের চোটে ফাঁকা গ্রামের পথে এঁকেবেঁকে বাইক চালাত। অহনা বেশি প্রগলভ হয়ে উঠত, হেসে গড়িয়ে পড়ত নীলের পিঠে, জাপটে জড়িয়ে ধরত ওকে। দুজনে সমস্বরে হেসে উঠত কলকল করে। নীলের লাল গাড়িতে করেও ওরা ঘুরেছে অনেক কিন্তু তার থেকে বাইকে ঘোরাই পছন্দ ছিল অহনার। নীলেরও খুব ভাল লাগত। এতে অহনাকে বেশি ঘনিষ্ঠভাবে পাওয়া যেত, একেবারে অঙ্গাঙ্গী।
খুবই ভাল চলছিল। এবার বিয়ের কথা ওঠে অহনার বাড়ি থেকে। এতদিন বাড়িতে কিছু জানত না, এবার সে মাকে জানায়, "আমার জন্য পাত্র দেখার দরকার নেই, আমার ঠিক করা আছে"। মা আকাশ থেকে পড়েন, তাঁর অমন শান্ত-সুশীলা মেয়ে কাকে কেমন করে ঠিক করে রাখল! চিন্তায়ও পড়েন তিনি। তবে মেয়ের কাছে সব শুনে কিছুটা নিশ্চিন্ত হন। নীলকে বাড়িতে নিয়ে আসতে বলেন। অহনা নীলকে জানায় সে কথা, ওকে তাদের বাড়ি নিয়ে যেতে চায়। নীল এড়িয়ে যায়। 'যাচ্ছি যাব' করে কাটায়, বলে, "গেলেই হবে, তাড়া কিসের?" "বেশ, তোমার যেদিন ইচ্ছে হবে বোলো, নিয়ে যাবো তোমায় আমাদের বাড়ি।" নীলের না আসাটা ভাল লাগে না অহনার মায়ের, বলেন, "কী ব্যাপার বল তো? ছেলেটি আসতে চাইছে না কেন আমাদের বাড়ি?" নীল নিজেও যে অহনাকে ওর বাড়ি নিয়ে যাবার কথা তোলে না সেটা অহনা আর মাকে বলে না। বলে, "আসবে মা, তুমি চিন্তা করো না। এত তাড়ার কী আছে?" তবে তার নিজেরও ভাল লাগে না এই ব্যাপারটা। কিন্তু বরাবরের শান্ত, ভদ্র মেয়ে অহনা এ নিয়ে কোনো জোরাজুরি করে না নীলকে। নীল আর তার এতদিনের ভালবাসা, সেখানে কোনোরকম তিক্ততা চায় না অহনা। তাই সে মেনে নেয় নীলের ইচ্ছে। ভাবে যখন চাইবে তখনই হবে। কিন্তু মনে মনে অহনা এবার সংসার করার জন্য প্রস্তুত। কিন্তু কি করবে? একতরফা তো হয় না।
আগের মত সবই চলছিল ঠিকঠাক, কিন্তু অহনার কেন এমন মনে হয়? খালি মনে হয় কোথায় যেন সুর কেটে গেছে, নীলের মধ্যে আগের মত আর আবেগ নেই যেন। মনে মনে ব্যথা অনুভব করে তবু নীলকে কিছু বলে না।
এরই মধ্যে এক ছুটির দিনে নীল অহনাকে বলে, "চল আজ বাইকে করে লং ড্রাইভে যাই"। অহনার খুব ভালো লাগে। নীলের মধ্যে মাত্রাছাড়া আবেগ অহনাকে খুশিতে ভরিয়ে তোলে। মনে মনে লজ্জা পায়। ছি ছি শুধু শুধু নীলকে সে কেমন ভুল বুঝছিল। নিজেকেই দোষারোপ করে সে। ন্যাশনাল হাইওয়ে দিয়ে শাঁ শাঁ করে বাইক ছুটছে। অহনা খুব মজা পাচ্ছে। মনের অবস্থা সেই 'সপ্তপদী' সিনেমার "এই পথ যদি না শেষ হয়" সিনটার মত। নীল বাইকের গতি বাড়ায়। রাস্তা দিয়ে এঁকেবেঁকে মজা করতে করতে নীলের বাইক চলছে। পিছনে লরি, নীল বাইকের গতি আরো বাড়ায়। এমনই এক সময় কখন যে অহনা বাইকের পিছন থেকে পড়ে গেছে নীল টেরই পায়নি। সে উড়ে চলেছে। বেশ অনেকদূর যাবার পর রাস্তায় গাড়ি বেশি চলে আসায় নীল বাইকের গতি কমায়। অহনাকে কিছু বলে সাড়া না পেয়ে নীল গাড়ি সাইড করিয়ে দেখে অহনা পিছনে নেই। নীল ঘাবড়ে যায়। আবার উল্টো পথে রওনা দেয়। কি হল, কোথায় গেল অহনা? প্রায় ৩কি.মি ফেরার পরে দেখে এক জায়গায় বিশাল হইচই, প্রচুর মানুষের ভিড়। নীল বাইক সাইড করে দুরুদুরু বুকে পায়ে পায়ে এগিয়ে দেখে একটা বডি ঘিরে জটলা। কাছে গিয়ে দেখে সেটা অহনা। তার দেহটা চেপ্টে রাস্তার সঙ্গে প্রায় মিশে গেছে কিন্তু মুখটা অবিকৃত। আর এমত অবস্থায় তার প্রাণটা তখনও রয়েছে। সে যে কী করুণ দৃশ্য! উপস্থিত সকলে যারা সেখানে ছিল অপরিচিত মেয়েটির এমন অবস্থা দেখে সবাই যে খুব কষ্ট পাচ্ছিল, তা তাদের কথাবার্তা শুনেই বোঝা যাচ্ছিল। নীলের মনে হল তাকে দেখে অহনা যেন কিছু বলতে চাইল, যদিও সে অবস্থায় ছিল না অহনা। নীল দু'হাত দিয়ে তার চোখ ঢেকে ফেলল। অহনাকে তুলে নিয়ে যাবার মত অবস্থায় সে ছিল না, কেবল মৃত্যুর অপেক্ষা। ঐখানে ঐভাবে কিছুক্ষণ পরে নীলের চোখের সামনেই তার মৃত্যু হল। বস্তুত, সেখানে উপস্থিত সকলেই অহনার তাড়াতাড়ি মৃত্যু কামনা করছিল, কারণ সবাই বুঝতে পারছিল কি প্রচণ্ড কষ্ট অহনা পাচ্ছিল। প্রত্যক্ষদর্শীদের কথায় জানতে পারা যায় অহনা পড়ে গেলে, পিছনেই এক দশচাকার লরি ছিল যেটা ঊর্দ্ধশ্বাসে দৌড়াচ্ছিল। সেটা গতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে অহনাকে পিষে দিয়ে চলে যায়।
অতঃপর পুলিশ, থানা, হাজতবাস সবই হল নীলের। অহনার বাবা-মা তথ্য প্রমাণ জোগাড় করে কেস করেন নীলের বিরুদ্ধে। সে নাকি অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে ও অহনার কাছ থেকে মুক্তি পেতেই তার এই ইচ্ছাকৃত দুর্ঘটনা ঘটানো।
আর পাঁচটা কেসের মতোই এখানেও মনের মত কোনো মীমাংসা হয় না। প্রমাণ হয় এ মৃত্যু দুর্ঘটনাজনিত। আর বাইক জোরে চলাকালীন পিলিয়ন রাইডার বাইকের পিছন থেকে পড়ে গেলে নাকি বাইকার সেটা না বুঝতেও পারে। উকিলের কেরামতিতে নীল বেকসুর খালাস হয়ে যায়। সে এখন দুটি বাচ্চার বাবা, সুখের সংসার। অহনার বাবা-মার মনে আজও প্রশ্ন — সত্যিই কি তাদের মেয়ের মৃত্যুটা ছিল দুর্ঘটনাজনিত?
=======================