Saturday, December 1, 2018

রাজিত বন্দোপাধ্যায়



বড়গল্প-
জীবন মৃত্যু     

অবিনাশী তু তৎ বিদ্ধি ,
যেন সর্বম্ ইদম্ ততম্ ,
বিনাশম্ অভ্যাস্যাস্য ,
ন কশ্চিৎ করতুম্ অরহতি ।।
অর্থাৎ , সমস্ত যদি নষ্টও করে ফেলা যায় , তবু আত্মার বিনাশ সম্ভব নয় । এই বলে মুখ তুলে আমাদের দিকে তাকালেন ব্রজেশ তিওয়ারী । আমি আর মিঃ পুরী তাঁর টেবিলের সামনে বসে । বিখ্যাত বৈজ্ঞানিকের মুখ গম্ভীর । বললেন ,     
-- আপ লোগোকো সমঝানে কে লিয়ে হমারে ভারত কা পুরাণ মে আত্মা কে বারে মে জো জ্ঞান থা ও বোলে । 
আমি কথা কেটে বললাম , 
-- লেকিন স্যর হম একবিংশ শতাব্দী মে বৈঠকর বাতে কর রহে হ্যায় ।   
-- তো পর ভী , আজ ভী নহী জানতে প্রাণ ক্যা হ্যায় ! আত্মা তো উস সে ভী সূক্ষ্ম বাত হ্যায় ব্যানার্জী সাহাব ।    
               কথা গুলো অতীব সত্য , একথা আমাদের মানতেই হবে । কেননা আজও বিজ্ঞান ভেবে বার করতে পারেনি প্রাণ কী বস্তু ! কেমন ভাবে তা জীব দেহে তৈরী হয় । কিসের দ্বারা তৈরী হয় । তবু ভারতে আমাদের পূর্ব পুরুষেরা প্রাণ বিষয়ে অনেক এগিয়ে ছিলেন । আমার কথা কেটে মিঃ পুরী বললেন ,  
-- সচ , ক্যা হ্যায় ও একস্ট্রা জ্ঞান মিঃ তিওয়ারী ?  
উনি বললেন , মান্ডুক্যাপনিষদে বলা হয়েছেঃ 
এসো 'নর সেতাসা ভেদিতাভ্য , যস্মিন প্রাণাহ পনসধা সামবিভেসা , প্রাণ ইস সিত্তাম শ্রভম্ ওতাম্ প্রাণায়ম্ , যস্মিন বিশুদ্ধে বিভাবতী এসা আত্মা ।।  
অর্থাৎ আত্মা পরমাণু সদৃশ্যই সূক্ষ্ম এবং তা একমাত্র অন্তর্দৃষ্টি দ্বারাই প্রত্যক্ষ করা সম্ভব । এই পারমাণবিক আত্মা পঞ্চ বায়ূ অর্থাৎ --- প্রাণ , আপন , বান , সমান ও উদন --- এরা যখন হৃদযন্ত্রে সঠিক ভাবে সজ্জিত হয় এবং এর স্পন্দন সমস্ত দেহে সঞ্চারিত করে দেয় তখনই সজীবতার সৃষ্টি হয় জীব দেহে !  
-- লেকিন স্যর হম আধুনিক জমানে মে মেডিক্যাল সায়েন্স কা খেয়াল পুছনে আয়ে থে         
মিঃ পুরীর প্রশ্নে তিনি জানালেন , চিকিৎসা বিজ্ঞানে জীবন হল তাপ গতীয় অসাম্য । জীবনের উদ্দেশ্য হল প্রকৃতিতে একটা তাপ গতীয় অসাম্য তৈরী করা । আর মৃত্যু হল তার ঠিক উল্টোটা । তাপ গতীয় স্থিতি । সমস্ত জৈব রাসায়নিক ক্রিয়া বিক্রিয়ার চিরতরে বন্ধ হওয়া । তাই মৃত্যুতে আমাদের দেহ অন্যান্য জড় পদার্থের মত স্থির ও ঠান্ডা হয়ে যায় । নোবেল বিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ক্রীকের মতে আত্মা হল মন ! আর মন হল মস্তিষ্কের স্নায়ূকোষ । তার মৃত্যুই তাই মনের মৃত্যু ও সেই সঙ্গে নশ্বর আত্মারও ।  
-- আর আপনাদের জিজ্ঞাস্য তো সেই তাপ গতীয় অসাম্যতা কি জীবদেহে ফিরিয়ে আনা যায় ? এ বিষয়ে বলি , হ্যাঁ যায় । অ্যান্টিডোটের আবিস্কার এই কাজেই ব্যবহৃত হয় । তবে তার প্রয়োগ সময় থাকতে করতে হয় ।  
আমি আর মিঃ পুরী তাঁর মুখের দিকে হতভম্বের মত চেয়ে রইলাম ।   
              এ কেসের মাথা মুন্ডু কিছুই এখনো আমার মগজে ঢোকেনি । কেবল বর্তমান সিচুয়েশনটা অদ্ভুত বলে বুঝতে পারছি । হোম ডিপার্টমেন্টের একটা সেল আছে যারা সারা দেশের অস্বাভাবিক ঘটনা নিয়ে তদন্ত চালায় । মিঃ পুরী সেই ডিপার্টমেন্টের একজন কর্তা ব্যক্তি । আমায় হোম সেক্রেটারী মারফৎ ডেকে এনেছেন এই অদ্ভুত পরিস্থিতিতে । ব্যাপারটা এসেছে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে ।    
বেশ কিছুদিন যাবৎ হঠাৎ দেখা যাচ্ছে যে পোলিও মুক্ত সার্টিফিকেট পাওয়া সত্ত্বেও ফের তা ধরা পড়তে শুরু করেছে । স্বাস্থ্য বিভাগের গোপন রিপোর্ট বলছে , এটা উত্তর ভারতেই বেশি করে দেখা যাচ্ছে । কমপ্লিট পোলিও কোর্স দেওয়া সত্ত্বেও কম বয়সী শিশুদের মধ্যে পোলিও দেখা দিচ্ছে ! এর কারণ কি ? পোলিও কি করে পুনরায় সক্রিয় হয়ে পড়ছে শরীরে ! ইউনিসেফ , বিশ্ব স্বাস্থ্য সংগঠনও ভীষণ ভাবে চিন্তিত ।   
আমি প্রায় চব্বিশ ঘন্টা হল এর কারণ খুঁজে পাইনি । তবে হাল ছাড়ছি নে । ব্রজেশ তিওয়ারীর সঙ্গে কথা বলার পর একটা পথ আমার মাথার মধ্যে উঁকি ঝুকি মারতে শুরু করেছে ।   
রাতে রেস্ট হাউসে ফিরে খাবার পর গুম মেরে বসে রইলাম বারান্দায় । সামনের গাছপালাও আজ গুম মেরে রয়েছে । দেশের লাখ লাখ বাচ্চার ভবিষ্যতের ব্যাপার ! কী হতে পারে ? বৈজ্ঞানিক কথা প্রসঙ্গে একটা নাম উল্লেখ করেছিলেন , ডঃ জীবক ঘোষদস্তিদার । কে এই ডঃ ? উঠে পড়ে ঘরের ভিতরে এলাম । কম্পিউটার খুলে গুগুলে সার্চ দেবার পর আর ঘুম এলনা !  
ডঃ ঘোষদস্তিদার দিল্লীতে এক অষুধ কোম্পানীর ল্যাবতে কাজ করতেন । গত ১৯৭৬- এর এক গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় ল্যাব থেকে বেরোবার পথে হঠাৎ পড়ে অজ্ঞান হয়ে যান ও সেই খানেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান । সেই সময় তাঁর ব্যাগ থেকে কিছু কাগজপত্র উধাও হয়ে যায় । যা তাঁর কম্প্যুটারে সেভ করা ছিলনা ! এই অবস্থায় পুলিশ আসে ও লাশ মর্গে যায় ।   
ময়না তদন্তে দেখা যায় হৃদরোগ নয় , আর্সেনিক ট্রাইহাইড্রাইড ! যা নিঃশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে ঢুকলে সরাসরি রক্তের লোহিত কণাকে ধ্বংস করে দেয় । আধ ঘন্টার মধ্যেই শরীর থেকে অদৃশ্য হয়ে যায় এই বিষ । তবে লক্ষণ রয়ে যায় দেহে । ডঃ ঘোষদস্তিদারের পুরুষাঙ্গের মধ্যে ও প্যান্টে রক্ত স্রাবের দাগ তারই প্রমাণ !
            ১৯৭৬- এ পুলিশী তদন্তে ল্যাবের তিনজন অ্যাসিসট্যান্ট বিজ্ঞানীর চাকরি যায় । কারণ এই তিনজনের মুখে মাস্ক ছিল সেই সময় । স্বীকার না করলেও এদের মধ্যে কেউ নিশ্চই গ্যাস স্প্রে করবার সুযোগ পেয়েছিল সেদিন । কেসের আজও সমাধান হয়নি । আমি ডঃ ঘোষদস্তিদারের গবেষণার বিষয়ে ঘাঁটতে ঘাঁটতে জানতে পারি , তিনি অ্যান্টিডোট বানাবার পদ্ধতির উন্নতি সম্পর্কে গবেষণা করছিলেন । সফল হয়ে ছিলেন কি ? আমার মনে হল বোধহয় !   
মনের মধ্যে কাঁটাটা খচ খচ করতে থাকায় আমি আবার গিয়েছিলাম ডঃ তিওয়ারীর কাছে । কথা বলে বুঝতে পারলাম ঘটনাটা প্রাকৃতিক নয় । লজিক্যালি বাচ্চাদের শরীরে ঢোকানো নিস্তেজ পোলিও ভায়রাসের ডি এন এ - র অবয়ব আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসার অর্থ হল অ্যান্টিডোট , যা বাচ্চাদের শরীরে কোন ভাবে ঢোকানো হয়েছে ।  
পরের দিন মিঃ পুরী এলে তাকে জিজ্ঞেস করে জানলাম , যে সব বাচ্চাদের মধ্যে পোলিও দেখা দিচ্ছে তা দিল্লী ও উত্তরাখন্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ । আমি মিঃ পুরীকে বললাম পোলিও আক্রান্ত বাচ্চাদের দেওয়া ওষুধ পত্রের একটা লিস্ট বানাতে । খুব দ্রুত কাজটা সারা হল ।
             এরপর যেটা ঘটল তা যেন ঝড় ! বাচ্চাদের দেওয়া ওষুধের মধ্যে পাওয়া গেল , ফলিক অ্যাসিড ও ভিটামিন সিরাপ ; প্যারাসিটামল ও অ্যান্টিবাওটিকের বাচ্চাদের ডোজের ট্যাবলেট । আমি লিস্টটা নিয়ে ভীষণ ভাবে চিন্তা ভাবনা ও গবেষণা শুরু করে দিলাম । এবং একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম যে , যাদের ফলিক অ্যাসিড সিরাপ দেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যেই শুধু দেখা যাচ্ছে পোলিও হবার লক্ষণ !   
এরপর আমার আগ্রহে স্বাস্থ্য বিভাগ জানালো , ঐ সিরাপ সাপ্লাই হয় দিল্লী ও আম্বালা থেকে । আমার আগ্রহে সেই সব ওষুধ বানানোর কোম্পানীর স্টক ও সরকারী মেডিসিন স্টোর থেকে সর্ব স্তরের স্টক তুলে নিয়ে আসা হল । ল্যাব টেস্টে একটি কোম্পানীর বানানো সিরাপে পাওয়া গেল অজানা বস্তু ! কিন্তু ঐ এলিমেন্ট যে কী তা ঠিক বোঝা গেলনা । কোম্পানীটি কে সীল করে দিয়েছে সি বি আই ।      
এরপর কোম্পানীর প্রতিটি কর্মচারী ও বৈজ্ঞানিকদের বায়োডাটা ও দৈনন্দিন কাজকর্ম ও গতিবিধি ট্রেস করতে শুরু করলে সি বি আই । তাতেই উঠে এল একটা অদ্ভুত তথ্য । যার মধ্যে আমি খুঁজে পেলাম একটা নাম , ডঃ রাকেশ শর্মা ।   
আমার মাথায় একটা খচ খচানি যেন আর থামছেই না । কোথায় যেন শুনেছি নামটা ? হঠাৎ মনে পড়ল ডঃ ঘোষদস্তিদারের মার্ডার কেসটা । আরে তিনজন সাসপেন্ড হয়ে যাওয়া তরুন বিজ্ঞানীর একজন না ? আমি ফের বসলাম কম্প্যুটার নিয়ে । প্রায় রাত একটায় ফোন করলাম হোম সেক্রেটারী অফিসে মিঃ পুরীকে ধরলাম ভায়া অফিসি । তারা সি বি আই ও এনফোর্সমেন্ট বিভাগে যোগাযোগ করলে দ্রুত ।  
               পরের দিন যখন স্বাস্থ্য দপ্তরে পৌঁছালাম , মিঃ পুরী কান এঁটো করা হাসি হেসে বললেন ,       
-- এট লাস্ট উই হ্যাব ডান মিঃ ব্যানার্জী । হি হ্যাজ কনফেসড ।    
-- বাট হোয়াই দিজ ?      
-- আরে ইয়ার ওহ অ্যান্টিডোট কা রেজাল্ট চেক কর রহা থা !        
আমি বিস্ময়ে একেবারে হতবাক হয়ে রইলাম।     

1 comment: