মৌলি বণিক

অণুগল্প -

অনুসন্ধান

ভীষণ শীতার্ত শহরটা আবছায়া ভারী কুয়াশার কম্বলের নীচে শীতকাতুরে নিদ্রায় নিদ্রিত সেদিন। রাস্তার আলোগুলোও ভালো দেখা যায় না - কোনক্রমে আধখোলা ঘোলাটে চোখে ঢুলছে। মধ্যরাত্রি - নৈঃশব্দ সপ্তপাতালের তলদেশ ছুঁয়েছে প্রায়।হঠাৎ নৈঃশব্দের বুক চিরে তীব্র কোলাহলে ভরে গেল শহরের উপকন্ঠের মধ্যবিত্ত পরিবার ভিত্তিক ছোট্ট একটি পাড়া। দুই জিপ বোঝাই আর্মড পুলিশ ফোর্স প্রায় যুদ্ধকালীন তৎপরতায় ঘিরে ফেলল ছোট্ট পাড়াটাকে। কুয়াশার পর্দা ছিঁড়ে জিপের হাই বীম লাইট প্রায় সার্চ লাইটের ভঙ্গীতে গলিগুলোর এমাথা- ওমাথা জুড়ে চিরুণী তল্লাসী শুরু করল। ভারী বুটের দৌড়াদৌড়ির দৌরাত্ম্য, তীব্র সাইরেন, মাইকের মুহূর্মুহূ হাঁকডাকের তান্ডবে প্রতিটি বাড়ীর জানালার কাঁচের ফ্রেমে তখন একে একে ফুটে উঠচ্ছে ভয়ার্ত আতঙ্কিত মুখের ছবি। বাইরের ঘন কুয়াশার মতই বিস্ময়ের প্রহেলিকার ছোঁওয়া সেই চোখগুলোতে।

ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে তল্লাসি- প্রতি ঘরে ঘরে রাতের ঘুম ভাঙিয়ে খটখটাখট্ কড়া নাড়া - জিজ্ঞাসাবাদ - সন্দেহ ও প্রয়োজন বোধে কয়েকটি গ্রেফ্তার আর সেই সংক্রান্ত বিকট শোরগোল-চিৎকার। আধ-ঘুমন্ত মানুষগুলোর ঘুমের রেশটুকু যাওয়ার আগেই ভয়ে প্রায় দিশাহারা । তবু তারই ভিতর ঠিক কি হচ্ছে, কেন হচ্ছে জানার প্রচেষ্টা থেকে আবিষ্কার করেছে যে ,পুলিশের কাছে গোপনসূত্রে খবর পৌঁছেছে কুখ্যাত এক আতঙ্কবাদী ও শহরের কয়েকটি ভয়াবহ ব্যাঙ্ক ডাকাতির মূল হোতা তথা মাষ্টার-প্ল্যানার তাদের এলাকায় গোপন ঘাঁটি গেড়েছে বেশ কিছুদিন হল আর এ'খবর নাকি অভ্রান্ত। অতঃপর মধ্যরাতের এই অতর্কিত পুলিশি অভিযান।

এস.পি. স্বয়ং এসেছেন এই অভিযানে - টেরিফিক টেররিস্ট হ্যান্ডেলিঙে তার বিশেষ সুনাম সুখ্যাতি। কিন্তু নাঃ কোথায় কি! সন্ত্রাসবাদীকে হাতে-নাতে ধরা তো দূরে থাক্ - তার ছায়াটিরও দেখা মিলছে না। দেড়ঘণ্টা অতিক্রম করতে চলেছে - চলছে রুদ্ধশ্বাস অপারেেশন; কিন্তু মিশন কিছুতেই সাকশেশফুল হচ্ছে না। ভিতরের চাপা হতাশাকে সঙ্গী করে পাড়ার একেবারে পেছনের গলির শেষ মাথায় ছোট্ট একটি একতলা বাড়ীর গেটের সামনে পৌঁছালেন এস.পি.। তার সেই হতাশাই বোধহয় কিছুটা ঝরে পড়ল একটানা অধৈর্য্য কলিংবেল বাজানোর শব্দে। বাড়ীর মালিকের দারিদ্রের চিহ্ন বাড়ীর বাইরে থেকেই প্রকট - জায়গায় জায়গায় লোনা ধরা প্লাস্টার খসা ভাঙা দেওয়াল- ফাটা কাঁচের জানালা রঙ-চটা বিবর্ণ ।

দরজা খুললেন বাড়ীর গৃহকর্ত্রী। কোনও বাক্যালাপ হওয়ার আগেই নিতান্ত অভদ্র ভঙ্গীতে দরজা ঠেলে পুলিশ সদলবলে বাড়ীতে ঢুকে পড়ল হুড়মুড়িয়ে। মুহূর্তে শুরু হল রুটিনমাফিক সন্ধানী চোখের কড়া খানাতল্লাসি প্রতিটি ইঞ্চি স্থানে- কিন্তু কোথাও কোনকিছুর হদিশ নেই। হঠাৎ এস.পি.র নজর পড়ল ডাইনিং রুমের দিকে - এত রাতে ডাইনিং টেবিল সুসজ্জিত - প্লেটে প্লেটে সুস্বাদু আহার্য পরিববেশিত হয়েছে। পরিবারের সদস্যসংখ্যা তিন, কিন্তু টেবিলের উপর সমস্ত আয়োজন সাজানো আছে চারজনের জন্য। অদ্ভুদ ব্যাপার ! ইন্সপেক্টরের যুগল ভ্রূ'তে দ্বিতীয় বন্ধনীর রেখাপাত। আচমকা পিছু ফিরে তাকালেন তিনি - উল্টোদিকের দরজার পর্দার আড়াল থেকে বছর তিন-চার এর একজোড়া উজ্জ্বল নির্ভিক চোখ উঁকি দিচ্ছে। কৌতুহলী হয়ে এস.পি. চোখ জোড়ার দিকে চেয়ে হাসলেন, ডাকলেন চোখের ইশারায়। কোনও ভূমিকা ছাড়াই সোজা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন, ' ডাইনিং টেবিলে কে ডিনার করছিল বলোতো? '

-: মাম্মী, ড্যাডি, দিদি আর আমি।

-:ড্যাডি? সে কোথায়? দেখছি না তো? ডাকো তাকে।

খুব সন্তর্পনে প্রায় ফিসফিস করে বললে -; 'সে তো নেই। তাকে ডাকলে সে আসবে না । সে তো ঈশ্বর।'

-: মানে? তবে এই প্লেটই বা কেন সাজানো?

-:সে আমাদের সঙ্গে থাকে না তো; সে ঐ আকাশে থাকে।

-: মানে, তোমার ড্যাডি মারা গেছেন? আকাশের তারা হয়ে গেছেন? তোমাদের মাঝে নেই?

-:না তো । সে আছে, মারা যায়নি।

-: তবে সে কোথায় গেলো?

এবার আরো সন্তর্পনে করুণ কান্নার মত উত্তর এল, -: 'তা তো জানিনা - তবে সে ঐ আকাশে থাকে- ঐ আকাশ থেকেই সে মাঝেমাঝে এই সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে আমাদের খাবার আর টাকা দিতে।'

ছোট্ট তর্জনীর নির্দেশ অনুশরণ করে এস.পি. সিঁড়ির দিকেে তাকিয়ে দেখেন, সিঁড়ির শেষ ধাপের উপরে ছাতের দরজা আধ-খোলা আর সেই দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে রাতের কুয়াশাচ্ছন্ন একটুকরো আকাশ।