Tuesday, June 25, 2019

দীপক আঢ্য

গল্প -

খেলা

গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি পড়ার যেন বিরাম নেই। কাল রাতে এত ভারি বৃষ্টি হল তাও যেন আকশের দুঃখ এতটুকু কমেনি। টিচার্স রুম থেকে দুবার এসে মাঠ দেখে গিয়েছেন শান্তিবাবু। তাঁরও মুখ ভার। বিগত পরপর তিনবার রানার্স হয়েই খুশি থাকতে হয়েছে তাঁর নিজের স্কুলকে। আর তিনবারই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে আর্চ রাইভ্যাল টাউন হাই স্কুল। তাই এই পরাজয় যত না বাহ্যিক, তাঁর থেকে অনেক বেশি মানসিক। নেহাত খেলার শিক্ষক, তা না হলে বাইরে থেকে কোচ আনার কথাও উঠে ছিল স্কুলের একাডেমিক কাউন্সিলের মিটিঙে। এই বছর ক্লাস ফাইভে উল্লেখযোগ্য ভাবে নতুন ছাত্রদের ভর্তির হার কম হওয়াও নাকি সেই বাহ্যিক লজ্জারই ফলাফল। এমনকি বছর স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির ভোটে সাধারণের ভোট দিতে না আসার কারনও নাকি সেই হার! সব গত মাস- আট মাস ধরে অনবরত শুনেই চলেছেন শান্তিবাবু। তাই সব কিছুর জবাবে বছরই কিছু করে দেখানোর অদম্য প্রচেষ্টার কোনো ত্রুটিই রাখেননি তিনি। সম্পূর্ণ পেশাদারি মানসিকতায় নিজে হাতে তৈরি করেছেন ছেলেগুলোকে। কোনো ঝুঁকির পথে হাঁটেননি সারা বছর। তাই পনেরো জনের পরিবর্তে আঠারো জনের দল করেছেন। কারো চোট পেলে নিঃসংশয়ে শক্ত রিজার্ভ বেঞ্চ থেকে অপর একজনকে তুলে নিতে দ্বিতীয়বার ভাববার সুযোগ রাখেননি নিজের কাছেই।
আজই আন্তঃস্কুল ফুটবল টুর্নামেন্টের ফাইনাল। অন্যবারের মতো এবারও বিদ্যার্থী ভবনের সাথে টাউন  হাই স্কুলের অন্তিম লড়াই। বিকেল তিনটেয় শুরু। গতকাল বৃষ্টির জন্যে একপ্রকার প্লেয়ারদের রেস্ট ডে দিতে বাধ্য হয়েছেন শান্তিবাবু। অনেক ইচ্ছা ছিল আজ সকালে একবার ফুল প্রাকটিস করাবেন। এমনকি ম্যাচ প্রাকটিসের কথাও ভেবে রেখেছিলেন মনেমনে। তাঁর বিশ্বাস একটা ম্যচ প্রাকটিস পাঁচটা জেনেরাল প্রাকটিসের থেকেও ভালো ফল দেয়। ছেলেগুলোকে ডেকে নিয়ে সকালে মাঠেও গিয়েছিলেন। মাঝমাঠ বাদে সব জায়গা জল থইথই। গোল পোস্টের সামনে যেন ছোটখাটো পুকুর। মাঠে এত জল শেষ কবে নিজে দেখেছেন মনে করার চেষ্টা করলেন শান্তিবাবু। গোল পোষ্টের সামনে দেখে নিজেই মনে হল লজ্জা পেলেন। এত খারাপ অবস্থা নিজের গোচরেও আসেনি কখনো। এমনিতে কচ্ছপপিঠে মাঠ তাদের। সাইডে জল একটু বেশিই জমে। তাইবলে... ফিরে আসতে বাধ্য হছেন সকালেই। ওরকম মাঠে আর যাই করা যাক না কেন অন্তত ফুটবল খেলা যায় না। তাছাড়া আসিফ, সুকুমার এরা সব রীতিমতো ক্লাবের হয়ে খেলছে। কিছু সুযোগ সুবিধাও পাচ্ছে। ওদের যদি কিছু হয়ে যায় গণরোষের শিকার হতে হবে তাকেই।
ঘড়িতে কাঁটায় কাঁটায় ঠিক বারোটা। টিচার্স রুমের ভিতর থেকেই এক দল ছেলেদের তীব্র চিৎকারে স্টাফ রুমের সকলে জানলা দিয়ে বাইরের দিক দেখার চেষ্টা করল। অস্পষ্ট ভাবে যেটুকু বোঝা গেল তা, টাউন হাই স্কুলের এক দল ছেলেদের প্রাথমিক মাঠ পরিদর্শন। একটু পরেই আসতে শুরু করবে  স্কুলের বাকি ছাত্রছাত্রীরাও। আজ উভয় স্কুলেই টিফিনের পরে ছুটি। তাদের স্কুলে এখন ক্লাস চলছে যথারীতি। কী করে যে টাউন হাই স্কুল এই সময়ে এই ছাত্রদের অ্যালাউ করে বাইরে আসতে দিতে, ভাবতেই অবাক হয়ে যান শান্তিবাবু। মনেমনে ভাবেন, মিনিমাম ডিসিপ্লিন তো থাকবে!
স্যার!দপ্তরী দিদির ডাকে জানলার দিক থেকে মুখ ঘোরান শান্তিবাবু। হেডস্যার ডাকছেন আপনাকে।

ধীর পায়ে নিজের চেয়ার থেকে উঠে হেডস্যারের ঘরের দিকে পা বাড়ান তিনি।
হেডস্যারের ঘরে ঢুকতেই দরজার কাছে থম মেরে যান শান্তিবাবু। দিব্যি খোশ মেজাজে টাউন হাই স্কুলের হেড মাষ্টারমশাই সুকুমারবাবুর সঙ্গে তাদের হেডস্যারের আলাপচারিতা চলছে সামনে চায়ের কাপ থেকে ধোঁয়া উড়ছে হালকাভাবে। শান্তিবাবুকে দরজার সামনে দেখেই ডেকেনিলেন তাঁদের হেডস্যার শচীনবাবু। বসতে বললেন পাশের চেয়ারে। নির্বাক হাসি মুখে যেন অভ্যর্থনা জানালেন সুকুমারবাবুও।
সুকুমারবাবুকে শচীনবাবুর ঘরে দেখে প্রমাদ গোনেন শান্তিবাবু। যেন যুদ্ধের প্রাক মুহূর্তে পাণ্ডবদের সেনা ছাউনিতে কৌরব পক্ষের প্রবেশ! সুকুমারবাবুর দিকে তাকিয়ে সৌজন্য হাসি হাসলেন শান্তিবাবু। হাসির প্রত্যুত্তরে সুকুমারবাবুর জিজ্ঞাসা, ‘ ছেলেরা সব তৈরি তো শান্তিবাবু?’
-সে তো তৈরিই। কিন্তু মাঠের যা অবস্থা...
-কেন? মাঠের কী অবস্থা
-গতকাল থেকে আজ সকাল পর্যন্ত যা বৃষ্টি হয়েছে তাতে কি মাঠ ভালো থেকে স্যার?
-সে কি! এই যে শুনি আপনাদের কচ্ছপপিঠের মাঠ। একটুও জল দাঁড়ায় না। নাকি আমাদের পরপর চারবার বিজয়ের খেতাব আটকাতে চাইছেন এভাবে?
কি বলছেন আপনি!শান্তিবাবুর গলায় যত না বিষ্ময় তার থেকে বেশি ক্ষোভ। শচীনবাবুর দিকে তাকিয়ে দেখেন তিনি কীসব এক গাদা কাগজের আড়ালে সুকুমারবাবুর কথা না শোনার ভান করে নজর আড়াল করেছেন।
-দেখুন, আমাদের ছেলেরা মাঠে নামার জন্যে শুধু প্রহর গুনছে। এখন আপনি যদি মাঠের দোহায় দিয়ে খেলা বন্ধ করে দেন, তাহলে বাকীদের কাছে কী বার্তা যাবে সে কি আমি বলতে পারি?
-আপনি কি মাঠ দেখেছেন স্যার?
-সে তো দেখলাম। এখানে আসার আগেই। 
-তা আপনি কি মনে করেন, এই রকম মাঠে ছেলেদের নামানো উচিত কাজ হবে? প্রয়োজনে আমরা খেলা এক-দুসপ্তা পিছিয়ে তো দিতে পারি।
-সে কথা আমি ইতিমধ্যে ভেবেছি শান্তিবাবু। ইনফ্যাক্ট আপনি আসার আগে আমরা সেই কথাই আলোচনা করছিলাম। তবে জানেন কি, ছেলেরা আর ওয়েট করতে চাইছে না। এমনকি, আমাকে বলে রেখেছে আগামী কাল ওদেরকে স্পেশাল সম্বর্ধনা দিতে হবে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্যে।
খেলাটা কিন্তু এখনো হয়নি স্যার। এমনকি আমাদের ছেলেরাও হেরে যায়নি। কাজেই...স্পষ্টত কঠোর গলার স্বর শান্তিবাবুর।
আপনারা কথা বলুন। আমি পাশের টিচার্স রুম থেকে আসি।শচীনবাবু তাঁর চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বললেন।
এটাকেই কি এসকেপেসিম্বলে? মনেমনে ভাবলেন শান্তিবাবু। শচীনবাবুর দিকে তাকিয়ে তাঁর কেমন যেন করুণা লো। এত অসহায় ইতিপূর্বে তিনি তাঁকে কখনো দেখেননি। চিরকালই একটু অন্তর্মুখী স্বভাবের মানুষ তিনি। হেডস্যার হওয়া সত্ত্বেও কেউ তাঁকে আজ পর্যন্ত মেজাজ হারাতে কিংবা তিরস্কার করতে দেখেছে কিনা সন্দেহ। আজ তাঁর নিজের চেয়ারে বসে থাকাকালীন যে কথা তাঁকে শুনতে লো, তা তাঁর শিক্ষকতার জীবনে নিশ্চয় মনে থাকবে।
হ্যাঁ, হ্যাঁ আমিও উঠব। তবে বলছিলাম কি, মাঠ যেহেতু খারাপ বলছেন আর আপনাদের ছেলেরা যদি... তাই ভেবে দেখুন খেলার সময়টা নব্বই মিনিটের বদলে তিরিশ মিনিট বা কুড়ি মিনিট করা যায় কিনা। আর গ্রাউণ্ডটাও ছোট করা যায় কিনা। আর যদি মনে করেন জল সরাতে আমাদের ছেলেদের সাহায্য লাগবে তাহলে বলুন, আমি স্কুলের সকল ছেলেদের পাঠিয়ে দিচ্ছি। এটুকু মাঠ শোক করতে ওদের সকলের বেশি সময় লাগবে না।নির্লিপ্তভাবে বলে গেলেন সুকুমারবাবু।
-থ্যাঙ্ক ইউ স্যার। ফর ইয়োর ওয়ার্ডস অফ কো-অপারেশন। কিন্তু ভুলে যাবেননা আপনার স্কুলের থেকে আমাদের স্কুলের স্টুডেন্টস স্ট্রেন্থ কিন্তু এখনও অনেক বেশি। কাজেই... কে... খেলার মাঠেই দেখা হবে। স্পোর্টসম্যান সুলভ আচরণ আশা করব টাউন হাই স্কুলের সকলের কাছ থেকেই। আর হ্যাঁ, খেলা হবে। আমাদের ছেলেরা মাঠে নামবে এবং পুরো নব্বই মিনিট খেলাই হবে। আশাকরি, স্পিরিট অফ স্পোর্টস কখনো ব্যাহত হবেনা।
                                              ************ 


হেডস্যার শচীনবাবুর সাথে কথা বলে ক্লাস নাইন ,টেন, ইলেভেন। টুয়েল্ভ ছুটি দেওয়া হলো তিন পিরিয়ডের পরেই। সকলকে মাঠে নামানো হলো। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। কারো হাতে কোদাল তো কারো হাতে ডিশ। কারো হাতে মগ,বালতি, কেউবা চটের বস্তা দিয়ে মাঠের জল সরানোর কাজে লেগে পড়ল। মাঠের উত্তর দিকের দুধারে মিউনিসিউপ্যালিটির পাকা ড্রেন। মাঠ থেকে জল পাস আউটের মুখগুলো সব কাদা আর প্লাস্টিকের আবর্জনায় আটকে ছিল এতক্ষণ। ছেলের দল সে মুখগুলো ছাড়িয়ে দিতেই সড়সড় করে জল নেমে গেল মুহূর্তেই।
জল সরে যাওয়ার সংবাদ পেতেই শান্তিবাবুর সাথে মাঠ দেখতে চলে এলেন শচীনবাবুও। শান্তিবাবু লক্ষ্য করলেন ,জল আটকে থাকায় মাঠের উত্তর দিকের মাটি যথেষ্ট নরম। শচীনবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী বুঝছেন শান্তিবাবু?’
-কিছু বালি ফেললে একটু বেটার হতো।
-তা অপেক্ষা কেন? অর্ডার করে দিন। কারা বালি সাপ্লাই দেয় খোঁজ করুন। ইউ মাস্ট ডু এভরিথিং দ্যাট উইল ব্রিং গুড রেসাল্ট।
শচীনবাবুর কথা শুনে মনে যেন জোর পেলেন শান্তিবাবু। আমি একটু আসছি স্যার।বলেই ধাঁ করে কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেলেন সঙ্গেসঙ্গে।
                                                  ***********
টিফিনের সময় আজ স্কুল ছুটি হয়ে গেলেও অধিকাংশ ছাত্রদের ঘরমুখো হতে দেখা গেলনা আজ। স্কুলের সদর গেট বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বাহাদূরকে। ভিতরে শিক্ষক আর খেলোয়াড়রা ছাড়া বিশেষ কেউ নেই। শান্তিবাবু নিজে ডেকে রেখে দিয়েছেন আরও দুচার জন ছেলেকে, যারা ফুটবলের সাথে জড়িত ওতপ্রোতভাবে। 
স্কুলের ভিতরে একচিলতে মাঠ। চতুর্দিকে ড্রেন থাকায় এখানে কখনো জল জমে না। স্কুলের এনসিসি আর স্কাউট হয় এখানেই। বাইরে থেকে দেখা যায় না কিছুই। 
গোটা পাঁচেক ফুটবল আর প্রায় কুড়ি-বাইশ জন ছেলে যে যার মতো প্রাকটিস করছে। কেউ কেউ এক্সারসাইজ করছে, জগিং করছে নিজের মতো। একটা ছেলেকে হামাগুড়ি দেওয়ার ভঙ্গিতে স্থিত রেখে তাকে টপকে ড্রাইভ দিয়ে বল সেভ করার স্যাডো প্রক্টিস করছে রতন। স্কুলের গোল কিপার। সমীর, ক্লাস টুয়েল্ভের ছেলে, সে চিৎকার করে বলছে, ‘এবার একটু শট স্টপ প্রাক্টিস কর। কাজে আসবে।রতন বল ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। ইঙ্গিতে এতক্ষণ হামাগুড়ির কায়দায় স্থিত ছেলেটাকে উঠতে বলে সে। অনুভব ওদের সবার থেকে বড়। শান্তিবাবুর খুব প্রিয়। ফুটবল খেলেনা। তবুও ফুটবলের খুঁটিনাটি জানার ইচ্ছের শেষ নেই তার। মাঠের অর্ধেকের বেশি জায়গা জুড়ে সেই এতক্ষণ শান্তিবাবুর কায়দায় প্রাক্টিস করিয়ে চলেছে প্রায় সকলকেই চিপলিফট, ড্রিবেল, ডামি এমনকি হুক কিক, পান্ট কিক সব। কেবল মাঠের এক কোণায় আসিফ আর সুকুমার কিছুটা নিঃস্পৃহ ভঙ্গীতে শরীর ঘুরিয়ে আলস্য ভাঙার কায়দায় সময় কাটাচ্ছে।
কীরে? তোরা দুজন বল থেকে এত দূরে কেন?’ হঠাৎ  শান্তিবাবুর গলার আওয়াজে সকলে সেদিকে তাকিয়ে দেখে কখন থেকে তিনি এসে দাঁড়িয়ে তাদের প্রাক্টিস দেখছেন। আসিফ আর সুকুমার থতমত খেয়ে আস্তে আস্তে বলে, ‘না স্যার এই করছি তো। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে, আবার মনেহয় বৃষ্টি আসবে। খেলা শেষ পর্যন্ত হবে তো?’
-আমি আগেও বলেছি এখনো বলছি, খেলোয়াড়দের সাথে সেনাদের ভাবনার মৌলিক কোন পার্থক্য নেই। কোন মেজর যদি ভাবেন, শত্রু আসুক, লড়াই শুরু হোক, তারপরে আমার সেনারা যুদ্ধক্ষেত্রে নামবে, তাহলে এতদিন আমাদের অন্য কোন দেশের পতাকাকে নিজেদের বলে ভাবতে হতো। ম্যাচ মানেই যুদ্ধ। আর সেই যুদ্ধে নামার আগে মানসিক ভাবে শারীরিক ভাবে সকলকে তৈরি থাকতেই হবে, তা না হলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে কখনো পৌঁছানো সম্ভব না। মাথা নীচু করে শুনতে থাকে আসিফ আর সুকুমার।


এভরিবডি, জাস্ট ফিউ মিনিটস্নিজের হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে হাতের ইশারায় সকলকে কাছে আসতে বলেন শান্তিবাবু। আর এক ঘন্টাও টাইম নেই। এবং আমরা খেলতে চলেছি...বলেই একটু থামলেন তিনি। 
ছেলেরা সমস্বরে উত্তর দিল ফুটবল। ফাইনাল ম্যাচ।’ 
এবার একটু মৃদু হাসলেন শান্তিবাবু। বলতে শুরু করলেন, ‘তোমরা আংশিক ভাবে সত্যি। আজ আমরা ফাইনাল খেলতে নামছি ঠিকই। কিন্তু সেটা ফুটবল নয়।
ছেলেদের সকলের মুখে বিস্ময়ের চিহ্ন। অস্ফুটভাবে কে একজন বলল, ‘তবে?’
তবেটাই হলো মেন্টাল গেম।বলতে থাকলেন শান্তিবাবু। একবার ভাবো, এই টুর্নামেন্টে বছর আমরা জিতেছি পাঁচটা ম্যাচ। টাউন হাই স্কুল জিতেছে পাঁচটা ম্যাচ। আমরা গোল করেছি এগারোটা। আমাদের প্রতিপক্ষ দশটা। আমরা গোল খেয়েছি ছটা। আর ওরা সাতটা। তাহলে কাগজে কলমে এগিয়ে আছে কারা?
কিছুটা যেন চার্জড হয়ে ছাত্ররা একসাথে বলল, ‘আমরা স্যার।
বেশ। কিন্তু বাইরে কান পাতো, কাদের সমর্থক বেশি?
অস্পষ্ট আওয়াজ এল, ‘ওদের।
হ্যাঁ, ঠিক তাই। সেই জন্যে আজ আমি তোমাদের অন্য কথা শোনাব।শান্তিবাবু ছেলেদের উৎসুক চোখের দিকে তাকালেন। আজ আমরা সেই অর্থে ফুটবল খেলব না। আমরা মাঠে নামব ঠিকই। এবং আমরা কী করব? আমরা আমাদের খেলাটাই খেলব। মনে রাখবে, রেসাল্ট আমাদের লক্ষ্য নয়। ম্যাচে হারজিত আছে। থাকবেও। তোমাদের মনে রাখতে হবে , সারা বছর ধরে তোমরা ট্রেনিং করেছ। তোমরা প্রতিপক্ষের থেকেও অনেক বেশি সাবলীল। অনেক বেশি দক্ষ। সুতরাং তোমাদের আজ যেটার দিকে নজর রাখতে হবে, সেটা হলো সারা বছর ধরে তোমরা যা শিখেছ তাঁর এক্সিকিউশান করা। তোমাদের অরগানাইসড্থাকতে হবে। এনজয় করতে হবে ম্যাচটাকে। তোমাদের শুধু মনে রাখতে হবে ট্যাকটিক্যাল স্ট্রাটেজিস্গুলো। কেবল বলের উপর সব সময় কন্ট্রোল রাখার চেষ্টা করে যাবে আর ফরমেশানকে বজায় রাখবে। ব্যাস! সামান্য এই কাজটাই দ্যেখো কত অসামান্য হয়ে ওঠে নব্বই মিনিট পরে।
                                                 ***********
মেঘলা আকাশ। হালকা জোলো বাতাস মাঝেমধ্যে অনুভূত হচ্ছে। আরও বেশি টের পাওয়া যাচ্ছে শিরিষ গাছের শুকনো পাতা এক এক বার বাতাসে উড়ে এসে পড়ছে গায়ে, মাথায়, মুখে। বিদ্যার্থী ভবনের মাঠের ধারে তিল ধারণেরও জায়গা নেই। বিশেষ করে পূর্বদিক আর পশ্চিম দিকে, যেদিক দিয়ে পথ গিয়েছে বেঁকে। মাঠের দক্ষিণদিকের এক প্রান্তে বিদ্যার্থী ভবনের খেলোয়াড়দের জমায়েত, আর অপর প্রান্তে টাউন হাই স্কুলের খেলোয়াড়রা।
মাঠে খেলোয়াড়দের নামার অপেক্ষা। শান্তিবাবু শেষবারের মতো খেলোয়াড়দের ইন্সট্রাকশান দিচ্ছেন। বাহ্যিকভাবে কাম অ্যাণ্ড কোয়াইট। ক্যপ্টেন অতনুকে বোঝাচ্ছেন, মাঠের উত্তরদিকে মাটি নরম। ওদিক দিয়ে আক্রমণের ধার থাকবে কম। বড় শর্ট নেওয়া মুশকিল হবে। সুতরাং ওদিক থেকে আক্রমণের দরকারও নেই। যতটা সম্ভব মাঝ মাঠের দখল রাখতে হবে। আক্রমণ হানার চেষ্টা করবে মাঝখান আর বাঁদিক থেকেই। ওদেরকে বাধ্য করাবে ডানদিক থেকে খেলাতে যতটা সম্ভব।
খেলা শুরু হয়। বৃষ্টিভেজা মাঠ। তবুও যা ভাবা গিয়েছিল তার থেকে অনেক বেশি মসৃণ গতিতে এগিয়ে যেতে থাকে খেলা। মুহুর্মুহু আক্রমণ হানতে থাকে টাউন হাই স্কুল। তাঁদের মধ্যে সিঙ্ক্রোনাইসেশন কম। দু-একজন নিজের পারদর্শিতায় মাঝমাঠ থেকে বল কেড়ে বিপক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে অনবরত। ওদিকে বিদ্যার্থী ভবনের খেলোয়াড়রা নিজেদের জায়গা ছেড়ে বের হচ্ছে না। বিপক্ষের গোল রুখে দিচ্ছে ডিফেন্ডাররা ঠিকই কিন্তু প্রতিপক্ষের গোলমুখ খোলার মতো কেউই নিজের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসছেনা। কিছুটা গুটিয়ে আছে আসিফ আর সুকুমার। দু-দুবার গোলমুখে যে সুযোগ তারা মিস করেছে তা সাম্প্রতিককালের মধ্যে ওদের কাছথেকে দেখা গেছে বলে মনে করতে পারেনা কেউই। শান্তিবাবুর মনে প্রশ্ন জাগে, ‘তবে কি ক্লাবের জন্যে...?’ আমল দেয়না নিজের ভাবনাকেই। গোলহীন অবস্থায় শেষ হয় প্রথমার্ধ।
দ্বিতীয়ার্ধের খেলা শুরুর কিছুক্ষন পরেই শান্তিবাবু রিসার্ভ বেঞ্চের সুনীল আর মোহনকে ডেকে নেন। মাঠে নামার জন্যে তৈরী হতে ইঙ্গিত করেন দুজনকেই। সুনীল একটা ম্যাচ স্কুলের হয়ে ইতিপূর্বে খেললেও মোহনের আজ ডেবিউ হতে চলেছে। শান্তিবাবুর ইঙ্গিতে কিছুটা অবাক হয় সে নিজেই। বুঝে উঠতে পারেনা কার পরিবর্তে সে নামতে চলেছে। শান্তিবাবু নিজেই এগিয়ে আসেন। ওদেরকে বলেন, ‘মাঠ স্লো। বাঁদিক ওরাও মারকিং করছেনা। প্রায় ফাঁকা। ওখান থেকেই আক্রমণ করতে হবে তোমাদের দুজনকে একসাথে। ছোট ছোট পাস খেলে প্যারালালি এগিয়ে যাবে দুজন। বল অল্টারনেট করবে। নিজের পায়ে রাখবেনা এক মুহূর্ত। এভাবেই এগিয়ে যাও। মনে করো, তোমরা দুজন ছাড়া সকলে তোমাদের প্রতিপক্ষ। বি পসিটিভ। রেসাল্ট আসবেই।
সকলের চমকে ওঠার বাকি ছিল আরও কিছু। একটু পরেই কয়েক মিনিট ব্যবধানে শান্তিবাবু পরপর তুলে নিলেন আসিফ আর সুকুমারকে। সঙ্গেসঙ্গে মাঠে গুঞ্জন বাড়ল। একটু বেশিই আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠল টাউন হাই স্কুল। পরক্ষনেই সকলের বোঝার আগে দুই কিশোর টুকটুক করে জল-কাদা ভেদ করে দুলকিচালে কখন যে বিপক্ষের দিকে এগিয়ে গিয়ে নিজেদের গতি বাড়িয়ে নিয়েছে তা উপলব্ধি হয়নি কারোর। গোল মুখে আসতেই মোহনের পায়ে বল। বল সেভ করার পজিশন নিচ্ছে গোলকিপার। দুজন ডিফেন্ডার দুপাশ দিয়ে ছুটে আসছে মোহনের দিকে। সকলে নিশ্চিত মোহন শর্ট নেবে গোলে। কিন্তু না, সকলকে অবাক করে মোহন চিপকিক করল। আলতো করে বল টপকে গেল গোলকিপারের মাথার উপর দিয়ে  দশ-পনের ফুট পিছনে। ঠিক সেই মুহূর্তেই কোত্থেকে বাঁদিক থেকে ছুটে এসে উন্মুক্ত গোলে শর্ট করল সুনীল। সঙ্গেসঙ্গে গগনভেদী চিৎকার গো---’ ‘গো---
খেলা শুরু হলো। শান্তিবাবু নীচে নামিয়ে আনেন আরো দুজনকে।  আক্রমণের চেষ্টা করতে থাকে টাউন হাই স্কুল। কিন্তু গোলমুখ খুলতে পারেনা। আবারও একই কায়দায় সুনীল আর মোহন চেষ্টা করে গোলের মার্জিন বাড়ানোর। কিন্তু ব্যর্থ হয় প্রতিপক্ষের নজরদারিতে। সময় এগিয়ে যায়। টাউন হাই স্কুল বুঝতে পারে অঘটন ঘটতে চলেছে দ্রুত। ইনজুরি টাইম আসে। পারও হয়। রেফারীর দীর্ঘ বাঁশি বেজে ওঠে। মাঠ ভরে যায় বিদ্যার্থী ভবনের ছাত্র এবং শিক্ষকে।
মাঠের ধার ঘেঁসে দাঁড়িয়ে থাকেন শান্তিবাবু। আনন্দে ঝাপসা হয়ে আসে তাঁর দুচোখ। বুকের মধ্যে অসংখ্য কথারা যেন বেরিয়ে আসতে চাইছে। মনে হচ্ছে আজ তাঁর উত্তর দেওয়ার সময়। কিন্তু কী আশ্চর্য! ব্যক্তিবিশেষ কারোর প্রতিই তিনি যেন কোন ক্ষোভ অনুভব করতে পারছেন না। গ্লানিহীন। মুহূর্তে মনে পড়ে, ফুটবল মানুষকে বৃহৎমনা হতে শেখায় হঠাৎ  দেখতে পান, জার্সি পরা দুটো ছোট ছেলে ছুটতে ছুটতে যেন এগিয়ে আসছে তাঁরই দিকে। দুহাত প্রসারিত। মুহূর্তে কৈশোরের উচ্ছ্বলতা যেন পেয়ে বসে তাঁকেও। ছুটতে শুরু করেন তিনি। মাঠের ভিতর ঢুকে সস্নেহে জড়িয়ে ধরেন কাদামেখে ঘেমে-নেয়ে ওঠা দুটো শরীর। ক্রমশ চাপা পড়ে যান আরও অনেক কাদামাখা ভালোবাসা আর উচ্ছ্বাসের আড়ালে। 
                                ------------*****------------

No comments:

Post a Comment