ডক্টর সৌরভ দত্ত

নিবন্ধ -

ক্রিকেটের বিশ্বযুদ্ধ - বদলাক ফাইনালের প্রবেশপন্থা

সীমিত ওভারের ক্রিকেট বিশ্বকাপের দ্বাদশ সংস্করণ শুরু হল। ১৯৮৩-র প্রুডেনশিয়াল বিশ্বকাপ অব্দি বিশ্বকাপের প্রতিটি খেলায় এক একটি ইনিংস ছিল সর্বাধিক ৬০ ওভারের। তাই দু'দলের ৬০ + ৬০ = ১২০ ওভার আর মাঝের বিরতি ধরে আনুমানিক ৯ ঘন্টার একটি ম্যারাথন যুদ্ধের সাক্ষী হয়ে থাকত দর্শকরা (একটি ওভার গড়ে ৪ মিনিট সময়কালের ধরে)। নিয়ম বদলালো ১৯৮৭-র রিলায়েন্স বিশ্বকাপ থেকে। শুরু হল ৫০ + ৫০ = ১০০ ওভারের ক্রিকেট যুদ্ধ। সেই পরম্পরায় বিকৃতি ঘটেনি আর। হ্যাঁ, সমান্তরালে টি-২০ শুরু হয়েছে এবং তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ২০০৭ সাল থেকে আরম্ভ হয়েছে টি-২০ বিশ্বকাপ, কিন্তু সীমিত ওভারের ক্রিকেট বিশ্বকাপ বলতে ক্রিকেটবিশ্ব বলাবাহুল্য এই ১০০ ওভারের লড়াইকেই বুঝে থাকে।

বিশ্বকাপের বিগত ১১টি সংস্করণে সেমিফাইনালে খেলার ছাড়পত্র দেওয়ার জন্য সুনির্দিষ্ট কোনও পদ্ধতি অনুসৃত হয়নি। এমন কিছু সংস্করণ ছিল যাতে অংশগ্রহনকারী দলগুলিকে বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ করে প্রতিটি গ্রুপের দলগুলিকে গ্রুপের অন্য সব দলের সঙ্গে খেলিয়ে তার ভিত্তিতে প্রতিটি গ্রুপের শীর্ষস্থানাধিকারী একটি বা দু'টি দলকে পরবর্তীতে নক্-আউট পর্বের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে। আবার এমন সংস্করণও হয়েছে যাতে অংশগ্রহনকারী প্রতিটি দলকে বাকী প্রতিটি দলের সঙ্গে খেলানো হয়েছে, যার ভিত্তিতে সেরা ৪টি দলকে সেমিফাইনালে জায়গা করে দেওয়া হয়েছে। বলাবাহুল্য, প্রথম ধরণের সংস্করণ সংখ্যায় অনেক বেশী। গ্রুপ বিন্যাস না করে সবার সাথে বাকী সবার লড়াই হয়েছিল ১৯৯২-র বিশ্বকাপে। সেই পর্যায়ে আগাগোড়া ভালো খেলেছিল মার্টিন ক্রো-র নিউজিল্যান্ড। অন্যদিকে, ধুঁকে ধুঁকে শেষ চারে জায়গা পেয়েছিল পাকিস্তান। নিয়মমতো একে অন্যের সাথে সেমিফাইনাল খেলেছিল নিউজিল্যান্ড আর পাকিস্তান। নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে পাকিস্তান ফাইনালে উঠেছিল এবং বাকীটা ইতিহাস। ইমরান খানের হাতে উঠেছিল বিশ্বকাপ। ক্রিকেট বিশ্ব পাকিস্তানের সাফল্যকে নতমস্তকে কুর্ণিশ করেছিল, কিন্তু তার সাথে নিউজিল্যান্ডের হঠাৎ প্রস্থানকে নিয়ে আশাহতও হয়েছিল। গোটা প্রতিযোগিতায় সবচাইতে ধারাবাহিক দলটির ফাইনালের আগেই পদস্খলন যেন প্রকারান্তরে ক্রিড়াসূচীর গঠন পদ্ধতিকেই প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল।

এবারের চলতি বিশ্বকাপ আয়োজিত হচ্ছে ১৯৯২-র বিশ্বকাপের আদলে। এবার ১০টি দল। সব দল খেলছে বাকী সব দলের সঙ্গে। অঙ্কের হিসেবে এই পর্যায়ে মোট খেলার সংখ্যা ৪৫টি। ম্যারাথন যুদ্ধ শেষে শীর্ষস্থানীয় দল সেমিফাইনাল খেলবে চতুর্থ স্থানাধিকারী দলের সঙ্গে, যেমনটি ১৯৯২-তে নিউজিল্যান্ড খেলেছিল পাকিস্তানের সঙ্গে। আরেকটি সেমিফাইনালে জায়গা করে নেবে দ্বিতীয় সেরা ও তৃতীয় সেরা দল দু'টি। সব শেষে দুই সেমিফাইনালের বিজয়ীরা অবতীর্ণ হবে কাপ জেতার মহাযুদ্ধে। বলতে দ্বিধা নেই, শেষ চার থেকে ফাইনালের দুই প্রতিদ্বন্দ্বীকে নির্বাচন করার এই সনাতনী পদ্ধতির যথার্থতা কিন্তু আজ কিছুটা হলেও প্রশ্নের মুখে। মানুষ আই.সি.সি. অনুমোদিত ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ দেখছে। সেখানে ৮টি দল কী পর্যায়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সেরা ২টি দলের একটি হওয়ার লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, তার সাক্ষী থাকছে ক্রিকেটপাগল জনতা। হ্যাঁ, লড়াইটি বাস্তবেই সেরা ২টি দলের একটি হওয়ার লড়াই, কারণ একমাত্র তাহলেই একবার হেরে গেলেও দ্বিতীয় সুযোগ মিলবে আর জিতে গেলে তো কেল্লা ফতে। ফাইনালের মহাযুদ্ধে জায়গা করে নেওয়ার প্রশ্নে সেরা ২টি দল নিজেদের চমৎকার ধারাবাহিকতার সুফল যখন এভাবে পাচ্ছে, তৃতীয় ও চতুর্থ স্থানাধিকারী দল দু'টি সেখানে একটি দ্বিস্তরীয় নক্-আউট পদ্ধতির মাধ্যমে ফাইনালের মহাযুদ্ধে অংশ নেওয়ার লড়াইতে ঝাঁপাচ্ছে। প্রথম ও দ্বিতীয়-র লড়াইকে বলা হচ্ছে "কোয়ালিফাইয়ার - ১", তৃতীয় ও চতুর্থ-র লড়াইকে বলা হচ্ছে "এলিমিনেটার"। পরিভাষার এই এক জোড়া শব্দই প্রথম/দ্বিতীয় এবং তৃতীয়/চতুর্থ-র ফারাক চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে যথেষ্ট। এরপর "কোয়ালিফাইয়ার - ১"-এর পরাজিত দল ও "এলিমিনেটার"-এর বিজয়ী দল একে অন্যের সঙ্গে মোকাবিলা করছে যে লড়াইয়ে, তা চিহ্নিত হচ্ছে "কোয়ালিফাইয়ার - ২" রূপে। সন্দেহ নেই, চমৎকার ভারসাম্যপূর্ণ একটি পদক্ষেপ, যেখানে সেরা ২টি দল নিজেদের ধারাবাহিকতার কদর পায়, কারন "কোয়ালিফাইয়ার - ১"-এ হেরে গেলেও পদস্খলন ঘটে না, বদলে সুযোগ থাকে "কোয়ালিফাইয়ার - ২" জিতে মহাযুদ্ধে পা ফেলার।

জানা নেই, আই.সি.সি. অদূর ভবিষ্যতে বিশ্বকাপে এই নিয়ম আনবে কিনা। নাগাড়ে পরীক্ষানিরীক্ষা যখন চলছেই, ২০২৩ বিশ্বকাপে পরীক্ষামূলকভাবে কি এই নিয়ম আনতে পারে না আই.সি.সি.? উত্তর সময়ই বলবে।