গল্প-
"লক্ষ্যভেদ"
"ও রোমা দা ,একটু শুনবে,তোমার সাথে আমার ভীষণ জরুরী দরকার আছে "।পায়ে বল নাচাতে নাচাতে আর শরীরী কসরতে ভ্রু তুলে তাকিয়ে অভি কে দেখে ,"হ্যা রে অভি,বল,কি বলছিস "। রোমা দা আমাকে ফুটবলের টেকনিক গুলো একটু শিখিয়ে দেবে গো ?কথাটা শেষ হয়েছে কি হয় নি,"না না বেশি সময় আমি নষ্ট করতে পারবো না ,ক্লাব কর্তারা রুষ্ট হবেন" বলে একটু রুক্ষ ঝাঁজ নিয়ে আরও হয়তো কিছু বলতে যাচ্ছিল অভি থামিয়ে দিয়ে, "না গো সেভাবে নয় ,পাড়ার ভাইয়ের মতো যদি এই জাস্ট তোমার সামনে একটু যদি অনুশীলন করতে পারি "আক্ষেপ জড়ানো কথা গুলো বলে থেমে গেলো অভি ।
" দেখ অভি ,তুই হয়তো জানিস ,আমি তো বকুলতলা স্পোর্টিং ক্লাবের ট্রেনার হিসাবে আছি ,ওদের সাথে আমার চুক্তি আছে ।আমি বাইরের কাউকে শেখাতে পারি না রে ,এটা একটা চুক্তি লঙ্ঘনের মধ্যে পড়ে"। "আমি এই নিয়মটা জানি গো রোমাদা "স্বগতোক্তির মতো শোনালো নিজের কথাটা কেই ,আসলে সে চেয়েছিল ,সামান্য দু চারটে কৌশল যদি শিখে নিতে পারে ,অনেকটাই মানসিক ভাবে স্কুলের মাঠে সে এগিয়ে থাকবে ।
ক্লাস সেভেনে ওঠার আগেই বাবা বলেছিলো ,"অভি,ভালো রেজাল্ট কর তোকে ফুটবল কোচিং এ ভরতি করে দেবো ।" অভি সাতাশি শতাংশ নম্বর পেয়ে ক্লাসে প্রথম হয়ে কথা রাখলেও কপাল তার সাথ দেয়নি ।টানা কুড়ি দিনের অজানা এক নাগাড়ে জ্বরে ভুগে চলে গেল বাবা। সামান্য চটকলে কাজ করা শ্রমিক,বড় ভরসার আপনজন সব ভাসিয়ে চলে যেতেই অভির ঘর-স্বপ্ন সব অন্ধকার হয়ে গেল এক লহমায় । বড়ো একা লাগে নিজেকে আজকাল অভির । কেবল বাবার কথা গুলো মনের মধ্যে ভিড় করে এসে জমাট কান্না হয়ে ভাসছে এই তিন মাস ।এই অপ্রাপ্তি,বাবার চলে যাওয়া যেন এক দৃঢ়তা হয়ে তাকে তাড়া করে বেড়ায় আজকাল। আর অভি ততো প্রতিজ্ঞা নেয় ,"ফুটবল কোচিংয়ে তো তাকে ভর্তি হতেই হবে ,এ তার শুধু লক্ষ্য নয়,বাবার স্বপ্ন পূরণও।
কিন্তু কি জানি ইদানিং কি যে হয়েছে মাঠে নামতে ইচ্ছে করে না অভির ।সদা চঞ্চল অভি কেমন যেন গুমরে যাচ্ছে ভেতরে ভেতরে।স্কুলের টুর্নামেন্ট থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতেই বন্ধুদের কি অভিমান,"না তোকে খেলতেই হবে,আমাদের জন্য তুই মাঠে নামবি,আর আমরা গর্বিত হয়ে মাঠের বাইরে থেকে গলা ফাটাবো।"আচ্ছা বাবা খেলবো যা তোরা,আসলে কি বলবো ইচ্ছা করছে না,পা গুলো আড়ষ্ঠ লাগছে"-এটা বললেও অভি বোঝে তাদের অনুপ্রেরণা আর বাবার উৎসাহ আজ তাকে এই ভালোবাসার জায়গা দিয়েছে ,
সুতরাং তাকে এগুতেই হবে সফলতাকে ছুঁতে।
আজ সকাল থেকেই খুব বিষণ্নতা গ্রাস করেছে অভিকে।মা পাশটায় ঠায় দাঁড়িয়ে মানসিক শক্তি দিয়ে চলেছেন । সকাল-সকাল স্নান সেরে ধূপ ধুনো জ্বালিয়ে বাবার ফটোতে রজনীগন্ধার মালা পড়িয়ে প্রণাম করে অভি রেডি। আজ কলকাতার বড় টিম অগ্রদূত ক্লাবে তার কিনা চূড়ান্ত যোগদান। সিলেকশনের দুর্দান্ত খবরটা বন্ধুদের মধ্যে আগেই ছড়িয়ে গিয়েছিল ।আজ তার যাবতীয় চুক্তি, আনুষ্ঠানিক যোগদান পর্ব সম্পন্ন হবে। শেষ চার বছর স্কুল টুর্নামেন্টে নিজের স্কুল কে চ্যাম্পিয়ন রাখার পর থেকেই পেছনে তাকাতে হয়নি অভিকে।সেরা স্টাইকার হিসেবে এক আলোচিত নাম হয়ে উঠেছে শহরের ফুটবলপ্রেমীদের মধ্যে।
প্রথম দুই মরশুম ছোট দুই অনামী ক্লাবে খেললেও হঠাৎ যেন ভাগ্যের চাকাটা একটু একটু করে ঘুরে যাচ্ছে এই অনুভূতি ,বাবার স্বপ্ন সাকার করে তোলার অনুকূল এই বোধটাকে জাগিয়ে তোলে। অভিও মন প্রাণ ঢেলে ফুটবল অনুশীলন করে আজকাল বুঝতে পারে মাঠের বাইরে তারও একটা ফ্যান ফলোয়ার ধীরে ধীরে জমাট বাঁধছে।গতকাল শহরের সেরা বিপক্ষ দলের সাথে টান টান উত্তেজনার খেলা যেন দুশ্চিন্তার বারুদে ঠাসা ছিল।অভির দৌলতে তার ক্লাব এক লহমায় অনেক খানি সমীহ আদায় করে নিয়েছে। অনুশীলন কোচ সমীর দা ভীষণ ভাবে অভি কে উৎসাহ দেয়। ওনার এখন পাখির চোখ অভির ফিটনেস অনেকটা বাড়িয়ে তাকে এক বড় ফুটবলার হিসাবে তুলে ধরা।
অভি জানে, মফস্বলের মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেরা এক বুক স্বপ্ন নিয়ে শহরে নানা ক্লাবে খেলতে আসে কিন্তু কিছুদিন পরপরই নানা সমস্যার জটিলতা গ্রাস করে তাদের। এরা নিজেদের একাগ্র ভাবে ঠিকমতো মেলে ধরতে পারে না ,এর অন্যতম কারণ হলো আর্থিক প্রতিবন্ধকতা। পারিবারিক জটিলতায় জর্জরিত নিম্ন মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলেগুলোর ন্যূনতম চাহিদা না মেটার ফলে মনের মধ্যে একটা আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয় ।প্রয়োজনীয় ফুড সাপ্লিমেনটারি তো দূর বাড়ির অন্যান্য অভাবী মুখগুলো দেখে অতিরিক্ত শারীরিক যত্ন নেবার ভাবনা বিলাসিতা অনেকের কাছে। কিছুজন তবু অদম্য মানসিক জোড়ে এগুলেও সবাই তা উতরোতে পারে না,মুখ থুবড়ে হেরে ফিরে যায় ভাবনার আঁতুর ঘরেই আবার।অভি কিন্তু সে দিক থেকে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করে। সেই পুচকে বেলার দিন থেকে বাবা কাঁধে চাপিয়ে বল নিয়ে ফাঁকা মাঠে নিয়ে যেতেন,নিজের পেট কে মেরে কি করে বড় হবার স্বপ্ন ছেলের মনে মধ্যে গেঁথে দিতে হয় সেই অদম্য প্রচেষ্টার মানুষটা অভির কাছে ভগবান। বাবা হয়তো বুঝেছিলেন অভি পারবে, সেই ছোট থেকে ঝড়-ঝাপটা সহ্য করে বড় হওয়া অভির মধ্যে ছিল আলাদা এক লড়াকু মানসিকতা ।সে এমন এক রত্ন,সোনার টুকরো ছেলে যার রন্ধ্রে রন্ধ্রে মজুদ একজন বড় ফুটবলারের আগ্রাসন,রক্ষণাত্মক রণকৌশল। যে অভাব নিয়ে সেই শৈশব থেকে এতটা পথ চলা ,বাবার মৃত্যুর পর দিদির আইসিডিএস চাকরিটা না থাকলে বোধ হয় অভিকে লড়াই থামাতে হত।
সামনে বড় ম্যাচ,আজ ফাইনাল অনুশীলনের পরপরই কোচ,ম্যানেজার বাবু সহ খেলোয়াড়দের সাথে গেম প্ল্যান নিয়ে অনেক আলোচনা চলছিল। আজ রাতের নাইট সার্ভিস এ অভিরা হয়তো সোজা চলে যাবে শিলিগুড়ি ।পরশু বিকালে কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়ামে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ শিলং একাদশের সাথে,কিন্তু কোচের অনেক জোরাজুরিতেও ম্যানেজার আজ নাইট সার্ভিস এ যাওয়ার ব্যাপারে অনড় রইলেন।উনি চাইছিলেন আগামীকাল রাতে যেতে তাহলে একদিনের হোটেল খরচ বাঁচবে কিন্তু প্র্যাকটিস আর রেস্ট ঠিক মতো হবেনা এই নিয়ে কোচের যুক্তি- তর্কের কচকচানি শুনে অভি কাছেই বন্ধুর বাড়িতে ফ্রেশ হতে বেরুলো যদি রাতেই বেরুতে হয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী।
ময়দানের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এক হাড় জিড়জিড়ে মহিলাকে খেলার এক ভারী অনুশীলন ব্যাগ সহ ছেলের সাথে হাঁটতে দেখে অভির ভীষণ ভাবে দিদির কথা মনে পড়ে গেল। কোন ভোরে দিদি ওঠে ,বাড়ির সব কাজ ,রান্না বান্না বাজার হাট সেরে হাসিমুখে দু ঘণ্টার বাস যাত্রায় অফিস পৌঁছায়। সেখানেও তার রীতিমতো ফিল্ড ওয়ার্কের চাপ তবু দিদিকে একদিনের জন্যও বিরক্ত হতে দেখেনি। বেশ ভালো কয়েকটা সম্বন্ধ এসেছিল ,নিজেই কাটিয়ে দিয়েছিল বাবা মারা যাবার পর সংসারের দায়িত্ব,ভাইয়ের লক্ষ্য পূরণের স্বপ্ন দেখা মেয়েটা ,সেই সঙ্গে মায়ের চিকিৎসার ভার,সব বইতে বইতে নুয়ে পড়েছে এই মাত্র একত্রিশ বছর বয়সেই। খুব খারাপ লাগে অভির কিন্তু কিই বা করার আছে তার প্রার্থনা করা ছাড়া। অন্তত যেন বছর দুয়েকের মধ্যেই সে একটা মাঝারি মাপের অন্তত চাকরি জুটিয়ে নিতে পারে এই সব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই তার চোখ পড়ে যায় হন্তদন্ত হয়ে তার কাছেই যেন ছুটে আসছে ছোটবেলার বন্ধু বোঁচকা আর রথীন দা। "আরে তোমাদের এমন উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে কেন ,কি হয়েছে বলো",বলতেই রথীনদা কান্না গলায়,"ভাই অভি তোমার কাছেই ছুটে আসছি,খুব বড় বিপদ হয়ে গেছে আমাদের প্রিয় রোমার",বোঁচকা ততক্ষনে বলতে শুরু করেছে,"এক বিরাট দুর্ঘটনার মুখে রোমাদা,প্রাণ নিয়ে সংশয়,এখুনি রক্ত লাগবে,তোর তো ভাই বি নেগেটিভ,চলনা রে জলদি,রোমাদা কে বাঁচাতেই হবে।" আর বিন্দুমাত্র কালক্ষেপ না করে তিন জনা অটো ধরে হাজির হাসপাতালের এমার্জেন্সি বেডে। প্রাথমিক কিছু ফর্মালিটি সেরে একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে অভি দু বোতল রক্ত দিয়ে রোমাদার মাথার কাছে চুপ করে দাঁড়িয়ে । বিশ্রী ভাবে ডান পায়ের ওপর দিয়ে চলন্ত বাসের চাকা চলে গিয়ে রোমা দার বিশ্রী পরিস্থিতি।উদাস হয়ে রোমাদা সিলিঙের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়েছিল,অভি এভাবে বিহ্বল হয়ে রক্ত দিতে এসেছে শুনেই চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় জল গড়িয়ে এলো ।মুহূর্তেই কোচের ফোন ,'অভি আজ রাতেই রওনা দিতে হবে তুমি রেডি হয়ে নটার মধ্যে ধর্মতলা চলে এসো'- একটা দীর্ঘশ্বাস ও চাপা উৎকণ্ঠা নিয়ে রোমাদার হাত টা আশীর্বাদ স্বরূপ নিজের মাথায় ঠেকিয়ে ছল ছল চোখে বেরিয়ে এলো।
উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটে ওঠা দর্শকদের তুমুল হর্ষধ্বনিতে আর একটা দুর্দান্ত টান টান খেলা শেষে শিলং একাদশ কে হারিয়ে অভিরা আজ শহরে ফিরছে। অপারেশনে রোমাদার একটা পা বাদ দিতেই হবে এই খবরটা আনন্দের মাঝেও খচ খচ করে কাঁটার মতো বিঁধছে অভির।কাল স্পোর্টস একাডেমীর উদ্যোগে অগ্রদূত ক্লাব, তাদের সেরা স্টাইকার অভিক গাঙ্গুলীকে সেরা টেকনিকে বিপক্ষকে হারানোর কৃতিত্ব স্বরূপ বর্ষসেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।ট্রফিটা মুষ্টিবদ্ধ হাতে আকাশের দিকে তুলে স্বর্গীয় বাবাকে উৎসর্গ ও রোমাদার সুস্থতা কামনায় আমাদের সেরা ফুটবলার অভি।
No comments:
Post a Comment