গল্প -
চিক্কু
চিক্কু, ক্লাস সিক্স এ পড়া সরল সাধাসিধে ছেলে, ক্রিকেট অন্ত প্রাণ । নিজে তো খেলেই এবং যেকোন খেলা টি.ভি.তে হলেই দেখে । সকল দেশের প্লেয়ারের নাম ওর মুখস্থ । যার জন্য পড়াশোনার বেশ প্রভাব পরে । রেজাল্ট খারাপ হয়, সেই কারণে সে বাবা ও মাস্টার মশাইয়ের কাছে পিটুনি খায় । এই খেলার জন্য পরীক্ষার আগেরদিনেও ওর কুছ পরোয়া নেহি মনোভাব, ভারতের কোন ম্যাচ থাকলে সেদিন সকাল থেকেই টিভিটা ওর দখলে চলে যায় । টিভি দেখা নিয়ে দাদুর সাথে ওর ভীষণ ঝামেলা হয়, দাদুকে বলে, ‘এই দাদু... বেশি বাড়াবাড়ি করলে না টি.ভিটা ভেঙ্গে দেব’ । এই বলে ওর ক্রিকেট ব্যাট নিয়ে ভাঙতে উদ্যত হতেই দাদু পিছু হটতে বাধ্য হয় ।
চিক্কু একটা ক্লাবের সাথে যুক্ত আছে । অনেক সিনিয়র বিজ্ঞ রথী-মহারথী ঐ ক্লাবে আসে যাদের সাথে ও খেলে । কিন্তু খেলার চেয়ে বেশী ওকে জ্ঞান হজম করতে হয় । কারণ ঐ সকল বিজ্ঞ রথী-মহারথীরা নিজেদের সচীন, সৌরভ ভাবে বেশী । একটু ব্যাট বা বল করার জন্য চিক্কুকে কত কিছু করতে হয় তার ঠিক নেই । যেমন সিনিয়রদের মাঝে মাঝে বিড়ি খাবার শখ হলে চিক্কুকে বলত, খেলার সময় বল মাঠের ধারে রাস্তার ড্রেনে বা পুকুরে পড়ে গেলে চিক্কুরই দায়িত্ব সেই বলটিকে খেলার মাঝে ফিরিয়ে আনার । আবার কখনও কোন সিনিয়ার দাদা তার ব্যক্তিগত চিঠি কোন সিনিয়র দিদিকে দিয়ে আসার জন্য চিক্কুকেই বলত । চিক্কু সবকিছু হাসিমুখে করে দিতো । যে কারণে সে মাঝে মাঝে সিনিয়ার দাদাদের সাথে খেলার সুযোগ পেত । ব্যাট-বলে নিজের দক্ষতা দেখাবার সুযোগ সে কোনমতেই হাতছাড়া করত না । চিক্কু ক্লাবের সকলের কাছে ধীরে ধীরে গ্রহনযোগ্য হয়ে উঠেছে, সকলে ওকে ভালোবাসতে থাকে ।
চিক্কুদের ক্লাব একটা ১৬ দলীয় ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন করেছে । ওদের ক্লাবও এই টুর্নামেন্টে খেলছে । ৯ সাইড টীম গড়তে হবে । সেইমত একটা টীম গড়া হল যাদের সবাই চিক্কুর সিনিয়ার, সে এক্ষেত্রে ব্রাত্য । চিক্কু টুর্নামেন্ট খেলবে কি! সে তো ড্রেন ম্যান । বল ড্রেনে পড়বে, সেই বল সে ড্রেন থেকে নিয়ে আসবে । ব্যাস তাতেই সে খুশি । হাজার হোক তার ক্লাবের টুর্নামেন্ট এবং সেই টুর্নামেন্টে ওর টীম খেলছে । ও সকলকে বেশ উৎসাহ দেয় । ওর গলার জোর মারাত্মক, চেঁচিয়ে সারা মাঠ মাতিয়ে রাখে । সকলে বেশ উপভোগ করে । ওর কত দায়িত্ব, ও সেটা মনে-প্রানে মানে, আর ঠিক এই সুযোগটাই ওর সিনিয়ররা বারেবারে নিয়ে নেয় ।
টুর্নামেন্ট শুরু হয়েছে, চিক্কুর টীমের গ্রুপ লিগের মোট ৮টা খেলা আছে । চিক্কু নিজে নাইবা খেলুক টীমের সব খেলায় ও বাইরে থেকে চেঁচিয়ে গেছে । ওর টিম ভালোই খেলেছে, কোন দু’টো খেলায় ও থাকতে পারেনি, সেই ম্যাচগুলোতেই ওর টীম খুব বাজে ভাবে হারে । ওর মনে হল ওর না থাকার জন্য বুঝি টীম হেরে গেছে । তাই ওর আরো দায়িত্ব নিয়ে থাকা উচিৎ ছিল । ও উপস্থিত থাকলেই টীম জিতবে, এটা ওর স্থির বিশ্বাস । যাইহোক ওর টীম টুর্নামেন্টের সেমিফাইনালে পৌছে গেল, চিক্কুর তো ভীষণ আনন্দ ।
সেমিফাইনাল ম্যাচ, টীমের একজন গুরুত্বপূর্ণ প্লেয়ারের পশ্চাৎ অংশে ফোঁড়া হয়েছে, ফলে সে সেমিফাইনাল ম্যাচে অনিশ্চিত । চিক্কুর বোধ হয় সেমিফাইনাল ম্যাচ খেলার ভাগ্য এইভাবেই ছিল । সে খারাপ খেলত না, সেইজন্যই হয়তো ও সুযোগ পেয়েছে । ও যদি সিনিয়র হত তাহলে অনেক আগেই টীমে জায়গা পেয়ে যেত । এই ম্যাচে শেষের দিকে জিততে মাত্র ৮ রান করতে হবে, ওর টীমের প্রথম দিকের সবাই আউট হয়ে গিয়েছে । চিক্কু সর্বশেষ ব্যাটসম্যান হিসাবে ক্রিজে নামল । সবাই ভাবল ম্যাচটা বুঝি বেরিয়ে গেল, কিন্তু চিক্কু পরপর দুটো বাউন্ডারী দিয়ে ওর টিমকে ফাইনালে তুলল । এরপর ওর সিনিয়রদের ওকে নিয়ে কি উল্লাস, সে আর বলার নয় । কেউ জড়িয়ে ধরে চুমু খেল, কেউ ওকে কাঁধে তুলে নিয়ে ঘুরলো । ওর তো আনন্দের শেষ নেই ...
ফাইনাল ম্যাচটা ওর টীম ওকে নিয়েই নামবে ঠিক করল । কিন্তু ওর যে মায়ের দয়া হয়েছিল । চিক্কু সেমিফাইনাল ম্যাচটা জিতিয়ে দিয়ে বাড়িতে গিয়ে শুয়ে পড়ে, ও খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে । ডাক্তার বললেন ওর পক্স হয়েছে, দিন কুড়ি ঘরেই থাকতে হবে । চিক্কুর ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল । শেষ ফাইনাল ম্যাচে ও থাকবে না, ও নাই খেলুক কিন্তু টিমকে চেঁচিয়ে সমর্থন যোগাতে পারবে এটাই ওর আশা ছিল সেটাও বারোটা বেজে গেল । অবশেষে ফাইনাল ম্যাচটা হয়ে গেল, মাঠের মধ্যে থেকে ওর সমর্থন ছাড়াই... । চিক্কু ছিলই না, কেন জানি না ওর টীমটাও যেন ফাইনাল ম্যাচটাতে ছিল না । অত্যন্ত জঘন্য ভাবে ম্যাচটা হেরে গেল । তবে কি চিক্কুর না থাকাটা ওর টীমের পক্ষে অমঙ্গল ? কিছু সিনিয়র দাদা এসেছিল ওদের প্রিয় চিক্কুর সাথে দেখা করতে, তারা আসতেই চিক্কু তাদের দেখে কাঁদতে আরম্ভ করেদিল । ও বলল, আমি সেদিন কেন থাকলাম না... আমাদের টিম হেরে গেল ।... ওই দাদারা বলল, “তুই সেদিন খেলতিস রে, সে তুই খেলিস বা নাই খেলিস তোর না থাকাটাই আমাদের হারের একমাত্র কারণ... তুই ভালো হয়ে ওঠ, আমরা আবার একসাথে খেলব আমাদের লাকি চিক্কু কে নিয়ে ... ঠিক আছে ... হিপ হিপ হুররে ... আমরা জিতবই” ।
No comments:
Post a Comment