Tuesday, August 14, 2018

পবিত্র চক্রবর্তী

প্রবন্ধ -  

ভারতীয় স্বাধীনতায় নৃত্য ও গীত

ভারতের স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে কলম বর্তমানের প্রেক্ষাপটে আজকাল অনেকটাই নানা কারনে স্তিমিত তবে লিখতে গিয়েই মনে হলো শুরু কি দিয়ে প্রারম্ভ করব এর মূল একমাত্র কারন উক্ত বিষয়ে বেশী-কম সকলেই জানেন কিন্তু যা জানেন না অধিকাংশ তা দিয়েই প্রবন্ধের বিষয়বস্ত রাখা যাক - বাংলার প্রান্তিক-ক্ষয়িষ্ণু নৃত্য গীত যা বর্তমানের কালের গহ্বরে প্রায় শায়িত তবুও ঘুম ভাঙাতে ক্ষতি কি ?
ব্রত কী ?
ব্রত শব্দের আক্ষরিক অর্থ হলো- নিয়ম সংযম আবার তপস্যা অর্থেও ব্রত শব্দ ব্যবহার করা হয় ধর্মানুশাসনে পূণ্যলাভ বা পাপক্ষয়ের জন্য যে নিয়ম সংযমের দ্বারা তপস্যা করা হয়, তাকেও ব্রত বলা হয়
লোক সাহিত্য গবেষক, সমাজসেবক, লেখক গুরুসদয় দত্ত কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত একটি সমাজসেবামূলক আন্দোলন গুরুসদয় তত্ত্বের ব্রত ছিল স্বদেশবাসীর কল্যাণের জন্য দেহ-মনের সংযম করার বিধি এক কথায় এই ব্রত হলো স্বদেশে কল্যাণের জন্য প্রতিজ্ঞামূলক জীবনাচরণের চর্চা সর্বজনের কল্যাণের জন্য সর্বজনের জন্য প্রচেষ্টাই হলো ব্রতচারী আন্দোলন

এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য
লোকসংস্কৃতির চর্চার নিজের দেশকে চেনা এবং নৃত্যগীত শরীর চর্চার মধ্য দিয়ে সুস্থ সবল দেহ মনের বিকাশ ঘটানো

লক্ষ্য পূরণের অদৃশ্য মন্ত্র
ব্রতচারী আন্দোলনের লক্ষ্য পূরণের জন্য রয়েছে কিছু মন্ত্রসদৃশ বাণী সকল বাণী নৃত্যগীত এবং আবৃত্তির মধ্য দিয়ে পরিবেশিত হয় বটে, কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে আর আদর্শিকভাবে তা গ্রহণ করতে হয়ে মনে-প্রাণে তাই ব্রতচারীর নৃত্যগীত শুধুই নাচগানের আসর নয় এর ভিতরে রয়েছে সর্বজনের কল্যাণের জন্য সর্বজনের বাণী গুরুসদয় দত্ত চাকুরীতে থাকাবস্থায় তিনি অনুভব করেছিলেন, ব্রিটিশ ভারতের প্রবল শক্তির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে জাগিয়ে তোলার জন্য, দৈহিক মানসিকভাবে সক্রিয় এবং সবল হয়ে উঠতে হবে তাই তিনি নৃত্যভঙ্গিমায় দেশীয় সুরে গান বেঁধেছিলেন মূলত নাচ-গানের ভিতর দিয়ে দেহ সাংস্কৃতিক চেতনা বিকশিত হবে- এই ভাব থেকে তিনি তৈরি করেছিলেন ব্রতচারী নৃত্যগীতি

দল গঠন ও ব্রতচারী সমাজ
১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি তাঁর নিজের প্রতিষ্ঠিত 'বঙ্গীয় পল্লীসম্পদ রক্ষা সমিতি' সদ্স্যদের নিয়ে 'ব্রতচারীর দল' গঠন করেন তাঁর এই প্রতিষ্ঠিত দলটি পরে ব্রতচারী সমিতির মাধ্যমে এই আন্দোলনের কার্যক্রম প্রচার করতে থাকে এই সময় সমিতির কেন্দ্রীয় কার্যালয় ছিল কলকাতার ১২ নং লাউডন স্ট্রিট সেকালে অবিভক্ত বাংলার অনেক এলাকাতেই এই সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এর ভিতরে পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলা ব্রতচারী সমিতি, কালীঘাট উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় ব্রতচারী সঙ্ঘ (কলকাতা) এই আন্দোলনকে সঞ্চালিত করেছেন এছাড়া সর্বভারতীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সাউথ ইন্ডিয়া ব্রতচারী সোসাইটি এবং সর্বভারতীয় ব্রতচারী সমাজ

লৌকিক কসরতের পত্রিকা
১৯৩৪ সালে ফরিদপুর ব্রতচারী সমিতির মূখপত্র হিসেবে 'ব্রতচারী বার্ত্তা' নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয় এর সহকারী সম্পাদক ছিলেন মৌলবি দলিলউদ্দীন আহম্মদ (খানসাহেব) বাংলা ব্রতচারী সমিতির উদ্যোগে ১৯৩৬ সালে বাংলার শক্তি নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল

নরমে-গরমে বিশ্বযুদ্ধ পরিবেশ এবং প্রসব
১৯৩২ সাল স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে নরমপন্থীদের অহিংস আন্দোলন, স্বাধীনতার স্বপ্নে চরমপন্থীদের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, আর পাকিস্তানের দাবিতে মুসলমানদের তাণ্ডবে, বাংলা তখন উত্তাল ব্রিটিশরাও বিব্রত critical বাঙালির জ্বালায় ব্রিটিশরা ভারতে তাদের রাজধানী টা সরিয়ে ফেলল তবুও স্বস্তি নেই অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক হুংকারে পৃথিবী উত্তাল
এমনই অগ্নিগর্ভ পরিবেশে জন্ম নিল একটি আধ্যাত্মিক সামাজিক উন্নয়নের আন্দোলন ব্রতচারী আন্দোলন

বাংলার লোকনৃত্য ও লোকসঙ্গীতে একতা
ঐক্যবদ্ধভাবে বাঙালির নিজস্ব ঘরানার লোকনৃত্য লোকসঙ্গীত চর্চার মাধ্যমে মানসিক আত্মিক বিকাশ লাভ দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করাই ছিল এই আন্দোলনের আসল উদ্দেশ্য
ব্রতচারীদের সত্যনিষ্ঠা, সংযম, অধ্যবসায় আত্মনির্ভরতা ছিল আন্দোলনের অন্যতম বৈশিষ্ট ব্রতচারীদের অভিবাদন ভঙ্গি,বেশ, মাতৃভাষা প্রীতি, স্বাস্থ্য জ্ঞান, সত্যনিষ্ঠা, সংযম, প্রফুল্ল ভাব, অধ্যাবসায় আত্মনির্ভরতা খুব জনপ্রিয়তা লাভ করে

ব্রতে জীবনব্রত
ব্রতচারী আন্দোলনে অন্তর্ভুক্তির পদ্ধতিটিও বেশ অভিনব ব্রতচারী আন্দোলনে ভুক্তির জন্য প্রথমে তিনটি উক্তি স্বীকার করে নিতে হত উক্তিগুলো হলোঃ
.আমি বাংলাকে ভালোবাসি
.আমি বাংলার সেবা করব এবং
.আমি বাংলা ব্রতচারী হব

শুধু কি তাই ? এছাড়াও
অতঃপর পঞ্চব্রত, ব্রতচারীর প্রতিজ্ঞা, ব্রতচারীরর ষোলপণ, ষোল পণের অতিরিক্ত এক পণ, ব্রতচারীর সতের মানা (নিষেধাজ্ঞা), ব্রতচারী বৃত্ত ইত্যাদি আবৃত্তি করে এই আন্দোলনের অন্তর্ভুক্ত হতে থাকে
ব্রিটিশ ভারতের নাগরিকদের মধ্যে দেশপ্রেম, জাতীয় চেতনা নাগরিকত্ববোধ তৈরী করা এবং তাদের জ্ঞান, শ্রম, সত্য, ঐক্য আনন্দের সাথে জীবনযাপনের পথপ্রদর্শন করাই ছিল ব্রতচারী আন্দোলনের মূল লক্ষ্য এখানে হিন্দু-মুসলিম , ধনী-দরিদ্র, উচ্চ-নীচ, বর্ণ-সম্প্রদায়ের কোন ভেদাভেদ ছিলনা সবার প্রতি সমান সৌহার্দ্যে অবিচল ছিল বাংলার ব্রতচারী সমিতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ তৎকালীন বাংলার বহু বিখ্যাত ব্যক্তি এই আন্দোলনে যুক্ত হন

বাঙালিকে বিশ্বমানব হওয়ার লক্ষ্যে উদাত্ত আহবান জানিয়ে আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা গুরুসদয় দত্ত লিখেনঃষোল আনা বাঙ্গালি
বিশ্ব মানব হবি যদি
শাশ্বত বাঙ্গালি ’”

জমিদার তন্ত্র এবং আরও কিছু লোক নৃত্য
জমিদারতন্ত্রের সুরক্ষায় থাকা লাঠিয়ালদের রায়বেঁশে রণপা নৃত্য বিবর্তনের হাত ধরে হারিয়ে যাওয়ার মুখে৷ পরাধীন ভারতে শৃঙ্খলারক্ষায় সৃষ্টি হয়েছিল ব্রতচারী চর্চা৷ সে - আজ প্রান্তিক শিল্পে পরিণত৷ হারিয়ে যাওয়ার মুখে টিমটিম করছে ঘোড়ানাচ , মোশানাচ৷ স্বাধীনতা আন্দোলনের স্বার্থে দেশবাসীর মধ্যে স্বদেশী চেতনা ভ্রাতৃত্ববোধ জাগিয়ে তোলাটাই সবচেয়ে বেশি জরুরি কাজ৷ কারণ পরস্পরের প্রতি ভ্রাতৃত্ববোধ তৈরি না হলে পরাধীনতার বাঁধন কাটা কোনও মতেই সম্ভব নয়৷ তাই রণপা , রাইবেঁশের মতো কিছুটা আলাদা আঙ্গিকে সৃষ্টি করেন ব্রতচারী৷ শুধু সেটুকু করেই ক্ষান্ত হননি তিনি৷ ব্রতচারীর জন্য গানও বাঁধা হয়৷ খেয়াল রাখা হয় যাতে গানের ছত্রে ছত্রে দেশাত্মবোধ ভ্রাতৃত্ববোধ লেগে থাকে৷ ব্রতচারীর প্রতি সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করতে লেখা হয় , ‘ব্রতচারী হয়েই দেখো জীবনে কী মজা ভাই৷

শেষ হয়েও শেষ কথা
সে সময় বহু মানুষ যোগ দিয়েছিলেন ব্রতচারী আন্দোলনে৷ ১৯৩৫ সালে গুরুসদয় তৈরি করেনবেঙ্গল ব্রতচারী সমিতি এখনও বেঙ্গল ব্রতচারী সমিতির লক্ষ হল আধ্যাত্মিক জাতীয়তাবোধ জাগিয়ে তুলে শারীরিক মানসিক কসরতের মাধ্যমে একজন মানুষকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা৷ তবে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ক্রমেই জনপ্রিয়তা কমতে থাকে ব্রতচারীর৷ এখন কার্যত হারিয়ে যেতে বসেছে ব্রতচারী নৃত্য৷

তথ্য সূত্রঃ –
বাংলার নৃত্যকে. ধারা
History of Indian freedom by N.Sehagal 
------------------------------------ 

পবিত্র চক্রবর্তী - দুর্গাপুর 

No comments:

Post a Comment