Monday, January 14, 2019

পবিত্র চক্রবর্তী



বড়গল্প -
সেই রাতের গল্প
একটু এগিয়ে বাঁ দিকের প্রথম গলিটায় ঢুকতেই তিতিন দেখল রাস্তার হাল খারাপ । সকাল থেকেই বৃষ্টির জন্য বেশ কিছু জায়গায় চওড়া হয়ে জল জমে আছে । অগত্যা একটু সাবধানেই এগোতে থাকে বাইকটা নিয়ে । রাস্তা অজানা ! বার কয়েক লাফিয়ে লাফিয়ে অবশেষে যখন ভাঙা বাড়ীটার সামনে পৌঁছালো তখন বাইক সমেত তিতিনের অবস্থা শোচনীয় ।
অনেকদিনের ইচ্ছা এমন জায়গায় রাত কাটাবে যেখানে মানুষ তো দূরের কথা কুকুর-বেড়াল অবধি এড়িয়ে চলে । আবছা অন্ধকারে বাড়ীটাকে মনে হচ্ছে প্রাচীন সভ্যতার শেষ সাক্ষী । মড়ার খুলির চোখের গর্তের মত আধখাওয়া কপাটহীন জানলা তাকিয়ে আছে । হাঁ হয়ে আছে প্রবেশ পথ ! কয়েক জায়গায় দাঁত বার করা ইঁটের স্তুপ । এদিক-ওদিক থেকে ঝুলে আছে ভাঙা কার্নিস । যেন যে কোন মুহূর্তে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়বে !
বাইকটাকে পাশে রেখে বেশ করে গায়ের র‍্যাপারটাকে জড়িয়ে নিল তিতিন । পিঠে মাঝারি আকৃতির ব্যাগ । পেন্সিল টর্চটা জ্বালিয়ে আলোটা ফেলতেই লক্ষ্য করল জঙ্গল প্রায় আর্ধেক বাড়ীটাকে গিলে ফেলেছে ! সামনেই মরচে ধরা কবেকার গেট । এক পাশে কাত হয়ে আছে তারই একটা পাল্লা ।
যাক এতদিনে মনের মত আস্তানা খুঁজে পেয়েছে সে । যদি এখানে রাত কাটাতে পারে তাহলে কেল্লা ফতে ! বন্ধু মহলে গল্পের খোরাকের সাথে কলার উঁচু করে বলতে পারবে সে মোটেই ভীতু নয়
কয়েক পা এগোতেই পথ আটকালো আগাছার দঙ্গল । বিকাল থেকে বৃষ্টিটা থেমেছে । তবে বেশ কাদা জমে আছে , ঢোকার মুখটা পিছল । আকাশে শেষ পূর্ণিমার ক্ষয়িষ্ণু চাঁদের বুকে দল বেঁধে মেঘের দল পাড়ী দিচ্ছে ।
কোনরকমে আগাছা সরিয়ে , কাদাটে পথে পা টিপে টিপে এগিয়ে চলল তিতিন । যেটুকু আলো তাতে বুঝল বাড়ীটা দোতলা । নীচের তলায় মাকড়শার জাল ঘিরে রেখেছে শীকারের প্রত্যাশায় । নানা জায়গায় পলেস্তারা খসে আছে । মেঝেতে পুরু ধুলোর স্তর । দেওয়ালের এক জায়গা দিয়ে শ্যাওলা ধরা ভিজে ভাব , যা আজকের অকাল বৃষ্টিতে আরও সজীব হয়ে উঠেছে । তিতিন লক্ষ্য করল ঘরের এক কোণায় বেশ উঁচু একটা উঁই-এর ঢিবি ।
টর্চের আলোটা একটু অন্যদিকে ঘোরায় তিতিন । অন্ধকারের মধ্যে ভেসে আসে দোতলায় যাওয়ার জন্য কবেকার সিঁড়ি । যেন শুধুমাত্র তারই জন্য অপেক্ষা করে আছে ! হাত ঘড়িতে নজর দিল । সময় এখন রাত দশটা । অথচ এখানকার পরিবেশটা এমনই , যেন মনে হচ্ছে গভীর রাতের শেষ সীমানা ! বেশীক্ষণ টর্চ জ্বালিয়ে রাখলে মুশকিল হতে পারে , এই ভেবে তিতিন বার কয়েক সিঁড়ির রাস্তাটা দেখেই নিভিয়ে দিল । আস্তে আস্তে অনুমান করে উপরে উঠতে থাকে । একটু ঘোরালো । আগেকার দিনের বাড়ীতে যেমনটা হয় আর কী !
দোতলার হাল তথৈবচ ! তবে একতলার থেকে একটু ভাল । মোটামুটি পিঠটা ঠেকিয়ে বসা যাবে । কাঁধে ব্যাগটা ঝুলে পড়েছে । ব্যাগটাকে নামিয়ে অন্ধকারের মধ্যেই ঘর থেকে আনা শতরঞ্জি গোছের চাদরটা কোনমতে বিছিয়ে বসে পড়ল তিতিন ।
নিস্তব্ধ রাতের বুক চিরে মাঝে মধ্যে রাত পাখীরা অদ্ভুত ভাবে ডাক ছেড়ে এদিক থেকে ওদিকে উড়ে যাচ্ছে । ওদের ডানার শব্দ রাতের গভীরতাকে যেন আরও জমাট করে তুলছে ! অনেকটা পথ বাইক চালিয়ে এমন একটা মন মত বাড়ী পেয়ে যাবে ভাবতেই বুকের ভিতরটা আনন্দে নেচে উঠছে তিতিনের । তবে অয়নকে সঙ্গে আনলে ভাল হত ! বেচারা কবে থেকে বলে রেখেছিল এমন অভিযানের সঙ্গী হবে বলে । কিন্তু হঠাৎ করে জ্বরে কাবু হয়ে যাওয়ার জন্য তিতিন ইচ্ছা করেই ওকে জানায় নি । মনে মনে বলেছিল , ‘ একটু সুস্থ হয়ে নিক, পরে না হয় আবার নিয়ে আসা যাবে ।
ভাবতে ভাবতে পা টান টান করে আধ শোয়া হয়ে পরে তিতিন । বেশ ক্লান্ত লাগছে ! ঘুমালে চলবে না ! তাহলে সব মজাই বৃথা হয়ে যাবে । দূর থেকে শেয়ালের যুগলবন্দী ডাক , চামচিকের ভ্যাপসা গন্ধ ঘরের বাতাসটাকে বেশ ভারী করে তুলছে ।
হঠাৎ , একটু ঠ্যালা খেতেই তিতিনের চোখ খুলে যায় । মনে মনে লজ্জা পায় । ইস ! কখন সে ঘুমিয়ে পড়েছিল ! নিজের প্রতি একটু রাগও হল । কিন্তু ঠ্যালাটা মারল কে ? অবাক হতে না হতেই তিতিন অনুভব করল তার পাশে কে যেন বসে আছে ! হাল্কা নিঃশ্বাসের শব্দ । নড়ে চড়ে বসতেই একটা চেনা গলার শব্দ কানে আসতেই চমকে ওঠে তিতিন  এ কী ! ও কোথা থেকে এল ! মনে সাহস আনতেই পাশে বসা দ্বিতীয় জন ফিসফিস করে বলে , “ কী রে ! খুব ফাঁকি মারলি তাই না !
অবাক হয়ে গিয়ে তিতিন আমতা আমতা করে বলে , “ তু-ই ! কী ভা-বে এ-লি ! কা-র সা-থে...!
অনেকগুলো কথা বিস্মিত হয়ে প্রায় অনুচ্চ স্বরে বলে যায় ।
এত দিনের সম্পর্ক ; আর তুই যে আমাকে আনবি না তা ভাল করেই জানতাম ! জ্বরটা একটু কমতেই তোকে না জানিয়ে পিছু নিলাম ।
কিন্তু , আমি তো কিছু বুঝলাম না !
ওটাই তো ! তোকে চমকে দেব বলে কিছুই বুঝতে দেই নি ।
যাক অয়ন যখন এসে গেছে তখন তিতিনের আর চিন্তা কী ! দুই বন্ধুতে গল্প করে রাতটা কাটিয়ে দেওয়া যাবে ।
তিতিন মোমবাতিটা ব্যাগ থেকে খুঁজে জ্বালানোর চেষ্টা করতেই অয়ন বলে উঠল , “ থাক না ! অন্ধকারটা বেশ লাগছে । শুধু শুধু জ্বালিয়ে মজাটা নষ্ট করার কোন মানে হয় না তিতিন !
তা ঠিকই বলেছিস , তবে থাক এই বলে ব্যাগের থেকে হাতটা বার করে নিল তিতিন ।
দোতলার এই ঘরটায় দুটো পেল্লায় গরাদহীন জানলার ফাঁক দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখে ভাঙা চাঁদটা কখন মেঘের ভিতরে লুকিয়ে গেছে আবার । মাঝে মধ্যে বিদ্যুতের কুটিল আলো খেলে যাচ্ছে ।
আবার মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবে তিতিন বলে ওঠে ।
ভালোই তো ; ভাঙা ভূতুড়ে বাড়ী , বৃষ্টি ভেজা রাত ! জমে যাবে বল ,” অয়ন হাঁসতে হাঁসতে জবাব দেয় । ওর চোখের মধ্যে যেন অজানা অবাক শিরশির করা মিচকে হাসি ঘুড়ে ফিরে আসছে । এমন হাসি তিতিন আগে কখন দেখে নি ! তবুও নিজের মনের ভুল এটাই ভেবে বসল তিতিন ।
বন্ধুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছাও করছে  কবে কার সেই বন্ধুত্ব ! ক্লাস ওয়ান থেকে এই সেকেন্ড ইয়ার অবধি একসাথে পরছে । অয়নের বিজ্ঞান আর নিজের কমার্স । এই যা পার্থক্য । না হলে একই কলেজ । একে অপরের সব কথা জানে । বোঝেও পরস্পরকে । তবে আজকের ওই অদ্ভুত হাসিটা কিছুতেই মন থেকে মুছে ফেলতে পারছে না তিতিন ।
আরও অদ্ভুত ! যতবার তিতিন অয়নকে ধরতে চেষ্টা করছে ঠিক ততবারই মনে হচ্ছে অয়ন সরে সরে যাচ্ছে ।
কী রে তোকে ধরতে পারছি না কেন বল তো !
অয়ন কথাটা শুনেই জোরে হেসে ওঠে । হাসিটা যেন ওই প্রাচীন বাড়ীটার দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে যেন প্রতিধ্বনি তুলছে ।
 আবার ডেকে ওঠে শেয়ালের দল ক্যা হুয়া ক্যা হুয়া করে । হাসির শব্দে ঘরের কোণায় একদল বাদুর , যারা এতক্ষণ মাথা হেঁট করে ঝুলে ছিল তারা ডানা খুলে ফরফর করে জানলা দিয়ে উড়তে উড়তে বেরিয়ে গেল ।
অয়ন আচমকা বলে উঠলো , “ কী রে ভয় পেয়ে গেলি নাকি !
নাহ ! তা কেন ? তবে তোর গলার স্বর কেমন যেন লাগছে !তিতিন খানিকটা বিস্ময়ের ঘর কাটিয়ে বলে ওঠে ।
মাঝে মধ্যে দূর থেকে ভেসে আসছে রাতের রেলের ইঞ্জিনের কর্কশ শব্দ । দূরে কোথাও পাড়ি জমাচ্ছে রাতের রেল গাড়ী ।
চাকার ঘটাং ঘটাং শব্দ রাতের নিস্তব্দতাকে খান খান করে দিয়ে যাচ্ছে । সাথে পাল্লা দিয়ে উত্তুরে জলীয় হাওয়া বইছে । মনে হচ্ছে আবার এক পশলা বৃষ্টি নামবে একটু বাদেই ।
অয়ন আবার বলে ওঠে , “ হ্যা রে তিতিন এক জায়গায় বসেই কাটিয়ে দিবি নাকি ! চল না জানলার পাশটায় দাঁড়াই ।
এমন আবদার , এমন সুর এত বছরে প্রথমবার শুনলো তিতিন । অয়ন চিরকালই রগচটা ধরনের । সহজে কারো সাথে বন্ধুত্ব হয় না । বরং তিতিন অনেকটাই শান্ত । জীবনে বেশ কয়েকবার নানা ভাবে ধাক্কা খেয়েছে । যতবার আঘাত পেয়েছে ততবারই অয়ন অদ্ভুতভাবে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে । স্বান্তনা দিয়েছে , আবার প্রয়োজনে ধমক লাগাতেও ভোলে নি । 
অয়ন নিজের থেকেই জানলার কাছে এগিয়ে গেল । খুবই হাল্কা ছায়ার রেশটাকে অনুসরণ করে তিতিনও এগিয়ে গেল । এখন অন্ধকারে চোখটা সয়ে গেছে ।
উত্তুরে হাওয়া থেমে গেছে কিছুক্ষণ আগেই । বৃষ্টির ধারালো ছাঁট লাগছে ।
আয় রে তিতিন ভিতরে আয় । ভিজে গিয়ে আমার মত শরীরটা তোরও খারাপ হবে ।
তুই নিজেকে সামলা । নিজের জ্বর ! আবার পাকামো করে আমার পিছন পিছন চলে এসেছেকপট রাগ দেখিয়ে তিতিন বলে ওঠে । আবার হেসে ওঠে অয়ন তিতিনের মাতব্বরের মত কথা শুনে । 
যতবার অয়ন কথাগুলো বলছে বা হাসছে ততবারই তিতিনের মনে হচ্ছে কতদূর থেকে আওয়াজগুলো হাওয়ায় ভর করে ভেসে আসছে । হয়ত এই পোড়ো বাড়ীর পরিবেশটাই এমন !
কিরে ক্ষিদে পেয়েছে নাকি !অবাক করে দিয়ে অয়ন প্রশ্নটা করে ।
তা একটু পেয়েছে রে ! বাড়ী থেকে বেরনোর সময় বিশেষ কিছু মুখে দেই নি ।
তিতিনকে কিছুতেই বাড়ী থকে ছাড়ত না যদি কোন ভাবে জানতে পারত এমন জায়গায় রাত কাটাবে । তাই পড়তে যাওয়ার নাম করে বেড়িয়ে এসেছে দাদার ভাঙা বাইকটা নিয়ে । কাল বাড়ি ফিরলে মোকাবিলা না হয় করে নেবে ।
ভালো মত এবার বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছে । বিদ্যুতের আলো মাঝে মধ্যে আকস্মিক ভাবে ঘরের মধ্যে খেলে যাচ্ছে । তিতিন এইবার এক ঝলক অয়নকে দেখে । বন্ধুটি পাশেই রয়েছে । এতক্ষণে শান্তি ! নিজের মনেই হেসে উঠল তিতিন , ‘ কী সব ভুলভাল ভেবে বসেছিল !
কী এবার বিশ্বাস হল তো ! তুই আমাকে ছেড়ে আসতে পারিস কিন্তু আমি তোকে যে ছেড়ে থাকতে পারব তা ভাবলি কী ভাবে !অয়নের এই অনুনয় তিতিনের মনটাকে ভিজিয়ে তুলল । এ কোন অয়ন !
বৃষ্টিতে ভেজা একটা বেড়াল পথ ভুল করে টুক করে ঘড়ে ঢুকতেই হঠাৎ চমকে দিয়ে লম্বাটে একটা ছায়া এগিয়ে গিয়ে খপ করে তুলে ধরল । তারপর এক নিমেষে দুহাত দিয়ে ছিঁড়ে দিলো মাথাটা ধড় থেকে । বাইরে অসম্ভব জোরে কড়-কড়া-ৎ শব্দে বাজ পড়ল । সেই আলোতে আবার দেখা গেল বিড়ালটার শরীর তিরতির করে বার কয়েক কেঁপেই স্থির । দুজনারই প্রচন্ড ক্ষিদে ।
মা অনেকক্ষণ ধরেই মুখে আঁচল দিয়ে কেঁদে চলেছেন । বাবা স্থির হয়ে বসে আছেন । বাড়ীর বড় ছেলে মন শক্ত করে কথা বলে যাচ্ছে ক্যাশ কাউন্টারে ।
স্যার আর কতক্ষণ লাগবে ?”
আপনাদের বিল প্রায় রেডি আরেকটু ...কাঁচের দেওয়ালের ওপাশ থেকে ক্যাশিয়ার যন্ত্রের মত বলে ওঠেন । 
হসপিটালের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছেন অয়নের মা-বাবা । মাঝে মধ্যে অয়নের মা তিতিনের মায়ের পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন ।
একটু বাদেই তিতিনের বডিটা সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে স্ট্রেচারে করে বেড়িয়ে আসে ।
নিঃস্পন্দ শরীরটার উপর আছড়ে পড়েন তিতিনের মা । গত রাতে ছেলেটা রোড অ্যাকসিডেন্টে মারা যায় । রাস্তার লোকেরা হসপিটালে আনার ঘন্টাখানেকের মধ্যেই সব শেষ । একটা ট্রাককে ওভারটেক করতে গিয়েই এই বিপত্তি । তিতিনের মা কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলে যান ।
একটু পর নিজেকে সামলিয়ে তিতিনের বাবা অয়নের মায়ের দিকে তাকিয়ে ধীর গলায় জিজ্ঞাসা করেন , “ আপনারা জানলেন কী করে ?”
অয়নের মা রুমাল দিয়ে চোখের জল মুছে গলা ঝেড়ে বলেন , “ বাড়ীতে ছেলেটার এত জ্বর । জ্বরের ঘোরে বার বার বলছিল তিতিন আমাকে জানালো না...!
অয়নের বাবা এগিয়ে এসে বলেন , “ আমরা তারপরেই পাড়ায় খবর নিলাম আজ ভোর বেলায়... ,এই অবস্থা...।
এতক্ষণ পর তিতিনের বাবা অয়নের বাবাকে জড়িয়ে ধরে জোরে কেঁদে উঠলেন ।। 

No comments:

Post a Comment