Monday, January 14, 2019

অর্ণব গরাই



বড়গল্প -


ধূপছায়া

কুল খাবে, কাঁচা কুল সঙ্গে নুন আর শুকনো লঙ্কা গুড়ো, আহা! এ স্বাদ অমৃত সমান । ছাদে বই নিয়ে পড়তে বসেছিলাম একমনে, মিঠির ডাকে একটা শিহরণ বয়ে গেল পুরো শরীর বেয়ে । দুপুরের এই সময়টা খাওয়া দাওয়ার পর আমি প্রতিদিন ছাদের একটা নির্দিষ্ট কোনে থাকি, আচমকা কেউ খুঁজে না পেলেও মিঠি জানে আমি কোথায় আছি । কারন পড়ার থেকেও অপেক্ষাটা বেশি থাকে  মিঠির জন্য, বিশেষত কলেজের ছুটির দিনগুলো শুধু এই দুপুরটারই অপেক্ষা করে বেশি । কোনদিন কুল, কোনদিন আমড়া, কাঁচা পেয়ারা থেতো করে, সরষের তেল দিয়ে মাখো মাখো করে বাতাপি লেবু সবকিছুই খাওয়া শিখেছিলাম মিঠির কাছে । 
মিঠি আমার সেই কবেকার বন্ধু, আমাদের বাড়ি আর ওদের বাড়ি গায়ে লাগিয়ে । দুটো ছাদের মধ্যেখানে শুধু আড়াই ফুটের একটা পাঁচিল, আর ব্যবধান বলতে দু বাড়ির জাত আর দুজনের বয়স  নাহ! তাই বলে আমাকে আর মিঠিকে এসবের কেউ কখনও ছুঁতে পারেনি, বরং মিঠি আর আমার শরীর বেশ কয়েকবার ছুঁয়েছে । কই বুঝিনি তো  মিঠির জাত কি?না সত্যি বলছি প্রতিবার মনে হয়েছে মিঠি আমার থেকে অনেক উঁচু, আর সবার থেকেও অনেক অনেক উঁচু । মিঠি আমাকে বিশ্বাস করে, মিঠি আমাকে ভালোবাসে, আমি মিঠির ভরসা । 

আজ অনেক কুল নিয়ে এসেছে মিঠি, ছাদের এই কোনের দিকটা দুপুরের এই সময়টা বেশ ধূপছায়া থাকে । এ্যকাউন্টেসির বই আর খাতাটা সামনে, অথচ মিঠিকে দেখে সব জাবদা গুলো ভুল হয়ে যাচ্ছে । দুদিন আগে মিঠির সাথে খুব ঝগড়া হয়েছিলো, আগেরদিন কথা দিয়েও সে আসেনি, কারনও
জানায়নি আজ না বলেই এসেছে, হলুদ রঙের সালোয়ার কামিজ পড়ে, মাথায় লাল রঙের একটা ছোট্ট টিপ । ঠিক যেমন আমি পছন্দ করি, মিঠি জানে আমার রাগ ভাঙানোর মাসুল কি । তবে মিঠি আজ এই সাজের সাথে চুল বেঁধে রেখেছে কেন? কেন চুল খোলা রাখেনি? তাহলে কি....

দেখো আমি কিন্ত অনেক লুকিয়ে তোমার জন্য কুলগুলো এনেছি, আজ যদি না খাও তবে কিন্তু আর পাবেনা । আর পাওয়া যাবে না মানে? এখন তো কুলেরই সময়, তবে কি মিঠি আর আসবেনা আমার কাছে? রাগ অভিমান ভুলে জাপ্টে ধরলাম মিঠিকে, এর আগেও কতবার মিঠিকে এভাবে আমি ধরেছি । ঝগড়া হওয়ার দিন দুই আগেও থেঁতো পেয়ারা খেতে খেতে মিঠির ঝাল লাগলে মিঠির ঠোঁট দুটো  আমার ঠোঁট দিয়ে মিঠির সব ঝাল আমি হরণ করেছি । মিঠির মিঠে কড়া প্রশ্রয়ে আমি অশান্ত হয়ে উঠেছি বারে বারে । মিঠির উপর একটা জন্মসিদ্ধ অধিকারবোধ কিভাবে যেন তৈরী হয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত । এ অধিকার দেখার নয়, এ অধিকার আইনত প্রমানিতও নয়, এঅধিকার শুধুই আমার আর মিঠির অনুভূতির । শুধু মিঠির শরীর নয়, মিঠির মন,প্রান, মায়া সবকিছুতেই শুধু আমি আর আমি । মিঠি জানে কি প্রচন্ড ভালোবাসি আমি তাকে, মিঠি জানে কিভাবে তিলে তিলে আমি তাকে নিয়ে আমার স্বপ্নমহল গড়ে চলেছি প্রতিনিয়ত । না আজ মিঠি শুধু আমার আর আমার, আজ রাতের শেষ প্রহর পর্যন্ত আমি মিঠির রসে মাতাল হয়ে উঠবো । 

আমার হাতটা মিঠির হাতে রাখতেই একটা দীর্ঘশ্বাস পড়লো, স্পষ্ট বুঝলাম মিঠি এইমুহুর্তে আর কিছু চায়না । তবে , তবে কেন সে হলুদ শাড়ি আর লাল টিপ পড়ে এসেছে । প্রায় জোর করেই মিঠির কোমড়ে হাত দিয়ে বুকের কাছাকাছি টেনে নিলাম তাকে, এবারেও বাধা দেবার একটা কপট চেষ্টা সে করলো । আস্তে আস্তে বিকেল হয়ে আসছে,সূর্য্য পশ্চিমাকাশে ধীরে ধীরে ঢলে পড়ছে । একটা লাল আভা আমাদের ছাদটাকে গ্রাস করছে খুব সন্তর্পনে, এই গোধূলীবেলায় মিঠির চোখদুটো কি ভীষন মায়াবী হয়ে পড়েছে । আমি এক ঝটকায় মিঠির গোছানো চুল খুলে দিলাম, মিঠির ঠোঁটে আমার ঠোঁট রেখে দিলাম । তিরতির করে কাঁপছে মিঠির ঠোঁট দুটো, অদ্ভুত শিহরণে চোখ বুজে ফেলেছে সে, আর আমি অপলক দৃষ্টিতে পান করতে থাকলাম মিঠির সৌন্দর্য্য  মিঠি আলগা করে দিয়েছে তার শরীর, দুজনেই সম্বিত হারিয়ে ফেলেছি সেইমুহুর্তে  আর ঠিক সেই সময় আচমকা আমাকে এক ঠেলায় দূরে সরিয়ে দিলো মিঠি, আমি কেন জিজ্ঞেস করতেই ও উদ্যেত হলো চলে যাওয়ার জন্য । সাঁতপাঁচ না ভেবে এক ঝটকায় মিঠির ওড়না ধরে টান মারলাম, বে আব্রু হতেই দেখলাম মিঠির মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেছে । বুঝলাম অজান্তে এই ভুলটা করা আমার উচিৎ হয়নি, তৎক্ষনাৎ ক্ষমা চাইতেই আমি যায় বলেই পা বাড়ালো মিঠি । মিঠির চোখের কপট অভিমান চিনতে আমার ভুল হয়নি,না আজ মিঠিকে যেতে দিলে চলবেনা । আমি যদি ভুল না হয় তাহলে নির্ঘাত ও বিশেষ কিছু বলতেই আজ এসেছিলো , আজ না বলে চলে গেলে হয়তো আর কোনদিনই বলবেনা । বড় চাপা স্বভাবের মেয়ে, ভাঙবে তবু চোখ দিয়ে একফোঁটা জল বের হবেনা । তাই বলে মিঠি যে কাঁদেনা তেমন নয়, তবে সে কান্না আবেগের, অভিমানের । 

মিঠি আজ কি তুমি কিছু বলতে এসেছিলে, আমি জানি তুমি মিথ্যে বলবেনা । না তেমন কিছু নয়, আমি আজ যায় । স্পষ্ট বুঝতে পারছি মিঠির চোখে অনেক প্রশ্ন, কোথাও যেন একটু হলেও কিন্তুর অবকাশ রয়েছে । বেশ দৃড়তার সাথেই বললাম, আমি কিন্তু নিশ্চিত তুমি কিছু বলতেই এসেছো তাই বলে ফেলো । সন্ধ্যে হয়ে আসছে, না শুনে কিন্তু আমি ছাড়বোনা । মিঠি ইতস্তত করছে দেখে আমি ওকে সহজ করার জন্য একটু মজা করলাম, আচ্ছা মিঠি আজ এতো সেজেছ কি ব্যাপার কোন ছেলে দেখতে এসেছিলো বুঝি? না অন্য কোন বিশেষ কেউ । মিঠি তোমার বিয়েতে আমি কিন্তু একটা দারুন পাজ্ঞাবী পরবো, তোমার যে টিয়া সবুজের পাজ্ঞাবীটা সবচেয়ে বেশি পছন্দ সেটাই আমি পরবো । মজাটাতে দারুন কাজ হলো, এক ঝাঁপে মিঠি আমার বুকে আমাকে জাপটিয়ে ধরেছে । আমি মিঠির মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি, আমি জানি ওর মাথায় আমার হাত থাকলে ওর মনের মধ্যে এক অদ্ভুত শান্তি বিরাজ করে, মিঠি সবসময় বলে ও নাকি যখন কোন মানসিক অবসাদে ভোগে তখন ম্যাজিকের মত কাজ করে আমার হাত । ওর মনে হয় যাবতীয় টেনশান সব ভোজবাজির মত উবে যায়, মিঠি আমাকে কখনও কখনও আদরকরে তাই জিয়নকাঠি বলে ডাকে । ও বলে ওর যদি কখনও মৃত্যুও হয় তাহলে নাকি একমাত্র আমার স্নেহের হাতই নাকি ওকে মৃত্যুর মুখ থেকেও কেড়ে নিয়ে আসতে পারে । পাগলী একখানা, ও জানেনা আমি ওর জন্য হাজার বার মরতে পারি কিন্তু মিঠি একবারও নয় । না মিঠিদের মরতে নেই, ওরা অমর । 

কতক্ষন হয়েছে জানিনা, হঠাৎ বুকের কাছটা ভিজে ভিজে লাগতেই বুঝতে পারি পাগলীটা কাঁদছে । বুক থেকে সরিযে মিঠির চিবুকটা তুলে ধরি আমি, দুচোখ বেয়ে জলধারা বইতে থাকে । কান্না কোনো ক্ষেত্রেই ভালো নয়, কিন্তু মিঠির পটলচেরা চোখে এইমুহুর্তে জলটা যে অসম্ভব ভালো লাগছিলো তা বলাই বাহুল্যগোধূলীর শেষ লগ্নে রক্তিমআভাটা মিঠির মুখে পড়তেই কি অদ্ভুত মায়াবী মনে হচ্ছিল ওকে । মনে হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা বোধহয় এই বিশেষ মুহুর্তটা আমার আর মিঠির জন্যই তৈরী করেছে । উত্তরের দিক থেকে একটা সোঁদা গন্ধ আসছে নাকে, কয়েক ফোঁটা জল আমাদের গায়ে পড়তেই বুঝলাম এবার যেতে হবে । কিন্তু মিঠি তো বললোনা ও কি বলতে চাই, এভাবে যে যেতেও পারবোনা । বলো মিঠি, তুমি কিছু বলতে চাওদেখো বৃষ্টি পড়ছে, দয়া করে কিছু বলো । ঠোঁট দুটো ইষৎ কাঁপছে, এই বুঝি মুখ খুলবে ........
বৃষ্টির তীব্রতা হঠাৎই করে বেড়ে গেলো, একদিকে আকাশে তখনও সূর্য্যস্তের শেষ রক্তিম আলো তার মধ্যে বৃষ্টি  উফ! পুরো মোহময় পরিবেশ, প্রেম করার জন্য একেবারে উপযুক্ত । খুব কাছাকাছি কোথাও একটা ভীষণ জোরে বাজ পড়লো , চমকে উঠলাম দুজনেই এক ছুটে পৌঁছৈ গেলাম চিলে কোঠার ঘরে এই চিলে কোঠার ঘরেই আমার সব কিছু । এই ঘরটা যেহুতু আমার তাই এই ঘরে খুব প্রয়োজন ছাড়া কেউ আসেনা, ঘরটার আলোকসজ্জা থেকে পর্দা, সবকিছুই আমার পছন্দের । তবে এই ঘরটারে আর একজনের পছন্দও স্বীকৃতি পেয়েছে সে হলো মিঠি, সে মাঝে মাঝেই এই ঘরটা পরিস্কার করে, গুছিয়ে রাখে আমার যাবতীয় পড়ার বই, খাতা, কাগজ । গত বছর রঙ করার সময় মিঠি নিজের থেকে রঙ পছন্দ করেছিলো, ও সবসময় একটু হালকা ধরনের রঙ পছন্দ করতো আমার বইয়ের টেবিলে যে ফুলদানিটা আছে সেটাও মিঠিরই দেওয়া, এইবছর আমার জন্মদিনে আমার পাওয়া সেরা উপহার । 

চিলেকোঠার ঘরে ঢুকতই আবার একটা বাজ পড়লো, ভয়ে মিঠি আমাকে জাপটে ধরলো । এরপর মুহুর্মুহু বেশ কয়েকটা বাজ পড়লো
মনে হচ্ছে ছাদফুটো করে এই বুঝি আমাদের ছুঁয়ে ফেলে । এবারে আকাশ বেশ কালো করে এসেছে, জানলাটা বন্ধ হওয়াতে চারিদিকে অন্ধকার ঘুটঘুটে । মিঠি সেই যে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে তারপর আর ছাড়ার নাম নেই, সত্যি বলতে কি আমি নিজেও চাইছিলাম না মিঠি আমাকে ছাড়ুক তাই আমিও বেশ শক্ত করেই মিঠিকে ধরে রেখেছি । বৃষ্টির ধরন দেখে বুঝতে কষ্ট হচ্ছিলোনা যে ঘন্টা দুই আমাদের খোঁজে ছাদে কেউ আসবেনা, তাই একপ্রকার বেশ সাহসীই হয়ে গেলাম । এইবার রাশ আলগা করলাম, মিঠির ঠোঁটে আমার ঠোঁট ডুবিয়ে দিলাম । এবারে মিঠিও সাড়া দিলো, নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পন করে দিলো আমার  কাছে। এভাবে মিঠিকে পাবো কখনও কল্পনা করিনি , এমনিতেই মিঠির আজকের সাজ পোষাক আমাকে আকৃষ্ট করেছে তার মধ্যে আজ বারেবারে মিঠি আমাকে ধরা দিয়েছে । এক হ্যাঁচকায় মিঠির বেঁধে রাখা চুল খুলে দিলামআবার একটা বাজ পড়লো, জানলা দিয়ে যে আলো এলো তাই দিয়ে মিঠির সৌন্দর্য্য পান করলাম অকাতরে । নাহ! আজ সম্পূর্ণ অন্য মিঠি, আজ আর সেই লাজুক মিঠি নেই । মিঠি এখন দামাল হয়ে গেছে, মিঠির যৌবন, রুপ রস, গন্ধ আমাকেও দামাল করে দিচ্ছে । আমি ধীরে ধীরে বেশ বুঝতে পারছি মিঠি ছাড়া আমার কোন অস্তিত্ব নেই,থাকতেই পারেনা । মিঠি শুধু আমার, শুধু আমার আর আমার । 

সবাই গোল করে বসে আছে বেঞ্চের ঐদিকটায়, ভালো করে কান পাতলে বোঝা যাচ্ছে একটা জটলা । একি! আমার বাবাকে দেখছি এক জায়গায় বসে আছে, বাবাকে ঘিরে আছে জনা কয়েক বাবার বন্ধু । কি ব্যাপার, তাহলে কি আজ আমাদের বিচার বসেছে? হ্যাঁ আমার আন্দাজ একদম ঠিক, মিঠি এসে এইমাত্র খবর দিলো যে ঐ দিকের জটলায় বসা লোকগুলো আমাকে আর মিঠিকে নিয়ে জটলা করছে । মিঠির চোখে রাগ আর ঘৃনা দেখতে পাচ্ছি, কি ব্যপার মিঠি কি হয়েছে ? ওরা কি আলোচনা করছে বলো
মিঠি ঘৃনাভরে ওদের দিক করে একদলা থুতু ফেলে বললো ওরা তোমার আর আমার সম্পর্ক নিয়ে নোংরা নোংরা কথা বলছে । আমি হা হা করে হেসে উঠলাম, বললাম ওরে পাগলী কেউ নোংরা ছড়ালেই কি আর আমাদের সম্পর্ক মলিন হয়ে যাবে । আমাদের প্রেম অমর, অজেয় । 
আমার বাবা যেদিকটাই বসে সেদিকটাই আমরা দুজনেই হাত ধরাধরি করে এগোলাম । সামনে যেতেই দেখলাম বাবা কাঁদছেন, বাবার বন্ধু বিমল কাকু, রজ্ঞিত কাকুরা বাবকে কি যেন বোঝাচ্ছেন । আমি বাবার কাছে জানতে চাইলাম কি হয়েছে না বাবা কিছুই জবাব দিলোনা, একে একে বিমল কাকু, রজ্ঞিত কাকু সবাইকে জিজ্ঞেস করলাম তবুও কেউ জবাব দিলোনা । বেশ বিরক্ত বোধ করলাম, মিঠির দিকে চাইতেই দেখি মিটিমিটি হাসছে । কি ব্যপার বলোতো মিঠি, ওরা জবাব দিচ্ছনা কেন? মিঠি আঙুল দিয়ে ইশারা করলো ওদিকটায়, দেখলাম দুটো শবদেহ রাখা আছে । হঠাৎ এক চিলতে ঝড়ো হাওয়ায় চাদর দুটো উঠতেই ঝলসানো মুখ দুটোতে আমাকে আর মিঠিকে চিনতে আমার একটুও অসুবিধা হলোনা ।

No comments:

Post a Comment