Monday, January 14, 2019

সুজান মিঠি



অণুগল্প-
আগুন

পৌষালি রাত্রি, সজলবাবুর দামি গাড়ির অহংকারী হেডলাইট, পথ মাড়িয়ে ছুটে যাচ্ছে দেমাকে মাতাল হয়ে। চোখে নেশা আর মনে শান্তি এখনো লেগে রয়েছে সজলবাবুর। জেলেপাড়ার আগে গাছালিবনে হঠাৎ গাড়ির সামনে জ্বলে উঠলো দমকা আগুন। গাড়ির স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেল, সামনের কাঁচ ভেদ করে আগুনটা একছুট্টে গাড়ির মধ্যে ঢুকে এসে বসলো পাশের সিটে। সজলবাবুর আরাম শরীর পেঁচিয়ে ধরলো আগুন। সজলবাবু জ্বলতে লাগলেন দাউদাউ করে। সারা শরীরে পুড়ে যাওয়ার জ্বালা, সজলবাবু চিৎকার করে করে পুড়ে ছাই হয়ে গেলেন।

সকালবেলায় মধু জেলে দেখতে পেয়ে লোকজন ডেকে এনে অচেতন সজলবাবুকে পৌঁছে দেয় বাড়ি। জ্ঞান না ফেরা অবধি চললো ডাক্তার-অবজারভেশন-দুশ্চিন্তা। জ্ঞান ফিরতেই গিন্নির কান্নামিশ্রিত প্রশ্নবানে জর্জরিত হলেন সজলবাবু। ওগো, কতবার বলি, এত মদ খেয়ো না, খেয়ো না। এইভাবে রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলে  কেন তুমি! তোমার কিছু হয়ে গেলে আমাদের কি হবে গো…’

সারাদিন কাটলো একপ্রকার। কিছুতেই কোনো ব্যাখ্যা সজলবাবুর মনে সঠিক সান্ত্বনা জোগাতে পারলো না। তারপর রাতের অন্ধকার গভীর হওয়ার পরেই গিন্নির নাক ডাকানির সুর, জোরালো ঘুমের ওষুধ উপেক্ষা করে সজলবাবুকে ছুটতে হলো এক অদৃশ্য চুম্বকের টানে। সেই স্থানে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন তিনি, আর তার উপরে এসে পড়ল সেই আগুনটা। জড়িয়ে ধরে মুখের উপর আগুন মুখ দিয়ে চুম্বন শুরু করলো যেন।

পরদিন বাড়িতে ডাক্তার আর তার পাশাপাশি আবির্ভূত হলেন তান্ত্রিক। চললো ডাক্তারি-ঝাড়ফুঁক। রাত্রে ব্যবস্থা করা হলো কড়া পাহারার। হুকুমও কড়া- একবিন্দু ঘুমানো চলবে না কারো। শীতের হিমেল রাত হঠাৎ করে সবার চোখে বুলিয়ে গেল নিদ্রা-ব্রাশ যেন। সবাই ঘুমিয়ে পড়লো নিষেধ অগ্রাহ্য করেই। আর সজল বাবু ছুটলেন আগুনের গায়ে আদর জড়াতে।

দিন সাতেক পোড়ার পরে তিনি পুড়তে পুড়তেই জোড়হাত করে ছুঁতে চাইলেন আগুনের পা, কাঁদতে কাঁদতে বললেন- আমায় ক্ষমা করে দে, পুঁটি।
সেদিন আগুনটা জোরে অনেক জোরে আঁকড়ে ধরলো সজলবাবুকে, হওয়ার স্রোতে ভেসে এলো কথা-- এখন কেন ক্ষমা চাইছ বাবু? তোমার বাড়িতে কাজ করতাম বলে আমার দেহেরও ভাগ তোমার হকের ছিল নাকি। তা দিতে চাইনি বলেইনা জ্যান্ত পোড়ালে আমায়। তাইতো এখন তোমার হক তোমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছি সজলবাবু। এই নাও তোমার হক, আমার শরীর।
রাত্রে পুড়ে ঝাঁজরা শরীর নিয়ে ঘরে ফেরার পরে শুরু হতো তান্ত্রিকের ঝাড়ফুঁক- ঝাঁটা-জুতো-সর্ষে আগুন। পনের দিন পরে এক রাতে যখন সজলবাবুকে বেঁধে রাখা হলো লোহার কঠিন শিকলে, সেই রাতে তিনি গিয়ে কেঁদে পড়লেন পুঁটি আগুনের পায়ে- পুঁটি, তুই আমায় মৃত্যু দে, তুই আমায় মৃত্যু দে।আগুন বাতাসের স্রোতে হেসে উঠে নিবিড় হয়ে জড়িয়ে ধরলো সজলবাবুকে।

তান্ত্রিক ফিরে গেছেন, একে একে সবাই। পান চিবাতে চিবাতে গিন্নিও এখন উঠতে বসতে পাগল স্বামীর উপর ঝাড়েন রাগ। সেই দেমাকি গাড়ির হেডলাইট জ্বালিয়ে এখন সজলবাবুর মেয়ে করে বেড়ায় লেটনাইট পার্টি। সজলবাবু অবশ্য অনেকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন কিন্তু হয় দড়ি গেছে ছিঁড়ে নইলে বিষ হয়েছে অমৃত।

সজলবাবুর মেয়ে তানি মাতাল হয়ে ফিরছিল গাড়িতে , মাতাল করিয়ে দেওয়া বন্ধুর কাঁধে মাথা দিয়ে। গাছালিবনের কাছে এসে বন্ধুর মাথায় খেলে গেল ইচ্ছা। তানির জামার বোতাম খুলতেই সামনে দেখতে পেল এক ভয়ংকর দৃশ্য। ছুটে আসছে আগুনের দমকা এক গোলা, আর তার সামনেই তানির বাবা ভয়ার্ত মুখে দাঁড়িয়ে। আগুনটা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে খেয়ে ফেলল তানির বাবাকে। আর সেই আগুনের আঁচে বন্ধুটিরও গা জ্বলতে লাগলো হঠাৎ। মাথার ইচ্ছেটাও পড়ে রইল ওই গাছালিবনে। মাতাল তানি সুস্থ ভাবেই পৌঁছালো তার বাড়ি।

তানির বন্ধুর দেওয়া বর্ণনা শুনে সজলবাবুকে রাখা হয়েছে গভীর অবজার্ভেশনে। দেশের বড় বড় তাবড় তাবড় তান্ত্রিকের বহু চেষ্টায় সজলবাবুকে মুক্তি দিয়েছে অবশ্য পুঁটি, কিন্তু এত আগুন সোহাগ খেয়ে সজলবাবুর রয়ে গেছে শুধু প্রাণটুকু।

তানির বন্ধু স্বীকার করেছে তার গোপন ইচ্ছের কথা।  সজলবাবুর সারা গ্রামে আর কেউ এমন ইচ্ছেকে কখনো যদি মাথায় আনে, তক্ষুনি চোখের সামনে দেখে আগুনের হলকা তীব্র বেগে হয়ে ছুটে আসছে। সজলবাবুর কাহিনী এখন সবাই জানে, কোনো মেয়ে একলা অন্ধকারে ওই গ্রামের পথ দিয়ে হেঁটে গেলে রাস্তার মাচায় বসে থাকা ইয়াং ছেলেরা চিৎকার করে বলে ওঠে, ‘ পুঁটি, আমরা আছি, তুই নিশ্চিন্ত থাক, বোনটিকে আমরাই বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসছি।

No comments:

Post a Comment