Monday, January 14, 2019

মিনতি গোস্বামী




অণুগল্প -
লেখার টানে

সুখে খেতে ভূতে কিলোয় বলে একটা প্রবাদ ছোট থেকেই শুনেছিলাম, কিন্তু সেটা যে আমার জীবনে এমন সত্য হয়ে উঠবে এটা ভাবতে পারিনি।বাংলায় এম, পড়তে পড়তে কিছু লেখালিখি শুরু করি।বি,এড পাশ করার পর একটা মাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষকতাও পেয়ে যাই।নিশ্চিত জীবন হওয়ার পর লেখাটাতেই মন দিই।কিন্তু যে বললাম ভূতে কিলোয়হঠাৎ কবি বন্ধু সুমনা বললো,'আমাদের নিজেদের একটা পত্রিকা করলে হয় না?' ব্যস, যেমন প্রস্তাব তেমনি কাজ।লেখা যোগাড় করতে শুরু করলাম।চাকরিটা যেহেতু পেয়ে গেছি, তাই টাকার চিন্তা নেই।ঠিক হল, পত্রিকা বের করার জন্য আমি টাকা দেব।তারপর যদি কেউ কিনে নেয়, তখন ভাবা যাবে বছরে কটা সংখ্যা করা হবে
সুমনা,রিক্তা, আমি আর বিমল চারজনে লেখা যোগাড় করতে লাগলাম। ওরা তিনজনে বেকার বলে ওদের পত্রিকার সব ভার দেওয়া হল।কারণ আমাকে বাইশ কিলোমিটার জার্নি করে চাকরি করতে যেতে হয়।
প্রথমে ঠিক হল জেলার লেখকদের খুঁজে বের করে লেখা আনতে হবে, সাথে তরুণ লেখকদেরও খুঁজতে হবে।লিটিল ম্যগাজিনের কাজই তো তাই।আমরা ঠিক করি  প্রথমদিকে কোন বড় লেখকের কাছে আমরা যাবো না।পত্রিকা পড়ে যদি কেউ আগ্ৰহ দেখায় , তবেই তার কাছে লেখা সংগ্ৰহ করবো।
ওরা তিনজন লেখা সাধ্যমত যোগাড় করে।বিমল প্রেস ঠিক করা,বার বার প্রুফ দেখার কাজ নীরবে করায় পত্রিকা আলোর মুখ দেখলো।
সত্যি একটা নতুন পত্রিকার জন্ম দেওয়ায় আমরা গর্ব অনুভব করছিলাম।আমাদের জেলার প্রায় সব গ্ৰামের লাইব্রেরীতে ঘুরে ঘুরে বিমল পত্রিকা দিয়ে এলো।বেচারার এনার্জি খুব।বিমল পত্রিকার সহ সম্পাদক।এমন একটা পত্রিকা করতে পেরে তার মনে খুব আনন্দ হয়।
বিমল বলে,'বেকার হলেই বা, নতুন একটা কিছু করে তো মানুষের কাছে নিজের নাম পৌঁছে দিতে পেরেছি।দেখবি এই পত্রিকা একদিন খুব বড় হবে।'
পত্রিকার নাম, ঠিকানা দেখে আমাদের জেলার নাম করা কবি পুর্ণেন্দু ভৌমিক একদিন আমাকে ফোন করে বললেন, চমৎকার পত্রিকা হয়েছে।প্রথমেই এত ভালো কাজ? তোমরা একদিন খুব বড় কাজ করবে।পরবর্তী সংখ্যার জন্য আমার একটি লেখা নিয়ে যেও।আমার বাড়িতে তোমার নিমন্ত্রণ রইল।'
আমরা তো আনন্দে টগবগে।সুমনা আনন্দের চোটে সেদিন সবাইকে চিকেন পকোড়া খাইয়ে দিলে।ঠিক হল, আমি যাবো পুর্ণেন্দু বাবুর বাড়ি
পরের মাসে রবিবার লোভ সামলাতে না পেরে বেরিয়ে পড়লাম লেখা আনতে।খড়ি নদীর ধারে নতুন গাঁয়ে কবির বাড়ি।পাশের গ্ৰামে আমার মাসির বাড়ি।তাই ঠিক করলাম দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর বাড়ি থেকে বেরোবো।লেখা নিয়ে মাসির বাড়ি রাতে থাকবো।কবি বলেছিলেন,'বাসস্ট্যান্ড থেকে নেমে ডানহাতে চারপা এগোলেই ব্যাঙ্ক।তার দোতলাতেই তিনি থাকেন।ব্যাঙ্ককে তিনিই ভাড়া দিয়েছেন নীচতলা।'
প্রায় বিকেল চারটেয় বাস ধরলাম।কিন্তু বৈশাখ মাস বলে বাসে উঠেই বিপত্তি।মেঘের মুখ ভার, চারিদিকে অন্ধকার,টানা বৃষ্টি আর ঝড়।একঘন্টার পথ যেতে বাস দুঘন্টা লাগালো।বাসস্ট্যান্ডে নামতেই রাস্তা সুনসান।বৃষ্টি অবশ্য থেমে গেল।ম্লান অন্ধকারে বাড়ি চিনতে অসুবিধা হলনা।দরজায় বেল দিতেই দরজা খুলে গেল।
দিন পনের আগে ফোন করে বলে দিয়েছিলাম, তাই হয়তো চিনতে পারলেন।দরজা খুলে দিলেন।কিন্তু স্পষ্ট তাকে দেখা যাচ্ছিল না।বললেন,'এসো' তাকে অনুসরণ করে ঘরে গিয়ে একটা চেয়ারে বসলাম।
বললেন,'ঘরে আলো নেই, লোডশেডিং।ঘরে তো একা আছি, তাই আলো জ্বালাতে পারছি না।'
পত্রিকা সম্বন্ধে প্রশংসা করলেন এবং তার পরে বললেন, এই দেখ তোমার জন্য খামে ভরে টেবিলে লেখাটা রেখে দিয়েছি। এটা আমার আত্মজীবনী।এটাই আমার শেষ লেখা জানবে।আমি আর কোনদিন কোন পত্রিকায় লিখবো না।'
বললাম , এমন কঠিন সিদ্ধান্ত কেন?
বললেন,'প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে।'
আমি আরকথা না বাড়িয়ে লেখাটা নিয়ে চলে এলাম।তাকে প্রনাম  করতে গেলে আরও দূরে সরে গেলেন।মনটা খচখচ করছিল, আলোতে তার অবয়ব দেখা  হলনা বলে। কিন্তু রাত  হয়ে  গেলেমাসির বাড়ি যাওয়ার জন্য টোটো পাবোনা বলে তাড়াতাড়িবেরিয়ে এলাম। দরজাটা ধড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল    বাড়ি থেকে আমাকে বেরোতে   দেখে একদল ছেলে আমাকে ঘিরে ধরলো।
বললো,'আপনি কি  করছিলেন বাড়িতে?
তারা আমার মুখে সব শুনে বললো, পুর্ণেন্দু বাবূ সাতদিন আগে   বাড়িতে গলায় দড়ি দিয়ে মারা গেছেন।তিনি তো শহরে থাকতেন।হয়তো  মরার জন্যই  এই বাড়িতে এসেছিলেন।দেখছেন না, বাড়িটা তালা বন্ধ।ওনার স্ত্রী, ছেলে এসেছিল দেখতে।পুলিশ লাশ  নিয়ে যাওয়ার পরই তারা চলে গেছে।
আমি নেড়েচেড়ে দেখলাম, খামটা তো সত্যি।
ছেলেরা বললো,'বড় লেখক ছিল তো , তাই লেখার প্রতি  টানটা এখনো আছে।আর কথা দিয়ে কখনো কথার খেলাপ করতেন না শুনেছি।
আমি নিজের গায়ে চিমটি কেটে দেখলাম আমি ঠিক আছি কি না

No comments:

Post a Comment