Monday, January 14, 2019

রিয়া ভট্টাচার্য



বড়গল্প-
নিষ্কৃতি (প্রাপ্তমনষ্কদের জন্য)

শীততাপনিয়ন্ত্রক যন্ত্রে কৃত্রিমভাবে ঘরের তাপমাত্রা নেমেছে আঠারো ডিগ্রি সেলসিয়াসে, জানলার কাঁচে বাষ্পজালিকার ধুম্রছায়া। জান্তব শিৎকারে মাঝে মাঝেই শিউরে উঠছে অন্দরবাতাস, বাসনারা দীর্ঘশ্বাস হয়ে মাথা খুঁড়ে মরছে চারিদিকে। বিছানার কুঁচকানো চাদরে পড়ে থাকা মানবজমিনে ঘোড়সওয়ারি করছেন এক রাজেন্দ্রাণী, শাসনদণ্ড যেন আজ নিজেই শাসিত শোষিতের কাছে। লম্বা চুলের ঝাঁক যেন অজস্র নাগপাশের মত জড়িয়ে ধরেছে পুরুষালি অঙ্গ, বেহায়া ঠোঁটের চাবুক থেকেথেকেই পুষ্পবৃন্ত হতে চয়ন করে নিচ্ছে তৃষ্ণার মধু। অনাঘ্রাত কমলদলে আজ কামিনীর রাজ্যাভিষেক, অন্ধকারের খনিজ যেন মায়াময় হয়ে জ্বলছে তার আঁখিমুকুরে। যন্ত্রনাক্লিষ্ট হাসি ও বেপরোয়া অশ্রুকণা যেন মাখামাখি হয়ে সহাবস্থান করছে হেথায়, কঠিন প্রস্তরতল চিরে প্রবাহিত হচ্ছে বারিধারা। 
বাইরে আকাশের আধখাওয়া চাঁদখানা যেন পাহারা দিচ্ছে মুহূর্তের, তারকারাজি মুখ লুকিয়েছে ভৌম লজ্জায়। প্রত্যাশিত শিহরণের সঙ্গে শক্তিস্খরণ করে রোমশ বুকে আছড়ে পড়েছেন কালনাগিনী, অত্যাচারিতের বাহুডোরে বিন্দু বিন্দু স্খলিত হচ্ছে অত্যাচারীনির ঘাম। 

--" ইয়ে তুনে কেয়া কিয়া বাঁওরি? মালিককো পতা চল গেয়া তো!" নাগিনীর কপালের চুল সরাতে সরাতে ফিসফিস করে বলে শিকার নিজেই।
--" আমি কারো পরোয়া করিনা৷ যা ইচ্ছে তাই করি। আর আজ নয়ত কাল বাবা জানবেনই, এতে ভুল তো কিছু না! " লাল চোখে ফুঁসে ওঠে সর্পিণী। 
--" এয়সি বাত নেহি হ্যায়, বাত ইয়ে হ্যায় কি ম্যায় নৌকর অউর তুম জমিনদারকি বিটিয়া হো! কোই কেয়সে....."।
---" কে কি ভাববে সেটা আমার ভাববার বিষয় নয়, তবে ভাবছি বাবাকে কালই খুলে বলব আমাদের ব্যাপারটা। ইংরেজ শাসন নেই, দাসপ্রথাও আর নেই, অগত্যা বাবার প্রতিবাদ করার কিছুই নেই।" দ্রুতহাতে নিজ বেশবাস ঠিক করে নিতে নিতে দৃঢ়কণ্ঠে বলে সর্পিণী। 
--" মগর জামুনিয়া, শুন তো! অগর মালিক না মানে তো কেয়া তু মেরেকো ছোড় দেগি?" 
একটা ক্রুর হাসি আচমকাই খেলে যায় জামুনিয়া ওরফে যমুনার চোখে, কঠিন লাস্যে অপরূপ মুখ ফিরিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে যাওয়ার আগে ধাতবপিণ্ডের মতো ছুঁড়ে দেয় শব্দ, "হ্যাঁ"।
ব্যবহৃত বিছানায় পিঠ লাগিয়ে অন্ধকার মেখে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে কিষণ, যন্ত্রণাটা বের করে দিতে ইচ্ছে করে ভাঙচুর করে। পরক্ষণেই মনে পড়ে এটা একটা হোটেলের কামরা মাত্র, বাগবাজারের প্রখ্যাত জমিদারবংশের একমাত্র বংশধর আদিত্যনাথ রায়ের প্রতিভাময়ী বিদুষী কন্যা যমুনাবালা ওরফে জ্যামির তার মত বাবার কারখানাতে কাজ করা সামান্য বেতনভুক কর্মচারীর সঙ্গে কিছু মুহূর্তযাপনের মাধ্যম মাত্র; এতে ভালোবাসা নাকি শুধুই ক্ষুধা মিশে আছে জানা নেই তার।

*       *        *        *        *

---" মেয়ের এই অবস্থা কবে থেকে? এতদিন কি কোনো ডাক্তারই দেখান নি?" চিন্তিত মুখে বললেন স্বনামধন্য ডাক্তার স্যান্যাল।
--" দেশের প্রায় সমস্ত বড় বড় ডাক্তারকে দেখিয়েছি, এমনকি যত পরীক্ষা করানো সম্ভব সবই করিয়েছি। কিন্তু কেউই রোগ ধরতে পারছে না। " কাঁচুমাচু মুখ করে বললেন আদিত্যনাথ রায়, দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী জমিদার অনাদিকিঙ্কর রায়ের একমাত্র বংশধর।
---" মেয়েতো দিনদিন রক্তশূন্য হয়ে পড়ছে, চোখের তল কাগজের মত সাদা! এভাবে চললে তো বেশিদিন....." 
---" প্লিজ আপনি কিছু করুন, যত টাকা লাগে দেব। আমার এই একটিই কন্যা, যেভাবেই হোক তাকে বাঁচান ডাক্তার।" হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন প্রৌঢ় অভিজাত ব্যক্তিটি।
---" দেখুন আমি যা রিপোর্ট দেখছি তাতে কোনো চিকিৎসাই করা বাকি নেই, কিন্তু ফলাফল শূন্য। এমনটা কিকরে হতে পারে!" হতাশাজনক শোনাল প্রাজ্ঞ ডাক্তারের গলা।

বিশাল বড় হলঘরখানায় জ্বলছে কম পাওয়ারের বিজলিবাতি, আধো আলো আধো অন্ধকারে কেমন ছায়াময় রহস্যজনক পরিবেশ। মাথার কাছের দেওয়ালজোড়া জানলাটা ঢাকা পুরু পর্দায়, মখমলের মত নরম বিছানায় মিশে গিয়ে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে এক ক্ষয়াটে রুগ্ন শরীর; যমুনাবালা ওরফে জ্যামি!
---" আমি কি করব ডাক্তার? দিনদিন অসংলগ্ন কথা বেড়েই চলেছে, এখন তো ঠিক করে আর উঠেও বসতে পারেনা মেয়েটা। আলো দেখলেই চিৎকার করে, সবসময় আতঙ্কগ্রস্ত। সাইকিয়াট্রিস্ট দেখিয়েও ফল পাইনি।" একটানা কথাগুলি বলে হাঁফাতে লাগলেন আদিত্যনাথ। শৈশবে মা মরা একমাত্র কন্যারত্ন, প্রয়োজনের চেয়ে অধিক প্রাচুর্যের মাঝে বড় করেছেন তাকে। পূর্বপুরুষের বিশাল সম্পত্তি ও পিতার ব্যবসার একমাত্র উত্তরাধিকারীনী আজ মৃত্যুমুখে ধুঁকছে ; অসহায় পিতার বিলাপ ব্যতীত আর কোনো কর্মই নেই। 
ডাক্তার স্যান্যাল সন্দিগ্ধদৃষ্টিতে লক্ষ করছিলেন রোগীনীকে, অস্থিচর্মসার মুখে যেন অজানা ভয় আর আতঙ্কের যুগপৎ ছাপ তাকে অসাড় করে ফেলেছে, কে বলবে এই যমুনাবালা ওরফে জ্যামি কোলকাতার ডাকসাইটে সুন্দরীদের অন্যতমা!
--" ভালো পাত্র দেখে বিয়ে দিয়েছিলাম, বেশ ছিল বিদেশে। কেন যে নিজের শারীরিক অসুস্থতার দোহাই দিয়ে আনতে গেলাম এখানে! বাড়ি ফেরার তৃতীয় দিন থেকেই শুরু হল ঘটনাগুলো, মেয়ের পাগলামি দেখে জামাই বাবাজি তো প্রাণ হাতে করে পালিয়ে বাঁচলেন।" কপাল চাপড়াতে কথাগুলি বলছিলেন আদিত্যনাথ, তার কাঁধে হাত রেখে শান্ত হতে বললেন ডাক্তার স্যান্যাল।
--" দেখুন উতলা হবেন না, তবে আপনার কন্যার লক্ষণ ভালো না। এতবড় যশস্বী ডাক্তারেরা যখন এর রোগনির্নয়ে অক্ষম হয়েছেন তখন আমি কোন ছার! তবে একটা কাজ আমি করতে পারি, আমার এক বন্ধু প্রসেন প্যারাসাইকোলজিস্ট। তাকে একবার ডেকে দেখাতে পারি, যদি সে কিছু বোঝে! দেখুন আদিত্য বাবু, আজও কিছু কিছু জিনিস আছে যা আমাদের ব্যখ্যার বাইরে; অগত্যা চেষ্টা করতে দোষ কোথায়!"
মুখ তুলে তাকালেন আদিত্যনাথ, চোখে অজানা অতীত আতঙ্ক যেন ঝিলিক দিয়ে উঠেই মিলিয়ে গেল। ক্লান্তভাবে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলেন তিনি। পরদিন সকালে আসবেন বলে ব্যাগ গুছিয়ে উঠে পড়লেন স্যান্যালবাবু।

*       *        *       *     *

--" কি রে কিষণ! যার নুন খাস তার ঘরেই সিঁধ কাটিস! লজ্জা করে না তোর!" ভাঁটার মত গনগনে চোখে কিষণকে দগ্ধ করতে করতে বললেন আদিত্যনাথ।
--" জামুনিয়া হামসে পেয়ার করতি হ্যায় হুজুর, বহত পেয়ার। হামভি উসকে বিনা নেহি রহ সকতা হুঁ, আপ চাহে তো উসসে পুছ সকতে হ্যায়।" মরিয়া হয়ে জবাব দিল কিষণ। ইতিমধ্যে আদিত্যনাথের দেহরক্ষীদের মারে ভালোমতই জখম হয়েছে সে, ঠোঁটের কষ বেয়ে গড়িয়ে নামছে রুধিরধারা। কালশিটে পড়া ফোলা চোখে চাইতেও অসুবিধা হচ্ছে বড্ড, ডানহাতটা ভেঙেছে কিনা কে জানে!
---" চো ও ও প রাস্কেল কোথাকার, ভালোবাসা দেখাচ্ছ তুমি আমায়? জানোনা সাতদিন পরে আমার মেয়ের বিয়ে, পাত্র বিদেশে কর্মরত বিশাল ব্যবসায়ী। সাহস কিকরে পাও অত রাতে আমার মেয়ের ঘরে ঢোকার!" মুষ্টিবদ্ধ হাত দুম করে সেন্টার টেবিলে আছড়ে ফুঁসতে ফুঁসতে বললেন আদিত্যনাথ।
--" মেহেরবানি করকে উসকি শাদি মত করাইয়ে হুজুর, ও হামারি হ্যায়। হাম তো বস উসসে পুছনে গেয়ে থে কি উসনে শাদিসে মানা কিঁউ নেহি কিয়া।" হাঁফাতে হাঁফাতে বলল কিষণ।
আদিত্যনাথের মাথায় আগুন জ্বলছে, ইচ্ছে করছে এখুনি এই ছোকরার মাথা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলতে। এত বড় সাহস মনিবের মেয়েকে ভালোবাসার স্বপ্ন দেখে! কিন্তু না, তিনি এখন কিচ্ছু করবেন না। যা বলার যমুনাই বলুক এই বেল্লিককে। কিছুক্ষণ ভেবে খাস চাকরানী মানদাকে ডেকে হুকুম দিলেন আদিত্যনাথ,
--" নিয়ে এসো যমুনাকে, ওই এসে বলুক সত্যিটা।" 

যমুনা এল, আকাশী আনারকলিতে হিরের গয়নার সৌম্য দীপ্তি তাকে করে তুলেছে আরো মোহময়ী, চোখে বেপরোয়া উচ্ছ্বাসের ঝলক।
--" আয় মা, এই ছেলেটি কাল রাতে তোর ঘরে ঢুকতে গিয়ে ধরা পড়েছে। এ যা বলছে তা কি সত্যি?" গম্ভীর মুখে প্রশ্ন করলেন আদিত্যনাথ।
যমুনাকে দেখেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছে কিষণ, ঠিক যেমন আঘাতপ্রাপ্ত শিশু কেঁদে ওঠে মাতৃস্পর্শে।
---" এ জামুনিয়া, মত কর শাদি। তু মেরেকো পেয়ার করতি হ্যায় না? বোলদে সবকো। কোই মেরি বাত শুনতা নেহি।" কান্নাজড়ানো কিষণের কণ্ঠস্বর কেমন যেন হাহাকার হয়ে কানে বাজে সকলের। অবিচল যমুনা আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় তার দিকে, আঙুলের ডগা দিয়ে মুছে নেয় ঠোঁটের কষ বেয়ে নামা রক্ত, ফের বাবার দিকে ফিরে মুচকি হেসে বলে,
--" ছেড়ে দাও একে বাবা, জানোতো কত ছেলে কলেজে পড়ার সময় থেকে আমার জন্য পাগল; এ আর নতুন কি! " 
বজ্রাহত কিষণ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে যমুনার দিকে। তার দৃষ্টি দেখে এবার হো হো করে হেসে ওঠে যমুনা। কাছে গিয়ে কিষণের থুতনি ধরে নেড়ে দেয় স্নেহভরে
--" ছাড়া পেলেই তোর গাঁও য়ে ফিরে যা বুঝলি? গ্রাম্য কোনো মেয়েকে বিয়ে করে নে, যমুনা তোর জন্য নয়।" 
নিস্পন্দ হলঘরে শোনা যায় ঘড়ির কাঁটার টিকটিক শব্দ, মেয়ের নিষ্ঠুরতার আসল গল্প অনুধাবন করতে পেরে স্তম্ভিত হয়ে যান আদিত্যনাথ। চোখ মুছে এবার নড়েচড়ে ওঠে কিষণ, আস্তে আস্তে পা ফেলে দরজার দিকে যেতে যেতে বলে,
-- " তেরি শাদিকা তৌফা জরুর দেঙ্গে হাম।"

এসেছিল উপহার, যমুনার বিয়ের দিন সকালে। সুন্দর বাক্স হতে বেরিয়েছিল রক্তাক্ত কর্তিত লিঙ্গ, পুরো বিয়েবাড়ি স্থানু হয়ে গিয়েছিল এই চরম নির্মম অঙ্গীকারে। সানাইয়ের সুর ছাপিয়ে ভেসে এসেছিল একদল কাকের কর্কশ আর্তনাদ ; মাঠের মাঝে পড়ে থাকা সদ্যমৃতের টাটকা মাংসের উল্লাসে।

*       *       *      *       *

--" আপনারা কেউই ধরতে পারেন নি আপনার মেয়ে প্রতিরাতে নিষ্পেষিতা হচ্ছে কোনো প্রেতাত্মার দ্বারা!" চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন প্রসেনজিত সিকদার; স্বনামধন্য প্যারাসাইকোলজিস্ট। 
--" এত ডাক্তার দেখিয়েছি,কিন্তু কোনো রেপ সাইন তো...!" মাথা চুলকে বললেন আদিত্যনাথ।
---" ভুল করছেন, আমি যে রেপিস্টের কথা বলছি, সে কোনো মানুষ নয়; আত্মা। তাই ডাক্তারি পরিভাষায় নির্নয় সম্ভব নয়, ভেতর থেকে ক্ষয়ে গিয়েছিল আপনার মেয়ে ; তাই শেষরক্ষা হয়নি।" 
ডুকরে কেঁদে উঠলেন আদিত্যনাথ, তিনদিন আগে; যেদিন প্রসেনবাবুর আসার কথা ছিল সেদিন ভোরেই মারা যায় যমুনা। তার মৃত্যুকালীন আর্তনাদ আজও কানে বাজে অসহায় পিতার, মৃত্যুর সাথে সাথেই ঝনঝন করে ভেঙে পড়েছিল মাথার কাছে দেওয়ালজোড়া আয়নার সমস্ত কাঁচ।
--" নিজেকে সামলান আদিত্যবাবু, আসলে পাপ কাউকেই ছাড়ে না।  মৃত্যুর পরেও কিষণের আত্মা নিষ্কৃতি দেয়নি যমুনাকে,বরং অপেক্ষা করেছে তার দেশে ফিরে আসার। যদি আগে আসতে পারতাম হয়ত বাঁচাতে পারতাম তাকে, আবার হয়ত পারতাম না। তবে কিষণ তার মৃত্যুর সঠিক বিচার পেয়েছে।" উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন প্রসেন।
বাইরে ঘনিয়ে এসেছে সন্ধ্যার আঁধার, পাখিরা ফিরতে শুরু করেছে আপন কুলায়। নিষ্প্রদীপ রায়ভিলা হতে বেরিয়ে নিজের গাড়ির দিকে যেতে যেতে কি মনে হতে পেছন ফিরে ছাদের দিকে চাইলেন তিনি।
 ঝাপসা কুয়াশার অন্তরালে এক নারীকে জড়িয়ে রয়েছে এক নগ্ন পুরুষ; লিঙ্গহীন। সন্ধ্যার অন্ধকার গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ঝরে পড়ছে তাদের ওপর।।

(সমাপ্ত)

No comments:

Post a Comment