Monday, January 14, 2019

চন্দ্রাবলী ব্যানার্জী




বড়গল্প -
আড়ালে

অনেক রাত রায়পুরগঞ্জ স্টেশনে একটা ট্রেন থামলো এসে । একটা লোক নামল । বয়স ৩৬-৩৭, চোখে চশমা, সুঠাম দেহ,প্রায় ছ' ফুটের মত লম্বা, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা ।  লোকটার সাথে একটা ট্রলি ব্যাগ,আর দুটো সাইড ব্যগ  দুর্যোগের রাতবাইরে মুষলধারে বৃষ্টি পরছে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে ।  স্টেশন চত্তর প্রায় ফাঁকা । ট্রেন থেকে নেমে এদিক ওদিক দেখলো,তারপর একটা বেঞ্চের উপর ব্যাগ গুলো রেখে সিগারেট ধরালো। ফোন বার করে কাকে যেন ফোন করলো কিন্তু যান্ত্রিক শব্দ করে ফোনটা কেটে গেল । বিড়বিড় করে বললো - এতবার ফোন করছি লাইন পাচ্ছিইনা ।  ফোন পকেটে রেখে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। স্টেশনের এক কোণে একটা ভিখারি মত বুড়ো লোক বসে আছে চাদর মুরি দিয়ে জড়সড় হয়ে । ওই আগন্তুক লোকটা বুড়ো লোকটা কে জিজ্ঞাসা করলো - ও দাদা এখানে গাড়ি বা ঐ জাতীয় কিছু পাওয়া যাবে ?
বুড়োটা কথা না বলে আঙুল দিয়ে ইশারা করে বাইরের দিকে দেখালো ।
আগন্তুক ট্রলিটা টেনে নিয়ে বাইরের দিকে সেডের নিচে গিয়ে দাঁড়ালো দূরে একটা ট্যাক্সি দেখতে পেলো,যেটা দাঁড়িয়ে আছে, বৃষ্টির জলে সব ঝাপসা,ভিতরে কেউ আছেকিনা বোঝা যাচ্ছে না।  ব্যাগ গুলো সেডের নিচে রেখে ট্যাক্সির জানালায় গিয়ে টোকা দিল ।
---
ভিতরে কেউ আছেন দাদা ?
উত্তরে ট্যাক্সির কাচটা অল্প খুলে ভিতর থেকে কে যেন বললো, - কোথায় যাবেন বাবু ?
আগন্তুক  বললো,-আপাতত একটা ভালো হোটেলে নিয়ে চলুন।  ড্রাইভার গেটের লক খুলে দিয়ে নিচে নেমে ডিকি খুলে ট্রলি ব্যাগটা রেখে দেয়।  দুজনেই গাড়ির ভিতর ঢুকে বসে।
ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিয়ে জিজ্ঞাসা করে
- কোন হোটেলে যাবেন বাবু,
আগন্তুক - যে কোন ভাল একটা হোটেলে নিয়ে চলুন ।
ড্রাইভারের মুখ ভাল করে দেখা যাচ্ছে না, দাড়ি গোঁফের জঙ্গল। বেশ কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ।
আগন্তুক বাইরের বৃষ্টির ঢল দেখতে দেখতে যায়।
তারপর আগন্তুক বলে,
- আপনাদের এখানে কবে থেকে হচ্ছে এ রকম বৃষ্টি ?

ড্রাইভার - আজ দুপুর থেকেই শুরু হয়েছে, দুদিন ধরেই  অল্প অল্প মেঘ করেছিলবৃষ্টি অবশ্য হয়নি, আজ একেবারে থামার নাম করছে না, একবার বাড়ে একবার কমে।
 আপনি কোথা থেকে আসছেন বাবু ?
আগন্তুক - কলকাতা থেকে ।
ড্রাইভার - বেরাতে এসেছেন?
আগন্তুক - না, আমার এখানে পোষ্টিং হয়েছে তাই।
ড্রাইভার - ও,  ( একটু থেমে) কি করেন বাবু?
আগন্তুক - আমি ব্যাঙ্কে চাকরী করি ।
(বেশ কিছুক্ষন ট্যাক্সিটা চলে, আগন্তুকের চোখে মুখে উদ্ব্বেগের ছাপ। )
--আর কত দূর ?
ড্রাইভার -- এইত সামনে একটা হোটেল আছে ।
 গাড়িটা একটা হোটেলের পের্টিকোর নিচে এসে দাঁড়ায়,
খুব সুনসান জায়গা, আগন্তুক নেমে দাঁড়ালো গাড়ি থেকে, ড্রাইভার ব্যাগ গুলো নিচে নামিয়ে বললো,
--এটা খুব ভাল হোটেল, ঢুকে যান বাবু ।
আগন্তুক - ঘর পাওয়া যাবেত?
ড্রাইভার - হ্যাঁ বাবুযাবে ।
আগন্তুক, ড্রাইভারকে পাঁচশো টাকা বার করে দিয়ে বললো, --হয়েছে ?
ড্রাইভার - এই দুর্যোগের রাতে নিয়ে এলাম কিছু বেশি দিন বাবু ।
আগন্তুক আরো একশো টাকা দিয়ে বললো –
-কি খুশিতো ?
ড্রাইভার মাখনের মত হেসে বললো - হ্যাঁ বাবু ।
বলে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল ড্রাইভার ।
 আগন্তুক কাউকে দেখতে পেলনা হোটেল চত্তরে, নিজেই ট্রলিটা টেনে ভিতরে নিয়ে গেল।
হোটেলের রিসেপসানে একটা লোক চেয়ারে বসে ঘুমাচ্ছেমাঝ বয়সি, হালকা চুল, মোটা ভ্রু, পুরু ঠোঁটথুতনিটা বুকে ঝুলিয়ে নাক ডাকছে।
আগন্তুক - ও দাদা শুনছেনও দাদা।
সারা না পেয়ে টেবিলের উপর খট খট শব্দ করে।
লোকটা ধড়মড় করে উঠে পরে ।
বলে - এ্যাঁ কেকে?  (তারপর চোখ কোচলে), কে আপনি ?

আগন্তুক - আজ্ঞে একটা রুম চাই, পাওয়া যাবে?
লোক- হ যাইবো, কেমন ঘর চাইসাতশো থেইকা শুরু কইর‍্যা ,তিন হাজার  পর্যন্ত আছে ।
আগন্তুক - মোটামুটি পরিষ্কার একটা রুম হলেই হবে।
        লোকটা, আগন্তুকে দিয়ে রেজিস্টার খাতায় সই করিয়ে নেয়, তারপর একটা চাবি দিয়ে বলেন,
-- এই নিন ১১১ নং রুমের চাবিএকটু দাঁড়ান,
(
উচ্চস্বরে কাউকে ডাকে)
--শিবু....... ও শিবুকোনো সারা না পেয়ে, বেল টিপলেন দুবারতিনবার ।
কিছু পরে একটা অল্প বয়সি ছেলে এল প্রায় ঢুলতে ঢুলতেছেলেটা সরু মত, রোগা ঢ্যাঙা, মাথার সব চুল প্রায় নেড়া করে কাটা, শুধু মাথার চাঁদিতে কিছু বাহার করা চুল।
শিবু - ডাকলেন কেন  বলেন ।
লোক- এনার মালপত্র গুলো ১১১ নং ঘরে দিয়ে আয়, আগন্তুক - আচ্ছা দাদা একটু কি কফি পাওয়া যাবে ?
লোক - হ্যাঁ পাওয়া যাবেআর কিছু খাবেন?
আগন্তুক - নাআপাতত এক কাপ কফি দিন একটু কড়া করে, এত রাতে অন্য কিছু খাবার ইচ্ছা নেই।
শিবু ট্রলি আর চাবি নিয়ে সিড়ির দিকে এগিয়ে গেল।
পিছন পিছন আগন্তুক।
 ফার্স্ট ফ্লোর ছেড়ে  সেকেণ্ড ফ্লোরের সিড়িতে ওঠবার সময় দেখলো, ফার্স্ট ফ্লোরটা বেশ অন্ধকার। প্যাসেজের দুই প্রান্তে বেশ ধোঁয়া ধোঁয়া অন্ধকার।
একপ্রান্তের দিকে তাকাতেই চমকে গেল । একটা অল্প বয়সের মেয়ে । শিবুকে কিছু বলার জন্য সামনে তাকিয়ে দেখে, শিবু অনেকটা উঠে গেছে । আবার ঘাড় ঘোরালোমেয়েটাকে আর দেখা গেল না ।
তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে উপরের দিকে এগিয়ে গেল ।
 রুমে পৌঁছে  শিবু লাইট গুলো জ্বেলে দিল, কেবলের তার জুড়ে দিল।
শিবু জিজ্ঞাসা করলো আর কিছু লাগবে স্যার?
আগন্তুক - না, একটা জলের বোতল আর এক কাপ কফি, ব্যাস।
এমন সময় ট্রেনের হুইসেল শোনা গেল।
আগন্তুক - শোনো শিবু, ট্রেনের শব্দ হল, স্টেশন কত দূরে?
শিবু - এইত কাছেই, হাঁটা পথে মিনিট পাঁচেক হবে।
আগন্তুক - রায়পুরগঞ্জ স্টেশন ?
শিবু - হ্যাঁ স্যার ।
আগন্তুক - সেকি!!!  ট্যাক্সি ড্রাইভার তো আমাকে প্রায় আধ ঘন্টা ধরে নিয়ে এল ।
উত্তরে শিবু কিছু বললো নাএকটা রহস্যময় হাসি দিয়ে চলে গেল ।
আগন্তুক একটা সোফায় আধশোয়া হয়ে সিগারেট খাচ্ছে আর ফোন দেখছেএমন সময় খুট করে একটা শব্দ হল, সে শুনলো কিন্তু পাত্তা দিল না।
একটু পরে জোড়ে ফ্ল্যাশ টানার শব্দ হল।  আগন্তুক লাফ দিয়ে উঠলপায়ে চটি গলিয়ে বাথরুমের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো - কেভিতরে কে ?
কোনো সাড়া না পেয়ে দরজা খুলে দিলভিতরটা অন্ধকারদেওয়ালের সুইচ গুলো একটা একটা করে জ্বাললোঅবশেষে  বাথরুমের আলো জ্বললো ।
ভিতরে উঁকি দিয়ে দেখলো কেউ নেই ।
ভয় মুখে আবার এসে শুলো সোফায়।
একটু তন্দ্রা মত এসেছিল, কিন্তু দরজায় টোকা পরতেই ঘুম ভেঙ্গে গেলগিয়ে দরজা খুলে ঘুম জড়ানো গলায় বললো,--কফিটা একটু কড়া করেছো তো?
কোনো উত্তর পেল নাভাল করে চোখ খুলে দেখে কেউ নেইচমকে উঠলো তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে দিল।
একটু পরে আবার দরজায় খটখট করে শব্দ হল।
আগন্তুক - কেকে ওখানে?
 শিবু - আমি স্যার, আপনার কফি,
সশব্দে দরজা খুললো, সামনে শিবুহাতে ট্রের উপর ধুমায়িত কফি আর জলের বোতল।
আগন্তুক - ভিতরে এস। আচ্ছা শিবু, একটু আগে কি তুমি দরজায় নক করেছিলে?
শিবু - কইনাতো, আমি এই এলাম কফি নিয়ে।
আগন্তুক - তাহলে কে নক করলো একটু আগে?
শিবু- তাহলে অন্য কোনো রুমে করেছে। আপনি ভুল শুনেছেন।
আগন্তুক - চিন্তিত মুখে বলে  এত রাতে কে  নক করবে?
নতুন কেউ এল নাকি?
শিবু উত্তর না দিয়ে কফির কাপ আর জলের বোতল টি টেবিলের উপর রেখে বেরিয়ে গেল ।
কফি খেয়ে বিছানায় এসে শুতেই ঘুম জড়িয়ে এল চোখে ।একটা কম বয়সি মেয়ে আগন্তুকের বিছানায় পাশে এসে বসে।  মুখটা ভাল করে দেখাই যায়না, চুলে মুখটা প্রায় ঢাকা
আগন্তুক - কে আপনিকি চান.?

মেয়েটির একটা হাত আগন্তুকের গলার কাছে পৌঁছায় ।
 আগন্তুক চেঁচিয়ে বলে ,- কি চানকে আপনি?
দমকা হাওয়ায় মেয়েটার মুখের চুল গুলো উড়ে গেলআগন্তুক দেখলোএ যেন এক মৃত মানুষের মুখ ।
আগন্তুক ভয়ে চিৎকার করে চেঁচিয়ে ওঠে বাঁচাও, বাঁচাও করে । আগন্তুকের ঘুম ভেঙ্গে গেলদেখলো সে গল গল করে ঘামছে,চারিদিক তাকিয়ে দেখলো,কিন্তু কাউকে দেখতে পেলো নাবুঝলো সে ভয়ংকর স্বপ্ন দেখেছে।
কিন্তু কোথাও একটা ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে আওয়াজ হচ্ছেসে বোতল খুলে জল খেলো।  তারপর শব্দ লক্ষ্য করে ভয়ে ভয়ে বাথরুমের দিকে গিয়ে আলো জ্বাললো। দুম করে দরজাটা খুললো, দেখলো কেউ নেই, স্কাইলাইটের পাল্লাটা দুপাশের আলম্বকে কেন্দ্র করে ওঠা নামা করছেতাতেই এই শব্দ।  পাল্লাটা নামিয়ে দিয়ে এসে বিছানায় বসে ।
ফোনে টাইম দেখে বলে,
- নাহআর ঘুম হবে না একটু পরেই আলো ফুটলে বেরিয়ে যাব।
খাটের উপর রাখা ফোনে রিং হয়, আগন্তুক বাথরুম থেকে বেরিয়ে রিসিভ করে।
আগন্তুক  - হ্যালোকে?
ফোনের ওপাশে - স্যার, আমি অচিন্ত্য,
আগন্তুক - কি ব্যাপার কাল দুপুর থেকে ফোন করছি, ফোন ঢুকছেই না? আপনাকে না পেয়ে আমাকে কাল রাতটা হোটেলেই কাটাতে হল ।
অচিন্ত্য - স্যার যা ওয়েদার, দেখছেনতোসব সারভার ডাউন, একটা বুথ থেকে ফোন করছি। তা আপনি কোথায় আছেন?
আগন্তুক - আমি স্টেশনের কাছে ভবতারিণী হোটেলে আছিআপনি আসছেন কখন?
অচিন্ত্য - আমি আধ ঘণ্টার মধ্যে চলে আসছি স্যার।
আগন্তুক - ওকেআসুন ।
হোটেলের বাইরে দুটো রিক্সা দাঁড়িয়ে।
একটা লোক পায়চারী করছে।  বয়স যে খুব বেশী তা না, কিন্ত বুড়োটে মার্কা দেখতে, মাথায় হালকা টাক,
বেঁটে, আর একটু কোল কুঁজো
আগন্তুক হোটেলের বাইরে এসে সেই ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করলো ,-আপনি অচিন্ত্য বাবু?  
অচিন্ত্য - হ্যাঁ স্যার। আপনি  তয়ন মুখার্জী তো?
তয়ন বলে ,- হ্যাঁ , কিন্তু রিক্সা নিয়ে এসেছেন ,তার মানে আমরা যেখানে যাবো সেটা কাছেই ।

অচিন্ত্য - না স্যার, বেশ খানিকটা দুরেই, রায়পুরগঞ্জের পুরনো বাজার, তার পিছন দিকে।
রিক্সাওয়ালা দুজন দৃষ্টি বিনিময় করলো
একজন রিক্সাওয়ালা - বাবু অতদূর যামু না।
তয়ন - হ্যাঁ ঠিক কথাই, একটা ট্যাক্সি নিয়ে নিন।
অচিন্ত্য - কিন্তু স্যার মফস্বলে সেরকম ট্যাক্সির চল নেইপাওয়া যায় না, খুব দরকার পড়লে লোকে ওলা বা উবের বুক করে নেয় ।
তয়ন - কেনকালতো আমি ট্যাক্সি করে এলাম স্টেশন থেকে, অবশ্য লোকটা চিটিংবাজদুমিনিটের রাস্তা আমাকে আধ ঘন্টা ধরে ঘুরিয়ে ছশো টাকা নিয়ে গেল।
অচিন্ত্য - সেকিএখানেতো সচারচর ট্যাক্সি দেখাই যায়না তার উপরে দুর্যোগের রাতে।  তারপর রিক্সাওয়ালাদের উদ্দেশ্য করে বলে.. –
চলো চলো, আর নখরা দেখিওনা। ডাবল ভাড়া দেব।
দ্বিতীয় রিক্সাওয়ালা প্রথম রিক্সাওয়ালার দিকে চেয়ে বলে চল ননী ।
আগু পিছু দুটো রিক্সা চলতে লাগলো।
প্রথমে অচিন্ত্য, পিছনে তয়ন।
তয়ন উচ্চস্বরে বলে,- অচিন্ত্যবাবু, সামনে সিগারেটের দোকান দেখলে দুপ্যাকেট নিয়ে নিন তো, আমার এই লাগেজ সামলে নামাই মুশকিল।  টাকা নিয়ে নিন আমার থেকে ।
জনবসতি ছাড়িয়ে রেল লাইনের ধার দিয়ে যে রাস্তা গেছে সেখান দিয়ে আগুপিছু চলতে লাগলো দুটো রিক্সা ।
অচিন্ত্য বলে ,-স্যারএখানে আপনি কদ্দিন থাকবেন?
তয়ন বলে ,-অন্য কোত্থাও পোষ্টিং না হওয়া পর্যন্ত ।
অচিন্ত্য - আপনি কিসে আছেন স্যার?
তয়ন - ব্যাঙ্কে সার্ভিস করি, ব্যাঙ্ক ম্যানেজার ।
 অচিন্ত্য - ( রিক্সা থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে, উঁকি দিয়ে চোখ বড় বড় করে )
 বাবা!!!!  ব্যাঙ্ক ম্যানেজার ?
তয়ন - কেন, আপনি জানতেন না?
অচিন্ত্য - না স্যার, আমাকে বিপ্লব বাবু ফোন করে বললেন, উনার এক বন্ধু আসছে কলকাতা থেকেআমি যেন একটা ভাড়া বাড়ি দেখে দিইআমি বললাম ঠিক আছে, তারপর উনি আপনার ফোন নং দিয়ে দিলেন।
তয়ন - আপনি কি করেন অচিন্ত্য বাবু?
 অচিন্ত্য - জমি,বাড়ির দালালি ।
তয়ন - কেমন চলে এই ব্যবসা ?
অচিন্ত্য - হলে ভালই হয়, না হলে নয়.।
তারপর আর কথা এগোয় না ।
প্রথম রিক্সা, দাঁড়িয়ে যায় একটা তেমাথা মোরে।পিছনে আসা দ্বিতীয় রিক্সাটাও দাঁড়িয়ে যায়।
প্রথম রিক্সাওয়ালা বলে,- আর যামু না বাবু, এইহানেই নামেন
অচিন্ত্য - কেন রে, কি হলডাবল ভাড়া দেব বললাম তো।
প্রথম  রিক্সাওয়ালা বলে,- ডবল তো দিবেনি বাবু, এদ্দুর আইলাম, আর যামুনাএইহান থেইক্যা সামান্যই পথ,হাইট্যা যাইতে পারবেন ।
দ্বিতীয় রিক্সাওয়ালা বলে,- হ বাবুআর যামু না।
তয়ন - এখান থেকে ওই বাড়ি কত দূরে?
অচিন্ত্য - এই রাস্তা দিয়ে গিয়ে একটু খানি।
তয়ন - ঠিক আছে চলুন হেঁটেই যাওয়া যাক ।
রিক্সাওয়ালারা ভাড়া বুঝে নিয়ে পড়িমরি করে পালালো ।
একটা একতলা বাড়িনুতন না আবার খুব পুরনোও না, নিচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরাএকটা ছোট্ট গেটকোণায় কোণায় আগাছাবাড়িটার রঙ জ্বলে গেছে ।
ঘরের ভিতরে তালা খুলে অচিন্ত্য বাবু ঢুকলেন, পিছনে তয়ন ঢুকলো । ঘরে যে দরজা দিয়ে ঢোকা হল, তার বা পাশের দিকে একটা বড় ড্রেসিংটেবিলতার আয়নাতে অনেক টিপ লাগানো, লাল ছিল কোন এক সময়, কিন্তু ধুলো জমে কালচে হয়ে গেছে । তার পাশে একটা দেওয়ালে একটা দেওয়াল আলমারিডান দিকে একটা পালঙ্ক তাতে একটা সাদা বেডকভার পাতা, তার ওপাশে একটা কাঠের ছোট্ট টেবিল ।  এ দরজার সোজাসুজি আর একটা দরজা ভিতরে যাবার।। ওই দরজা দিয়ে ঢুকে একটা বারান্দাডান দিকে বাথরুম ও কলঘরবা দিকে তালা দেওয়া একটা বন্ধ ঘর
তয়ন মুখে রুমাল চাপা দিয়ে বলে,-  কি বিশ্রী ভ্যাপ্সা গন্ধ ভিতরে, পরিস্কার করেন নি?
অচিন্ত্য বলে, হ্যা স্যার করেছি, তা দিন চারেক আগে । সব দরজা জানালা তো বন্ধ, আর একটু পুরনো বাড়ি, বুঝতেই তো পারছেন স্যারসব খুলে দিচ্ছি এক্ষুনি গন্ধ কেটে যাবে ।
তয়ন খাটের উপর সাইড ব্যাগ দুটো রেখে সব  ঘুরে ঘুরে সব দেখল । তারপর বললো ,- আচ্ছা অচিন্ত্যবাবু পাশের ঘরটা দেখলাম বন্ধ ওটা তে কেউ থাকে
অচিন্ত্য থতমত খেয়ে বলে,-  কেউনা স্যার, আবোলতাবোল ভাঙ্গাচোরাতে ভর্ত্তি ঘরটা। ওদিকে যাবার দরকার নেইডান দিকে বাথরুম, কলঘর  সব পেয়ে যাচ্ছেন।।
তয়ন বলে তবে এবার কিছু খাওয়ার বন্দোবস্ত করতে হবেঅনেক বেলা হল, কি পাওয়া যায় এদিকেহোটেল টোটেল কিছু আছে নাকি ?

অচিন্ত্য - হ্যা স্যার, বেরিয়ে তিনমাথা মোড় পাবেন তার ডান দিকের রাস্তা ধরে একটু গেলেই পাবেন।
তয়ন -আর একটা কথাআজ না হয় হোটেলে খেয়ে নিলাম, কিন্তু রান্নাবান্না আর ঘরের কাজের জন্য একটা লোক দেখে দিন নাতাহলে খুব উপকার হয়।
অচিন্ত্য  - আমি বেরিয়েই খোঁজ করছি, কাল পরশুর মধ্যে পেয়ে যাবেন।
তয়ন - আর আপনার দক্ষিণা অচিন্ত্যবাবু?
অচিন্ত্য  সব দাঁত বার করে বলে,- সবার থেকে ছ মাসের এডভান্স নিই, কিন্তু আপনি চার মাসের দিলেই হবে।
তয়ন  হেসে বলে,- তা আমার উপর এত দয়া যে আপনার ?
অচিন্ত্য দেঁতো হেসে বলে ,-  আমার চেনা মানুষের বন্ধু আপনি তার উপর ব্যাঙ্কের ম্যানেজারএকটুতো খাতির করতেই হয়।
তয়ন টাকা দিল অচিন্ত্য কে, সে লোভীর মত টাকাটা গুনে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
তয়ন তা দেখে মুচকি হাসলো ।
 সন্ধ্যা হয়ে গেছে অনেক আগেইচারিদিক অন্ধকারঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আসছে একটানাদূর থেকে একটা কুকুরের কান্নার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছেহঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হল ।  তয়ন অঘোরে ঘুমাচ্ছে।  আবার হল শব্দটাবেশ জোড়েই, খট খট করেই।
তয়নের ঘুম ভেঙ্গে গেল, একটু ঘোর কাটতেই জিজ্ঞাসা করলো
-
কেআসছি আসছি ।
তয়ন চশমা পরে, পাঞ্জাবী পড়ে, লাইট জ্বেলে,আয়নার দিকে দেখলোতারপর  দরজা খুললো । দেখে বিবাহিত কুড়ি বছরের কাছাকাছি বয়সের একটা মেয়ে ।
তয়ন জিজ্ঞাসা করে কাকে চায়?
তরুণী নিচু স্বরে বলে,- আপনি কাজের লোক খুঁজছিলেন  বাবু তাই এসেছি ।
তরুণী স্লিম, শ্যামবর্ণা, পিঠের উপর লম্বা একটা বেণি, সুন্দর মুখশ্রীকপালে একটা লাল ভেলভেটের টিপ, দুহাতে সরু সরু লাল পলা ।
তয়ন বলে,- ভিতরে এস। তোমাকে কি অচিন্ত্যবাবু পাঠিয়েছেন? উত্তরের অপেক্ষা না করেই আবার বলে   অচিন্ত্যবাবু বেশ করিৎকর্মা লোক, তা তুমি কিকি কাজ করবে বুঝিয়ে দিয়েছেন তো অচিন্ত্যবাবু ? তরুণী মাথা নেড়ে হ্যা জানালো ।
তয়ন - বাহবেশ, কবে থেকে কাজ শুরু করবে?
তরুণী  - আজ থেকেই বাবু।
তয়ন - তা রান্নাবান্না করতে পারো? অবশ্য মনে হয় এখানে কোনো রান্নাঘর নেই ।  এই ঘরেই একটা ব্যবস্থা করতে হবে।

তরুণী  - হ্যা রান্নাঘর আছে। বারান্দা দিয়ে বেরিয়ে বা দিকের বন্ধ ঘরের পাশেই ।
তয়ন - বাবা!!  তুমি জানলে কি করে ?
তরুণী  - আমি তো এ বাড়িতেই থাকতাম .
তয়ন - মানেএখন কোথায় থাকো, এখানে কার কাছে থাকতে?
তরুণী  - আগে এ বাড়িতে যারা থাকতো  তাদের কাছেই।
তয়ন - এখন কোথায় থাকো?
তরুণী  আঙুল দিয়ে দূরে ইশারা করে বলে,-  ও....ই  দিকে।
তয়ন - তা বেশ, কে কে আছে তোমার বাড়িতে? দাঁড়িয়ে আছ কেন বোসো।
তরুণী চেয়ার টেনে বসে বলে সবাই আছে, স্বামীশ্বশুড়, শাশুড়ি ।
তয়ন - তোমার স্বামী কি করে?
তরুণী  - ও বাবু আজই সব শুনবেন নাকিযাই দেখি রান্নার জোগাড় করি ।
তয়ন - কিন্তু বাজারহাট তো করা নেই। আজ থাক বাইরে খেয়ে নেব, তুমি কাল সকালবেলা চলে এসো।
তরুণী  - সকালবেলা আসতে পারবোনা বাবুএই সন্ধ্যাবেলা এসে সব কাজ করে দেব।
তয়ন অবাক হয়ে বলে,- কেন?
তরুণী - দিনেরবেলা আমার অনেক কাজ থাকে বাড়িতে, তবে আপনার কোনো অসুবিধা হবে নারান্নাবান্না রাতেই সেরে যাব।
তয়ন - ঠিক আছে তবে তাই এসো ।
তরুণী  - আজ কাজ করে দিয়ে যাই বাবু?
তয়ন - কিন্তু আজ ত বাজার করা নেই।
তরুণী  - ঠিক আছে, আমি দেখে নিচ্ছি রান্নাঘরে গিয়ে, আপনাকে কোনো চিন্তা করতে হবে না., চাল ডাল কিছুতো আছেযা হোক করে দিচ্ছি ।
তয়ন - কিন্তু এ বাড়িতে এ সব কে রেখে গেছে?
তরুণী  - আগে যে বাবু ছিল সেই বাবু ।
 তয়ন - ওতার মানে এ বাড়ির কাজ তোমার বাধা ।
তরুণী  - হ্যা বাবু।
তয়ন - ঠিক আছে দেখ তবে ।
 তয়ন ল্যাপটপ খুলে অফিসের কাজ করছে বিছানায় বসে হঠাৎ একটা টানাহ্যাঁচড়ার শব্দ পায়যেন ভারী কিছু কেউ টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে । তয়ন বার কতক বললো - কেকে?
শব্দটা থেমে যায় , টর্চ বার করে বিছানার পাশের জানালায় ফেলে বাইরের কিছু দেখার চেষ্টা  করলোহঠৎ একটা ফোন আসতেই তয়ন চমকে ওঠে।
কাঁপা হাতে ফোনটা রিসিভ করে
তয়ন অস্ফুট শব্দে বলে,-  হ্যালো, ?  কে?
ফোনের ওপ্রান্ত থেকে সেই কাজের মেয়েটির গলা এল - হ্যালো,তয়ন জোর ভয় পেয়ে যায়,
তয়ন চেঁচিয়ে বলে,-  কে?
ওপাশ থেকে - দাদা আমি, যাবার পর থেকে একটাও ফোন করিসনি, আর তোকে ফোনে পাওয়াও যাছে নামা চিন্তা করছেতো।
তয়ন - ও ও তুই? একটু থেমে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে,-
এখানে কাল থেকে খুব ঝড় বৃষ্টি হয়েছে, সারভার ডাউন ছিল, তাছাড়া নতুন জায়গাতোএকটু গুছিয়ে গাছিয়ে নিতে দেরী হল। মা কে চিন্তা করতে না করিস, কাল ফোন করে নেব ।
অপার থেকে - আচ্ছা দাদা, তাহলে রাখছি ।
তয়ন দেখে টেবিলের উপর থালা দিয়ে খাবার চাপা দেওয়া আছে ঘরদোর পরিপাটি, ট্রলি ব্যাগটা একপাশে দাঁড় করানোহঠাৎ কি মনে হতেই লাফ দিয়ে খাট থেকে নামলো, ব্যাগ খুলে দেখলো ফাঁকা ।
কিছুতো নেই ব্যাগে, আতঙ্ক ছেয়ে গেল মুখেকি মনে হতে আলমারি খুললো । দেখে, জামা গুলো হ্যাঙ্গারে ঝোলানো, প্যান্ট গুলো পাট পাট করে রাখা, পাশে টাকার ফোলিও ব্যাগ টা, বুকে ছ্যাত করে ওঠে, খুলে দেখে টাকা ঠিক ঠাক আছে । শান্তি পেল দেখে ।
আলমারি বন্ধ করে টেবিলের দিকে এলখাবারের চাপাটা খুলে দেখে তাতে খিচুড়িবেগুন ভাজা আর ডিম ভাজা।  দেখে অবাক হল, কিন্তু খিদেতে কিছু ভাবার সময় দিল নাভালই লাগলো । কিন্তু সে গেলো কই
তয়ন ডাকলো,- ও মেয়েকোথায় গেলে কোনো উত্তর এল না,আবার বলে,- ও মেয়ে শুনছোতুমি কোথায়কোনো উত্তর নেই, ভিতরের দিকের দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে আবার ডাকলো- ও মেয়ে কই গেলে ?
কিন্তু সাড়া  না পেয়ে ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দিল।
নিজের মনেই বললো, মেয়েটা কি চলে গেলোকিন্তু বলে গেলো নাতো । কিন্তু গেলো কোথা দিয়ে, সামনের দরজা তো বন্ধপিছনে কোনো দরজা  আছে কিকাল দিনের বেলা ভাল করে দেখতে হবে। যাক এখন তো খেয়ে নিই।।
অনেক রাত তখনতয়ন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, ঘুমের মধ্যে কেমন একটা অস্বস্তি হলঘুম ভেঙ্গে গেলঠিক তখনি দেখে হঠাৎ করে জানালা খুলে গেল, একটা সিরসিরে ঠাণ্ডা বাতাস ঘরে ঢুকলো । ঘরে নাইট ল্যাম্পের নীল আলোয় দেখলো কে যেন দাঁড়িয়ে,
তয়ন ভয় পেয়ে চিৎকার করে বলে,- কেকে ওখানে টর্চটা হাতরে নিয়ে আলো ফেললো মুখে, দেখে সেই তরুণী ।
তয়ন বেশ রাগত ভাবে বলে, - একি ,বাড়ি যাওনি ?
তাছাড়া তুমি ছিলে কোথায়ডেকেতো তোমাকে পেলাম নাআর এত রাতে এখানেই বা কি করছো?
তরুণীকে অন্ধকারে  মূর্তিময়ী বিভিষিকা মনে হল, খুব ধীরে সে বললো,-  আমি রান্নাঘরেই ছিলাম।
বলার পর সামনের দরজাটা খুলে আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেল।
তয়ন উঠে দরজা বন্ধ করেভিতরের দরজা বন্ধ করতে গিয়ে মনে পড়লো সে আগেই দরজাটা বন্ধ করেছিলতাহলে মেয়েটা ঢুকলো কেমন করে ?
বাজারের একটা চায়ের দোকান, অনেক বয়স্ক লোক আছে দোকানেতয়ন চা খাছিল আর পেপার উল্টেপাল্টে দেখছিল।
একজন বুড়ো লোক  তয়নকে উদ্দেশ্য করে বলে,- ও মশাই দেখেতো নতুন লোক বলে মনে হছে ।
তয়ন বলে,- হ্যা, ঠিকি ধরেছেনকদিন হল এখানে এসেছি।
বুড়ো লোক - ওতা কার বাড়িতে এসেছেন।
তয়ন - কারোর বাড়ি নাআমি ব্যাঙ্কে চাকরী করি, পোষ্টিং এখানে।
বুড়ো লোক - তা কোন ব্যাঙ্ক?
তয়ন - স্টেট ব্যাঙ্ক।
বুড়ো - তা ভাল, তা ভাল,বিয়ে থা করেছ?
তয়ন - আজ্ঞে না। সে সৌভাগ্য হয়নি এখনো ।
অন্য বুড়ো - তা মশাই আপনার নাম কি?
তয়ন - তয়ন মুখার্জী
বুড়ো - বেশ বেশ, ভাল লাগলো পরিচয় হয়ে আমার ছেলে একটা লোনের জন্য দরখাস্ত করেছে, আপনি যদি একবার ম্যানেজারকে বলে দেন তাহলে খুব ভাল হয় ।
তয়ন - আপনার ছেলের নাম?
বুড়ো - সদু দত্ত ।
তয়ন - আমিই ব্যাঙ্কের ম্যানেজার ।
বুড়ো - বাহ তাহলে তো ভালই হল।
কথা আর এগোলো নাতয়ন উঠে পড়লো, বুড়োদের উদ্দেশ্যে বললোআসছি।
বুড়োরা সমন্বয়ে - আচ্ছা আসুন।
তয়ন চলে গেল।

একজন বুড়ো লোক - কিন্তু কোথায় উঠেছে জানা হল না,
চায়ের দোকানের মালিক - কোথায় আবার, ওই ভুতুড়ে বাড়িতে ।
বুড়ো লোক - আগে বলবি তোতাহলে না করে দিতাম ওখানে থাকতে ।
রাতের খাবার সেরে তয়ন ল্যাপটপে বসেছে।  অনেকক্ষণ কাজ করার পর দেখলো বারোটা বেজে গেছে।  ল্যাপটপ বন্ধ করে শোয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেএমন সময় ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ পেল ।  সে কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করলো,কোথা থেকে শব্দটা আসছে তারপর ধস্তাধস্তির আওয়াজ পেতে বুঝলো পাশের ঘর থেকে শব্দটা আসছেসে ভিতর দিকের দরজাটা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে এল ।
 তয়ন -- কেকে ওখানে ?
সঙ্গে সঙ্গে শব্দটা থেমে গেলো তয়ন পাশের ঘরের দরজায় টোকা দিল,
তয়ন - কে এ ঘরে?
 কোনো সারা শব্দ পেলো নাটর্চ মেরে দেখলো তালা বন্ধ ঘরটায়হঠাৎ মনে হল কে যেন দাঁড়িয়ে আছে অন্ধকারে । তয়ন চমকে ওঠে ।
তয়ন চেঁচিয়ে বলে,-  কে ওখানে
মেয়েলী গলায় উত্তর - আমি ।
তয়ন - কে আমি?
তরুণী - আমি কাজের মেয়ে বাবু ।
তয়ন - ওতুমিএত রাতে এখানে কি করছো ?বাড়ি যাওনি ?
তরুণী - এইতো যাব বাবু ।
তয়ন - এত রাতে তুমি যাবে কি করেআর ছিলেইবা কোথায়।?
তরুণী  - রান্নাঘরে বাবু ।
তয়ন - আছা বলতে পারো কান্নার শব্দ আর ধস্তাধস্তির শব্দ কোথা থেকে এলো ?
তরুণী  - কইআমিতো কিছুই শুনিনি বাবু ।
তয়ন - ওতুমি শোনোনিতাহলে কি আমার শোনার ভুল।?
পরের দিন তয়ন বাজারে এসে বাজার করছেআর একটা বুড়ো লোক এল। বললো,-নমস্কারকেমন আছেন ?
তয়ন - ভাল আছি, আপনি কেমন আছেন?
বুড়োলোক - আমার এ বয়সে থাকা আর না থাকা দুই সমাননানানরকম রোগ আষ্টেপৃষ্ঠে বেধে রেখেছে বাবা । আনার কথা থাক, তা বাবা তুমি ও বাড়িতে কি করে আছো ?
তয়ন - কেন, সবাই যেমন করে থাকে ।
বুড়োলোক - আরে নাসে কথা বলিনি ওই বাড়িটা একটু গণ্ডগোলেরতা কোনো ভয়টয় পাওনিতো ? বা অস্বাভাবিক কিছু দেখনি ?
তয়ন - নাসেরকম ভয়টয় পাইনি তবে অস্বস্তিকর পরিবেশ, কেমন যেন রহস্যময়
বূড়োলোক। - কতদিন হল আছ ওই বাড়ি ?
তয়ন - দিন সাতেকতো হবেই।
বুড়োলোক - সর্বনাশ,!!  কি করে আছপাল্টে ফেলো বাড়ি, অন্যত্র ব্যবস্থা কর।
তয়ন - হুমদেখছিআজ চলি, অফিসের দেরী হয়ে যাবে ।
গভীর রাত, তয়ন ঘুমিয়ে আছেহঠাৎ বুকফাটা চিৎকারে তয়নের ঘুম ভেঙ্গে যায় ।
 বিছানায় শুয়ে শুয়ে হাতরে চশমা পেয়ে পড়ে নেয়। তারপর টর্চটা হাতে নিয়ে চুপ করে শুয়ে থাকে ।  কিছুক্ষণ পর আবার সেই কান্নার আওয়াজ তয়ন এবার উঠে শব্দ লক্ষ্য করে এগোয় ভিতরের দরজা খুলে বারান্দায় আসে ওই বন্ধ ঘরের সামনে যায় । তখন ঘরের মধ্যে রীতিমত ধস্তাধস্তির শব্দ শুনতে পায় । টর্চের আলো ফেলে দেখে তালা বন্ধভয়ে আতঙ্কে কি করবে ভেবে উঠতে পারেনা ।  সেই বূড়োর কথাটা মনে পরে যায় । তাড়াতাড়ি সেখান থেকে আসতে গিয়ে দেখে সেখানে অন্ধকারে, কে একটা দাঁড়িয়ে । তয়ন খুব ভয় পেয়ে গেল,মুখ দিয়ে গোঙানির মত আওয়াজ বের হল, ভয়ে ভয়ে  টর্চ মেরে দেখে সেই তরুণী ।
তয়ন - শিগগির ঘরে চলএক মিনিটও দাঁড়িও না ।
তরুণী ঘরে এলো তয়নের সাথে ।
তরুণী - কিছু কথা আছে বাবু আপনার সাথে ।
তয়ন - এত রাতে কি কথাতাছাড়া এখনো তুমি বাড়ি যাওনি ?
তরুণী  - আছে কিছু কথাবলেই বাড়ি যাব ।
তয়ন - এত রাতেকাল সকালে এসো সব শুনবো ।
তরুণী  - কিন্তুআমিতো সকালে আসতে পারবো না।
তয়ন - ঠিক আছে সন্ধ্যায় এসো,সব শুনবো, তোমাকে একটু কি এগিয়ে দেব?
তরুণী  - না বাবু, আমি যেতে পারবো, আমার চেনা যায়গা  সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছেতয়ন সিগারেটের প্যাকেট গুলো থাক থাক করে ড্রেসিংটেবিলের উপর সাজিয়ে রাখছে । আয়নায় চোখ গেল, অনেক টিপ লাগানো আছেটিপ গুলো কোনো একসময় লাল ছিল, কিন্তু ধুলো পরে পরে কালচে হয়ে গেছে । তারপর তয়ন সিগারেট খেতে খেতে পায়চারী করতে লাগলোসিগারেট শেষ হতেই, সেই সিগারেট থেকে আর একটা সিগারেট ধরালো ।
এমন সময় ওই তরুণী  বিছানার কাছে এসে দাঁড়ালো    আয়নার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে দেখে মেয়েটি বিছানায় বসে অথচ মেয়েটাকে আয়না দিয়ে দেখা যায়নি সেটা তয়ন লক্ষ্য করে না ।
তয়ন - কখন এলে ?
তরুণী - এই মাত্র আপনার সাথে কিছু কথা বলার ছিল ।
তয়ন - হ্যা, কালতো বলেছিলে । বলো কি বলবে ?
তার আগে বলতোওই ঘরে কারা থাকেকে কাঁদে রাতের বেলা কারা মারামারি করে?
তরুণী  - বাবু এই বাড়িটা গোপীনাথ শিকদারের । সে বাংলাদেশ বর্ডারে চোরাচালানের কারবার করে ভাল টাকা কামায় । ভালই চলছিল ব্যাবসা ।  তার একটা মাত্র ছেলে    গোপীনাথ তখন এই বাড়িটা তৈরি করে। ছেলের বিয়ে দেবে বলে । কিন্তু হঠাৎ একদিন  বি.এস.এফ এর হাতে ধরা পরে  জেল হয়জেল থেকে বছর খানেক পর ফিরে এসে আর ব্যবসা চালাতে পারেনি, দলে  নতুন নতুন ছেলে এসেছে, তারা কেউ পাত্তাই দিতনা গোপীনাথকে । পুঁজিও কম ছিলআলাদা করে কিছু করার ক্ষমতাও ছিলনা । তখন সে অনেক দেনাপাওনা নিয়ে ছেলের বিয়ে দিয়েছিল  ছেলেটা একটা আটার মিলে কাজ করতো , কিন্তু বিয়ের সম্বন্ধ করার সময় বলেছিল যে ছেলের বড় ব্যবসা আছে । কিন্তু বিয়ের পর মেয়েটা সব জানতে পারে । তখন কিছু করার  থাকেনা ।
কিন্তু সেখানেও গোপীনাথের ছেলে বেশিদিন কাজ করতে পারেনাচুরির দায়ে চাকরীটা যায়  তখন গোপীনাথগোপীনাথের বৌ আর ছেলে মিলে, ছেলের বৌকে বললো বাবার কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা আনতেছেলে ব্যবসা করবে ।  কিন্তু মেয়ের বাবা গরীবঅনেক কষ্টে টাকা জোগাড় করে তবে মেয়ের বিয়ে দিয়েছে    এখন সে এত টাকা কোথা থেকে জোগাড় করবে । মেয়েটি বললো তার বাবা এত টাকা  দিতে পারবে না । তখন শুরু হল মেয়েটির উপর অত্যাচার।  একবার স্বামীএকবার শশুর, একবার  তার শাশুড়ি। যে যখন পায় মারে ।
একদিন মেয়েটা অত্যাচার সহ্য করতে নাপেরে, শাশুড়িকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়।  তখন রাগে অন্ধ হয়ে মেয়েটির স্বামী আর শাশুড়ি গলায় ফাঁস দিয়ে মেয়েটাকে মেরে ফ্যালে।  তারপর পাশের ঘরের মেঝেতে গর্ত্ত করে মেয়েটার লাশ পুতে সিমেন্ট করে দেয়। তারপর থেকে মেয়েটার অতৃপ্ত আত্মা রোজ রাতে কাঁদে ।
তয়ন - মেয়েটির স্বামীর নাম কি?
তরুণী  - অচিন্ত্য শিকদার।
তয়ন - মানেযে অচিন্ত্য বাবু আমাকে এখানে  নিয়ে আসে?
তরুণী - হ্যা,
তয়ন - শশুর তো গোপীনাথ শিকদার, সে বেঁচে আছে?
তরুণী - হ্যা সে ট্যাক্সি চালায় ।
তয়ন - এই রায়পুরগঞ্জে ?
তরুণী - হ্যা বাবু।
তয়ন -কেমন দেখতে?
তরুণী - মাঝারী হাইট, কালো, স্বাস্থ্যবান, এক মুখ দাঁড়ি গোফ।
তয়ন - ও আচ্ছা আচ্ছাআসার দিন ওর ট্যাক্সি করেই এলাম, দু মিনিটের পথ আমাকে আধ ঘণ্টা ধরে ঘুরিয়ে আমার থেকে ছশো টাকা নিয়েছে ।
আর স্বামী সে কি করে?
তরুণী -সে নানা রকম দুনম্বরী কাজ করে, তারপর এই বাড়ি ভাড়া দিয়ে ৬ মাসের এডভান্স নিয়ে ভাড়াটে রাখে, দুদিন না যেতেই সব ভাড়াটে পালায়, সে পুরো টাকাটা আত্মসাৎ করে।  মাসে ২-৩ জন ভাড়াটে আসে ।
তয়ন - মেয়েটাকে যে মেরেছে তাতে সেই শশুর শাশুড়ি বা স্বামীর কোনো শাস্তি হয়নি?
তরুণী - মেয়ের বাবা থানায়  মেয়ের মিসিং ডায়েরী করেছিল, পুলিশ ধরেও নিয়ে গিয়েছিলকিন্তু ওরা বলেছে মেয়েটা কুলোটাপরপুরুষের হাত ধরে পালিয়েছে। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও মেয়ের কোনো হদিশ পায়নি পুলিশ ।  অবশেষে শ্বশুরবাড়ির লোক বেকসুর খালাশ পেয়ে যায় ।  পুলিশও ফাইল বন্ধ করে দেয় ।
 তয়ন - সবতো শুনলাম, কিন্তু সেই মেয়েটির শাশুড়ির কথাতো কিছু বললে না ।
তরুণী - সে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত ।  হয়তো বেশিদিন বাঁচবে না ।
তয়ন - সবতো বুঝলাম, কিন্তু আমাকে এ সব কথা শোনালে কেন ?
তরুণী - আমি চাই ওদের শাস্তি হোক ।
তয়ন - কিন্তু আমাকেই বা কেন শোনালেএর আগেওতো অনেকেই এসেছে, তাদের বলনি কেন ?
তরুণী - চেষ্টা করেছিলাম বাবু, কিন্তু তারা ভয়েই পালিয়ে গেছে ।
তয়ন - ঠিক আছে আমি আবার ফাইল ওপেন করবো, এত অন্যায় করে এরা সমাজের বুকে দাপিয়ে বেড়াবে এটা অসহ্য । কালই যাব থানায়।
তরুণী - আর একটা অনুরোধ ছিল বাবু ।
তয়ন - বলো ।
তরুণী - আমি চাই মেয়েটার আত্মার শান্তি হোক।
তয়ন - কিভাবে ?
তরুণী - ওর নামে গয়ায় গিয়ে যদি পিণ্ড দান করেন,তবে তার আত্মার শান্তি হবে।
তয়ন - ঠিক আছে, এদিকের একটা ব্যবস্থা করে নিই, আগে ফাইল ওপেন করি, তারপর গয়ায় গিয়ে  পিণ্ডদান করে আসবো ।
তরুণী - অনেক ধন্যবাদ বাবু। আপনি খুব ভালোমানুষ।
তয়ন - নানা এতে ধন্যবাদের কিছু নেই, এটা একটা সামাজিক কর্তব্য ।  কিন্তু মেয়েটার নাম কি।
তরুণী একটু থেমে বলে,-  বল্লরী মণ্ডল ।
 বন্ধ ঘরের তালা ভাঙা হয়েছেকিছু পুলিশের লোক কিছু স্থানীয় জনমজুর, কিছু কৌতুহলি লোকজন গিজ গিজ করেছে সেই বাড়িটায় ।
ঘরের মেঝে খুঁড়ে একটা কঙ্কাল পাওয়া গেল ।
থানার ওসি - তালুকদার বাবু, এখনি এই নরকঙ্কাল ফরেনসিক ল্যাবে পাঠান।  সব তথ্যাদি পেয়ে যাব, ভিকটিম বডিটা কার, কতদিন আগে মারা হয়েছে,গোপীনাথতার স্ত্রী আর অচিন্ত্য কে এরেস্ট  করুন যত শীঘ্র সম্ভব ।
 তালুকদার - ইয়েস স্যারআমি এখনি সব বন্দোবস্ত করছি ।
 গয়ার গঙ্গার ঘাট, পুরোহিত সহযোগে বল্লরীর নামে পিণ্ডদান করলো  তয়ন।  পরনে ধুতি ও উত্তরীয় ।
তয়ন খাটে বসে আছে ।  সামনে ল্যাপটপ খোলা, কিন্তু কিছুই করছে না।  খুব অন্যমনস্কওই তরুণীর কথা মনে পড়ছে ।  একবার বাইরের দরজা খুলে বাইরের দিকে দেখে ।
তয়ন - আজ এখনোও এল না,   এত দেরী করছে কেন কে জানে ।
আবার এসে খাটে বসে, বেশ রাত হল ।
এবার দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ হলদরজা খুলে দেখে সেই তরুণী ।
তয়ন - আজ এত দেরী হল যে ?
তরুণী একটু থেমে বলে,- আমি আর আসতে পারবো না বাবু ।
তয়নের ব্যাথায়  মুখটা ছেয়ে গেল, বললো,-  কেনআসবে না কেন আমিতো আসতে না করিনি, তবে কেন আসবে নাআমার রান্না আমার কাজ কে করে দেবে গলা বুজে এল তয়নের কষ্টে
তরুণী - আমার কাজ শেষ বাবু ।
তয়ন তরুণীর খুব কাছে এসে, গলার স্বরে অপত্য প্রেম নিয়ে বলে,- আমিতো তোমায় ছুটি দিয়নিতাহলে কেন চলে যাবে আমাকে ছেড়েকোথাও যেতে দেবনা আমি তোমাকে, তুমি আমার কাছেই থাকবে সারাজীবন ।
তরুণী - একটা কথা বলার ছিল ।
তয়ন - বলো, তোমার সব কথা শুনবো ।
তরুণী  - আমি সেই বল্লরী বাবু ।
তয়ন স্তম্ভিত হয়ে গেল, উদ্বেগ নিয়ে বলে,-কি বলছো এসব তুমি?
তরুণী - হ্যা বাবু, আমি মুক্তি পেয়ে গেছি ।
তয়ন - সত্যিই তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে ?
তরুণী চোখ ছল ছল করে বলে  হ্যা বাবু, আমাকে ভাল মনে বিদায় দিন।
তয়ন অনেক কষ্টে বলে,-  এসো বল্লরীযেখানেই থাকো তোমার আত্মার শান্তি হোক।।
বল্লরী আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল ।
সকালবেলাসেই চায়ের দোকান,তয়ন আর সব বুড়োলোক গুলো বসে আছে
একজন বুড়োলোক - তুমি একটা কাজের কাজ করেছ বাবাতিন জন অপরাধী অপরাধ করে কেমন সবার নাকের ডগার উপর দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, কি কাণ্ড ।
অন্যজন - হ্যা, সেইতোএবার বুঝুক কত ধানে কত চালহুহু বাবা, ভেবেছে পার পেয়ে যাবে । পুলিশে মেরে হাত পা ভেঙে দিক ।
আর একজন - আমরা এতদিন আছি কিছুই জানতে পারিনি, তুমি কি করে জানলে বাবা?
তয়ন - ওই বাড়িতে থাকতে থাকতেই সব জেনে গেলাম আরকি( প্রথম বূড়োলোক কে উদ্দেশ্য করে)
আপনার ছেলের কি যেন নাম?
১ম জন - সদু, সদু দত্ত
তয়ন - আজই আমি ওর লোনের ব্যাপারটা দেখবো
১ম জন - অনেক ধন্যবাদ বাবা।
তয়ন - নানা এতে ধন্যবাদের কিছু নেই, মানুষ হয়ে মানুষের জন্য কিছু করবো, এটাই তো মানব ধর্ম।।
২য় জন - সে ধর্ম কজন পালোন করেবলতে পারো বাবা?
তয়ন - কেউ কেউ তো করে, না হলে পৃথিবী কবেই মরুভূমি হয়ে যেত।
আচ্ছা আজ আসি, অফিস যাব ।
সমন্বয়ে সবাই - এসো বাবা।
তয়ন কিছুটা এগিয়ে গিয়ে আবার ফিরে এসে বললো,- আমাকে একটা কাজের লোক দেখে দিতে পারেন? পুরুষ  কাজের লোক, যে সব কিছু পারবে ।
 একজন বুড়োলোক - আমি আজকালের মধ্যেই দেখছি বাবা ।
তয়ন এগিয়ে গেল নিজের গন্তব্যে, বল্লরীর ছবিটা চোখে ভাসিয়ে ।
                         

No comments:

Post a Comment