গল্প –
সীতাহরণ পালা
সুকন্যা মল্লিক
মহালয়ার ঠিক দুদিন আগে টুকাই এর ছোট মামা নাটক মঞ্চস্থ করার প্রস্তাবটা দিল
।সবাই তখন ঠাকুরদালানে বসে জলযোগে ব্যস্ত । ছোটোমামার কথা শুনে সবার বিষম খাওয়ার
উপক্রম ।বড়মামার ছেলে ভুটু আর মেয়ে টুসি, দুজনেই
চমকে গেল । মেজমামার এক ছেলে অপুর চোখ দুটো বড় হয়ে গেল । সেজোমামার দুই যমজ মেয়ে
রুনু-ঝুনু তো হেসেই কুটোপাটি । শুধু সেজোমামার ছেলে পচা খেতে ব্যস্ত । এদিকে রুনু-
ঝুনুর হাসি দেখে ছোটু মানে ছোটোমামা কটমট করে ওদের দিল । ওরা ভয়ে চুপ করে গেল ।
এবার বাকিদের দিকে তাকিয়ে বলল " কোনো টেনশন করিস না তোরা । সব ব্যবস্থাই আমি
করব । তোরা শুধু আমার কথা শুনে কাজ করবি ।" এরপরে কারোর আর কিছুই বলার নেই ।
দুদিনের মধ্যেই ছোটু সত্যিই সব ব্যবস্থা করে ফেলল । তারপর সবাইকে চরিত্র বুঝিয়ে
দিয়ে নাটকের রিহার্সাল শুরু করে দিল । সংলাপ ও নিজেই লিখেছে । নিজে হবে রামচন্দ্র,
টুসি হবে সীতা, অপু লক্ষণ, ভুটু রাবণ আর পচাকে গড়ুর পাখির চরিত্র দিয়েছে । এ ব্যাপারে পচা প্রথমে
প্রবল আপত্তি জানায়, কিন্তু নাটক থেকে বের করে দেবার ভয়
দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত ওকে রাজি করানো হয়েছে । ছোটু টুকাইকেও অভিনয় করার কথা বলেছিল ।
কিন্ত ও রাজি হয়নি । বাকি কচিকাঁচাদের বানর সাজানো হবে । রুনু- ঝুনুও নাটকে যোগ
দিতে চেয়েছিল, কিন্ত ওদের খিলখিলে হাসির কথা মনে পড়তেই ছোটু
ওদের নাকোচ করে দিল । তাই ওরা মুখ গোমড়া করে বসে রইল । নাটকের কথা শুনে বাড়ির
সবাই খুব খুশি । মামারা তাদের সাধ্যমত সাহায্য করল । কদিন পুরোদমে খেটে দাঁড়
করানো হল ' সীতাহরণ পালা ' ।
সপ্তমীর সন্ধে, ঠাকুর দেখার থেকেও নাটক
দেখার জন্য ভীড় যেন উপচে পড়ছে । গ্রামের সবাই এসেছে নাটক দেখতে । বাড়ির লোকজন আর
কিছু বিশেষ মানুষদের জন্য চেয়ারের ব্যবস্থা হয়েছে ।বাকিরা মাটিতে ।যথাসময়ে শুরু হল
নাটক । প্রথম দৃশ্য, রামচন্দ্র পিতৃ সত্য পালনের জন্য ভাই লক্ষণ
ও বৌ সীতাকে নিয়ে বনে এসে বাস করছে । ছোটো ভাইয়ের এলেম দেখে বড়মামার বুক গর্বে
ফুলে উঠছে । পরের দৃশ্য, সোনার হরিণ আনার জন্য রামচন্দ্রের
প্রস্থান । মিনিটখানেক পরেই পর্দার আড়াল থেকে চিৎকার শোনা গেল " বাঁচাও,
বাঁচাও! " রামের করুণ আবেদন শুনে লক্ষণ সীতার চারপাশে রেখা
টেনে দিয়ে সাবধান করে চলে গেল দাদাকে বাঁচাতে । এরপর রাবণের প্রবেশ ভিক্ষুকের বেশে
। ভিক্ষা নেওয়ার নামে সীতাকে তুলে নিয়ে যাবার কথা । সেইমতো রাবণ হেঁচকা টান দিতেই
সীতা টাল সামলাতে না পেরে রাবণের ঘাড়ে গিয়ে পড়ল । রাবণ বা ভুটু তৈরি ছিল না বলে
দুজনেই মঞ্চ থেকে প্রপাত ধরণীতলে । " ও মাগো " বলে সীতা ককিয়ে উঠল ।
তারপর কোনরকমে উঠে দাঁড়িয়ে ভাইয়ের গালে এক চড় কষিয়ে বলল " অত জোরে টানলি কেন
রে?? " চড় খেয়ে রাবণ মানে ভুটুর মাথায় রাগ উঠে গেল ।
" তুই আমায় মারলি?? " বলে টুসির চুল ধরে ঝাঁকিয়ে
দিল । ব্যাস শুরু হয়ে গেল খণ্ডযুদ্ধ । রাবণের গোঁফ- দাড়ি সীতার হাতে আর সীতার চুল
রাবণের হাতে । এই নতুন নাটক দেখে দর্শকরা তো হেসেই খুন । বাকিরা হতভম্ব । ঠিক সময়ে
টুকাই আর ছোটু ছুটে এসে ঝামেলা সামাল দিল । আবার শুরু হল নাটক । এবার গড়ুর পাখির
রাবণকে বাধা দেওয়ার দৃশ্য । মোটামুটি ভালই হল । শুধু টানাটানিতে পচার টিকালো
নাকটা খুলে গিয়েছিল । কিন্ত পচা সময়মতো ওটা লাগিয়ে নিয়ে সামাল দিয়েছে ।
এবার শেষ দৃশ্য রামের শোকের প্রকাশ । থেকে থেকেই সীতার শোকে ডুকরে কেঁদে উঠছে
। আর ভাই লক্ষণ সান্তনা দেবার চেষ্টা করছে । ঠিক তখনই ছোটুর পিঠটা একটু কুটকুট করে
উঠল । কিন্ত কোনরকমে দাঁত চেপে সহ্য করে নিল । কিন্ত পরমুহুর্তেই মাথাটা চুলকে উঠল
। একটা আঙুল দিয়ে কায়দা করে চুলকে নিতেই গোটা শরীরে চুলকানি অনুভব করল । আর সম্ভব
নয়, বাধ্য হয়ে চারিদিক চুলকাতে লাগল আর গোটা
মঞ্চ জুড়ে লাফালাফি করতে লাগল । দুঃখের সময় রামচন্দ্রকে এভাবে অঙ্গভঙগী করতে দেখে
চারপাশে হাসির রোল উঠল । পাশাপাশি লক্ষণের ও একই সমস্যা দেখা দিল । চুলকানির চোটে
দুজনেই মঞ্চের মধ্যে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিয়েছে। ওদের অবস্থা দেখে টুকাই তাড়াতাড়ি
পর্দা ফেলে দিতে গেল, কিন্তু কপাল খারাপ, পর্দার কাপড়টা কোথাও আটকে যাওয়ার জন্য পড়ল না । ততক্ষণে একটা- দুটো পচা
ডিম ও টমেটোর আগমন ঘটতে শুরু করে দিয়েছে । একটা তো সোজা ছোটুর কপালে এসে ফাটল ।
ওদিকে সেজোমামা চিৎকার করছে " ওরে হতভাগারা পরদাটা ফেল না রে ।" কিন্ত
তা হবার উপায় নেই । বাধ্য হয়ে রাবণ ই ছুটে এল শত্রুদের বাঁচাতে । দুজনকেই চাগিযে
সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল । ওদের অবশ্য সেদিকে খেয়াল নেই । ওরা তখন মনের সুখে গা চুলকে
চলেছে । দর্শকদের মধ্যে তুমুল চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেছে । বিভিন্ন বাঁকাচোরা
মন্তব্য ভেসে আসছে যেগুলো তীরের ফলার মত মামাদের বুকে বিঁধছে । বন্ধ হয়ে গেল '
সীতাহরণ পালা ।
পরের দিন সবাই হলঘরে উপস্থিত । ছোটু আর ওর সাঙ্গপাঙ্গরা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে
। হঠাৎ বড়মামা চিৎকার করে উঠল ' হতভাগা মর্কট ছেলে,
এই তোমার নাটকের ছিরি!!! শুধু লোক হাসানো আর বংশের নাম ডোবানো!!!
গোটা গ্রামের মানুষ আমাদের নিয়ে হাসাহাসি করছে । লজ্জায় মুখ দেখানোর উপায় নেই
আর!!! " ছোটু কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু ধমক খেয়ে চুপ করে গেল । " এই
তুমুল অপরাধের শাস্তি হল পুজোর বাকি দিনগুলো তোরা চিলেকোঠার ঘরে বন্ধ হয়ে কাটাবি ।
তোদের সবার নতুন জামাকাপড় কেড়ে নেওয়া হবে । খাওয়া দাওয়াও বনধ । আর পরের বছর থেকে
কোনও নাটক নয়, শুধুই গান আর কবিতা!! ' কথাগুলো
বলে বড়মামা গটগট করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল । মেজমামা আবার যাবার সময় ছোটুর কান দুটো
বেশ করে মুলে দিয়ে বলল " এবছর যদি পাশ করতে না পারিস তো তোর মাথা কামিয়ে ঘোল
ঢেলে বাড়ি থেকে বের করে দেব । "
সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর রুনু- ঝুনু ভাল মানুষের মত মুখ করে বলল "
কী দরকার ছিল ছোটকা, এইসব ফালতু কাজ করে লোক
হাসানোর????" দুজনের এই গা জ্বালানো কথা শুনেই ছোটু
" তবে রে " বলে দুজনকেই মারবে বলে ছুটে আসতেই ওরা খিলখিল করে হাসতে
হাসতে দৌড়ে পালাল । ছোটু বেজার মুখ করে বলল " পুজোটাই মাটি হয়ে গেল
রে!!!" এবার বাকিরা বেশ করে ঝাড় দিল ছোটু কে " তোমার জন্যই আমাদের এই
অবস্থা । তোমার কথায় নাটক করতে গিয়ে সব বন্ধ হয়ে গেল ।" সবার রণমূর্তি দেখে
ছোটু ভয়ে চুপ করে বসে পড়ল ।
কিন্ত একটা কথা কেউ জানতেই পারল না যে নাটকে না নেওয়ার প্রতিশোধ নিতে রুনু-
ঝুনুই ছোটু আর অপুর জামাকাপড়ে চুলকানির পাউডার লাগিয়ে রেখেছিল যাতে ছোটুর তৈরি
নাটক একেবারে পণ্ড হয়ে যায় । আর সেটাই হয়েছে । পুজোর সময় এরকম একটা মজা করতে পেরে
ওরা দুজনেই খুব খুশি ।।
-----------------------------------------
রামরাজাতলা, হাওড়া
ভালো
ReplyDeleteভালো..
ReplyDelete