স্মৃতিচারণা
হাসি: জীবনের পাসওয়ার্ড
রাণা চ্যাটার্জী
মানুষের জীবনটাই কান্না
হাসির লুকোচুরি খেলার মতো। জীবনে প্রতিবন্ধকতা
যেমন আছে ,তেমনি সেই সঙ্গে নানা হাসির উপকরণ সম্মৃদ্ধ ঘটনাও ,যা আদতে আমাদের ব্যস্ততার
জীবন কে সরল ভাবে চলমান রাখতে এনার্জি দেয় ।প্রত্যেকের জীবনে, কিছু হাসির কোলাজ সারাজীবন
রেশ রেখে যায়,তেমনই কিছু নমুনা মনে করে তুলে আনার চেষ্টায় রইলাম ।
তখন ক্লাস টুয়ে উঠেছি সবে
,দাদা পড়ে অন্য স্কুলে। ছোট থেকে খুব দুস্টু বুদ্ধি খেলতো মাথায়।বন্ধুদেরকে আর বাড়িতে
দাদা বা দিদিকে সুযোগ পেলেই রাগানোর চেষ্টা
করতাম,আর সফল হলে এর আনন্দটাই আলাদা। শৈশবের সেই ঝগড়া ,খুনসুটির দিন গুলিতে রাগানোর
মধ্যে একটা অন্য স্বাদ,মজার মোড়ক ছিল।দাদাও একটুতেই রেগে কাঁই কাঁই করে জ্বলে উঠতো
বলেই হয়তো এর স্বাদ দ্বিগুণ হতো।
একদিন স্কুল থেকে ফেরার
পথে রাস্তায় দুটি প্লাস্টিকের পাতা কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। দেখে বোঝাই যাচ্ছিল ফুলদানির
ফুলের স্টিক ছিল একসময় ওটা। ফুল টা ছিড়ে এখন দুটি পাতা অব্যবহৃত হয়ে রাস্তায় এসে পড়েছে। বাড়িতে এসেই দাদাকে ওটা দেখিয়ে বলেছিলাম
,"জানিস ওই যে "দুটি পাতা" সিনেনাটা হলে চলছে (তখন ওই সিনেমা টা চলছিল
রমরমিয়ে)ওটা আমাদের ক্লাস থেকে স্যর দেখাতে নিয়ে যাবেন। যেহেতু আমরা ছোট,কাগজের টিকিট
যদি ছিঁড়ে ফেলি তাই , প্লাস্টিকের দুটো করে পাতা দিয়ে বলেছে ওটাই টিকিট,কাল দেখালে
তবেই হলে ঢুকতে দেবে। "
কথাটা শুনেই তো দাদা ছুটলো
রান্নাঘরে "ও মা, দেখো রাণা, বড়দের সিনেমা দেখতে যাবে বলছে!" আমি ততক্ষনে,
ওর কান্ড কারখানায় দেখে কলতলায় হাত পা ধুতে ধুতে হেসেই অস্থির।
এখন না হয় মানুষ অনেক
সচেতন হয়েছে ,রাস্তায় কিছু দেখলেও কুড়িয়ে
নেয় না।কিন্তু যদি সেটা হয় টাকা বা মানিব্যাগ ,হলফ করে বলতে পারি ,কেউ দেখেনি তো এই
বলে টুক করে কেউ না কেউ তুলবেই। আমাদের বাড়িটা ছিলএক সরু গলির মধ্যে, যেটা মেন রোড
যাওয়ার শর্টকাট রাস্তা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। প্রতিদিন দেখতাম ঠিক আটটা কুড়ি বাজলেই
, এক মধ্যবয়সী উকিল মানুষ হন্তদন্ত হয়ে বাস ধরতে যেতেন।যেভাবে উনি দৌড়ে যেতেন, বোঝাই
যেত একটু দেরি হওয়া মানে ওনার বাস ফেল ।
একদিন হলো কি বাবার একটা
বাতিল মানিব্যাগ পেলাম। আপাত দেখতে ভাল কিন্তু ভেতরটা ছিল পর্দাফাই,এক্কে বারে ছেঁড়া।
সেটাকে একটু নারকেল তেল দিয়ে ঘষে, চক চক করে নিলাম।ভেতরে একটা কাগজের টুকরো রেখে
,তাতে লিখে দিলাম, "আপনি ভাগ্যবান ,তাই মানি ব্যাগ টা কুড়িয়ে পেয়েছেন , ফেরার
সময় একশত টাকা ভরে যেখানে পেয়েছেন ফেলে যাবেন ,আপনার দিন শুভ হোক "। এই ভাবে
রেডি করে ব্যাগটা আমাদের সদর দরজায় ফেলে রাখলাম আর কি হয় কি হয় দেখার জন্য আড়ালে
অপেক্ষা।
যেমন ভাবনা তেমন কাজ, উনি
ঠিক পেরুনোর মাঝে মানিব্যাগটা দেখি থমকে দাঁড়ালেন ,কেউ দেখছে না তো এটা ভেবে ,চুপিচুপি পকেটে চালান করে দিলেন। ততক্ষনে আমি নিচে নেমে এসেছি
ওনার পিছু পিছু কি করেন কৌতূহলে।গলির মুখে গিয়ে দেখলাম উনি চট করে ব্যাগটা বার করে
ঘেঁটে মনযোগ দিয়ে ভ্রূ কুঁচকে চিরকুট পড়লেন
তারপর ঠোঁট উল্টে হতাশ হয়ে " যত্ত সব" বলেই ছুঁড়ে দিলেন সামনের ডাস্টবিনে
।ততক্ষনে ওনার বাস হাওয়া।এতগুলো বছরের পরও আমি যখনই এই দিন ও ওনার সেই বোকা বনে যাওয়া
মুখটা ভাবি নিজের মনেই হেসে ফেলি।
তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি আমি।বাড়ির
পাশের ফাঁকা জায়গাটায় ,বাবার মামার ছেলে বাড়ি শুরু করলেন ।প্রথম প্রথম সন্ধ্যা হলেই
খোল করতাল সহযোগে হরিনাম কীর্তন চলতো। ভাবলাম একদিন ভয় খাওয়াতে
হবে একটু। যেমন ভাবা তেমন কাজ। সন্ধ্যাবেলায় সুতলি দড়িতে খান তিনেক বুড়িমা চকলেট
বোমা বেঁধে ছাদ থেকে ঝুলিয়ে দিলাম, আমাদের বাড়ির জানলার লেবেল অনুযায়ী। যখন রাত প্রায় দেড়টা,সুনসান চারিদিক ,জানালার ফাঁক
দিয়ে দেশলাই কাঠি জ্বালিয়ে এক মিনিট ছাড়া ছাড়া বিকট শব্দের বোম ফাটিয়ে দিই।ভেবেছিলাম
ঘুমের ঘোরে ওনারা কেঁপে উঠবেন কিন্তু দেখি কি , ডাকাত ডাকাত বলে চিল চিৎকার করে কাকিমা যেন গোটা পাড়া মাথায় করছেন। আর কাকু ও কাকুর
ছেলে তখন কাঁসর ঘণ্টা বাজাতে শুরু করে দিয়েছে। আমি যেন কিছুই জানিনা,কত্ত ঘুম আমার
চোখে!ঘুমানোর মিথ্যা ভান করে ভোর বেলায় চুপি চুপি
ছাদে উঠে , ইঁট চাপা সুতলী দড়ি গুলো সরালাম। বেলা করে ঘুম থেকে উঠে গা ভাঙতে
ভাঙতে কৌতুহল চোখে শুনলাম ,পাড়ায় নাকি রাতে ডাকাত এসেছিল।
নতুন বাড়ি করে এসেই এই
কাকিমাটি গ্রাম্য কূটকাচালিতে,প্রতিবেশী দের মনে বিষ ঢালতে শুরু করে দিয়েছিলেন নিজস্ব স্টাইলে। এর কথা তাকে
,তার কথা একে বলে, মিথ্যা বানিয়ে বানিয়ে ,আর নিজেকে সেরা করার এ এক পন্থা।এক দিন
গভীর রাতে বন্ধু কে নিয়ে রং তুলি দিযে ওদের বাড়ির দেওয়ালে লিখেছিলাম ,"এই বাড়িতে
কুমন্ত্রণা শিক্ষা দেওয়া হয় "।আসলে এখন ভাবলে খারাপ লাগে বটে কিন্তু ওই বন্ধুটির
বাড়িতে আমার নামে,আর আমার বাড়িতে ওর নামে মা বাবাকে বলে বিভাজন ঘটানোর চেষ্টা করেছিলেন
এই মন্থরা মানুষটি।
ক্লাসের আর একটি ঘটনা খুব
মনে পড়ছে।অঙ্কের রাগী শিক্ষক রমেন বাবু ক্লাস নিচ্ছেন,অচিন্ত্য ফিক করে হটাৎ হেসে ফেলতেই
সেকি বিপত্তি! মাথায় ফটাফট করে রমেন বাবুর স্পেশাল যা গন্ডা পাঁচেক রাম গাট্টা পড়লো ,অচিন্ত্য তো কেঁদে
কেটে বেসামাল।অথচ মুখে শব্দ করাও চলবে না।পাশেই ক্লাসের বিচ্ছু স্মার্ট ছেলেটি উঠে
দাঁড়িয়ে বললো,'স্যর, অচিন্ত্য খুব কাঁদছে,বিশ্রী ভাবে মাথা ফুলে গেছে,বরফ দিলে একটু
উপকার হয়" । স্যর ওর কথাটি একেবারে উড়িয়ে
দিতে পারলেন না,ইতস্তত ভাবে," বরফ কোথায় পাবি "বলতেই দুটাকা দিন স্যর, আইসক্রিম
আনছি "বলে,টাকা নিয়ে দৌড়ালো। এর পর দেখি ,একটা অরেঞ্জ আইসক্রিম কিনে যতটা পারা
যায় চুষে চুষে,স্যর কে আড়াল করে আর আমাদের
দেখিয়ে দেখিয়ে খেয়ে সাদা করে কিনা অচিন্ত্যর ঘেন্না সত্ত্বেও ওর মাথায় বোলাতে লাগলো।
সেই দৃশ্য আজ এত বছর পরেও যখন মনে পড়ে হাসি থামাতে পারি না!
এই বদমাস ছেলেটি আর একদিন
টিফিনে আইসক্রিম ওয়ালার কাছে দামি পেস্তা আইসক্রিম টা দাও বলে দু চার বার চুষে বলে
কিনা ,"ও কাকু,এটা রাখো ,ভালো না" পয়সা তো তখন দেয় নি,কি করে আইস ক্রিম কাকু
রেগে ফেরাতেও পাচ্ছে না,পরে কিনা পার্থ বলে ওর কাছে মাত্র এক টাকা আছে,প্লেন আইসক্রিম
দাও।
আমার মামা ছিলেন ভীষণ মজার
এবং রসিক মানুষ ।উনার কাছে শোনা এক মজার গল্প,একবার নাকি কোনো এক বিয়ে বাড়িতে গিয়েছিলেন
।সামনের কোয়ার্টারের দরজায় কলিংবেলে দেশলাইয়ের
কাঠি সরু করে এমন ভাবে ওনাদের কেউ গুঁজে দিয়েছিলো
যে সারারাত বেল বেজেই যাচ্ছিল। আর রাতবিরেতে গৃহকর্তা দরজা খুলছে আর "কে কে" বলে বিরক্তিতে সারা রাত জেগে।
একবার মামার বাড়ি থেকে
মামারা বন্ধুদের নিয়ে বরযাত্রী গিয়েছিল। রাস্তায় এত বৃষ্টি হলো আর এঁটেল কাদার প্যাচপ্যাচে
সে এক যাচ্ছেতাই অবস্থা। সেই সঙ্গে ছিল শীতকালের
কনকনানি ঠান্ডাও। বিয়েবাড়ি পৌঁছে সবাই বউ দেখে
তো ,চমকে যাবার উপক্রম। একদম কালো আলকাতরার
মতো কুচকুচে গায়ের রং নতুন বউয়ের। কনের বাড়ির আয়োজনে রাখা ছিল লেপ,তোষক ও গদির সারি
সারি বিছানা।ঠান্ডা আর ঐ বৃষ্টি আবহাওয়াতে সবাই যখন কাদা পা নিয়ে বিছানায় উঠছিল, কনের
পিসি এসে অনুনয়ের সুরে বললেন ,"বাবারা কাদা পা নিয়ে এভাবে ঢুকলে যে ,সব নোংরা
কালো হয়ে যাবে,একটু ধুয়ে এলে হতো না?" তখনই একজন বলেছিল," পিসিমা এই নোংরা কালো ময়লা তো সাবান
সোডা দিয়ে কাচলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে, কিন্তু যা কালো ময়লা বউ আমাদের ঘরে পাঠাচ্ছেন,
সারা জীবন কিলো কিলো সাবান ঘষলেও পরিস্কার হবে না"! সবাই তো শুনে হো হো করে হেসে
উঠতে উনি লজ্জায় "তোমরাই পছন্দ করেছ বাবা" বলে ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন।
এই রকম নানান মজার মজার
ঘটনা আমাদের জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে ।আজও প্রতিনিয়ত এমন সূক্ষ্ম রস বোধের নানান
ঘটনা ঘটে চলে,যেগুলো মাঝে মাঝে ভাবলে হাসি পায় খুব মজাও লাগে। তাই সকলকে
বলি,ব্যস্ততা থাকবেই তার মাঝেই হাসির গল্প পড়ুন,হাসির ঘটনা মনে করুন,অন্যদের ও হাসান।
কারণ এই আধুনিক জটিল বাঁধন জীবনে সবাই জানি
হাসি জীবনের এক মহৌষধ ।
সবচেয়ে ভালো লাগলো।
ReplyDeleteদুরন্ত
ReplyDelete