অণুগল্প -
বিরিয়ানি
পায়েল খাঁড়া
“বিরিয়ানি
খাওয়াটা আসলে একটা আর্ট! বুঝলে দাদা, ওটি
যার তার কম্ম নয়। খাব বললেই যেমন খাওয়া যায় না,
তেমন শুধু খেলেই হয় না; জমিয়ে ব্যাপারটাকে উপভোগ
করা চাই বুঝলে।যেন বিরিয়ানি নয় প্রেমিকার নরম তুলতুলে গাল—উফফ মনে পড়লেই না সারা শরীর মন এক্কেবারে চাঙ্গা হয়ে ওঠে!”
বিরিয়ানির উপর ছোটখাট একটা লেকচার দিয়েই হাঁক পাড়ল পান্তুয়া—“ কই গো শিমুল বউদি আর কত দেরি, পেটের ছুঁচোগুলো যে এবার ডন বৈঠক
ছেড়ে রীতিমত ক্যারাটে শুরু করে দিয়েছে......”
এই হল পান্তুয়া ওরফে প্রাণতোষ সর্দার।আমাদের পাড়ার এক নম্বর বিরিয়ানি খোর— অবিশ্যি
বিরিয়ানি আজকের দিনে কেই না ভালোবাসে কিন্তু এ ব্যাপারে পান্তুয়াকে টেক্কা দেওয়া—নৈব নৈব চ! ছোট থেকেই বিরিয়ানির প্রতি ওর এক মারাত্বক
অ্যাডিক্সন, একরকম হ্যাংলামোই বলা যায়; এমনি তে বাবু হাড় কিপ্টে অথচ সপ্তায় ২-৩দিন বিরিয়ানি
না হলে ওর যেন নাভিঃশ্বাস ওঠার জোগাড়।আর তাই পুরো এলাকায় যেদিন যাদের বাড়িতেই বিরিয়ানি
রান্না হোক না কেন তার গন্ধ পান্তুয়ার নাকের রেডারে ধরা পড়বেই আর অমনি বিন
বুলায়ে ম্যাহমান ঠিক সেখানে গিয়ে হাজির।এমনকি রেস্তোরাঁ থেকে কিনে আনালেও সে সুবাস পান্তুয়ার
নাককে ফাঁকি দেওয়া সির্ফ মুস্কিল হি নেহি নামুমকিন হেয়।ছোটবেলায় দোষটা তবু না হয় মানা যেত কিন্তু এত
বড় বয়সেও এমন হ্যাংলামো কার না গায়ে লাগে—পাড়ার লোকেরা
টিটকিরি করে, বাড়িতে ঝগড়া হয় এমনকি বিরিয়ানি খাবার চক্করে চাকরীটা
অব্ধি যেতে বসেছিল,
তবু কোনোকিছুতেই কোন হেলদোল নেই পান্তুয়ার।ওর জীবনে সেই এক ও অদ্বিতীয় সত্য হল বিরিয়ানি—বিরিয়ানি হি ধর্মঃ বিরিয়ানি হি কর্মঃ বিরিয়ানি হি পরমং তপঃ!
এক থালা মটন বিরিয়ানি আর স্যালাড এনে পান্তুয়ার সামনে রাখল শিমুল বউদি আর সাথে
সাথেই হলুদ ভাতের জাফরানি সুবাসে স্বর্গীয় সুখ জাগিয়ে তুলল তার পঞ্চেন্দ্রিয়ে। সহসা একটা কান এঁটো
করা হাসি হেসে সে বলল—“ হে হে ...তাহলে এবার শুরু করলাম।”
শুরু তো করল কিন্তু শেষ যে কোথায় গিয়ে হবে আর তারপরে নিজেদের ভাগ্যে কতটুকু অবশেষ
থাকবে সে কথা ভেবেই একটা শুকনো হাসি ফুটে উঠল রজতদার মুখে অতঃপর স্বামী-স্ত্রী দুজনেই বিরসবদনে অনাহুত অতিথির আতিথ্য করতে লাগল। দেখতে দেখতে এক
থালা ক্রমান্বয়ে পাঁচে গিয়ে দাঁড়ালো মিনিট তিরিশের মধ্যেই।
“পেট তো
নয় যেন জালা...” মনে মনে গজগজ করে উঠল রজতদা কিন্তু মুখের উপর
তো আর কিছু বলা যায় তাছাড়া বলেই বা লাভ’টা কী? পাড়া প্রতিবেশীরা এই নিয়ে ওকে ঠুকতে তো কম করে না কিন্তু বিরিয়ানির ব্যাপারে
পান্তুয়ার মতন এমন দু’কান কাটা মানুষ চিত্রগুপ্তের খাতায় আর দ্বিতীয়টি
আছে ব’লে তো এ তল্লাটে কারোর জানা নেই।যাই হোক শেষ থালাটা সাফা করে হলদেটে বত্রিশ পাটি
বের করে গদগদ স্বরে পান্তুয়া বলে উঠল—“ উফফ বউদি
আজ বিরিয়ানিটা যা রেঁধেছ না, একটু বাড়াবাড়ি রকমেরই টেস্ট হয়েছে;
এক্কেবারে আর্সেলানকে টেক্কা দেবে এই বলে দিলুম!”
এরপর এক গ্লাস জল খেয়ে সবে মাত্র খানচারেক ঢেঁকুর তুলেছে তখনি টিভির খবরটা কানে
এল পান্তুয়ার—ভাগাড় কান্ডে ধরা পড়া দোকানগুলোর
নাম বলছে; হঠাৎই হাঁ- হাঁ করে উঠল শিমুল
বউদি—“ একি, আজ তো এই দোকানের মাংসেই বিরিয়ানি
রেঁধেছিলা্ম, ভাগ্যিস আমরা এখনও কেউ খায়নি!”
কথাটা বলেই জিভ কাটল বউদি। পিছনে ডাইনিং টেবিলে
বসা পান্তুয়ার কথাটা তো তার মাথাতেই ছিল না__আচমকা একটা ‘দড়াম’
শব্দে দুজনেই ফিরে তাকিয়ে দেখল এঁটো হাতেই মেঝেতে চিৎ পটাং হয়ে পড়ে আছে
পান্তুয়া।
[২]
যখন চোখ খুলল পান্তুয়ার ততক্ষনে কাহিল অবস্থা।ভাগাড়ের মাংস খাবার কথা জেনেই তার মাথাটা ঘুরে
গেছিল, শেষে জল টল দিয়ে হুশ তো ফেরানো হল কিন্তু বিরিয়ানির লোভে
পড়ে সে ভাগাড়ের মাংস খেয়ে ফেলেছে কথাটা মনে পড়তেই তার মুখে যেন অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে
আসার জোগাড়, আবার এমন একটা কেলোর কীর্তি বাড়িতেও বলা চলে না।তাহলে উপায়...
অবশেষে পান্তুয়া গিয়ে হাজির হল পাড়ার হরেন খুঁড়োর বাড়ি। খুঁড়ো এককালে শখের
কবিরাজি করতেন—কি জানি যদি একটা হিল্লে করতে
পারেন! খুঁড়োর কাছে ওষুধ তো মিলল কিন্তু সেটা খেতে গিয়ে আর এক
বিপত্তি।ওষুধ যে এমন বিটকেল
তেতো হতে পারে সে ধারনা পান্তুয়ার ছিল না; তার উপর
সেটা খাওয়া ইস্তক সে আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারল না।চব্বিশ ঘন্টায় প্রায় আটচল্লিশ বার পায়খানা-বমি করে
প্রাণতোষের প্রাণ একেবারে ওষ্ঠাগত হয়ে পড়ল।এদিকে তার এই অবস্থা দেখে বাড়ির লোক তো চিন্তায়
অস্থির।পান্তুয়া বরাবরই
ভোজনরসিক কিন্তু এমন পেটের ব্যামো তার তো কস্মিনকালেও ছিল না।নিশ্চই কারোর নজর লেগেছে, সুতরাং ডাক্তারে কড়া ওষুধ আর অখাদ্য পথ্যের পাশাপাশি চলল ওঝার
ঝাড়ফুঁক আর জুতো-ঝাঁটার ধোলাই।আর বেচারা পান্তুয়াও মুখে কুলুপ এঁটে সবকিছু বরদাস্ত
করতে থাকল।পাক্কা দশদিন পর
দু’তরফা জল্লাদের হাত থেকে রেহাই পেয়ে সে যখন খাঁড়া
হয়ে দাঁড়ালো তখন পান্তুয়া আর পান্তুয়া নেই চুপসে আমসত্ব হয়ে গেছে।
শেষ পাওয়া খবরে গত একবছরের মধ্যে বিরিয়ানির নামটুকুও আর মুখে আনেনি আমাদের আদরের
শ্রীমান পান্তুয়া।।
----------------------------------------
BARTALA, KOLKATA
খুব ভালো
ReplyDeleteপ্রাসঙ্গিক বিষয়ের ওপর মজার লেখা
ReplyDelete