গল্প -
রবিনবাবু
দীপক আঢ্য
রবিনবাবুকে এই তল্লাটে চেনেনা এমন লোক বোধহয় খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আগে এই কাছেই
থাকতেন ভাড়া বাড়িতে। বছর দুয়েক হলো এই এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন কলোনির ভিতরে আরও একটু
সস্তা ঘর দেখে অন্য ভাড়া বাড়ি। আমার বন্ধু সুখেনের বাড়ি বাজারের উপরেই বলা চলে। ওর
বাড়ির সামনে সারি দিয়ে অনেকগুলো দোকান। তার একটাতে রবিবারের সকালটা প্রায়ই শেষ হয়
আমাদের কয়েক জনের। টেলারিং শপ। রবিবার কর্মচারীর ছুটি থাকায় দোকানের মালিক সমীরণ
অনেকটা সময় দিতে পারে আমাদেরও।
দুর্গাপুজোর মাস কয়েক আগেই হবে। বাইরে পচা ভাদ্রের গরম। আমরা ক’জন দোকানের ভিতর ফ্যানের তলায় বসে
আখ চিবোতে ব্যস্ত। এমন সময় রবিনবাবু এলেন। দরদর করে ঘামছেন। আমরা সরে গিয়ে তাকে
বসতে দেওয়ার পর তিনি ফ্যানের বাতাসে যেন একটু স্বস্তি পেলেন। সমীরণকে বললেন ‘একটু ঠাণ্ডা জল খাওয়াতে পারো?’
ইতস্তত করেও সমীরণ দোকান থেকে বেরিয়ে পাশের মিষ্টির দোকানের ফ্রিজ
থেকে নিজেদের জন্যে রাখা ঠাণ্ডা জল এনে খাওয়ালো রবিনবাবুকে। তৃপ্তি সহকারে জলটা শেষ
করার পর রবিনবাবু সমীরণকে বললেন, ‘আমি আসলে তোমার কাছেই
এসেছিলাম। একটা বিষয় জানার ছিল। তুমিতো দেখি আজকাল সারাক্ষণ কেবল ছেলেদের জামা আর
প্যান্ট কাটাও। সেলাই করো। তা এই আমাদের মতো হাফবুড়ো লোকদের জন্যে পাজামা কাটাও না?
-হ্যাঁ। কাটাই তো। পাজামা পাঞ্জাবি তো কতো লোকেই করতে আসে।
-বাহ্! আমি ভাবছিলাম... যাক গে, তা পাজামার মুজুরী
কত করে নাও?
-সে আমি আপনার কাছথেকে কমসম করেই নেব।
-সে তো জানি। আর সেই জন্যেই না এই গরমে দু কিলোমিটার হেঁটে তোমার কাছে আসা।
‘দু-কিলোমিটার হেঁটে!’ কথাটা শোনা মাত্রই আমার গরম
লাগা যেন দ্বিগুণ হয়ে উঠল।
সমীরণ হাসিহাসি মুখ করে বলল , ‘আপনাদের এই ভরসাতেই তো এই দোকান...’
-শুধু ভরসা বললে হবে না। মুজুরীটা তো জানা চাই। তা না হলে পরে সমস্যা হতে
পারে।
সমীরণ একটু ভেবেই বলল, ‘সকলের কাছ থেকে পঁচাত্তর টাকা নিই। কিন্তু আপনি সত্তরই দেবেন।’
সত্তর শুনে একটু যেন দমে গেলেন রবিনবাবু। প্রায় স্বগতোক্তিতে বললেন ‘এটাই ফাইনাল?’
কথাটাকে না শোনার ভান করে সমীরণ একটু হাসল মাত্র। রবিনবাবু নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে
তারপর বললেন, ‘বেশ। আমার একটা পাজামার মাপ নাও। এই যেমন পরা আছে তেমনই’ একথা বলে নিজের পরনের পাজামার দিকে ইঙ্গিত করলেন। সমীরণ তার বসার টুল ছেড়ে
বাইরে বেরিয়ে এসে কোমর-হাইট-পুট সব মাপ নিল নিয়ম মাফিক। খাতায় এন্ট্রি করল। মাপ
লিখল। ঠিক যে মুহূর্তে খাতাটা বন্ধ করতে যাবে তখনই রবিনবাবু ‘দাঁড়াও! দাঁড়াও!’ বলে আটকালো সমীরণকে। আমরাও কৌতূহলী
হয়ে উঠলাম যথারীতি।
-বলছিলাম যে, পাজামার সঙ্গে একটা চেন ফিট করে দিতে
পারো? বুঝতে তো পারছো, বয়স হয়েছে। দড়ির
গিঁট খোলা মাঝে মধ্যে বেশ ঝামেলার হয়ে ওঠে। তাই আর কি!
নিতান্ত সৌজন্য দেখিয়ে তেঁতো ওষুধ খাওয়ার মতো মুখ করে সমীরণ বলল, ‘আচ্ছা।’
-আর একটা কথা। এই নস্যির ডিবেটা যে কখন কোথায় রাখি তা খেয়াল করে উঠতে
পারিনে কিছুতেই। তাই বলছিলাম যদি একদিকে অন্তত একটা পকেট বানিয়ে দিতে...
নির্বাক সমীরণ একবার রবিনবাবুর দিকে তাকাতেই একগাল হাসি হেসে দিলেন তিনি।
সমীরণ তার খাতায় লিখে নিল , ‘পকেট একটা।’
'আর একটা কথা, ওই বলছিলাম না যে গিঁট... গিঁট... সময়
অসময়ে খোলাটা খুব ঝকমারি হয়ে যাচ্ছে। তাই বলছিলাম যে, তুমি
ওই কোমরে দড়ির পরিবর্তে একটা ইলাস্টিক লাগিয়ে দিও। আমি না হয় ইলাস্টিকের জন্যে যা
আলাদা দাম দিতে হয় দিয়ে দেবো। সে আর কী করা যাবে। পাজামার খরচটা না হয় একটু বাড়বে!
আর হ্যাঁ, ভিতরে একটা চোরা পকেট করে দিও কিন্তু। সে যে কোনো
কাপড়ের করে দিলেই চলবে। কত সিট-কাপড় ওইতো পড়েই আছে।' বলে
সেদিকে তাকিয়ে নিলেন এক পলক।
রবিনবাবুর এহেন অর্ডার শুনে আমরা সকলে যখন বিস্মিত বললেও কম বলা হয় তখনও সমীরণ
আগের মতোই স্থিতধী। আমি তোমাকে ক’টা টাকা অ্যাডভান্স করে যাই?’ রবিনবাবু
সস্নেহে বললেন সমীরণকে।
-না। না। থাক। তার দরকার হবেনা। আপনি ডেলিভারী দেওয়ার সময়ই দেবেন।
-আচ্ছা। বেশ। আমি তাহলে যাই, বুঝলে। ওই মিষ্টির দোকানে একটু যেতে হবে।
আগের দিন দুশো সন্দেশ কিনেছিলাম। দামটা এখনো মেটানো হয়নি। কেউ আমার কাছে টাকা পেলে
আমি না দেওয়া পর্যন্ত শান্তি পাইনে।
সমীরণের দোকান থেকে বেরনোর একটু পরেই পাশের মিষ্টির দোকান থেকে দুএক জনের উচ্চস্বরে
বচসার শব্দ কানে আসায় একে একে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। দেখি রবিনবাবুর সঙ্গে জোর কথা
কাটাকাটি চলছে মিষ্টির দোকানদারের। এমনকি দোকানের কর্মচারীরার মাঝে মধ্যে
উচ্চস্বরে একথা ওকথা বলে চলেছে রবিনবাবুকে। দুচারজন লোকও জমেছে।
রবিনবাবু গলার স্বর চড়িয়ে বলছেন, ‘এতো রীতিমতো চিটিং। হ্যাঁ, আমি ভুল করেছি স্বীকার করছি। ভুল আমার হয়েছেই। আমার খুব মনে আছে, বাড়িতে ক’জন লোক ছিল তাই ব্যস্ততায় আমার দাম
জিজ্ঞাসা করা হয়নি। হ্যাঁ, আমি কম মিষ্টির সন্দেশই চেয়েছিলাম
দুশো। নিয়েও গিয়েছিলাম। তখন কি জানতাম, তোমাদের এই
চিটিংবাজির কথা! কম মিষ্টির সন্দেশ! তার তো স্বাভাবিক ভাবেই দাম কম হওয়া উচিত,
বেশি মিষ্টির সন্দেশের চেয়ে। আরে চিনির তো একটা দাম আছে কিনা! আর
তোমরা কিনা অবলীলায় লোক ঠকাচ্ছো? কম মিষ্টির সন্দেশ পঁচিশ টাকা
শ' অথচ বেশি মিষ্টি বলছ কুড়িটাকা করে! নিষ্পাপ লোকগুলোতো
ঠকবেই। আমি এর বিহিত করেই ছাড়বো। আমি ক্রেতা সুরক্ষা দপ্তর পর্যন্ত যাব। দাও।
আমাকে দুশো সন্দেশের পাকা রসিদ দাও। রসিদ না পেলে আমি এক পাও এখান থেকে নড়বো না,
এই বলে রাখলাম।’
আমি দেখলাম আমার সঙ্গীসাথীরা একটু দূরেই দাঁড়িয়ে। রবিনবাবুর এতক্ষণের অতি ন্যায্য কথা কাকে যে নতুন করে শোনাবো তার জন্যে
এদিক ওদিক তাকাতাকি করলাম বটে, কিন্তু এই যতক্ষণ না তোমাকে শোনাতে পারলাম ততক্ষণে যেন শান্তি পাচ্ছিলাম না।
------------------------------------------------
মধ্যমগ্রাম, উত্তর ২৪ পরগণা।
------------------------------------------------
মধ্যমগ্রাম, উত্তর ২৪ পরগণা।
ভালো লাগলো ৷
ReplyDelete