Monday, February 18, 2019

কাকলী দাস ঘোষ





গল্প –
বিবর্ণ তিয়াসা

" তিয়াসা দেখ , ঈশান কোণে মেঘ জমেছে আজ  চল না রে -আজ একটু বোসেদের বড় দিঘির পারে গিয়ে বসি   ", দেবেশ তিয়াসার হাত ধরে বলল  দেবেশ আর তিয়াসা -ওরা ছোটবেলার বন্ধু  দেবেশ তিয়াসার চেয়ে বছর তিনেকের বড়  দুজনেই থাকে উত্তর চব্বিশ পরগনার রাজারহাটে  ছেলেবেলা থেকেই হেসেখেলে , বেণু মাসিমার বাগানের কুলটা -আমটা চুরি করে খেয়ে একসাথে বেড়ে ওঠা ওদের  আর এই বেড়ে উঠতে উঠতে দুটো সবুজ মন কখন যেন বেশ কাছাকাছি চলে এসেছে -হয়তো ওদেরই অজান্তে
দেবেশ আর তিয়াসা -দীঘির পারে এসে বসে
"আচ্ছা দেবেশ দা -তোর তো বছর মেডিকেল এর লাস্ট ইয়ার   তারপর তো তুই ডাক্তার , আমাকে তখন তুই ভুলে যাবি নারে  " , তিয়াসা বেশ অভিমানী সুরে দেবেশকে বলে
"
দূর বোকা মেয়ে তুই আমার কে জানিস -আমার প্রাণ , তুই এইখানে আছিস রে  " , বুকের বাঁ দিকে হাত রেখে তিয়াসার বিনুনী -তে একটান দিয়ে দেবেশ বলল
তিয়াসা কলেজে পরে  ইংরাজী অনার্স এর ছাত্রী -সেকেণ্ড ইয়ার  তিয়াসা  সুন্দরী , বেশ ধবধবে ফর্সা গায়ের রঙ  দিঘির তীরে বাঁধা একটা নৌকায় বসে পা -দুটো ঝুলিয়ে জলে ডুবিয়ে তিয়াসা হঠাৎ বলল , " জানিস দেবেশদা বাড়িতে আমার সম্বন্ধ দেখছে  "
দেবেশের বুকে যেন এক অজানা যন্ত্রণা মোচড় দিয়ে উঠল  তবু নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দেবেশ বলল , "তবে করে নে --বিয়ে  "
তিয়াসার দুচোখ দিয়ে জল ঝরতে থাকে
চিৎকার  করে বলে , " দেবেশ দা -তোকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করব না রে  "
দেবেশ আজ প্রথম স্বীকার করে তিয়াসা কে ভালবাসে
দুই -বছর কেটে গেছে  দেবেশ এখন একটা নামি নার্সিংহোমের ডাক্তার  দুই পরিবারের সম্মতিক্রমে দেবেশ তিয়াসার বিবাহ স্থির হয়েছে আগামী ৫ই ডিসেম্বর  বিবাহের ঠিক একমাস পূর্বে দেবেশ তিয়াসা কে বলে ,
" জানিস আজকাল খুব মাথা যন্ত্রণা করে , ঘুমাতে পারি না  "
তিয়াসা বলে , " দেবেশ দা , তুই কাজের প্রেসার একটু কমিয়ে দে না রে , শরীরের দিকে তোর একদম নজর নেই  "
দেবেশ তিয়াসার দুই হাত চেপে ধরে বলল , " তুই আমার বৌ হয়ে এলে খুব শাসন করবি নারে ?"
" করবই তো  " , তিয়াসার প্রতি উত্তর
এর পর থেকে দেবেশের শরীর বেশ ভেঙে পড়তে থাকে  প্রায়ই অসয্য মাথা যন্ত্রণা , বুকের ভিতর থেকে কী একটা অস্বস্তি গুলিয়ে উঠতে থাকে  ভীষন বমি ভাব , মাঝে মাঝে চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসে ওর
বিবাহের নির্দিষ্ট দিনের ঠিক পাঁচদিন অবশিষ্ট  আবার সেই দীঘির পারে দেবেশ তিয়াসাকে ডাকে  আজ দেবেশ কেমন যেন এক অন্যরকম  নির্নিমেষ নয়নে তিয়াসার দিকে চেয়ে থাকে
"এমন করে কী দেখছিস দেবেশ -দা ? "
দেবেশ কেমন এক অচেনা ধরা গলায় ধীরে ধীরে বলল ," বিয়ে আমি করতে পারব না তিয়াসা "  
তিয়াসা কী শুনল ? ঠিক শুনল তো ? এক মুহুর্ত সে নিশ্চুপ এরপর অবাক বুকের পাঁজর দুমড়ে -মুচড়ে উঠে আসা যন্ত্রণা নিয়ে সে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় দেবেশের প্রতি , "কেন দেবেশ দা , কী বলছিস তুই ? "
বৃষ্টিধারা আজ তিয়াসার দুই চোখে  কিন্তু গোধুলির আলো -আঁধারির খেলায় দেবেশের চোখের কোলেও যে বর্ষার পূর্বাভাস সেটা তিয়াসার নজর এড়িয়ে যায়
দেবেশের পরবর্তী কথাগুলি একঝাঁক তীরের মত এসে তিয়াসাকে বিদ্ধ করে
" তিয়াসা --আমি ---আমি --আর বাঁচব না রে ---বাঁচব না ---আমার ব্রেন টিউমার হয়েছে রে ---অ্যাডভান্সড স্টেজ ----" ,
দেবেশ আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না  তার স্বপ্ন -তার আশা , তার সব ---সবকিছু তিয়াসাকে জড়িয়ে ধরে দেবেশ  চোখের বৃষ্টি , মনের বৃষ্টি এত বাঁধ দিয়ে কে বা রাখতে পারে
দেবেশের কথা শেষ হতে না হতেই এক আর্ত চিৎকার বেরিয়ে আসে তিয়াসার গলার সমস্ত শিরা -উপশিরা ছিঁড়ে , " না --না --না -- সত্য নয় --- হতে পারে না ,না  "
দেবেশ কাঠের পুতুল যেন আজ  যেন ওর যান্ত্রিক হাত তিয়াসার দিকে এগিয়ে দেয় ওর মারণ রোগের সংকেতবাহী মেডিকেল রিপোর্ট  তিয়াসার স্বপ্নগুলো চোখের নিমেষে ভাঙা কাঁচের টুকরোর মত চুরমার হয়ে যায়  কিছুক্ষণ পরে যেন অচেতন কোন অবস্থা থেকে সম্বিত ফিরে পায়  খুব অস্ফুটে ওর গলা থেকে বেরিয়ে আসে কটি কথা , " যা হয় হবে , আমার ভাগ্য আমায় যেদিকে নেয় সেদিকেই যাব  আমি তোকে ওই দিনই বিয়ে করব  এর অন্যথা হবে না আর যদি হয় তোর আগেই আমার শেষ দিন আসবে  "
তিয়াসার কথাগুলো মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতে শুনতে দেবেশের চোখের কোল ছাপিয়ে জল গড়াতে থাকে   তিয়াসাকে কিছু বলতে চায় কিন্তু তিয়াসা ওর মুখ চেপে ধরে
আজ ৫ই ডিসেম্বর  অপরূপ সাজে সজ্জিতা কনে তিয়াসা তার পরম চাওয়া দেবেশের  গলায় মালা দিয়ে সিঁথির সিঁদুরে রেঙে উঠল
আজ ৭ই ডিসেম্বর  তিয়াসা দেবেশের ফুলশয্যা  বেশ কজন মেয়ে -বধূ বেশ খিলখিল হাসিতে তিয়াসাকে দিয়ে গেল ফুলশয্যার পালঙ্কে  অনেক হতাশা , কষ্ট , রোদন -বেদনের মাঝেও তো মানুষ শেষ কোন আশা , কোন ক্ষীণ আলো হাতড়ে বেড়াতে চায়   একটু বেঁচে থাকা , একটু বুক ভোরে নিঃশ্বাস নেয়া পরম চাওয়া , আকুতি হয়ে ওঠে  তিয়াসার তরুণী মন -ওর গভীর ভালবাসা আজ সেই আশার কোন ক্ষীণ আলোর সন্ধান পেতে চায়
দেবেশ সুন্দর শেরওয়ানিতে সজ্জিত আজ  কী সুপুরুষ ! কে বলবে শরীরে বহন করছে মারণ রোগের সর্বগ্রাসি বিষ  ফুল বিছানো খাটে নতুন কোন স্বপ্ন গেঁথে তিয়াসা একদৃষ্টে দেবেশের দিকে চেয়ে থাকে আর দেবেশ বেনারসি , মালা , চন্দন , সিঁদুরে সজ্জিতা তিয়াসার দিক থেকে যেন চোখ ফেরাতে পারে না আজ  দু -হাতে পরম ভালবাসায় জড়িয়ে ধরে সে তার প্রেয়সী , তার বহুদিনের কাঙ্খিতাকে  এক রোমাঞ্চকর আবেগে তিয়াসা চোখ বুঁজে ফেলে  কিন্তু একী ! দেবেশ তো আর তিয়াসা কে দেখতে পাচ্ছে না  কী যন্ত্রণা ওর সারা মাথায় , এক্ষুণি ফেটে যাবে যেন  ক্রমশ সারা পৃথিবীটা যেন অন্ধকার হয়ে যাচ্ছিল ওর চোখের সামনে  ধীরে -খুব ধীরে ওর নিথর মাথাটা ঢলে পড়ে তিয়াসার কোলে 
হায় রে আশা - কেন এত ছলনা তোর ! একমুহুর্ত স্তব্ধতা আর এরপর আবার তিয়াসার গলা -বুক চিরে বেরিয়ে আসে হাজার প্রদীপ নিভিয়ে দেয়া আর্ত চিৎকার , "দেবেশ দা , আমাকে ছেড়ে যাস না , যেতে পারিস না -না -না না -না---- " ,আছড়ে পড়ে দেবেশের  নিথর দেহে
কারা যেন ওর সধবা সাজ খুলে ওকে বিধবা বেশে সাজায়  তিয়াসা সেকথা জানে কী না কিম্বা ওর অনুভুতির কোন গোপন স্তরে ওর হারানো কথা লেখা আছে কিনা  জানি না   যে কথা বলে নি আর কখনও কোনদিন


No comments:

Post a Comment