গল্প-
আগুন পাখি
তখন আমার আস্তানা জঙ্গলের ভিতর নদীর ধারের মাটির বাংলো। বাংলো ঠিক নয়,
কাঁচা মাটি আর পাথরের টুকরো দিয়ে বানানো ছোট ঘর বলা যায়। এক সন্ধেবেলা বারান্দায় বসে আছি। সামনে কুয়াশার চাদড়ে মােড়া অমাবস্যার জঙ্গল। কানে আসছে নদীর জলের আওয়াজ সাথে আধ কিলোমিটার দূরের ঝর্ণার শব্দ, ঝম্-ঝম্ বৃষ্টির মতন। রাত্রি গভীর হওয়ার সাথে সাথে জলতরঙ্গের আওয়াজও গভীর মোহময় হয়ে ওঠে আরোও।
প্রায় প্রতি বছরই একবারে অখ্যাত এই পাহাড়ি গ্রামে বায়ু পরিবর্তনের জন্য আসি আমি। নিজে ডাক্তার হলেও নিজের পরিপাকতন্ত্রের বেহাল দশার হাল একবারেই ধরতে পারিনি,
অগত্যা এখানে আসা। তবে এই বন্য-প্রকৃতি স্বাস্থ্যকর এবং মনোহর, একাথা স্বীকার করতেই হবে। পিতৃব্য কবিরাজ দ্বিজকাকাই এই জায়গার হদিস দিয়েছিলেন আমাকে বহুদিন আগে। এখন অবশ্য তিনি স্বর্গে। বলেছিলেন,
'ওখানে গিয়ে থাক, কপাল ভালো হলে একবারে সুস্থ হয়ে যাবি তুই, একটা বিস্ময়কর ব্যাপারও আছে জায়গাটায়, ভাগ্য ভালো হলে তুইও দেখতে পাবি, …
… ... ।'
আলোপ্যাথি,
হোমিওপ্যাথি, কবিরাজি, ঠাকুর বাড়ি, ঝাড়ফুঁক, তেলপড়া, জলপড়া, সংস্কার, কুসংস্কার সব হজম হয়ে গেছে আমার পেটে। এখানে বায়ু পরিবর্তনে এসে ওই বায়ু খেয়েই থাকি বলতে গেলে ইদানীং। পাঁচফুট আট ইঞ্চি চেহারা আর ওজন পঁয়ত্রিশ কেজি পাঁচশ পঞ্চাশ গ্রাম। সেদিন তো ঝড়ে প্রায় উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে ফেলছিলো ওই ছোটো পাহাড়ী নদীতে, ঝর্ণার খানিকটা আগে। ভাগ্যিস পিরামিড মন্দিরটার পাশে আটকে গেলাম একটা গাছে, একবারে আঁকড়ে ধরলাম গাছটাকে আমার লম্বা দুহাত দিয়ে, তাই রক্ষে। যাইহোক, আমার এই হৃষ্টপুষ্ট সুপুরুষ চেহারার নিশ্চই আর বর্ণনা দিতে হবেনা।
এই ছোট্টো পিরামিড মন্দিরটা নিয়ে একটা অদ্ভুত গল্প শুনেছি কবিরাজ-কাকার কাছে। এই মন্দিরটার দেবতা নাকি কোনো একটা পাখি আর তার জন্যই নাকি গ্রামটা এমন সুস্থ,
স্বাস্থ্যকর, মনোহর। প্রতি বছর শীতের শেষে এখানে আসি আমি,
দু-আড়াইমাস মানে গোটা বসন্ত কাটিয়ে তবেই ফিরি। এখানে থাকার জায়গা বলে কিছু নেই তেমন। গ্রামে কদাচিৎ আমার মতোই দু-চারজন আসেন প্রতিবছর, নদীর পাশে গ্রামবাসীদের মাটি আর পাথর দিয়ে বানানো কাঁচা ঘরেই থাকার ব্যবস্থা আর ওদের কাছেই খাওয়া। ফেরার সময় অল্প কিছু টাকা পয়সা দিয়ে গেলেই ওরা ভীষণ খুশি। আমি অবশ্য দ্বিজকাকার এক পরিচিতের কাছেই থাকি। একটু ডাক্তারি করি বিনাপয়সায় ওই মাস দুয়েক, ওষুধও দিই, তাই আমার খাতির ও একটু বেশি। আমার জন্য একটা সুন্দর কাঁচা ছোট্টো ঘর গুছিয়ে রেখে দেয় ওরা। আমার কাছে ওটাই একটা সুন্দর বাংলো।
তবে এবছর গ্রামটা যেন কেমন রুক্ষ হয়েগেছে। একটুও চাষবাস হয়নি বৃষ্টির অভাবে। পলাশ মহুলের গাছ গুলোতেও দু-একটা ফুল ফুটেছে মাত্র। ঝর্ণায় জল একবারেই কম। গ্রামে ডায়রিয়ার মতো একটা অজানা রোগের প্রাদুর্ভাব হয়েছে। কেউ মারা যায়নি তবে খুব অসুস্থ হচ্ছে ঘরে ঘরে। আমার যেটুকু করার করছি তবে লাভ কিছু হচ্ছে বলে আমার মনে হয়না। আমার নিজের শরীরটা ভালো যাচ্ছেনা। বনমালী সেদিন আমাকে বলে গেলো,
'তু এত ভাবিস নাই ডাক্তারকাকা, যেদিন উ পাখি আসবেক,
স্যদিন সবোই ঠিক হুয়ে যাবেক।'
আজ সন্ধ্যা থেকেই শরীরটা ভীষণ খারাপ আমার,
মনটাও ভালো নেই। বনমালীর ছেলেটার শরীর ভীষণ অসুস্থ, বাঁচবে কিনা কে জানে, তবে ওরা কেউ কোনোদিনই হসপিটালে যায়না। আমার কথা কানেই তুললো না। কোনো এক অদৃশ্য শক্তিকে যেন বিরাট বিশ্বাস করে। সারারাত ঘুম এলোনা আমার সেদিন। রাত তিনটের দিকে টর্চ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বুনো রাস্তা ধ'রে চলে এলাম ঝর্ণার পাশের সেই জায়গাটাতে, তবে আজ একটু বেশি আগেই। বসে পড়লাম সমতল পাথরটার উপরে। পাশে মস্কিউটো কয়েল জ্বালিয়ে দিলাম। আমার প্রাত্যহিক যোগচর্চা করে বসে পড়লাম ধ্যানে।
জানিনা কতটা সময় পেরিয়েছিলো। হঠাৎ সারা শরীর জুড়ে একটা অদ্ভুত শিহরণ অনুভব করলাম,
যেনো চারিদিকের গাছপালা গুলোও অদ্ভুত ভাবে চঞ্চল হয়ে উঠেছে। একটা অশরীরী শিহরণ-স্রোত নেমে গেলো শিরদাঁড়া বেয়ে। এই পেটের রোগে ভুগে ভুগে আমার ভয়ডর বলে কিছু ছিলোনা। আমার বন্ধ চোখ কেউ যেনো টেনে জোর করে খুলে দিলো। ঈষৎ ঈশান কোন থেকে একটা ঊষারাঙা বিরাট পাখি গোটা পাহাড়ের উপর দিয়ে বিরাট ডানা মেলে হালকা রাঙা আলোর ছায়া ফেলে সারা পার্বত্য বনভূমিকে বিরাট পাখার আলতো হাওয়ায় দোলাতে দালাতে আস্তে আস্তে আমার মাথার উপর দিয়ে উড়ে এসে অদ্ভুত ভাবে একটু একটু ছোটো হতে হতে নেমে এলো ঝর্ণায়। তখনই ঝর্ণার জলের বেগ হুহু করে বয়ে গেলো ঊষারাঙা পাখিটার ডানামেলা শরীরের উপর দিয়ে। পরিষ্কার ঈষৎ স্বচ্ছ তারা খচিত আকাশ থেকে সারা বনভূমিতে ঝরতে লাগলো মৃদু বৃষ্টি। পাখিটা স্নান করার পর হয়ে গেল একবারে ধপধপে সাদা পেঁজা তুলোর মেঘের মতো। তারপর বিশাল সাদা ডানা মেলে পাখিটা উড়ে গেলো পিরামিড মন্দিরের দিকে খুব মৃদু গতিতে। মন্দিরে যেনো মিলিয়ে গেলো। আমার চমক ভাঙলো একটু পরে যখন গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে ভোরের সূর্যের আলো আমার চোখে এসে পড়লো। আমি উঠে ঝর্ণায় স্নান করে ধীরে ধীরে উপস্থিত হলাম ছোট্টো সেই পিরামিড মন্দিরে। প্রণাম করলাম আজ প্রথম। তখন একটা অদ্ভুত সুন্দর সাদা পাখি মন্দির থেকে বেরিয়ে আমার মাথায় পাখার বাতাস দিয়ে উড়ে গিয়ে বসলো একটা অচেনা গাছে। অদ্ভুত একটা মিষ্টি সুরে ডেকে উঠলো বেশ কয়েক বার। পাহাড়ি বনের গায়ে সেই ডাক বারবার প্রতিধ্বনিত হলো। তারপর ডানা মেলে দিলো আকাশে। ধীরে ধীরে বড়ো আর আবছা হ'তে হ'তে মিলিয়ে গেলো ভোরের নীল আকাশে জুড়ে। আমি বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম।
… 'ই বাবু,
দিখেছিস তু পাখি টারে? উ আমাদের ঠাকুর বটে!'
আমার ধ্যান ভাঙলো,
'বনমালী তোর ছেলে কেমন আছে?'
… 'এক্কেবারে ঠিক হুয়ে গেছেরে বাবু,
সুকালে উঠেই খেলছেক আমুর বেটা।''
ছোট্টো মন্দির চাতালে দেখলাম একটা সাদা রঙের ছোটো স্ফিংস এর মূর্তি। আমি সেটার গায়ে যেই হাত দিয়ে স্পর্শ করেছি অমনি আমার শরীরের মধ্যে যেনো তড়িৎ খেলে গেলো। আমার কানে অলক্ষ্যে কেউ যেন কয়েকটা শব্দ উচ্চারণ করলো … 'Aftó
eínai gia sas. Eísai ygiís tóra' (আপ্ত ইমি গিয়া স্যাস, তেসেই গেস তরা)। আমি হতবাক। একটুও ভয় লাগলো না আমার। মনে হলো, কেমন যেনো একটা রূপকথার দেশে ঢুকে পড়েছি। আনমনেই মূর্তিটা হাতে ক'রে তুলে আমার ঝোলা ব্যাগে ভরে নিলাম। শব্দ কটা মনে মনে আওড়াতে আওড়াতে ঘরে এসেই লিখে ফেললাম আমার দিনলিপির ডাইরিতে।
পরদিন একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করলাম। বনের মধ্যে যেন একটা আনন্দের শিহরণ লেগে গেছে হঠাৎ,
গাছ গুলো যেন হঠাৎ ফুলে ফুলে ভরে গেছে। গ্রাম থেকে সেই অজানা রোগটাও যেনো কোথায় পালিয়ে গেছে কখন।
আজই বাড়ি যেতে হবে,
সব গোছগাছ করে নিচ্ছি, এমন সময় হঠাৎ বনমালীর বউ শাল পাতার থালায় করে কি একটা বনপাতার চপ ভেজে নিয়ে হাজির,
… ই বাবু ইগুলান তুর লগে,
তু খাবি ইগুলান আজ।
… সেকি রে,
আমার তো পেটের রোগ, খেলেই মরে যাবো, ও তোরা খা, আমি খাবোনা।
… তুর অসুখ তো ভাল্লো হুয়ে যাবেক ইবার,
তু খাইয়ে লে বাবু।
মনে হলো সত্যিই তো পেটটা যেনো অনেক হালকা হয়ে গেছে। তেলেভাজা খেয়েই বেরিয়ে পড়লাম। এক পাক খেয়ে পাহাড় পেরিয়ে পাকা রাস্তায় এসে বাসে চাপলাম। সারাদিনে দুটো মাত্র বাস। মোবাইলে টাওয়ার এলো একটু পরে। সেই শব্দ গুলো গুগুল ট্রানসেলেটর-এ ফেলে খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেলাম বাংলা মানে,
'এটা তোমার জন্য, তুমি এখন সুস্থ।' শব্দ গুলো গ্রিক শব্দ। মাথার ভিতরের জট যেনো খুলতে শুরু করেছে। 'স্ফিংস'টা ব্যাগ থেকে বার ক'রলাম, হাতে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে মনে হলো, 'এটা আমার জন্য, আমি এখন সুস্থ'। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে মনে পড়ে গেলো আরও কয়েকটা শব্দ 'ফিনিক্স' অর্থাৎ আগুন পাখি, প্রাচীন মিশরের সূর্যের দেবতা 'রা'। এই পাখি মঙ্গলময়। মিশরীয় উপকথা গুলো মনে পড়ে যেতে লাগলো একে একে। মিশরে প্রাচীন কাল হায়রোগ্লিফিক-লিপির ব্যবহার হতো, তবে ভাষা হিসাবে মিশরীয় এবং গ্রিকভাষার প্রচলন ছিলো। এ পাখির মৃত্যু নেই, হাজার বছরেরও বেশি আয়ু। সবার মঙ্গল করে,
দুঃখ বিনাশ করে এই পাখি। অবশেষে মৃত্যুদ্যুত এলে, নিজেই আগুন জ্বেলে সেই আগুনে নিজেই মৃত্যু বরণ করে কিন্তু মৃত্যুদ্যুতের হাতে নিজেকে কখনো অর্পণ করেনা। পুনরায় নিজের দেহভস্ম থেকে নিজেই নিজের নবজন্ম দেয়।
কেমন একটা অদ্ভুত বিস্ময়ের মধ্যে কতো সময় ডুবেছিলাম খেয়াল নেই। পাশের লোকের খোঁচায় ঘোর কাটলো,
… 'উঠুন দাদা নামতে হবে, এসে গেছি তো পুরুলিয়া'।
এবার ট্রেনে বসে চোখ বুজে গা এলিয়ে দিলাম সিটে। মনে মনে ভাবলাম আগামী বছর ওখানে গিয়ে ওই পিরামিড মন্দিরের ইতিহাসটা ঘেঁটে বার করতে হবে,
উদ্ঘাটন করতে হবে রহস্য।
অসাধারণ ...হারিয়ে গেছিলাম পড়তে পড়তে।
ReplyDelete