Saturday, April 4, 2020

সুজাতা মিশ্র(সুজান মিঠি)



ছোটগল্প-

মোনা-লিসা



শুভ্র জ্যোৎস্নার শান্ত প্রকৃতি যখন গড়াগড়ি খেলে আবেগে, ঠিক তখন সুরের ঢেউ ঢেলে দেয় মোনার বাঁশি। কখনো বুড়ো বটের নীচের বড় শিকড়ের উপর বসে গাছের গায়ে হেলান দিয়ে কখনো বসন্তে ফাগুন বুকে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষ্ণচূড়ার মাটিতে কিংবা কখনো ঘেসো জমির উপর চোখ বুজে সে সুরের স্রোত তুলে যায় চাঁদের গায়ে, বাতাসের গায়ে, আবেগের গায়ে।

                      ক্লাসের মধ্যে বারবার আনমনা হয়ে পড়া, শাস্তি পাওয়া মোনা একদিন পুরোপুরি ছেড়েই দিল স্কুল। বাবা মা অনেক বোঝানোর পরেও যখন কিছুতেই পারলেন না স্কুল-মুখো করতে, তখন চাইলেন অন্তত ভালো ঘরে পাত্রস্ত করতে। কিন্তু জন্মলগ্নেই যে মেয়ে কেঁদে উঠেছিল সুরে, সে কী আর তার মায়াজাল থেকে বেরিয়ে আবদ্ধ হতে পারে স্বামী-শ্বশুরবাড়িতে! এ পাড়া ও পাড়া গাছতলা সবখানেই রাতের নিস্তব্ধতাকে ভেঙে দিল তার সুর।

বাবা বললেন, 'ওরে তুই মেয়ে কেন হলি রে মা!'

মা বললেন, 'পোড়ারমুখী, মরবি তুই!'

দাদা বললো, 'রোজ রোজ এসব আর ভালো লাগে না মোনা। কাল থেকে বেরোলে তোকে মেরে পাট করে দেব বলে দিলাম!'

এরপরেও চুপিচুপি মাঝরাতে বাড়ি ফেরা মোনা আদর পায় বাবার। সকালে দাদা জানতে পারে মায়ের কাছে, ঘরে তালা দিয়ে রাখে। তারায় ভরা রাত জোনাকির রাত অপেক্ষা করে সুরের। প্রহর ডাকা পাখির আওয়াজের আড়ালে বাবা খুলে দেয় দরজা। হাতে বাঁশি নিয়ে ছোটে মোনা।

                     মাধবী মোনার বন্ধু, ওকে জিজ্ঞেস করে, 'কেন রে মোনা কেবল রাতেই তুই বাজাস বাঁশি? কেন তাও বাইরে?' এর কোনো উত্তর নেই মোনার কাছে, কোন টানে কোন মায়ায় সে ছুটে যায়, সে জানেনা নিজেও।



মায়ের আশঙ্কাই সত্যি হলো একদিন। বাঁশবাগানের কাছে কারা যেন তার বাঁশির সুরকে টুকরো টুকরো করে রেখে গেছে। বুক চাপড়ে কাঁদতে কাঁদতে মা বললেন, 'সব হয়েছে ওর বাবার জন্য। ওর আস্কারায়। এবার কী হবে গো আমাদের? এবার কী হবে এই মেয়ে নিয়ে আমাদের?'

এক সপ্তাহ বাড়ির বাইরে গেল না মেয়ে, বাঁশি বাজলো না কোথাও। সপ্তাহের শেষদিন বুড়ো বটের একটু দূরে দাউদাউ করে জ্বললো আগুন। সেদিন অমাবস্যার অন্ধকার কাঁদলো আলোর বিকট গন্ধে, পুড়ে ছাই হলো মোনা।

পাগল হলো বাবা।

                         বছর খানেক বাদে দাদা-বৌদির সন্তান লিসা জন্মগ্রহণ করলো পৃথিবীতে। দুই বছর বয়সে কচি কচি পায়ে টলমল করতে করতে বাগান থেকে কুড়িয়ে পেল বাঁশি। ফুঁ দিল তাতে, বেজে উঠলো অদ্ভুত মিষ্টি সুর। ছুটে এলো লিসার বাবা, ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললো, 'খবরদার বাড়িতে যদি একটাও বাঁশির টুকরো থাকে তো!' ভয় পেল লিসার মা। বুকে জড়িয়ে ধরলো মেয়েকে।

কুড়ি বছর পরে পাড়ার তারক মহাজন খুন হলো। তারপর কিছুদিন বাদে মানিক। দুজনেই এলাকায় ভীষণ বাজে লোক হিসেবেই পরিচিত অনেক আগে থেকেই। নানারকম মামলাও চলতো তাদের নামে। জেলও খেটেছে দু একবার। লিসার বাবা তার মাকে বললো, 'মা গ্রামের অবস্থা ভালো নয়। আমি কলকাতায় বাড়ি কিনছি, চলে যাবো। তুমিও বাবাকে নিয়ে প্রস্তুত হয়ো।'

পূর্ণাঙ্গ তদন্তের শেষে পুলিশ অফিসার লিসার বাড়ি ঘিরে ফেললো। গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেল থানায়। বড়বাবু বললেন,  'তুমি কেন ওদের খুন করলে? ওরা খুব খারাপ জানি, তাও ওরা তোমার সঙ্গে কী কিছু করেছিল? বলো আমাকে!'

লিসা নিরুত্তর।

মামলা আদালতে উঠলো। বিচারপতি আসামি লিসার দিকে তাকিয়ে বললেন, 'তোমার নাম কী?'

লিসা কিছুটা চুপ থেকে উত্তর দিল- 'মোনালিসা।'



হঠাৎ আদালতে ছুটে এসে ঢুকলো লিসার দাদু, হাতে ছোট এক বাঁশি, লিসার দিকে তা ছুঁড়ে দিয়ে চিৎকার করে বললো, 'জজসাহেব, ও ফিনিক্স! ও ফিনিক্স! ও ফিনিক্স!'

ততক্ষণে লিসার ঠোঁটে বেজে উঠেছে মোনার সুর।

No comments:

Post a Comment