ছোটগল্প-
প্রিজনার
আজ অনেকদিন পরে আলবেসের ফোনটা পেয়েই চৈতালী চনমন করে উঠল। ফোনের ওপ্রান্তে আলবেসের গলার টোন শুনেই বুঝতে পেরেছে শুভ কিছু ঘটতে চলেছে। একটা দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষার যেন সুন্দর ফসল ফলল।
বেশ কদিন ধরেই আলবেস ফোন করছে। আলবেসের ফোন আসে। কথা বলে চৈতালী। কিন্তু প্রতিটি ফোনেই কোন পজিটিভ কিছু আসেনা। আজ ওর ফোনটা পেয়েই চৈতালীর মুখের জ্যামিতি যেন বদলে গেল। আজ বহুদিন পরে যেন ওদের সকলের ইচ্ছে পূরণ হতে চলেছে।
ওদের বলতে চৈতালী , আলবেস , তমজিৎ , ইরফান আর গুরু সিং। ওদের সকলের মনের একটা সুপ্ত বাসনা ছিল মিউজিকের ব্যাণ্ড তৈরী করা ও সেই ব্যাণ্ডের একটা বড়সড় স্টেজ পারফর্ম। মিউজিক ব্যাণ্ড যদিও হল অনেক লড়াইয়ের পর। কিন্তু কিছুতেই বিশাল মাপের স্টেজ পারফর্ম করা যাচ্ছিল না। কোথায় যেন আটকে যাচ্ছিল। আজ আলবেসের ফোন চৈতালীর কানে স্টেজ পারফরম্যান্সের বার্তাই নিয়ে আসল। চৈতালী তাই ভীষণ খুশী।
হাতে গোনা আর মাত্র কটা দিন। তারপর ওদের , এই পঞ্চ পাণ্ডবের একটা ইচ্ছে পূরণের , নিজেদের লক্ষ্যে পৌঁছানোর গল্প শোনানোর দিন শুরু। চৈতালীর চোখের কোণ চিকচিক করে উঠল আবেগে।
কদিন পরেই ওদের " প্রিজনার " ব্যাণ্ডের প্রথম বড় রকমের পাবলিক শো হতে চলেছে। অনেক লড়াইয়ের পর যেন একটা মাইল স্টোন পেরনো গেল। যেন এক ইতিহাসের শুরু।
আলবেস , চৈতালী, ইরফান, তমজিৎ আর গুরু সিং এই পাঁচজনের একটা মিউজিকের দল। এরা কেউ কাউকে চিনত না। না ছিল কোন পৃর্ব পরিচয়। বিধাতায় একদিন এদের পাঁচজনকে মিলিয়ে দিল। শৈশবের সামান্য ভুল আর অবৈধ কিছু কাজ কারবারের জন্য এদের সবাইকে একদিন জেলে যেতে হয়। তারপর এ জেল ও জেল ঘুরে সব শেষে স্থান হয় আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে।
ওদের পাঁচজনের বেশ মিল রয়েছে। ওরা পাঁচজনই অনাথ। ওদের পূর্ব পুরুষের কোন কিছুই ওরা জানেনা। পাঁচ জনেই কোন না কোন ভাবে কেউ ফুটপাতে কেউ বাড়ির বারান্দায় , কেউ খোলা আকাশের নীচে শুয়ে তারা দেখে দিন কাটিয়েছে। কখনো বা অভুক্ত পেটে।
চৈতালী একটা সময় বড় ব্যাংক রবারীর ইনফরমার হিসেবে কাজ করত। হাতে পয়সা আসার পর লোভ জাগতে থাকে। পরে ঐ লোভই ওর সব শেষ করে দেয়। ও ধরা পরে যায়। আর ওর জেল হয়।
তমজিৎ একটা প্রোমোটারের আণ্ডারে কাজ করত। সেই প্রোমোটার অনেক অবৈধ কাজে লিপ্ত হলে প্রোমোটার ধরা পড়লে তমজিৎও ধরা পড়ে। ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাসে তমজিৎকে জেলের চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দী জীবন কাটাতে হয়।
ইরফান গরু পাচারকারীর হয়ে কাজ করত। ও জানতই না ও এই নোংরা কাজ করত। পরে ওর মালিক ধরা পড়লে ও ধরা পড়ে যায়।
আলবেস খুব ছোট থেকেই ড্রাগ পাচারকারীর হয়ে কাজ করত। পরে নিজেই ড্রাগের মারণ নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়।ওর কপালেও শাস্তি জোটে।
গুরু সিং এর ব্যাপারটা সবার থেকে আলাদা। গুরু আসলে পাকিস্তানের লাহোরের ছেলে। খুব ছোটতে ও এক বন্ধুর মুখে দিল্লী শহরের গল্প শোনে। দিল্লী শহরের গল্প শোনার পর ওর মনে দিল্লী দেখার সাধ জাগে। নিজের সুপ্ত বাসনাকে চরিতার্থ করার জন্য কোন কারণে পাকিস্তানের সীমান্ত পেরিয়ে গুরু ভারতে চলে আসে। তারপর ধরা পড়ে যায়।
ওদের পঞ্চপাণ্ডবের আরো এক জায়গায় মিল রয়েছে। ওরা প্রত্যেকে ভাল মিউজিক বাজায়। গান করে। গুরু গিটার খুব সুন্দর বাজায়। আলবেস সিন্থসাইজারে দারুণ দক্ষ। ইরফানের বেস গিটারের হাত বেশ ঝকঝকে।তেমনি ভাল ড্রামার। তমজিৎ এর সাউণ্ড সিস্টেমের উপর দারূণ দখল। ভাল গানও করে। আর চৈতালীর ঈশ্বর প্রদত্ত গানের গলা। ঐ লিড সিঙ্গার ব্যাণ্ডের।
একটা সময় জেল থেকে বেরিয়েই এদের সবার পরিচয় হয় লোকাল ট্রেনে। সে ও অনেকদিন আগের কথা।
.... ...... ... .....
... ..... .... ......
লোকাল ট্রেনের ব্যস্ত ট্রেনের কামরা। মুখোমুখি বসে পাঁচজন তরুণ তরুণী। ওরা কেউ কাউকে চেনে না। একটা করে স্টেশন এগিয়ে আসছে। আর ট্রেন একটু একটু করে ফাকা হচ্ছে।
বেশ কিছুক্ষণ পরে ট্রেনের কমপার্টমেন্ট অনেকটাই ফাকা হয়ে গেলে ঐ পাঁচজন তরুণ তরুণীর একজন তরুণী আপণমনে গুনগুন করে গান করতে লাগল। মেয়েটির গান শুনে বাকি চারজন কেমন নড়েচড়ে বসল। মেয়েটির নাম চৈতালী। চৈতালীর গান সকলকে মুগ্ধ করে। চৈতালীর গানের তালে তালেই ট্রেনের সিটেই ইরফান ড্রাম বাজানোর মতন করে কাঠের সিটটা বাজাতে থাকে। এরপর আর কিছু করতে হয়নি। একে একে গানের সাথে তাল মেলায় গুরু , তম আর আলবেস। একটা খুব সুন্দর জমকালো মিউজিক্যাল পরিবেশ তৈরী হয়।
খানিক পরিচয় পর্বের পর ওরা পাঁচজন বুঝে যায় ওদের সকলের জীবন রেখা একই দিকে প্রবাহমান। ওরা এটাও বোঝে ওদের পাঁচজন কেউ কাউকে ছেড়ে থাকতে পারবে না এক সেকেণ্ডের জন্য। কারণ ওদের সকলের লক্ষ্য এক। সেই শুরু হল পথ চলা। পাঁচটি না খেতে পাওয়া হাত , অভুক্ত পেট অমলিন , নিষ্পাপ হৃদয় মিলে মিশে একাকার হয়ে গেল।
এরা সবাই ভাল মিউজিক বাজায়। গুরু সিংই একটা ব্যাণ্ড করার কথা বলে। গুরুর কথাটা সবাই লুফে নেয়। পাঁচটা হাতের মুঠো একটা প্রবল শক্তি তৈরী করে।
সেই শুরু .... ..... .......
এরপর কাজের খোঁজে বেরিয়ে পড়া। খুব অল্প সময়ের মধ্যে ওরা সবাই কাজও পেয়ে যায়। কেউ হোটেলে কেউ বা চার্চে। আবার কেউবা কোন সংগীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এমনি করেই এগিয়ে যেতে থাকে দিন।
তারপর আস্তে আস্তে সব কিছু গোছানো শুরু হয়। যেহেতু ওরা সবাই একটা সময়ে বন্দী জীবন কাটিয়েছে তাই ওরা ওদের ব্যাণ্ডের নাম দেয় " প্রিজনার "।
অল্প কিছুদিনের মধ্যেই " প্রিজনার " অন্য তথাকথিত নামী ব্যাণ্ডের পিছনে ফেলে নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে। অবশেষে বড় রকমের স্টেজ শো করার পরিকল্পনা আলবেসের মাথায় আসে। এর জন্য আলবেসকে অনেক ঘাম রক্ত ঝরাতে হয়।
অনেক লড়াইয়ের পর আলবেসদের ব্যাণ্ড নেতাজী ইন্ডোর স্টেডিয়ামে স্টেজ শো করার ছাড়পত্র পায়। ঠিক হয় সামনের জুন মাসেই হবে স্টেজ শো। আর সেটা হবে মাইকেল জ্যাকশনের মৃত্যু দিনকে স্মরণ রেখে।
..... ..... ......
অবশেষে বহু প্রতীক্ষার অবসান হল। আজ মাইকেল জ্যাকশনের মৃত্যুদিন। আজ " প্রিজনার " ব্যাণ্ডের প্রথম বড় পাবলিক শো। পাঁচজনের শিরায় শিরায় বোহেমিয়ান শিহরণ। সকলের চোখে ভিসুভিয়াসের মতন জ্বলে ওঠার স্বপ্ন। শরীরের ভিতরে লাভাস্রোত বইছে। আজ সকলের একটা ইচ্ছে পূরণ হতে চলেছে।
নেতাজী ইন্ডোর স্টেডিয়াম ভিড়ে উপচে পড়ছে। চারিদিকে প্রবল উত্তেজনা। টেনসনের পারদ একেবারে তুঙ্গে।
পাঁচ জেলবন্দীর লড়াইয়ের পরিচয় , ভালবাসার পরিচয় ইচ্ছের কথা , স্বপ্নের কথা মানুষ আজ জানতে পারবে আর কয়েক সেকেণ্ড পরে।
নেপথ্যের কারিগর " প্রিজনার "।
ভিসুভিয়াস!
বেরিয়ে আসছে লড়াইয়ের লাভা স্রোত।
ঠিক সন্ধ্যে সাতটা। কাউন্ট ডাউন শুরু।
5 - 4-3-2-1-0
ঝলসে উঠল গুরুর গিটার। সেই সাথে বাকিদের মিউজিকের সুনামী।
একটার পর একটা গান। আর অক্লান্ত হাততালির তুফান। সবাই মন্রমুগ্ধের মত গোগ্রাসে গিলছে সংগীতের সুধা।
ভোর তিনটেই শেষ হল অনুষ্ঠান। একটা স্টেজ শো বদলে দিয়েছে সকলের চোখে মুখের জ্যামিতি।
স্বার্থক হল পাঁচ লড়াকু তরুণ তরুণীর ইচ্ছে পূরণের গল্প লেখার ইতিহাস।
পরের দিন সব খবরের কাগজের পাতায় পাতায় ছেয়ে রয়েছে " প্রিজনার " এর তরুণ তরুণীর ইচ্ছে পূরণের অমর কথা।
শুরু হল আরো একবার নতুন করে পথ চলা।
ভিসুভিয়াস রিয়েলি ঝলসে উঠল।
No comments:
Post a Comment