Saturday, April 4, 2020

অর্ণব গরাই


ছোটগল্প -

দ্বৈত

ঘুমের মধ্যে চিৎকার করে উঠলো শাবানা, এভাবে মাঝে মাঝেই রাতের ঘুমে তার ব্যাঘাত ঘটে । এখনও সেই দু:স্বপ্নের রাত সে কিছুতেই ভুলতে পারেনা । সেই ভয়ঙ্কর রাতের কথা সে কেন হয়তো এই পরিবারের অনেকেই আজও ভুলতে পারেনি ।

মনসুর আলী  একজনের কাছে খাতা লেখার কাজ করে কোনরকমে কায়ক্লেশে দিন গুজরান করে । এপাড়ায় সুনির্মল চৌধুরীদের একতলায় এক মেয়ে,ও এক ছেলে এবং স্ত্রী সহ ভাড়া রয়েছেন প্রায় বছর ষোলো সতেরো হলো ।  মেয়ে শাবানা  বি এ পরীক্ষা পাশ  করে  পাড়ার একটা কম্পিউটার সেন্টারে চাকরীতে ঢুকেছে। আস্তে আস্তে বাপ মেয়ের রোজগারে সংসারে সবে একটু শ্রী ফিরছে । ছেলেও আর বছর দুই পর বি.কম পাশ করলেই হয়তো সেও একটা কোনরকমে চাকরী জোটাতে পারলেই মনসুর আলীর সব চিন্তা দূর হয়ে যাবে ।

বিপদ বোধহয় দরজায় ওঁৎ পেতেই বসেছিল , মন্দির না মসজিদ এই অছিলায় চারিদিকে তখন অগ্নিগর্ভ অবস্থা । বাইরে ১৪৪ ধারা জারি অথচ বাইরে না গেলে পেট চলবে কি করে । মনসুর তাই কোন বাধাই মানেনি , বেড়িয়ে গেছিলো খাবারের খোঁজে , ছেলে মকসুদ বাবাকে একা যেতে দিতে রাজি ছিলোনা তাই সেও গেছিলো বাবার সাথেই । ছোট রাস্তা পেরিয়ে সবে তখন মেন রোড ধরতে যাবে সেদিন তাদের পাড়ায় কিছুজন মিলে আক্রমন করে । বোমা ও গুলির আঘাতে বারা ও ছেলে দুজনেই তৎক্ষনাৎ মারা যায় । খবর ছড়িযে পড়তে দেরি হয়নি । আগুনের মতো হু হু করে আসে পাশে ছড়িয়ে পড়ে । খবর আসে শাবানাদের ঘরেও । আর সাথে সাথেই আক্রমন শানাতে আসে একদল বিক্ষোভকারী ।

শাবানার মা ছুটে এসে পায়ে পড়ে সুনির্মলবাবুর পায়ে । দাদা, আমাদের বাঁচান । জানিনা কি অন্যায় করেছি । সবই তো চলে গেছে, এইটুকু অন্তত বাঁচান । শাবানার বাবাকে আর দাদাকে গোর দিতে পারবো কিনা জানিনা, তার মধ্যে এতবড় সোমত্ত মেয়ে । নিথর সুনির্মলবাবু কি বলবেন বুঝতে পারছেননা, ঠিক কি ভাষায় স্বান্তনা দিলে এই মুহুর্তে মানুষগুলোকে স্বস্তি দেওয়া যায় তা তার অজানা । অজানা কি উপায়ে এদের বাঁচানো যায় । এদিকে বাইরে ক্রমাগত উত্তাপ বেড়ে চলছে । একের পর এক হুমকি ধেয়ে আসছে মনসুরের পরিবারের জন্য । সুনির্মল কি করবে বা কি করা উচিৎ কিছুই বুঝে উঠতে পারছেনা । তার মধ্যেই ছেলে অনির্বাণ দুম করে দরজাটা খুলে দেয় । বাইরে তখন প্রবল উত্তেজনা, ঘরের এক কোণে শাবানা আর সফিয়া দুজনেই সেঁধিয়ে আছে । অনির্বাণের সাথে তর্কাতকি চলছে প্রবল । ওরা দরজা পেরিয়ে শাবানাদের নাগালের মধ্যে পেতে চাইছে । পুলিশকে যে ফোন করবে সে উপায়ও ততক্ষনে তারা ধুলিস্যাৎ করে দিয়েছে । দাঙ্গায় আর কিছু না হোক ক্ষতি হয়েছে বিস্তর । ঘরবাড়ি, দোকান , টেলিফোনের লাইন সহ একাধিক জিনিষ নষ্ট করে ফেলেছে দাঙ্গাকারীরা ।

সাংঘাতিক কান্ডটা ঘটিয়ে ফেললেন সফিয়া, একদৌড়ে অনির্বাণকে একধাক্কায় ঠেলে সোজাসুজি মুখোমুখি হলেন সফিয়া । অনির্বাণ কিছু বুঝে ওঠার আগেই দাঙ্গাকারীদের হাতের নাগালের মধ্যে সফিয়া । পাগলের মতো চিৎকার করতে থাকে, সব খেয়েছিস আমার, হিম্মত থাকলে আমাকে মেরে দেখা । এরপর যা হওয়া উচিৎ ছিল তাই হলো, আগুনে ঘি পড়লো । সফিয়ার রক্তাক্ত দেহ সুনির্মলদের বাড়ীর উঠোনে । শাবানার চোখে মুখে আতঙ্কর ছাপ স্পষ্ট । কেঁদে কেঁদে চোখ মুখ ফুলে উঠেছে । ওরা শাবানাকেও চাই । বংশের ধ্বংস না দেখে যাবেনা কিছুতেই । শাবানাও বাইরে যেতে চাইলে আগলে ধরেন সুনির্মলের স্ত্রী সুধা দেবী । একটু আস্তেই আড়ালে ডেকে নেন সুনির্মলকে । বলছি এদের তো সব শেষ হলো, এবারে কি এই মেয়েটাকেও এরা শেষ করবে নাকি? সুনির্মলবাবু হতবাক হয়ে হ্যাঁ সূচক ঘাড় হেলান । আতঙ্কে কেঁপে ওঠেন সুধা, বলেন একটা কথা ছিল । সুনির্মল তাকান সুধার দিকে । সুধা চাপাস্বরে বলেন, বলছি মেয়েটাকে বাঁচানোর লি কোন উপায় নেই । সুনির্মল বলেন ইশ্বর জানেন, আমি তো কোন উপায় দেখছিনা । যদি আমি কোন উপায় বলে দিই, সুধার কথায় অবাক দৃষ্টিতে তাকান সুনির্মল । বলছি অনির সাথে শাবানার যদি বিয়ে দিয়অ দিই তাহলে তো ও হিন্দুই হয়ে যাবে নাকি? সুনির্মল উত্তেজনায় জড়িয়ে ধরেন সুধাকে । এতক্ষন তো এটা ভাবিনি । কিন্তু শাবানা কি রাজি হবে? হতেই হবে, আমি করাবো রাজি তাকে বলেন সুধা দেবী ।

দেখ মা, গোর আর কেউ নেই । এখন আমরাই তোর সব । তাই যা বললাম সেটা তোর ভালোর জন্যই ।এছাড়া আমাদের কাছে তোকে বাঁচানোর মত আর কোন রাস্তায় খোলা নেই । আর হ্যাঁ, এজন্য তোকে তোর নিজস্বতা হারাতে হবেনা, তুই যেমন আছিস তেমন থাকবি । নমাজ পড়বি, ঈদ করবি । সব করবি । শুধু বাইরে একজন হিন্দু সেজে থাকবি । ঘরে তুই সেই শাবানাই থাকবি । পাশ থেকে সুনির্মলও বলেন, মা রে এছাড়া যে আমাদের আর কোন উপায় নেই । এই বুড়োবুড়িও যে তোর বাবা মায়ের মতনই । অনিও বাবা মায়ের কথার অমান্য করেনি । সে তো আগে থাকতেই শাবানাকে মনে মনে ভালোবাসতো, শুধু কোনদিন কিছু বলতে পারেনি । কি জানি শাবানারও সেরকম কিছু আছে কিনা । আছড়ে পড়ে শাবানা সুধাদেবীর পায়ে,কিন্তু আমার বাবা মা, ভাই? ভরসা দেন সুনির্মল । আমি ব্যাবস্থা করছি ।

পরেরদিন সকালে এক এক করে তিনজনের দেহ গোর দেওয়া হলে তার পরেরদিন শাবানাকে বিয়ে করে অনির্বাণ । শাবানাকে তার নিজস্বতা হারাতে হয়নি, চৌধুরী বাড়ীর কেউ এব্যাপারে কোনদিনই জোর করেনি । আজ দশ বছর হয়ে গেছে, সুধাদেবী চলে যাবার পর এই সংসারে বাবা ছেলের যাবতীয় দায়িত্ব শাবানার কাঁধেই । শাবানা এখনও নমাজ পরে , ঈদ পালন করে । শাবানা বৃহস্পতিবারে লক্ষীপূজোও করে । তার এই দ্বৈত ভূমিকায় অনির্বাণ বা সুনির্মলও যারপরনাই খুশী । শুধু সুধাদেবীর অনুপস্থিতি বড় কুড়েকুড়ে খায় শাবানাকে ।

No comments:

Post a Comment