বড়গল্প-
জীবন মৃত্যু
অবিনাশী তু তৎ বিদ্ধি ,
যেন সর্বম্ ইদম্ ততম্ ,
বিনাশম্ অভ্যাস্যাস্য ,
ন কশ্চিৎ করতুম্ অরহতি ।।
অর্থাৎ , সমস্ত যদি নষ্টও করে ফেলা যায় , তবু আত্মার বিনাশ সম্ভব নয় । এই বলে মুখ তুলে
আমাদের দিকে তাকালেন ব্রজেশ তিওয়ারী । আমি আর মিঃ পুরী তাঁর টেবিলের সামনে বসে ।
বিখ্যাত বৈজ্ঞানিকের মুখ গম্ভীর । বললেন ,
-- আপ লোগোকো সমঝানে কে লিয়ে হমারে ভারত কা
পুরাণ মে আত্মা কে বারে মে জো জ্ঞান থা ও বোলে ।
আমি কথা কেটে বললাম ,
-- লেকিন স্যর হম একবিংশ শতাব্দী মে বৈঠকর বাতে
কর রহে হ্যায় ।
-- তো পর ভী , আজ ভী নহী জানতে প্রাণ ক্যা হ্যায় ! আত্মা তো
উস সে ভী সূক্ষ্ম বাত হ্যায় ব্যানার্জী সাহাব ।
কথা গুলো অতীব সত্য , একথা আমাদের
মানতেই হবে । কেননা আজও বিজ্ঞান ভেবে বার করতে পারেনি প্রাণ কী বস্তু ! কেমন ভাবে
তা জীব দেহে তৈরী হয় । কিসের দ্বারা তৈরী হয় । তবু ভারতে আমাদের পূর্ব পুরুষেরা
প্রাণ বিষয়ে অনেক এগিয়ে ছিলেন । আমার কথা কেটে মিঃ পুরী বললেন ,
-- সচ , ক্যা হ্যায় ও একস্ট্রা জ্ঞান মিঃ তিওয়ারী ?
উনি বললেন , মান্ডুক্যাপনিষদে বলা হয়েছেঃ
এসো 'নর সেতাসা ভেদিতাভ্য , যস্মিন প্রাণাহ
পনসধা সামবিভেসা , প্রাণ ইস সিত্তাম
শ্রভম্ ওতাম্ প্রাণায়ম্ , যস্মিন বিশুদ্ধে
বিভাবতী এসা আত্মা ।।
অর্থাৎ আত্মা পরমাণু সদৃশ্যই সূক্ষ্ম এবং তা
একমাত্র অন্তর্দৃষ্টি দ্বারাই প্রত্যক্ষ করা সম্ভব । এই পারমাণবিক আত্মা পঞ্চ বায়ূ
অর্থাৎ --- প্রাণ , আপন , বান , সমান ও উদন --- এরা যখন হৃদযন্ত্রে সঠিক ভাবে সজ্জিত হয় এবং এর স্পন্দন সমস্ত
দেহে সঞ্চারিত করে দেয় তখনই সজীবতার সৃষ্টি হয় জীব দেহে !
-- লেকিন স্যর হম আধুনিক জমানে মে মেডিক্যাল
সায়েন্স কা খেয়াল পুছনে আয়ে থে ।
মিঃ পুরীর প্রশ্নে তিনি জানালেন , চিকিৎসা বিজ্ঞানে জীবন হল তাপ গতীয় অসাম্য ।
জীবনের উদ্দেশ্য হল প্রকৃতিতে একটা তাপ গতীয় অসাম্য তৈরী করা । আর মৃত্যু হল তার
ঠিক উল্টোটা । তাপ গতীয় স্থিতি । সমস্ত জৈব রাসায়নিক ক্রিয়া বিক্রিয়ার চিরতরে বন্ধ
হওয়া । তাই মৃত্যুতে আমাদের দেহ অন্যান্য জড় পদার্থের মত স্থির ও ঠান্ডা হয়ে যায়
। নোবেল বিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ক্রীকের মতে আত্মা হল মন ! আর মন হল মস্তিষ্কের
স্নায়ূকোষ । তার মৃত্যুই তাই মনের মৃত্যু ও সেই সঙ্গে নশ্বর আত্মারও ।
-- আর আপনাদের জিজ্ঞাস্য তো সেই তাপ গতীয়
অসাম্যতা কি জীবদেহে ফিরিয়ে আনা যায় ? এ বিষয়ে বলি , হ্যাঁ যায় ।
অ্যান্টিডোটের আবিস্কার এই কাজেই ব্যবহৃত হয় । তবে তার প্রয়োগ সময় থাকতে করতে হয়
।
আমি আর মিঃ পুরী তাঁর মুখের দিকে হতভম্বের মত
চেয়ে রইলাম ।
এ কেসের মাথা মুন্ডু কিছুই এখনো আমার মগজে ঢোকেনি । কেবল বর্তমান
সিচুয়েশনটা অদ্ভুত বলে বুঝতে পারছি । হোম ডিপার্টমেন্টের একটা সেল আছে যারা সারা
দেশের অস্বাভাবিক ঘটনা নিয়ে তদন্ত চালায় । মিঃ পুরী সেই ডিপার্টমেন্টের একজন কর্তা
ব্যক্তি । আমায় হোম সেক্রেটারী মারফৎ ডেকে এনেছেন এই অদ্ভুত পরিস্থিতিতে ।
ব্যাপারটা এসেছে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে ।
বেশ কিছুদিন যাবৎ হঠাৎ দেখা যাচ্ছে যে পোলিও
মুক্ত সার্টিফিকেট পাওয়া সত্ত্বেও ফের তা ধরা পড়তে শুরু করেছে । স্বাস্থ্য
বিভাগের গোপন রিপোর্ট বলছে , এটা উত্তর ভারতেই
বেশি করে দেখা যাচ্ছে । কমপ্লিট পোলিও কোর্স দেওয়া সত্ত্বেও কম বয়সী শিশুদের মধ্যে
পোলিও দেখা দিচ্ছে ! এর কারণ কি ? পোলিও কি করে
পুনরায় সক্রিয় হয়ে পড়ছে শরীরে ! ইউনিসেফ , বিশ্ব স্বাস্থ্য সংগঠনও ভীষণ ভাবে চিন্তিত
।
আমি প্রায় চব্বিশ ঘন্টা হল এর কারণ খুঁজে পাইনি
। তবে হাল ছাড়ছি নে । ব্রজেশ তিওয়ারীর সঙ্গে কথা বলার পর একটা পথ আমার মাথার
মধ্যে উঁকি ঝুকি মারতে শুরু করেছে ।
রাতে রেস্ট হাউসে ফিরে খাবার পর গুম মেরে বসে
রইলাম বারান্দায় । সামনের গাছপালাও আজ গুম মেরে রয়েছে । দেশের লাখ লাখ বাচ্চার
ভবিষ্যতের ব্যাপার ! কী হতে পারে ? বৈজ্ঞানিক কথা
প্রসঙ্গে একটা নাম উল্লেখ করেছিলেন , ডঃ জীবক ঘোষদস্তিদার । কে এই ডঃ ? উঠে পড়ে ঘরের ভিতরে এলাম । কম্পিউটার খুলে গুগুলে সার্চ দেবার পর আর ঘুম এলনা
!
ডঃ ঘোষদস্তিদার দিল্লীতে এক অষুধ কোম্পানীর ল্যাবতে
কাজ করতেন । গত ১৯৭৬- এর এক গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় ল্যাব থেকে বেরোবার পথে হঠাৎ পড়ে
অজ্ঞান হয়ে যান ও সেই খানেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান । সেই সময় তাঁর ব্যাগ
থেকে কিছু কাগজপত্র উধাও হয়ে যায় । যা তাঁর কম্প্যুটারে সেভ করা ছিলনা ! এই
অবস্থায় পুলিশ আসে ও লাশ মর্গে যায় ।
ময়না তদন্তে দেখা যায় হৃদরোগ নয় , আর্সেনিক ট্রাইহাইড্রাইড ! যা নিঃশ্বাসের
মাধ্যমে শরীরে ঢুকলে সরাসরি রক্তের লোহিত কণাকে ধ্বংস করে দেয় । আধ ঘন্টার মধ্যেই
শরীর থেকে অদৃশ্য হয়ে যায় এই বিষ । তবে লক্ষণ রয়ে যায় দেহে । ডঃ ঘোষদস্তিদারের
পুরুষাঙ্গের মধ্যে ও প্যান্টে রক্ত স্রাবের দাগ তারই প্রমাণ !
১৯৭৬- এ পুলিশী তদন্তে ল্যাবের তিনজন অ্যাসিসট্যান্ট বিজ্ঞানীর চাকরি যায় ।
কারণ এই তিনজনের মুখে মাস্ক ছিল সেই সময় । স্বীকার না করলেও এদের মধ্যে কেউ নিশ্চই
গ্যাস স্প্রে করবার সুযোগ পেয়েছিল সেদিন । কেসের আজও সমাধান হয়নি । আমি ডঃ
ঘোষদস্তিদারের গবেষণার বিষয়ে ঘাঁটতে ঘাঁটতে জানতে পারি , তিনি অ্যান্টিডোট বানাবার পদ্ধতির উন্নতি
সম্পর্কে গবেষণা করছিলেন । সফল হয়ে ছিলেন কি ? আমার মনে হল বোধহয় !
মনের মধ্যে কাঁটাটা খচ খচ করতে থাকায় আমি আবার
গিয়েছিলাম ডঃ তিওয়ারীর কাছে । কথা বলে বুঝতে পারলাম ঘটনাটা প্রাকৃতিক নয় ।
লজিক্যালি বাচ্চাদের শরীরে ঢোকানো নিস্তেজ পোলিও ভায়রাসের ডি এন এ - র অবয়ব আবার
আগের অবস্থায় ফিরে আসার অর্থ হল অ্যান্টিডোট , যা বাচ্চাদের শরীরে কোন ভাবে ঢোকানো হয়েছে
।
পরের দিন মিঃ পুরী এলে তাকে জিজ্ঞেস করে জানলাম
, যে সব বাচ্চাদের মধ্যে
পোলিও দেখা দিচ্ছে তা দিল্লী ও উত্তরাখন্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ । আমি মিঃ পুরীকে
বললাম পোলিও আক্রান্ত বাচ্চাদের দেওয়া ওষুধ পত্রের একটা লিস্ট বানাতে । খুব দ্রুত
কাজটা সারা হল ।
এরপর যেটা ঘটল তা যেন ঝড় ! বাচ্চাদের দেওয়া ওষুধের মধ্যে পাওয়া গেল ,
ফলিক অ্যাসিড ও ভিটামিন
সিরাপ ; প্যারাসিটামল ও
অ্যান্টিবাওটিকের বাচ্চাদের ডোজের ট্যাবলেট । আমি লিস্টটা নিয়ে ভীষণ ভাবে চিন্তা
ভাবনা ও গবেষণা শুরু করে দিলাম । এবং একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম যে , যাদের ফলিক অ্যাসিড সিরাপ দেওয়া হয়েছে তাদের
মধ্যেই শুধু দেখা যাচ্ছে পোলিও হবার লক্ষণ !
এরপর আমার আগ্রহে স্বাস্থ্য বিভাগ জানালো ,
ঐ সিরাপ সাপ্লাই হয়
দিল্লী ও আম্বালা থেকে । আমার আগ্রহে সেই সব ওষুধ বানানোর কোম্পানীর স্টক ও সরকারী
মেডিসিন স্টোর থেকে সর্ব স্তরের স্টক তুলে নিয়ে আসা হল । ল্যাব টেস্টে একটি
কোম্পানীর বানানো সিরাপে পাওয়া গেল অজানা বস্তু ! কিন্তু ঐ এলিমেন্ট যে কী তা ঠিক
বোঝা গেলনা । কোম্পানীটি কে সীল করে দিয়েছে সি বি আই ।
এরপর কোম্পানীর প্রতিটি কর্মচারী ও
বৈজ্ঞানিকদের বায়োডাটা ও দৈনন্দিন কাজকর্ম ও গতিবিধি ট্রেস করতে শুরু করলে সি বি
আই । তাতেই উঠে এল একটা অদ্ভুত তথ্য । যার মধ্যে আমি খুঁজে পেলাম একটা নাম ,
ডঃ রাকেশ শর্মা ।
আমার মাথায় একটা খচ খচানি যেন আর থামছেই না ।
কোথায় যেন শুনেছি নামটা ? হঠাৎ মনে পড়ল ডঃ
ঘোষদস্তিদারের মার্ডার কেসটা । আরে তিনজন সাসপেন্ড হয়ে যাওয়া তরুন বিজ্ঞানীর একজন
না ? আমি ফের বসলাম কম্প্যুটার
নিয়ে । প্রায় রাত একটায় ফোন করলাম হোম সেক্রেটারী অফিসে মিঃ পুরীকে ধরলাম ভায়া
অফিসি । তারা সি বি আই ও এনফোর্সমেন্ট বিভাগে যোগাযোগ করলে দ্রুত ।
পরের দিন যখন স্বাস্থ্য দপ্তরে পৌঁছালাম , মিঃ পুরী কান এঁটো করা হাসি হেসে বললেন ,
-- এট লাস্ট উই হ্যাব ডান মিঃ ব্যানার্জী । হি
হ্যাজ কনফেসড ।
-- বাট হোয়াই দিজ ?
-- আরে ইয়ার ওহ অ্যান্টিডোট কা রেজাল্ট চেক কর
রহা থা !
আমি বিস্ময়ে একেবারে হতবাক হয়ে রইলাম।
ভালো। খুব ভালো বলবো না
ReplyDelete