গল্প-
বাচ্চু
বদরপুরে নতুন খুব একটা কেউ আসেনা। আসবেই বা কেন, শহর না বলে গঞ্জ বললেই ঠিক হবে। মেরেকেটে তিরিশ হাজার লোক হবে কিনা সন্দেহ। তবে দু দুটো প্রধান শহরের সাথে সড়ক আর রেলপথে যোগাযোগ থাকায়, চাকুরীজীবী আর ব্যবসায়ীদের বেশ কিছু মেসবাড়ি আছে এখানে।
এরকমই এক মেসবাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রবীর দাঁত মাজছিলো, যখন লোকটা এলো। উস্কোখুস্কো চুল, তিন চারদিনের না কামানো দাড়ি মুখে, সাথে একটা মাঝারি মাপের বাক্স। ‘ কাকে চাই?’ প্রবীরের পাশ থেকে প্রশ্নটা অরুণাভ’র। সদ্য সদ্য মর্নিং ওয়াক থেকে ফিরেছে সে।
‘ শুনলাম এখানে একটা বোর্ডারের জায়গা খালি আছে?’ভরাট কিন্তু ভারী বিষণ্ণ গলা। লোকটার সমস্ত মুখে লেপ্টে আছে ভয়, যেন প্রাণপণ কিছু গোপন করছে। কিছু লোককে দেখলেই কেমন যেন লাগে।এ লোকটা তেমনই।
এখনও অফিস খোলেনি। অফিস বলতে এককোণের চিলতে একটা ঘর, যেখানে মেসের মালিক বিজয়বাবু সকাল থেকে সন্ধ্যা বসে খবরের কাগজ পড়েন আর টিভি দেখেন।
‘
আসুন,
আপাতত এখানেই বসুন।’ বারান্দায় একটা চেয়ার এগিয়ে দেয় প্রবাল। এই মেসের সবচেয়ে হুল্লোড়ে লোক। ‘মশায়ের নাম? কোত্থেকে আসা হচ্ছে? চাকরি না ব্যবসা?’
হুড়মুড়িয়ে প্রশ্ন ছোঁড়ে প্রবাল। প্রবীর,
অরুণাভ ছাড়াও বিভাস আর সমরেশও গুটি গুটি তাদের ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে।
‘ শে... সরি বাচ্চু। বাচ্চু বোস। এখানেই একটা ছোটো খাটো কাজ পেয়েছি। কলকাতার কাছে থাকি’
। ইতস্তত গলাতে উত্তর দেয় লোকটা। গলায় অস্বস্তি স্পষ্ট। বলতে বলতে বিজয়বাবু চলে আসেন। ‘ বাচ্চুবাবু? আপনার কথা আমার শালা বললো কলকাতা থেকে। আসুন,
ফর্মালিটিজগুলো করে নিই।’ বাকিরা বোঝে, লোকটার থাকা ঠিক হয়েই রয়েছে। লোকটা আর একটাও কথা না বলে মাথা নিচু করে অফিসের দিকে রওনা দেয়। একটা হাসি পর্যন্ত খরচ করাতেও যেন আপত্তি। ‘ জ্বালাবে!’ অস্ফুট মন্তব্য সমরেশের। তারপর দিন শুরু হয়ে যায় ।
অবশ্য খুব একটা জ্বালায় না বাচ্চু। ভোরবেলা চুপচাপ বেরিয়ে যায়, রাতে ফেরে। সকলের চোখ এড়িয়ে এক কোণে বসে খেয়ে ঘরে ফিরে শুয়ে পড়ে। এমনকি তার ঘরের বাকি দুজন, মানে অসমঞ্জ আর অনির্বাণের সাথেও তার বিশেষ সখ্যতা নেই। যেই আলাপ করতে গেছে, একটা ভদ্রতা মাখা অনতিক্রম্য দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে গেছে। মাঝে মাঝে মোবাইলে চাপা গলায় বারান্দার কোণে কথা বলে, বাকি সময় চুপ।
খটকাটা লাগলো ওই ফোনের বার্তালাপেই। প্রবাল স্পষ্ট শুনলো একদিন বাচ্চু বলছে ‘ পুলিশের ব্যাপারটা মিটেছে তো? আর কতদিন এইভাবে থাকতে হবে কে জানে!’ প্রবীরেরও একদিন খট করে কানে লাগলো ‘ রক্ত না দেখে একদিনও থাকতে পারতামনা
, আর এখানে ভাবো, ভাড়া খাটছি অন্যের হয়ে। কবে যে আবার দুহাতে আমার নামেই রক্ত লাগবে!’
ব্যাপার সন্দেহজনক। বিজয়বাবুর থেকে মোবাইল নম্বর জোগাড় করে একদিন কাছের বুথ থেকে ফোন করেই ফেললো অরুণাভ। ‘ হ্যালো!’ ফিসফিস করে বললো বাচ্চু। তারপর চোস্ত ইংরাজিতে শব্দ ভেসে এলো ‘ হু ইজ দিস?’ । কিন্তু সেইসব শব্দ পেরিয়ে অরুণাভ’র কানে আছড়ে পড়লো পেছনের থেকে আসা এক নারীকন্ঠের আর্তনাদ ‘ ছেড়ে দাওওওওওও,
আমি আর পারছিনা, পায়ে পড়ি, আমায় রেহাই দাও! উফফ , কি যন্ত্রণাআআআআআ..’
অরুণাভ তড়িঘড়ি ফোন নামিয়ে হাঁপাতে থাকে।
সেদিন বাচ্চু ফেরার আগেই মেসে একটা মিটিং বসে। এই সব সমাজবিরোধীরা কখন কি করে বসে ঠিক নেই। তখন সকলকে নিয়েই টানাটানি হবে। অসমঞ্জ আর অনির্বাণ সবচেয়ে সরব, বলা তো যায় না কখন বাচ্চুর ‘ দুহাতে রক্ত’
মাখার ইচ্ছে হয়। অথচ সামনে বলাও চাপের, ওর দলবল যে আছে সেটা ফোনের কথা থেকে বোঝাই যাচ্ছে।
বিভাসের এক জামাইবাবু বদরপুর থানারই হেড কনস্টেবল। তাঁকেই ডেকে আনা হয়েছে। কোনো পুলিশি অভিযোগ নেই, সুতরাং বাচ্চুকে তো আর থানায় তলব করা যায় না!
পরেরদিন অনেকেরই ছুটি, বিহারীদের ছট পরব। বাচ্চুকে কেউ ছুটি নিতে দেখে নি, সুতরাং ওইদিনও সে বেরোবে। জামাইবাবুর পরামর্শ মতো, গোটা মেসই বেরোলো বাচ্চুর সাথেই। বাচ্চুকে সমরেশ স্বতঃপ্রনোদিত হয়েই বলে বসলো, ‘ আজ মেসের পিকনিক, আপনার তো আবার কাজ..’ ।বিনা হাসিতে বাচ্চু মাথা নাড়লো, তারপর হাঁটতে শুরু করলো স্টেশনের দিকে। বাকিরাও গল্পের ভান করতে করতে ওর একটু পেছনেই।
সকলেরই মান্থলি,
সুতরাং টিকিট কাটার ফ্যাঁকড়া নেই। বাচ্চুর পরের কামরাটায় ওরা উঠলো। মুখেচোখে ফুটে বেরোচ্ছে চাপা আতংক, ফলো করছে বুঝতে পারলে আজকে ওদের ফেরা মুশকিল। রোজ রক্ত না মাখলে যার ভাত হজম হতো না, তেমন লোকের পিছু নিয়ে ওরা বোধহয় বোকামিই করছে।
বাচ্চু নামলো শিবানিপুরে। ওই অঞ্চলের সবচেয়ে গমগমে শহর। এদিক ওদিক তাকিয়ে আবার দ্রুত হাঁটা লাগালো সে। একটু তফাত রেখে বাকিরাও, তবে সকালের আত্মবিশ্বাস তলানিতে ঠেকেছে। এই বুঝি একদল গুন্ডা এসে ঠেসে ধরবে, এমন চিন্তা বারবার ফিরে আসছে। হঠাৎ বাচ্চু
একটা বাড়িতে ঢুকে পড়ে। বাকিরা একটু পরেই এসে দেখে,
সেটা একটা নার্সিং হোম।
নার্সিং হোম! তবে কি বাচ্চু কিডনি পাচার করে? সদ্য দেখা ‘ অন্ধাদুন’
প্লট যেন চোখের সামনে। হঠাৎই একটা ময়লা কিশোর এসে ওদের বলে, ‘আপনাদের ডাকছে’।
বাচ্চু! কাছের একটা চায়ের দোকানে। দুরুদুরু বুকে ওরা এগোয়, ধরা পড়ে গেছে। সমরেশ টের পায়, একবার বাথরুম গেলে বেশ হতো। ‘ চা?’ বাচ্চু বলে? ‘ ভাবছেন তো , আমি কি করি? কেন কথা বলি না? এতদূর যখন এসেই পড়েছেন, শুনতে হবে সবটা। তারপর দেখা যাবে।’
শোনে ওরা হাঁ করে। বিখ্যাত স্ত্রীরোগবিশেষজ্ঞ ডাঃ শেখর বোস এক রাজনৈতিক নেতার স্ত্রীর অপারেশন করেছিলেন। নানান কমপ্লিকেশনের পরে রোগিনী মারা যেতেই প্রভাবশালী নেতা তার প্রতিপত্তি খাটাতে দেরী করেননি। একরকম বিনা বিচারেই দুবছরের জন্য তাঁর রেজিস্ট্রেশন নম্বর কেড়ে নেওয়া হয়। ডাক্তারি ছাড়া মানুষটা আর কিছুই করেননি, কিভাবে সংসার চালাবেন তাই নিয়ে অথই জলে তখন। অবশেষে এক বন্ধুর সুবাদে এই নার্সিংহোমে হেড ওটি বয় সেজে দিন গুজরান করেন বাচ্চু ওরফে শেখর বোস।
ওদের বসতে বলে ভেতরে যান বাচ্চু। একটু বাদে ডেকে পাঠান আবার ওদের। কোলে একটি সদ্যজাত। ‘ ওরা রেজিস্ট্রেশন কেড়েছে। জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা নয়। এখানে আর কারো কলকাতা যেতে হয় না।’ বলে, সবাইকে অবাক করে, হো হো করে হেসে ওঠেন বাচ্চু বোস।
খুব সুন্দর। কবিতার মতো দাদা গল্পেও ফাটিয়ে দিচ্ছেন।
ReplyDelete