বড়গল্প-
পীঠস্থানে বীর বাহিনী
বুলেট বাহিনীর বীরত্বের কথা তোমাদের তো আগেই বলেছি।
বুলেটের পুলিশ কাকা বুলেট-বাহিনীকে আগে একটু নিচু
নজরে দেখলেও ন’কড়ি বাবুর চুরির কিনারাতে বুলেট বাহিনীর সেই বিশাল অবদানের পর থেকে
তাদের একটু সমীহই করে চলেন তিনি। এমনকি চুরি-ডাকাতির কিনারা করতে মাঝে মধ্যে তাদের
সাহায্যও নেন। বুলেট-বাহিনী তো গ্রামে একেবারে হিরো হয়ে গেছে।
বুলেট বাহিনীর সব থেকে ক্ষুদে সদস্যা রূপাই গেছে কোপাই নদী পেরিয়ে লাভপুরে।
মাঘী পূর্ণিমায় সেখানে মা ফুল্লরা তলায় বসে বিরাট মেলা। কত রকমের যে জিনিসপত্র
বিক্রী হয় তার ঠিক ঠিকানা নেই। ভালভাল সার্কাস বসে। কত রকমের খাবার-দাবার বিক্রী
হয়- লাভপুরের বিখ্যাত মনোহরা, মণ্ডা খেতে রূপাই খুব ভালবাসে- এগুলো রূপাই বৈঁচীগ্রামে পায় না, মেলায় এসে
রূপাই মেলা খায় এসব। দূর দূর গ্রাম থেকে কত লোকজন আসে মা ফুল্লরা তলায়। মেলা বসে
একটা বিরাট মাঠে। সেই মাঠকে ফুল্লরা মায়ের ডাঙা বলে সবাই। খুব জাগ্রত মা ফুল্লরা।
সতীর একান্ন পীঠের এক পীঠ। রূপায়ের মা রূপাইএর মঙ্গল কামনায় প্রতিবছর আসেন এখানে
এই মাঘী পূর্ণিমায় মা ফুল্লরাকে পুজো দিতে। পুজো দিয়ে এখানেই ভোগ খেয়ে রূপাই মায়ের
সাথে মেলাতে ঘুরতে বেরুল। প্রথমেই সে দেখল সার্কাস। জীবজন্তু নিয়ে সার্কাস দেখানো
এখন প্রায় উঠে গেছে। রূপাইএর মা গল্প করছিলেন কত রকমের জীবজন্তু আগে সার্কাসে তিনি
দেখেছেন। কিন্তু জীবজন্তু কমে যাচ্ছে বলে পশুপাখি নিয়ে খেলা দেখানো এখন প্রায়
নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। তবু নানান রকম কসরৎ আর জোকারদের মজাদার অঙ্গভঙ্গীতে রূপাই খুব
মজা পেতে লাগল। ঘুরতে ঘুরতে অনেক খেলনা আর মণ্ডা-মনোহরা কিনে রূপাইএর মা রূপাইকে
আর খুঁজে পাচ্ছেনা-দুহাতে জিনিস, তাই রূপাই হাত ফসকে কোথায় যে চলে গেল, ভীষণ চঞ্চল
রূপাই, এক মুহূর্ত স্থির থাকে না-ঐ তো পাশের দোকানে রূপাই চলে গেছে- দেখতে পেয়ে
তাড়াতাড়ি রূপাই-এর মা ছুটলেন- হাত ধরে রূপাইকে টানতে লাগলেন-কিন্তু রূপাই কিছুতেই
আসবে না, সে জেদ্ ধরল তাকে একটা মোবাইলের চিপ্ কিনে দিতে হবে। এখানে নাকি মোবাইল,
মোবাইলের চিপ্, ক্যামেরা খুব সস্তায় পাওয়া যাচ্ছে। রূপাই-এর মা তো রেগেই আগুন- “কি
যে জেদ্ ধরিস না, আমাদের সময় বাপু এ সব ছিলনা, তোদের সবেতেই জেদ্, এই সেদিন জেদ
ধরে মোবাইল কিনলি।’’
-“সে তো ক্লাসে ফার্স্ট হয়েছি বলে দাদু কিনে দিয়েছে-কিন্তু
আগের দুই জি.বি. চিপটার মেমরী ফুল হয়ে গেছে। আমাকে চার জি.বি.র
চিপ কিনে দিতেই হবে। দেখ কি সুন্দর সুন্দর বাউল গান লোড করে দিচ্ছে-’’
রূপাইএর জেদের কাছে তার ওর মাকে নতি স্বীকার
করতেই হল- রূপাইএর গানে খুব ঝোঁক, গানগুলো এখান থেকে নিয়ে সে ঠিক তুলে ফেলবে, এইসব
ভেবেচিন্তে রূপাইকে ওর মা একটা চার জি.বি.র মোবাইল চিপ অনেক দরদাম করে মাত্র সত্তর
টাকায় কিনে দিলেন। মহানন্দে রূপাই মনোহরা খেতে খেতে বাড়ি ফিরল,অবশ্য মোবাইলের
চিপটায় দারুণ দারুণ বাউল গানগুলো ভরে নিতে ভুল করল না।
লাভপুর থেকে বৈঁচীগ্রামে দু’দিন বাদেই রূপাইরা ফিরে এল-সঙ্গে সঙ্গেই
বন্ধুদের গান শোনাবে বলে মোবাইলটা নিয়ে দে দৌড়। বুলেট বাহিনী তো গান শুনে মহাখুশি।
কঙ্কা তো নাচতেই লাগল, সে ভাল নাচে। তুফান বলে উঠল,“তা ওখানে গান লোড করলি কি করে?
তোর তো চিপটা এখানেই ফুল হয়ে গিয়েছিল।”
-আরে ওখানে কি সস্তায় সস্তায় চিপ, মোবাইল, এমনকি
ক্যামেরা, ল্যাপটপও পাওয়া যাচ্ছে জানিস।
-তুফান জিজ্ঞেস করল,“তোর চিপটা কত নিয়েছে রে?”
-মোটে সত্তর টাকা-মা অনেক দরদাম করে কিনেছে।
-“হ্যাঁ চিপটা খুব চিপে পেয়েছিস”-তুফানের বলার
ধরণে সবাই হেসে উঠল।
বুলেট জিজ্ঞেস করল,“কত জি.বি.চিপ রে?”
রূপাই সানন্দে বলে উঠল,“চার জি.বি.র চিপ বুলেট
দা।”
বুলেট বলল,“কই দেখি?”
মোবাইল খুলে চিপটা উল্টেপাল্টে দেখে বলল,“মনে
হচ্ছে সেকেন্ড হ্যান্ড মানে পুরনো। কোন কভার ছিলনা নিশ্চয়?”
-না তা ছিল না, ঢেলে বিক্রী হচ্ছিল এত এত চিপ।
তা হোক বুলেটদা সস্তা কিনা বল?
-আর কি কি বিক্রী হচ্ছে বললি রূপাই? ক্যামেরা,
ল্যাপটপ আর কি যেন?
-ঘড়ি, মোবাইল কত কি।
বুলেট ভ্রূ কুঁচকে চিন্তা করতে লাগল। বুলেট ভ্রূ
কোঁচকালেই বুলেট-বাহিনী চুপ করে যায়, তারা বোঝে বুলেট ঠিক রহস্যের গন্ধ পেয়েছে।
ইদানিং কাকুমনি বলছিল যে খুব মোবাইল, ঘড়ি, ক্যামেরা চুরি বেড়ে গেছে-এগুলো চোরাই
মাল নিশ্চয়-তা না হলে এত সস্তায় দিতে পারে? হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে সে বাহিনীর সবাইকে
বলল,“চল কাকুমনির কাছে যেতে হবে, ঐ মেলার ক্যামেরা,মোবাইল ঐ সমস্ত জিনিসই চোরাই
মাল।”
-‘সে কি’-সবাই সমস্বরে বলে উঠল।
-হ্যাঁ, নতুন হলে প্যাকেট থাকত আর এত সস্তায়
দিতেও পারত না। এক্ষুনি চল, কাকুমনিকে গিয়ে বলি সব কথা।
বুলেট-বাহিনী চলল সেই বুলেটের পুলিশ কাকুর কাছে।
-সব শুনে কাকু বললেন,“একদম দেরি করা যাবেনা,কাল
সকালেই আমরা পুলিশ নিয়ে ঐ মেলায় গিয়ে হাজির হব।তোরাও যাবি আমার সঙ্গে।’’
বুলেট-বাহিনীর আনন্দ তো ধরে না-সবাই মিলে যাওয়ার
আনন্দই আলাদা-পথে পেটপুরে শক্তিগড়ের নোড়ার মত বড় বড় ল্যাংচা আর বর্ধমানের মিহিদানা
সীতাভোগ উপভোগ করতে করতে ওরা পৌঁছে গেল সেই মেলায়।
কিন্তু মেলায় যখন জিপ ঢুকল তখন কোথায় চিপের দোকান-সেখানে তো চপ বিক্রী
হচ্ছে। মোবাইল,ক্যামেরা,ল্যাপটপ এসব কিছুই নেই।
পুলিশ কাকু বললেন,‘কই রে রূপাই,তোর মোবাইলের
দোকান কই, সত্যি দেখেছিলি না কি স্বপ্ন?’
বুলেট বলল,“কাকুমনি এভাবে পুলিশের জিপ নিয়ে চোর
খোঁজা যাবে না। তোমরা ফিরে যাও। আমরা থেকে যাই। ওরা তোমাদের আসার খবর পেয়ে গেছে।
আমরা পাঁচজন থেকে যাই।”
টুকুন বলে উঠল,“কাকুমনি তোমরা যদি আমাদের কোন
ফোন পাও তো সাধারণ পোশাকে এসো, আর পুলিশের জিপে এসোনা-ওরা সবাই সতর্ক হয়ে গেছে।’’
কাকুমনি বললেন,“হ্যাঁ সব জায়গায় ওদের চর ছড়িয়ে
আছে। কিন্তু তোরা কোথায় থাকবি?’’
“আমার মামারবাড়িতে ওরা থাকবে কাকুমনি,’’রূপাই
বলে ওঠে।
“চল তোদের পৌঁছে দিয়ে আমি ফিরব,তবে ওরা খুব
ডেঞ্জারেস হয়,খুব সাবধান,বুলেট,বেশি ওস্তাদি করতে যাবিনা,কিছু সন্দেহ হলেই আমায়
ফোন করবি।’’কাকুমনি ওদের সাবধান করে দিলেন বারেবারে।
রূপাইরা মামারবাড়ি যেতেই দিদিমা ছুটে এলেন-“একি রে রূপাই তুই হঠাৎ?কোন বিপদ
হয়নি তো?’’
-“না,দিদা, এই বন্ধুদের নিয়ে এলাম মেলা
দেখাতে,রূপাই আসল কথা বেমালুম চেপে গেল।
রূপাইএর দাদু ও দিদা দুজনে থাকেন,রূপাইএর মামা
কলকাতায় ফ্ল্যাট কিনে সেখানে থাকেন। দাদুকে দেখাশোনা করার জন্যে রাতদিনের একটা আয়া
থাকে। একা একা দিদা হাঁপিয়ে ওঠেন,তাই বুলেট-বাহিনীকে পেয়ে মহানন্দে তিনি লুচি
ভাজতে বসে গেলেন। কতরকমের নাড়ু যে দিদার স্টকে থাকে তার হিসেব নেই।
মুড়ির,চিঁড়ের,তিলের,ছোলার,নারকেলের,সিঁড়ির নাড়ু আর লুচি দিয়ে দারুণ খাওয়াদাওয়া হল।
দুপুরেও প্রচুর খেয়েদেয়ে ওরা মেলা আবার ঘুরতে গেল। না, দুপুরেও সেই মোবাইলের
দোকানটায় জিলিপি,চপ এসব ভাজছে।–বিকেলেও কিছু ওরা দেখল না। সন্ধ্যেবেলা সার্কাস আর
পুতুলনাচ দেখে বুলেট-বাহিনী রূপাইএর মামারবাড়ি চলে এল। খুব টায়ার্ড তারা। গরম গরম
খিচুড়ী,পায়েস,বেগুনী খেয়ে ওরা তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ল। সারাদিন খুব ধকল গেছে,তাই সঙ্গে
সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল সবাই। মাঝরাতে বুলেটের বাথরুমে যাওয়ার প্রয়োজন হল। দিদিমা বলে
দিয়েছিলেন কোন প্রয়োজন হলে আয়ামাসিকে ডাকতে। আয়ামাসির সঙ্গে বুলেট নিচে
নামল-অ্যাটাচড্ বাথরুম এখানে নেই। হঠাৎ বুলেট দেখল সববাড়িই অন্ধকার,কিন্তু পাশের
মাটির দোতলাতে আলো জ্বলছে। বীরভূমের কাঁকুড়ে লালমাটি খুব শক্ত-তাই এই মাটি দিয়ে
দোতলাও তোলা যায়। আয়ামাসিকে জিজ্ঞেস করে বুলেট জানতে পারল যে ওখানে জনা ছয়েক ছেলে
থাকে-সারাতই আলো জ্বালিয়ে রাখে-দিনের বেলা ওরা থাকেনা-রাত্রে এসে জোটে-খুব মদ
খায়-আর মাঝে মধ্যে বচসাও হয়। আয়ামাসির বয়স বেশি নয়-তাই খুব ভয় খায় ছেলেগুলোকে।
গায়ে পড়ে আয়ামাসির সঙ্গে আলাপ জমাবার চেষ্টা করে। ওদের মধ্যে একটা ছেলে খোঁড়া-ওটাই
ওদের নেতা আয়ামাসির মনে হয়। ওর নাম ল্যাংড়া কেতো। আয়ামাসির সঙ্গে বাথরুম সেরে উপরে
উঠে বুলেট আবার শুয়ে পড়ল। কিন্তু ঐ ঘরের ভেতরটা না দেখতে পাওয়া পর্যন্ত বুলেটের
শান্তি হচ্ছে না। রূপাইকে ডেকে তুলে তাকে ঐ ঘরের কথাটা বলে দুজনে বেরিয়ে পড়ল নিশীথ
অভিযানে। পাঁচিল টপকে দুজনে ঐ বাড়িটায় পৌঁছে গেল। কিন্তু দোতলায় উঠবে কি করে?
ঠাণ্ডাও পড়েছে বেশ। দরজা-জানলা সব বন্ধ। দোতলার কাছ ঘেঁসে একটা আমগাছের ডাল এসে
পড়েছে। বুলেট রূপাইকে পাহাড়ায় রেখে কাঠবেড়ালির মত গাছে উঠে পড়ল। দোতলার বারান্দায়
নেমে চোখ রাখল দরজার ফুটোতে-দেখল বেশ কিছু সুটকেস,বাক্স রয়েছে-একটা বাক্সতে
মোবাইল,আর একটাতে ক্যামেরা,ঘড়ি এসব রয়েছে। কত ল্যাপটপ,এমনকি গয়নাও রয়েছে। তবে ওদের
মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে বচসা চলছে মনে হচ্ছে। তার মানে পাততাড়ি গুটিয়ে ওরা
পালাবার ধান্ধা করছে। সঙ্গে সঙ্গেই বুলেট ঘরে এসে কাকুমনিকে ফোন করল। কাকুমনি
পরদিন খুব ভোরে এসে হাজির হলেন আর বামালশুদ্ধু চোরেরা ধরা পড়ল। কিন্তু সবাইকে
পাওয়া গেল না। তবে টুকুনের কথামত পুলিশ সাধারণ পোশাকে থাকাতে বাড়ির বাইরে বাকি
তিনটের দুটো ধরা পড়ল। তুফান তুফান বেগে ছুটে আর একটা চোরকে ধরে ফেলল। এ সেই
ল্যাংড়া এটা। এভাবে ছটা চোরকেই বুলেট-বাহিনীর সহায়তায় পুলিশ ধরে ফেলল। মিলল
অগুন্তি মোবাইল,একশ চারটি ক্যামেরা,ল্যাপটপ কুড়িটি,ঘড়ি বাহাত্তরটি-মোবাইলের চিপের
তো পাহাড় হয়ে গেছে। গয়নাগাটিগুলোও উদ্ধার হল। চোরেদের লাভপুর থানায় জমা করে কাকুমনির
সঙ্গে বুলেট-বাহিনী রূপাইএর দলের কীর্তিকলাপ দেখে দাদু-দিদিমা তো হতবাক্।
দাদু বললেন,“এখানে খুব চুরি-ছিনতাই বেড়ে
গিয়েছিল-আশেপাশের গ্রামগুলোতেও খুব মোবাইল,ল্যাপটপ এসব চুরি যাচ্ছিল-শুধু ব্যাগ বা
পকেট থেকেই এগুলো খোয়া যাচ্ছিল না-জানলা খোলা রেখে রাত্রে ঘুমোলেই কিভাবে ওরা ঠিক
জানলা দিয়ে এগুলো ছিনতাই করে নেয়। পুলিশকাকু বললেন,“মাসিমা,বাচ্ছাদের যেমন
পড়াশোনার স্কুল আছে,তেমনি চোর-ডাকাতেরও শেখবার জন্যে স্কুল আছে,সেখানে রীতিমত
হাতে-কলমে শেখানো হয় চুরির বিভিন্ন পদ্ধতি।”দিদিমা বললেন,“ওমা,সে কি কথা।’’
“কিন্তু মাসিমা আপনারা ছিলেন বলেই বুলেট-বাহিনীর সহযোগিতায় আমরা বামালশুদ্ধু চোর
ধরতে পারলাম।”-অনেক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে,বুলেট-বাহিনীকে নিয়ে পুলিশকাকু
বৈঁচীগ্রামে ফিরে এলেন। গ্রামবাসী তো সবশুনে বুলেট-বাহিনীর জয়গান গাইতে লাগল।
দারুণ। ছোটরাও ভীষণ মজা পাবে।
ReplyDelete